মিশর : উমার বিন খাত্তাবের নিকট প্রেরিত আমর বিন আছের চিঠির বর্ণনায়
ড. শিহাবুদ্দীন আহমাদ
আধুনিক
যুগে যুবসমাজের মধ্যকার সমস্যা নিয়ে এই লেখাটি লিখতে আমি স্বস্তিবোধ করছি।
কেননা এটি এমন এক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে যা কেবল ইসলামী সমাজেই নয় বরং
প্রতিটি সমাজে বিদ্যমান। বর্তমান যুবসমাজ বুদ্ধিবৃত্তিক ও মানসিকভাবে এমন
কিছু প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছে যা তাদেরকে প্রায়শই জীবন সম্পর্কে
একধরনের উৎকন্ঠায় নিক্ষিপ্ত করছে। এ দুঃশ্চিন্তা হতে নিষ্কৃতি পাওয়া এবং এই
হতাশাময় অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য তারা চেষ্টাও করছে যথাসম্ভব। তবে
এটা সত্য যে, ধর্মীয় অনুভূতি ও চারিত্রিক মূল্যবোধের অনুশীলন ব্যতীত তাদের
এই প্রচেষ্টা কখনোই সফল হবে না। কেননা এ দুটির উপরই মানব সমাজ ভিত্তিশীল।
দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ নিহিত রয়েছে এর মাঝেই। যাবতীয় কল্যাণ ও সমৃদ্ধি
অর্জন এবং অনিষ্টতা ও বিপদাপদকে দূরীভূত করার জন্য এ দু’টি মূলনীতির
অনুশীলন অপরিহার্য।
একটি দেশ যেমন কখনো তার অধিবাসী ছাড়া বসতিপূর্ণ হয় না, তেমনিভাবে দ্বীন তার অনুসারী ছাড়া প্রতিষ্ঠা পায় না। আর যখনই দ্বীনের প্রতিষ্ঠায় দ্বীনদাররা দন্ডায়মান হয়ে যাবে তখনই আল্লাহ তাদেরকে সাহায্য করবেন, তাদের শক্র যেমনই হোক না কেন, মহান আল্লাহ বলেছেনঃ يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنْ تَنْصُرُوا اللَّهَ يَنْصُرْكُمْ وَيُثَبِّتْ أَقْدَامَكُمْ وَالَّذِينَ كَفَرُوا فَتَعْسًا لَهُمْ وَأَضَلَّ أَعْمَالَهُمْ ‘হে ঈমানদারগণ যদি তোমরা আল্লাহকে সাহায্য করো, তাহলে আল্লাহও তোমাদেরকে সাহায্য করবেন এবং তোমাদেরকে দৃঢ়পদ করবেন। আর যারা কুফরী করেছে, তাদের জন্য রয়েছে দূর্ভোগ এবং তিনি তাদের আমল সমূহকে বিনষ্ট করে দিবেন (মুহাম্মদ, ৪৭/৭-৮)।
যেহেতু দ্বীন তার অনুসারী ব্যতীত প্রতিষ্ঠা পায় না, সেহেতু আমরা যারা মুসলিম এবং ইসলামের পতাকাবাহী তাদের জন্য অত্যাবশ্যক কর্তব্য হল, নিজেদেরকে প্রথমে নেতৃত্ব ও পথপ্রদর্শনের যোগ্য করে গড়ে তোলা এবং শক্তি ও সৌভাগ্যের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠা। আর সেজন্য আল্লাহর কিতাব ও রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাতের জ্ঞান অর্জন করতে হবে, যা বাকচারিতায়, কার্যকলাপে এবং দিক-নির্দেশনাদানে এবং মানুষের কাছে দাওয়াত পৌঁছে দেওয়ার জন্য আমাদেরকে উপযুক্ত করে গড়ে তুলবে। ফলে সত্যানুসন্ধানী ও বাতিলপন্থীদের সম্মুখে ধারালো হাতিয়ার ও স্বচ্ছ আলোকঝান্ডা নিয়ে দাঁড়ানো সম্ভব হবে।
এর পরের কাজ হল এ অর্জিত জ্ঞানকে বাস্তবের ময়দানে প্রয়োগ করা। এর এতে যেন আমাদের ঈমান, দৃঢ়বিশ্বাস, একনিষ্ঠতা ও দ্বীনের পূর্ণ অনুসরণ প্রকাশ পায়। কেবল বক্তব্যই যেন সার না হয়। কেননা বক্তব্যের যথার্থতা যদি কর্মে প্রতিফলিত না হয়, তখন বক্তব্য কেবল আড়ম্বরই থেকে যায়। তাতে নেতিবাচক ফল ছাড়া আর কিছু পাওয়া যায় না। যেমন আল্লাহ বলেছেন, يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لِمَ تَقُولُونَ مَا لَا تَفْعَلُونَ (২) كَبُرَ مَقْتًا عِنْدَ اللَّهِ أَنْ تَقُولُوا مَا لَا تَفْعَلُونَ ‘হে ঈমানদারগণ, তোমরা যা করো না, তা কেন বলো? তোমরা যা করো না, তা বলা আল্লাহর কাছে অত্যন্ত অসন্তোষজনক (ছফ ৬১/২,৩)।
