সম্পাদকীয়

মুযাফফর বিন মুহসিন 1391 বার পঠিত

আল-হামদুলিল্লাহি ওয়াহদাহ ওয়াছ ছালাতু ওয়াস সালামু ‘আলা মাল্লা নাবিইয়া বা‘দাহ

২০১৩ সালের শুরু থেকে বাংলাদেশের ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এমন কিছু পরিবর্তনশীল ঘটনা ও দুর্ঘটনা ঘটে চলেছে যা এদেশের ভবিষ্যৎ গন্তব্য সম্পর্কে দাঁড় করাচ্ছে এক জটিল সমীকরণ। মুক্তিযুদ্ধের ৪ দশক অতিবাহিত হবার পর বিতর্কিত ‘যুদ্ধাপরাধ’ ইস্যুটি সামনে এনে ক্ষমতাসীন সরকার যে নাটক শুরু করেছিল, তা এখন চূড়ান্ত পরিণতির পথে। ‘আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইবুনাল’ নামক ‘বিচারালয়ে’ ইতিমধ্যেই একটি ইসলামী রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাদের ঢালাওভাবে ‘অপরাধী’ ঘোষণা করে দন্ডপ্রদান শুরু হয়েছে। একে কেন্দ্র করে সংঘটিত হয়েছে দেশজুড়ে এক নযীরবিহীন রক্তক্ষয়ী সংঘাত। যাতে প্রাণ হারিয়েছে দুই’শরও বেশী রাজনৈতিক কর্মী ও সাধারণ মানুষ। অন্যদিকে ‘যুদ্ধাপরাধ’-এর বিচারে কাংখিত ফাঁসির রায় না পাওয়াকে ছুঁতো বানিয়ে স্বার্থান্বেষী ‘মুক্তিযুদ্ধ’ ব্যবসায়ীরা এক নতুন খেলা শুরু করল। তাদের লেলিয়ে দেয়া একশ্রেণীর ‘ইন্টারনেটবিলাসী’ ভ্রষ্ট তরুণ রাজধানীর শাহবাগে ‘যুদ্ধাপরাধের বিচার চাই’ ব্যানার সামনে রেখে শুরু করল এ দেশের হাযার বছরের ধর্মীয় চেতনার বিরুদ্ধে এক ভয়ংকর অপতৎপরতা। পত্র-পত্রিকায়, ইলেক্ট্রোনিক মিডিয়ায় এমনকি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাদেরকে নিয়ে শুরু হল অস্বাভাবিক মাতামাতি। স্বার্থান্বেষীদের এই অতি উৎসাহের পিছনে যত না উদ্দেশ্য ছিল ‘যুদ্ধাপরাধের বিচার’, তার চেয়ে বেশী ছিল এ দেশের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক কাঠামো থেকে ধর্মকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলার এক নোংরা অভিলাষ। এই লক্ষ্য পূরণের উদ্দেশ্যে মিসরের তাহরীর স্কয়ারের স্থানিক আবেদনকে ব্যবহার করে তারা শাহবাগকে ‘প্রজন্ম চত্বর’ হিসাবে ঘোষণা দেয় এবং তাদের লালিত ধর্মনিরপেক্ষ ও নাস্তিক্যবাদী চেতনাকে এ দেশের তৃণমূল পর্যায়ে বিস্তার করার জন্য দেশব্যাপী ‘ঢোল-তবলা’র আন্দোলন শুরু করে। তাদের আপ্রাণ প্রচেষ্টা ছিল ধর্মনিরপেক্ষ কুফরী চেতনাকে এ দেশের আপামর জনগণ বিশেষ করে ‘তরুণ প্রজন্মে’র চেতনা হিসাবে উপস্থাপন করা এবং সুকৌশলে ধর্মবিরোধী চেতনার একটি শক্ত সামাজিক ভিত দাঁড় করানো। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী যখন এই নাস্তিক্যবাদী আন্দোলনকে ‘দ্বিতীয় প্রজন্মের মুক্তিযুদ্ধ’ আখ্যায়িত করলেন, তখন তাদের স্পর্ধা বৃদ্ধি পেল আরো বহুগুণ। কিন্তু স্বভাবতই শাহবাগ চত্বরের দূরদৃষ্টিহীন তরুণদের মুখে অব্যাহতভাবে ‘ফাঁসি চাই ফাঁসি চাই’ শ্লোগান আর তীব্র ঘৃণা ও বিদ্বেষমূলক প্রচারণা কোন বিবেকবান মানুষ মন থেকে মেনে নিতে পারে নি। সেই সাথে শাহবাগীদের কর্মসূচী কাগজে-কলমে একটি ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলকে লক্ষ্য করে শুরু হলেও প্রচ্ছন্নভাবে ইসলামের বিরুদ্ধে তাদের নিদারুণ বিতৃষ্ণার বহিঃপ্রকাশ এবং আন্দোলনের নামে উন্মুক্ত, উদ্দাম নৃত্য ও গান-বাজনাসহ তাদের চরম বেলেল্লাপনা ভিতরে ভিতরে চরম ক্ষুব্ধ করে তুলেছিল এদেশের ধর্মপ্রাণ মানুষকে। অতঃপর নিকৃষ্টতম নাস্তিক রাজীবের নিহত হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে যখন এ আন্দোলনের নাস্তিক্যবাদী চরিত্র একেবারে খোলাখুলিভাবে প্রকাশ পেয়ে গেল, তখন