অহি-র বিধান প্রতিষ্ঠাই আমাদের শপথ
অধ্যাপক আকবার হোসাইন
মানব মনের স্বাভাবিক প্রশ্ন
আচ্ছা এই দুনিয়ার জীবনটাই কি একমাত্র জীবন, না এর পরেও কোন জীবন আছে? অর্থাৎ মরণের সাথে সাথেই কি এই মানব জীবনের পরিসমাপ্তি, না তার পরও জীবনের জের টানা হবে? মানব মনের এ এক স্বাভাবিক প্রশণ এবং সকল যুগেই এ প্রশ্নে দ্বিমত হয়েছে এবং এর ভিত্তিতেই গড়ে উঠেছে দুই বিপরীতমুখী সমাজ ব্যবস্থা।
মানুষ ভূমিষ্ঠ হবার পর কিছুকাল এই দুনিয়ায় অবস্থান করে এবং তারপর বিদায় গ্রহণ করে। এ এক চিরন্তন রীতি। এতে কোন পরিবর্তন নাই। তবে এ অবস্থান কারো জন্যে কয়েক মুহূর্ত মাত্র। কারো বা কয়েকদিন, কারো বা কয়েক মাস, কারো বা কয়েক বছর। আবার কেউ শতাধিক বছরও বেঁচে থাকে। কেউ আবার অতি বার্ধ্যক্যে শিশুর চেয়েও অসহায় অবস্থায় জীবনযাপন করে। বেঁচে থাকাকালীন মানুষের জীবনে থাকে কত আশা-আকাংখা, কত রঙ্গিন স্বপ্ন। কারো জীবন ভরে উঠে অফুরন্ত সুখ-সাচ্ছন্দ্যে, লাভ করে জীবনকে পরিপূর্ণরূপে উপভোগ করার সুযোগ-সুবিধা ও উপায়-উপকরণ। ধন-দৌলত, মান-সম্মান, যশ ও গৌরব-আরও কত কি? অবশেষে একদিন সব কিছু ফেলে, সকলকে কাঁদিয়ে তাকে চলে যেতে হয় এই দুনিয়া ছেড়ে। তার ক্ষমতা, প্রভাব-প্রতিপত্তি, বাদশাহী, পরিষদবৃন্দ, উজির নাজির, বন্ধু-বান্ধব ও গুণগ্রাহীবৃন্দ, অঢেল ধন সম্পদ কেউ তাকে ধরে রাখতে পারে না। অতীতেও কেউ কাউকে ধরে রাখতে পারেনি আর ভবিষ্যতেও কেউ পারবেনা। রাজা-প্রজা, ধনী-গরীব, সাদা-কালো সবাইকেই স্বাদ গ্রহণ করতে হয় মরণের।
কারো কারো জীবনে নেমে আসে একটানা দুঃখ-দৈন্য। অপরের অবহেলা, অত্যাচার-উৎপীড়ন, অবিচার-নিষ্পেষণ। সারা জীবনভর তাকে সবকিছুতেই মুখ বুজে নীরবে সয়ে যেতে হয়। অবশেষে সমাজের এই নির্মম বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে সেও একদিন এই দুনিয়া থেকে বিদায় নেয়। আবার এমনটিও দেখা যায় যে, এক ব্যক্তি অতিশয় সৎ জীবনযাপন করছে। পরস্বার্থহরণ, পরনিন্দা, হিংসা, পরশ্রীকাতরতা তার স্বভাবের সম্পূর্ণ বিপরীত। ক্ষুধার্তকে অন্নদান, বিপন্নের সাহায্য, ভালো কথা, ভালো কাজ ও ভালো চিন্তা তার গুণাবলীর অন্যতম। কিন্তু সে তার জাতির কাছ থেকে পেল চরম অনাদর, অত্যাচার ও অবিচার। অবশেষে নির্মম নির্যাতনের মধ্যে কারাপ্রাচীরের অন্তরালে অথবা ফাঁসীর মঞ্চে তার জীবনলীলার অবসান হয়। এ জীবনে সে তার সত্য ও সুন্দরের কোন পুরষ্কারই পেল না। তাহলে কি তার মানবতা শুধু আর্তনাদ করেই ব্যর্থ হবে? আবার এমন দৃষ্টান্তও পাওয়া যায় ভুরি ভুরি যে, কোন ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ সত্যের আওয়াজ তুলতে গিয়ে, সত্যকে প্রতিষ্ঠা করার সংগ্রাম করতে গিয়ে অসত্যের পূজারী, জালেম শক্তিধরকে করেছে ক্ষিপ্ত, জালেমদের ক্ষমতার মসনদকে করেছে কম্পিত ও টলটলায়মান। অতঃপর জালেম তার প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে গিয়ে সত্যের পতাকাবাহীকে করেছে বন্দী। বন্দীশালায় তার উপর চালিয়েছে নির্মম নির্যাতনের ষ্টীমরোলার, আঘাতে আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত ও জর্জরিত করেছে তার দেহ। তা সত্ত্বেও তাকে বিচলিত করা যায়নি সত্যের পথ থেকে। তার অত্যাচার নির্যাতনের কথা যার কানেই গেছে তার শরীর রোমাঞ্চিত হয়েছে। হয়তো সমবেদনায় দু ফোঁটা চোখের পানিও গড়িয়ে পড়েছে।
যারা ন্যায়, সত্য ও সুন্দরের পূজারী তারা কি চায় না যে, নির্যাতিত ব্যক্তি পুরস্কৃত হোক এবং জালেম স্বৈরাচারীর শাস্তি হোক? কিন্তু কখন এবং কিভাবে?