সবচেয়ে ভাল হয় নতুন করে পথচলা শুরু করে আমাদের যুবকদের চিন্তা-ভাবনা ও কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করতে পারলে, যেন তাদের মধ্যকার ভালোগুণ গুলোকে বৃদ্ধি এবং খারাপসমূহকে সংশোধন করে দেয়া যায়। কেননা আজকের যুবকরা আগামী দিনের পুরুষ। তাদের উপরই নির্ভর করছে উম্মতের ভবিষ্যৎ। তাই পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছে তাদেরকে উত্তমভাবে প্রতিপালন করা এবং তাদের জন্য মঙ্গল ও কল্যাণ নিহিত রয়েছে এমন বিষয়াদির প্রতি দিক-নির্দেশনা প্রদান করার জন্য উৎসাহিত করা হয়েছে। জাতির ভবিষ্যৎ এই যুবসমাজের মাঝে যখন সংস্কার আসবে এবং ধর্মীয় ও চারিত্রিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে যখন তাদের জীবন গড়ে উঠবে, তখন অচিরেই জাতির জন্য উজ্জ্বল ভবিষ্যত রচিত হবে এবং আমাদের নেতাদের যোগ্য উত্তরসূরী তৈরী হবে ইনশাআল্লাহ।
যুবকদের পরিচয়
যুবকদেরকে অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে দেখলে আমরা সাধারণভাবে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, তারা তিন শ্রেণীতে বিভক্ত।
ক. সুপথগামী যুবক খ. বিপথগামী যুবক গ. দিশেহারা যুবক ।
সুপথগামী যুবক
এই যুবক সেই মুমিন যুবক যে মুমিন শব্দটির অর্থ পুরোপুরি বহন করে। এরা তারা যারা তাদের ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রতি পূর্ণ আস্থাশীল, দ্বীনকে ভালবাসে, দ্বীনে পরিতৃপ্ত থাকে, আনন্দিত হয়, দ্বীনকে গণীমত হিসাবে গণ্য করে এবং দ্বীন থেকে বঞ্চিত থাকাকে সুস্পষ্ট ক্ষতির কারণ মনে করে।
তারা এমন যুবক যারা শিরকমুক্ত হয়ে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর দাসত্ব করে। যারা কোনকিছু করা বা না করার ক্ষেত্রে রাসূল মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর কথা ও কাজকে অনুসরণ করে এই বিশ্বাসে যে, তিনি হলেন আল্লাহর রাসূল এবং অনুকরণীয় মডেল।
তারা এমন যুবক যারা সাধ্যমত পরিপূর্ণতার সাথে ছালাত ক্বায়েম করে, কারণ তারা ছালাতের উপকারিতা, দ্বীনী ও দুনিয়াবী কল্যাণ, ব্যক্তিগত ও সামাজিক ফলাফলের ব্যাপারে পূর্ণ বিশ্বাসী। তারা জানে ছালাত পরিত্যাগে ব্যক্তিগত ও জাতিগত কি ভয়াবহ কুপরিণাম নিহিত আছে।
তারা এমন যুবক যারা হক্বদারদের প্রতি যাকাত আদায় করে পূর্ণভাবে, কেননা তারা ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের অন্যতম হিসাবে ইসলাম ও মুসলিমদের প্রয়োজন পূরণে যাকাতের ভূমিকার প্রতি দৃঢ়বিশ্বাস রাখে।
তারা এমন যুবক যারা শীতে-গ্রীষ্মে সর্বদাই রামাযানের ছিয়াম পালন করে এবং স্বীয় প্রবৃত্তি ও লালসাকে নিবারণ করে। কেননা তারা বিশ্বাস করে এতেই আল্লাহর সন্তুষ্টি রয়েছে। তাই নিজের কামনা-বাসনার ঊর্ধ্বে আল্লাহর সন্তুষ্টিকে তারা প্রাধান্য দেয়।
তারা এমন যুবক যারা বায়তুল্লায় ফরজ হজ্জ আদায় করে। কেননা আল্লাহকে যেহেতু তারা ভালবাসে কাজেই আল্লাহর ঘরকেও তারা ভালোবাসে। ভালবাসে রহমত ও মাগফেরাতপ্রাপ্তির স্থানসমূহে যেতে এবং সেখানে প্রত্যাগত মুসলমানদের সাথে শরীক হতে।
তারা এমন যুবক যারা আল্লাহকে নিজেদের এবং আসমান-জমীনের সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা হিসাবে বিশ্বাস করে। কেননা তারা আল্লাহ তাআলার নিদর্শনাবলীতে এমন কিছু টের পায় যা আল্লাহর অস্তিত্বের ব্যাপারে কোনরূপ সন্দেহ ও দ্বিধার অবকাশ রাখে না। সুবিশাল আকারবিশিষ্ট অনুপম ও সুশৃংখল মহাজগতের মধ্যে একজন মহান স্রষ্টার অপরূপ সৃষ্টিকর্ম, অসীম ক্ষমতা ও অনন্যসাধারণ প্রজ্ঞার সুস্পষ্ট প্রমাণ তারা লক্ষ্য করে। কেননা এ জগত নিজেই নিজেকে সৃষ্টি করতে পারে না। আকস্মিক কোন দুর্ঘটনার মাধ্যমেও এর জন্ম হয়নি। কেননা অস্তিত্বলাভের পূর্বে এটা ছিল অস্তিত্বশূন্য। আর অস্তিত্বশূন্য জিনিস কোন অস্তিত্ববান জিনিস সৃষ্টি করতে পারে না, কেননা তার তো নিজেরই অস্তিত্ব নেই।
