ভ্রান্ত আক্বীদা : পর্ব-৫
মুযাফফর বিন মুহসিন
তাওহীদের
৩টি প্রকারের মধ্যে প্রথম প্রকারটি হল তাওহীদে রুবূবিয়াত বা ‘স্রষ্টা
হিসাবে আল্লাহর এককত্ব’। এই দর্শনের ভিত্তি হচ্ছে যে, যখন কিছুই ছিল না তখন
আল্লাহ সকল সৃষ্টিকে অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্ব দেন; সৃষ্টি থেকে অথবা
সৃষ্টির জন্য কোন প্রয়োজন মেটানোর কারণ ব্যতিরেকেই আল্লাহ সৃষ্টিজগৎ
প্রতিপালন করেন। তিনি সমগ্র বিশ্ব ও এর অধিবাসীদের একমাত্র প্রভু এবং তাঁর
সার্বভৌমত্বের কোন প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। আরবী ভাষায় ‘রুবূবিয়াত’ শব্দটির
মূলধাতু হচ্ছে ‘রব’ (প্রতিপালক) যা একই সাথে সৃষ্টি ক্ষমতা এবং প্রতিপালন
উভয় গুণের পরিচয় বহন করে।
এই শ্রেণীবিন্যাস অনুযায়ী আল্লাহই একমাত্র সত্যিকার শক্তি, তিনিই সকল বস্ত্তর চলাফেরা ও পরিবর্তনের ক্ষমতা দিয়েছেন। তিনি যেটুকু ঘটনা ঘটাতে দেন সেটুকু ব্যতীত সৃষ্টিজগতে কিছুই ঘটে না। এই বাস্তবতার স্বীকৃতি স্বরূপ রাসূল মুহাম্মাদ (ছাঃ) প্রায়ই ‘লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ’ (আল্লাহর ইচ্ছা ব্যতীত কোন বিচলন অথবা ক্ষমতা নেই) বলে বিস্ময়সূচক উক্তি করতেন।
কুরআনের বহু আয়াতে রুবূবিয়াত আক্বীদার ভিত্তি পাওয়া যায়। উদাহরণ স্বরূপ-আল্লাহ বলেছেন, ‘আল্লাহ সমস্ত কিছুর স্রষ্টা এবং তিনি সমস্ত কিছুর নিয়ন্তা’ (যুমার ৬২)। ‘প্রকৃতপক্ষে আল্লাহই সৃষ্টি করেছেন তোমাদেরকে এবং তোমরা যা কর তাও’ (ছাফফাত ৯৬)। ‘এবং তুমি যখন নিক্ষেপ করেছিলে তখন তুমি নিক্ষেপ করনি, আল্লাহই করেছিলেন’ (সূরা আনফাল ১৭)। ‘আল্লাহর অনুমতি ব্যতিরেকে কোন বিপদই আপতিত হয় না (সূরা তাগাবুন ১১)।
রাসূল (ছাঃ) এই ধারণার আরও বিশদ ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, ‘সাবধান, যদি সমস্ত মানবজাতি তোমাকে সাহায্য করার জন্য কিছু করতে চায়, তারা শুধু অতটুকুই করতে সক্ষম হবে, যতটুকু আল্লাহ তোমার জন্য আগেই লিখে রেখেছেন। অনুরূপ, যদি সমস্ত মানব জাতি ক্ষতি করার জন্য একত্রিত হয়, তারা শুধু ততটুকুই ক্ষতি করতে সক্ষম হবে যতটুকু আল্লাহ তোমার জন্য আগেই লিখে রেখেছেন (আহমাদ, তিরমিযী, মিশকাত হা/৫৩০২)।
