তাক্বলীদ সম্পর্কে ওলামায়ে কেরামের বক্তব্য

আব্দুল হালীম বিন ইলিয়াস 866 বার পঠিত

ইসলামের প্রসিদ্ধ চার ইমাম প্রত্যেকেই সুপ্রতিষ্ঠিত পন্ডিত, মুত্তাক্বী এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি আনুগত্যশীল ছিলেন। তাঁরা পার্থিব পদমর্যাদা ও সম্মানের লোভী ছিলেন না। তাদের প্রত্যেকেই নিজেদের ও অন্য মানষের সার্বিক জীবনকে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে গড়ে তুলেতে সচেষ্ট থাকায় তারা অনেক দুঃখ-কষ্ট ভোগ করেছেন এবং নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। কোন মাসআলা কুরআন ও ছহীহ হাদীছে না পেলে তাঁরা ইজতিহাদ বা গবেষণা করে ফায়সালা প্রদান করেছেন। তাতে ভুল হলেও তাঁরা ছাওয়াবের অধিকারী হয়েছেন। যেমন হাদীছে এসেছে, عَنْ عَمْرِو بْنِ الْعَاصِ أَنَّهُ سَمِعَ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ إِذَا حَكَمَ الْحَاكِمُ فَاجْتَهَدَ ثُمَّ أَصَابَ فَلَهُ أَجْرَانِ وَإِذَا حَكَمَ فَاجْتَهَدَ ثُمَّ أَخْطَأَ فَلَهُ أَجْرٌ. আমর ইবনুল ‘আছ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছেন, ‘বিচারক যখন সঠিক রায় প্রদানে সচেষ্ট থেকে সঠিক ফায়সালা প্রদান করে তখন তার জন্য দুটি নেকী রয়েছে। আর যখন সঠিক রায় প্রদানে সচেষ্ট থেকেও ভুল ফায়সালা প্রদান করে তাহ’লে তার জন্য একটি নেকী রয়েছে (ছহীহ বুখারী হা/৭৩৫২, ‘কুরআন ও সুন্নাহ আঁকড়ে ধরা’ অধ্যায়, ‘বিচারক ঠিক করুক বা ভুল করুক তার প্রতিদান পাবে’ অনুচ্ছেদ, বঙ্গানুবাদ (ঢাকা, তাওহীদ পাবলিকেশন্স ২০১২) ৬/৪৬৮ পৃঃ, ছহীহ মুসলিম হা/১৭১৬)

উপরোক্ত হাদীছের ভিত্তিতে ইমামগণ ইজতিহাদ বা শরী‘আত গবেষণা করে মানুষকে সঠিক পথের দিশা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। সাথে সাথে তাঁরা এটাও আশঙ্কা করেছেন যে, তাঁদের কথা ভুলও হ’তে পারে। সেজন্য তাঁরা তাদের তাক্বলীদ করতে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। এক্ষণে প্রসিদ্ধ চার ইমামের প্রচলিত চার মাযহাবের জন্মদাতা এবং তাঁরাই একমত হয়ে যে কোন একটি অনুসরণ উম্মাতে জন্য ফরয (?) করে গিয়েছেন। এমনকি তাবলীগী ভাইয়েরা চিল্লাতে গিয়েও কবিতাকারে তাদের লোকদের ১৩০ ফরযের মধ্যে চার মাযহাবকে চার ফরয হিসাবে তা‘লীম দিয়ে থাকেন ও মুখস্থ করিয়ে থাকেন-তার সত্যতা কতটুকু? নিম্নে প্রদত্ত্ব মাননীয় চার ইমামের জন্ম মৃত্যু সন ও তাদের উক্তিগুলো বিচার করলেই উপরের ধারণাগুলির অসারতা বুঝা যায়।

এক নযরে চার ইমামের পরিচিতি :

ক্রম

নাম

জন্ম

মৃত্যু

জন্মস্থান

আবু হানীফা নু‘মান বিন ছাবিত (রহঃ)

৮০ হিঃ

১৫০

হিঃ

কূফা, ইরাক

মালিক বিন আনাস (রহঃ)

৯৩ হিঃ

১৭৯ হিঃ

মদীনা মুনাওয়ারা

মুহাম্মাদ বিন ইদরীস আশ-শাফেঈ (রহঃ)

১৫০

২০৪

গাযা, ফিলিস্তীন। বসবাস মক্কায়।

আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ)

