সুন্দরবনের গহীনে
এ্যাডভোকেট জারজিস আহমাদ
২০০৫ সাল। দেশের অন্যতম
শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ মতিহারের সবুজ চত্বরে সগর্বে মাথা উঁচু করে থাকা রাজশাহী
বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবী বিভাগে ভর্তি হয়েছি। জ্ঞানের সর্বোচ্চ স্তরে এসে
হঠাৎই যেন নতুন নতুন অভিজ্ঞতার সাথে সাথে দৃষ্টিভঙ্গির প্রসারতাও অনুভূত
হতে লাগল। বাড়তে থাকল নানা অঙ্গনে অবাধ বিচরণ। আর সেই সূত্রেই দেশের সীমানা
পেরিয়ে বিদেশের মাটিতে শিক্ষাসফর সম্পর্কে ধারণা পেলাম। মাস্টার্সে ভর্তি
হয়েই বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের বড়ভাইদেরকে শিক্ষাসফরে বিদেশভ্রমণের
প্রস্ত্ততি নিতে দেখে আমাদের মনেও ব্যাগ্রতা সৃষ্টি হত যে, আমরা কখন
মাস্টার্সে পড়ার সুযোগ পাব আর কখন সেই বিদেশভ্রমণের অভীপ্সিত মাহেন্দ্রক্ষণ
আসবে। অতঃপর চোখের পলকে জীবনের ৫টি মূল্যবান বছর অতিক্রম করে অনার্স
পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলাম এবং ২০১০ সালে মাস্টার্সে ভর্তি হলাম। ক্লাস শেষ
হবার কিছুদিন পূর্বে ডিপার্টমেন্টের পক্ষ থেকে আসল সেই কাংখিত ঘোষণা।
স্যারদের উৎসাহ আর আমাদের স্বতঃস্ফূর্ত আগ্রহের যোগসূত্রে আরবী বিভাগের
ইতিহাসে প্রথমবারের মত আমরাই দেশের বাইরে শিক্ষাসফরের সূচনা করলাম।
শিক্ষাসফরের স্থান নির্ধারিত হয় ভারত, নেপাল ও ভুটান। শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষক
ড. সেতাউর রহমানের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও পরিশ্রমে সহজেই পাসপোর্ট ও ভিসা
সংক্রান্ত যাবতীয় জটিলতা সেরে কাংখিত সফরের দিন-তারিখ ধার্য করা হল- ১৭ই মে
২০১১ ইং, মঙ্গলবার। অবশ্য ভিসা জটিলতায় পরে নেপাল ভ্রমণের সিদ্ধান্ত
স্থগিত করতে হয়। এই সফরে আমাদের সফরসঙ্গী ছিলেন আরবী বিভাগের প্রবীণ
প্রফেসর একেএম শামসুল আলম স্যার এবং স্বপরিবারে জনাব ড. মুহাম্মাদ সেতাউর
রহমান স্যার।
যাত্রা শুরু : ১৭ই মে ১১ মঙ্গলবার ফজর ছালাতান্তে ভোর ৬-টায় রাজশাহী বাস টার্মিনাল থেকে অনিক ট্রাভেলস যোগে আমরা রওয়ানা দিলাম। অতঃপর বেলা প্রায় ১০.৩০টা নাগাদ রংপুর টার্মিনালে পৌঁছে গেলাম। সেখানে সকালের নাস্তা সেরে পূর্ব থেকে অপেক্ষমাণ মাইক্রোতে চড়ে সীমান্তবর্তী যেলা লালমনিরহাটের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। অতঃপর তিস্তা ব্যারেজ পেরিয়ে পাটগ্রামে পৌঁছে আমাদের স্যারের এক বন্ধুর বাসায় দুপুরের খাবার খেয়ে বুড়ীমারী বর্ডারের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেই।