আবার এমন দৃষ্টান্তও রয়েছে অসংখ্য যে, এক ব্যক্তি স্ত্রী-পুত্র পরিজন নিয়ে সুখে জীবনযাপন করছে। সে কারো সাথে অন্যায় করেনি কোনদিন। হঠাৎ একদিন একদল সশস্ত্র দুর্বৃত্ত তার বাড়ী চড়াও করল অন্যায়ভাবে। গৃহস্বামী ও তার পুত্রদেরকে হত্যা করলো, নারীদের উপর চালালো পাশবিক অত্যাচার। গৃহের ধন-সম্পদ লুণ্ঠন করলো। অবশিষ্টের উপর করলো অগ্নিসংযোগ। ঘটনাটি যেই শুনলো সেই বড় আক্ষেপ করলো। সকলের মুখে একই কথা, আহ! এমন নির্মম নিষ্ঠুর আচরণ? এর কি কোন বিচার নেই?
হয়তো তার বিচারের কোন সম্ভাবনাও নেই। কারণ বিচারের ভার যাদের হাতে, তাদের হয়তো সংযোগ সহযোগিতা রয়েছে এইসব নরপিশাচদের সাথে। তাহলে কি মানব সন্তানের উপর এমনি অবিচার অত্যাচার চলতেই থাকবে? বিচার পাবার আগেই তো উক্ত নির্যাতিত মানব সন্তানগুলো এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে। এখন তারা কোথায়? নির্যাতিত আত্মাগুলো কি মহাশূন্যে বিলীন হয়ে গেছে? নিঃশেষ হয়ে গেছে, নাকি এখনো তারা আর্তনাদ করেই ফিরছে? তাদের মৃত্যুর পরের অধ্যায়টা কেমন? পরিপূর্ণ শূন্যতা নাকি অন্যকিছু? আর জালেম নরপিশাচ যারা, যাদের কোন বিচার হলো না এই দুনিয়ায়, তারারও তো একদিন মৃত্যুবরণ করবে। মৃত্যুর পরে কি তাদের কিছুই হবে না? তাদের এত বড় অন্যায়ের শাস্তির কোন ব্যবস্থা কি থাকবেনা?
আবার দেখুন, এ দুনিয়ার বুকে কাউকে তার অপরাধের শাস্তি এবং মহৎ কাজের পুরষ্কার দিতে চাইলেই কি তা ঠিকমতো দেয়া যায় বা সম্ভব?