কাজেই মানুষ যা সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্য বলে ধারণা করে তা শুধুমাত্র এই জীবনের পূর্ব নির্ধারিত পরীক্ষার অংশ। আল্লাহ যেভাবে নির্ধারণ করে রেখেছেন সেভাবেই ঘটনাসমূহ সংঘটিত হয়। আল্লাহ কুরআনে উল্লেখ করেছেন, ‘হে মু’মিনগণ! তোমাদের স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততিদের মধ্যে তোমাদের (কিছু) শত্রু রয়েছে; অতএব তাদের সম্পর্কে তোমরা সর্তক থাকো’ (সূরা তাগাবুন ১৪)।
অর্থাৎ মানুষের জীবনের ভাল জিনিসের মধ্যেও আল্লাহর উপর বিশ্বাসের কঠিন পরীক্ষা নিহিত আছে। অনুরূপভাবে জীবনের কঠিন ও ভয়াবহ ঘটনাবলীতেও পরীক্ষা নিহিত রয়েছে; যেমন আয়াতে উল্লেখ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আমি তোমাদেরকে ভয়, ক্ষুধা, মাল ও জানের ক্ষতি ও ফল-ফসল বিনষ্টের মাধ্যমে পরীক্ষা করব। তুমি ধৈর্যশীলগণকে শুভ সংবাদ দাও’ (সূরা বাক্বারা ১৫৫)।
কখনও কখনও জীবনের ঘটনাগুলো উপলব্ধি ও ব্যাখ্যা করা সহজ, যখন কার্যকারণ অনুযায়ী ফলাফল ঘটে। আবার কখনও উপলব্ধি করা কঠিন, যখন আপাতঃদৃষ্টিতে মন্দ কাজের সুফল অথবা ভাল কাজ থেকে খারাপ ফল আসে। আল্লাহ বলেন, সীমিত জ্ঞানের জন্যে এই ধরনের আপাতঃ অনিয়মের পেছনে কি বিজ্ঞতা রয়েছে তা মানুষের প্রত্যক্ষ উপলদ্ধির বাইরে। আল্লাহ বলেন, ‘কিন্তু তোমরা যা পসন্দ কর না সম্ভবতঃ তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর এবং যা পছন্দ কর সম্ভবতঃ তা তোমাদের কাছে অকল্যাণকর’ (সূরা-বাকারা ২১৬)।
মানুষের জীবনে আপাতঃ অকল্যাণকর ঘটনা কখনো শেষ পর্যন্ত কল্যাণকর বলে প্রমাণিত হয় এবং আপাতঃ কল্যাণকর জিনিস যা মানুষ পছন্দ করে তা শেষ পর্যন্ত অকল্যাণকর হয়। জীবনে যে সব সুযোগ আসে তা থেকে পছন্দ করে জীবন গড়ার মধ্যেই মানুষের প্রভাব সীমাবদ্ধ-সুযোগের প্রকৃত ফলাফলের উপর মানুষের কোন ক্ষমতা নেই। অন্য কথায়-‘মানুষ প্রস্তাব করে, স্রষ্টা নিষ্পত্তি করে’। ‘সৌভাগ্য’ এবং ‘দুর্ভাগ্য’ (সবই আল্লাহ প্রদত্ত এবং বিভিন্ন তাবিজ-কবচ ও কুসংস্কার (যেমন-খরগোশের পা, এক বোঁটায় চার পাতা বিশিষ্ট ছোট গাছ, ইচ্ছা পূরণ করার হাড়, ভাগ্যবান সংখ্যা, রাশিচক্র ইত্যাদি) অথবা অশুভ সংকেত (যেমন-১৩ তারিখের শুক্রবার, আয়না ভাঙ্গা, কালো বিড়াল) দ্বারা এসব সংঘটিত হতে পারে না। প্রকৃতপক্ষে যাদু এবং শুভ-অশুভ সংকেতে বিশ্বাস করা শিরক (তাওহীদে রুবূবিয়াত পরিপন্থী) এবং একটি কঠিন গুনাহ। উক্ববা (রাঃ) বলেন যে, ‘একদিন একদল লোক আনুগত্য