প্রসঙ্গ : তাবলীগী ইজতেমা : একটি সংস্কারধর্মী গণআন্দোলন

বযলুর রহমান 889 বার পঠিত

ভূমিকা

নবী ও রাসূলগণ আল্লাহর নির্দেশনার প্রচার-প্রসার এবং তা নিজেদের জীবনে বাস্তবায়নের মাধ্যমে সমাজের নিকটে নিজেদেরকে এক অবিস্মরণীয় মডেল হিসাবে উপস্থাপন করেন। উপস্থিত হন এক দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী যুগ সংস্কারক হিসাবে। যার আলোড়নে অনুপ্রাণিত হয়ে নির্যাতিত মানবতা দলে দলে ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করে ধন্য হয়। বিশ্ব ইতিহাস যার জ্বাজল্য প্রমাণ। মূলত প্রচারের মাধ্যমে সংশোধন ও সংস্কারের পথের উপরই নির্মিত হয় ইসলামের চির শাশ্বত সোনালী সৌধ। যে সৌধ মটকাবে কিন্তু ভাঙ্গবে না। বস্ত্ততঃ দাওয়াত ও তাবলীগের মৌলিকত্ব ও চিরন্তনতা এখানেই নিহিত। নিম্নে বাংলাদেশের বুকে ১৯৯১ সাল থেকে অদ্যবধি চলমান ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’ আয়োজিত বার্ষিক জাতীয় তাবলীগী ইজতেমা সম্পর্কে একটি পর্যালোচনা এবং একটি সংস্কারধর্মী গণআন্দোলনের প্রতিরূপ হিসাবে এর মূল্যায়ন উপস্থাপন করা হল।  

ফিরে দেখা

১৯৭৮ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারী। শিরক ও বিদ‘আতের আতঙ্ক, বাতিলের খড়গ, হক ও ন্যায়ের অতন্দ্রপ্রহরী নির্ভেজাল তাওহীদের ঝান্ডাবাহী এদেশের একক যুবসংগঠন ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ’ এক নতুন দিনের সোনালী স্বপ্নের হাতছানি দিয়ে আত্মপ্রকাশ লাভ করে। তরুণ ছাত্র ও যুব সমাজের নিকটে নির্ভেজাল তাওহীদের বাণী পৌঁছিয়ে দেওয়া এবং তাদেরকে যাবতীয় শিরক, বিদ‘আত ও তাক্বলীদী ফির্কাবন্দীর অর্গল থেকে মুক্ত হয়ে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ ও খালেছ মনে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহ অনুযায়ী নিজের জীবন ও পরিবার গঠনে উদ্বুদ্ধ করা।

‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ’ প্রতিষ্ঠার পরপরই দুই বছরের মাথায় পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের ঘুমন্ত দাওয়াতকে বিশ্ব মানবতার নিকটে পৌঁছে দেওয়া এবং ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায় ও গোষ্ঠী নির্বিশেষে সকল জনসাধারণের নিকট ইসলামের নির্ভেজাল বক্তব্য উপস্থাপনের মহা পরিকল্পনা নিয়ে আহলেহাদীছ আন্দোলনের ইতিহাসে ঢাকা যেলা ক্রীড়া সমিতি মিলনায়তনে ‘ঐতিহাসিক ১ম জাতীয় সম্মেলন’-এর পদযাত্রা শুরু হয়। ১৯৮০ সালের ৫ ও ৬ এপ্রিল। আহলেহাদীছ আন্দোলনের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় দিন। এদিন থেকেই আহলেহাদীছ যুবসংঘের স্বচ্ছ দাওয়াত জাতীয় সীমানা পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলের বিস্তৃত ময়দানে পদযাত্রার সূচনা করে। ফালিল্লা-হিল হামদ। সেদিন আহলেহাদীছ যুবসংঘের ইতিহাসে এমনকি খোদ বাংলাদেশের ইতিহাসে হয়তবা সর্বপ্রথম ‘তাওহীদের শিক্ষা ও আজকের সমাজ’ শীর্ষক ইসলামী সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। যা উপস্থিত সুধী মন্ডলী কর্তৃক উচ্ছ্বসিত প্রশংসিত হয় এবং বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করে প্রচার করার প্রস্তাব আসে। অনুষ্ঠানে অন্যান্যদের মধ্যে বিশেষ অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন সঊদী রাষ্ট্রদূত ফুয়াদ আবদুল হামীদ আল-খত্বীব প্রমুখ। সেদিন এই ঐতিহাসিক সম্মেলনে দেশের নানা প্রান্ত থেকে তরুণ ও যুবকরা স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করেন। সত্যের সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মিছিলে এই অভূতপূর্ব আবেগ-অনুভূতির উচ্ছ্বাস যেন সুস্পষ্টভাবেই এ দেশে আহলেহাদীছ আন্দোলনের এক নবজোয়ারের আগমনীবার্তা অনুরণিত করেছিল (মাসিক আত-তাহরীক, মার্চ-২০১২, ১৫তম বর্ষ ৬ষ্ঠ সংখ্যা, পৃষ্ঠা ৪১)। অতঃপর অনেক ঘাত-প্রতিঘাত, অনেক সংঘাত ও আভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্রের কারণে ‘জাতীয় সম্মেলন’-এর ধারাবাহিকতায় পড়ে যায় এগার বছরের এক দীর্ঘ বিরতি। তারপর উক্ত ঘাত-প্রতিঘাত, ঝড়-ঝঞ্ঝাকে সাহসিকতার সাথে মোকাবেলা করে পুনরায় ১৯৯১ সালের ২৫ ও ২৬ শে এপ্রিল দ্বিতীয়বারের মত অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় সম্মেলন ও তাবলীগী ইজতেমা। রাজশাহী মহানগরীর উপকণ্ঠে ১৯৪৯ সালে মাওলানা আব্দুল্লাহিল কাফী আল-কোরায়শী (রহঃ) যে নওদাপাড়ার মাটিতে এক ঐতিহাসিক সমাবেশ করেছিলেন, সেখানেই প্রতিষ্ঠিত ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী’-এর দক্ষিণ পার্শ্বের বিস্তীর্ণ খোলা ময়দানে এই জাতীয় সম্মেলন ও তাবলীগী ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর থেকে প্রতি বছর বাংলাদেশের সর্বাধিক আহলেহাদীছ অধ্যুষিত এই রাজশাহীতে তাবলীগী ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। ফালিল্লা-হিল হামদ

বাঁধার প্রাচীর ডিঙ্গিয়ে সত্যের আত্মপ্রকাশ

তাবলীগী ইজতেমার উক্ত ধারাবাহিকতা বাধাগ্রস্ত হয় ২০০৫ সালে। তৎকালীন ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী তথাকথিত ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলের কোপানলে পড়ে যায় সত্যান্বেষী ও জান্নাত পাগল হাজার হাজার মানুষের হৃদপিন্ড সদৃশ এই ‘তাবলীগী ইজতেমা’। জঙ্গীবাদের মিথ্যা ধোঁয়া তুলে ইজতেমার মাত্র দুদিন পূর্বে ২২ শে ফেব্রুয়ারীর গভীর রাতে সংগঠনের কেন্দ্রীয় কার্যালয় ‘দারুল ইমারত আহলেহাদীছ’ থেকে অকস্মাৎ বিনা ওয়ারেন্টে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করা হয় তাবলীগী ইজতেমার মাননীয় সভাপতি, ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’-এর মুহতারাম আমীর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবী বিভাগের প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিবসহ শীর্ষ চার কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দকে। পন্ড করে দেয়া হয় তাবলীগী ইজতেমার সুদৃশ্য বিশাল প্যান্ডেল। জনমনে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে ভয়ংকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সশস্ত্র অবস্থান গ্রহণ করে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের চতুর্দিকে। সৃষ্টি হয় এক ভুতুড়ে পরিবেশের। এই কিংকর্তব্যবিমূঢ় ও হতবুদ্ধিকর পরিস্থিতিতেও দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে সত্যের তেজোদীপ্ত শক্তির বলে বলীয়ান হয়ে অসংখ্য মানুষ ইজতেমা ময়দানে হাজির হন এবং ইজতেমা না হওয়ার বেদনায় ব্যথাতুর মনে অশ্রুসিক্ত নয়নে প্রত্যাবর্তন করেন। সেদিন নির্বিকার হয়ে গিয়েছিল মানুষের চিন্তা-চেতনা। স্তব্ধ হয়েছিল বাকশক্তি। দিগ্বিদিক শূন্য হয়ে মানুষগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। কিন্তু থেমে থাকেনি তারা। বেঈমানী করেনি তাদের ঈমানী খুন। রীতিমত আন্দোলন ও বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই করে সর্বোপরি আল্লাহর মেহেরবানীতে দীর্ঘ তিন বছর ছয় মাস ছয়দিন কারাভোগের পর ২০০৮ সালের ২৮ আগষ্ট মুহতারাম আমীর কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করেন (ফালিল্লাহিল হাম্দ)। অতঃপর আজ অবধি তাবলীগী ইজতেমা সফল ও নিয়মতান্ত্রিকভাবে সুশৃঙ্খলভাবে বাস্তবায়িত হয়ে আসছে। ফালিল্লা-হিল হামদ।