মনে করুন এক ব্যক্তি শতাধিক মানব সন্তানকে অন্যায়ভাবে হত্যা করেছে। তার অত্যাচারে শত শত পরিবার ধ্বংস হয়েছে। অবশেষে একদিন তাকে আসামীর কাঠগড়ায় দাড় করানো হলো। এখানে পৌঁছে সে আইনের চোরা পথে অথবা অন্য কোন অসৎ পন্থায় বেঁচেও যেতে পারে। যদি তার বাঁচার কোন পথই খোলা না থাকে তাহলে আপনি থাকে শাস্তি দিবেন। কিন্তু কি শাস্তি? সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড হতে পারে। প্রকৃত খুনীর মৃত্যুদন্ড কিন্তু অনেক সময় মওকুফও হয়ে যায়। সর্বোচ্চ ক্ষমতাসীন ব্যক্তি উক্ত খুনীকে তার নিজের স্বার্থে ব্যবহারের জন্যে মুক্তও করে দিতে পারে। আর যদি মৃত্যুদন্ড কার্যকরই হয়, তাহলে শতাধিক ব্যক্তি হত্যার দায়ে কি একটিমাত্র মৃত্যুদন্ড? এ দন্ড কি তার জন্যে যথেষ্ট হবে? কিন্তু এর বেশী কিছু করার শক্তিও যে আপনার নেই।
অপরদিকে একব্যক্তি তার সারা জীবনের চেষ্টা-সাধনায়, অক্লান্ত শ্রম ও ত্যাগ-তিতীক্ষায় একটা গোটা জাতিকে মানুষের গোলামীর নাগ-পাশ থেকে মুক্তও করে এক সর্বশক্তিমান সত্তার সুবিচারপূর্ণ আইনের অধীন করে দিল। তাদের জন্যে একটা সুন্দর ও সুখকর সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে দিল। তারা হলো সুখী, সমৃদ্ধ ও উন্নত। তাদের জান-মাল, ইজ্জত-আব্রু হল সম্পূর্ণ নিরাপদ। এমন মহান ব্যক্তিকে কি যথাযোগ্য পুরষ্কারে পুরস্কৃত করা যায়?
উপরোক্ত ব্যক্তিদের জীবনের জের যদি মৃত্যুর পরে টানা হয় এবং কোন এক সর্বশক্তিমান সত্তা যদি তাদের উভয় শ্রেণীকে যথাযোগ্য দন্ডে দন্ডিত ও পুরষ্কারে পুরস্কৃত করেন-যাদের যেমনটি প্রাপ্য- তাহলে কি সেটা সত্যিকার ন্যায় বিচার হয়না? তাহলে বিবেককে জিজ্ঞেস করে দেখুন, মৃত্যুর পরের জীবনটাও কি অপরিহার্য নয়? এটাই সেই স্বাভাবিক প্রশ্ন যা আবহমানকাল থেকে মানব মনকে বিব্রত ও বিচলিত করে এসেছে। এর সঠিক জবাব মানুষ চিন্তা-গবেষণা করে খুঁজে পায়না, পেতে পারে না। এর সঠিক জবাব পেতে হবে এক সর্বজ্ঞ ও নির্ভুল সত্তার কাছ থেকে।
কি সেই নির্ভুল জ্ঞান যেখান থেকে পাওয়া যাবে মানব মনের এই স্বাভাবিক প্রশ্নের উত্তর?
যেকোনো প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্যে একমাত্র যে জিনিসটার দরকার তা হল জ্ঞান। জ্ঞান ব্যতিরিকে কেউ কখনো কোন প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পারে না বা পেতে পারে না। জ্ঞানের উৎস প্রধানত দুইভাবে বিভক্ত-
ক) পঞ্চেন্দ্রিয়---ইন্দ্রিয়ভিত্তিক ও ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান।
খ) অহী---আল্লাহ্ তায়ালার পক্ষ থেকে নবী ও রাসুলগণ কর্তৃক প্রাপ্ত নির্ভুল অভ্রান্ত জ্ঞান। যদিও যুগে যুগে কিছু মানুষ এই জ্ঞানকে অস্বীকার করতে চেয়েছে এবং এখনো করছে।
বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমেও জ্ঞান লাভ করতে পারেন তবে তার মুলেও রয়েছে ইন্দিয়নিচয়। সাক্ষ্য প্রমাণাদির দ্বারাও জ্ঞানলাভ করা যায়। কিন্তু সে জ্ঞানও সাক্ষ্যদাতার ইন্দ্রিয়লব্ধ। তেমনি ইতিহাস পাঠে যে জ্ঞানলাভ করা যায় তাও ইতিহাসলেখকের চোখে দেখা অথবা কানে শোনা জ্ঞান। তার অর্থ ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান। এ জ্ঞানও সবসময় নির্ভুল হয়না। সত্যর বিপরীত সাক্ষ্যও দেয়া হয়ে থাকে এবং সত্যকে বিকৃত করেও ইতিহাস লেখা হয়ে থাকে। তথাপি সত্য-মিথ্যা জ্ঞানের উৎসই এগুলোকে বলতে হবে।
এখন পরকাল সম্পর্কে যে জ্ঞান অর্থাৎ পরকাল আছে বলে যে জ্ঞান অথবা পরকাল নেই বলে যে জ্ঞান, তার কোনটাই ইন্দ্রিয়লব্ধ হতে পারেনা। কারণ মৃত্যু যবনিকার ওপারে গিয়ে দেখে আসার সুযোগ কারো হয়নি অথবা মৃত আত্মার সাথে সংযোগ রক্ষা করারও কোন উপায় নেই, যার ফলে কেউ একথা বলতে পারে না যে, পরকাল আছে কি নেই।
কেউ কেউ বিজ্ঞানীর মতো ভান করে বলেন যে, পরকাল আছে তা যখন কেউ দেখেনি, তখন কিছুতেই তা বিশাস করা যায়না। কিন্তু তার এ উক্তি মোটেই বিজ্ঞানসুলভ ও বিজ্ঞোচিত নয়। কারণ কেউ যখন মৃত্যুর পরপারে গিয়ে সেখানকার অবস্থাটা দেখে আসেনি তখন কি করে বলা যায় যে পরকাল নেই?
