সাম্প্রতিক মুসলিম বিশ্ব
তাওহীদের ডাক ডেস্ক
তাওহীদের ডাক ডেস্ক 888 বার পঠিত
মু‘আম্মার গাদ্দাফীর রক্তাক্ত বিদায়
লিবিয়ার অবিসংবাদিত নেতা কর্ণেল মু‘আম্মার আল-গাদ্দাফী সাম্রাজ্যবাদী ইহুদী-খৃষ্টানচক্রের সামরিক জোট ‘ন্যাটো’র বিমান হামলায় গত ২০ অক্টোবর শেষ পর্যন্ত নিহতই হলেন। নিজ জন্মশহর সির্ত থেকে ২০ অক্টোবর সকাল সাড়ে ৮-টার দিকে পালানোর চেষ্টা করেন গাদ্দাফী। এ সময় তার গাড়িবহরে বিমান হামলা চালায় ন্যাটো। হামলায় গাদ্দাফির গাড়ি বহরের ১৫টি ট্রাকই ধ্বংস হয় এবং আরোহী ৫০ জন নিহত হন। নিহতদের মধ্যে ছিলেন গাদ্দাফী পুত্র মু‘তাছিম ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী আবূবকর ইউনুস। তবে কয়েকজন সঙ্গীসহ গাদ্দাফী বেঁচে যান। তবে আহতবস্থায় তাকে গ্রেফতার করে বিদ্রোহী এনটিসি সদস্যরা। এসময় তার মাথা ও নাক দিয়ে রক্ত ঝরছিল। এরপর তাকে একটি গাড়ির বনেটের ওপর টেনেহেঁচড়ে তোলা হয়। আবার একইভাবে নামানো হয়। এ সময় একজন তার মাথা বরাবর বন্দুক তাক করে গুলী করলে তিনি নিহত হন। তাঁর লাশ মিসরাতা শহরের এক বাজারে বড় একটি গোশত রাখার হিমঘরে রাখা হয়। ৪ দিন যাবৎ সন্তানসহ তাঁর লাশ প্রদর্শনীর জন্য ফেলে রাখা হয়। অতঃপর লাশে পচন ধরলে পঞ্চম দিনে লোক চক্ষু এড়িয়ে মরুভূমির এক অজ্ঞাত স্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয়। এভাবে ১৯৮৬ সাল থেকে পশ্চিমাদের টার্গেটে থাকা গাদ্দাফীর দীর্ঘ ৪২ বছরের অধিক শাসনের অধ্যায়ের করুণ পরিসমাপ্তি ঘটে।
গাদ্দাফীর শেষ অছিয়তটি ছিল বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। তাঁর লিখিত ওছিয়ত এভাবে পাওয়া গেছে-‘এটি আমার অছিয়ত। আমি মু‘আম্মার বিন মুহাম্মাদ বিন আব্দুস সালাম আল-ক্বাযযাফী এই মর্মে শপথ করছি যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই এবং মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল। তাঁর উপর শান্তি বর্ষিত হৌক! আমি প্রতিজ্ঞা করছি যে, আমি একজন মুসলিম হিসাবে মৃত্যুবরণ করব। যদি আমি নিহত হই, তাহ’লে আমি মুসলিম রীতি অনুযায়ী সমাধিস্থ হতে চাই আমার মৃত্যুকালীন পোষাকে গোসল না করা অবস্থায় (আমার জন্মস্থান) সির্তের পারিবারিক গোরস্থানে। আমি চাই যে, আমার মৃত্যুর পরে আমার পরিবার বিশেষ করে নারী ও শিশুদের প্রতি উত্তম ব্যবহার করা হবে। লিবীয় জনগণ যেন এর ঐক্য, উন্নতি, ইতিহাস এবং তাদের পূর্বপুরুষ ও বীরদের ভাবমূর্তি রক্ষা করে। লিবীয় জনগণের উচিৎ হবে না তাদের স্বাধীন ও সর্বোত্তম ব্যক্তিদের উৎসর্গ সমূহকে বর্জন করা। আমি আমার সমর্থকদের