আবার আকস্মিকভাবে অস্তিত্বলাভেরও কোন সম্ভাবনা নেই, কেননা এ মহাবিশ্ব এমন এক অপরিবর্তনীয়, সুশৃংখল ও নিখুঁত নিয়মের অধীনে পরিচালিত হচ্ছে যার কোন ব্যত্যয় নেই। মহান আল্লাহ বলেছেন فَلَنْ تَجِدَ لِسُنَّتِ اللَّهِ تَبْدِيلاً وَلَنْ تَجِدَ لِسُنَّتِ اللَّهِ تَحْوِيلاً ‘আর তুমি আল্লাহর বিধানের কখনোই কোন পরিবর্তন পাবে না এবং আল্লাহর বিধানের কোন ব্যতিক্রমও কখনো দেখবে না (ফাতির, ৩৫/৪৩)। مَا تَرَى فِي خَلْقِ الرَّحْمَنِ مِنْ تَفَاوُتٍ فَارْجِعِ الْبَصَرَ هَلْ تَرَى مِنْ فُطُور* ثُمَّ ارْجِعِ الْبَصَرَ كَرَّتَيْنِ يَنْقَلِبْ إِلَيْكَ الْبَصَرُ خَاسِئاً وَهُوَ حَسِيرٌ ‘দয়াময় আল্লাহর সৃষ্টিতে তুমি কোন খুঁত দেখতে পাবে আবার তাকিয়ে দেখ, কোন খুঁত কি দেখতে পাও? অতঃপর তুমি দুই বার করে দৃষ্টি ফিরাও, সেই দৃষ্টি ব্যর্থ ও ক্লান্ত হয়ে তোমার দিকে ফিরে আসবে (মুলক ৩-৪)।
এই অপূর্ব সুশৃঙ্খল ও সুসমন্বিত মহাবিশ্ব হঠাৎ করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে আবির্ভূত হয়েছে-এটা কখনই সম্ভব নয়। যদি তাই হত তবে এর গোটা ব্যবস্থাপনাও হত আকস্মাৎ, ফলে তাতে যে কোন মুহূর্তে চরম বিশৃংখলা ও বিপর্যয় নেমে আসত।
তারা এমন যুবক যারা আল্লাহর ফেরেশতাগণের উপর বিশ্বাস স্থাপন করে। কেননা আল্লাহ কুরআনে তাদের কথা বর্ণনা করেছেন এবং রাসূল (ছাঃ) তাদের সম্পর্কে সংবাদ দিয়েছেন। কুরআন ও সুন্নাহে তাদের গুণাবলী, ইবাদত ও সৃষ্টিজগতের কল্যাণে তাদের তৎপরতা সম্পর্কে যা বিবৃত হয়েছে তা-ই তাদের বাস্তবিক অস্তিত্বকে অকাট্যভাবে প্রমাণ করে।
তারা এমন যুবক যারা আল্লাহর কিতাবসমূহের প্রতি আস্থাশীল হয় যেগুলি আল্লাহ তাআলা তাঁর রাসূলগণের প্রতি নাযিল করেছিলেন মানবজাতিকে সঠিক পথ প্রদর্শনের জন্য। কেননা কেবল মানবিক জ্ঞানশক্তির মাধ্যমে ইবাদাত ও মুআমালাতের বিষয়াদি বিস্তারিতভাবে জানা সম্ভব নয়।
তারা এমন যুবক যারা আল্লাহর নবীগণ ও রাসূলগণের প্রতি ঈমান রাখে যাদেরকে আল্লাহ প্রেরণ করেছেন সৃষ্টিজগতের প্রতি। এসকল নবীদের দায়িত্ব হল, তারা মানবজাতিকে কল্যাণের দিকে আহবান করেন এবং তাদেরকে সৎকাজের আদেশ ও মন্দকাজ থেকে নিষেধ করেন। যাতে করে মানবজাতি আল্লাহর কাছে কিয়ামতের দিন কোন হুজ্জত বা আপত্তি প্রকাশ করতে না পারে। নূহ (আঃ) ছিলেন প্রথম রাসূল এবং মুহাম্মাদ (ছাঃ) সর্বশেষ।
তারা এমন যুবক যারা শেষ দিবসের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে যেদিন মানুষকে উত্থিত করা হবে। যেখানে তাদেরকে মৃত্যুর পর আবার জীবন দান করা হবে এই কারণে যেন তাদেরকে প্রাপ্য প্রতিফল বুঝিয়ে দেয়া যায়। আল্লাহ বলেছেন- فَمَنْ يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ خَيْرًا يَرَهُ (৭) وَمَنْ يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ شَرًّا يَرَهُ (৮) ‘কেউ অণু পরিমাণ সৎকর্ম করলে সে তাও দেখবে কেউ অণু পরিমাণ অসৎকর্ম করলে তাও দেখবে (যিলযাল, ৯৯/৭,৮)। কেননা যদি সৃষ্টির জন্য এমন কোন দিন না থাকে যেদিন সৎব্যক্তিদের জন্য পুরষ্কার এবং অসৎব্যক্তিদের জন্য পাপের শাস্তি দেয়া হবে, তাহলে এই দুনিয়াবী জীবনের যথার্থতা ও তাৎপর্যটা কি?