সমাজ সংস্কারের কতিপয় দৃষ্টান্ত

প্রতিবছরের ফেব্রুয়ারী মাসটি সংগঠনের জন্য একটি বিশেষ মাস। রাজশাহীর ইজতেমায় আগমন করে হক্বপন্থী আপোষহীন আলেমদের নিকট থেকে ইসলামের মৌলিক শিক্ষা পাওয়ার জন্য হক্বপিয়াসী মানুষের উচ্ছ্বসিত মনটা ব্যাকুল হয়ে উঠে। জান্নাত পাওয়ার আশায় যাবতীয় কষ্টকে তারা হাসিমুখে ধৈর্যের সাথে বরণ করে নেন।

কিন্ত কেন এই ব্যাকুলতা, কেন এই ব্যাগ্রতা? এর কারণ এদেশের মুসলিম সমাজে যে সংস্কারের পদধ্বনি দিনে দিনে উচ্চকিত হচ্ছে, বিগত ২২ বছর ধরে চলমান এই তাবলীগী ইজতেমা তারই সুযোগ্য প্রতিনিধিত্ব করে চলেছে প্রতিনিয়ত। শিরক ও বিদ‘আত থেকে সতর্ক হওয়া, যঈফ ও জাল হাদীছের উপর আমল না করা, যত বড় পীর-বুযুর্গই হোক না কেন, কোন মানুষকে অন্ধ অনুসরণ না করার চেতনা জাগ্রত করার মাধ্যমে এই তাবলীগী ইজতেমা এ দেশের ঘুণে ধরা মুসলিম সমাজে যে ঈমানী চেতনার ঢেউ জাগিয়ে তুলেছে, তা সত্যিই আমাদেরকে আবেগাক্রান্ত করে তোলে এবং মহান আল্লাহর দরবারে কৃতজ্ঞতার অশ্রুপাত নির্গত করায়। নিম্নে তাবলীগী ইজতেমার কতিপয় সমাজ সংস্কারের দিক আলোচনা করা হ’ল।

(ক) ভ্রান্ত আক্বীদার বিপরীতে বিশুদ্ধ আক্বীদার শিক্ষা : এক সময় এ দেশের মুসলিম সমাজ ছিল একচেটিয়াভাবে ভ্রান্ত আক্বীদায় ভরপুর। আল্লাহ নিরাকার, তিনি সর্বত্র বিরাজমান, রাসূল নূরের তৈরী, রাসূল গায়েব বা অদৃশ্যের খবর জানেন- ইত্যাকার অসংখ্য সামাজিক কুসংস্কার ও ভ্রান্ত বিশ্বাসে আচ্ছন্ন ছিল মুসলিম সমাজ। এমনকি আহলেহাদীছ নামধারীদের মধ্যেও এরূপ ধারণা বিদ্যমান ছিল। কিন্তু আহলেহাদীছ আন্দোলনের এই তাবলীগী ইজতেমা মানুষের ঘুমন্ত চেতনাকে অভ্রান্ত সত্যের চূড়ান্ত উৎস অহীর বিধানের কাছে আত্মসমর্পণের আহবানে জাগ্রত করেছে এবং সমাজের ভ্রান্ত আক্বীদা ও সামাজিক কুসংস্কারের মূলে কুঠারাঘাত হেনে আল্লাহ প্রদত্ত ও রাসূল (ছাঃ) প্রদর্শিত এবং সালাফে ছালেহীনের অনুসৃত পথ ও পদ্ধতি জনগণের সম্মুখে উন্মোচিত করতে সক্ষম হয়েছে।