আহবান জানাচ্ছি, লিবিয়ার উপর বিদেশী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আজ, কাল ও সর্বদা প্রতিরোধ যুদ্ধ চালিয়ে যাবার জন্য। বিশ্বের স্বাধীন মানুষেরা জেনে নিক যে, আমরা আমাদের নিজস্ব নিরাপত্তা ও স্থিতিশীল জীবনের জন্য সবকিছু কুরবানী দিতে পারি। আমরা এর বিনিময়ে অনেক কিছুর প্রস্তাব পেয়েছিলাম। কিন্তু আমরা কর্তব্য ও সম্মানের প্রতীক হিসাবে সম্মুখভাগে থেকে মুকাবিলার পথকে বেছে নিয়েছিলাম।. এখুনি যদি আমরা জিততে নাও পারি, তবুও আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য একটি শিক্ষা রেখে যাব যে, জাতিকে রক্ষা করা হ’ল সম্মানজনক কাজ এবং একে বিক্রি করে দেওয়া হ’ল সবচেয়ে বড় বিশ্বাসঘাতকতা। ইতিহাস চিরদিন তাদের স্মরণ করবে, অন্যেরা তোমাদের যেভাবে বলার চেষ্টা করুক না কেন’।
তিউনিশিয়ায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত : আন-নাহযা পার্টির বিজয়
প্রায় ১০ মাস আগে তিউনিসিয়ায় ঘটে যায় তথাকথিত জেসমিন বিপ্লব। বিপ্লবের শেষদিকে অবস্থা বেগতিক দেখে স্বৈরাচারী শাসক যায়নুল আবেদীন বিন আলী জানুয়ারীর ১৪ তারিখ সঊদী আরব পালিয়ে যান। তারপর মাত্র ৯ মাসের মধ্যে গত ২৩ শে অক্টোবন দেশটিতে হয়ে গেল প্রথম সাধারণ নির্বাচন। প্রথম সাংবিধানিক পরিষদ নির্বাচনে আনুষ্ঠানিকভাবে মধ্যপন্থী ইসলামিক দল ‘আন নাহযা’কে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। উক্ত ফলাফলে দেখা যায়, নাহযা ৪১ শতাংশেরও বেশি ভোট পেয়ে মোট ২১৭টি আসনের মধ্যে ৯০টি আসনে জয়ী হয়েছে। দেশের সবচেয়ে বড় ধর্মনিরপেক্ষ দল কংগ্রেস প্রজাতন্ত্র (সিপিআর) ১৪ শতাংশের কাছাকাছি ভোট পেয়ে ৩০টি আসন জিতেছে। আর ১০ শতাংশ ভোটে ২১টি আসন নিয়ে তৃতীয় হয়েছে বামপন্থী ইত্তাকাতোল। আনুষ্ঠানিক ঘোষণার পর আন নাহযার প্রধান রশিদ ঘানুসি বলেন, ‘‘নতুন কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে তিউনিসিয়ার প্রত্যেক নাগরিকের অধিকার রক্ষা করা হবে।’’ নাহযা পার্টির এক মুখপাত্র বলেন, তারা ক্ষমতায় গেলে তিউনিশিয়াকে মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করবে। মাদক নিষিদ্ধ করা হবে না বা বিদেশীদেরকে সী বীচে বিকিনি পরিধান নিষিদ্ধ করা হবে না। ইসলামী ব্যাংকিংকে বাধ্যতামূলক করা হবে না। কেননা তাঁর মতে তিউনিসিয়া সবার দেশ। রশিদ ঘানুসির ভাষায়- ‘..in which the rights of God, the Prophet, women, men, the religious and the non-religious are assured because Tunisia is for everyone’ এখানে আল্লাহ, মুহাম্মাদ (ছাঃ), নারী, পুরুষ ধার্মিক, অধার্মিক নির্বিশেষে সকলের অধিকার নিশ্চিত করা হবে, যেহেতু তিউনিসিয়া সকলের’ (বিবিসি নিউজ, ২৭ অক্টোবর’১১)।