১৬৪

২৪১

বাগদাদ, ইরাক

উপরোক্ত চার ইমাম ছাড়াও যাদের নামে মাযহাব সৃষ্টি হয়েছে তাঁরা হলেন, রবী‘আতুর রায় মাদানী (মৃত ১৩৬ হিঃ), মুহাম্মাদ বিন আব্দুর রহমান ইবনু আবী লায়লা আনছারী মাদানী (মৃত ১৪৮ হিঃ), আব্দুর রহমান বিন আমর আওযাঈ সিন্ধী কূফী (৮৮-১৫৭ হিঃ), সুফিয়ান বিন সাঈদ ছওরী কূফী (৯৭-১৬১ হিঃ), লাইছ বিন সা‘আদ মিসরী (৯৪-৪৭৫ হিঃ), ইসহাক্ব বিন রাহওয়াইহে নিশাপুরী (১৬৬-২৩৮ হিঃ), দাঊদ বিন আলী ইসফাহানী তাহেরী (২০০-২৭২০ হিঃ), আবু জা‘ফর মুহাম্মাদ ইবনু জারীর তাবারী বাগদাদী (২২৪-৩১০ হিঃ), ইমাম তাক্বিউদ্দীন আহমাদ বিন আব্দুল হালীম ইবনু তায়মিয়াহ হার্রানী দামেষ্কী (৬৬১-৭২৮ হিঃ) প্রমুখ বিদ্বানগণ। এদের কেউ ৮০ হিজরীর পূর্বে জন্ম গ্রহণ করেননি। অথচ ইসলামের স্বর্ণযুগ অতিবাহিত হয়েছে এদের পূর্বেই এবং তাঁরা সহ আহলেসুন্নাত-এর সকল বিদ্বানই কুরআন ও ছহীহ হাদীছের বিপরীতে তাঁদের তাক্বলীদ করতে সকলকে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। যেমন :

তাক্বলীদ সম্পর্কে চার ইমাম বক্তব্য

ইমাম আবু হানীফা (৮০-১৫০ হিঃ) :

1- إياكم والقول في دين الله تعالي بالراي وعليكم باتباع السنة فمن خرج عنها ضل-

(১) ‘তোমরা দ্বীনের ব্যাপারে নিজ নিজ রায় অনুযায়ী কথা বলা হ’তে বিরত থাক। তোমাদের জন্য সুন্নাতের অনুসরণ করা অপরিহার্য। যে ব্যক্তি সুন্নাতের অনুসরণ থেকে বেরিয়ে যাবে সে পথভ্রষ্ট হবে’ (আব্দুল ওয়াহহাব শা‘রানী (৮৯৬-৯৭৩ হিঃ) কিতাবুল মীযান (দিল্লী : আহযাহুল মাতাবে, ১২৮৬ হিঃ) ১/৬৩ পৃঃ; তিনটি মতবাদ ১৫ পৃঃ)

2- حرام علي من لم يعرف دليلي ان يفتي بكلامي-

(২) ‘আমার কথা অনুযায়ী ফৎওয়া দেওয়া হারাম ঐ ব্যক্তির জন্য যে আমার গৃহীত দলীল সম্পর্কে অবগত নয়’ (তদেব)। এখানে ইমাম ছাহেব তাঁর তাক্বলীদ করতে নিষেধ করছেন এবং তাঁর দলীল যাচাই করে সে অনুযায়ী ফৎওয়া দিতে বলেছেন। যা দলীলের অনুসরণ বা ইত্তেবায়ে সুন্নাত, তাক্বলীদ নয়। অতঃপর তিনি দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করে দিয়েছেন-

৩- إذا صح الحديث فهو مذهبي-

(৩) ‘যখন ছহীহ হাদীছ পাবে, জেনো সেটাই আমার মাযহাব’ (ইবনু আবেদীন, শামী রদ্দুল মুহতার শারহ দুর্রে মুখতার (দেউবন্দ, ১২৭২ হিঃ) ১/৪৬ পৃঃ; তিনটি মতবাদ ১৬ পৃঃ; আহলেহাদীছ আন্দোলন কি ও কেন ৭ পৃঃ)

4- إذا قلت قولا يخالف كتاب الله وخبر الرسول صلي الله عليه وسلم فاتركوا قولي-

 (৪) ‘আমি যদি আল্লাহর কিতাব (কুরআন) ও রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কথার (হাদীছ) বিরোধী কোন কথা বলে থাকি, তাহ’লে আমার কথাকে ছুঁড়ে ফেলে দিও’ (ছাহেল  ফুল্লানী, ইক্বাযু হিমাম ৫০ পৃঃ)

একবার তিনি তাঁর প্রধান শিষ্য আবু ইউসুফ (১১৩-১৮২ হিঃ)-কে বলেন,

5- لا ترو عني شيئا فإني والله ما ادري مخطي ام مصيب؟

(৫) ‘তুমি আমার পক্ষ হ’তে কোন মাসআলা বর্ণনা করো না। আল্লাহর ক্বসম আমি জানিনা নিজ সিদ্ধান্তে আমি বেঠিক না সঠিক’ (আবু বকর খতীব বাগদাদী, তারীখু বাগদাদ, ১৩/৪০২ পৃঃ; আহলেহাদীছ আন্দোলন ১৭৯ পৃঃ-এর ৪৮ নং টীকা দ্রষ্টব্য)

6- ويحكم يكذبون علي في هذه الكتب مالم اقل.

