শিশুদের নিরাপত্তাবিধানে ইসলাম

বযলুর রহমান 1217 বার পঠিত

মানুষ সামাজিক জীব। সমাজবদ্ধ জীবন ছাড়া জগত সংসারের গতি নিষ্প্রভ। সমাজ, সভ্যতা ও পরিবেশের সাথে সুসামঞ্জস্য ও নিরবচ্ছিন্নভাবে খাপ খেয়ে চলাই সমাজবদ্ধ জীবনের মৌলিক দাবী। আর সমাজের মূল রূহ হ’ল পরিবার। পরিবার গঠিত হয় মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তা‘আলার অপরূপ সৃষ্টিকৌশলের মাধ্যমে। আর তা হ’ল নিষ্কলংক বিমল পুষ্পের মত ভালবাসাময় পবিত্র দাম্পত্য জীবন। যা একজন পুরুষ ও নারীর বৈধ সম্পর্কের ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যায়ন। একপর্যায়ে তাদের এই বৈধ সামাজিক সম্পর্কের সূত্র ধরে পৃথিবীর আলো বাতাসে আগমন করে নতুন অতিথি। আনন্দের হিল্লোল খেলে যায় পিতা-মাতার হৃদয়ের গভীরে। যেন রাজ্যের সমস্ত আনন্দের বহিঃপ্রকাশ। শুরু হয় সদ্য প্রসূত অতিথিকে ঘিরে নতুন পথের নব যাত্রা। নতুন সাজে সজ্জিত হয় পিতা-মাতার হৃদয়ে জমে থাকা সমস্ত আশা-আকাংখার। স্বপ্ন দেখে হাজারো রকমের। উৎফুল্লতা আর আত্মতৃপ্তির এই সুখকর সংবাদ আত্মপ্রকাশ করে হাস্যজ্জল চেহারায় স্বগৌরবে। তারপর আরম্ভ হয় আরেক যুদ্ধ। সন্তানকে একজন সৎ, আদর্শবান ও সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার। এই যুদ্ধে কেউ বিজয়ীর জয়মাল্য পরিধান করে চির শান্তির নিদ্রায় শায়িত হয়। আবার কেউ পরাজয়ের গ্লানি টানতে টানতে এক সময় মৃত্যু তার উপর জয়লাভ করে। আর এটাই এই জগত সংসারের স্বাভাবিক ঘটনাপ্রবাহ।

শিশুরা মানব সভ্যতার রক্ষাকবচ। ইসলামী জীবন দর্শনে মানব সন্তান তথা মানবশিশু হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলার বিশেষ নে‘য়ামত। পিতা-মাতার চোখ জুড়ানো ধন। মানব প্রজন্মের ভবিষ্যৎ কর্ণধার এবং বিশ্ব মানবতার সমৃদ্ধ জীবনের আশার আলো। সেজন্য শিশুর নিরাপত্তা বিধান, অধিকার প্রদান ও সংরক্ষণে ইসলাম আপোষহীন। ইসলাম মানব শিশুর জন্মের পবিত্রতা, নিরাপত্তা, লালন-পালন, শিক্ষা-প্রশিক্ষণ ও আদর্শ মানবরূপে গড়ে তোলার জন্য বিশেষ তাগিদ দিয়েছে। আর এ ক্ষেত্রে মেধা, মনন, আত্মা ও পরিবেশের সুষ্ঠু প্রশিক্ষণ প্রদান তাদের সুসামঞ্জস্য জীবনের অন্যতম নিদর্শন। এই সুসামঞ্জস্য জীবন গঠনের কারিগর হলেন পিতা-মাতা। একজন মুসলিম পিতা-মাতার অত্যাবশ্যক কর্তব্য হল, সন্তান প্রতিপালনে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব বিশ্বনবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কালজয়ী আদর্শ গ্রহণ করা। তাদের মধ্যে ইসলামী চেতনা ও জ্ঞান সৃষ্টি করা এবং সেই অনুযায়ী জীবন ও সমাজ গড়ে তোলার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করার দৃষ্টিভঙ্গি অন্তর জগতে ঢুকিয়ে দেওয়া। অতঃপর তাদের মধ্যে ইসলামী জীবন দর্শনের বীজ বপন করে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নির্দেশ মোতাবেক তার বিধানাবলী প্রচার-প্রসারের জাযবা তৈরীর মাধ্যমে জীবনকে পত্র-পল্লবে সুশোভিত করার শিক্ষা প্রদান করা। সাথে সাথে মতবাদ বিক্ষুব্ধ পৃথিবীতে নিজের সন্তানকে যাবতীয় কুসংস্কার ও অপসংস্কৃতির বেড়াজাল থেকে মুক্ত করার জন্য সঠিক ও সুনিয়ন্ত্রিত পদ্ধতিতে দক্ষ প্রশিক্ষকের নিকটে ইসলামী তামুদ্দনিক প্রশিক্ষণ প্রদান করা। যাতে করে সে নিয়ন্ত্রিত জীবন-যাপন করতে পারে। পরিশেষে জামা‘আতবদ্ধ জীবন-যাপনের জন্য বিশুদ্ধ ও আদর্শিক সংগঠনে অন্তর্ভুক্ত করে শিশুদের অন্তরে সামাজিক দায়িত্ববোধের সমন্বয় সাধন করা। যা বিরাজমান যাবতীয় অন্যায় কাজ থেকে তাকে বিরত রাখতে সহায়ক হবে। সমাজ সংস্কারের জন্য তার মধ্যে একজন বীরযোদ্ধাস্বরূপ দুর্দমনীয় শক্তি ও সাহসের বীজ রোপিত হবে। এভাবে ভারসাম্যহীন ভোগবাদিতা ও লাগামহীন দুর্নীতির অক্টোপাশ থেকে মুক্ত করে শিশুর সার্বিক জীবনকে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের স্বচ্ছ বারিধারায় সিঞ্চিত করে কলুষযুক্ত জীবনচরণে অভ্যস্ত করাই সন্তানের প্রতি পিতা-মাতার একান্ত দায়িত্ব। যা সঠিকভাবে অনুসরণ, অনুকরণ ও যথাযথ পালনের মাধ্যমে সমাজে অন্যায়-অত্যাচার ও অশান্তির উপাদানগুলো অপসৃত হবে। শান্তির সুখময় পরিবেশ বিরাজ করবে সমাজের আনাচে কানাচে। মানুষ ফেলতে পারবে অফুরন্ত স্বস্তির নিঃশ্বাস। নিম্নে শিশুদের নিরাপত্তা বিধানে ইসলামের ভূমিকা আলোচনা করার প্রয়াস পাব ইনশাআল্লাহ্।

শিশুদের নিরাপত্তা বিধানের গুরুত্ব :

আল্লাহ প্রদত্ত অসংখ্য নে‘য়ামতের মধ্যে সন্তান-সন্ততি একটি বড় নে‘য়ামত। এই নে‘য়ামতের শুকরিয়া আদায় করলে আল্ল­াহ খুশি হন। আর তাদের জন্য পিতা-মাতার দো‘য়া আল্লাহ কবুল করে থাকেন।

