মৃত্যু : একটি ধ্রুব বাস্তবতা ও আমরা!
মুজাহিদুল ইসলাম
তাওহীদুল আসমা ওয়াছ-ছিফাত (আল্লাহর নাম ও গুণাবলীর এককত্ব বজায় রাখা) :
তাওহীদুল আসমা ওয়াছ-ছিফাত-এ শিরক
(ক) মানবিকীকরণ দ্বারা শিরক
এই শ্রেণীর তাওহীদের পাঁচটি প্রধান রূপ আছে-
১. আল্লাহর নাম ও গুণাবলীর ক্ষেত্রে এককত্ব বজায় রাখার প্রথম শর্ত হ’ল, কুরআন এবং হাদীছে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (ছাঃ) আল্লাহর যেভাবে বর্ণনা দিয়েছেন সেভাবে ছাড়া আর কোনভাবে আল্লাহর নাম এবং গুণাবলীর বর্ণনা দেয়া যাবে না। তিনি বলেন, وَيُعَذِّبَ الْمُنَافِقِينَ وَالْمُنَافِقَاتِ وَالْمُشْرِكِينَ وَالْمُشْرِكَاتِ الظَّانِّينَ بِاللَّهِ ظَنَّ السَّوْءِ عَلَيْهِمْ دَائِرَةُ السَّوْءِ وَغَضِبَ اللَّهُ عَلَيْهِمْ وَلَعَنَهُمْ وَأَعَدَّ لَهُمْ جَهَنَّمَ وَسَاءَتْ مَصِيرًا ‘এবং মুনাফিক পুরুষ ও নারী এবং মুশরিক পুরুষ ও নারী যারা আল্লাহ সম্বন্ধে মন্দ ধারণা পোষণ করে তাদেরকে তিনি শাস্তি দিবেন। তাদের চারিদিকে অমঙ্গল চক্র, আল্লাহ তাদের প্রতি রাগ করেছেন, তাদের প্রতি অভিসম্পাত করেছেন এবং তাদের জন্য জাহান্নাম প্রস্তুত রেখেছেন। উহা কত নিকৃষ্ট আবাস’ (ফাত্হ্ ৬)।
কাজেই ক্রোধ আল্লাহর গুণাবলীর একটি। এটা বলা ভুল হবে যে, যেহেতু ক্রোধ মানুষের মধ্যে একটি দুর্বলতার চিহ্ন যা আল্লাহর জন্য শোভন নয় সেহেতু আল্লাহর ক্রোধ অবশ্যই তাঁর শাস্তি বুঝায়। ‘কোন কিছুই তাঁর সদৃশ নয়’ (শূরা ১১)। আল্লাহর এই ঘোষণার ভিত্তিতে আল্লাহর ক্রোধ যে মানুষের ক্রোধের মত নয় তা গ্রহণ করতে হবে। তথাকথিত ‘বিজ্ঞতাপূর্ণ’ (rational interpretation) ব্যাখ্যা অনুযায়ী যখন যুক্তিসম্মত সিদ্ধান্তে পৌছানো যায়, তখন তা নাস্তিকতার জন্ম দেয়।[1] কারণ আল্লাহ নিজেকে জীবন্ত বলে উল্লেখ করেছেন, সুতরাং যুক্তিবাদী বিচার অনুযায়ী স্রষ্টা নিষ্প্রাণ এবং অস্তিত্বহীন নয়। প্রকৃত ব্যাপার হ’ল আল্লাহর গুণাবলীর সঙ্গে মানুষের সাদৃশ্য শুধুমাত্র নামে, মাত্রায় নয়। যখন স্রষ্টাকে উদ্দেশ্য করে গুণাবলী ব্যবহৃত হয় তখন সেগুলি সার্বভৌম অর্থে গ্রহণ করতে হবে এবং বুঝতে হবে সে সেগুলি মানবসুলভ অসম্পূর্ণতা মুক্ত।
২. তাওহীদুল আসমা ওয়াছ-ছিফাত-এর দ্বিতীয় রূপ হ’ল আল্লাহর উপর কোন নতুন নাম ও গুণাবলী আরোপ না করে তিনি নিজেকে যেভাবে উল্লেখ করেছেন সেভাবেই তাঁকে উল্লেখ করা। উদাহরণ স্বরূপ, যদিও তিনি বলেছেন যে তিনি রাগ করেন তথাপি তাঁর নাম আল্-গাযিব (রাগী জন) দেয়া যাবে না। কারণ আল্লাহ বা তাঁর রাসূল (ছাঃ) কেউ এই নাম ব্যবহার করেননি। এটা একটি ক্ষুদ্র বিষয় মনে হতে পারে, কিন্তু আল্লাহর অসত্য বা ভুল বর্ণনা রোধ করার জন্য তাওহীদুল আসমা ওয়াছ-ছিফাত অবশ্যই বজায় রাখতে হবে। অর্থাৎ সসীম মানুষের পক্ষে কখনোই অসীম স্রষ্টার সংজ্ঞা দেওয়া সম্ভব নয়।