(৬) ‘আরেকবার তিনি তাকে ধমক দিয়ে বলেন, তোমাদের ধক্ষংস হোক, তোমরা এইসব কিতাবগুলিতে আমার উপরে কত মিথ্যা আরোপ করেছ, যা আমি বলিনি’ (তদেব)

7- وكان إذا افتي يقول هذا راي ابي حنيفة وهو احسن ما قدرنا عليه فمن جاء باحسن منه فهو اولي بالصواب-

(৭) তিনি ফৎওয়া দিলে বলে দিতেন যে, এটি আবু হানীফার রায়।  আমাদের সাধ্যপক্ষে এটিই উত্তম মনে হয়েছে। এর চেয়ে উত্তম পেলে সেটিই সঠিকতর বলে গণ্য হবে (কিতাবুল মীযান, ১/৬০ পৃঃ, তিনটি মতবাদ ১৬ পৃঃ)

8- لا يحل لاحد أن يأخذ بقولنا ما لم يعلم من اين اخذناه-

(৮) আমরা কোথা থেকে গ্রহণ করেছি তা না জেনে আমাদের কথা গ্রহণ করা কারো জন্য বৈধ নয় (হাশিয়া ইবনু আবেদীন, ১/৬৩; মুক্বাদ্দামাতু ছিফাতু ছালাতিন নাবী (ছাঃ), অনুবাদ : তাওহীদ পাবলিকেশন্স ২০১১, ২৩ পৃঃ)

9- فاننا بشر نقول القوم اليوم ونرجع غدا-

(৯) কেননা আমরা মানুষ। আজ এ কথা বলি, আবার আগামীকাল তা থেকে প্রত্যাবর্তন করি (মুক্বাদ্দামাতু ছিফাতি ছালাতিন নাবী (ছাঃ), ২৪ পৃঃ)

10- ويحك يا يعقوب لا تكتب كل ما تسمع مني فاني قد اري الراي اليوم فاتركه غدا اري الراي غدا واتركه بعد غد-

(১০) তিনি তাঁর প্রধান শিষ্য আবু ইউসুফকে তাঁর বক্তব্য লিখতে দেখে ধমক দিয়ে বলেন, ‘সাবধান! হে ইয়াকুব (আবু ইউসুফ) আমার নিকট থেকে যাই শোন, তাই লিখে নিয়ো না। কেননা আমি আজকে যে রায় দেই, কালকে তা পরিত্যাগ করি, কাল যে রায় দেই পরদিন তা পরিত্যাগ করি (তারীখু বাগদাদ ১৩/৪০২ পৃঃ; আহলেহাদীছ আন্দোলন ১৭৯ পৃঃ-এর ৪৮ নং টীকা দ্রষ্টব্য; মুক্বাদ্দামাতু ছিফাতি ছালাতিন নাবী (ছাঃ) ২৫ পৃঃ; আহলেহাদীছ আন্দোলন কি ও কেন ৭ পৃঃ)

ইমাম মালেক (৯৩-১৭৯ হিঃ) :

1- انما انا بشر اخطي واصيب فانظروا في راي فكل ما وافق الكتاب والسنة فخذوه وكل ما لم يوافقه فاتركوه-

(১) আমি একজন মানুষমাত্র। আমি ভুল করি সঠিকও করি। অতএব আমার সিদ্ধান্তগুলি তোমরা যাচাই কর। যেগুলি কুরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী পাও, সেগুলো গ্রহণ কর। আর যেগুলো না পাও  সেগুলো পরিত্যাগ কর (ইউসুফ জয়পুরী, হাক্বীক্বাতুল ফিক্বহ ( বোম্বাই: পরিবর্ধিত সংস্করণ, তাবি) ৭৩ পৃঃ; ইমাম ইবনু হাযাম, আল-ইহকাম ফী উছূলিল আহকাম ৬/১৪৯ পৃঃ; তিনটি মতবাদ ১৬ পঃ)

2- ما من احد الا ومأخذوه من كلامه و مردود عليه الا رسول الله صلي الله عليه وسلم-

(২) তিনি মূলনীতি আকারে বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ব্যতীত দুনিয়াতে এমন কোন ব্যক্তি নেই যার সকল কথা গ্রহণীয় অথবা বর্জনীয় (শাহ ওয়ালিউল্লাহ, ইকদুল জীদ অনুবাদসহ (লাহোর, তাবি), ৯৭ পৃঃ; তিনটি মতবাদ ১৬-১৭ পৃঃ; ইমাম ইবনু হাযম, আল-ইহকাম ফী উছূলিল আহকাম ৬/১৪৯ পৃঃ)। অন্য বর্ণনায় এসেছে الا صاحب هذه الروضة ‘এই কবরবাসী (রাসূল ছাঃ) ব্যতীত’ (কিতাবুল মীযান ১/৬৪ পৃঃ; তিনটি মতবাদ ১৭ পৃঃ)