পিতা-মাতার নিকট সন্তান-সন্ততি এক অমূল্য সম্পদ। এই অমূল্য সম্পদের সঠিক ব্যবহার করা পিতা-মাতার উপর নৈতিক দায়িত্ব। কেননা একদিকে সন্তান-সন্ততির কার্যক্রম পিতা-মাতার মুখ উজ্জ্বল করে, অন্যদিকে কোন সময় তাদের জন্য ক্ষতিকর বস্ত্ততেও পরিণত হয়। মহান আল্লাহ বলেন, يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تُلْهِكُمْ أَمْوَالُكُمْ وَلَا أَوْلَادُكُمْ عَنْ ذِكْرِ اللَّهِ وَمَنْ يَفْعَلْ ذَلِكَ فَأُولَئِكَ هُمُ الْخَاسِرُونَ. ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি যেন তোমাদেরকে আল্লাহর স্বরণ থেকে ধ্বংস না করে। আর যদি এরূপ হয় তাহ’লে তারা ক্ষতিগ্রস্থদের অন্তর্ভুক্ত হবে’ (মুনাফিকূন ১০৪/৯)।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আরো বলেন যে, عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ إِذَا مَاتَ الإِنْسَانُ انْقَطَعَ عَنْهُ عَمَلُهُ إِلاَّ مِنْ ثَلاَثَةٍ إِلاَّ مِنْ صَدَقَةٍ جَارِيَةٍ أَوْ عِلْمٍ يُنْتَفَعُ بِهِ أَوْ وَلَدٍ صَالِحٍ يَدْعُو لَهُ. ‘আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল­াহ (ছাঃ) বলেছেন, যখন মানুষ মারা যায় তখন তার আমল ও ছাওয়াবের ধারা বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু তিন প্রকার আমলের ছাওয়াব সর্বদা অব্যাহত থাকে। যথা ১. সাদকায়ে জারিয়া ২. এমন ইলম বা জ্ঞান, যা দ্বারা মানুষের কল্যাণ সাধিত হয়। ৩. সুসন্তান, যে তার জন্য (তার মৃত্যুর পর) দো‘আ করে (মুসলিম হা/৪৩১০; আবুদাঊদ হা/২৮৮০; তিরমিযী হা/১৩৭৬)। উপরোক্ত কুরআনের আয়াত ও হাদীছ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, সৎচরিত্রবান, উপকারী সুসন্তান পিতা-মাতার স্থায়ী সম্পদ। যার কোন ক্ষয় নেই, লয় নেই। সন্তানকে চরিত্রবান হিসেবে গড়ে তুলতে পারলে মৃত্যুর পরেও কবরে অবস্থান কালে ছাওয়াব পাওয়া যায়। আবার কর্তব্য পালনে অবহেলার কারণে যদি সন্তান কুসন্তান হয় তাহ’লে সেখানে নিশ্চিত কঠিন শাস্তির সম্মুখিন হতে হবে।

নেতৃত্বশূন্য ও অশান্ত এ পৃথিবীতে নেতৃত্ব সৃষ্টি ও শান্তির স্বর্গরাজ্যে পরিণত করতে শিশুদের সুষ্ঠ বিকাশ ও সঠিক নিরাপত্তা বিধানের গুরুত্ব অপরিসীম। আর তার প্রথম ধাপ হ’ল পরিবার। কেননা পরিবার হ’ল একটি রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রাথমিক কাঠামো। আর পরিবারই একটি শিশুর প্রাথমিক বিদ্যালয়। যেখানে শিক্ষকের ভূমিকায় থাকেন পিতা ও মাতা। শিশুর ব্যক্তিত্ব গঠন ও বিকাশের পথে পরিবার অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। কারণ শিশুর যাবতীয় দৈহিক, মানসিক, বস্ত্তগত ও অবস্ত্তগত প্রয়োজন মিটায় পরিবার। পরিবারেই শিশু তার চিন্তা, মনন, আবেগ ও কর্মের অভ্যাস গঠন করে। মূলতঃ শিশুর চরিত্রের ভিত্তি প্রস্তর রচিত হয় পরিবারেই। সমাজের একজন যোগ্য ও দায়িত্বশীল ব্যক্তিত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে গড়ে তোলার জন্য পরিবারের অবদান সবচেয়ে বেশী। এক্ষেত্রে পরিবার যদি তথাকথিত আধুনিক নষ্ট সভ্যতার পুচ্ছধারী হয়, অপসংস্কৃতির লালনকারী হয়, অবসর সময়কে আড্ডাবাজী, গান-বাজনা, টিভি-সিনেমা ইত্যাদির মাঝে অতিবাহিত করে। তাহ’লে এর ধ্বংসাত্মক প্রভাব একটি শিশুকে প্রভাবিত করে অতি দ্রুত। ফলে তার সামনে স্বচ্ছ আদর্শ বলতে কিছুই অবশিষ্ট থাকেনা। যা বর্তমানে হরহামেশাই ঘটছে।

বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপট নিরেপক্ষভাবে বিশ্লে­ষণ করলে আরও ভয়াবহ দৃশ্য ফুটে উঠবে। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সম্পর্কের ভিন্নতা, পিতা-মাতার মধ্যে সম্পর্কের টানা-পোড়েন, ভাইয়ে-ভাইয়ে দ্বন্দ্ব, ঘুষখোর পিতার অগাধ লোভ ও দুর্নীতির সাথে সম্পৃক্ততা, নেশাগ্রস্ত পিতার উন্মত্ততা, সামাজিক বন্ধনে ফাটল, তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে স্থায়ী পারিবারিক বা সামাজিক দ্বন্দ্ব, ধর্মীয় অনুশীলনের অনুপস্থিতি প্রভৃতি একটি শিশুকে তাড়া করে ফিরছে প্রতিনিয়ত। ফলে অনেক আশা থাকা সত্ত্বেও এ সকল ভয়াবহতা থেকে শিশুকে রক্ষা করতে পারছে না সচেতন (?) অভিভাবকমন্ডলী।

মুসলিম সমাজের চিত্র অবলোকন করলে আরো দৃষ্টিগোচর হয় যে, বিজাতীয় সভ্যতার নোংরা আক্রমণ ছেয়ে ফেলেছে সমগ্র মুসলিম মিল্লাতকে। আধুনিকতার চরম উৎকর্ষ সাধিত হওয়ার সাথে সাথে বাংলার শহর থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত তার হিংস্র ও ধ্বংসাত্মক ঢেউ লেগেছে। ফলে এমন কোন ঝুপড়ি নেই যেখানে টিভি-সিডি নেই। যা গোগ্রাসে গিলছে এদেশের কচি-কাঁচা সোনামণিরা। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ৫-৭ বছরের ছোট্ট বাচ্চাদের হাতেও শোভা পাচ্ছে ভিডিও মোবাইল। যার মাধ্যমে তারা পরিচিত হচ্ছে হাজারো অপসংস্কৃতির সাথে। এজন্য বর্তমানে শিশুদের নিরাপত্তা বিধানের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অন্যান্য যেকোন সময়ের চেয়ে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত। নিম্নে বর্তমান সমাজে শিশুদের ভয়াবহ পরিস্থিতি অনুধাবনের জন্য প্রামাণিক কিছু আলোচনা করার প্রয়াস পাব ইনশাআল্লাহ্।

কেস-স্টাডি

. আড়াই বছরের ছোট্ট মেয়ে। বাবলা গাছের নিচে বসিয়ে রেখে মা গেছে পাশের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করতে। পাশের বাড়ির ধনীর পাষন্ড ছেলে এসে তাকে ফুসলিয়ে নিকটস্থ এক পরিত্যক্ত বাড়িতে নিয়ে তার উপর পাশবিক নির্যাতন চালায়। ছোট্ট মেয়েটি কাঁদতে কাঁদতে এসে ভয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে। ছোট্ট মেয়েটি ভয় ও কান্না জড়িত কন্ঠে বলে, ‘মা! তুমি ঐখানে যেওনা। ঐখানে ভূত আছে। ভূত কামড়িয়ে দিবে। আমাকে কামড়িয়ে দিয়েছে।’ ছোট্ট অবুঝ শিশু। কিছুই বোঝেনা। মা তাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠে। এই নির্যাতিত শিশুর অসহায় গরীব মায়ের গগণবিদারী আর্তনাদ সেদিন আকাশ বাতাস ভারি করে তুলেছিল। এভাবে কত অসহায় মা-বোন এই বাংলার যমীনে পাশবিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে তার হিসাব কে রাখে! (দৈনিক আমার দেশ, মার্চ ২০১০)