৩. তাওহীদুল আসমা ওয়াছ-ছিফাত-এর তৃতীয় শর্ত অনুযায়ী আল্লাহকে কখনোই তাঁর সৃষ্টির গুণাবলী দেয়া যাবে না। উদাহরণ স্বরূপ, বাইবেল ও তাওরাতে দাবী করা হয় যে, আল্লাহ ছয় দিনে বিশ্ব সৃষ্টি করেন এবং তারপর সপ্তম দিনে নিদ্রা যান। এই কারণে ইহুদি ও খৃষ্টানগণ হয় শনিবার নতুবা রবিবারকে বিশ্রামের দিন হিসাবে নেয় এবং ঐ দিন কাজ করাকে পাপ বলে গণ্য করে। এই ধরনের দাবী স্রষ্টার উপর তাঁর সৃষ্টির গুণাবলী আরোপ করে। মানুষই গুরুভার কাজের পর ক্লান্ত হয়ে পড়ে এবং সবলতা পুনরুদ্ধারের জন্য তাদের ঘুমের প্রয়োজন হয়।[2] বাইবেল ও তাওরাতের অন্য জায়গায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, মানুষ যেমন তার ভুল উপলদ্ধি করে অনুতপ্ত হয় তেমনি স্রষ্টাও তাঁর খারাপ চিন্তার জন্য অনুতপ্ত হন (I and the Lord repented of the evil which he thought to do to his people- Exodus 32: 14 ‘এবং প্রভু অনুতপ্ত হলেন মানুষের অমঙ্গল করার চিন্তা করার জন্য)।
অনুরূপভাবে স্রষ্টা একটি আত্মা অথবা তাঁর একটি আত্মা আছে বলে দাবী করা তাওহীদুল আসমা ওয়াছ-ছিফাতকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দেয়। আল্লাহ কুরআনের কোন জায়গায় নিজেকে আত্মা বলে উল্লেখ করেননি অথবা তাঁর রাসূল (ছাঃ) হাদীছে ঐ ধরনের কোন বক্তব্য প্রদান করেননি। প্রকৃতপক্ষে, আল্লাহ আত্মাকে তাঁর সৃষ্টির একটি অংশ হিসাবে উল্লেখ করেছেন।
আল্লাহর গুণাবলী উল্লেখ করতে কুরআনের আয়াতকে মৌলিক নিয়ম হিসাবে অনুসরণ করতে হবে, لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَهُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ ‘কোন কিছুই তাঁহার সদৃশ নয়, তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা’ (আশ-শূরা ১১)।
শ্রবণ ও দর্শন মানুষের গুণাবলী, কিস্তু যখন স্রষ্টার উপর আরোপিত করা হয় তখন সেগুলো তুলনাবিহীন এবং ত্রুটিমুক্ত। যাহোক এই গুণাবলী মানুষের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে চোখ ও কান অপরিহার্য, যা স্রষ্টার জন্য প্রযোজ্য নয়। স্রষ্টা সম্বন্ধে মানুষ কেবলমাত্র ততটুকুই জ্ঞাত যতটুকু তিনি তাঁর নবীদের মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। সুতরাং মানুষ এই সংকীর্ণ গন্ডির মধ্যে অবস্থান করতে বাধ্য। মানুষ যদি স্রষ্টার বর্ণনা দিতে লাগামহীন বুদ্ধি প্রয়োগ করে তাহলে আল্লাহকে তাঁর সৃষ্টির গুণাবলীর সঙ্গে সম্পৃক্ত করার মত ভুলের সম্ভাবনা থেকে যায়।