3- ليس احد بعد النبي صلي الله عليه وسلم الا ويؤخذ من قوله و يقوله من النبي صلي الله عليه وسلم-

(৩) নবী করীম (ছাঃ) ব্যতীত অন্য যে কোন লোকের কথা সব গ্রহণীয় কিংবা বর্জনীয় নয় (কিন্তু নবী (ছাঃ)-এর সকল কথা গ্রহণীয় ও বর্জনীয়) (ছিফাতু ছালাতিন নাবী ২৭ পৃঃ)

ইমাম শাফেঈ (১৫০-২০৪ হিঃ) :

1- إذا رأيتم كلامي يخالف الحديث فاعملوا بالحديث واضربوا بكلامي الحائط و قال يوما للمزني يا ابراهيم لا تقلدني في كل ما اقول وانظر في ذالك لنفسك فانه دين-

(১) ‘যখন তোমরা আমার কোন কথা হাদীছের বরখেলাফ দেখবে তখন হাদীছের উপর আমল করবে এবং আমার কথাকে দেওয়ালে ছুড়ে মারবে। তিনি একদা স্বীয় ছাত্র ইবরাহীম মুযানীকে বলেন, ‘হে ইবরাহীম! তুমি আমার সকল কথার তাক্বলীদ করবে না। বরং নিজে চিন্তা-ভাবনা করে দেখবে। কেননা এটা দ্বীনের ব্যাপার’ (ইকদুল জীদ ৯৮ পৃঃ; তিনটি মতবাদ ১৭ পৃঃ; আহলেহাদীছ আন্দোলন ১৭৭ পৃঃ-এর ২৪ নং টীকা দ্রষ্টব্য)

2- كل ما قلت فكان عن النبي صلي الله عليه وسلم خلاف قولي مما يصح فحديث النبي اولي فلا تقلدني-

(২) আমি যেসব কথা বলেছি, তা যদি নবী করীম (ছাঃ)-এর হাদীছের বিপরীত হয় তবে নবী করীম (ছাঃ)-এর হাদীছই অগ্রগণ্য। অতএব তোমরা আমার তাক্বলীদ করো না (ইবনু আবী হাতিম, ৯৩ পৃঃ সনদ ছহীহ, ছিফাত ৩৩ পৃঃ)

3- كل حديث عن النبي صلي الله عليه وسلم فهو قولي وان لم تسمعه-

(৩) নবী করীম (ছাঃ)-এর প্রত্যেকটি হাদীছই আমার কথা যদি আমার নিকট থেকে তোমরা তা না শুনে থাক তবুও (তদেব)

4- ما من احد الا و تذهب عليه سنة لرسول الله صلي الله عليه وسلم وتعزب عنه مهما قلت من قول او أصلت من اصل فيه عن رسول الله صلي الله عليه وسلم خلاف ما قلت فالقول ما قال رسول الله صلي الله عليه وسلم وهو قولي-

(৪) ‘প্রত্যেক ব্যক্তি থেকেই রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কিছু সুন্নাত গোপন থাকবেই এবং ছাড়া পড়বেই। তাই আমি যত কথা বলেছি অথবা মূলনীতি উদ্ভাবন করেছি সেক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) থেকে আমার বক্তব্যের বিরুদ্ধে বক্তব্য পাওয়া গেলে তাঁর কথাই চূড়ান্ত এবং এটিই হবে আমার গ্রহণীয় কথা’।-ছিফাত (মূল), পৃ. ৫০; বঙ্গানুবাদ (তাওহীদ) পৃ. ২৯।

5- اجمع المسلمون علي ان من استبان له سنة عن رسول الله صلي الله عليه وسلم لم يحل له ان يدعها لقول أحمد-

(৫) ‘মুসলমান এ ব্যাপারে একমত যে, যার কাছে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সুন্নাহ (হাদীছ) পরিষ্কাররূপে প্রকাশ হয়ে যায় তার পক্ষে অন্য কারো কথায় তা বর্জন করা বৈধ নয়। -তদেব

6- إذا وجدتم في كتابي خلاف سنة رسول الله صلي الله عليه وسلم فقولوا بسنة رسول الله صلي الله عليه وسلم ودعوا ما قلت وفي رواية فاتبعوها ولا تلتفتواالي قول احد-

(৬) যখন তোমরা আমার কিতাবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সুন্নাহ বিরোধী কিছু পাবে, তখন তোমরা তাঁর সুন্নাতানুসারে কথা বলবে এবং আমি যা বলেছি তা ছেড়ে দেবে।