সীমান্ত পেরিয়ে শিলিগুড়ি : বাংলাদেশের বুড়ীমারী নদীর ওপারে ভারতের চ্যাংরাবান্ধা সীমান্তে পাসপোর্ট সংক্রান্ত যাবতীয় ঝামেলা সেরে একটি ইন্ডিয়ান মাইক্রোতে চড়ে পড়ন্ত বিকালের গোধূলি এবং সান্ধ্যলালিমার মায়াময় সান্নিধ্যে থেকে কখনো জনাকীর্ণ প্রান্তর আবার কখনো বা উন্মুক্ত ফসলের মাঠ পেরিয়ে রাত ৯.৩০ নাগাদ পৌঁছে গেলাম বিখ্যাত শিলিগুড়ি শহরে। সেখানে ‘তাজমহল’ নামক হোটেলে রাত্রিযাপনের ব্যবস্থা হল। পরদিন ফজর ছালাতান্তে শিলিগুড়ি রেলওয়ে জংশনসহ পার্শ্ববর্তী পর্যটন কেন্দ্রসমূহ পরিদর্শনে গেলাম। হঠাৎ দেখি পশ্চিম দিগন্তে ঘনকালো মেঘ বিশাল এলাকা জুড়ে আকাশের সাথে মিশে একাকার হয়ে আছে। মনে হচ্ছিল এখুনি এক পশলা বৃষ্টি নামবে। পরক্ষণেই বুঝতে পারলাম এ কোন মেঘের আস্তরণ নয়; বরং আমাদের সফরের সবচেয়ে দর্শনীয় স্থান, ভয়ানক সৌন্দর্যের অপরূপ রাণী দার্জিলিং পাহাড়। মনে নানা কৌতূহল জাগতে লাগলো, আমরা কি আদৌ এই বিশাল উঁচু পাহাড়ের চূঁড়ায় উঠতে পারবে? সেই পাহাড়ের চূঁড়ায় অবস্থিত মোবাইল টাওয়ার ও কারেন্টের খুঁটিগুলো সমতল থেকে ছোট্ট ও চিকন কলমের মত দেখাচ্ছে। ভাবতে ভাবতে ইতিমধ্যে আমাদের কয়েকজন বন্ধু ও সেতাউর রহমান স্যার ভ্রমণ প্যাকেজ ঠিক করে ফেলেছেন।
দার্জিলিং-এর পথে : কিছুক্ষণ বাদেই বেলা ১১-টার দিকে দুপুরের হালকা খাবার নিয়ে মাইক্রো যোগে আমরা রওয়ানা দিলাম দার্জিলিং-এর চূড়া ছোঁয়ার প্রত্যাশায়। রাস্তার দু’পার্শ্বে দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ, সবুজ-শ্যামল বনরাজি, ফুটন্ত ফুলের ঘন ঝোপ-ঝাড় আর গাছ-গাছালী, ফাঁকে ফাঁকে নয়নাভিরাম চা বাগানকে সঙ্গী করে গাড়ী ছুটে চলল অবিরাম। একটু পরেই শুরু হল ছোট-খাট, উচুঁ-নীচু টিলা ও পাহাড়ের অপরূপ সৌন্দর্য আর কমলা গাছের মনমাতানো দৃশ্য। রুদ্ধশ্বাসে এসব দৃশ্য উপভোগ করতে থাকলাম। আর গাড়ী কখনো পাহাড়ের গা ঘেঁষে আবার কখনো বা দুই পাহাড়ের গিরিপথ ভেদ করে সাপের মত পেচানো আর সমুদ্রের ন্যায় ঢেউ খেলানো উঁচু-নীচু পীচঢালা কালো রাস্তার উপর ছুটে চলা অব্যাহত রাখল। মহান আল্লাহর অপরূপ সৃষ্টিকর্ম আমাদের ঈমানী তেজকে যেন উত্তুঙ্গে পৌঁছে দিল আর মনের মাঝে সুরের ভুবন সৃষ্টি করল। ইতিমধ্যে দীর্ঘ দুই ঘণ্টার পথ চলতে চলতে আমরা ‘মীরিখ’ নামক এক পাহাড়ী শহরে পৌঁছে গেলাম। চতুর্দিকে পাহাড় বেষ্টিত একটি উন্নত শহর হল এই মীরিখ। এ শহরে রয়েছে উন্নতমানের পোষাক-সামগ্রীর মার্কেট, কাঁচামালের দোকানপাট, রেস্টুরেন্ট, পর্যটনস্থল, নিত্যপ্রয়োজনীয় রকমারী দ্রব্য ইত্যাদির ব্যাপক সমারোহ। শহরের পাশ দিয়ে এবং পাহাড়ের গা ঘেঁষে অনেক দূরে বয়ে গেছে ছোট একটি নদী। দুই পাহাড়ের মানুষের যোগাযোগের সুব্যবস্থা ও পর্যটকদের যাতায়াতের