(খ) বিশুদ্ধ প্রমাণ নির্ভর আমলে অভ্যস্তকরণ : বিশুদ্ধ দলীল নির্ভর আমল ইবাদত কবুলের আবশ্যিক পূর্বশর্ত। কিন্তু বাংলার মুসলিম জনসাধারণ ইসলাম প্রতিপালনের জন্য বিশুদ্ধ দলীলের তোয়াক্কা করত না। মাযহাবী ফের্কাবন্দীর আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছিল মুসলমানদের ঈমানী চেতনা। অধিকাংশ আমল ছিল মাযহাবী ইমামের অন্ধভক্তি এবং যঈফ ও জাল হাদীছ নির্ভর। সুতরাং মানুষ যাতে করে বিশুদ্ধ প্রমাণ নির্ভর আমলী যিন্দেগী পরিচালনা করতে পারে সেই জন্য তাবলীগী ইজতেমা সর্বসাধারণ মানুষের নিকট অত্যন্ত জোরালোভাবে আহবান করে থাকে। যার ফলে সমাজের একজন নিম্নস্তরের সাধারণ মানুষ পর্যন্ত এখন মিথ্যা ও দুর্বল হাদীছের পরিবর্তে ছহীহ দলীলের অনুসন্ধান করে (ফালিল্লা-হিল হামদ)

(গ) মস্তিষ্কপ্রসূত মতবাদ সমূহকে পরিহারের আহবান : মানুষ তার জীবনের বিস্তৃত অঙ্গনে প্রবৃত্তিকে অনুসরণ করছে। ফলে বস্ত্তবাদিতা ও পরকালবিমুখতা মানুষকে হিংস্র পশুতে পরিণত করেছে। গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, জাতীয়তাবাদ, মার্কসবাদ, পুঁজিবাদ, সমাজতন্ত্রবাদ প্রভৃতি মস্তিস্কপ্রসূত মতবাদ সমূহ মুসলিম জনসাধারণকে ধর্মীয় পরিমন্ডল থেকে বের করে দুনিয়া সর্বস্ব মানুষের গোলামীতে আবদ্ধ করেছে। ফলে বিশ্ব আজ অশান্তির অগ্নিগর্ভে পরিণত হয়েছে। অশান্তির আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে বিশ্বব্যাপী। তাবলীগী ইজতেমা তাই বিশ্বের মানুষের নিকটে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ও অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে এগুলোর অসারতা প্রমাণ করে এর বিরুদ্ধে তীব্রভাবে প্রতিবাদ করে বলে, ‘সকল বিধান বাতিল কর, অহির বিধান কায়েম কর’। সাথে সাথে দৃপ্তভাবে ঘোষণা করে, ‘আমরা চাই এমন একটি সমাজ যেখানে থাকবে না প্রগতির নামে কোন বিজাতীয় মতবাদ, থাকবে না ইসলামের নামে কোন মাযহাবী সংকীর্ণতাবাদ’।

