পাহাড়ের বুকে অন্য বাংলাদেশ

ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব 1088 বার পঠিত

স্বপ্নডানায় ভর করিয়া..

প্রতিবার কক্সবাজার যাওয়ার পথে দিগন্তরেখায় নীলবর্ণ সারি সারি পাহাড়ের নীল হাতছানি মনটা ব্যাকুল করে তুলত। মুগ্ধ বিহবলতা নিয়ে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকতাম সেদিকে দৃষ্টিসীমা যতদূর যায় ততদূর। তবে সশরীরে ঐ সুউচ্চ পাহাড়ের দেশে যাওয়া যায় বা পর্বতারোহনের সুযোগ কখনও মিলবে তা ভাবনাতেই আসেনি। বাসের জানালায় ধরা দেয়া এই রহস্যাবৃত নীল সৌন্দর্যরাশি কেবল কল্পনায় ডুবে ডুবে উপভোগ করতে হয়-এ পর্যন্তই ছিল অনুভূতির সীমানা। দু’বছর আগে মূসা ইবরাহীম নামের বাংলাদেশী পর্বতারোহী যখন হিমালয় চূড়া ছুঁলেন, তখন থেকে পত্র-পত্রিকায় পর্বতারোহনের বিষয়টি বেশ গুরুত্বের সাথে আসতে লাগল। আর সে সূত্রেই বেশকিছু ফিচার পড়লাম বাংলাদেশের সরকারীভাবে স্বীকৃত সর্বোচ্চ পর্বতচূঁড়া কেওকারাডং আরোহন সম্পর্কে। এসব পড়ে মনের ভিতর বার বার উঁকি দিতে লাগল কীভাবে ঐ নীল পাহাড়ের দেশকে পদানত করা যায়। একরাশ বিস্ময় হয়ে যে দুর্গম পাহাড় এতদিন শুধু কল্পনায় ধরা দিত, তাকে আপন করে পাওয়ার নেশা ভালমতই পেয়ে বসল।   

স্বপ্ন থেকে বাস্তবে :            

কেওকারাডং আরোহনের জন্য টানা ৫/৬ দিন সময় হাতে রাখা প্রয়োজন। একাধারে কয়েকদিন ছুটি মিলানো, উপযুক্ত ভ্রমণসঙ্গী পাওয়া বেশ কঠিন হয়ে পড়লেও শেষমেশ বর্ষা পরবর্তী সেপ্টেম্বর মাসকেই বেছে নেয়া হল সফরের জন্য। ঢাকায় আমাদের কর্মী সম্মেলন ২০ সেপ্টেম্বর’১২। পূর্ববর্তী ২ সপ্তাহ সম্মেলনের প্রস্ত্ততির জন্য খুব ব্যস্ততায় কেটেছে। ক’দিন বিশ্রাম প্রয়োজন। এই বিশ্রামের সময়টুকু সফরের জন্য উপযুক্ত পুঁজি মনে করে পরদিন ২১ সেপ্টেম্বর সায়দাবাদ থেকে বিকাল ৫টায় চট্টগ্রামের বাস ধরলাম। সফরসঙ্গী নাজীব ও কাফী ভাই। পরের দিন আসবে মাহফুজ। রাত প্রায় ১২টার দিকে পাহাড়তলীতে আত্মীয়ের বাসায় পৌঁছলাম। পরদিন বিশ্রাম নিয়ে বিকেলে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ও সরঞ্জামাদি কিনে ফেললাম। সন্ধ্যায় রাস্তায় জ্যামে পড়ে পতেঙ্গা বীচের মিষ্টিরোদে ভাজা ঢেউয়ের তোড় দেখার সুযোগ না পেলেও রাতের চন্দ্রবিধুর সমুদ্র দর্শন বেশ উপভোগ্যই হল। বাসায় ফিরে জানতে পারলাম আগামীকাল হরতাল।

যাত্রা শুরু :