সুবিধার জন্য রয়েছে আধুনিক স্টাইলে নির্মিত বেশ কয়টি পুল/ব্রিজ। মীরিখের সমতলভূমি ছাড়াও চতুর্দিকের পাহাড় কেটে কেটে ৫/৬ তলাবিশিষ্ট সুন্দর সুন্দর অসংখ্য অট্টালিকা গড়ে উঠেছে। মনে হচ্ছিল এ কোন সুদক্ষ শিল্পীর আঁকা এক মনোরম চিত্রকর্ম। সেখানকার স্থানীয় লোকজনদের মুখে শোনা গেল যে, অত্র অঞ্চলের গোর্খাল্যান্ডে স্বাধীনতাকামী সৈনিকদের ট্রেনিং দেয়া হয়, যা সমতল থেকে প্রায় ৮৭০০ ফুট উঁচুতে অবস্থিত। বেলা প্রায় তিনটার দিকে মাইক্রো আমাদের নিয়ে পাহাড়ের আঁকা-বাঁকা পথ বেয়ে আবার ছুটে চলল গন্তব্যস্থল দার্জিলিং-এর দিকে। হঠাৎ শীতের আমেজে আমাদের শরীর শীতল হয়ে আসতে লাগল এবং যার যা শীতের পোষাক ছিল তা পরিধান করে নিল। এভাবে ঘণ্টাখানেক পথ চলার পর আমাদের সামনে ছোট একটি বাজার পড়ল এবং সেখানে যানজট পরিলক্ষিত হল। জানতে পারলাম স্থানটির নাম পশুপাথী (এটি মূলত নেপাল সীমান্তবর্তী ভারতের একটি শহর)। একটু সামনে অগ্রসর হয়ে দুটি রাস্তা দেখলাম। যার একটি গেছে বাম দিকে অন্যটি ডান দিকে। বাম দিকের রাস্তাটি সোজা নেপালের মধ্যে ঢুকে গেছে। একজন নেপালী বর্ডারগার্ড রাস্তা ফাঁকা করে গাড়িগুলিকে পারাপারে সহায়তা করছে। তখন মনে হল যাক! নেপাল ভ্রমণ করতে না পারলেও নেপালের বর্ডার তো দেখতে পেলাম! দুধের সাধ ঘোলে মেটানো আর কি! যানজট ছাড়লে আমাদের গাড়ী আবার ছুটে চলল,পথিমধ্যে পাহাড়ী স্কুল-কলেজ পড়ুয়া অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রী হাত নেড়ে নেড়ে আমাদেরকে স্বাগত জানাচ্ছিল, পাহাড়ের গা বেয়ে ধীরলয়ে আমরা এতটাই উপরে উঠতে থাকলাম যে, নীচে রেখে আসা পাহাড়ের গা ঘেঁষে গড়ে উঠা উঁচু উঁচু দালান-কোঠাগুলিকে ভাগাড়ে নিক্ষিপ্ত ময়লা-আবর্জনার কাগজ আর পলিথিনের মত ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র দেখাচ্ছিল।
নীল আকাশের সাদা মেঘের ভেলা তখন আমাদের থেকে অনেক অনেক নীচে পাহাড়ের গাছ-গাছালির উপর দিয়ে কখনও বা পাহাড়ের গায়ের উপর ভেসে বেড়াচ্ছিল। এ দৃশ্য দেখে আমাদের সেতাউর স্যারের মেয়ে ছোট্ট সোনামণি নাহাল তাহসিন বলে উঠল, ‘‘আববু! আমরা যখন আরো উপরে উঠে মেঘের ভিতর দিয়ে চলব তখন আমি হাত দিয়ে মেঘ ধরে ধরে তোমাদের সবার মুখে মাখিয়ে দিব।’’ তার কথা শুনে প্রফেসর শামসুল আলম স্যার তাকে ঠাট্টা করে বললেন, তুমি তো সবার ছোট, পাহাড়ে উঠতে পারবে না। নাছোড়বান্দা নাহলা ঠিকই জবাব দিল, ‘আচ্ছা আববু, দাদুতো সবার বড় আর বুড়ো মানুষ; দাদুই তো পাহাড়ে উঠতে পারবে না। আমরা দাদুকে নীচে রেখে সবাই পাহাড়ে উঠবো।’ ছোট্ট তাহসীন ও সবার মুরুববী প্রফেসর আলম স্যারের মাঝে এমন মধুর খুনসুটি পুরো সফরে আমাদের মাতিয়ে রাখতে প্রেরণাদায়ী রসদ যুগিয়েছিল। যাহোক বিকাল প্রায় সোয়া পাঁচটার দিকে সুখিয়া নামক শহর পার হয়ে দার্জিলিং-এ পৌঁছে গেলাম।