প্রকাশের জন্য আল্লাহর কাছে আগমন করলে তিনি একজন বাদে অপর নয়জনের শপথ গ্রহণ করলেন। যখন তারা জিজ্ঞাসা করল, কেন তিনি তাদের সঙ্গীর শপথ গ্রহণ করলেন না, তখন তিনি উত্তর দিলেন, ‘যথার্থই, সে মন্ত্রপুত কবচ (এক ধরনের তাবিজ) পরে আছে। যে লোকটি মন্ত্রপুত কবচ পরে ছিল সে তার আলখেল্লার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে কবচটি বের করে ভেঙ্গে ফেলল এবং তারপর শপথ পড়ল। রাসূল (ছাঃ) তখন বললেন, ‘যে কেউ মন্ত্রপুত কবচ পরবে সে শিরক করবে (আহমাদ, হা/১৭৪৫৮, সনদ শক্তিশালী)।
কুরআনকে মন্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা অথবা শয়তানকে সরিয়ে রাখার জন্য অথবা সেŠভাগ্য আনার জন্য তাবিজ হিসাবে কুরআনের আয়াত গলার হারে পরা অথবা থলির মধ্যে রাখার প্রথা এবং পৌত্তলিক প্রথার মধ্যে খুব কমই পার্থক্য বিদ্যমান। রাসূল (ছাঃ) কিংবা তাঁর সাহাবাগণ কোরআনকে এভাবে ব্যবহার করেননি এবং রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘যে কেউ ইসলামের অন্তর্ভুক্ত নয় এমন নতুন কিছু প্রচলন করবে, তা বাতিল বলে গণ্য হবে’ (মুত্তাফাক আলাইহ, মিশকাত হা/১৪০)। এটা সত্যি যে, পবিত্র কুরআনের সূরা নাস এবং ফালাক সূরা দু’টি নির্দিষ্টভাবে জাদুর প্রভাব দূর (অর্থাৎ মন্দ জাদুমন্ত্র দূর) করার জন্য নাযিল হয়েছিল, কিন্তু সঠিক কি পদ্ধতিতে সেগুলি ব্যবহার করতে হবে তা রাসূল (ছাঃ) দেখিয়ে গেছেন। একদা রাসূল (ছাঃ)-এর উপর বাণ মারা হলে তিনি আলী ইবনে আবু তালিবকে এই দু’টি সূরার প্রতিটি আয়াত পড়তে বলেছিলেন এবং তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে নিজের উপর সেগুলি নিজেই পড়তেন। তিনি সূরাগুলি লিখে তাঁর গলায় ঝুলাননি, হাতে অথবা কোমরে বাঁধেননি অথবা তিনি অন্য কাউকে এসব করতে বলেননি।
তাওহীদে রুবূবিয়াতের শিরক :
ক) সম্পৃক্ততার বা অংশীদারিত্বের দ্বারা শিরক :
খ) অস্বীকৃতির দ্বারা শিরক :
তাওহীদুর রুবূবিয়াতের বিরোধী বিষয়টিই হ’ল তাওহীদে রুবূবিয়াতের শিরক। এর দ্বারা বোঝায়-
১. অন্যেরাও আল্লাহর সমকক্ষ অথবা সমকক্ষের কাছাকাছি এবং তার সৃষ্টি কর্তৃত্বের অংশীদার। ইসলাম ছাড়া অন্য সকল ধর্মীয় মতবাদ রুবূবিয়াতে শিরকের এই রূপের অন্তর্গত।
২. স্রষ্টার আদৌ কোন অস্তিত্ব নেই। কিছু কিছু দার্শনিকগণের দর্শন চর্চায় এই ধরনের নাস্তিকতার পরিচয় পাওয়া যায়।