পরদিন ভোর ৫টার পূর্বেই আমরা ৪ জন বের হলাম বাসা থেকে। উদ্দেশ্য ঢাকা থেকে আসা নাইটকোচ ধরে বান্দরবান যাওয়া। কর্ণেলহাটে ঢাকা বাস কাউন্টারে গিয়ে জানা গেল ২০ মিনিট আগেই গাড়ি চলে গেছে। ফলে বহাদ্দারহাট বাস টার্মিনালে গিয়ে কাটা গাড়ি ধরা ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখি কোন ধরনের যানবাহন নেই। প্রায় ১ ঘণ্টা চলে গেল তবু কোন ব্যবস্থা হল না। শংকায় পড়ে গেলাম। পরে একটা বাস পাওয়া গেল কর্ণফুলী ব্রীজ পর্যন্ত। সেখান থেকে ভাগ্যক্রমে কেরাণীরহাটগামী একটি মাইক্রোবাস পেয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। সকাল ৮টার মধ্যেই কেরাণীরহাট পৌঁছলাম। কেরাণীরহাট থেকে বান্দরবান আরো প্রায় ২৫ কিলোমিটার। সিএনজিতে রওয়ানা হলাম। বেলা পৌনে ন’টার দিকে বান্দরবান শহরে পৌঁছলাম। সকালের নাস্তা সারলাম জামান হোটেলে। ছিমছাম ছোট্ট শহর বান্দরবান। দোকানপাটে উপজাতীয়দের আনাগোনা বেশ। এক দোকান থেকে অডোমস ক্রীম, স্যালাইন, গ্লুকোজ, ব্যান্ডেজ, চকলেট, বিস্কুট ইত্যাদি কিনে ফেললাম। সামনে ৩ দিন পাহাড়ে পাহাড়ে কাটাতে হবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পাওয়া সেখানে দুষ্কর। বান্দরবান থেকে রুমা বাজার যেতে হবে। অটোবাইকে চড়ে রুমা বাসস্টান্ডে এসে বাসের অপেক্ষা। হরতালের দিন যাত্রী নেই বলে বাসও ছাড়ে না। অবশেষে ঘন্টাখানিক পর আসন পূর্ণ হলে বাস ছাড়ল। উঁচূ-নিচু পাহাড়ী রাস্তা। প্রায় ৩৫ কিঃমিঃ যেতে হবে এই সংকীর্ণ অাঁকা-বাঁকা পথ ধরে। কয়েকমাস পূর্বে চাঁদের গাড়িই ছিল একমাত্র ভরসা। সেনাবাহিনী পীচের রাস্তা করে দেয়ায় এখন বাস চলাচল করছে। শীঘ্র্ই কানে চাপ আর ব্যথা অনুভূত হতে লাগল। পাহাড়ী পথে এটা খুব সাধারণ উপসর্গ। রাস্তার দুই ধারে যতদূর চোখ যায় বিস্তীর্ণ ধূসর পাহাড়ী উপত্যকা। মনে হয় যেন বিমান থেকে ভূমির দৃশ্য দেখছি। শীতের শুরু হয়নি। কিন্তু কুয়াশার মত আবছা নীল দৃশ্যপট। অনেক নীচে পাহাড়ের বাক ঘুরে ঘুরে বয়ে চলেছে সাঙ্গুর ফিতের মত চিকন স্রো্তধারা। বিশাল উপত্যাকায় কেবলই পাহাড়। বাড়ী-ঘর তেমন দেখাই যায় না। মাঝে মাঝে যখন দুই পাহাড়ের ভয়ানক দর্শন গিরিখাত দিয়ে ওপারের বিশাল উন্মুক্ত প্রান্তর দেখা যাচ্ছিল, তখন মনের অজান্তেই বারবার বেরিয়ে আসছিল সুহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহি সুবহানাল্লাহিল আযীম। চিম্বুক রেঞ্জের উঁচু পাহাড়ের সারি বাসের জানালা দিয়ে ঘাড় নীচু করে দেখতে হচ্ছে। তারই এক চূঁড়ায় সুসজ্জিত অবকাশকেন্দ্রের ছাউনি দেখা গেল। মাহফুজ বলল, ওটাই নীলগিরি। চোখ ফিরাতে পারছি না জানালা থেকে। সর্বাধিক শক্তিশালী ক্যামেরারও সাধ্য নেই এই অনিন্দ্য সৌন্দর্যরাজির প্রকৃত রূপকে বন্দী করার। খুব কামনা করছিলাম গাড়ি থামুক কিছুক্ষণ। দু’চোখ ভরে প্রকৃতির এ রূপসুধা গলধঃকরণ করি। অবশেষে চাকা পাংচার হওয়ায় গাড়ি থামল বটে, তবে স্বপ্নরাজ্যের মত সেই ভ্যালিটি পার হয়ে এক জঙ্গলময় পাহাড়ঢাকা বাঁকের উপর থামল। গাড়ি থেকে নেমে রাস্তার পার্শ্বে গভীর খাদের কিনারে আসতে হাইটোফোবিয়ায় গা শির শির করে উঠল। গাড়ি সারাইয়ের পর আবার যাত্রা শুরু। বেলা পৌনে ২টার দিকে গাড়ী থামল কাইখ্যাংঝিরিতে। রাস্তা থেকে নীচে সাংগু নদী পর্যন্ত দীর্ঘ সিঁড়ি পার হয়ে ইঞ্জিন নৌকায় চড়লাম। সহযাত্রীরা অধিকাংশই উপজাতি। ভাষা কিছুই বোঝা যায় না। ২টার দিকে যাত্রা শুরু হল সাংগুর বুক চিরে। দুই তীরে পাহাড়ের সারি। বেশ খরস্রো্তা কিন্তু অগভীর নদীর বুকে পাহাড়ের ছায়া আর রোদের লুকোচুরি চলছে। চারিদিকে সবুজের সমারোহ। জংলী কলা আর নাম না জানা গাছ ও লতাপাতায় ছেয়ে আছে পাহাড়গুলো। সামনে বহুদূরে নীল চাদর জড়িয়ে যেন পথরোধ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে দূরবর্তী পাহাড়গুলো। নদীর কিনার ঘেঁসে ভেসে যাচ্ছে থরে থরে সাজানো পাহাড়ী বাঁশের আটি। ছোট ছোট ক্যানুর মত দাড় বাওয়া নৌকাও দেখা যায়। প্রকৃতি সৌম শান্ত নীরব। এমনি মৌন পাহাড়ঘেরা দৃশ্যপটের সামনে দাঁড়িয়ে কল্পনায় কেবলই ভাসছে ডকুমেন্টারীতে দেখা দক্ষিণ আমেরিকার আমাজন নদীর ভয়ংকর সব বাঁক আর সেখানকার কোন দুঃসাহসিক এ্যাডভেঞ্চার দৃশ্য। আমরা যেন আর আমরা নেই; অজানার পানে আজ আমরা যেন আবিষ্কারের নেশায় ধাবমান একদল অভিযাত্রী। পথিমধ্যে পড়ল নদীর উপর নবনির্মিত রুমা ব্রীজটি। জানতে পারলাম আগামী ১৫ অক্টোবর এটির উদ্বোধন হবে। তখন আর রুমা যেতে নৌকার এই মনোমুগ্ধকর যাত্রার প্রয়োজন হবে না। মনটা অকারণেই খারাপ হয়ে যায়। হয়তবা দেশের বাড়ীর যাত্রাপথে পদ্মার বুক চিরে ফেরী পার হওয়ার সেই হারানো স্মৃতি মনে করে। প্রায় ঘন্টাখানিক পথ চলার পর এক চমৎকার পাহাড়ঘেরা ইউটার্নের মুখে এসে নৌকা থামে। ঘাটে নেমে লম্বা সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে এলাম। এটাই বিখ্যাত রুমা বাজার। রুমা থানার আয়তন অনেক বড়। কেওকারাডং অতিক্রম করে সেই সুদূর তাজিনডং পাহাড় পর্যন্ত বিশাল এলাকার প্রাণকেন্দ্র এই রুমা বাজার। বাঙালীদের চেয়ে উপজাতীয়দেরই বেশী চোখে পড়ল। লম্বা পাহাড়ী পথ পাড়ি দিয়ে উপজাতীয়রা এই বাজারেই সদাই করে। মসজিদ, মন্দির, প্যাগোডা, চার্চ কি নেই এই বাজারে। প্রবেশমুখেই তিনটি রেস্টহাউজ। নতুন ও তুলনামূলক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন দেখে ‘আরণ্যক রিসোর্টে’ উঠলাম আমরা। মালিকের বাড়ি সাতকানিয়া। আমাদের বেশ সমাদর করলেন। অফ সিজন হওয়ায় পর্যটকশূন্য হোটেল। নিরিবিলি পরিবেশ। আমাদের বেশ সুবিধাই হল। সাংগু নদীতে গোসল করব চিন্তা করেছিলাম। কিন্তু পানি ঘোলা দেখে বাদ দিলাম সে চিন্তা। বিকালে হোটেল মালিক আমাদেরকে একজন গাইড ঠিক করে দিলেন। কিন্তু গাইড চার্জ শুনে তো চক্ষু চড়কগাছ। ধারণার চেয়ে অনেক বেশী। যাইহোক উপায়ন্তর না দেখে রাজী হয়ে গেলাম। গাইড জানাল, নিয়মিত-অনিয়মিত মিলিয়ে তার মত প্রায় ৭০ জন গাইড এই দুর্গম পাহাড়ী পথে টুরিস্টদের সেবা দিয়ে জীবিকা অর্জন করছে। গাইডের পরামর্শ মোতাবেক পাহাড়ী পথে চলাচলের উপযোগী গ্রীপযুক্ত সস্তা রাবারের স্যান্ডেল কিনে নিলাম। রাতে স্থানীয় সাতকানিয়া হোটেলে খাওয়ার পর বাজার মসজিদে ছালাত আদায় করলাম। আমাদের ছালাত আদায়ের ভিন্ন ধরন দেখে মসজিদের মুছল্লীদের দৃষ্টি সব আমাদের দিকে। তবে পর্যটন এলাকা বলে হয়ত বিশেষ কিছু জিজ্ঞাসা করল না। মসজিদ থেকে বেরিয়ে হাটতে হাটতে সাংগুর ঘাটে আসলাম। শুক্লাপক্ষের আধফালি চাদের মৃদু আলো তখন নদী ও পাহাড়ে জেঁকে বসা অাঁধারকে ঘোচানোর আপ্রাণ চেষ্টায় রত। মেঘের আনাগোনায় আকাশের দেশে ব্যস্ততার আভাস। সারি বেধে দাঁড়িয়ে থাকা নৌকাগুলোর একটার ছাদে উঠে প্রায় ঘন্টাখানিক নদী, পাহাড় ও চাঁদের মিলিত সম্ভাষণে সিক্ত হলাম। মাহফুয, নাজীব, কাফী ভাই ঘুমে ঢুলু ঢুলু। ওদেরকে ‘চন্দ্রাহত’ হওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়ে অনেকটা জোর করেই এনেছিলাম। সবাই মিলে পরিবেশটা খুব উপভোগ করলেও ঘুমের কাছে হার মেনে হোটেলে ফিরতে হল। রাতে খুব ভাল ঘুম হল। 