তারা এমন যুবক যারা তাক্বদীরের ভালো ও মন্দের প্রতি বিশ্বাস রাখে। তারা প্রতিটি ঘটনার কারণ ও প্রতিফলে যেমন বিশ্বাস করে, তেমনি বিশ্বাস করে সবকিছুই আল্লাহর পূর্বনির্ধারণ মোতাবেকই ঘটে। তারা জানে প্রতিটি সৌভাগ্যের পিছনে যেমন কারণ নিহিত, তেমনি দুর্ভাগ্যের পিছনেও কারণ নিহিত রয়েছে।
তারা এমন যুবক যারা দ্বীনকে নছিহত হিসাবে গ্রহণ করে আল্লাহর জন্য, তাঁর কিতাবের জন্য, তাঁর রাসূলের জন্য এবং মুসলিম জনসাধারণের জন্য। তারা মুসলিমদের সাথে দ্ব্যর্থহীন ও খোলামেলা জীবনাচরণে অভ্যস্ত হয়, যেমন আচরণ সে অন্যদের কাছে প্রত্যাশা করে। যেখানে থাকে না কোনরূপ ধোঁকা, শঠতা, প্রতারণা ও গোপনীয়তার লেশমাত্রও।
তারা এমন যুবক যারা আল্লাহর পথে আহবান করে জাগ্রত জ্ঞান সহকারে। এমন পরিকল্পনা অনুযায়ী যা মহান আল্লাহ তাঁর কিতাবে বর্ণনা করেছেন-ادْعُ إِلَى سَبِيلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ وَجَادِلْهُمْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ ‘তুমি মানুষকে তোমার প্রতিপালকের পথে আহবান কর হিকমত ও সদুপদেশ দ্বারা এবং তাদের সাথে তর্ক-বিতর্ক করো উত্তমরূপে’ (নাহল ১২৫)।
তারা এমন যুবক যারা ভালো কাজের আদেশ দেয় ও মন্দকাজ থেকে নিষেধ করে। কারণ তারা বিশ্বাস করে যে, এতেই জাতি ও উম্মতের সৌভাগ্য নিহিত রয়েছে। আল্লাহ বলেছেন كُنْتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ تَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَتُؤْمِنُونَ بِاللهِ ‘তোমরাই মানবমন্ডলীর জন্য শ্রেষ্ঠতম উম্মতরূপে উদ্ভূত হয়েছো, তোমরা ভাল কাজের আদেশ করবে এবং মন্দ কাজ হতে নিষেধ ও আল্লাহকে বিশ্বাস করবে (আলে ইমরান ১১০)।
তারা এমন যুবক যারা রাসূল (ছাঃ)-এ দেখানো পদ্ধতি মোতাবেক মন্দকে পরিবর্তনের চেষ্টা করে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, من رأى منكراً فليغيره بيده ، فإن لم يستطع فبلسانه ، فإن لم يستطع فبقلبه কেউ যদি খারাপ কিছু হতে দেখে তাহলে সে যেন তা হাত দ্বারা বদলিয়ে দেয়, যদি হাত দিয়ে সম্ভব না হয় তাহলে তার কথার মাধ্যমে বদলানোর চেষ্টা করে, যদি তাও না পারে তাহলে অন্তরে পরিবর্তনের কামনা করবে (মুসলিম, মিশকাত হা/৫১৩৭)।
তারা এমন যুবক যারা সত্য কথা বলে এবং সত্যকে গ্রহণ করে। কেননা সত্য ন্যায়পরায়ণতার দিকে পথ দেখায়, আর ন্যায়পরায়ণতা জান্নাতের পথ দেখায়। কোন ব্যক্তি যে সত্য বলে এবং সত্যের অনুসন্ধানে থাকে, সে পরিশেষে আল্লাহর দরবারে সত্যবাদী হিসাবে লিপিবদ্ধ হয়ে যায়।
তারা এমন যুবক যারা সাধারণ মুসলমানদের জন্য কল্যাণ কামনা করে। কেননা তারা রাসূল (ছাঃ)-এর সেই বাণীর প্রতি ঈমান রাখে, যেখানে তিনি বলেছেন- والذي نفسي بيده لا يؤمن أحد حتى يحب لأخيه ما يحب لنفسه ‘তোমাদের মধ্যে কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত সে নিজের জন্য যা পছন্দ করে তা তার অন্য ভাইয়ের জন্য পছন্দ না করে (মুত্তাফাক আলাইহ, মিশকাত হা/৪৯৬১)।
তারা এমন যুবক যাদের আল্লাহর প্রতি এবং নিজ দেশ ও জাতির প্রতি দায়িত্ববোধ রয়েছে। তারা সর্বদা আত্মকেন্দ্রিকতাকে দূরে ঠেলে নিজের ধর্ম, সমাজ ও জাতির কল্যাণ কল্যাণে প্রচেষ্টা চালায়। তারা অন্যের কল্যাণের প্রতি তারা লক্ষ্য রাখে সেভাবেই যেভাবে নিজের কল্যাণের প্রতি লক্ষ্য রাখে।