দুইভাবে এই শিরক সংঘটিত হতে পারে-
যে সব বিশ্বাস এই শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত তা হল সৃষ্টিজগতের উপর যে একজন প্রধান স্রষ্টা অথবা সর্বোচ্চ সত্তা বিদ্যমান তা স্বীকৃত, কিন্তু অন্যান্য ক্ষুদ্রতর দেবদেবতা, মানুষ, জ্যোতিষ্কমন্ডলী অথবা পার্থিব সামগ্রী ও তার রাজত্বের সঙ্গে অংশীদারীত্ব করে। এই ধরনের বিশ্বাসকে ধর্মতত্ত্বের বিশেষজ্ঞ এবং দার্শনিকগণ সাধারণভাবে এককত্বের দর্শন (একসৃষ্টার অস্তিত্বে) অথবা বহু ঈশ্বরবাদে (একের বেশী স্রষ্টার) বিশ্বাসী বলে উল্লেখ করে থাকেন। ইসলামী মতে, এই ধরনের সব বিশ্বাসই বহু ঈশ্বরবাদ। এই ধরনের বিকৃত বিশ্বাসের অনেকগুলি স্বর্গীয়ভাবে প্রেরিত ধর্ম পদ্ধতির বিভিন্ন মাত্রার অধঃপতনের প্রতিনিধিত্ব করে, অথচ এই সব বিশ্বাস শুরুতে তাওহীদ ভিত্তিক ছিল। হিন্দু ধর্মের সর্বোচ্চ সত্তা ব্রক্ষাকে অন্তর্যামী, সর্বপরিব্যাপক, অপরিবর্তনীয় এবং চিরন্তন, নৈর্ব্যক্তিক অসীমের নির্যাস হিসাবে কল্পনা করা হয়। তার মধ্য হতে সবকিছুর সূত্রপাত এবং সমাপ্তি। ব্রক্ষ্মা বিশ্বের সৃষ্টিকর্তা যিনি সংরক্ষক দেবতা বিঞ্চু এবং ধ্বংসের দেবতা শিবকে নিয়ে ত্রিত্ব (Trinity) গঠন করে। এভাবে হিন্দু ধর্মে স্রষ্টার গঠনমূলক, ধ্বংসাত্মক ও সংরক্ষণ ক্ষমতা এবং অন্যান্য দেবদেবতার উপর অর্পণকেই রুবূবিয়াতে শিরক প্রকাশ করা হয়ে থাকে।
খৃষ্টীয় ধর্মমতে, পিতা, পুত্র (যিশুখৃস্ট) এবং পবিত্র আত্মা এই তিন জনের মাধ্যমে স্রষ্টা নিজেকে প্রকাশ করে। তথাপি এই তিনজনকে একই বস্তুর অংশীদার হিসাবে একক বলে গণ্য করা হয়। পয়গম্বর যিশুকে দেবত্বে উন্নীত করা হয়েছে যিনি স্রষ্টার ডান হাতে বসেন এবং পৃথিবীর বিচার কার্য পরিচালনা করেন। হিব্রু বাইবেলে স্রষ্টা পবিত্র আত্মার মাধ্যমে তার সৃজনশীল ক্ষমতা প্রয়োগ করেন এবং খৃষ্টীয় মতবাদ হিসাবে তিনি দেবত্বের অংশ। পল (Paul) পবিত্র আত্মাকে (Holy Spirit) খৃষ্টের অভিন্ন হৃদয় বন্ধু, পথ প্রদর্শক খৃস্টানদের সাহায্যকারী হিসাবে ঘোষণা করে এবং পেনিকস্ট (Penecost) এর দিনে পবিত্র আত্মা প্রথম আত্মপ্রকাশ করে। ফলশ্রুতিতে যিশু এবং পবিত্র আত্মা স্রষ্টার সকল পবিত্র আত্মা স্রষ্টা আধিপত্যের অংশীদার যিশু আধিপত্যের অংশীদার, যিশু একই বিশ্বাসের উপর রায় ঘোষণা করেন এবং খৃষ্টানগণ পবিত্র আত্মা দ্বারা সাহায্যপ্রাপ্ত এবং পথপ্রদর্শিত হয়। এই সব খৃষ্টীয় বিশ্বাসের মধ্যমে রুবূবিয়াতে শিরক ঘটে।