মরক্কোয় ইসলামপন্থী দল পিজেডির জয়লাভ
মরক্কোর সংসদ নির্বাচনে ইসলামপন্থী জাস্টিস এন্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি বা পিজেডি জয়লাভ করেছে। ২৫ নভেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে পিজেডি ১০৭টি আসন পেয়েছে অর্থাৎ মরক্কোর সংসদের ৩৯৫টি আসনের মধ্যে এক চতুর্থাংশ আসনে তারা বিজয়ী হয়েছে। মরক্কোর তিনটি রাজনৈতিক দল মিলে 'সেক্যুলার ফ্রন্ট' নামে জোট গঠন করেছিল। এ ফ্রন্ট নির্বাচনে ১১৭টি আসন পেয়েছে। নির্বাচনে মোট প্রার্থী ছিলেন সাত হাজার। আর যে সব দল সাধারণ নির্বাচনে অংশ নিয়েছে তারা দেশটির রাজতন্ত্র অব্যাহত থাকার বিষয়টি মেনে নিয়েছে। ফলে অন্যান্য দলের সঙ্গে পিজেডি' জোট সরকার গঠন করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।
পিজেডির প্রধান আব্দুল্লাহ বিন কিরানে বলেছেন, গণতন্ত্র ও সুশাসন নিশ্চিত করতে অন্য দলগুলোকে নিয়ে জোট সরকার গঠন করা হবে। পিজেডি ঘোষণা দিয়েছে, তারা ইসলামের কোনো বিধান চাপিয়ে দেবে না। বরং তারা ইসলামী অর্থনীতি অনুসরণ করে দেশকে উন্নয়ন, অধিকতর সমবণ্টন এবং দারিদ্র্য বিমোচনের চেষ্টা করবে। তবে মাদক এবং মহিলাদের পর্দার মত বিষয়গুলোতে তারা কোন মতামত দেবে না, কেননা মরক্কো পর্যটকদের জন্য একটি আকর্ষণীয় স্থান (বিবিসি নিউজ, ২৭ নভেম্বর’১১)। তারা শাসনতান্ত্রিক রাজতন্ত্র মেনে নিয়েছে। এ ব্যবস্থায় বাদশাহ কেবল শাসনতান্ত্রিক প্রধান হবেন। দেশ পরিচালনা করবে পার্লামেন্ট এবং মন্ত্রীসভা।
মিসরে ইসলামপন্থী দলগুলোর একচেটিয়া সাফল্য
মিসরে সংসদ নির্বাচনের প্রথম দফা অনুষ্ঠিত হয়েছে গত ২৮ নভেম্বর। নির্বাচনে মিসরের জনপ্রিয় ইসলামী দল ‘মুসলিম ব্রাদারহুড’ নিয়ন্ত্রিত ‘ফ্রীডম এন্ড জাস্টিস পার্টি’ ৩৭% ভোট পেয়ে নিশ্চিত বিজয়ের পথে চলেছে। সাম্প্রতিক সময়ে গঠিত সালাফী সংগঠন আন-নূর পার্টি ২৪% ভোট পেয়ে ২য় স্থানে রয়েছে। এছাড়া ধর্মনিরপেক্ষ সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি লাভ করেছে ১৩% ভোট। ৬০%-এর বেশী ভোট পাওয়ায় নির্বাচনে ইসলামপন্থী জোট নিশ্চিতভাবেই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে যাচ্ছে। কেননা এখনো পর্যন্ত দেশের যে দুই-তৃতীয়াংশ অঞ্চলে নির্বাচন হয়নি সেসব অঞ্চলের অধিকাংশ ভোটারই ইসলামপন্থী দলগুলোর সমর্থক। আগামী জানুয়ারীতে পরবর্তী দফা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।