তারা এমন যুবক যারা কেবল আল্লাহর জন্যই আল্লাহর পথে একনিষ্ঠভাবে সংগ্রাম করে। কোন লোক দেখানো ও সুনাম অর্জনের আকাংখা তাদের থাকে না। তারা আপন শৌর্য-বীর্যের উপর নির্ভরশীল হয় না বা আত্মপ্রসাদে ভুগে না। বরং সবসময় আল্লাহর পথে কেবল আল্লাহরই সাহায্যপ্রার্থী হয়ে জিহাদ করে। আল্লাহর পথে সংগ্রাম চালানোর সময় তারা সম্পূর্ণভাবে দ্বীনের গন্ডিতে আবদ্ধ থাকে। কখনও বাড়াবাড়ি বা শিথিলতা প্রদর্শন করে না। আর ইসলাম ও মুসলমানদের স্বার্থে তারা প্রয়োজনমত নিজের বাকশক্তি, অস্ত্রশক্তি ও ধনসম্পদ ব্যবহার করে সংগ্রাম চালায়।
তারা এমন যুবক যারা চরিত্রবান ও দ্বীনদার। তারা মানুষের চরিত্র সংশোধনকারী। তারা দ্বীনের ব্যাপারে সুদৃঢ়, কোমল ও প্রশস্ত হৃদয়ের অধিকারী, আত্নমর্যাদাবোধসম্পন্ন, স্বচ্ছহৃদয় ও ধৈর্যশীল। তবে এমন বিচক্ষণ যে কোন সুযোগকে নষ্ট করে না এবং বিবেক ও সংস্কারবোধের উপর আবেগকে প্রাধান্য দেয় না।
তারা এমন যুবক যারা সচেতন ও নিয়ন্ত্রিত। যারা কাজ করে প্রজ্ঞার সাথে এবং মৌনভাবে। যাদের কাজে দক্ষতা ও উৎকর্ষতার ছাপ বিদ্যমান। যারা তাদের জীবনের অবসর সময়গুলোকে বিনষ্ট করে না বরং ব্যস্ত রাখে এমন কাজে যা তাদের নিজের জন্য এবং জাতির জন্য উপকার বয়ে আনে।
সাথে সাথে এই যুবকরা নিজের ধর্মীয় মূল্যবোধ, আচার-আচরণ ও চাল-চলনের হেফাযতকারী হয়। আর নিজেদেরকে সর্বান্তকরণে দূরে রাখে কুফরী, নাস্তিকতা, পাপাচার, নাফরমানী, দুশ্চরিত্রতা ও অন্যায় কর্মকান্ড থেকে।
এই শ্রেণীর যুবকরা হল জাতির গর্ব। তারা জাতির জন্য সৌভাগ্য ও জীবনের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠে। জাতীয় মূল্যবোধ তাদের মধ্যে দিয়ে ফুটে উঠে। তারাই তো সেই যুবক যাদের জন্য আমরা অহর্নিশ আল্লাহর কাছে কামনা করি, যেন আল্লাহ তাদের বদৌলতে ইসলাম ও মুসলমানদের চলমান দুরবস্থাসমূহ সংশোধন করে দেন এবং সত্যের পথিকদের পথচলাকে দীপ্তিমান করেন। তারাই তো সেই যুবক যারা দুনিয়া ও আখেরাতের সৌভাগ্যকে ছিনিয়ে আনতে পারে।
বিপথগামী যুবক
এই যুবক এমন যুবক যার আক্বীদা বিভ্রান্ত, আচরণ বেপরোয়া এবং সে আত্নম্ভরিতায় মগ্ন এবং নোংরা কার্যকলাপে নিমজ্জিত। সে অন্যের নিকট থেকে সত্য গ্রহণ করতে আগ্রহী নয় এবং নিজেও বাতিল, অগ্রহণযোগ্য কাজ থেকে নিবৃত হতে রাজী নয়। তার আচার-আচরণ স্বার্থপর, যেন সে কেবল দুনিয়ার জন্য সৃষ্ট হয়েছে এবং দুনিয়াও শুধুমাত্র তার একার জন্যই সৃষ্টি হয়েছে।
এই ধরনের উদ্ধত যুবক কখনও সত্যের প্রতি নমনীয় হয় না এবং বাতিল অপসারণেও তার কোন আগ্রহ থাকে না। সে আল্লাহর হক্ব নষ্ট হল কি না হল সে ব্যাপারে কোন পরওয়া করে না, পরওয়া করে না মানুষের হক্ব নষ্ট হল কিনা সে ব্যাপারেও। এই নৈরাজ্যবাদী যুবক তার চিন্তা-চেতনায় সাজুয্যতা হারিয়ে ফেলেছে। তার সকল কাজে-কর্মে এবং চলার পথে পরিমিতিবোধ খুইয়ে ফেলছে। নিজের সিদ্ধান্তের ব্যাপারে সে এমনভাবে মুগ্ধ হয়ে পড়ে, যেন সত্যই তার কথার উপরে চালিত হয়। সে যেন সকল ভুল-ভ্রান্তিমুক্ত একজন নিষ্পাপ মানুষ। আর যারা তার বিরোধিতা করে তারা যেন সব ভ্রান্তি ও বিচ্যুতির মাঝে পড়ে আছে।
এই যুবক এমন যুবক যে ধর্মীয় ক্ষেত্রে ছিরাতে মুস্তাকীমের পথ থেকে বিচ্যুত, সামাজিক নীতি-ঐতিহ্য হতে পথভ্রষ্ট। অধিকন্তু তার নোংরা অপকর্মগুলি তার কাছে সুশোভিত হয়ে উঠে। তাদের ব্যাপারে এটাই বলা যে, তারা হল ঐ দলের অন্তর্ভুক্ত যারা দুনিয়াবী জীবনে তাদের সকল আমল বরবাদ হওয়ার কারণে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত আমলদাররে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, অথচ তারা ধারণা করে যে তারা সৎকর্ম করছে।
সে নিজেই নিজের জন্য অমঙ্গল এবং সমাজের জন্য আপদ হয়ে দাঁড়ায়। জাতিকে সে টেনে নিয়ে যায় অধঃপতনের অতল তলে। প্রতিবন্ধকতার দেয়াল তুলে দেয় জাতির মান-মর্যাদার উপর। সমাজকে সে এমন এক জীবাণুযুক্ত ও প্রতিকারবিহীন ধ্বংসাত্মক পরিস্থিতির মধ্যে নিক্ষেপ করে যা থেকে কেবল আল্লাহ ইচ্ছা ব্যতীত কেউ উদ্ধার করতে পারে না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সমস্ত কিছুর উপর ক্ষমতাবান।