একটি বাক্সের ভিতর কি আছে কি নেই, তা আপনি বাক্সটি খুলে দেখেই বলতে পারেন। কিন্তু বাক্সটি না খুলেই কি করে আপনি বলতে পারেন যে, বাক্সটিতে কিছু নেই, আপনি শুধু এতটুকু বলতে পারেন, বাক্সটিতে কিছু আছে কি নেই তা আমার জানা নেই।
একজন প্রকৃত বিজ্ঞানী তার পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ দ্বারা কোন কিছুর সত্যাসত্য নির্ণয় করতে পারেন (তবে অনেক সময় তা ভুলও হতে পারে)। কিন্তু তার সে পরীক্ষা পর্যবেক্ষণের পূর্বে কোন কিছুর অস্তিত্ব সম্পর্কে হাঁ বা না কিছুই বলতে পারেন না। তাঁকে এ কথা বলতেই হয়-এ সম্পর্কে আমার কোন কিছু জানা নেই। অতএব সত্যিকার বৈজ্ঞানিকের উক্তি হবে- পরকাল আছে কি নেই-তা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা সম্ভব হয়নি। অতএব আছে বললে যেমন ভুল হবে, ঠিক তেমনি নেই বললেও ভুল হবে।
উপরের আলোচনা থেকে জানা গেল জ্ঞানের প্রথম উৎস পঞ্চইন্দ্রিয় পরকাল সম্পর্কে আমাদের কোন ধারণাই দিতে পারলো না। এখন রইল দ্বিতীয় সূত্র অহী। দেখা যাক অহী আমাদের কি জ্ঞান দান করে।
অহী--আল্লাহ্ তাআলার পক্ষ থেকে নবী ও রসূলগণ কর্তৃক প্রাপ্ত নির্ভুল অভ্রান্ত জ্ঞান
পৃথিবী ও আকাশমন্ডলী এবং উভয়ের মধ্যে যা কিছু আছে, এমনকি ভূগর্ভে ও সমুদ্রগর্ভে যা কিছু আছে, সবেরই একজন সৃষ্টিকর্তা আছেন। তিনিই সর্বশক্তিমান আল্লাহ্ তাআলা। মানুষ সৃষ্টি করার পর তাদের সঠিক জীবনবিধান সম্পর্কে তাদেরকে জানাবার জন্যে তিনি যুগে যুগে বিভিন্ন দেশ ও জাতির মধ্যে নবী ও রাসূল পাঠিয়েছেন। বলা বাহুল্য নবী ও রসূলগণ আমাদের মতই মানুষ ছিলেন। তবে আল্লাহ্ তাআলা সমাজের উৎকৃষ্ট মানুষদেরকেই নবী ও রাসূল হিসেবে বেছে নিয়েছেন। নবী ও রাসূলদের কাছে আল্লাহ্ তায়ালা যে জ্ঞান প্রেরণ করেছেন তাঁকে বলা হয় অহীর জ্ঞান। এ জ্ঞান নবী ও রাসূলগণ সরাসরি আল্লাহর কাছ থেকে লাভ করতেন, অথবা ফেরেশতা জিবরাঈল (আঃ) এর মাধ্যমে অথবা স্বপ্নযোগে লাভ করতেন। এ জ্ঞান যেহেতু আল্লাহর কাছ থেকে লাভ করা, তাই তা একেবারে অভ্রান্ত ও মোক্ষম সত্য।
এ দুনিয়াতে প্রথম নবী ছিলেন আদিমানব হযরত আদম (আঃ)। সর্বশেষ নবী হচ্ছেন হযরত মুহাম্মদ (ছাঃ)। তবে সর্বমোট এক লক্ষ চবিবশ হাজার নবী (যাদের তিনশত তেরজন রাসূলও ছিলেন), মতান্তরে কিছু কম বা বেশী এই পৃথিবীতে আগমন করেছেন। কিছু সংখ্যক নবী ও রাসূলের নাম পবিত্র কোরআনে উল্লেখ আছে। আবার অনেকের নাম উল্লেখ নেই। এ কথা পবিত্র কোরআনেই বলে দেয়া আছে।
সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (ছাঃ)সহ আরও যত নবী রাসূল এই পৃথিবীতে এসেছেন তাদের প্রত্যেকেই পরকাল সম্পর্কে একই মতবাদ পেশ করেছেন। পরকাল সম্পর্কে সকল নবী ও রাসূলদের উক্তির মধ্যে সামান্যতম মতভেদ নেই। তারা সকলেই একই কথা বলেছেন। মনে রাখতে হবে যে সকল নবী ও রাসূল একই যুগের এবং একই জনপদের লোক ছিলেন না যে, তারা একটি সম্মেলন করে, বহু আলোচনার পরে একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। সাধারণত একজন নবী বা রাসুলের মৃত্যুর পর তার শিক্ষা ও আদর্শ মানুষ একেবারে ভুলে গিয়ে সেই আদর্শ থেকে বিচ্যুত হওয়ার পর আরেকজন নবী বা রাসূল প্রেরিত হয়েছেন। হযরত ঈসা (আঃ)-এর মৃত্যুর ছয়শত বছর পর শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (ছাঃ)-এর আবির্ভাব হয়। মুষ্টিমেয় কয়েকজন ব্যতীত একজন নবী বা রাসূলের সাথে অন্য নবী বা রাসূলের সাক্ষাত হয়নি। কিন্তু বিভিন্ন সময় ও বিভিন্ন যুগের মানুষ হওয়া সত্ত্বেও তারা সকলেই একই কথা বলেছেন। তার কারণ এই যে তারা মানুষের কাছে যে বাণী বা আদর্শ প্রচার করেছেন, তা তাঁদের মনগড়া কথা ছিল না। একমাত্র আল্লাহ্ প্রদত্ত জ্ঞানই তারা মানুষের কাছে পরিবেশন করেছেন। আর আল্লাহ্ প্রদত্ত জ্ঞান থেকেই তারা পরকাল সম্পর্কে অভিন্ন মতবাদ পেশ করেছেন। এ ছাড়া যে আর কোন ভাবেই তা সম্ভব নয় তা একজন পাগলেও মেনে বাধ্য হবে যদি না সে হঠকারী এবং চরম মিথ্যাবাদী না হয়।
যেকোনো প্রশ্নের নির্ভুল উত্তর একটিই হয়ে থাকে
এ কথা সর্ববাদিসম্মত যে সকল প্রশ্নের উত্তর হ্যা বা না দিয়ে অথবা একটি মাত্র উত্তর থাকে সেই সব প্রশ্নের নির্ভুল উত্তর শুধুমাত্র একটিই হয়ে থাকে। ভুল উত্তর অসংখ্য এবং ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। কেননা যারা সঠিক উত্তর দিতে ভুল করে তাঁদের মাঝে চিন্তার কোন ঐক্য থাকে না। কোন নির্ভুল সূত্র থেকে তাঁদের চিন্তা প্রবাহিত হয় না। তাই আপনি যদি একটি ক্লাসের সকল ছাত্রদেরকে একটি অংক কষতে দেন তাহলে দেখবেন যারা সঠিক উত্তর দিয়েছে তাঁদের সকলের উত্তর একই রকম হয়েছে। অপরদিকে যারা ভুল করেছে তাঁদের সকলের উত্তর প্রায় ভিন্ন ভিন্ন। কারণ তাঁদের উত্তর সঠিক জ্ঞানের ভিত্তিতে হয়নি।
আর তাই একথা সন্দেহাতীতভাবে বলা যায় যে, পরকাল আছে নাকি নাই, সে প্রশ্নের একমাত্র সঠিক জবাব দিয়েছেন আল্লাহর নবী ও রাসূলগণ। তাঁদের জবাব সঠিক এই জন্যে যে তাঁদের সকলের জবাব হুবহু একই রকম হয়েছে। বিন্দুমাত্র কোন মতভেদ ছিলনা। আর এর সঠিকতা ও সত্যতার কারণ ছিল যে, তারা যা বলেছেন তা তাঁদের মনগড়া কোন জ্ঞান ছিলনা বরং তা ছিল আল্লাহ্ প্রদত্ত জ্ঞান।
অতএব উপরের আলোচনা থেকে এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে পরকাল অবশ্যই আছে এবং তার সত্যিকার রূপ হচ্ছে নবী ও রাসূলগণ যে রূপে বর্ণনা করেছেন। তার পরেও যদি কেউ পরকালকে অস্বীকার করতে চায় তাহলে তাঁকে হঠকারী আর চরম মিথ্যাবাদী ছাড়া কিছুই বলার থাকে না।