অপর বর্ণনায় রয়েছে, তোমরা তাঁরই সুন্নাতের অনুসরণ কর এবং অন্য কারো কথার প্রতি ভ্রূক্ষেপ করো না (পূর্বোক্ত, বঙ্গানুবাদ ছিফাত, পৃ. ৩০)

7- أنتم أعلم بالحديث والرجال مني فاذا كان الحديث الصحيح فاعلمواني به اي شيئ يكون كوفيا او بصريا أو شاميا حتي اذهب اليه إذا كان صحيحا-

(৭) (ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহ.) কে সম্বোধন করে তিনি বলেছেন) আপনারাই হাদীছ এবং তার রিজালের (বর্ণনাকারীদের) ব্যাপারে আমা অপেক্ষা অধিক জ্ঞাত। তাই ছহীহ হাদীছ পেলেই আমাকে অবহিত করবেন, চাই তা কূফী, বাছরী বা শামীদের (সিরিয়া) বর্ণনাকৃত হোক, ছহীহ হলে আমি তা গ্রহণ করব (তদেব)

8- كل مسألة صح فيها الخبر عن رسول الله صلي الله عليه وسلم عند اهل النقل بخلاف ما قلت فانا راجع عنها في حياتي و بعد موتي-

(৮) আমি যে মাসআলা বলেছি, তাতে আমার কথার বিরুদ্ধে হাদীছ বর্ণনাকারীদের নিকট রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কোন ছহীহ হাদীছ পাওয়া গেলে আমি আমার জীবদ্দশায় ও মৃত্যুর পরে তা থেকে প্রত্যাবর্তন করলাম (ইলামুল মুওয়াক্কিঈন, ২/৩৬৩ পৃ. ছিফাত, পৃ. ৫২; অনুবাদ ছিফাত পৃ.৩২)

৯-إذا رايتموني اقول قولا وقد صح عن النبي صلي الله عليه وسلم خلافه فاعلموا ان عقلي قد ذهب-

(৯) যখন তোমরা দেখবে যে, আমি এমন কথা বলছি, যার বিরুদ্ধে নবী করীম (ছাঃ) থেকে বিশুদ্ধ হাদীছ রয়েছে। তবে জেনে রেখ যে, আমার বিবেক হারিয়ে গেছে (তদেব)

১০- إذا صح الحديث فهو مذهبي-

(১০) যখন ছহীহ হাদীছ পাবে, জেনো সেটাই আমার মাযহাব (তদেব)

ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহ.) (১৬৪-২৪১হি)

১- لا تقلدني ولا تقلد مالكا ولا الأوزاعي ولا النخعي ولا غيرهم وخذ الاحكام من حيث اخذوا من الكتاب والسنة-

(১) তুমি আমার তাক্বলীদ করো না, তাক্বলীদ করো না ইমাম মালেক, আওযাঈ, নাখঈ বা অন্য কারও। বরং নির্দেশ গ্রহণ কর কুরআন ও সুন্নাহর মূল উৎস থেকে, যেখান থেকে তাঁরা সমাধান গ্রহণ করতেন (ইক্বদুল জীদ, পৃ ৯৮, থিসিস পৃ ১৭৭ টিকা নং-২৪; তিনটি মতবাদ, পৃ ১৭, ই‘লামুল মুওয়াক্কি‘ঈন ২/৩০২ পৃঃ)

২-لا تقلد دينك احدا من هولاء ما جاء عن النبي صلي الله عليه وسلم واصحابه فخذ به-

(২) তুমি দ্বীনের ব্যাপারে তাঁদের তাক্বলীদ করো না (বরং) নবী করীম (ছাঃ) ও তাঁর ছাহাবীদের থেকে যা আসে তা গ্রহণ করা (ছিফাত, ৪৬-৫৩ পৃঃ;  বঙ্গানুবাদ, তাওহীদ পাবলিকেশন্স, ঢাকা, ৩৩-৩৪ পৃঃ)

৩- رأي الاوزاعي و رأي مالك و رأي ابي حنيفة كله رأي وهو عندي سواء وانما الحجة في الاثار-

(৩) ইমাম আওযাঈ, মালেক ও আবু হানীফা প্রত্যেকের মতামত হচ্ছে মতামতই এবং আমার কাছে তা সমান মূল্য রাখে। তবে প্রকৃত দলীল রয়েছে কেবল হাদীছের মধ্যে (তদেব)

৪- من رد حديث رسول الله صلي الله عليه وسلم فهو علي شفا هلكة-

(৪) যে ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর হাদীছকে প্রত্যাখ্যাক করল সে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হ’ল (তদেব)