দার্জিলিং শহর : দার্জিলিংয়ের চারপাশ ঘিরে শুধু মেঘের মেলা। এ যেন এক মেঘপর্বত। পর্বতের গায়ে বেড়ে উঠেছে নানা প্রজাতির গাছ-গাছালী এবং গড়ে ওঠেছে হাজার হাজার ঘর-বাড়ি। আমাপ্যাকেজের মাধ্যমে পূর্বনির্ধারিত হোটেল ‘এভারেষ্ট গ্লোরিষ্ট হোটেল’-এর পরিচালক ও হোটেল বয়রা সঙ্গে সঙ্গে আমাদেরকে অভ্যর্থনা জানাল এবং লাগেজসমূহ নিয়ে নির্ধারিত তলায় পৌঁছে দিল। আমরা ফ্রেশ হয়ে ছালাত ও নাস্তা সেরে শহরের দিকে বেড়াতে বের হলাম। হঠাৎ দেখি পাহাড়ের চারিদিকে গাছ-গাছালী এবং ঘর বাড়িগুলি নক্ষত্রের মত জ্বলজ্বল করছে আর জোনাকি পোকার মত মিটিমিটি করে আলো ফুটছে। সন্ধ্যার পর বিদ্যুতের আলো সমগ্র পাহাড়টিকে এক অপরূপ শোভায় কারুকার্যখচিত করে তুলেছে। পাহাড় কেটে কেটে গড়ে উঠা হাজার হাজার বাড়ি-ঘর আর প্রাকৃতিক দৃশ্যগুলি যেন সুদক্ষ শিল্পীর তুলিতে আঁকা ছবির মত দেখাচ্ছিল। শত শত দেশী-বিদেশী পোশাকসামগ্রী আর নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির দোকান-পাট, আর ৮/১০ তলা বিশিষ্ট আবাসিক হোটেলে ভরপুর শহরটি কেবল পর্যটকদের জন্যই নির্মিত মনে হল। পাহাড়ী শহর হলেও এখানে গ্যাস, মোবাইল, টেলিফোন টাওয়ার ইত্যাদি নাগরিক সুবিধাদি অত্যাধুনিক। শহর ঘুরে ফিরে এসে এক হোটেল বয়ের কাছ থেকে জানা গেল, এখানকার ৯৫ শতাংশ লোক শিক্ষিত। এমনকি সে নিজেই ম্যানেজমেন্ট ডিগ্রী অর্জন করে এই এভারেষ্ট গ্লোরিস্ট হোটেলে প্রাকটিস করেছে। পরদিন ভোরে সূর্যোদয় দেখার জন্য ‘টাইগার হিল’ যাওয়ার নিয়তে রাতের খাবার সেরে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লাম। ভোর প্রায় ৪-টার দিকে হোটেলবয় আমাদেরকে জাগিয়ে দিলেন। আমরা প্রস্তুতি নেব ঠিক এমন সময় চতুর্দিক থেকে ভেসে আসা ফজরের আযানের সুমধুর ধ্বনি আমাদেরকে বিমোহিত করল। শত শত ফুট উচ্চতায় উঠে এমন এক বিধর্মী পাহাড়ী শহরে যে ফজরের আযান প্রতিধ্বনিত হবে তা কখনো কল্পনাই করিনি। সাথে সাথে আমরা আল্লাহর প্রশংসায় আলহামদুলিল্লাহ পাঠ করলাম।
টাইগার হিল : ফজরের ছালাত আদায় করে টাইগার হিলে সূর্যোদয়ের দৃশ্য দেখার জন্য একটি দ্রুতগামী মাইক্রোতে আরোহন করলাম। গাড়ী আমাদের নিয়ে ভোরের নীরব আলো-অাঁধারী আর মৃদু-মন্দ বাতাসের মধ্য দিয়ে ছুটে চলল। সূর্যোদয়ের পূর্বক্ষণে ভোরের আকাশ কিছুটা ফর্সা হতে না হতেই দেখলাম নীল আকাশের শুভ্র মেঘের ভেলা যেন বরফখন্ডের মত জমাট বেঁধে পাহাড়ের গা ঘেঁষে গাছ-গাছালীর কোলে নোঙর করে আছে। এসব দৃশ্য দেখতে দেখতে অল্প সময়ের