৫. পরকালের বিরোধিতা
প্রত্যেকই যুগেই অজ্ঞ মানুষেরা পরকালের তীব্র বিরোধিতা করেছে। তারা কিছুতেই বিশ্বাস করতে চায়নি যে, মৃত্যুর পর মানুষ আবার পুনর্জীবন লাভ করবে। কিছু কিছু মানুষের একজন সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস থাকলেও তার গুণাবলী ও পরিচয় সম্পর্কে তাঁদের ধারণা ছিল ভ্রান্ত ও নিকৃষ্ট। তাই তারা পরকালকে বিশ্বাস করতে পারেনি। মৃত্যুর পর মানুষের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, অস্থি, চর্ম, মাংস, প্রতিটি অনু-পরমাণু ধ্বংস ও ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে শূন্যে বিলীন হয়ে যায়। অথবা মৃত্তিকা এ সব কিছুকেই ভক্ষণ করে। অতঃপর তা আবার কি করে পূর্বের ক্ষয়প্রাপ্ত দেহ ও জীবন লাভ করবে? এ ছিল তাঁদের জ্ঞান-বুদ্ধির অতীত। তার জন্যে প্রত্যেক নবী রাসূল পরকালের কথা বলে যখন মানুষের দায়িত্বববোধ জাগ্রত করার চেষ্টা করেছেন, তখন জ্ঞানহীন লোকেরা তাঁদেরকে পাগল বলে অভিহিত করেছে। তাঁদের মতবাদ শুধু তারা মানতেই অস্বীকার করেনি, বরঞ্চ সে মতবাদ প্রচারের অপরাধে তাঁদেরকে নির্যাতিত, নিগৃহীত করেছে নানানভাবে।
কেন কিছু মানুষ যুগে যুগে পরকালের বিরোধিতা করেছে এবং এখনো করছে ?
পরকালের প্রতি বিশ্বাস এত মারাত্মক ছিল কেন? এ মতবাদের প্রচার বিরুদ্ধবাদীদেরকে এতটা ক্ষেপিয়ে তুলেছিল বা তুলে কেন? এ মতবাদের প্রচারের ফলে তাঁদের কোন সর্বনাশটা হয়েছিল বা হয় যার জন্যে তারা এ মতবাদকে সহ্য করতে পারেনি বা পারেনা? এর পশ্চাতে ছিল এক মনস্তাত্ত্বিক কারণ। তাহলো এই যে, যারা পরকালে বিশ্বাসী তাঁদের চরিত্র, কার্যকলাপ, আচার-আচরণ, রুচি ও মননশীলতা, সভ্যতা ও সংস্কৃতি হয় এক ধরনের। অন্যদিকে যারা পরকালে অবিশ্বাসী তাঁদের এসব কিছুই হয় সম্পূর্ণ বিপরীত ধরনের। এ এক পরীক্ষিত সত্য।
পরকাল বিশ্বাসীদের এমন এক মানসিকতা গড়ে উঠে যে, সে প্রতিমুহূর্তে মনে করে তার প্রতিটি গোপন ও প্রকাশ্য কাজের জন্যে তাঁকে মৃত্যুর পর আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। তার প্রতিটি কথা ও কাজ নির্ভুলভাবে এক অদৃশ্য শক্তি দ্বারা লিপিবদ্ধ হচ্ছে বলে তার দঢ় বিশ্বাস। তার কোন একটিও গোপন করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। তার প্রতিটি মন্দ কাজের জন্যে তাঁকে জবাবদিহি করতে হবে, শাস্তি পেতে হবে যদি না তার প্রভু আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁকে ক্ষমা না করে দেন। এ হচ্ছে তার দৃঢ় বিশ্বাস, দৃঢ় প্রত্যয়। তাই সে বিরত থাকার প্রাণপণ চেষ্টা করে সকল মন্দ কাজ থেকে।