পারস্য অগ্নিপূজারীরা (Zoroastrians) তাদের স্রষ্টা ‘আহুরা মাজদা’ সম্বন্ধে এই ধারণা পোষণ করে যে, তিনি যা কিছু ভাল তারই নির্মাতা এবং তিনি একমাত্র প্রকৃত উপাসনার যোগ্য। আহুরা মাজদার সাতটি সৃষ্টির মধ্যে অগ্নি একটি, যাকে তার পুত্র অথবা প্রতিনিধি হিসাবে গণ্য করা হয়। আংগ্রা মাইনু (Angra Mainyu) নামের অপর একজন দেবতা-অন্ধকার যার প্রতীক, তার দ্বারা শয়তানী হিংস্রতা, মৃত্যু সৃষ্টি হয়েছে। এই ধরনের কল্পনার বশবর্তী হয়ে তারা রুবূবিয়াতে শিরক করে।
কাজেই মন্দ গুণাবলী স্রষ্টার উপর আরোপ করার মানসিক ইচ্ছার কারণে পাপী আত্মাকে একজন বিরোধী দেবতার পর্যাযে উন্নীত করে সকল সৃষ্টির উপর স্রষ্টার সার্বভৌমত্ব ক্ষমতার (অর্থাৎ তাঁর রুবূবিয়াতের) অংশীদার করা হয়।
পশ্চিম আফ্রিকায় (প্রধানতঃ নাইজেরিয়া) ইয়োরুবা (Yoruba) ধর্মের অনুসারী এক কোটিরও বেশি লোকদের বিশ্বাস ওলোরিয়াস (Olorius অর্থাৎ স্বর্গের অধিপতি) অথবা ওলোডুমেয়ার (Olodumare) নামে একজন সর্বপ্রধান স্রষ্টা রয়েছে। তা সত্ত্বেও বিপুল সংখ্যক ‘ওরিশা’ (Orisha) উপাসনা দ্বারা আধুনিক ইয়োরুবা ধর্ম চিহ্নিত করা হয়, যার ফলে ইয়োরুবা ধর্ম কট্টর বহু-ঈশ্বরবাদ বলে মনে হয়। কাজেই ছোটখাট দেবতা এবং আত্মাদের উপর স্রষ্টার সকল দায়িত্ব চাপিয়ে দিযে ইয়োরুবা ধর্ম অনুসারীগণ রুবূবিয়াতে শিরক করে।
দক্ষিণ আফ্রিকার জুলু সম্প্রদায় এক স্রষ্টায় বিশ্বাসী, যার নাম আনকুলুনকুলু (Unkulunkulu) অর্থ প্রাচীন সর্বপ্রথম এবং সবচেয়ে সম্মানিত। স্রষ্টার সুনির্দিষ্ট মুখ্য উপাধিগুলো হ’ল এনকোসী ইয়াপজুলু (Nkosi yaphezulu অর্থ আকাশের স্রষ্টা) এবং আমভেলিংকানকী (Umvelingqanqi অর্থ সর্বপ্রথম আবির্ভুত)। তাদের সর্বপ্রধান স্রষ্টাকে একজন পুরুষ হিসাবে গণ্য করা হয়, যিনি পার্থিব মহিলার সাহায্যে মানুষ্যজগৎ সৃষ্টি করে। জুলু ধর্মের মতে, বজ্রপাত এবং বিদ্যুৎ চমকানো স্রষ্টা প্রদত্ত। পক্ষান্তরে অসুস্থতা এবং জীবনের অন্যান্য বিপদ-আপদ ইডলোজী (Idlozi) অথবা আবাপহানসি (abaphansi অর্থ যেগুলি মাটির নীচে) নামের পূর্বপুরুষ কর্তৃক সংঘটিত হয়। এই সব পূর্বপুরুষগণ জীবিতদের নিরাপত্তা বিধান করে খাদ্যের জন্য প্রার্থনা করে এবং আচার-অনুষ্ঠান ও বলিদানে সন্তুষ্ট হয়, অমনোযোগীদের শাস্তি প্রদান করে এবং জ্যোতিষীদের (in-yanga) নিয়ন্ত্রণে রাখে। এভাবে শুধুমাত্র মনুষ্য সৃষ্টি সম্বন্ধে তাদের মতবাদের জন্যই নয়, মানুষের জীবনে ভাল-মন্দ ঘটা তাদের পূর্বপুরুষদের আত্মার কাজ বলে আরোপিত করার কারণেই জুলু ধর্মে রুবূবিয়াতে শিরক সংঘটিত হয়।