. পিতা-মাতা উভয়ে কর্মস্থলে যাওয়ার সময়ে একমাত্র পুত্রকে ঘরে রেখে যান টিভি চালু করে দিয়ে। ফিরে এসে ডাকাডাকি করেও ছেলের সাড়া না পাওয়ায় অবশেষে দরজা ভেঙ্গে ঘরে ঢুকে দেখা গেল কিশোর ছেলেটির লাশ মায়ের উড়না গলায় পেঁচিয়ে ফ্যানের নিচে ঝুলছে। সামনে টিভিতে তখনও ভারতীয় ছবি চলছে। সেখানে দেখানো ফাসির দৃশ্যের অনুকরণ করতে গিয়ে পিতা-মাতার একমাত্র সন্তান হারিয়ে গেল চিরদিনের মত। ঢাকা মহানগরীর এই ঘটনাটি ২০০৮ সালের।

পরিস্থিতির মূল্যায়ন

শিশুরা যেভাবে আক্রান্ত হচ্ছে আধুনিক বিশ্বের তার কিছু চিত্র নিম্নরূপ :

ক. সামাজিক আগ্রাসন : আমেরিকায় টিভির ব্যবহার ও তার প্রভাব বিষয়ক সেদেশের একটি রিপোর্টে জানা যায় যে, সেদেশের ৯৬% পরিবারে অন্তত একটি টিভি সেট রয়েছে। সেদেশে তিন থেকে পাঁচ বছরের শিশুরা সপ্তাহে গড়ে ৫০ ঘন্টা টিভি দেখে। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে উচ্চ বিদ্যালয় পর্যন্ত ছাত্ররা টিভির সামনে বসে পার করে দেয় ২২০০০ ঘন্টারও বেশী সময়। অথচ স্কুলে সময় কাটায় মাত্র ১১০০০ ঘন্টা। টিভিতে অধিকহারে সন্ত্রাস দেখানোর ফলে তারাও সন্ত্রাসী ও বিধ্বংসী হয়ে উঠে (মুহাম্মাদ আসাদুল্ল­াহ আল-গালিব, ছবি ও মূর্তি, পৃষ্ঠা ৭)

মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী গত এপ্রিল মাসে কন্যা-শিশু ধর্ষণের ঘটনা আশংকাজনক হারে বেড়েছে। তাদের প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১০ সালের এপ্রিল মাসে মোট ৬৩ জন নারী এবং কন্যা-শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এদের মধ্যে ২৪ জন নারী ও ৩৯ জন কন্যা-শিশু। এর আগে ১লা জানুয়ারী থেকে ৩১শে মার্চ পর্যন্ত মোট তিন মাসে ৩৯ জন কন্যা-শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। তিন মাসে যা হয়েছে এপ্রিল মাসেই হয়েছে তার অর্ধেক। এপ্রিলে ২৪ জন নারীর মধ্যে ৮ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে এবং ১২ জন গণধর্ষণের শিকার হয়েছে। ৩৯ জন কন্যা-শিশুর মধ্যে ২ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে এবং ১০ জন গণধর্ষণের শিকার হয়েছে (দৈনিক আমার দেশ, মে ২০১০, পৃষ্ঠা ১১)। ‘অধিকার’ অনুসন্ধানে আরো দেখেছে, ২০১০ সালের ১লা জানুয়ারী থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত তিন মাসে ১২২ জন নারী ও কন্যা-শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এদের মধ্যে ৫৩ জন প্রাপ্ত বয়স্কা নারী এবং ৬৯ জন কন্যা-শিশু। ৫৩ জন প্রাপ্ত বয়স্কা নারীর মধ্যে ১১ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে এবং ২৬ জন গণধর্ষণের শিকার হয়েছে। ৬৯ জন কন্যা-শিশুর মধ্যে ধর্ষণের পর ৫ জনকে হত্যা করা হয়েছে এবং ২৪ জন গণধর্ষণের শিকার হয়েছে (প্রাগুক্ত)

এছাড়া দেশময় রাজনৈতিক অস্থিরতা, পাশবিকতার তান্ডব নৃত্য, ক্ষমতাসীন দলের দৌরাত্ম্য, চাঁদাবাজ, সন্ত্রাসী কার্যকলাপ, দূর্নীতির কালোহাত, অপসংস্কৃতির ভয়াল রূপ, জঙ্গীবাদের উত্থান, আধুনিকতার নামে চরিত্র বিধংসী আধুনিক প্রযুক্তির হিংস্র আক্রমণ, রাজনৈতিক দলগুলোর সরকার বিরোধী আন্দোলন, ইসলামের বিরুদ্ধে সরকারী অপতৎপরতা, ধর্মহীন শিক্ষাব্যবস্থা চালুকরণ, অর্থনৈতিক ভারসাম্যহীনতা, সুদভিত্তিক অর্থব্যবস্থার বৈধতা প্রভৃতি চলমান প্রেক্ষাপট জাতিকে ধ্বংসের অগ্নিরাজ্যে পরিণত করেছে। অশান্তির আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে। যেন মৃত্যু হাতছানি দিয়ে ডাকছে।

খ. পেশাগত আগ্রাসন :

অন্যদিকে নিম্নবিত্ত পরিবারের শিশুদের কায়িক শ্রমের বিষয়টি এখন পরিণত হয়েছে ডালভাতে। এক বিভীষিকাময় কর্মক্লান্ত জীবনযাত্রা অতিবাহিত করতে হচ্ছে শিশু শ্রমিকদের। সেখানে তারা ফুলের মত জীবনকে নিঃশেষ করে দেয় অবলীলাক্রমে। জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ)-এর উদ্যোগে ২০১০ সালের জুন মাসে প্রকাশিত ‘শিশু দারিদ্র ও বৈষম্য’-বিষয়ক একটি গবেষণা শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে মোট শিশুর সংখ্যা ৬ কোটি ৩০ লাখ। এদের মধ্যে ৫৬ শতাংশ দারিদ্র সীমার নীচে বাস করছে। যুক্তরাজ্য ভিত্তিক বেসরকারী সংস্থা ‘Save the children’ পরিচালিত অপর এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, বর্তমানে ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী ৭৪ লাখ শিশুই সরাসরি শিশু শ্রমের সংগে জড়িত। তাদের কাজের শতকরা ৯৯ ভাগই কমবেশী ঝুঁকিপুর্ণ। প্রায় ৪০ শতাংশ শিশুরই প্রতিদিন কমপক্ষে ১০ ঘন্টা করে কাজ করতে হয় (ইত্তেফাক, ১৫ই জুন ২০১০, পৃ. ১০)। দু’টি বেসরকারী সংস্থার শিশু জরীপ থেকে জানা যায়, উত্তরাঞ্চলে স্কুলে যায় না এমন শিশুর সংখ্যা চার লাখের উপরে। ৬ বছর থেকে ১০ বছর বয়সী শিশুর মধ্যে ১৫ হাজার শিশু শ্রম বিক্রি করে। ১০ বছর থেকে ১৫ বছর বয়সী শিশুশ্রমিকের সংখ্যা দেড় লাখেরও বেশি। ঝুঁকিপূর্ণ শিশু শ্রম দিচ্ছে ৫০ হাজার থেকে ৫৫ হাজার (ইত্তেফাক, ১৫ই জুন ২০১০; পৃ. ২)। বর্তমান প্রেক্ষাপটে শিশু ও শিশুশ্রমের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। যেখানে শিশুরা অত্যাচার-নির্যাতন, গালিগালাজ, কথিত অলসতার দোহাই দিয়ে লোহার লাকড়ি আগুনে উত্তপ্ত করে জলন্ত লোহার নির্মম আঘাতে জর্জরিত। অসহায় শিশুশ্রমিকরা কষ্টার্জিত শ্রমের টাকা ঠিকমত পায়না। ফলে চিন্তা-চেতনা, বিবেক-বুদ্ধি স্তব্ধ হয়ে তারা অসাড় কর্মহীন প্রাণীতে পরিণত হয়। বর্তমানে দিন যত যাচ্ছে তত দেশে ক্ষুধার্ত শিশু মানবতার আর্তচিৎকারে আকাশ বাতাশ ভারি হয়ে উঠছে। দু’মুঠো খাওয়ার আশায় এদিক ওদিক ফ্যাল ফ্যাল নয়নে তাকিয়ে থাকে যদি কেউ একটু খাবার দেয়! অথচ তাদের দেখার কেউ নেই। ১৭ই আগস্ট ২০০৯ইং তারিখে প্রকাশিত পত্রিকা রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, দেশে না খেয়ে মারা যায় প্রতি মিনিটে ১৫টি শিশু (প্রথম আলো, পৃ. ১০, ক. ৩)। এ প্রসঙ্গে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর ‘আমার কৈফিয়ত’ কবিতায় এই করুণ চিত্রটিই ফুটিয়ে তুলেছেন অত্যন্ত মর্মস্পর্শী ও হৃদয়গ্রাহী ভাষায়-

ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ, চায় দু’টো ভাত একটু নুন

বেলা বয়ে যায়, খায়নি কো’বাছা, কচি পেটে তার জলে আগুন।

কেঁদে ছুটে আসি পাগলের প্রায়

স্বরাজের নেশা কোথা ছুটে যায়!

কেঁদে বলি, ওগো ভগবান! তুমি আজিও আছ কি? কালি ও চুন

কেন ওঠে না কো তাহাদের গালে, যারা খায় এই শিশুর খুন?

গ. লিঙ্গবৈষম্যগত আগ্রাসন :

শিশুদের মধ্যে ছেলে-মেয়ে বৈষম্যটাও অনেক সময় প্রকট হয়ে উঠে। কোথাও দেখা যায়, ছেলে সন্তান যে সুবিধা ভোগ করে, মেয়েরা সে সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়। ছেলেদের প্রতি পিতা-মাতার নজর বেশি থাকে। একই জায়গায় খেতে বসলে ভাল ভাল খাবার ছেলেকে দেওয়া হয়, আর শেষের খারাপ খাবার দেওয়া হয় মেয়েকে। বলা হয় যে, সে কর্মঠ, সে বড় হয়ে ইঞ্জিনিয়ার হবে, ডাক্তার হবে, ব্যারিস্টার হবে ইত্যাদি। আর মেয়ে! সেতো কয়দিন পরেই শশুর বাড়ি চলে যাবে। তাকে এত দেখভাল করার কোন প্রয়োজন নেই। একই পরিবারের একই মায়ের উদরে জন্ম লাভ করা সন্তান যদি এইরূপ বৈষম্যের শিকার হয়, তাহ’লে দেশের সামাজিক অবস্থা যে কত ভয়াবহ তার পরিচয় পরিস্কার উদ্ভাসিত হয়। যেন তারা বৈষম্যের প্রশিক্ষণ কোর্সের নিয়মিত শিক্ষার্থী। এতে করে ঐ ছেলে লোভী ও অহংকারে স্ফীত হয়ে নৈতিকতাহীন পশুতে পরিণত হয়। আর মেয়েরা মানসিক যন্ত্রণা ও বেদনাবেধুর কষ্টকে সহ্য করে নীরবে নির্ভৃতে চোখের পানি ফেলে। ফলশ্রুতিতে তাদের সৌরভময় সুপ্ত প্রতিভার বিকশিত হওয়ার পথ চিরতরে স্তব্ধ হয়ে যায়। বিনষ্ট হয় তার সম্ভাবনাময় জীবনের ভবিষ্যৎ দিনগুলো।

ঘ. সমাজ পরিচালকদের উন্নাসিকতা :

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দেশের ভবিষ্যত সুনাগরিক গড়ে তোলার সর্ববৃহৎ কারিগর। ছাত্র-ছাত্রী উক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রাণ। আর শিক্ষকমন্ডলী হলেন উক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নামক দেহের এক একটি অঙ্গ স্বরূপ। একজন শিশুকে সৎচরিত্রবান ও যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব হিসেবে গড়ে তোলার জন্য শিক্ষকের ভূমিকা অতুলনীয়। তাই একজন শিক্ষককে হতে হবে একদিকে যেমন চরিত্রবান, পরিশ্রমী, সত্যাশ্রয়ী ও অধ্যবসায়ী। অন্যদিকে থাকতে হবে ছাত্রকে পড়ানো ও বুঝানোর যোগ্যতা। কিন্তু চলমান প্রেক্ষাপট তার সম্পূর্ণ বিপরীত। একই শ্রেণীর শিশুরা শুধু মাত্র ধনী-গরীবের পার্থক্যের বিভিন্নতার কারণে অধিকার বঞ্চিত ও অবহেলিত। অন্যদিকে শ্রেণীকক্ষে ছাত্রদের সামনে শিক্ষকের নিশ্চিন্ত ঘুমানো, সিগারেট খাওয়া ও আনতে বলা, অসৌজন্যমূলক আচরণ, পাঠ শেখানোর প্রতি অমনোযোগী ইত্যাদি একজন শিশুর উপর বিরূপ প্রভাব পড়ে। ফলে যেখান থেকে বের হওয়ার কথা এক একটি সংস্কারধর্মী প্রতিভা, ইবনে তাইমিয়া, শাহ ওয়ালিউল্ল­াহ দেহলভী, নাছিরুদ্দীন আলবানীর মত উজ্জ্বল নক্ষত্রস্বরূপ মানব সম্পদ, যাদের প্রস্ফূটিত আলোকরশ্মির তীব্রতায় বিশ্বের বুকে বিকশিত হবে জ্ঞানের প্রদীপ, যাদের সত্যানুসন্ধানের হুংকারে বাতিল শক্তি পরাভূত হবে, কেঁপে উঠবে তাদের মায়া-মরীচিকাময় আধুনিকতার চোরাবালির দুর্বল ভীত; অথচ সেখান থেকে বের হচ্ছে আজ একজন মাস্তান, নেশাগ্রস্ত, সন্ত্রাসী এরশাদ শিকদার, প্রকাশ, বিকাশের মত অপরাধ জগতের মহা খলনায়করা। এর চেয়ে করুণ বাস্তবতা আর কি হতে পারে!

করণীয় :

ক. পিতামাতার নিবিঢ় পরিচর্যা :

ইসলাম পরিবার প্রথা অতি গুরুত্বপূর্ণ, কেননা পরিবারই হল মানুষের সবচেয়ে কার্যকর প্রশিক্ষণকেন্দ্র। একটি শিশুর ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণ ও সুষম বিকাশের জন্য পারিবারিক পরিবেশে এবং সুখ, ভালবাসা ও বোঝাপড়ার আবহে তা বেড়ে উঠা দরকার। এক্ষেত্রে সমাজের মৌলিক একক হিসাবে শিশুদের বিকাশ ও কল্যাণের স্বাভাবিক পঠভূমি হিসাবে পরিবারকে সমাজের সব ধরনের নিরাপত্তা ও সহায়তা দেওয়া উচিত। যাতে সমাজ তার ভূমিকা পুরোপুরি গ্রহণ করতে পারে (জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ, ইউনিসেফ, ১১ পৃঃ)