(ঘ) পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে জীবন গড়া : অখন্ড মুসলিম মিল্লাত আজ ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হ’য়ে গেছে। বিভিন্ন মাযহাব, মতবাদ, ইযম, মারিফতী ফন্দী ও তরীকার বেড়াজালে মানুষ আজ শতধা বিভক্ত। মুসলমান আজ নিজেদের মধ্যে মতের সাদৃশ্য না হওয়ায় সামাজিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করছে। নিজের পিতা, ভাই ও বোনকে পরিবারচ্যুত এমনকি সমাজচ্যুত করতে দেখা যায় মতের অমিলের কারণে। সুতরাং এহেন পরিস্থিতিতে তাবলীগী ইজতেমা মানুষকে যাবতীয় মাযহাব, মতবাদ, ইযম ও তরীকার বেড়াজাল ছিন্ন করে অভ্রান্ত সত্যের চূড়ান্ত ও একমাত্র মানদন্ড পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের মর্মমূলে জমায়েত হয়ে বিশুদ্ধ জীবনবিধানের প্রতি বিশ্ববাসীকে আহবান করে থাকে। এ লক্ষ্যে তাবলীগী ইজতেমার সহজ-সরল অথচ তাৎপর্যপূর্ণ আহবান-‘আসুন! পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে জীবন গড়ি’।

(ঙ) পরকালমুখী হওয়া : তাবলীগী ইজতেমার অন্যতম দিক হল এখানে কোন আলোচক বা বক্তাগণ অন্য কোন দল বা মতের প্রতি আক্রমণ করা থেকে বিরত থাকে। এমন কোন বাক্য ব্যবহার করা হয় না যাতে অন্য দল বা সংগঠনের সদস্য বা মানুষকে কষ্ট বা দুঃখ দেয়। বরং মানুষকে সর্বদা দুনিয়াকে প্রাধান্য না দিয়ে পরকালমুখী করার উদাত্ত আহবান করে থাকে। আর এখানেই নওদাপাড়ার তাবলীগী ইজতেমার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ফুটে ওঠে।

(চ) একক ইমারতের অধীনে জামা‘আতবদ্ধ জীবন-যাপন করা : জামা‘আতবদ্ধ জীবন-যাপন মুসলিম জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এককভাবে জীবন-যাপন বৃক্ষ-লতাহীন মরুভূমির ন্যায়। জামা‘আত ছাড়া বসবাস করা জাহিলিয়াতের হালাতে মৃত্যুর সাথে তুলনীয়। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি এক বিঘত পরিমাণ জামা‘আত থেকে পৃথক থাকল, সে যদি মৃত্যুবরণ করে তা’হলে জাহিলিয়াতের হালাতে মৃত্যুবরণ করবে’ (ছহীহ বুখারী হা/৭০৫৪; ছহীহ মুসলিম হা/৪৮৯২; মিশকাত হা/৩৬৬৮, ‘নেতৃত্ব ও বিচার ফায়সালা’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-১)। সুতরাং ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশে’র তাবলীগী ইজতেমা বিশ্ব মানবতাকে একক নির্ভেজাল তাওহীদ ও রাসূল (ছাঃ)-এর পূর্ণ আনুগত্য স্বীকারকারী একক ইমারতের অধীনে সার্বিক জীবন পরিচালনা করার জন্য জোর তাগিদ প্রদান করে।

(ছ) শিরক ও বিদ‘আতমুক্ত জীবন গঠন :  শিরকের শিখন্ডী আর বিদ‘আতের বেসাতী চূর্ণ-বিচূর্ণ ও উৎখাতের জন্য পৃথিবীতে আল্লাহ তা‘আলা নবী-রাসূলদেরকে প্রেরণ করেছেন। কিন্তু মুসলিম বিশ্ব আজ শিরক ও বিদ‘আতের নোংরা নর্দমায় নিমজ্জিত। ভুলে গেছে মুসলিম ঐতিহ্য আর রাসূলের বিশ্বজয়ী আদর্শের বিশ্বময়তার বিস্ময়তা। তাই নির্ভেজাল তাওহীদের বিলুপ্তপ্রায় বিশুদ্ধ আদর্শকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আহলেহাদীছ আন্দোলনের এই তাবলীগী ইজতেমা এক বিরাট ভূমিকা পালন করে আসছে।

অন্যান্য তাবলীগী ইজতেমা আর নওদাপাড়ায় আহলেহাদীছের তাবলীগী ইজতেমার মধ্যে কতিপয় পার্থক্য :