মধ্যেই আমরা পৌঁছে গেলাম টাইগার হিলে। হিমালয় আর কাঞ্চনঝঙ্গার চূড়ায় সূর্যোদ্বয়ের অপরূপ আলোক ঝলকানীর মূহূর্তটি উপভোগ করার জন্য টাইগার হিলে তখন শতশত গাড়ী আর হাজার হাজার মানুষের সমাগম। সবকিছুই প্রস্ত্তত। কিন্তু দুর্ভাগ্য! কুয়াশাচ্ছন্ন আবহাওয়া আর হালকা মেঘাচ্ছন্ন আকাশের কারণে সে দৃশ্য ভালভাবে উপভোগ করতে পারলাম না। তবে খুব কাছ থেকে হিমালয় পর্বত দেখার অভিজ্ঞতা হল।
ঘুম মন্দির ও বাতসিয়া ইকোপার্ক : তারপর সেখান থেকে আরো কয়েকটি দর্শনীয় স্থান পরিদর্শনের জন্য ছুটে চললাম। কিছু পথ অগ্রসর হতেই রাস্তার বাম দিকে দেখলাম ‘ঘুম মন্দির’ নামক বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের এক বিরাট বড় মঠ। এই মঠের নির্মাণকাল সম্পর্কে কোন তথ্য সেখানে নেই। তবে স্থানীয়দের বক্তব্য যুগ যুগ থেকে তারা এভাবেই গির্জাটিকে দেখে আসছে। কর্তৃপক্ষ মন্দিরটিকে সবসময়ের জন্য ফুলের গাছ আর কাগজের তৈরী ফুল আর কৃত্রিম কারুকার্যে সুসজ্জিত করে রেখেছে। মন্দিরের প্রবেশপথের ডান দিকে বিশাল বড় এক ঘণ্টা রয়েছে। ভিতরে সমস্ত ঘর জুড়ে ছাদ থেকে মাটি পর্যন্ত এক বিশাল বুদ্ধ মূর্তি। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা মূর্তিটির সামনে মাথা নত করছে এবং পাপ মোচনের আশায় স্ব-স্ব হস্তে ঐ ঘণ্টাটিকে সবসময় ঘুরাচ্ছে আর মাঝে মধ্যেই সেটি টুংটুং করে বেজে উঠছে। মন্দির পরিদর্শন শেষে আমরা ‘বাতসিয়া ইকো পার্কের’ উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। ছোট একটি ব্রিজ পেরিয়ে পাহাড়ের চূড়ায় আধুনিক স্টাইলে নির্মিত ও সুন্দর ফুলবাগান বেষ্টিত এ পার্কটি থেকে বাইনোকুলারের মাধ্যমে পার্শ্ববর্তী তিনটি দেশ তথা চীন, নেপাল ও ভুটান খুব ভালভাবে দেখা যাচ্ছিল। সেখান থেকে আমরা ‘রকগার্ডেন’-এর দিকে যাত্রা করলাম।
রক গার্ডেন : টাইগার হিল পেরিয়ে নাম না জানা আরো কয়েকটি বিরাট উঁচু উঁচু পাহাড় হতে সাপের মত পেচানো সরু-চিকন রাস্তা বেয়ে বেয়ে আমাদের মাইক্রোবাস নামতে লাগল। বহু উপর থেকে অপর পাহাড়ের দিকে তাকালে মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল সাদা সরু ফিতার মত কি যেন একটা পাহাড়ের উপর থেকে ধাপে ধাপে নীচে নেমে গেছে। কৌতূহলী হয়ে উঠলাম কি হতে পারে ওটা? অবশেষে আমরা যখন নীচে নেমে আসলাম, তখন দেখলাম এটিই সেই পাহাড় বেয়ে নেমে আসা ঝরনার পতনস্থল। যাকে একটি পর্যটন স্পটে পরিণত করে নাম দেয়া হয়েছে ‘রকগার্ডেন’। একদিকে আল্লাহর অপরূপ সৃষ্টি অবিরল ধারায় প্রবাহিত ঝরনা, অপরদিকে নানান কিসিমের পাহাড়ী ফুল ও বাগ-বাগিচা গার্ডেনটিকে আরো বেশী শোভামন্ডিত মনোহরী করেছে। আমরা ঝরনার