রুমাবাজারের সকাল :

এক ঘুমে রাত শেষ হল। দ্রুত অযু সেরে মসজিদে গেলাম। ছালাতে মুছল্লীদের উপস্থিতি তুলনামূলক ভালই মনে হল। মুনাজাতের পর একটি বই বের করে হাদীছ পড়া শুরু করলেন ইমাম সাহেব। আমরা বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আবার সাংগুর তীরে নেমে এলাম। ভোরের সাংগুকে দেখায় খুব শান্ত ও স্নিগ্ধ। আজ রবিবার হাটের দিন। পাহাড় থেকে নৌকাযোগে আনা শত শত কলার কাঁদি ও তরি-তরকারী নামানো হচ্ছে ঘাটে। ঘাট থেকে একটু দূরে স্তূপীকৃত বাঁশের সারি সারি অাঁটি। বিশেষ পদ্ধতিতে একটার একটা সাজিয়ে ভাসিয়ে আনা হয়েছে দূর-দূরান্ত থেকে। পানিতে পা ছুঁইয়ে হাঁটতে হাঁটতে উঁচূ পাহাড়ের উপর গ্রামটিতে উঠলাম। খাড়া ঢাল বেয়ে উপরে উঠতে পা ব্যথা হয়ে গেল। গ্রামের ভিতরটা দেখে চক্ষু চড়কগাছ। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে ঘর বেঁধে মাঝখান দিয়ে একেবারে প্রশস্ত রাস্তা তৈরী করে বিরাট শহরই যে বানিয়ে ফেলেছে গ্রামবাসীরা। বঙ্গবন্ধু, জিয়াউর রহমান, বিএনপি, আওয়ামী লীগ, ব্রাক, আশা, প্রশিকা কি নেই সেখানে! উপজাতীয়দের সদ্য ঘুম ভাঙ্গা কটমটে চোখের উঁকিবুকি দেখে আর বেশী না এগিয়ে নেমে এলাম নীচে।

বগালেক অভিমুখে যাত্রা : 