কিছু মুসলিমদের মধ্যে রুবূবিয়াতে শিরক এই ধরনের বিশ্বাসে প্রকাশিত হয় যে ওলী-আওলিয়া এবং অন্যান্য বুজুর্গ ব্যক্তিগণের আত্মা, এমনকি তাদের মৃত্যুর পরও জাগতিক ঘটনাবলীতে প্রভাব ফেলতে সক্ষম। এটা বিশ্বাস করা হয় যে, এই সব আত্মা একজনের চাহিদা পূরণ করতে, বিপর্যয় দূর করতে এবং যারাই তাদের স্মরণ করবে তাদেরই সাহায্য করতে সক্ষম। সুতরাং কবরপূজারীগণ এই জীবনের ঘটনাবলী সংঘটিত হবার জন্য মানুষের আত্মার উপর স্বর্গীয় ক্ষমতার উপস্থিতি প্রমাণ করে, যা প্রকৃতপক্ষে একমাত্র আল্লাহই ঘটাতে পারেন।
বহু সূফীদের (মরমীবাদী মুসলিম) মধ্যে সাধারণভাবে এই বিশ্বাস প্রচলিত যে ‘রিজালুল গায়েব’দের[1] মধ্যে যিনি প্রধান তিনি কুতুব নামক স্তরে অধিষ্ঠিত এবং তার দ্বারা এই পৃথিবীর বিষয়াদী নিয়ন্ত্রিত হয়।
বিভিন্ন দর্শন এবং ভাবাদর্শ যেগুলি সুনির্দিষ্টভাবে অথবা ইঙ্গিতে স্রষ্টার অস্তিত্বকে অস্বীকার করে, এই উপশ্রেণীতে তারই আলোচনা হবে। অর্থাৎ কতিপয় ক্ষেত্রে স্রষ্টার অস্তিত্তহীনতার (নাস্তিকতা বা Atheism) ঘোষণা দেওয়া হয়। পক্ষান্তরে কতিপয় ক্ষেত্রে তার অস্তিত্বের দাবী করা হলেও যেভাবে তাকে কল্পনা করা হয়, তাতে প্রকৃতপক্ষে তার অস্তিত্বকে অস্বীকার করা হয় (হতাশাবাদ বা Patheism)।
কিছু প্রাচীন ধর্মীয় তন্ত্র আছে যার মধ্যে স্রষ্টার অস্তিত্ব নেই। এদের মধ্যে অন্যতম হল গৌতম বুদ্ধের প্রচারিত তন্ত্র। খৃষ্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে বর্ণপ্রথার বিরোধিতাকারী একটি সংস্কারমূলক আন্দোলন হিসাবে বৌদ্ধধর্ম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। একই সময়ে জৈন ধর্মের প্রচলন শুরু হয়। খৃষ্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে বৌদ্ধ ধর্ম রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসাবে চালু হয়। অবশেষে এটা হিন্দু ধর্ম কর্তৃক অঙ্গীভূত হয়ে যায় এবং বুদ্ধকে অবতারদের (স্রষ্টার প্রতিমূর্তি) মধ্যে একজন গণ্য করা হয়। ভারতে এই ধর্মের প্রভাব কমে