রাসূলুল্ল­াহ (ছাঃ)-এর বাণী অনুযায়ী পৃথিবীর প্রত্যেক শিশু-কিশোর ফিতরাত অর্থাৎ-স্বভাবজাত ধর্মের উপর জন্মগ্রহণ করে। পিতা-মাতাই তাকে ইহুদী-খ্রীষ্টান ও অগ্নিপূজক বানায় (মুত্তাফাক্ব আলাইহ. মিশকাত হা/৯০)। আর মানুষের স্বভাবজাত ধর্ম হ’ল ইসলাম। আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণ করে সে দুনিয়ায় এসে আল্লাহকে ভুলে যায় পিতা-মাতার কারণে। কারণ পিতার জীবন ও কার্যপ্রণালী একজন শিশুর উপর দ্রুত প্রভাব বিস্তার করে। যার ফলে পিতা যদি মাস্তান, গুন্ডা, চোর, ডাকাত, হিরোইনখোর, নাস্তিক ইত্যাদি হয় তাহ’লে সন্তানও নিজেকে সে পথেই এগিয়ে নিয়ে যায় অতি দ্রুতগতিতে। কারণ জন্মের পর থেকেই সে এ পরিবেশের সাথে সম্পৃক্ত। সে কোনদিন তার সন্তানকে ভাল উপদেশ দেয়নি।। একটি স্থিতিশীল ও সুশীল সমাজ গড়তে যে একটি শিশুকে চরিত্রবান ও শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে হয় সেদিকে তার কোন ভ্রুক্ষেপই ছিলনা। অতএব, সন্তানকে মানুষের মত মানুষ হিসেবে গড়তে হলে অবিভাবকদের সচেতনতার অধিকারী হওয়া একান্ত অপরিহার্য।

নৈতিক অগ্রগতি ও চারিত্রিক মাধুর্য্য একটি শিশুকে উন্নতি ও অগ্রগতির শীর্ষস্থানে পৌঁছাতে সক্ষম। আর এটা সম্ভব কেবল ইসলামী জীবন পরিচালনার মাধ্যমে। কারণ ইসলামই একমাত্র সার্বজনীন ভারসাম্যপূর্ণ ধর্ম। যা প্রত্যেক যুগের জন্য উপযোগী একটি জীবন ব্যবস্থা। ইসলামের হুকুম-আহকামগুলো যথাযথভাবে পালন করলে তার জীবন হবে সুশৃংখল। আর ছালাত হ’ল শৃংখল সমাজ বিনির্মাণের ও নৈতিক জাগরণের মূল হাতিয়ার। সঠিক, সুন্দর, নম্র-বিনম্র ও সুচারুপূর্ণভাবে ছালাত আদায় করলে তা হবে নৈতিক উন্নতি ও উত্তম চরিত্র গঠনে সহায়ক। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, বাংলাদেশে এমন পিতা-মাতার সংখ্যা খুব কমই আছে যারা তাদের সন্তানদের ছালাত শিক্ষা দেয়। যদিও তারা পড়াশুনা, খেলাধূলা ও অন্যান্য বৈষয়িক বিষয়ে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে নজরদারি করে থাকে। সমাজের ৯৮% শিশু-কিশোরদের ছালাত প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় না। অবিভাবকমন্ডলীকে মনে রাখতে হবে, আল্লাহর দেয়া জীবনব্যবস্থার সাথে সন্তানকে পরিচয় করে দেয়াটাই পিতা-মাতার সর্বপ্রধান কর্তব্য। এই কর্তব্যে অবহেলা করার জন্য পিতা-মাতাকে অবশ্যই কিয়ামতের দিন দায়ী থাকতে হবে। 

শিশুদের স্বাস্থ্য গঠন ও সুপ্ত প্রতিভা বিকাশে পারিবারিকভাবে পিতা-মাতার ভূমিকা সর্বাগ্রে। শিশু তার সার্বিক জীবনে এককভাবে নির্ভরশীল থাকে তার পিতা-মাতার উপরে। ফলে পিতা-মাতার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সন্তানকে প্রভাবিত করে। পিতা-মাতার বৈশিষ্ট্য শিশুদের নৈতিক, চারিত্রিক ও মানবিক উন্নয়নে যথেষ্ট স্বতন্ত্র পথপ্রদর্শক। শিশুদের সাথে পিতা-মাতার সম্পর্ক নিয়ে বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিকগণ বহু গবেষণা করেছেন। গবেষণায় দেখা গেছে, শিশুর মন ও মনন পরিগঠনে মাতাপিতার ভূমিকাই প্রধান, অতঃপর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সমাজের প্রভাব। প্রখ্যাত মনোবিজ্ঞানী ও মনোচিকিৎসাবিদ সিগমান্ড ফ্রয়েড (১৮৫৬-১৯৩৯খ্রিঃ) মানুষের ব্যক্তিত্ব গঠনের উপর ব্যাপক গবেষণা করে ‘থিওরি অব পারসোনালিটি’ নামে ‘ব্যক্তিত্ব গঠনের তত্ত্ব’ উদ্ভাবন করেন। তিনি বলেন, ‘মানুষের ব্যক্তিত্ব গঠন নির্ভর করে জন্মের পর থেকে ৫ বছর (০-৫ বছর) বয়সের মধ্যে পিতা-মাতার সাথে সন্তানের সুসামঞ্জস্য সম্পর্কের উপর’। এই সময়টিকে তিনি ৩ ভাগে বিভক্ত করেছেন। (ক) ০-১ বছর বয়সের সময়কে তিনি ‘মৌখিক অবস্থা’ (Oral stage) নাম দিয়েছেন এবং বলেছেন যে, এই সময়ে শিশুর সাথে মায়ের শারীরিক ও মানসিক সংস্পর্শে তথা সার্বিক সম্পর্ক ঠিকমতো না হ’লে পরবর্তীতে শিশু বড় হতে থাকলে তার ব্যক্তিত্বে কতগুলো অভ্যাস বা আচরণ সৃষ্টি হতে পারে। যেমন- আঙ্গুল চোষা, দাঁত দিয়ে নখ কাটা, বাঁশি বাজানো পছন্দ করা, কলমের উল্টা অংশ মুখে দেওয়া বা চোষা, ধূমপান করা, অতিরিক্ত পান খাওয়া, অপরকে মনকষ্ট বা আঘাত দিয়ে কথা বলা, বাচালতা, পরনির্ভশীলতা ইত্যাদি। (খ) ‘পায়ু অবস্থা’ (Anal stage) : ১-৩ বছর বয়স কাল। এই সময় মায়ের সাথে শিশুর সম্পর্কের ঘাটতি বা ব্যাঘাত হ’লে পরবর্তীতে তার আচরণে বিশৃঙ্খল, অগোছালো অবস্থা অথবা অতিরিক্ত সুশৃঙ্খল, সূচীবাই, অতিরিক্ত বাধ্যবাধকতা মনোভাব ও তা মেনে চলা, কার্পণ্যতা বা বেশী বেশী টাকা পয়সা খরচ করা ইত্যাদি দেখা দিতে পারে। (গ) ‘লিঙ্গীয় অবস্থা’ (Phallus stage) : ৩-৫ বছর বয়স পর্যন্ত সময়। এখানে মাতা-পিতার সাথে সুসামঞ্জস্য সম্পর্কের অবনতি হ’লে সন্তান বড় হ’লে পরবর্তীতে তার কামশীলতা অথবা কামাচারী ইত্যাদি জাতীয় সমস্যা দেখা দিতে পারে।[1] সুইস জীব বিজ্ঞানী, দার্শনিক মনোবিজ্ঞানী জীন পিজেট (Jean peaget) ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে তার নিজ শিশু কন্যা লুসিনের উপর গবেষণা করে লক্ষ্য করলেন যে, ‘কন্যা শিশুটি ৮ মাস বয়সের পর তার মাকে খোঁজাখুঁজি করে যখন তার মা আড়ালে চলে যায়। কিন্তু ৮ মাস বয়সের পূর্বে ঐ কন্যা শিশুটি তার মাকে খুঁজত না যখন তার মা আড়ালে চলে যেত। এতে তিনি বুঝাতে চেয়েছেন যে, শিশুর পরিচর্যায় মায়ের ভূমিকাই অনেক বেশী’ (মাসিক ইতিহাস অন্বেষা, ৮ম বর্ষ, ১২ সংখ্যা, ডিসেম্বর ২০১১, পৃ. ৫৯-৬০)। এরিক এরিকসন (Arik Erikson) ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে ‘মা ও শিশুর মিথস্ক্রিয়া’ সম্পর্কে গবেষণা করে দেখলেন যে, ‘মায়ের সাথে শিশুর পারস্পারিক সম্পর্কের মিথস্ক্রিয়ার উপরই শিশুর পরবর্তী জীবনের সুষ্ঠ ব্যক্তিত্ব তৈরি নির্ভরশীল’। প্রসিদ্ধ মনোরোগ গবেষকদ্বয় জন বলবে (John Bowlby) ১৯৫১-১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দে এবং ই এস পিকেল (ES Paykel) ১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দে ‘মাতৃস্নেহ বঞ্চিত শিশুদের অবস্থা’-এর উপর ব্যাপক পরীক্ষা করে দেখেন যে, ‘মাতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত থাকলে পরবর্তীতে ঐ শিশুরা অপরাধী বালক, মাস্তান, সন্ত্রাসবাদী, মাদকাসক্ত, মদ্যপ, বিষণ্ণতা ও অন্যান্য মানসিক সমস্যা ও রোগে ভুগতে পারে’। অন্যদিকে একটি শিশুর পরিপূর্ণ বিকাশে মস্তিষ্কের কোষের সংযোগ স্থাপনের গুরুত্ব সর্বাধিক। গবেষণা থেকে জানা যায় যে, একটি শিশুর জন্মের সময় মস্তিষ্কে ১০০ বিলিয়ন কোষ (নিউরন) থাকে। এককভাবে একটি কোষ অন্য প্রায় ১৫ হাজার কোষের সংগে সংযোগ স্থাপন করতে পারে। শিশুর আট বছর বয়সের মধ্যে প্রায় ৯০ ভাগ কোষের ভিতর সংযোগ স্থাপিত হয়। কোষের সংযোগ থেকেই শিশুর শারীরিক, সামাজিক, বুদ্ধিবৃত্তিক, সৃজনশীল ও আবেগীয় যে বিকাশ-সবকিছুই এ সময়ে সম্পন্ন হয়। আর মস্তিষ্কের বিকাশ শৈশবে না হলে আর কখনই বিকশিত হওয়ার সুযোগ থাকে না। সেকারণে শিশুর শূন্য থেকে আট বছর পর্যন্ত বয়সকাল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই সময়কালকে ‘প্রারম্ভিক শৈশব বিকাশ’ বলে। এ সময় পরিবারের পক্ষ থেকে শিশুর বিকাশে যত্ন নেয়া দরকার। এ জন্য প্রতিটি শিশুর বাবা-মা এবং সন্তান লালন-পালনের সংগে জড়িত প্রত্যেকের এই ‘প্রারম্ভিক শৈশব বিকাশ’ সম্পর্কে জানা উচিত (দৈনিক আমার দেশ ১১ই জানুয়ারী’১১, মঙ্গলবার পৃ: ৮)