ঘাটে নেমে আসতেই গাইড আলমগীরের ফোন। তাড়াতাড়ি সকালের নাস্তা সেরে গোসল করে তৈরী হয়ে নিলাম ৭টার মধ্যে। চিরাচরিত পোষাক ছেড়ে নতুন বেশে পিঠে নতুন কেনা ব্যাকপ্যাক ঝুলিয়ে হোটেল থেকে বেরিয়ে এলাম। বাড়তি জিনিসপত্র সব হোটেল লবিতে রেখে এসেছি। বেশ অভিযাত্রী অভিযাত্রী মুডে আছি সবাই। বাজারের পিছনে পাহাড়ের উপরে অবস্থিত আর্মি ক্যাম্পে গিয়ে রিপোর্ট করলাম। উপস্থিত অফিসারদ্বয় আমাদের নাম-ঠিকানা লিখে নিলেন। তাদের আন্তরিক ব্যবহার ও শুভকামনায় বেশ ভাল লাগল। রিপোর্টিং সেরে নীচে নেমে বিখ্যাত সেই ফোর হুইলার চাঁদের গাড়িতে চড়ার জন্য স্ট্যান্ডে আসলাম। হুডখোলা লোকাল গাড়িতে চাপাচাপি করে ১৮/২০ জন বসেছি। সামনের দিকে বসলাম গাইডসহ আমরা পাঁচজন। বাকি সবাই উপজাতি। পৌনে আটটার সময় যাত্রা শুরু হল। খানিকবাদেই গাড়ি থামল। পুলিশ বক্সে আবার রিপোর্ট করতে হবে। গাড়ি থেকে নেমে আবার নাম-ঠিকানা, গন্তব্য সব লিখতে হল। স্থানীয়দের অবশ্য এসব প্রয়োজন হয় না। বগালেকের যাওয়ার জনপ্রিয় ট্রেইল ঝিরিপথ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার অনুমতি চাইলাম। কিন্তু পুলিশ অফিসারটি খুব শক্তভাবেই বারণ করল ওপথে যেতে। বর্ষা মৌসুমে নাকি সেখানে নানা বিপদের আশংকা। যাইহোক মনের ইচ্ছা চাপা দিয়ে গাড়িতে উঠে বসলাম। সামনে ইট বসানো উঁচু পাহাড়ী পথ। গাড়ী প্রায় খাড়াভাবে উঠছে তো উঠছেই। মনে হল গাড়ী উল্টেই যাবে। শক্ত করে দু’হাত দিয়ে অাঁকড়ে ধরে রয়েছি সামনের রড। পিছনের দিকে তাকালে ভয়ে শরীর ঠান্ডা হয়ে যায়। অনেকক্ষণ ধরে উঠার পর এবার নামা শুরু হল। নামছে তো নামছেই। পুরোটা রাস্তাটাই এমন। রাস্তা থেকে অনেক নিচে সারি সারি পাহাড়। মেঘ, রৌদ্দুরের লুকোচুরিতে সবুজ পাহাড়ের রূপ অবশ্চর্যরকমভাবে ক্ষণে ক্ষণে বদলাচ্ছে। রাস্তার দুধারে ঘন নলখাগড়ার ঝাড় এমনভাবে ঝুকে আছে যে আমাদের গায়ে তা বার বার এসে লাগছে আর নানা জাতের পোকামাকড়ে শরীর ভরে যাচ্ছে। এভাবে বগামুখপাড়া পর্যন্ত বৈচিত্র্যময় ১৩ কিলোমিটার পাহাড়ী রাস্তা অতিক্রম করতে ১ ঘন্টারও বেশী সময় লেগে গেল। ৯টার দিকে বগামুখপাড়ায় গাড়ি থেকে নামলাম। এবার পায়ে হেঁটে যাত্রা শুরু। ১৫ মিনিট হাটার পর পাহাড়ী সরু ট্রেইলে ঢুকে পড়লাম। প্রকৃতির শোভা দেখতে দেখতে হাটছি। সামনে পিছনে ডানে বামে চারিদিকে শুধু পাহাড় আর পাহাড়। তন্ময় হয়ে সেসব দৃশ্য দেখছি আর বার বার হোচট খাচ্ছি। কিছুক্ষণ পর দেখি সাথীরা অনেকটা সামনে এগিয়ে গিয়েছে। ওদের দেখতে পাচ্ছি না। অাঁকাবাঁকা খাড়া ট্রেইলে দৌড় দিয়ে এগিয়ে ওদেরকে ধরার চেষ্টা করলাম। এতেই বাধল বিপত্তি। ওদেরকে নাগালের মধ্যে পেতে পেতে এতটাই হাপ লেগে গেল যে, মাটিতে শুয়ে পড়ার দশা। সবাই মিলে কিছুক্ষণ রেস্ট নিলাম গাছের ছায়ায়। আবার উঠলাম। হাটা শুরু হল। কিন্তু না, পা চলতে চায় না। কিছুদূর এগিয়ে আবার রেস্ট। বুকটা এমন ধড়ফড় করছে যে তার আওয়াজ কানে শুনতে পাচ্ছি। মাহফুযেরও একই দশা। রোদের প্রখর তাপে ঘেমে নেয়ে হাঁস-ফাঁস অবস্থা। সামনের উঁচু পাহাড়টা পার হতে হবে জেনে একদম ভেঙ্গে পড়ার দশা। যাইহোক গাইড সাহস দিল। ঢাল বেয়ে উঠছি আর উঠছি। খানিকটা রেস্ট নেই, আবার এগুতে থাকি। কারো মুখে রা নেই। এভাবে কখন যেন পাহাড়ের মাথায় চলে এসেছি। নাজীব আর কাফী ভাই পাহাড় চূঁড়া থেকে ওপারে নেমে গেছে। আমি সবার পিছনে ভগ্নমনোরথে চূড়ায় উঠছি আর ভাবছি সামনে না জানি কত বড় পাহাড় অপেক্ষা করছে। কষ্টে মুখ ব্যাদান করে চূঁড়ায় উঠে দাড়ালাম। নিচে তাকিয়েই হতবাক। এ কি, আসমানের নীলাকাশ ভূমির বুকে আছড়ে পড়ল কিভাবে? পীতাভ সুউচ্চ পর্বতশ্রেণীর গর্ভে এমন মোহনীয় ঝকঝকে স্বর্গীয় নীল সরোবর? এ দৃশ্য দেখার জন্য মোটেও প্রস্ত্তত ছিলাম না। চোখ রগড়ে নিলাম। স্বপ্ন দেখছি না তো। মাহফূয কাছে এসে বলল এটাই তো সেই বগালেক। আমি বাকরুদ্ধ। সেই বিখ্যাত বগা লেক যে এতকাছে, তা তো একবারও বলেনি ঐ গাইড ব্যাটা? পাহাড়ের উপরে স্থানুর মত

কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে থেকে এই বিপুল সৌন্দর্যরাশিকে প্রাণভরে প্রতিটি নিঃশ্বাসের সাথে গিলতে লাগলাম। তারপর ধীরে ধীরে নেমে এলাম নিচের লোকালয়ে।                    

বগালেক পাড়ায় :