দেশে প্রচলিত স্বপ্নে প্রাপ্ত মতবাদ ও শিরক-বিদ‘আতের আখড়া ইঁলিয়াসী জামা‘আতের তাবলীগী ইজতেমা প্রতিবছর ঢাকায় টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরে অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে লাখো মুসলিম জনসাধারণ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে উপস্থিত হয়ে থাকে। অন্যদিকে আল্লাহ প্রদত্ত ও তাঁর রাসূল (ছাঃ) প্রদর্শিত পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে জীবন গড়ার উদাত্ত আহবান জানিয়ে অনুষ্ঠিত হয় উত্তরবঙ্গে রাজশাহীর নওদাপাড়ার ট্রাক টার্মিনাল ময়দানে আহলেহাদীছের সুবৃহৎ দুদিন ব্যাপী তাবলীগী ইজতেমা। আক্বীদাগত বিশ্বাস, আমলগত বৈশিষ্ট্য ও চূড়ান্ত লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার পথ-পরিক্রমণের দিকে লক্ষ্য করলে উভয় ইজতেমার মধ্যে দেখা যায় বিস্তর ব্যবধান। যেমন-

(ক) টঙ্গীর ইজতেমায় উক্ত জামাআতের প্রতিষ্ঠাতা মহোদয়ের কপল-কল্পিত কেচ্ছা-কাহিনী এবং যঈফ ও জাল হাদীছ ভিত্তিক আমলের প্রতি আহবান করা হয়। পক্ষান্তরে আহলেহাদীছের তাবলীগী ইজতেমায় কেবলমাত্র পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে জীবন গড়ার প্রতি আহবান করা হয়।

(খ) টঙ্গীর ইজতেমায় মিথ্যা ফযীলতের ধোঁকা, চিল্লা প্রথা আর আক্বীদাগত বিভ্রান্তি চরমভাবে বিদ্যমান। পক্ষান্তরে আহলেহাদীছের তাবলীগী ইজতেমা এগুলো থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। মানুষকে সঠিক দ্বীনের অনুসারী করাই এর একমাত্র উদ্দেশ্য।

(ঘ) শৈথিল্যবাদ ও বৈরাগ্যবাদ তবলীগ জামাতের ইজতেমার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কারণ দল-মত নির্বিশেষে সর্বশ্রেনীর মানুষ তাদের তথাকথিত আখেরী মোনাজাতে অংশগ্রহণ করে থাকে। পক্ষান্তরে আহলেহাদীছের তাবলীগী ইজতেমা ইসলামের মূল ও আদিরূপ প্রতিষ্ঠায় মুসলিম জনসাধারণকে একক ইমারতের অধীনে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহবান করে। যাবতীয় ষড়যন্ত্র, নির্যাতন ও অত্যাচারকে হাসিমুখে বরণ করে নিয়ে আপোষহীনভাবে হক্বের উপর অটুট থাকে। কখনো অস্তিত্বের দোহাই দিয়ে বাতিলের সাথে আপোষ করে না। সর্বদা আল্লাহর পবিত্র অহীকে অগ্রগণ্য করে থাকে।

(ঙ) টঙ্গীর ইজতেমায় শুধুমাত্র ফাযায়েলে নিসাবের কিতাব সমূহ থেকে বিভ্রান্তিকর বক্তব্য উপস্থাপন করা হয়। যা অধিকাংশ মিথ্যা বানোয়ট ও যঈফ হাদীছ ভিত্তিক বক্তব্য। সমকালীন রাজনীতি, অর্থনীতি কিংবা পাশ্চাত্য সংস্কৃতির বিরুদ্ধে তাদের কোন প্রস্তাবনা কিংবা আবেদন পরিলক্ষিত হয় না। বাতিলের প্রতি সংগ্রামের কোন নজীরই তাদের বক্তব্য-বিবৃতিতে প্রতিফলিত হয় না। পক্ষান্তরে আহলেহাদীছের ইজতেমায় সর্বদা সমকালীন সমস্যাসমূহের উপর তত্ত্ব ও তথ্যবহুল অত্যন্ত মূল্যবান আলোচনা উপস্থাপন করা হয়। রাজনীতি, সমাজনীতি এবং অর্থনীতির নামে যাবতীয় উদ্ভুত সমস্যার বিরুদ্ধে যেমন সোচ্চার বক্তব্য উপস্থাপিত হয়, তেমনি সরলমনা মুসলিম জনসাধারণের ঈমানের সুযোগ নিয়ে যারা বিজাতীয় সভ্যতার দিকে মানুষকে আহবান করে তাদের বিরুদ্ধেও গণআন্দোলন গড়ে তুলে তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জ্ঞাপন করে এবং তা থেকে উত্তরণের জন্য সুচিন্তিত ও যুগোপযোগী প্রস্তাবনা পেশ করে থাকে।