খ. সামাজিক করণীয় :

সমাজের গতি, আদর্শ ও সংস্কৃতির উপর নির্ভর করে তার জনগোষ্ঠির আদর্শ বা সংস্কৃতি। একজন শিশু শৈশবকাল থেকে সামাজিক সংস্কৃতি ও পরিবেশ থেকে যে শিক্ষা নিয়ে বেড়ে উঠে জীবনের বিস্তীর্ণ ক্ষেত্রে তার মধ্যেই সে আবর্তন করে। সামাজিক আদর্শ বা সংস্কৃতি যদি প্রগতিশীল, পাশ্চাত্য সংস্কৃতি ও মস্তিষ্ক প্রসূত বিভিন্ন অপসংস্কৃতির লালনকারী হয় তবে শিশুর জীবন হবে অপসংস্কৃতির নির্মম কষাঘাতে জর্জরিত। নীরবে নির্জনে-নিভৃতে অপমানের গ্লানিতে জীবন হবে মর্মাহত। সুতরাং একজন শিশুর জীবনের সার্বিক নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজন সমাজের এমন এক শৃঙ্খলিত ও সুনিয়ন্ত্রিত সামাজিক জীবন যার ফলে সমাজের আন্তঃগোষ্ঠি অধিবাসীদের মধ্যে সৃষ্টি হয় কল্যাণকামী এক যুগপোযোগী সমাজ। সৃষ্টি হওয়া প্রয়োজন পারস্পরিক ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সহনশীল সম্পর্ক। যেখানে থাকবে না গীবত-তোহমত, হিংসা-বিদ্বেষ, দাম্ভিকতা আর স্বভাবজাতহীন বৈপরীত্যপূর্ণ আচরণ। থাকবেনা ধন-ঐশ্বর্যের লোভ, নেতৃত্বের কোন্দল আর স্বার্থপরতার জঞ্জালপূর্ণ আবহ। বরং সেখানে বিরাজ করবে কল্যাণকামিতা, ভালবাসা আর স্নেহধন্য পরিবেশের ছড়াছড়ি। যেমন আনন্দের হিল্লোল প্রবাহিত হয়েছিল দেড়হাযার বছরের এক সামাজিক প্রেক্ষাপটে। হিজরত পরবর্তী সময়ে সর্বপ্রথম জন্ম নেওয়া পুত্র সন্তান আব্দুল্লাহ ইবনু যুবাইর (রাঃ)-কে বরণ করে নেওয়ার জন্য মুসলিম জনগোষ্ঠির মধ্যে যে মধুর পরিবেশের অবতারণা হয়েছিল তা বিশ্বের ইতিহাসে শান্তিপূর্ণ সমাজ বিনির্মাণে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। আর এটাই হবে শিশু-কিশোরদের নিরাপত্তা বিধানে সামাজিক দায়বদ্ধতা।

গ. সরকারের করণীয় :

আজকের শিশু আগামী দিনের দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ কর্ণধার। ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রনায়ক তাদের মধ্যে থেকেই আবির্ভাব ঘঠবে। তাদেরকে সুষ্ঠ পরিচর্যা, সুস্থ বিনোদন, বিশুদ্ধ আক্বীদাগত শিক্ষা, ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে সুনাগরিক হিসাবে গড়ে তোলার সার্বিক ব্যবস্থাপনা করা সরকারের অন্যতম দায়িত্ব ও কর্তব্য। এক্ষেত্রে সরকারী যে সকল পদক্ষেপ সাধারণভাবে গৃহীত হয়, তা মোটামুটিভাবে যথার্থ হলেও আমাদের দেশে যে বিষয়ে ঘাটতি দেখা যায় তা হল, উপযুক্ত ধর্মীয় শিক্ষা। শিশুদের যথাযথ ধর্মীয় মূল্যবোধ গড়ে উঠার জন্য পরিবার ও সমাজের পাশাপাশি সরকারী বা রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপও অত্যন্ত জরুরী। বিশেষ করে স্কুল-মাদরাসায় উন্নতমানের ধর্মীয় পাঠ্যবই প্রণয়ন, প্রতিটি শ্রেণীতে ধর্ম বিষয়টি বাধ্যতামূলক করার সাথে সাথে প্রতিটি মসজিদে ইসলামী ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে শিশুদের সুস্থভাবে গড়ে তোলার জন্য সরকারকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। 

শিশু প্রতিপালনে ইসলামের নীতি :

শিশুদের জীবন রক্ষা, নিরাপত্তা ও বিকাশের জন্য ইসলামের নীতি, আদর্শ, শিক্ষা যেমন সুদূরপ্রসারী ও সুস্পষ্ট তা আর অন্য কোন আদর্শ, মতবাদ বা ধর্মে খুঁজে পাওয়া যায় না। যেমন-

ক. ইসলামী আক্বীদা ও সংস্কৃতির লালন :