ঠিক এর বিপরীত চরিত্র হয় পরকালে অবিশ্বাসীদের। যেহেতু তাঁদের ধারণা বা বিশ্বাস অনুযায়ী মৃত্যুর পরে আর কোন কিছুই নেই, তাই তাঁদের কৃতকর্মের জন্যে তাঁদেরকে কারো কাছে জবাবদিহি করতে হবে না। দুনিয়ার জীবনে তারা যদি চরম লাম্পট্য ও যৌন অনাচার করে, তারা যদি হয় দস্যু ও লুণ্ঠনকারী, তারা যদি মানুষকে তার ব্যক্তিস্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করে পশুর চেয়ে হীন জীবনযাপনে বাধ্য করে, তবুও তাঁদের কোন ভয়ের কারণ নেই। কারণ তাঁদের বিশ্বাস এসবের জন্যে তাঁদেরকে মৃত্যুর পরে কারো কাছে জবাবদিহি করতে হবে না। তাঁদের মতে মৃত্যুর পরে তো আর কিছুই নেই। না নতুন জীবন, না হিসাব-নিকাশের ঝঞ্জাট- ঝামেলা।
তারা একজন সৃষ্টিকর্তা ও পরকাল অস্বীকার করে এক নতুন মতবাদ গড়ে তুলেছে। সেটা হল এই যে, যেহেতু সৃষ্টিজগতের কোন স্রষ্টা নেই, পরকাল বলে কিছু নেই, অতএব জীবন থাকতে এ দুনিয়াকে প্রাণভরে উপভোগ করতে হবে। কারণ মৃত্যুর সাথে সাথে তো সব কিছুই শেষ হয়ে যাবে। অতএব খাও, দাও আর জীবনকে উপভোগ কর- (Eat, Drink and Be Merry)। আরও বলে থাকে যে, দুনিয়ার জীবনটা হল একমাত্র বেঁচে থাকে সংগ্রাম- (A Struggle for existence)। যে সবল ধূর্ত ও বুদ্ধিমান বেঁচে থাকার অধিকার একমাত্র তারই আছে, মানে ডারউইনের Survival of the fittest। আর যে দুর্বল, হোক সে সৎ ও ন্যায়পরায়ণ, তার বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই!!!
স্রষ্টা ও পরকাল স্বীকার করলেই প্রবৃত্তির মুখে লাগাম লাগাতে হবে, স্বেচ্ছাচারিতা ও উচ্ছৃঙ্খলতা বন্ধ করতে হবে এবং অন্যায় ও অসদুপায়ে জীবনকে উপভোগ করা যাবে না। উপরন্তু জীবনকে করতে হবে সুনিয়ন্ত্রিত ও সুশৃঙ্খল। আর তা করলে তো জীবনটাকে কানায় কানায় ভোগ করা যাবে না। অতএব আল্লাহ ও পরকালের অস্তিত্বকে অস্বীকার করার পেছনে এই হল তাদের মনস্তাত্ত্বিক কারণ।
উপরের দৃষ্টিভঙ্গি ও মানসিকতা তৈরী হয় পরকালে অবিশ্বাসের দরুন। নৈতিকতা, ন্যায়, সুবিচার, দুর্বল ও উৎপীড়নের প্রতি সহানুভূতি ও দয়া প্রদর্শন প্রভৃতি গুণাবলীতে তারা বিশ্বাসী নয়। নিষ্ঠুরতা, বর্বরতা, হত্যাকান্ড, প্রতিশ্রুতিভঙ্গ ও বিশ্বাসঘাতকতা তাঁদের কাছে কোন অপরাধ বলে স্বীকৃত নয়। যৌন বাসনা চরিতার্থ করার জন্যে নারীজাতিকে ভোগলালসার সামগ্রীতে পরিণত করতে, স্বীয় স্বার্থসিদ্ধির জন্যে একটি মানব সন্তান কেন একটা গোটা দেশ ও জাতিকে গোলামে পরিণত করতে অথবা ধ্বংস করতে তাদের বিবেক কোন দংশন অনুভব করে না। তাই ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়। অতীতের