উৎসমুখের খোঁজে পাহাড়ের গা বেয়ে উঠতে থাকলাম। কিন্তু অনেক উপরে উঠেও তার নাগাল পেলাম না। সেখান থেকে নামার সময় হঠাৎ চোখে পড়ল গুহা সদৃশ একটি ভয়ঙ্কর স্থান। হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা পাহাড় কেটে গুহা সদৃশ এ স্থানটিকে তাদের উপসানালয়ে পরিণত করে নানা মূর্তি স্থাপন করেছে। রক গার্ডেনের পাশ দিয়ে হেঁটে কিছুদুর গেলেই নেপালের সীমান্তবর্তী পাহাড়ী এলাকা। এরপর আমরা টি গার্ডেন-এর দিকে ছুটে চললাম। সেখানে পৌঁছে দেখলাম পাহাড়ের সুবিস্তৃত এলাকা জুড়ে শুধু চা বাগান আর চা বাগান। একদিকে পাহাড়ের উপর স্তরে স্তরে লাগানো নানা প্রকার চা গাছ, অপরদিকে বাগান ঘেঁষে ভাসমান সাদা মেঘের লুকোচুরি টি গার্ডেনটিকে এক অপরূপ সাজে সজ্জিত করেছে। সবকিছু পরিদর্শন শেষে সারাদিনের ভ্রমণক্লান্তি নিয়ে আমরা আবার ফিরে আসলাম আমাদের থিতুস্থল হোটেল এভারেস্ট গ্লোরিস্টে।
লাভা : পরদিন সকালের নাস্তা সেরে রওয়ানা হলাম ‘লাভা’ পাহাড়ের উদ্দেশ্যে। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে, কিছুদূর যেতেই পথে এক জায়গায় প্রায় দুই ঘণ্টা ট্রাফিক জ্যামে আটকে পড়ায় আমাদেরকে পথ পরিবর্তন করে অন্য পথে যেতে হল। ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ী পথ অতিক্রম করতে করতে হঠাৎ এমন এক স্থানে পৌঁছলাম যেখান থেকে আমরা ‘সিকিম’ ও ‘গ্যাংটক’ পাহাড়ের আংশিক দৃশ্য দেখতে পেলাম। সেখান থেকে নামতে নামতে তিনটি পাহাড়ের পাদদেশ দিয়ে বয়ে চলা তিস্তা ও রঙ্গীত নদীর মোহনায় পৌঁছে সেখানকার প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী ক্যামেরাবন্দী করে আবার যাত্রা করলাম। বেশ কয়েকটি পাহাড় অতিক্রম করে বেলা ৩টার দিকে আমরা পৌঁছে গেলাম ‘‘লাগ’’ শহরে। বিকালে শহরটির বিভিন্ন স্থান পরিদর্শন করে পরদিন সবচাইতে মনোরম ও আকর্ষণ প্রাকৃতিক দৃশ্যে ভরপুর ‘বিশপ’ পাহাড় দেখতে গেলাম। ‘বিশপ’ পাহাড়ে পৌঁছে দেখলাম সত্যিই আল্লাহ স্থানটিকে যেন এক অপরূপ সাজে সজ্জিত করেছেন। পাহাড়টির যত উপরে উঠা যায় ততই দেখা যায় যে, শুভ্র সুন্দর মেঘমালা ঘর-বাড়ী ও গাছ-পালার গা বেয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। উপরে উঠতে উঠতে হঠাৎ এক স্থানে দেখি পুকুরপাড়ে ইঁদুরের গর্ত থেকে মাটি পড়ার মত পাথর পড়ছে। পাহাড়ী গাছ-গাছালী আর মাটির সুড়ঙ্গের ফাঁক দিয়ে ছোট-বড় পাথর অবিরত পড়তেই আছে এবং জীবিকা নির্বাহের তাগিদে এক শ্রেণীর মানুষ সেগুলো কুড়িয়ে নিচ্ছে। দিনটি শুক্রবার হওয়ায় জুম‘আর সময়ের পূর্বেই আমরা লাভায় ফিরে আসলাম। কিন্তু দার্জিলিংয়ের মত এখানে কোন মসজিদ না থাকায় হোটেল কর্তৃপক্ষের