একজন শিশুর বিকাশ মূলত হয় দুইভাবে-শারীরিক ও মানসিক। শারীরিক বিকাশ বলতে শিশুর দৈহিক অবয়বের পরিবর্তন এবং আকার-আকৃতির উত্থান-পতনকে বুঝায়। মানসিক বিকাশ বলতে শিশুর চিন্তা-চেতনা, বোধ শক্তি, অনুভূতি, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ব্যবহার ও ভাবের আদান-প্রদানসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ক্রমান্বয়ে শিশুর ক্ষমতা অর্জনকে বুঝায় (আবুল হায়াত মুহাম্মাদ তারেক, ইসলামের দৃষ্টিতে শিশুর অধিকার (পাঞ্জেরী ইসলামিক পাবলিকেশন্স, ঢাকা, ফেব্রম্নয়ারী-২০০৭ ইং, পৃঃ ১৮)। উক্ত বিকাশ ছাড়া শিশুর পরিপূর্ণ বিকাশ আদৌ সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে অভিভাবকবৃন্দকে প্রাথমিক পর্যায়ে বৈবাহিক জীবনের গুরুত্ব ও মাতৃগর্ভে শিশুর আগমন ও বেড়ে উঠা, গর্ভকালীন শিশুর পরিচর্যা ও প্রতিপালন, গর্ভবতী মায়ের সুষ্ঠু চিকিৎসা ও ধৈর্যের নসিহত, গর্ভস্থ শিশুর ভবিষ্যৎ নির্ধারণে জন্ম-পূর্ববর্তী প্রস্ত্ততি, জন্ম-পরবর্তী শিশুর সার্বিক প্রতিপালন, পিতৃ ও মাতৃস্নেহে শিশুর পরিচর্যা ও প্রতিপালন এবং সর্বোপরি পিতা-মাতার মনন, চিন্তা-চেতনা বা সংস্কৃতি ইসলামী বিশুদ্ধ আক্বীদা সম্বলিত জ্ঞান সম্পর্কে যথোপযুক্ত ধারণা থাকতে হতে হবে। সর্বপ্রকার বাতিল আক্বীদা, চিন্তাধারা ও নোংরা সংস্কৃতির নাগপাশ থেকে সর্বোতভাবে আত্মরক্ষা করতে হবে। উপরিউক্ত বিষয়গুলো শতভাগ বাস্তবায়িত হলে শিশুর সুপ্ত প্রতিভা ও সৃজনলশীলতা প্রকাশে কোনরূপ বাধা থাকবে না। এগুলোর পিছনে ইসলামের ভূমিকা অনস্বীকার্য। কেননা এগুলো শিশুর মনস্তাত্তিক বিকাশে অন্যতম সহায়ক শক্তি।

খ. উপযুক্ত শিক্ষাদান :

শিশুর সার্বিক বিকাশে শিক্ষা একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। শিশুর শিক্ষা অর্জনের ক্ষেত্রে ইসলামের ভূমিকা অনস্বীকার্য। শিক্ষা দুই প্রকার। ক. জাগতিক শিক্ষা খ. ধর্মীয় শিক্ষা। ইসলাম শিশুকে এই উভয় শিক্ষায় শিক্ষিত করার ব্যাপারে অভিভাবকদের কঠোরভাবে নির্দেশনা প্রদান করে। কারণ মানুষের শৈশবকালীন শিক্ষার উপরেই তার বিস্তীর্ণ জীবনের ভিত রচিত হয়। যেমন- রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘প্রত্যেক মুসলমানের উপর শিক্ষা অর্জন করা ফরয’ (ইবনু মাজাহ হা/২২৪; মিশকাত হা/২১৮)। অন্যত্রে তিনি বলেন, ‘যে ব্যক্তির নিকটে কোন দাসী থাকে আর সে যদি তাকে উত্তম শিক্ষা দেয় এবং উত্তম শিষ্টাচার শিক্ষা দেয় অতঃপর তাকে মুক্তি করে বিবাহ করে তাহ’লে তার জন্য দুই নেকী’ (বুখারী হা/৫০৮৩ ; মুসলিম হা/৪০৪)। অন্যদিকে শুধুমাত্র আল্লাহ ও রাসূল (ছাঃ) সম্পর্কে সঠিক ও বিশুদ্ধ ধারণা থাকার কারণে রাসূল (ছাঃ) একজন দাসীকে দাসত্বের জিঞ্জির থেকে মুক্তি প্রদানের কথা বলেছিলেন। যেমন-মুয়াবিয়া ইবনুল হাকাম আস-সুলামী (রাঃ) বলেন, আমার একজন দাসী ছিল। সে আমার ছাগল চরাতো। একদিন হঠাৎ করে বনের বাঘ ছাগল পাল থেকে একটি ছাগলের বাচ্চা নিয়ে গেল। ফলে আমি রাগান্বিত হয়ে তার গালে একটি থাপ্পড় মারি। অতঃপর আমি রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে এসে বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমি বড় অন্যায় করে ফেলেছি (তখন তাকে ঘঠনাটি বললাম)। অতঃপর বললাম, আমি কি তাকে মুক্ত করে দিব ? তখন রাসূল (ছাঃ) বললেন, তাকে আমার নিকট নিয়ে আস। তাকে নিয়ে আসা হ’লে রাসূল (ছাঃ) তাকে বললেন,  فَقَالَ لَهَا أَيْنَ اللَّهُ قَالَتْ فِى السَّمَاءِ قَال مَنْ أَنَا قَالَتْ أَنْتَ رَسُولُ اللَّهِ قَالَ أَعْتِقْهَا فَإِنَّهَا مُؤْمِنَةٌ. ‘বলতঃ আল্লাহ কোথায়? বালিকাটি বলল, আল্লাহ আসমানে। অতঃপর তিনি বললেন, বলতঃ আমি কে? বালিকাটি বলল, আপনি আল্লাহর রাসূল। তখন তিনি বললেন, তাকে (বালিকাকে) মুক্ত করে দাও। কেননা সে মুমিনা মহিলা’ (মুসলিম হা/১২২৭; মিশকাত হা/৩৩০৩; সিলসিলা ছহীহাহ হা/৩১৬১)। সুতরাং শৈশব কালের বিশুদ্ধ ও সঠিক শিক্ষা কত গুরুত্বপূর্ণ উপরোক্ত ঘটনা তার বাস্তব প্রমাণ।

সন্তানকে সুশিক্ষা প্রদান করা পিতা-মাতার অন্যমত দায়িত্ব ও কর্তব্য। এক্ষেত্রে লোকমান হাকীম তার সন্তানকে যে শিক্ষা প্রদান করেছিলেন সেটি প্রনিধানযোগ্য (সূরা লোকমান দ্রষ্টব্য)। তিনি তাঁর সন্তাকে মূলত তাওহীদ, রিসালাত ও আখিরাত সম্পর্কিত মৌলিক তিনটি বিষয়ে জ্ঞান দান করেছিলেন। সুতরাং সন্তানকে নির্ভেজাল তাওহীদের স্বরূপ ও প্রকৃতি, রিসালাতের দায়িত্ব ও কর্তব্য, আখিরাতের চিরস্থায়ী জীবন সম্পর্কে সুস্পষ্ট শিক্ষা প্রদান করতে হবে। তাহ’লে ঐ সন্তান হবে একজন সমাজ সংস্কারক, সমাজে ঘুনেধরা সকল ভ্রান্ত আক্বীদা ও বিজাতীয় মতবাদকে পদপিষ্ট করে আল্লাহর উপর আস্থা রেখে সম্মুখ পানে অগ্রসর হবে। ফলে বিজয় লাভ করবে তাকওয়া, বিতাড়িত হবে যাবতীয় অন্যায়, দুর্নীতি আর অসত্যের দুর্বল ভিত, চূর্ণ-বিচূর্ণ হবে অহংকারীর দাম্ভিকতা। শান্তির সুবাতাস প্রবাহিত হবে সমাজের আনাচে কানাচে। সুতরাং তাওহীদ, রিসালাত ও আখিরাতই হবে শিক্ষাক্ষেত্রে শিশুর বিকাশে ইসলামের মৌলিক নীতিমালা।

গ. উসওয়াহ হাসানাহ বা উত্তম নমুনা :