মহামতি চার ইমামের পর অন্যান্য ওলামায়ে কেরামগণের বক্তব্য

১. ইমাম রাযী (রহঃ) বলেন, আমার উস্তাদ বলেন, আমি মুক্বাল্লিদ ফকীহদের একটি দলকে দেখেছি যখন আমি তাদের সম্মুখে কোন বিষয়ে অনেকগুলি আয়াত পড়ি যা তাদের মাযহাবের বিরোধী তখন তারা তা কবুল করে না। এমনকি সেদিকে দৃকপাতও করেনা। তারা আমার দিকে বিস্মিত নেত্রে তাকিয়ে থাকে আর ভাবে এই সব আয়াতের প্রকাশ্য অর্থের উপরে কিভাবে আমল করা যেতে পারে। অথচ আমাদের পূর্বসূরী বিদ্বানদের পক্ষ হতে এর বিরোধী বক্তব্য প্রচলিত আছে। যদি তুমি বিষয়টিকে যথার্থভাবে অনুধাবন কর তবে দেখবে যে, এই রোগ দুনিয়াবাসীর শিরা-উপশিরায় প্রবাহিত আছে (আহলেহাদীছ আন্দোলন ১৫২ পৃঃ)

  • তিনি আরো বলেন, যদি মুক্বাল্লিদ ব্যক্তিকে বলা হয় যে, কোন মানুষের প্রতি তাক্বলীদ সিদ্ধ হবার শর্ত হ’ল একথা জ্ঞাত হওয়া যে, ঐ ব্যক্তি হক্ব-এর উপরে আছেন একথা তুমি স্বীকার কর কি-না? যদি স্বীকার কর তাহ’লে জিজ্ঞেস করব তুমি কিভাবে জানলে যে, লোকটি হক-এর উপর আছেন? যদি তুমি অন্যের তাক্বলীদ করে থাক, তাহ’লে তো গতানুগতিক ব্যাপার হয়ে গেল। আর যদি তুমি তোমার জ্ঞান দ্বারা উপলব্ধি করে থাক, তাহ’লে তো আর তাক্বলীদের দরকার নেই, তোমার জ্ঞানই যথেষ্ট। যদি তুমি বল যে, ঐ ব্যক্তি হক্বপন্থী কিনা তা জানা বা না জানার উপরে তাক্বলীদ নির্ভর করে না। তাহ’লে তো বলা হবে যে, ঐ ব্যক্তি বাতিলপন্থী হলেও তুমি তার তাক্বলীদ সিদ্ধ করে নিলে। এমতাবস্থায় তুমি জানতে পারনা তুমি হক্বপন্থী না বাতিলপন্থী। জেনে রাখা ভাল যে, পূর্বের আয়াতে (বাক্বারাহ ১/১৬৮) ‘শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ না করার’ জন্য কঠোর হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করার পরেই এই আয়াত (বাক্বারাহ ২/১৭০) বর্ণনা করে আল্লাহ তা‘আলা এ বিষয়ে ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, শয়তানী  ধোঁকার অনুসরণ করা ও তাক্বলীদ করার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। অতএব এই আয়াতের মধ্যে মযবুত প্রমাণ নিহিত রয়েছে ‘দলীলের অনুসরণের’ এবং চিন্তা গবেষণা ওয়াজিব হওয়ার ব্যাপারে ও দলীল বিহীন কোন বিষয়ের দিকে নিজেকে সমর্পণ না করার ব্যাপারে (তাফসীরুল কাবীর ৫/৭ পৃঃ; আহলেহাদীছ আন্দোলন ১৫৪ পৃঃ)

২. আল্লামা সৈয়দ রশীদ রেযা (১১৮২ হিঃ/১৩৫৪ হিঃ-১৮৬৫ খ্রিঃ/১৯৩৫খ্রিঃ) সূরা মায়েদার (৫/৩)-এর আয়াতে দ্বীনের পূর্ণতা বিষয়ক আলোচনায় তিনি তাক্বলীদ কিভাবে ইলমকে ধ্বংস করেছে এবং তাক্বলীদপন্থী আলেমগণ কিভাবে কিতাব ও সুন্নাতের সার্বভৌম অধিকারকে ভূলুণ্ঠিত করেছেন তা অত্যন্ত আকর্ষণীয় ভাষায় ব্যক্ত করে বলেন, দ্বীনের পথে মানুষকে আহবান ও সেজন্য বিগত পথ অনুসরণের ব্যাপারটি (فبهدهم اقتده) (আন‘আম ৬/৯০) দ্বারা তাক্বলীদ প্রমাণ করার কোন সুযোগ নেই। কেননা এর প্রকৃত তাৎপর্য স্বচ্ছ সকালের চাইতেও স্বচ্ছ। কিন্তু মুক্বাল্লিদ গ্রন্থকারদের অধিকাংশই এ ব্যাপারে মন্দ রীতির উপর চলেছেন।...মানবীয় উন্নতির জন্যই আমাদের দ্বীনকে পূর্ণ ও চিরস্থয়ী করা হয়েছে, যার উপরে আমল করা ওয়াজিব। এটা আমাদের অন্যতম প্রধান মূলনীতি। যেটা বুঝতে অনেক বিদ্বান সন্দেহে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন (সাইয়িদ রশীদ রেযা, তাফসীরুল কুরআন (মিসর : দারুল মানার, ২য় সংস্করণ ১৩৬৭/১৯৪৮, ৬/৪১৬ পৃঃ; আহলেহাদীছ আন্দোলন ১৫৬)