দিশেহারা যুবক
এমন যুবক যে নানা পথ ও মতের মাঝে উভ্রান্ত-দিশেহারা হয়ে থাকে, অথচ সে হক্বকে চিনেছে ও তাতে প্রশান্তি লাভ করেছে এবং একটি রক্ষণশীল সমাজে লালিত পালিত হয়েছে। তবে সকল দিক থেকে অনিষ্টতার দরজাসমূহ তার জন্য উন্মুক্ত হয়ে রয়েছে। যেমন আক্বীদাকে ঘিরে সন্দেহের আবর্ত, চাল-চলনের অধঃপতন, আমলের বিকৃতি, পূর্বকাল থেকে চলে আসা নীতি-নৈতিকতার গন্ডিমুক্ত হওয়া, বাতিলের নানামুখী স্রোত, বুদ্ধিবৃত্তিক ও মনস্তাত্ত্বিক দুষ্টচক্র ইত্যাদি। বাতিলের এই প্রবল স্রোতের মুখে সে এমন অবস্থায় উপনীত হয় যে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া তার আর গত্যন্তর থাকে না। সে বুঝতে পারে না এই সমস্ত চিন্তাধারা, মূলনীতি ও কর্মপদ্ধতিতে যা কিছু প্রতীয়মান হচ্ছে তা-ই কি সত্য, না কি যে নীতির উপর তার পূর্বপুরুষগণ বা তার রক্ষণশীল সমাজ ছিল তা-ই সত্য? এই গোলকধাঁধাঁয় পড়ে সে দিশেহারা ও উৎকন্ঠিত হয়ে গেছে এবং একবার এটা, আরেকবার ওটাকে প্রাধান্য দিচ্ছে।
এই শ্রেণীর যুবক তার জীবনে একটা নেতিবাচক অবস্থানে থাকে। ফলে সে এমন একজন শক্তিশালী আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের মুখাপেক্ষী হয়, যে তাকে সত্য ও কল্যাণের পথে পরিচালিত করবে। তাই আল্লাহ যখন তার জন্যে একজন উত্তম, প্রজ্ঞাপূর্ণ, জ্ঞানধারী ও চমৎকার পরিকল্পনা সম্পন্ন একজন দাঈকে ন্যস্ত করে দেন, তখনই সেটা তার জন্য সহজ হয়ে যায়।
উপরোক্ত তিন শ্রেণীর মধ্যে এই শ্রেণীর যুবকের সংখ্যাই সমাজে বেশী। তারা ইসলামী সংস্কৃতির কিছু ছোয়া পেয়েছে বটে, কিন্তু ব্যাপকভাবে অন্যান্য দুনিয়াবী শিক্ষা লাভ করেছে যা প্রকৃতপক্ষে বা তাদের ধারণামতে দ্বীনের সাথে সাংঘর্ষিক হয়ে গেছে। ফলতঃ তারা দ্বিমুখী দুই সংস্কৃতি বা সভ্যতার সামনে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে থমকে দাঁড়িয়েছে।
তাদের জন্য এই হতভম্ব অবস্থা হতে নিষ্কৃতি পাওয়া সম্ভব হবে সমগ্র জীবনাচরণে ইসলামী সভ্যতা-সংস্কৃতির বীজ রোপণের মাধ্যমে এবং খুলূছিয়াতসম্পন্ন ওলামায়ে কেরামের নিকট থেকে কিতাবুল্লাহ ও সুন্নাহ মূল উৎস হতে এই সংস্কৃতি শিক্ষালাভের মাধ্যমে। আর এ কাজটি তাদের জন্য খুব কঠিন নয়।
যুবকদের বিভ্রান্ত হওয়া ও তার সমস্যা
যুবকদের বিভ্রান্ত হওয়ার এবং সমস্যায় আপতিত হওয়ার অনেক কারণ রয়েছে। যেমন যখন একজন মানুষ যৌবনে উপনীত হয় তখন তার শারীরিক, মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়। কেননা এসময় সে জীবনের বাড়ন্ত বেলা অতিক্রম করে। ফলে তার মধ্যে পরিবর্তন, পরিবর্ধনটা হয় খুব দ্রুতগতিতে। সুতরাং জীবনের এই পর্যায়ে তার জন্য আত্মনিয়ন্ত্রণের সূত্রগুলি প্রস্ত্তত রাখা এবং তার খামখেয়ালীপনাকে লাগাম পরানো ও ছিরাতুল মুস্তাকীমের দিকে তাকে পরিচালিত করার জন্য হেকমতের সাথে নেতৃত্ব দেয়া অতীব যরূরী।
যুবকদের পথভ্রষ্ট হওয়ার মৌলিক কারণসমূহ
১. অবসর : চিন্তা-চেতনা, বিচারবুদ্ধি ও শারীরিক শক্তি বিনষ্টের জন্য অবসর হল একটি ধংসাত্মক ব্যধি। যেহেতু কর্মতৎপর ও কর্তব্যনিষ্ঠ থাকাটা মানুষমাত্রেই অপরিহার্য। কেননা মানুষের যখন কাজ থাকে না তখন তার চিন্তা-ভাবনায় আলস্য সৃষ্টি হয়, বুদ্ধিমত্তা স্থূল হয়ে পড়ে ও হ্নদয়ের উদ্দীপনা দুর্বল হয়ে পড়ে। আর মনের সে শূন্যস্থান দখল করে নেয় কুমন্ত্রণা ও নোংরা চিন্তা-ভাবনা। ফলে এই শ্বাসরুদ্ধকর কর্মহীন অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে সে কখনো কখনো এসব নিকৃষ্ট কুচিন্তার বাস্তবায়ন ঘটিয়ে ফেলে। এ সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে যা করণীয় তা হল, অবসর সময়কে অলসভাবে না কাটিয়ে নিজের জন্য উপযোগী কোন কাজে ব্যস্ত রাখতে হবে। হতে পারে তা পড়াশোনা, ব্যবসা, লেখনী বা অনুরূপ এমন কিছু যা দিয়ে সে নির্বিঘ্নে অবসর কাটাতে পারে এবং নিজের সফলতা অর্জন ও অপরের সেবার মাধ্যমে সমাজে নিজেকে একজন কর্মঠ ও যোগ্য সদস্য হিসাবে গড়ে তুলতে সক্ষম হবে।