বহু জাতি পার্থিব উন্নতি ও সমৃদ্ধির উচ্চশিখরে আরোহণ করলেও পরকাল অবিশ্বাস করার কারণে তারা নিমজ্জিত হয়েছিল নৈতিক অধঃপতনের অতল গহবরে। তারা হয়ে পড়েছিল অত্যাচারী রক্তপিপাসু নরপিশাচ। তাই আল্লাহ্ তাঁদের সমূলে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন এবং তাঁদের নাম-নিশানা মিটিয়ে দিয়েছেন পৃথিবীর বুক থেকে। তবে পরবর্তীকালের এদের অনুসারীদের জন্যে রেখে দিয়েছেন শিক্ষামূলক দৃষ্টান্ত।
এটাই ছিল আসল কারণ যার জন্যে কোন নবী ও রাসূল পরকালের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের আবেদন জানালে পরকালে অবিশ্বাসী লোকেরা তাঁকে করে অপদস্ত, প্রস্তরঘাতে ক্ষতবিক্ষত করেছে অথবা করেছে মাতৃভূমি থেকে নির্বাসিত। পরকালের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে তারা তাঁদের জীবনধারাকে করতে চায়নি সুশৃঙ্খল ও সুনিয়ন্ত্রিত, তাঁদের উগ্র ভোগবিলাসিতাকে করতে চায়নি দমিত। মানুষকে গোলাম বানিয়ে তাঁদের উপর প্রভুত্ব করার আকাংখাকে করতে চায়নি নিবৃত্ত। নবী-রাসূলদের সাথে তাঁদের বিরোধের মূল কারণ এটাই ছিল।
পরকালে অবিশ্বাস ও চরম নৈতিক অধঃপতনের কারণে অতীতে হযরত নূহ (আ)-এর জাতি, লুত (আঃ)-এর জাতি, নমরুদ, ফেরাউন, আদ ও সামুদ জাতি, তুববা প্রভৃতি জাতিসমূহ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। মানবসমাজে তাঁদের নাম উচ্চারিত হয় ঘৃণা ও অভিশাপের সাথে। প্রাচীন গ্রিক ও রোমান সভ্যতাও শুধুমাত্র ইতিহাসের বস্তুতে পরিণত হয়েছে।
শেষ কথা
আশাকরি উপরের আলোচনা থেকে এ কথা অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে পরকাল থাকতেই হবে। পরকালের অস্তিত্ব সুস্থ বিবেকের দাবী। পরকালকে অস্বীকার করে কোন মানুষ সুস্থ বিবেকসম্পন্ন হতে পারে না, অবশ্যই বলতে হবে সে অসুস্থ বিবেক ও মন-মানসিকতার অধিকারী। এর পরেও যদি কোন মানব সন্তান পরকালের অস্তিত্বকে অস্বীকার করে তবে তাঁকে হঠকারী আর চরম মিথ্যাবাদী বলা ছাড়া কোন উপায় থাকে না। এই আলোচনা শেষ করার আগে পবিত্র কোরআনের দুটি আয়াতের উদ্ধৃতি দিতে চাই। আল্লাহ্ তাআলা বলেন-
‘তোমাদের সবাইকে তার দিকে ফিরে যেতে হবে। এটা আল্লাহর তাআলার পাকাপোক্ত ওয়াদা। নিঃসন্দেহে সৃষ্টির সূচনা তিনিই করেন তারপর তিনিই দ্বিতীয়বার সৃষ্টি করবেন যাতে যারা ঈমান আনে ও সৎকাজ করে তাদেরকে পূর্ণ ইনসাফ (ন্যায়বিচার) সহকারে প্রতিদান দেয়া যায় এবং যারা অবিশ্বাসীদের পথ অবলম্বন করে তারা পান করবে ফুটন্ত পানি এবং ভোগ করবে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি, নিজেদের সত্য অস্বীকৃতির প্রতিফল হিসেবে’ (সুরা ইউনুস ৪)।
তানভীর আহমাদ আরজেল