৩. শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী তাঁর প্রণীত বিভিন্ন গ্রন্থে তাক্বলীদ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন এবং সর্বত্র তিনি অন্ধ তাক্বলীদের (تقليد جامد) কঠোর সমালোচনা করেছেন। যেমন-তিনি বলেন, ( হে পাঠক!) বর্তমান সময়ে তুমি বিশ্বের প্রায় সকল অঞ্চলে মুসলিম জনসাধারণের মধ্যে দেখবে যে, তারা বিগত কোন বিদ্বানের মাযহাবের অনুসরণ করে থাকে এবং তারা মনে করে যে, মাত্র একটি মাসআলাতেও যদি তার অনুসরণীয় বিদ্বানের তাক্বলীদ হ’তে সে বেরিয়ে যায়, তাহ’লে হয়তোবা সে মুসলিম মিল্লাত থেকেই খারিজ হয়ে যাবে। ঐ বিদ্বান যেন একজন নবী যাকে তার কাছে পাঠানো হয়েছে। অথচ চতুর্থ শতাব্দী হিজরীর পূর্বেকার কোন মুসলমান কোন একটি নির্দিষ্ট মাযহবের অনুসারী ছিলেন না (শাহ ওয়ালিউল্লাহ, তাফহীমাতুল ইলাহিয়াহ, আরবী ও ফারসী (ইউপি-ভারত : মদীনা অফসেট প্রেস, বিজনৌর, ১৩৫৫/১৯৩৬) ১/১৫১ পৃঃ; আহলেহাদীছ আন্দোলন ১৬০ পৃঃ)

  • তিনি আরো বলেন, ‘কোন ইমামের মুক্বাল্লিদের নিকট কোন মাসআলায় যদি রাসূলের (ছাঃ) কোন হাদীছ পৌঁছে যায়, যা তার ইমামের কথার বিরোধী হয় এবং তার ধারণা যদি জোরালো হয় যে, হাদীছটি ছহীহ, তাহ’লে অন্যের অজুহাতে রাসূলের (ছাঃ) হাদীছকে পরিত্যাগ করার ব্যাপারে তার কোন কথা কাজে আসবে না। এটা কোন মুসলমানের শান নয়। যদি কেউ করে তবে মুনাফিক হওয়ার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে’ (প্রাগুপ্ত ২/১৩৪ পৃঃ; আহলেহাদীছ আন্দোলন ১৬১ পৃঃ)
  • মুজতাহিদদের তাক্বলীদকে শাহ ওয়ালিউল্লাহ ওয়াজিব ও হারাম দু’ভাগে ভাগ করেছেন :

১. ওয়াজিব হ’ল রেওয়াতের অনুসরণ করা। এর ব্যাখ্যা এই যে, কিতাব ও সুন্নাহ সম্পর্কে আনকোরা ব্যক্তি যিনি এসব অনুসন্ধান ও সমাধান বের করতে অক্ষম, তার দায়িত্ব হ’ল কোন বিদ্বানকে জিজ্ঞেস করা যে, এই মাসআলায় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর হুকুম কি? তখন উক্ত বিদ্বান তাকে খবর দিবেন তখন তিনি তার অনুসরণ করবেন। চাই সে খবর প্রকাশ দলীল থেকে গৃহীত হোক বা তার সদৃশ বিষয়ের উপরে কিয়াস করে হোক। সবকিছুই রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর রেওয়াতের দিকে প্রত্যাবর্তিত হবে মর্মগতভাবে। এই ধরনের তাক্বলীদের (বরং ইত্তেবার) উপর যুগ যুগ ধরে উম্মতের ঐক্যমত চলে আসছে। বিগত উম্মত গুলির শরী‘আতেও এ ব্যাপারে ঐক্যমত ছিল। এই তাক্বলীদ অর্থ হ’ল ঐ ব্যক্তি মুজতাহিদের কথার উপরে আমল করবে এই শর্তে যে, বিষয়টি সুন্নাতের অনুকূলে হবে। অতঃপর লোকটি সর্বদা তার সাধ্যমত সুন্নাতের সন্ধানে থাকবে। যখন তার নিকটে মুজতাহিদের কথার বরখেলাফ কোন হাদীছ প্রকাশিত হবে, তখনই সে হাদীছ গ্রহণ করবে (এবং উক্ত কথা ছেড়ে দিবে)।