২. পরিবার এবং পরিবারের বাইরে যুবক ও বয়স্কদের মধ্যে সম্পর্কের দূরত্ব ও বিচ্ছিন্নতা : কতিপয় প্রবীণ লোকদের দেখা যায় যারা যুবকদের মাঝে অথবা অন্য কারোর মাঝে ত্রুটি-বিচ্যুতি লক্ষ্য করার পর তাদের সংশোধনের ব্যাপারে নিরাশ হয়ে পড়েন এবং দিশেহারা হয়ে ক্ষান্ত হয়ে যান। তাদের এই মনোভাব যুবকদের অন্তরে ক্রোধ ও অবাধ্যতার জন্ম দেয় এবং তারা ভাল নাকি খারাপ কাজ করছে সে ব্যাপারে সর্বাবস্থায় বেপরোয়া ভাব দেখায়। এসময় বয়স্করা প্রায়শই সব যুবককে এক পাল্লায় বিচার করে বসেন এবং প্রত্যেক যুবক সম্পর্কে এক ধরনের মানসিক সমস্যায় ভুগতে থাকেন। এর ফল দাঁড়ায় এই যে, সমাজটি ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় এবং যুবক ও বয়স্করা প্রত্যেকেই পরস্পরকে হেলাফেলার দৃষ্টিতে দেখে এবং তুচ্ছ জ্ঞান করে। যা অবশেষে এক বিরাট সমস্যার রূপ নিয়ে সমাজকে পরিবেষ্টিত করে রাখে।
এই সমস্যার প্রতিবিধান হল যুবক ও বয়স্ক প্রত্যেকেই নিজেদের মধ্যে বিদ্যমান এই বিচ্ছিন্নভাব ও দূরত্ব দূর করার জন্য প্রচেষ্টা চালাবে। প্রত্যেককে এই বিশ্বাস রাখতে হবে যে, যুবক ও প্রবীণ সকলকে নিয়েই সমাজ একটি অভিন্ন দেহ। যদি তার কোন একটি অঙ্গে ক্ষয় দেখা দেয়, সর্বাঙ্গজুড়ে তা বিস্তৃত হয়। একইভাবে প্রবীণদের বুঝতে হবে যে, যুবকদের প্রতি তাদের স্কন্ধে অনেক বড় দায়িত্ব রয়েছে। তাই এসব যুবকদের সংশোধনের স্বার্থে হৃদয়ে চাপা হতাশাগুলোকে দূরীভূত করতে হবে। আর জেনে রাখতে হবে নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান। কত পথহারাকে তিনি সুপথ দেখিয়েছেন, যারা পরে নিজেরাই মানুষের জন্য হেদায়াত ও সংস্কারের জন্য আলোকবর্তিকায় পরিণত হয়েছে।
আর যুবকদের জন্য অবশ্য করণীয় হল প্রবীণদের প্রতি তাদের অন্তরে সম্মানের একটা স্থান রাখা। তাদের উপদেশকে গুরুত্ব সহকারে নেয়া এবং তাদের দিক-নির্দেশনা অনুযায়ী চলা। কেননা জীবনের বাস্তবতা থেকে এবং অভিজ্ঞতা থেকে তারা যা সঞ্চয় করেছেন, যুবকদের তা নেই। আর এবাবে যখন প্রবীণদের প্রজ্ঞা ও নবীনদের শক্তির মাঝে সুসমন্বয় ঘটবে তখনই আল্লাহর ইচ্ছায় সমাজ সমৃদ্ধির পানে ধাবিত হবে।
৩. পথভ্রষ্ট লোকজনের সাথে চলা-ফেরা ও সখ্যতা রাখা : এই বিষয়টি যুবকদের মস্তিষ্কে, চিন্তা-চেতনা জুড়ে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। এজন্যই মহানবী (ছাঃ) বলেছেন المرء على دين خليله فلينظر أحدكم من يخالل ‘প্রত্যেক ব্যক্তি তার বন্ধুর বৈশিষ্ট্যে প্রভাবিত হয়। অতএব তোমাদের উচিৎ কার সাথে বন্ধুত্ব করছ সে ব্যাপারে খেয়াল করা (আহমাদ, আবুদাউদ, তিরমিযী, মিশকাত হা/৫০১৯)।
তিনি আরও বলেছেনঃ مثل الجليس السوء كنافخ الكير : إما أن يحرق ثيابك ، وإما أن تجد منه رائحة كريهة ‘খারাপ বন্ধুর উপমা হচ্ছে কামারের হাপরে ফুঁক দানকারীর ন্যায়। হয় তা তোমার কাপড়কে পুড়িয়ে দিবে অথবা তা হতে তুমি দুর্গন্ধ পাবে’ (বুখারী হা/২১০১ ও ৫৫৩৪, মুসলিম, হা/২৬২৮, মিশকাত হা/৫০১০)।
