একটি সিগন্যাল ও আমার আমি
অলি আহমাদ
তাওহীদের ডাক ডেস্ক 688 বার পঠিত
১৯৭৬
সাল। সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত স্বাধীন বাংলাদেশের যুবসমাজ তখন উদ্ভ্রান্ত,
কিংকর্তব্যবিমূঢ়। আমরা এলাকার কতিপয় যুবক এই অবস্থায় ঈমান-আক্বীদা রক্ষার
উদ্দেশ্যে একত্রিত হলাম নন্দলালপুর আহলেহাদীছ মসজিদে। দীর্ঘ আলোচনার পর
আলহাজ্জ মুস্তাকীম হোসেন সাহেবকে সভাপতি করে একটি যুব সংগঠনের বীজ বপন করা
হয়। যার নামকরণ করা হয় ‘নন্দলালপুর আহলেহাদীছ যুব পরিষদ’। এই সংগঠনের
উল্লেখযোগ্য সদস্যদের মধ্যে ছিলেন ডাঃ মকিলউদ্দিন বিশ্বাস, ছানাউল্লাহ,
আবুল কালাম আজাদ, আব্দুল বাকী, আবুল কাসেম, নিযামুদ্দীন, আব্দুর রশীদসহ
আমরা অনেকেই। আমাদের একটি লাইব্রেরী ছিল। সাড়ে তিনশতের অধিক বই ছিল এখানে।
বইগুলো সংগ্রহ করা হয়েছিল বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আহলেহাদীছ আলেমগণের ব্যক্তিগত
পাঠাগার থেকে এবং ‘আরাফাত’ পত্রিকার অফিস লাইব্রেরী থেকে। আমরা প্রতিদিন
বাদ আছর পাঠাগারে জমায়েত হতাম এবং নিয়মিত বই পড়তাম। আমাদের প্রধান কাজ ছিল
সমাজ থেকে শিরক ও বিদ‘আত দূর করা। এভাবেই এগিয়ে চলছিল আমাদের কার্যক্রম।
ঠিক এমন এক মুহূর্তে ১৯৮০ সালে ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ’-এর পক্ষ হতে
মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব স্বাক্ষরিত প্রথম বার্ষিক কনফারেন্সের একটি
দাওয়াতপত্র পেয়ে আমি নিজে এবং আবুল কালাম (বর্তমান কুষ্টিয়া পূর্ব সাংগঠনিক
জেলা আন্দোলনের সভাপতি) ঢাকা গমন করি এবং আমাদের বর্তমান অবস্থান, সংগঠনের
কার্যনির্বাহী পরিষদের যাবতীয় নথিপত্র মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিবকে
দেখান হয়। তিনি আমাদের কার্যকলাপ দেখে সন্তোষ প্রকাশ করেন এবং আমাদেরকে
যুবসংঘের অর্ন্তভুক্ত করে নেন। এইভাবে আমরা যুবসংঘের সাথে জড়িয়ে পড়লাম।
কিন্তু সাংসারিক ব্যস্ততার কারণে আমরা সংগঠন থেকে বেশ কিছুটা পিছিয়ে পড়ি।
১৯৯০-এর শেষের দিকে মরহুম আবুল কালাম আযাদ (প্রাক্তন সভাপতি, রাজবাড়ী
জেলা)-এর সাথে সংশ্লিষ্ট হয়ে পুনরুদ্দমে সংগঠনিক কার্যক্রমের মাঝে
ওতপ্রোতভাবে জড়িত হই। একই সময়ে পাবনা জেলা যুবসংঘের সভাপতি বেলালউদ্দিন
ভাইয়ের সাথেও পরিচিত হই এবং তাঁর সাথে কাজ করতে থাকি। এ সময় আমি ও আমার
সাথীরা বাইসাইকেলে করে পদ্মা নদীর ওপর পাড়ে বন্ধুর মেঠো পথ অতিক্রম করে
পাবনার খয়েরসূতী গিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানাদিতে যোগদান করতাম। এইভাবে কিছুদিন
কাজ করার পর রাজবাড়ী ও কুষ্টিয়া পূর্ব জেলাকে সংযুক্ত করে বেলাল ভাইয়ের
সহযোগিতায় যুবসংঘের কুষ্টিয়া পূর্ব সংগঠনিক জেলা গঠিত হয় ১৯৯১ সালের শেষের
দিকে। যার প্রথম সভাপতি ছিলাম আমি। আমার বয়সসীমা অতিক্রম করায় যুবসংঘের
দায়িত্ব ছেড়ে আন্দোলন-এর সহ-সভাপতি পদে দায়িত্বভার গ্রহণ করি এবং সভাপতি
হিসাবে আমার চাচা আলহাজ্জ মুস্তাকীমকে দায়িত্বভার অর্পণ করা হয়। ১৯৯৫ সালে