মানুষের বাস্তব জীবনের বিস্তীর্ণ পরিমন্ডল অসংখ্য ঘাত-প্রতিঘাত, অবহেলা-অবজ্ঞা আর ষড়যন্ত্রের মধ্যে ঘূর্ণায়মান। হক্ব গ্রহণ ও প্রতিপালন এবং বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অসংখ্য বাধা-বিপত্তির সম্মুখিন হতে হয়। নবী-রাসূলদের নবুয়তী জীবন, ছাহাবায়ে কেরামগণের সংগ্রামী জীবন, সালাফে-ছালেহীনদের বিপ্লবী জীবন আর যুগে যুগে হক্বপন্থী মুসলিম মনীষীগণের জীবনীতিহাস তার জাজ্বল্য প্রমাণ। এ সমস্ত মহান ব্যক্তিদের জীবনী শিশুদের মাঝে সংগ্রাম মুখর বাস্তব জীবনের পাথেয় হিসাবে কাজ করবে। তাদের মত আজকের শিশুরা যেন ধৈর্যের পরকাষ্ঠা প্রদর্শন করে বাস্তব জীবনে পাশ্চাত্য সভ্যতার আক্বীদা ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের যুগে আবু বকর, ওমর, বেলাল, হামযা, মুছ‘আব বিন উমায়ের (রাঃ), ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বল, ইমাম বুখারী, নাছিরুদ্দীন আলবানী, মূসা বিন নুসায়ের, তারিক বিন যিয়াদ, মুহাম্মাদ বিন ক্বাসিম (রহঃ) প্রভৃতির মত দৃঢ় হিমাদ্রিসম অবস্থান গ্রহণ করে দ্বীন ইসলামকে যেন আবার বিশ্বের বুকে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। এক্ষেত্রে ইসলামের অবস্থান পরিস্কার। এটাই শিশুর বাস্তব জীবনে অবদানের জন্য  ইসলামের নীতি। 

কতিপয় প্রস্তাবনা : 

শিশুদের জীবনের নিরাপত্তা ও নৈতিক বিকাশে সরকারের নিকট আমাদের পক্ষ থেকে কতিপয় প্রস্তাবনা উল্লেখ করা হলো : 

১. শিশুর জন্ম-পূর্ববর্তী ও পরবর্তী অবস্থাকে সঠিকভাবে পর্যবেক্ষণ ও নিবিড়ভাবে পরিচর্যার জন্য সরকারীভাবে স্থানীয় পর্যায়ে ‘নিরাপদ মাতৃত্ব সেবাদান কেন্দ্র’ স্থাপন করা। 

২. শিশুদের সঠিক শিক্ষা নিশ্চিত করণের লক্ষ্যে প্রাথমিক পর্যায় থেকে উচ্চতর শিক্ষা পর্যন্ত ইসলাম শিক্ষাকে সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব দিয়ে ছেলে-মেয়েদের পৃথক শিফটিং শিক্ষা পদ্ধতি প্রচলন করা এবং মাযহাব ভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থা ও সিলেবাস পূর্ণাঙ্গভাবে বাতিল করা। এক্ষেত্রে বিশুদ্ধ আক্বীদা, আমল, আখলাক্ব, ইসলামের মৌলিক নীতিমালা ও পদ্ধতি সমূহ এবং চারিত্রিক সৌন্দর্য্যের নিষ্কলুষতা শিক্ষা দান ‘প্রাথমিক শিক্ষা কর্মসূচী’তে গুরুত্বের সাথে প্রাধান্য প্রদান করা।

৩. শিশুদের সুপ্ত ও সৃজনশীল প্রতিভা বিকাশ ও নৈতিক অবক্ষয়রোধে পারিবারিক ও সামাজিকভাবে ‘শিশু সাংস্কৃতিক অঙ্গন’ নামে একটি  সুস্থ বিনোদন কেন্দ্র স্থাপন করা। যেখানে দেশীয় ও পাশ্চাত্য সভ্যতার আকাশ সংস্কৃতির ভয়ানক থাবার কোন সংস্পর্শ থাকবে না।

৪. অভিভাবকদেরকে নির্ভেজাল তাওহীদ সম্পর্কে পরিপূর্ণ ধারণা প্রদানের জন্য প্রতিটি এলাকায় একটি ‘অভিভাবক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র’ কিংবা প্রতিদিন ‘পারিবারিক বৈঠক’-এর ব্যবস্থা গ্রহণের সার্বিক ব্যবস্থার গ্রহণের পৃষ্ঠাপোষকতা প্রদান করা। যেখানে ধর্মীয় অন্যান্য বিষয়সহ বিশেষ করে বিশুদ্ধ আক্বীদা বিষয়ক প্রশিক্ষণের যথাযথ ব্যবস্থা করা।

৫. শিশু শ্রম, শিশু অপব্যবহার, শিশু নির্যাতন ও শিশু পাচারসহ প্রভৃতি শিশু বৈষম্যকে কার্যকর ও স্থায়ীভভাবে বন্ধ করা এবং অপরাধী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা।

৬. সর্বোপরি শিশু জীবনের বিস্তীর্ণ ক্ষেত্রে যেন শুধুমাত্র মহান আল্লাহকে স্মরণ ও তদীয় রাসূল (ছাঃ)-এর জীবনাদর্শ গ্রহন করে তার জীবন পরিচালনা করতে পারে তার সকল প্রকার ব্যবস্থা গ্রহন করা। অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর আদর্শ অনুযায়ী জীবন গড়ার জাযবা তৈরী করা।

উপসংহার :

আজকের শিশু আগামী দিনের দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ কর্ণধর। জাতির ভবিষ্যৎ উন্নতি ও অগ্রগতির জন্য তাদের জীবনের রক্ষা, সুষ্ঠ নিরাপত্তা, সুপ্ত প্রতিভা বিকশিত করার পথ উন্মোচন করা এবং সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তোলার কোন বিকল্প নেই। এ বিষয়ে জাতিসংঘসহ বিশ্বের সকল রাষ্ট্র একমত যে, যোগ্যতা সম্পন্ন নেতৃত্ব ও প্রকৃত সৎ নাগরিক ব্যতীত রাষ্ট্র তার স্বমহিমায় দন্ডায়মান হতে পারে না। তাই তারা বিভিন্ন নীতিমালা, শিশু অধিকার সনদ ও বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করেছে এবং বাস্তবায়ন করার চেষ্টাও অব্যহত রেখেছে। এক্ষেত্রে আমরা জাতির সম্মুখে কতিপয় প্রস্তাবনা উপস্থাপন করেছি। সুতরাং আমাদের সন্তানকে সৎ ও যোগ্য নাগরিক এবং তাক্বওয়াশীল ব্যক্তি হিসাবে গড়ে তুলতে হবে। যাতে করে সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে যাবতীয় অন্যায়-অসত্য, যুলুম-নির্যাতন ও দুর্নীতির কালো হাত অপসারিত হয়ে শান্তির রাজ কায়েম হবে ইনশাআল্লাহ। পরিশেষে বিখ্যাত দার্শনিক নেপোলিয়ানের দার্শনিক বক্তব্য পেশ করেই শেষ করছি। তিনি বলেন, Give me a educated mother, I will give you a educated notion ‘অর্থাৎ আমাকে একজন শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাকে একটি শিক্ষিত জাতি দিব’।

বযলুর রহমান

লেখক : কেন্দ্রীয় সহ-পরিচালক, সোনামণি।


[1]. মাসিক ইতিহাস অন্বেষা, ৮ম বর্ষ, ১২ সংখ্যা, ডিসেম্বর ২০১১, পৃ. ৫৯-৬০; মোঃ লুৎফর রহমান ও এ. কে.এম শওকত আলী খান, সমাজ মনোবিজ্ঞান (গ্রন্থ কুটির, বাংলাবাজার, ঢাকা, দ্বিতীয় প্রকাশ অক্টোবর ২০০৯), পৃ. ১৯২-২১৯।



বিষয়সমূহ: শিষ্টাচার
আরও