পরামর্শে একটি বড় রুমে আমরা জুম‘আর খুৎবা ও ছালাত আদায়ের জন্য প্রস্ত্ততি নিলাম। আযান শেষে প্রফেসর শামসুল আলম স্যার ‘পাহাড় ও পর্বতমালা পৃথিবীর জন্য পেরেক রূপে সৃষ্টি’-এ বিষয়ের উপর এক হৃদয়গ্রাহী খুৎবা প্রদান করলেন। মসজিদবিহীন এই দুর্গম লাভা পাহাড়ের ইতিহাসে জুম‘আর ছালাত আদায়ের ঘটনা হয়তোবা এটিই প্রথম বলে আমাদের ধারণা। যেন নতুন ইতিহাসের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন।
লোলেগা : বিকালে অপর একটি মাইক্রোবাসযোগে নিঃসীম নীলিমা ভেসে বেড়ানো মেঘের ভেলা আর পাহাড়ী বনভূমির মিলনস্থল লোলেগা (Lolegaon)-র উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। লোলেগা যাওয়ার রাস্তাগুলি এমনই উঁচু-নীচু ছিল যে, নিম্নগামী হওয়ার সময় ভ্রাইভার গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করে শুধু নিয়ন্ত্রণ রক্ষা করছিল। পথিমধ্যে স্থানে স্থানে পাহাড়ী গরু-ছাগলের পালকে ভীড় জমিয়ে লতা-পাতা খেতে দেখা গেল। অবশেষে লোলেগা পৌঁছে গাড়ী থেকে নামতেই পায়ে জোঁক লাগলো। হালকা বৃষ্টিতেই এখানে জোঁকের উপদ্রব দেখা যায়। পাহাড়ের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে সেই শ্বেত-শুভ্র মেঘ অবারিত ভেসে বেড়াচ্ছে, আর আমরাও সেই মেঘের ভিতর দিয়ে মনের আনন্দে চলাফেরা করছিলাম। মনে হচ্ছিল যেন আমরা আকাশের সাথে মিশে গেছি। ঘুরতে ঘুরতে গভীর জঙ্গলে গিয়ে এক ঝুলন্ত ব্রিজ দেখলাম। অত্যন্ত কষ্ট করে সেই ব্রিজে আরোহন করলাম। আবার সেখান থেকে নেমে গাড়ীর নিকটে পৌঁছতেই তাহসীন তারস্বরে বলে উঠে ‘আম্মু! আম্মু! তোমার পায়ে জোঁক!’ ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে ওর বাবা জোঁক খুঁজলেন কিন্তু পেলেন না। তখন তিনি এমন ভয় দেখানোর জন্য মেয়েকে বকা দিতে গেলে তাহসীন যথারীতি নাটুকে ভঙ্গিতে বলে উঠল, ‘যে যে জিনিসের ভয় করে তাকে সেটাই গিফ্ট করতে হয়’। অবশেষে ‘কাফির’ নামক এক গ্রামীণ হাট সদৃশ্য মার্কেট ও পার্শ্ববর্তী এলাকা পরিদর্শন শেষে লোলেগা ফিরে আসলাম।
ভুটান : পরদিন সকালে জয়েগা ও ভুটানের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম। পাহাড়ী ভূখন্ড দার্জিলিং লাগ আর লোলেগার পাদদেশ দিয়ে হাজার হাজার একর বাগানের মধ্য দিয়ে বয়ে চলা পিচঢালা পথ ধরে প্রথমে আমরা জয়েগা পৌঁছে গেলাম। সময় স্বল্পতার কারণে গাড়ী থেকেই জয়েগার প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করে ‘ভুটান’ সীমান্তের বিশাল গেটের নিকট উপস্থিত হলাম। গেট দিয়ে গাড়ীতে একসঙ্গে ৮ জনের বেশী প্রবেশ করার নিয়ম না থাকায় কয়েকজন বন্ধুকে হোটেলে আসতে বলে আমরা ভুটানের ভিতরে ডুকে