বগালেকের তীর ঘিরে বগালেকপাড়া। দক্ষিণ দিকে খৃষ্টান ধর্মাবলম্বী ব্যোম পাড়া, উত্তর দিকে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী মারমা পাড়া। ব্যোমপাড়ায় পাহাড়ের ঢালের উপর আর্মী ক্যাম্প। ক্যাম্পের ভিতরে মসজিদ আছে। আর্মীরা এখানে জুম‘আর ছালাতও আদায় করে। আমরা সোজা আর্মী ক্যাম্পে ঢুকে বসে পড়লাম। উপস্থিত অফিসারটি খুব আন্তরিকভাবে আমাদেরকে স্বাগত জানালেন এবং প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনা দিলেন। নাম-ধাম লিখে তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বগালেকপাড়ায় ঢুকলাম। এ পাড়ায় ২৩টি পরিবার এবং ১৩২ জন অধিবাসী রয়েছে। লেকের অপর পাড়ে মারমা পাড়াতেও অনুরূপ জনসংখ্যা। গাইডের পরিচিত এক দোকানে ঢুকে গ্লাসের পর গ্লাস পানি সাবাড় করলাম আর পাহাড়ী কলা খেয়ে শক্তি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করলাম। কাফী ভাই স্যালাইন ও গ্লুকোজ গুলে সবাইকে দিল। প্রায় আধাঘন্টা রেস্ট নিয়ে একটু চাঙা হলে গাইড তাড়া দিল কেওকারাডং অভিমুখে যাত্রা শুরুর জন্য। ১১টা বেজে গেছে। রওনা হচ্ছি। এ সময় মাহফুয বেঁকে বসল। সে আর যাবেই না। এই লম্বা পথ ট্রেকিং-এর কষ্ট সহ্য করার মত বিন্দুমাত্র শক্তি তার অবশিষ্ট নেই। আগামী দু’দিন সে বগালেকেই থেকে যাবে। তার সিরিয়াস ভঙ্গি দেখে আমি সাফ জানিয়ে দিলাম,  ‘দেখ, আমরা কাউকে ছেড়ে যাওয়ার জন্য আসিনি, তোমাকে অবশ্যই যেতে হবে। প্রয়োজনে আরো ১ ঘন্টা পর যাব। তোমাকে বাঁশের অাঁকড়ায় বহন করে হলেও নিয়ে যাব, যদি হাটতে না পার’। ধমক খেয়ে সে অবশেষে নরম হল আর কিছু ছেলেমানুষী শর্ত জুড়ে দিল। সব শর্ত মেনে নেয়ার আশ্বাস দিলাম। ওর জন্য ডবল দামে একটি রাবারের স্যান্ডেল কেনা হল। দোকানের সামনে বাঁশের লাঠি দেখে সবাই একটি করে নিলাম। পাহাড়ী অঞ্চল ভ্রমণে নবীশ ট্রেকারদের জন্য এই লাঠির কোন বিকল্প নেই। অথচ আমাদের গাইড কিছুই বলেনি। এজন্যই পিছনের পাহাড়টা অতিক্রম করে আসতে আমাদের এত কষ্ট হয়েছে। খুব রাগ হল গাইডের উপর।        

বাংলাদেশের হিমালয় অভিমুখে :  

বগালেকপাড়ার পূর্বদিকে আকাশছোঁয়া অন্তর হীম করা পাহাড়। ঘন অন্ধকারাচ্ছন্ন জঙ্গলে ছেয়ে আছে। মনে হচ্ছে সামনে গেলেই প্রকান্ড আনাকোন্ডা বা কোন হিংস্র প্রাণী ঘাড়ের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। ভর দুপুরেও একটানা ঝিঝির কান ঝালাপালা করা চিৎকার। পাখির কলরবও তাতে ঢাকা পড়েছে। ঢুকে পড়লাম বিচিত্র সব লতা-গুল্মে ঢাকা ট্রে্ইলে। বর্ষাকালে না আসলে প্রকৃতির এত রূপ বৈচিত্র্য হয়ত দেখা যেত না। শীতকালের ম্যাড়মেড়ে আবহাওয়ার সাথে এখনকার প্রাণবন্ত সবুজ প্রকৃতির কোন তুলনাই হয় না। মনে মনে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলাম। এখনকার ট্রেইলটা আগের মত অতটা খাড়া নয়, বেশ সমতল। তাছাড়া হাতের লাঠিও বেশ উপকার দিচ্ছে। সরু পথ বেয়ে এগিয়ে চলেছি। কখনও ঘন জঙ্গল, কখনো পাহাড়ের একেবারে কিনার ধরে হাটার পথ, যেখান থেকে একেবারে খাড়াভাবে নেমে গেছে গভীর খাদ। নলখাগড়া আর লতা-গুল্মের ঝোপের আড়ালে খাদের গভীরতা তেমন বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু একটু খেয়াল করলে নীচে তাকালেই হৃদকম্প শুরু হয়ে যাচ্ছে। পথে বেশ কয়েকটি ঝর্ণা ও ঝিরি পড়ল। বিরাট বিরাট পাথরের ঢিবি ভেদ করে সেসব ঝর্ণা প্রবাহিত হচ্ছে। অন্ধকারাচ্ছন্ন জঙ্গলে প্রকান্ড পাথরগুলো সেখানে এক আধিভৌতিক আবহ তৈরী করে রেখেছে। ভগ্ন মাটির ঢিবিই হয়ত শত শত বছর ধরে ঝর্ণার অব্যাহত স্রোতের তোড়ে কোন এক সময় পাথরে পরিণত হয়েছিল। তারপর কত শত বছরের ইতিহাসের স্বাক্ষী হয়ে যে পাথরগুলো দাঁড়িয়ে আছে তা আল্লাহ্ই মা‘লূম। আজলা ভরে ঝর্ণার শীতল পানি খেলাম। শ্রান্ত পথিকের জন্য এর চেয়ে প্রশান্তিকর বিনোদন আর কিই বা হতে পারে। পথে সবচেয়ে বড় যে ঝর্ণাটি পড়ল তার নাম ‘চিনরি’ ঝর্ণা। গাইড জানালো আসার পথে এই ঝর্ণার উৎসস্থলের দিকে নিয়ে যাবে। প্রায় ঘন্টাখানিক হাটার পর রেস্ট নিলাম কিছুক্ষণ। যে মাহফুয কোন মতেই পাহাড়ে উঠবে না জানিয়ে দিয়েছিল, তাকে এখন দেখছি সবার আগে আগে। ও বলল, ‘তোমার ধমক আমাকে তাতিয়ে দিয়েছে’। আমরা হাসলাম। আবার হাটা শুরু হল। এক নাগাড়ে একের পর এক পাহাড় অতিক্রম করছি। প্রত্যেকের মাঝে বেশ ব্যবধান। কারো মুখে কোন কথা নেই। ট্রেকিং-এর সময় কথা বললে দম ফুরিয়ে আসে। চারিদিকে শত শত পাহাড়ের নির্বাক শোভা আর ঘন জঙ্গলের নৈঃশব্দ্য। কেমন যেন ঘোরের মধ্যে হাঁটছি আর হাঁটছি। আরো ঘন্টাখানিক পার হয়ে গেল। একটা মোড়ের মত জায়গায় এসে আমরা থেমে গেলাম। এখানে রেস্ট নেওয়ার জন্য একটা ছাউনী ঘেরা জায়গা আছে। আমাদের আগেই ১৫/১৬ জনের এই পর্যটক দল ফিরতি পথে এখানে এসে রেস্ট নিচ্ছে। কেওকারাডং হয়ে তারা জাদিপাই ঝর্ণা পর্যন্ত গিয়েছিল। আমাদেরকেও উৎসাহ দিল জাদিপাই যাওয়ার জন্য। ওদের সাথে আরো বেশ খানিকক্ষণ কথাবার্তা হল। তারপর পরস্পর শুভেচ্ছা বিনিময় করে আমরা আবার যার যার পথ ধরলাম। এখানে দাঁড়িয়েই সর্বপ্রথম কেওকারাডং শিখরের দেখা পেলাম। আকাশছোঁয়া কেওকারাডং রেঞ্জের ঢেউ খেলানো পর্বতশ্রেণীর সর্বশেষ ও সর্বোচ্চ শিখরটিই হল আমাদের বহু কাংখিত কেওকারাডং। মেঘের আড়ালে চূড়াটি বার বার হারিয়ে যাচ্ছে। মাঝের বিশাল উন্মুক্ত প্রান্তর জুড়ে এক অসাধারণ ভ্যালি। সেখানে সারি সারি পাহাড়ের উপর লতা-গুল্মের অলংকারে সুসজ্জিত লম্বা লম্বা রেইনট্রির ঘন সবুজ বন আর তার উপরে মেঘ ও রোদের অদ্ভুত খেলা। একদিকে আলোয় ভরা সবুজ তো আরেক দিকে কালো ছায়ার আলেয়া। কি যে অসাধারণ লাগছে ভ্যালিটাকে। চোখ ফেরানো দায়।