আসলেও চীন এবং অন্যান্য পূর্বের দেশগুলোতে প্রভাবশালী হয়ে পড়ে। গৌতম বুদ্ধের মৃত্যুর পর বৌদ্ধ ধর্মের দু’ধরনের ব্যাখ্যার উৎপত্তি হয়। ঐ দুই ব্যাখ্যার মধ্যে প্রাচীনতর হিনযান (Hinayana) বৌদ্ধ ধর্ম (৪০০-২৫০খৃঃপুঃ) পরিস্কার করে দেয় যে, স্রষ্টা বলে কেউ নেই। সেজন্য ব্যক্তি বিশেষের পরিত্রাণ লাভের দায়িত্ব তার নিজের উপর বর্তায়। এভাবে বেŠদ্ধ ধর্মের প্রাচীন ধারাকে রুবূবিয়াতে শিরকের উদাহরণ হিসাবে শ্রেণীভুক্ত করা যায়, যেখানে স্রষ্টার অস্তিত্ব সুনির্দিষ্টভাবে অস্বীকার করা হয়েছে।
অনুরূপভাবে জৈন ধর্মের শিক্ষক ভারধামানা (Vardhamana) প্রচার করে যে স্রষ্টা বলে কিছুই নেই, তবে মুক্ত আত্মা অমরত্ব এবং অসীম জ্ঞানের মধ্যে দিয়ে স্রষ্টার পদমর্যাদার কিছু অংশ অর্জন করে। ধর্মীয় সমাজ এমনভাবে এসব তথাকথিত মুক্তআত্মাদের সঙ্গে আচরণ করে যেন তারা দেবতাসুলভ, তাদের জন্য মন্দির নির্মাণ করে এবং তাদের মূর্তি পূজা করে।
আরেকটি প্রাচীন উদাহরণ হল পয়গম্বর মূসার সময়কালের ফেরাউন। আল্লাহ কুরআনে উল্লেখ করেছেন যে, ফেরাউন আল্লাহর অস্তিত্বকে অস্বীকার করেছিল এবং মূসা ও মিসরের জনগণের কাছে দাবী করেছিল যে, সে সকল সৃষ্টির একমাত্র সত্যিকার প্রভু। সে মূসাকে বলেছিল বলে আল্লাহ উল্লেখ করেন, ‘‘তুমি যদি আমার পরিবর্তে অন্যকে ইলাহরূপে গ্রহণ কর, তাহলে আমি তোমাকে অবশ্যই কারারুদ্ধ করব’ (শু‘আরা ২৬-২৯) এবং জনগণকে বলেছিল ‘‘আমিই তোমাদের শ্রেষ্ঠ প্রতিপালক’ (নাযি‘আত ২৪)।
ঊনবিংশ এবং বিংশ শতাব্দীতে কিছু সংখ্যক ইউরোপীয় দার্শনিক স্রষ্টার অস্তিত্বহীনতা দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করে যা ‘স্রষ্টার মৃত্যু দর্শন’ (death of God philosophy) নামে পরিচিতি লাভ করে। জার্মান দার্শনিক ফিলিপ মেইনল্যান্ডার (Philpp Mainlander ১৮৪১-১৮৭৬) তাঁর The Philosophy of Redemption ১৮৭৬ (প্রায়শ্চিত্ব করার দর্শন) শীর্ষক বইতে উল্লেখ করেছেন যে, যেহেতু বিশ্বের একাধিকত্বে স্রষ্টার এককত্বের মূল উপাদান ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে এবং পরমানন্দের তত্ত্বকে শাস্তিভোগতত্ত্ব (যা বিশ্বের সর্বত্র বিরাজমান) দিয়ে অস্বীকার করা হয়েছে, সেহেতু স্রষ্টার মৃত্যুর পর বিশ্বের যাত্রা শুরু হয়েছে। প্রুশিয়ার ফ্রেড্রিক নিটশে (Friedrich Nietzsche, 1844 – 