পড়লাম। বিশ্ব মানচিত্রের ইতিহাসে ভুটান অতি ক্ষুদ্র ভূখন্ড হলেও চতুর্দিকে পাহাড়-পর্বত বেষ্টিত ও স্বায়ত্তশাসিত একটি সুপরিচিত রাষ্ট্র। ভারতীয় নাগরিকত্ব থাকলেই এখানে অনায়াসে চলাফেরা করা যায়। কোন পাসর্পোট, ভিসার প্রয়োজন হয় না। এখানকার শহরগুলি অত্যন্ত পরিস্কার-পরিছন্ন। রাস্তা-ঘাটগুলি যানজট ও জনকোলাহল মুক্ত। বিল্ডিংগুলো প্রাচীন স্টাইলের হলেও আধুনিক সাজে-সজ্জিত। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি নির্ধারিত ইউনিফর্ম ও কঠোর নিয়ম-কানুনের ভিত্তিতে পরিচলিত। মার্কেটগুলোতে দেশীয় ও ভারতীয় উভয় মুদ্রা উভয়ই প্রচলিত। শহরের বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন শেষে আমরা আবার ইন্ডিয়ায় ফেরৎ আসলাম এবং কলকাতা যাত্রার উদ্দেশ্যে শিলিগুড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম।
কলকাতা : ২১ শে মে আমরা রওয়ানা দিলাম কলকাতার উদ্দেশ্যে। নিউ জলপাইগুলি জংশন থেকে রাত ৯-টার ‘কাঞ্চনঝঙ্গা’ ট্রেনে চড়ে রাতের মৃদু-মন্দ বাতাস, ঝিঝি পোকার সুরেলা ঐক্যতান, ফসলে ভরপুর বিশাল বিস্তীর্ণ প্রান্তর, ফারাক্কা ব্রীজ ইত্যাদির সঙ্গী হয়ে দীর্ঘ রাত অতিক্রম করলাম এবং সকাল ৮-টার দিকে পৌঁছে গেলাম ‘হাওড়া’ রেলওয়ে জংশনে। অতঃপর সেখান থেকে কলকাতা শহর। স্থানীয় এক হোটেলে উঠে বিকালে শহরের বিভিন্ন স্থান, ফিস মিউজিয়াম, চিড়িয়াখানা, ভিক্টোরিয়াল মেমোরিয়াল পার্ক, ন্যাশনাল লাইব্রেরী, কলকাতার ঐতিহ্যবাহী ঘোড়ার গাড়ী ইত্যাদি পরিদর্শন শেষে পাতাল ট্রেনে চড়ে হোটেলে ফিরে আসলাম। পরদিন কলকাতা ইউনিভার্সিটি, কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা ও প্রেসিডেন্সি কলেজের বিভিন্ন অনুষদ, ভবন ও ডিপার্টমেন্ট পরিদর্শন শেষে ট্রামে (দুই বগিবিশিষ্ট বিদ্যুৎ চালিত ট্রেন যা সড়ক পথে নির্মিত রেল লাইনের উপর দিয়ে বাস মাইক্রো ট্যাক্সি ইত্যাদির সাথে একই পথে চলাচল করে) চড়ে ফিরে আসলাম।
ক্লান্ত মুসাফিরের নীড়ে প্রত্যাবর্তন : সেদিনই রাত ৮-টায় আবার ‘কাঞ্চনঝঙ্গা’ ট্রেন যোগে ফিরতি যাত্রা করে পরদিন সকালে নিউ জলপাইগুড়ি এসে পৌঁছলাম। অতঃপর সেখান থেকে মাইক্রোতে করে চন্দ্রাবান্ধা বর্ডারে আসলাম। এখানে পাসপোর্ট ও ভিসার কাজ সেরে বাংলাবান্ধায় এসে মাইক্রোতে চড়ে কিছুদূর আসতেই হঠাৎ ছোট-খাটো একটা এক্সিডেন্টে মাইক্রোটির এক কোণা উল্টে গেল তবে আমাদের কার কোন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। পরে আরেক মাইক্রোতে সৈয়দপুর এসে তিতুমীর এক্সপ্রেস ট্রেনযোগে রাজশাহী ফিরে আসলাম বহু অভিজ্ঞতার ভারে নুব্জ হয়ে।
আব্দুর রশীদ
লেখক : কেন্দ্রীয় সহ-পরিচালক, সোনামণি