দেশের আপামর জনতা আর স্থির থাকতে পারে নি। এমতবস্থায় শাহবাগীদের বিরুদ্ধে হেফাজতে ইসলাম ১৩ দফা দাবী নিয়ে রাজপথে নামলে দল-মত নির্বিশেষে সাধারণ মানুষ এ আন্দোলনকে অত্যন্ত স্বতঃস্ফূর্তভাবে স্বাগত জানালো। যার ঐতিহাসিক বহিঃপ্রকাশ ঘটল রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র শাপলা চত্বরে স্মরণকালের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ গণজমায়েতের মাধ্যমে। এই গণজমায়েত দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষের বুকে যেমন নতুন এক সাহস ও উদ্দীপনার জোয়ার সৃষ্টি করল, তেমনি একেবারে ম্রিয়মান করে ফেলল প্রায় দু’মাসব্যাপী শাহবাগী এবং তাদের দোসর ধর্মনিরপেক্ষ বুদ্ধিজীবি ও মিডিয়ার উল্লম্ফ নাচন। সবচেয়ে বড় কথা রাসূল (ছাঃ)-কে অবমাননাকারী ও নাস্তিক্যবাদীদের বিরুদ্ধে যেভাবে গর্জে উঠল সর্বস্তরের মুসলমান এবং সমাবেশকে কেন্দ্র করে ইসলামের প্রতি যে সার্বজনীন ও প্রাণবন্ত আবেগ-উচ্ছাসের জোয়ার পরিলক্ষিত হল, তা ছিল এ দেশের ইসলামী আন্দোলনের ইতিহাসে এক মাইলফলক। ইসলামপন্থী এবং ইসলামবিরোধীদের মধ্যে পার্থক্যরেখাটা এত স্পষ্ট হতে দেখা যায়নি ইতিপূর্বে কখনও। ফলে কোন কোন ধর্মনিরপেক্ষ কলামিস্ট পর্যন্ত বলতে বাধ্য হয়েছে যে, গত একশ বছরের ইতিহাসে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধর্ম এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেনি (আলী রিয়াজ, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি, প্রথম আলো, ৩০.০৫.১৩)। এমনকি মিডিয়ায় এবং টকশোতেও হেফাজতের ১৩ দফা দাবী যেরূপ গুরুত্বের সাথে আলোচনার বিষয়বস্ত্ত হয়ে পড়ল তা ইসলামের আদর্শিক বিজয়ের দিকেই ইঙ্গিত করছিল। কিন্তু শেষপর্যন্ত ৫ মে দিবাগত রাতের হতাশাব্যঞ্জক ও হৃদয়বিদারক রক্তাক্ত ট্রাজেডীর মাধ্যমে এ সম্ভাবনাময় আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় হঠাৎ ছেদ পড়ে গেল। তবে নেতিবাচক দিকগুলি বাদ দিলে যে বিষয়টি লক্ষ্যণীয়, এ আন্দোলন ইসলামের পক্ষে বহু অচেতন মুসলমানের ঘুমন্ত আবেগকে জাগিয়ে দিয়েছে এবং ভবিষ্যতে এদেশের সমাজ ও রাজনীতিতে ইসলামের আদর্শিক বিজয়ের পথে একটা বড় সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে। তাই সাময়িকভাবে হোঁচট খেলেও আগামীতে এ আন্দোলনের একটি সুসূরপ্রসারী প্রভাব পরিলক্ষিত হবে, এটা নিশ্চিতভাবে আশা করা যায়। তবে এখান থেকে আরেকটি বিষয় স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে ও আদর্শে অবিচল একদল কর্মীবাহিনী ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্ব না থাকলে কেবলমাত্র সাময়িক আবেগ দিয়ে ইসলামের প্রতিষ্ঠা হয় না। অপরদিকে আদর্শবান জান্নাতী মানুষ তৈরী না হলে আবেগী জনতা যত বেশী সংখ্যায় একতাবদ্ধ হৌক না কেন, তাতে ইসলামের বিজয় সাধিত হতে পারে না। সুতরাং বুলেট, ব্যালট কিংবা জনসংখ্যা কোনটাই ইসলামের বিজয়ের নিয়ামক নয়, বরং নিয়ামক হল ইসলামের বিশুদ্ধ আক্বীদা ও আমল। এই বিশুদ্ধ আক্বীদা ও আমলের উপর মুসলমানরা যতদিন সুদৃঢ়ভাবে একতাবদ্ধ হতে না পারবে, যতদিন বাতিল আক্বীদা ও মতাদর্শের খপ্পর থেকে নিজেদেরকে বের করে নিয়ে আসতে না পারবে, ততদিন ইসলামের সর্বাত্মক বিজয় প্রত্যাশা করা অমূলক। আল্লাহ আমাদেরকে এই চূড়ান্ত সত্যটি অনুধাবন করার তাওফীক দান করুন এবং ইসলামবিদ্বেষী যাবতীয় অপতৎপরতার বিরুদ্ধে যথাযথ প্রতিরোধ গড়ে তোলার সামর্থ্য দান করুন। আমীন!



বিষয়সমূহ: বিবিধ
আরও