1900) ‘স্রষ্টার মৃত্যু’ মতবাদ সমর্থন করে উপস্থাপন করেছিলেন যে, স্রষ্টা মানুষের অস্বস্তিকর বিবেকের অভিক্ষেপ (Projection) ছাড়া আর কিছুই ছিল না এবং মানুষ অতি মানবের (Superman) সঙ্গে সেতুবন্ধন ছিল। বিংশ শতাব্দীতে জাঁ পল সার্তে (Jean Paul Sarte) নামে একজন ফরাসী দার্শনিকও ‘স্রষ্টার মৃত্যু’ চিন্তাধারার প্রতিধ্বনি করেন। তিনি দাবী করেন যে, স্রষ্টা বিদ্যমান থাকতে পারে না। কারণ তিনি পরস্পর বিরোধী শব্দ সম্বলিত একটি উক্তি। তার মতে স্রষ্টা শুধু মানুষের কল্পনার তৈরী নিজস্ব অভিক্ষেপ (Projection)।
মানুষ মহিমাম্বিত বানর ছাড়া কিছুই নয়-ডারউইনের (মৃত-১৮৮২) এই প্রস্তাব সমাজবিজ্ঞানী এবং দার্শনিকগণ কর্তৃক ব্যাপকভাবে গৃহীত হয়েছিল। কারণ এই তত্ত্ব স্রষ্টার অস্তিত্বহীনতার ‘বৈজ্ঞানিক’ ভিত্তি রচনা করে। তাদের মতে, সর্বপ্রাণবাদ (animism) হতে একেশ্বরবাদ ধর্মের সূচনা, স্বতন্ত্র ব্যক্তি হতে মানুষের সামাজিক বিবর্তন এবং বানর হতে দৈহিক বিবর্তনের মাধ্যমে মানুষের উৎপত্তি। কোন কিছুরই অস্তিত্ব ছিল না এবং অস্তিত্বহীনতা (বা শূন্যতা) থেকে মানুষ সৃষ্টি হয়-এই অমূলক দাবীর মাধ্যমেই তারা সৃষ্টি সম্পর্কিত প্রশ্নাবলী এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করে। এভাবেই তারা আল্লাহর আদি এবং অন্তহীনতা মানুষের উপর আরোপ করে। আধুনিককালে এই মতবাদে বিশ্বাসীগণ কার্ল মার্কসের (Karl Marx) অনুসারী সাম্যবাদী ও বৈজ্ঞানিক সমাজতান্ত্রিকগণ। এরা দাবী করে গতিশীল পদার্থই বিদ্যমান সকল বস্তুর উৎস। তারা আরও দাবী করে যে, নির্যাতিত জনগোষ্ঠী যে বাস্তবতার মধ্যে বাস করে তা থেকে তাদের দৃষ্টি অন্য দিকে সরিয়ে নেয়ার জন্য শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক মানুষের কল্পনার স্রষ্টাকে আবিষ্কার করা হয়েছে।
কিছু মুসলমানদের মধ্যে এই ধরনের শিরকের একটা উদাহরণ হল ইবনে আরাবীর মত বহু সূফী যারা দাবী করে যে, একমাত্র আল্লাহই অস্তিত্বমান (সবই আল্লাহ এবং আল্লাহই সব)। তারা আল্লাহর পৃথক অস্তিত্ব অস্বীকার করে প্রকৃতপক্ষে তাঁর অস্তিত্বকেই অস্বীকার করে। সপ্তদশ শতাব্দীতে ওলন্দাজ ইহুীদ দার্শনিক বারুচ স্পিনোজা (Baruch Spinoza) এই ধরনের মতবাদ প্রকাশ করেছিল। তার মতে মানুষসহ বিশ্বের সকল অংশের সমষ্টিই হল স্রষ্টা।
ড. আবু আমীনা বিলাল ফিলিপ্স
অনুবাদ : আবু হেনা