কল্পিত চিত্রের প্রতি আসক্তির কারণে খৃষ্টানরা মানুষ সদৃশ অগণিত চিত্র অঙ্কন, খোদাই এবং ঢালাই করে সেগুলিকে স্রষ্টার প্রতিচ্ছবি নাম দিয়েছে। এইগুলি জনগণের মধ্যে যিশুখৃষ্টের দেবত্বের স্বীকৃতি আদায় করতে সাহায্য করেছে। স্রষ্টা মানুষের মত, একবার এই কল্পনা গ্রহণযোগ্য হলে, যিশুখৃষ্টকে স্রষ্টা হিসাবে গ্রহণ করতে সত্যিকার কোন সমস্যা দেখা দেয় না।
৪. তাওহীদুল আসমা ওয়াছ-ছিফাত-এর চতুর্থ রূপের জন্য প্রয়োজন মানুষের উপর আল্লাহর গুণাবলী আরোপ না করা। যেমন, বাইবেলের নতুন সংস্করণে (New Testament) পলকে (Paul) তাওরাতে (Genesis 14:18-20) বর্ণিত সালেমের রাজা মেলচিজদেকের রূপে দেখানো হয়েছে এবং তার ও যিশুখৃস্টের কোন আদি বা অন্ত নেই, এই বলে স্বর্গীয় গুণে গুণাম্বিত করা হয়েছে-
‘স্রষ্টার প্রধান পুরোহিত, সালেমের রাজা মেলচিজদেক রাজাদের বধ করার পর প্রত্যাগত আব্রাহামের সঙ্গে সাক্ষাত করলেন এবং তাকে আশীর্বাদ করলেন এবং আব্রাহাম তাকে সব কিছুর এক দশমাংশ বিলি করে দিলেন। তাঁর নামের অর্থ হিসাবে তিনিই প্রথম ন্যায়নিষ্ঠার রাজা এবং সালেমেরও রাজা, অর্থাৎ শান্তির রাজা। তিনি পিতা অথবা মাতা অথবা বংশ বৃত্তান্ত এবং আদি অস্তবিহীন; কিস্তু স্রষ্টার পুত্রের সদৃশ হয়ে চিরদিন পুরোহিত হিসাবে বহাল থাকবেন (Hebrews 7: 1-3, Holy Bible, Revised Standard Version)।
সুতরাং যিশুখৃস্টও নিজেকে প্রধান পুরোহিত পদে পদোন্নতি দেননি কিন্তু তাঁর দ্বারা নিয়োজিত হয়েছিলেন যিনি তাঁকে বললেন, তুমি আমার পুত্র, আজ আমি তোমাকে জন্মদান করলাম’। যেমন তিনি অন্যখানেও বলেন, ‘‘মেলচিজ্দেকের পরে তুমি চিরদিনের জন্য পুরোহিত’’ (Hebrews 5: 5-6 (Holy Bible, Revised Standard Version)।
বেশীরভাগ শী‘আ সম্প্রদায় (ইয়েমেনের যাইদিয়া ছাড়া) তাদের ইমামগণকে সম্পূর্ণভাবে ভুলভ্রান্তির উর্ধ্বে (মাসুম)[3], অতীত, ভবিষ্যত ও অদৃশ্য সম্বন্ধে জ্ঞানী, ভাগ্য পরিবর্তনে সক্ষম[4] এবং সৃষ্টির অনু-পরমাণু নিয়ন্ত্রণকারী[5] হিসাবে স্বর্গীয় গুণে গুণান্বিত করেছে। এঁটা করতে যেয়ে তারা সেই সব প্রতিদ্বন্দ্বী সৃষ্টি করেছে যারা নাকি স্রষ্টার অদ্বিতীয় গুণাবলীর অংশীদার এবং আল্লাহর সমমর্যাদাসম্পন্ন (!)।
৫. আল্লাহর নামের এককত্ব বজায় রাখার আরও অর্থ হ’ল যদি নাত্মে আগে আব্দ’ (অর্থ ভৃত্য অথবা বান্দা) সংযোজিত না করা হয় তাহলে তার সৃষ্টিকে আল্লাহর কোন নামে নামকরণ করা যাবে না। কিস্তু ‘রউফ’ এবং ‘রহীম’ এর মত বহু স্বর্গীয় নাম মানুষের নাম হিসাবে অনুমোদিত কারণ রাসূল (ছাঃ)-কে উল্লেখ করতে যেয়ে আল্লাহ এই ধরনের কিছু নাম ব্যবহার করেছেন।