রাজবাড়ী-কুষ্টিয়া সড়কের সবেমাত্র কাজ শুরু হয়। সম্পূর্ণ মাটির রাস্তায়
সাইকেলে যাতায়াত বড়ই কষ্টকর ছিল, তবুও আল্লাহর রহমতে স্তিমিত হয়ে যাইনি।
রাজবাড়ী জেলাকে সক্রিয় করতে যা কিছু প্রয়োজন সবই করেছিলাম এবং রাজবাড়ী জেলা
যুবসংঘ কমিটি গঠন করতে সমর্থ হই। এই কমিটির প্রথম সভাপতি ছিলেন আবুল
হাশেম। শুরু হল নতুন উদ্যমে যুবসংঘের সাংগঠনিক কার্যক্রম। নন্দলালপুরকে
ঢেলে সাজালাম আমরা। জুম‘আর জামাতে দুই আযানের নিয়ম দূর করে এক আযান চালু
করা হয় ১৯৯৩/৯৪ সালের জানুয়ারীতে, মুহতারাম আমীরে জামা‘আত ও নায়েবে আমীর
আব্দুছ ছামাদ সালাফী সাহেবের বলিষ্ঠ ভূমিকার মাধ্যমে। যা আজও বিদ্যমান।
ছালাতে জামা‘আতবদ্ধভাবে মুনাজাত, মৃতকে কবরস্থ করার পর মিষ্টান্ন বিতরণ,
চল্লিশা, কুলখানি, খতম পড়া ইত্যাদি বিদ‘আতী রসম-রেওয়াজ বন্ধ করতে সক্ষম
হয়েছি। শবেবরাত উপলক্ষে হালুয়া-রুটি বিতরণ বন্ধ হয়েছে। বন্ধ হয়েছে ঈদুল
ফিতরের দিন সমাজে সমাজে খিঁচুড়ী ভাত বিতরণ। ফালিল্লাহিল হাম্দ।
তাওহীদ ট্রাষ্টের অধীনে নন্দলালপুর আহলেহাদীছ জামে মসজিদ পুনঃসংস্কার করে ২২০০ বর্গফুট বিশিষ্ট বিশাল মসজিদ নির্মাণ করা হয় এবং বিদ‘আতী দলসমূহের কার্যক্রম মসজিদে কঠোরহস্তে বন্ধ করা হয়। সবচাইতে যে কাজটি গুরুত্ববহ তা হল ছালাতের শৃংখলা ফিরিয়ে আনা। এই দীর্ঘ কর্মজীবনে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বিদ‘আতী দলের কর্মীদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছি, গীবত-তোহমতের শিকার হয়েছি। একটি ধর্মীয় দল কিভাবে যে অন্য একটি ধর্মীয় সংগঠনের লাগামহীন সমালোচনা করে যায়, আমি ভেবে পাই না। আমীরে জামা‘আত মিথ্যা মামলায় আটক হওয়ার পর আমরা নানা সমস্যার সম্মুখীন হয়েছি। পুলিশ, গোয়েন্দা বিভাগ, এমনকি স্থানীয়, চৌকিদার, দফাদার পর্যন্ত আমাদের উপর খবরদারি করেছে। নানাভাবে মনোবল ভেঙ্গে দেওয়ার অপকৌশল প্রয়োগ করেছে। ভয় দেখানো হয়েছে, জেএমবি বলে ধরিয়ে দেওয়ার। কিন্তু আলহামদুলিল্লাহ তাদের কোন অপকৌশলই আমাদের বিরুদ্ধে কাজে আসেনি। বরং আমরা ছিলাম নির্ভীক সৈনিক, অটল হিমাদ্রীর মতো। সকলক্ষেত্রে আমরা আল্লাহ পাকের সাহায্যপ্রাপ্ত হয়েছি, কেটে গেছে অমানিশা। আমীরে জামা‘আতকে মুক্ত করার জন্য সম্মেলন, মিছিল-সমাবেশ সব কিছুতেই আমরা কুষ্টিয়াবাসী ছিলাম অগ্রগামী। সেদিনের সেই স্মৃতি চির অম্লান থাকবে। নন্দলালপুর আহলেহাদীছদের একটি অতিপ্রাচীন ঐতিহ্যবাহী গ্রাম। কিন্তু তারপরও মনে হচ্ছে নতুন নেতৃত্ব সেভাবে আসছে না। ফলে আমাদের কার্যক্রমে বেশ ভাটা পড়ে যাচ্ছে। আল্লাহ পাকের কাছে কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করছি, এখানে একজন বলিষ্ঠ নেতৃত্বের জন্য। যেন এই গ্রাম আবার জেগে ওঠে নতুন উদ্যমে। ফিরিয়ে আনতে পারে পুরাতন তাওহীদী ঐতিহ্য। আমীন!!
মোঃ হাশিম উদ্দিন সরকার
সহ-সভাপতি, আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ, কুষ্টিয়া (পূর্ব)।