বিজয় কেওকারাডং :

চূড়া দেখার পর শরীরে যথেষ্ট শক্তি ফিরে এসেছে। অজানাকে জানার, অদেখাকে দেখার চাপা উচ্ছাসে মনটা উথাল-পাথাল করছে। ঠিক সে সময় বৃষ্টি নেমে এল। রিমঝিম বৃষ্টির শব্দ পাহাড়ের গায়ে প্রতিধ্বনিত হয়ে শব্দের অপূর্ব ছন্দময় তান তুলছে। শো শো বাতাসে সে শব্দ কান পেতে শুনছি আর ঝংকৃত হচ্ছি। দুপাশ থেকে ভেজা লতা-পাতার অবুঝ ঝাপটা.. দূরের পাহাড়ে মেঘের দলের শান্ত-সমাহিত চলাচল.. আহা! এ পথ যদি শেষ না হত! অভিযাত্রী দলে সবার পিছনে ছিলাম আমি। প্রকৃতিকে আপন করে পেতে গিয়ে আরো পিছিয়ে পড়েছি। পাহাড়ের আড়ালে ওদের দেখা যায় না। নিঃসীম প্রকৃতির কোলে কেবল আমি আর আমি। নির্জনতার সবটুকু উপভোগ করছি একান্তই নিজের মত করে। হঠাৎ মনে হল কোথাও কেউ নেই। অজানা শিহরণে আৎকে উঠে দৌড় দিলাম। অবশেষে সহযাত্রীদের নাগাল যখন পেলাম তখন তারা দার্জিলিংপাড়ায় ঢুকছে। কেওকারাডং থেকে কয়েকশ গজ নিচে এই গ্রামের অবস্থান। বেশ শিক্ষিত মনে হল প্রায় শ’খানিক অধিবাসীর এই ছোট্ট গ্রামটি। আশে পাশের পাহাড়গুলো সব মেঘে ঢেকে গেছে। বৃষ্টি তখনও কমেনি। সেখানকার একমাত্র দোকানটিতে বসে চা খেলাম। তারপর বৃষ্টির মধ্যেই আবার রওয়ানা হলাম। আর বেশী পথ বাকি নেই। জোরে জোরে পা চালাচ্ছি। বৃষ্টিভেজা আবহাওয়ায় ক্লান্তির রেশ অনেকটা ধুয়ে গেছে। চূড়ার প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছি কিন্তু নাগাল পাই না। অবশেষে এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ছোটকাল থেকে বইয়ের পাতায় দেখে আসা সেই কেওকারাডংশীর্ষ উদ্ধতভাবে দন্ডায়মান চোখের সামনে। পায়ে পায়ে উঠে এলাম বাংলাদেশের হিমালয়ের শীর্ষ চূড়ায়। হৃদয়জুড়ে খেলা করছে এভারেস্ট জয়ের অনুভূতি। শুণ্যের পানে মুষ্টিবদ্ধ হাত উচিয়ে কাজী নজরুলের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে বলতে ইচ্ছে হল- ‘আমি চির বিদ্রোহী বীর, বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা, চীর উন্নত শীর’। ঘন মেঘের উড়াউড়ি চূড়ার উপর। কুয়াশার মত বহমান ধোয়াশা আর ভেজা নিঃশ্বাস-এই হল মেঘ। হাতের কাছে পেলে অবাধ্য মেঘের দলকে ছুয়ে চেপে ধরার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু মেঘের রাজ্যে ঢুকে বোঝা গেল-এ কোন ধরার বস্ত্ত নয়, কেবলই অনুভবের। ঘড়িতে তখন বেলা ৩টা বেজে পার হয়ে গেছে।

লালা বাবুর রেস্ট হাউজে :