আল্লাহ বলেন, لَقَدْ جَاءَكُمْ رَسُولٌ مِنْ أَنْفُسِكُمْ عَزِيزٌ عَلَيْهِ مَا عَنِتُّمْ حَرِيصٌ عَلَيْكُمْ بِالْمُؤْمِنِينَ رَءُوفٌ رَحِيمٌ ‘তোমাদের মধ্যে হতেই তোমাদের নিকট এক রাসূল এসেছেন। তোমাদেরকে যা বিপন্ন করে তা তাঁর জন্য কষ্টদায়ক। তিনি তোমাদের মঙ্গলকামী, মু’মিনদের প্রতি দরদী (রউফ) ও পরম দয়ালু (রহীম)’ (আত-তওবা ৯ঃ ১২৮)।
কিস্তু ‘আর-রউফ’ (যিনি সবচেয়ে সহমর্মিতায় ভরপুর) এবং ‘আর রহীম’ (সবচেয়ে ক্ষমাশীল) মানুষের ব্যাপারে তখনই ব্যবহার করা যাবে যখন নামের আগে আবদ ব্যবহার করা হবে, যেমন আব্দুর-রউফ অথবা আব্দুর রহীম। আর-রাউফ এবং আর-রহীম এমন এক পূর্ণতার প্রতিনিধিত্ব করে যা শুধুমাত্র আল্লাহর জন্যই প্রযোজ্য। তেমনিভাবে, আব্দুর রাসূল (বার্তাবাহকের গোলাম), আব্দুন নবী (রাসূলের গোলাম), আব্দুল হুসাইন (হুসাইনের গোলাম) ইত্যাদি নামগুলি নিষিদ্ধ, কারণ এখানে মানুষ নিজেদেরকে আল্লাহ ব্যতীত অন্যের গোলাম হিসাবে ঘোষণা করেছে। এই কারণে রাসূল (ছাঃ) মুসলিমদের তাদের অধীনস্থদের ‘আবদী’ (আমার গোলাম) অথবা ‘আমাতী’ (আমার বাঁদী) বলে উল্লেখ করতে নিষেধ করেছেন (মুসলিম, মিশকাত হা/৪৭৬০)।
এই শ্রেণীর শিরকে আল্লাহর উপর তাঁর সৃষ্টির গুণাবলী আরোপ করার সাধারণ পৌত্তলিক প্রথা এবং একই সাথে সৃষ্ট বসুতর উপর আল্লাহর নাম ও গুণাবলী আরোপ করা উভয়ই অন্তর্ভুক্ত।
আসমা ওয়াছ-ছিফাতের এই শিরকের রূপ হল আল্লাহকে মানুষ ও জন্তুর আকার ও বৈশিষ্ট্য প্রদান করা। পশুর উপর মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের কারণে মূর্তিপূজারীরা সাধারণভাবে সৃষ্টিতে স্রষ্টার প্রতীক ব্যবহার করতে মানুষের আকার ব্যবহার করে। ফলে প্রায়ই তারা যাদের পূজা করে তাদের শারীরিক বৈশিষ্ট্য বিশিষ্ট মানুষের আকারে স্রষ্টার প্রতিকৃতি অংকন করে, ছাঁচ এবং খোদাই তৈরী করে। উদাহরণস্বরূপ, হিন্দু ও বৌদ্ধরা এশিয়ার লোক সদৃশ অগণিত মূর্তি পূজা করে এবং এই সব মূর্তিকে সৃষ্টির মধ্যে স্রষ্টার প্রকাশ হিসাবে গণ্য করে। আধুনিক খৃষ্টানরা বিশ্বাস করে যে, পয়গম্বর যিশু মূর্তিমান স্রষ্টা ছিলেন। স্রষ্টা যে তাঁর নিজের সৃষ্টি এটা সেই ধরনের শিরক এর উদাহরণ। তথাকথিত অসংখ্য প্রসিদ্ধ খৃস্টান চিত্রকরদের মধ্যে মাইকেল এ্যাঞ্জেলো বিখ্যাত ছিলেন (Michaelangelo, মৃঃ ১৫৬৫ খ্রি)। তিনি ভ্যাটিক্যানে অবস্থিত সিসটিন গির্জার (Sistine Chapel) ছাদে স্রষ্টাকে এঁকেছিলেন লম্বা ঝুলে পড়া চুল দাড়ি বিশিষ্ট একজন উলঙ্গ ইউরোপীয় বৃদ্ধ হিসাবে। কালক্রমে এই সব চিত্র খৃস্টান জগতে অত্যন্ত শ্রদ্ধার বস্তু বলে বিবেচিত হয়।
(খ) দেবত্ব আরোপের দ্বারা শির্ক