পরিশেষে বলব, হে মুসলিম জাতি! তোমার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও তুমি আজ বিজাতীয় সভ্যতার ক্রীড়নকে পরিণত হয়েছে। তুমি আজ ঘরে-বাইরে পাশ্চাত্য মতবাদের হিংস্র ছোবলের অসহায় শিকার। তোমার চেতনা আজ স্তব্ধ ও কর্মহীন জড় পদার্থে পর্যবসিত। তুমি আজ নামেমাত্র মুসলিম হয়ে ইহুদী-খ্রিষ্টানদের গোলামে পরিণত হয়েছো। অতএব হে তরুণ নওজোয়ান ও ছাত্র সমাজ! তোমার বিশ্বজয়ী গৌরবান্বিত সোনালী ইতিহাস ও ঐতিহ্য থাকা সত্ত্বেও তুমি আজ কেন বিজাতীয় সভ্যতার খোরাকে পরিণত হয়েছো? তুমি কেন শিরকের শিখন্ডী আর বিদ‘আতীদের লালনকারীদের অপরাধকর্মে শরীক হয়েছ? তুমি না মুসলিম? তোমার শরীরে মুছ‘আব বিন উমায়ের, খালিদ বিন ওয়ালিদ, বেলাল, তারিক বিন যিয়াদ, মূসা বিন নুসাইর, মুহাম্মাদ কাসিম-এর তেজোদীপ্ত খুন প্রবাহিত হচ্ছে! যাদের সিংহ গর্জনে বাতিল শক্তি পর্যদুস্ত হয়েছে, অবদমিত হয়েছে বিজাতীয় সভ্যতার হিংস্র থাবা, উৎখাত হয়েছে যাবতীয় শিরক ও বিদ‘আত। তাইতো দুনিয়া কাপানো শ্লোগান ‘সকল বিধান বাতিল কর অহীর বিধান কায়েম কর’ ও ‘আসুন! পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে জীবন গড়ি’ তাবলীগী ইজতেমায় লক্ষ জনতার উদ্দেপিত কণ্ঠে পুনঃপুনঃ অনুরণিত হয়। তারপর পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আহবানে অনুপ্রাণিত হয়ে তরতাজা ঈমানের দৃপ্ত মশাল হাতে নিয়ে পুণরায় স্ব স্ব গন্তব্যে ফিরে যায়। এভাবে সমাজ-সংস্কারের বার্তা ছড়িয়ে পড়ে  দিক-দিগন্তে, শহরে-বন্দরে। কেয়ামত পর্যন্ত একটি দল এভাবেই হক্বের দাওয়াত প্রচার করেই যাবে। বাতিলের কোন শক্তি নেই তাদের অগ্রযাত্রাকে প্রতিরোধ করার। এটাই আল্লাহর ওয়াদা। আল্লাহ রাববুল আলামীন এই তাবলীগী ইজতেমাকে কবুল করে নিন এবং সারাদেশের মানুষের জন্য একে বিশুদ্ধতম হেদায়েতের বার্তাবাহক বানিয়ে দিন। আমীন!

মুহাম্মাদ বযলুর রহমান

[লেখক : কেন্দ্রীয় সহ-পরিচালক, সোনামণি]



বিষয়সমূহ: সংগঠন
আরও