এর প্রতিবিধান হল, একজন যুবককে এমন কারো সঙ্গ বেছে নিতে হবে যে হবে কল্যাণকামী, সৎ ও বুদ্ধিমান, যেন তার গুণাবলী থেকে সে উপকৃত হতে পারে। এমনিতেই মানুষ তাদের সহচরদের সাথে উঠা-বসা করার পূর্বেই তাদের বাহ্যিক হাল-চাল ও সুখ্যাতি দেখে আকৃষ্ট হয়ে যায়। যদি সেই সহচরগণ হয় চরিত্রবান, মহৎ ও সরল-সঠিক দ্বীনের উপর প্রতিষ্ঠিত, যদি হয় সুনামের অধিকারী, তবে তারাই হল সেই ইপ্সিত, বহুকাঙ্খিত ও গণীমতের সম্পদতুল্য মানুষ, যাদেরকে আঁকড়িয়ে ধরে রাখা আবশ্যক। আর যদি অন্যথা হয়, তবে তাদের থেকে সতর্ক দূরত্ব বজায় রাখা অপরিহার্য যেন তাদের মিষ্টি বাকচাতুর্যে এবং বাহ্যিক চাকচিক্যে ধোঁকা না খেতে হয়। কেননা এইসব খারাপ লোক ধোঁকা-প্রবঞ্চনা ও ভ্রষ্টপথ অনুসরণের মাধ্যমে সহজ-সরল জনসাধারণকে নিজেদের দিকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা চালায়। এর মাধ্যমে তারা তাদের দলভারী করতে চায় এবং তাদের ভিতরকার নিকৃষ্ট দিকগুলো ঢেকে রাখে। কবি কতই না চমৎকারভাবে বলেছেন,
أبل الرجال إذا اردت إخائهم وتوسمن أمورهم وتفقد
فإذا ظفرت بذي اللبابة والتقى فيه اليدين قرين عين فاشدد
তুমি যাদের সাথে বন্ধুত্ব করতে চাও তাদেরকে আগে পরীক্ষা করে নাও আর তাদের এমন কর্মকান্ডকে চিহ্নিত কর যা তোমার মাঝে নেই।
অতঃপর যখন তুমি কাউকে পাও বুদ্ধিমান, তাক্বওয়াশীল ব্যক্তি হিসাবে যার রয়েছে চক্ষুশীতলকারী বন্ধুত্বের বাড়ানো দু’খানা হাত, তখন সে বন্ধুত্বকে অাঁকড়িয়ে ধরবে।
৪. ধ্বংসাত্মক বই-পুস্তক ও পত্র-পত্রিকা অধ্যয়ন করা : এ সকল বই-পত্র মানুষকে তার ধর্ম ও ঈমান-আক্বীদা সম্পর্কে সন্দিহান করে তোলে, যা তাদেরকে পরিচ্ছন্ন চরিত্র হতে অপবিত্র নিকৃষ্ট চরিত্রের দিকে ঠেলে দেয় যা খুব সহজেই তারা কুফরী ও ঘৃণ্য পাপে নিক্ষেপ করে। সুতরাং যদি যুবকদের মাঝে সত্য-মিথ্যা ও উপকারী-অপকারী বস্ত্তর মাঝে পার্থক্য বুঝতে পারার মত দ্বীনী সংস্কৃতির গভীরতা না থাকে এবং অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন চেতনার সুদৃঢ় প্রতিরক্ষা না থাকে, তবে তারা এসব বই-পত্র পড়ে পথভ্রষ্ট হতে বাধ্য। এই ধরনের বই-পুস্তক অধ্যয়ন যুবকদেরকে পতনের শেষপ্রান্তে নিয়ে যায়। কেননা যুবকদের বিবেক-বুদ্ধির উর্বরভূমিতে কোন রকম প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই এসব বই-পুস্তকের চিন্তাধারাসমূহ আক্রমণ করে এবং মজবুতভাবে গেড়ে বসে যাবতীয় শিকড় ও ডাল-পালা নিয়ে। আর এভাবে তাদের জীবন ও জ্ঞানের মতিগতিকে ভিন্ন পথে প্রবাহিত করে।
এই সমস্যার সমাধান হল, এ জাতীয় বই-পুস্তক থেকে দূরে থেকে ঐ সকল বই-পুস্তক অধ্যয়ন করতে হবে, যা হৃদয়ে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ভালবাসার বীজ বপন করে। ঈমান ও সৎআমলের প্রতিফলন ঘটায়। আর বিশেষত এর উপরই ধৈর্য ধরে টিকে থাকতে উদ্বুদ্ধ করে। নতুবা হৃদয়জগতে অচিরেই আগের পড়া বইগুলো পুনরায় পড়ার জন্য তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করতে পারে। ফলে অন্যান্য উপকারী গ্রন্থসমূহ পাঠের বিষয়টি তার কাছে বিরক্তিকর ও বোঝাস্বরূপ মনে হতে পারে এবং আল্লাহর আনুগত্যে টিকে থাকার প্রচেষ্টায় তার সংযমের বাঁধ নস্যাত হয়ে যেতে পারে। যার শেষ পরিণাম হতে পারে আমোদ-প্রমোদ আর বিনোদনে নিজেকে ব্যস্ত রাখা।
উপকারী গ্রন্থসমূহের মাঝে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল, আল্লাহর কিতাব, আর যা ওলামাগণের লিখিত ছহীহ সুন্নাহভিত্তিক ও সঠিক বুদ্ধিবৃত্তিক তাফসীর। তেমনিভাবে মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর হাদীছ। অতঃপর সে সব গ্রন্থসমূহ যা লিখেছেন আলেমগণ এই দু’টি উৎস অবলম্বনে। (ক্রমশঃ)
মুহাম্মাদ বিন ছালেহ আল-উছায়মীন
অনুবাদ : আহমাদুল্লাহ