আসমা ওয়াছ-ছিফাতের এই ধরনের শিরক এমন বিষয় সম্পর্কিত যেখানে সৃষ্টিকৃত জীবন্ত প্রাণী অথবা বস্তুকে আল্লাহর নাম অথবা তাঁর গুণাবলী আরোপ করা হয়। যেমন যেসব মূর্তির নাম আল্লাহর নাম থেকে গ্রহণ করা হয়েছিল যেসব মূর্তি পুজা করা প্রাচীন আরবদের প্রথা ছিল। তাদের প্রধান তিন মূর্তি হল আল্লাহর নাম আল-ইলাহ থেকে নেয়া আল-লাত্, আল আজিজ থেকে নেয়া আল উজ্জাহ এবং আল্ মান্নান থেকে নেয়া আল-মানাত। রাসূল মুহাম্মদ (ছাঃ)-এর যুগে ইয়ামামা এলাকায় একজন মিথ্যা নবীও ছিল, যে ‘রহমান’ নাম গ্রহণ করেছিল, যে নাম শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য প্রযোজ্য।
সিরিয়ার শী‘আদের মধ্যে ‘নুসাইরিয়াহ’ নামের সম্প্রদায় বিশ্বাস করে যে, রাসূল মুহাম্মদ (ছাঃ)-এর চাচাতো ভাই ও জামাত আলী ইব্নে আবি তালিবের মধ্যে আল্লাহর প্রকাশ ছিল এবং তাঁর উপর আল্লাহর অনেক গুণ আরোপিত করেছিল। এদের মধ্যে ইসমাইলীরা যারা আগাখানি বলেও পরিচিত, তারা তাদের নেতা আগা খানকে স্রষ্টার প্রকাশ বলে মনে করে। লেবাননের দ্রুজরাও এই শ্রেণীভুক্ত, যারা বিশ্বাস করে যে ফাতেমীয় খলিফা আল-হাকিম বিন আমরিল্লাহ মনুষ্য জাতির মধ্যে আল্লাহর শেষ প্রকাশ।
আল-হাল্লাজের মত ছূফীদের (মরমীবাদী মুসলিম) দাবী যে, তারা স্রষ্টার সঙ্গে একীভূত হয়ে গেছে। সুতরাং স্রষ্টার সৃষ্টির মধ্যে তারা স্রষ্টার প্রকাশ হিসাবে বিরাজ করছে, তাদের এই দাবিও আসমা ওয়াছ-ছিফাতের শ্রেণীভুক্ত শির্ক এর অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। আধুনিক দিনের আধ্যাত্মিকতায় বিশ্বাসীগণ যেমন শার্লী ম্যাকলিন (Shirley Maclaine) জে, জে, নাইট (J. Z. Knight) প্রায়শই নিজেদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের উপর দেবত্ব দাবি করে। বহুল পঠিত আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ব (E = mc2, শক্তি সমান ভর গুনন আলোর গতির বর্গফল) প্রকৃতপক্ষে আসমা ওয়াছ-ছিফাতের অন্তর্ভুক্ত শিরকের অভিব্যক্তি। এই তত্ত্ব মতে শক্তি সৃষ্টি বা ধ্বংস কোনটাই করা যায় না। শুধুমাত্র শক্তি পদার্থে রূপান্তরিত হয় অথবা পদার্থ শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। যাহোক পদার্থ এবং শক্তি উভয়ই সৃষ্ট অস্তিত্ব এবং উভয়কেই ধ্বংস করা হবে। আল্লাহ যেমন স্পষ্ট উল্লেখ করেছেন-اللَّهُ خَالِقُ كُلِّ شَيْءٍ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ وَكِيلٌ ‘আল্লাহ সমস্ত কিছুরই স্রষ্টা এবং তিনি সমস্ত কিছুরই বিধায়ক’ (যুমার ৩৯ঃ ৬২)। তিনি আরো বলেন, كُلُّ مَنْ عَلَيْهَا فَانٍ ‘ভুপৃষ্ঠে যা কিছু আছে সমস্তই ধ্বংস হয়ে যাবে’ (রহমান, ৫৫ঃ ২৬)।
এই তত্ত্বের আরও অর্থ এই যে, পদার্থ এবং শক্তি চিরন্তন যার কোন শুরু অথবা শেষ নেই, যেহেতু এ দু’টির জন্ম নেই এবং একটার থেকে অন্যটায় রূপান্তরিত হয় বলে ধরা হয়। যাহোক, এই স্বাভাবিক গুণ শুধু আল্লাহর এবং তিনি একমাত্র যাঁর শুরু অথবা শেষ নেই।
ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্বও স্রষ্টার হস্তক্ষেপ ছাড়াই প্রাণহীন পদার্থ হতে প্রাণ এবং আকারের বিবর্তন সম্বন্ধে ব্যাখ্যা দেবার একটা প্রচেষ্টা। এই শতাব্দীর একজন শীর্ষ ডারউইনতাত্ত্বিক স্যার আলডাস হাক্সলি তাঁর চিন্তাধারা নিম্নরূপভাবে প্রকাশ করেছেন- ‘ডারউইনতত্ত্ব, প্রাণী সত্ত্বার সৃষ্টিকর্তা হিসাবে স্রষ্টার ধারণাকে সম্পূর্ণভাবে রাষ্ট্রীয় আলোচনার পরিমন্ডল থেকে দূর করে দিয়েছে।[6] অর্থাৎ ডারউইনতত্ত্ব স্রষ্টার অস্তিত্বকে মিথ্যা প্রমাণ করেছে।
[1]. “rational interpretation” দ্বারা খুব সম্ভবত লেখক আবু আমিনাহ এটাই বলতে চেয়েছেন যে যেহেতু ‘কোন কিছুই তাঁর সদৃশ নয়’ (শূরা ১১) কাজেই আল্লাহ মানুষের মত এবং যেহেতু মানুষের প্রাণ আছে কাজেই আল্লাহর প্রাণ থাকতে পারে না। এই যুক্তির ফলেই একজন নাস্তিকতায় উপনীত হয়। কিন্তু এটা শুধু শব্দের মারপ্যাঁচের মাধ্যমে সত্যের অপব্যাখ্যা- অনুবাদক।
[2]. এর বিপরীতে আল্লাহ কুরআনে পরিস্কারভাবে উল্লেখ করেছেন, ‘তাঁকে তন্দ্রা অথবা নিদ্রা স্পর্শ করে না’-আল বাকারা ২৫৫।
[3]. মুহাম্মাদ রিযা আল্-মুযাফফর তার Faith of Shi’a Islam (U.S.A) Muhammadi Trust of Great Britain and Northern Ireland, 2nd ed, 1983). শীর্ষক বইতে উল্লেখ করেছেন, আমরা বিশ্বাস করি যে, রাসূলের মত, একজন ইমাম অবশ্যই ভুলভ্রান্তির ঊধের্ব অর্থাৎ জন্ম হতে মৃত্যু পর্যন্ত, প্রকাশ্য অথবা অপ্রকাশ্য, পরিকল্পিতভাবে অথবা অপরিকল্পিভাবে ভুল করা অথবা অন্যায় করায় অক্ষম। কারণ ইমামগণ ইসলামের সংরক্ষক এবং এটা তাদের অধীনে সুরক্ষিত; পৃষ্ঠা ৩২। আরও দেখুন- Islam (Teheran: A Group of Muslim Brothers, 1973), p 35, by Sayed Saeed Akhtar Rizvi.
[4]. আল মুযাফফর আরো উল্লেখ করেছেন, আমরা বিশ্বাস করি যে ইমামগণের অনুপ্রেরণা পাবার ক্ষমতা উৎকর্ষতা চূড়ান্ত শিখরে পৌঁছেছে এবং আমরা এটাকে স্বর্গীয় ভাবে প্রদত্ত ক্ষমতা বলি। এই ক্ষমতা বলে ইমাম সুশৃঙ্খল যুক্তিতর্ক অথবা কোন শিক্ষকের পথ নির্দেশ ছাড়াই যে কোন স্থানে এবং যে কোন সময়ে যে কোন বিষয়ে সংবাদ তাৎক্ষণিকভাবে বুঝতে সক্ষম।
[5]. খোমেনী বলেন, ‘নিশ্চয়ই ইমামের একটি সম্মানজনক অবস্থান, সুউচ্চ পদমর্যাদা, সৃজনশীল খেলাফত এবং সৃষ্টির সকল পরমাণুর উপর সার্বভৌম ক্ষমতা ও প্রাধান্য রয়েছে’। (Aayatullah Musavi al-khomeini, al-Hukoomah al- Islaameyah, Beirut: at Taleeiah press, Arabic ed, 1979, p 52).
[6]. Quoted in Francis Hitchingis the Neck of the Giraffe, (New York: Ticknor and Fields, 1982), p 245 from Tax and Callender, 1960, vol III p 45।
ড. আবু আমীনা বিলাল ফিলিপ্স
অনুবাদ : আবু হেনা