চূড়ায় উঠে দেখি বেশ এলাহী কারবারই। এই এলাকা এখন সরকারী বনবিভাগের নয়, বরং ব্যক্তিমালিকানায় লীজ দেয়া হয়েছে। ব্যোম উপজাতিভুক্ত লাল মুন থন লালা পরিবারের মালিকানাধীন এই কেওকারাডং পাহাড়সহ পার্শ্ববর্তী  পাহাড়সমূহ। লালা সাহেবের বাবা এই বিশাল ভূ-সম্পত্তির মালিক হয়েছিলেন। তার নাকি কেবল পাহাড়ী গয়ালই ছিল ২/৩ হাজার। এখন সেই জাঁকজমক আর নেই। তবে ভূ-সম্পত্তিগুলো এখনও এই পরিবারের আয়ত্বে আছে। লালা সাহেব, তার স্ত্রী, পুত্র ও পুত্রবধু আর ১ বছর বয়সী চমৎকার এক নাতি-এই ক’জন মিলেই পরিবারটি। কেওকারাডং চূড়া পর্যন্ত সরকারীভাবে যে সিঁড়িটি করা হয়েছে তার গোড়াতেই একটা দোতালা কাঠের বাড়িতে তাদের বাস। মাত্র মাসতিনেক পূর্বে ৩টি কাঠের কটেজ নির্মাণ করে লালা বাবু হোটেল ব্যবসা শুরু করেন। নামটাও দিয়েছেন বেশ গালভারি-‘কেওকারাডং মোটেল কমপ্লেক্স’। প্রতিটি কটেজে ১২ জন থাকতে পারে। দূরের কোন ঝিরিতে পাইপ বসিয়ে মেশিন দিয়ে সরাসরি পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বাড়ির সামনে রাখা বিশাল গাজী ট্যাংক। লালা বাবুর স্ত্রী আমাদেরকে গোসলের আমন্ত্রণ জানিয়ে বললেন, ‘বাড়িতে যেয়ে গল্প করবেন কেওকারাডং-এ গোসল করেছি’। আমাদের অবশ্য তখন দীর্ঘ পথ হেটে ক্ষুধায় পেট চো চো করছে। গোসল না করে কোনমতে হাত-পা ধুয়েই খাওয়ার টেবিলে বসে পড়লাম। মেন্যু ডিম, সব্জি আর ডাল। গোগ্রাসে খেয়ে ফেললাম যদিও রান্না তেমন সুস্বাদু মনে হয়নি।

জোঁকের জোকারি :

খাওয়া শেষে চা পান করছি। হঠাৎ পায়ের পাতার উপর নরম কিছু পড়ল। তাকিয়ে দেখি ছোট্ট একটা সরিসৃপ। ফুলে ঢ্যাবঢেবে হয়ে আছে। সামনেই বসা ছিল গাইড। জোঁক, জোঁক বলে চেচিয়ে উঠে বলল, ইয়া আল্লাহ! এতবড় জোঁক আমি কখনও দেখিনি। আমি বেশ মজাই পেলাম জোঁকটি দেখে। ভাবছি ভাগ্য ভাল, সময় মত চোখে পড়েছে, নতুবা এত বড় জোঁক কামড়ালে কি বিপদেই না পড়তাম। ভ্রমণ কাহিনীগুলোতে জোঁক থেকে সতর্ক হওয়ার কথা অনেকবার পড়েছি। গাইড লবন নিয়ে এসে জোঁকটি মারতে বসল। সবাই সে দৃশ্য দেখছে। এ সময় নাজীব বলল, তোমার পায়ে কোথাও কামড়ালো না তো! আমি পাজামা একটু উচু করতেই দেখি রক্তের লম্বা স্রোত। ব্যাথার লেশমাত্র নেই, অথচ এত রক্ত! অাঁৎকে উঠলাম। গাইড বাইরে থেকে দূর্বাঘাস এনে চিবিয়ে পায়ে লাগিয়ে দিল। কিন্তু মিনিট দশেক ধরে থাকার পরও রক্ত বন্ধ হয় না। এ অবস্থাতেই উপরে উঠে আমাদের জন্য নির্ধারিত কটেজের ব্যালকনিতে  বসে পড়লাম। মাহফুয ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দিল। তাতেও কোন কাজ হল না। অবশেষে গামছা দিয়ে শক্ত করে পা বেঁধে বসে রইলাম। জোঁকের কামড় খাওয়ার অভিজ্ঞতা আমার ছিল না। এমন কি তার আকার-আকৃতিও মনে নেই। আর আমাকে দিয়েই শুরু হল জোঁকের জোকারি। পরে জানলাম সাধারণত ক্ষত থেকে এত রক্ত বের হয় না, অনেকক্ষণ কামড়ে ধরে রাখার ফলেই রক্তের প্রবাহ এত বেশী। আশ্চর্যের বিষয় হল প্রাণীটিকে আল্লাহ এমনভাবে সৃষ্টি করেছেন যে, এরা শরীরে কেবল ধমনীর উপরই ছিদ্র করে এবং শিকারকে কিছু বুঝতে না দিয়ে নীরবে রক্ত শুষে নেয়। এদের মুখে এমন এক লালা নিঃসরিত হয় যার ফলে রক্ত জমাট বাধতে চায় না, আবার ক্ষতস্থানে কোন ব্যথাও করে না।   

সুন্দরের রাজ্যে জীবন গদ্যময় :

বেলকনীতে বসে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ চূঁড়া থেকে নীচের পৃথিবী দেখছি। এখানকার পৃথিবীর সীমানা অনেক সুবিস্তৃত। বেলকনি থেকে উত্তর দিকটা পাহাড়ের এ মাথা ও মাথা পেরিয়ে বহুদূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। সদ্য বৃষ্টিস্নাত অবারিত পৃথিবী। যতদূর চোখ যায় কেবল সবুজে সবুজে অপরূপ পাহাড়ের সারি। পেজা তুলার মত শুভ্র মেঘের ভেলা সেসব পাহাড়ের কোলে পরম আদরে আশ্রয় পেতেছে। হঠাৎ রংধনুর আলোড়নে হেসে উঠল মেঘলা পূবাকাশে। সবমিলিয়ে প্রকৃতি কি যে এক মনোহর ঐন্দ্রজাল তৈরী করেছে এই পড়ন্ত বিকেলে, তার খবর প্রকৃতি নিজেও বুঝি রাখে না। ‘সুন্দরে সুন্দরে দেয় পাল্লা, জানি না কত সুন্দর তুমি আল্লাহ’-গানের কলিটি বাস্তবিকই আজ হাজির হয়েছে কেওকারাডং চূড়ায় আমাদের স্বাগত জানাতে। চোখ ধাঁধিয়ে আসে ভয়ংকর সে সৌন্দর্যে। মাগরিবের পূর্বে লম্বা সিঁড়ি বেয়ে আবার উঠলাম সর্বোচ্চ চূড়ার উপর যেখানে সেনাবাহিনী ফলক বসিয়েছে ১৯৯৩ সালে। পাশেই পাকা ছাউনী ঘেরা বসার জায়গা। ঝড়ো বাতাস আর মেঘের প্রবল আনাগোনার মধ্যে সেখানে বসে অনেকক্ষণ গল্পগুজব করলাম। দূরের কিছুই দেখা যাচ্ছে না মেঘের ধোয়াশায়। তুষার ঝড়ের মত আবহাওয়া। সূর্যাস্তের স্থানটিও ঠাওর করার উপায় নেই। ঘড়ি দেখে মাগরিবের সময় অনুমান করে কাফী ভাইকে বললাম আযান দিতে। ইথারে ভেসে ভেসে সে আযানের ধ্বনি বুঝি বহুদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ল। আযান দিয়ে খুশীতে উজ্জ্বল কাফী ভাইয়ের চেহারা। উনার প্রবল বিশ্বাস কেওকারাডং চূড়ায় উনিই হলেন প্রথম এবং একমাত্র আযানদাতা। আমরাও সোৎসাহে সায় দিলাম। হতেও তো পারে, হাহা...।

বাদ মাগরিব কিছুক্ষণ রেস্ট নিলাম। চারিদিকে শুনশান নীরবতা। পর্যটন মৌসুম নয় বলে পর্যটক বলতে আমরা ৪জনই। নতুবা এত নিরিবিলি থাকার সৌভাগ্য হত না। কাঠের ঘরে টিমটিমে প্রদীপের আলোয় এক ভিন্ন আমেজ অনুভব করছি। মাঝে মাঝেই স্বপ্নের মত মনে হচ্ছে পৃথিবী ছেড়ে বোধ হয় কোন এক অজানা গ্রহে আছি। রাতের খাবারের ডাক এল। লালা বাবুর ডাইনিং রুমে মুরগীর গোশত দিয়ে ভাত পরিবেশন করা হয়েছে। মাগরিবের পূর্বে নাজীব ও কাফী ভাইয়ের যৌথ প্রচেষ্টা জবাই করা হয়েছিল বিরাট পাহাড়ী মুরগীটি। রান্না যথারীতি সুস্বাদু মনে হল না। খাওয়া-দাওয়া সেরে লালা বাবুর টেলিটক নাম্বার থেকে বাসায় কথা বললাম। এখানে কেবল টেলিটকেরই নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়। ঘুমাতে যাওয়ার আগে সিঁড়ি বেয়ে চূড়ায় উঠলাম চন্দ্রকরোজ্জ্বল নিশুতি রাতের শোভা উপভোগ করার লোভে। কিন্তু ভাগ্য খারাপ। মেঘে ঢাকা আকাশ। চাঁদ নেই। নিশ্চিদ্র অাঁধার জমে আছে পাহাড়ের রাজ্য। বহু দূরে রুমা বাজারের আর্মী গ্যারিসনের হাজারো লাইটের ফুটফুটি দেখা যাচ্ছে। অপরদিকে মিয়ানমার বর্ডারে বিজিবি ক্যাম্পের টিমটিমে আলো। এছাড়া কোথাও কোন আলোর কোন চিহ্ন নেই। পরিবেশটা জমল না। কিছুক্ষণ পর নাজীবরা নীচে নেমে ঘুমাতে গেল। আমি আর মাহফুয রয়ে গেলাম। গল্প করতে করতে আরও ঘন্টাখানিক পার হয়ে গেল। ইতিমধ্যে আকাশ প্রায় পরিষ্কার হয়ে চাঁদের আভাস মিলেছে। মৃদু আলোয় ইতিমধ্যে নিচের পাহাড়গুলো স্বচ্ছ হয়ে উঠছে। খাঁজে খাঁজে আটকে থাকা দুগ্ধ ফেনিল শুভ্র মেঘের সাথে চাঁদের মধুর মিতালীতে পৃথিবীটা তখন এক পরাবাস্তব সপ্নিল জগৎ হয়ে উঠল। সুবহানাল্লাহি ওয়াবিহামদিহি সুবহানাল্লাহিল আযীম! আহ, সাদা ভূষণে মোড়া এই স্বর্গ দেখার লোভেই তো এতক্ষণ জেগে থাকা! প্রকৃতির এই নির্বাক রূপরহস্য ভেদ করার জন্য এই মধ্যরাতে আমরা দুটি প্রাণী ছাড়া কেওকারাডং জুড়ে আর কেউ নেই। সুদূর থেকে ভেসে আসা শিকারে বের হওয়া কোন শিয়াল বা হুতুমের পিলে চমকানো হুংকারও কানে আসে না। কেবলই নিঝ্ঝুম স্তব্ধতা। পলে পলে সময় বয়ে যাচ্ছে। চাঁদের আলো গলে গলে পড়ছে পাহাড় বেয়ে অনেক নিচে, মেঘ সমুদ্রে। তন্ময় আমরা অভিভূত। একসময় ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি ১২টা বাজতে চলেছে। নাহ, এবার ঘরে যেতে হবে, নয়তো শুক্লাপক্ষের আধফালি চাঁদের আকর্ণ বিস্তৃত নরম হাসিতে বিমুগ্ধ এই মন মাতাল করা রাত যে কতক্ষণ নির্ঘুম আটকে রাখবে কেওকারাডং শীর্ষে, তা কে জানে! ঘরে ফিরে দুটো কম্বল গায়ে টেনে ঘুমিয়ে পড়লাম ক্লান্ত শরীরে। (আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)

আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব



আরও