২. তাক্বলীদ হারাম ঐ সময়ে যখন মুজতাহিদ ফক্বীহ সম্পর্কে কোন ব্যক্তি এই ধারণা পোষণ করেন যে, তিনি জ্ঞানের এমন উচ্চতম শিখরে পৌঁছে গিয়েছেন, যেখানে তার আর ভুল হওয়ার সম্ভাবনা নেই। ফলে উক্ত মুজতাহিদের বক্তব্য বিরোধী কোন স্পষ্ট ছহীহ হাদীছ তাঁর নিকটে পৌঁছে গেলেও তিনি ঐ ফৎওয়া পরিত্যাগ করেন না। বরং ধারণা করেন যে, তিনি যার তাক্বলীদ করেন তিনিই তার ফৎওয়ার জন্য আল্লাহর নিকট দায়িত্বশীল থাকবেন। এই মুক্বাল্লিদ ব্যক্তিটি যাবতীয় গুণহীন বেওকুফের মত।... এই আক্বীদা সম্পূর্ণ বাতিল এবং এই কথা সম্পূর্ণ বাজে। এর পক্ষে শরী‘আত বা যুক্তির কোন দলীল নেই। বিগত যুগের কেউ এমন করেননি (অলিউল্লাহ, ইকদুল জীদ (লাহোর, তাবি) ৮৪-৮৬ পৃঃ, আহলেহাদীছ আন্দোলন ১৬২ পৃঃ)

  • হাদীছ পাওয়া সত্ত্বেও নির্দিষ্ট কোন বিদ্বানের তাক্বলীদের উপর যিদ করাকে তিনি ‘ইহুদী স্বভাব’ বলে ভীষণভাবে কটাক্ষ করে বলেন, যদি তুমি ইহুদীদের নমুনা দেখতে চাও তাহ’লে দুষ্ট আলেমদের দিকে তাকাও যারা দুনিয়ার সন্ধানী। যারা বিগত কোন ব্যক্তির তাক্বলীদে অভ্যস্থ। যারা কিতাব ও সুন্নাতের দলীলসমূহ হ’তে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং কোন একজন আলিমের সূক্ষ্মবাদিতা, কঠোরতা ও সুধারণাযুক্ত সমাধান (ইসতিহসান)-কে কঠিনভাবে অাঁকড়ে ধরে। যারা মা‘ছুম রাসূলের কালাম হ’তে বেপরওয়া হয়ে বিভিন্ন জাল হাদীছ ও বাতিল ব্যাখ্যাসমূহ (তা’বীল) কে অনুসরণীয় হিসাবে গ্রহণ করে। তামাশা কেমন তারা যেন খোদ ইহুদী (আহলেহাদীছ আন্দোলন  ১৬৫ পৃঃ)
  • তিনি বলেন, নিছক মুক্বাল্লিদ কোন ব্যক্তি কখনই সত্যে উপনীত হতে পারে না। বরং পৃথিবীর অধিকাংশ ফাসাদ ও বিশৃঙ্খলা তাক্বলীদের উৎস হ’তেই পয়দা হয়েছে (আহলেহাদীছ আন্দোলন ২৬৭ পৃঃ)
  • তাক্বলীদপন্থী আলেমগণের ধিক্কার দিয়ে তিনি বলেন, এদের সমস্ত ইলমের পুঁজি হ’ল হেদায়া, শরহে বেকায়া প্রভৃতির মধ্যে। এরা আসল বস্ত্ত কিভাবে বুঝবে (তদেব)

৪. শাহ ইসমাঈল শহীদ (১১৯৩-১২৪৬ হিঃ/১৭৭৯-১৮৩১ খ্রিঃ) অনির্দিষ্ট ভাবে যে কোন আলেমের তাক্বলীদ সম্পর্কে হাফেয ইরাক্বী প্রমুখাৎ ইজমার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, ...ছহীহ হাদীছ পাওয়া সত্ত্বেও যদি মুক্বাল্লিদ ব্যক্তিটি তার ইমামের কথা পরিত্যাগ না করে, তাহ’লে (বুঝতে হবে যে তার মধ্যে শিরকের দোষ মিশ্রিত আছে।... একজন নির্দিষ্ট ব্যক্তির কথার অনুসরণ করা এই অর্থে যে, তার বিপরীত হাদীছ বা কুরআনের দলীল সমূহ প্রমাণিত হলেও তা ঐ ব্যক্তির  কথার অনুকূলে ব্যাখ্যা করা হবে তাহ’লে তার মধ্যে নাছারাদের স্বভাব ও শিরকের অংশ বিশেষ মিশ্রিত হয়ে যাবে (শাহ ইসমাঈল শহীদ, তানভীরুল আইনাইন ফী ইছাবাতি রাফ‘ইল ইয়াদাইন (মীরাট : মুজতাবায়ী প্রেস ১২৭৯হি/১৮৩৬ খ্রিঃ, উর্দু অনুবাদসহ ৩৭-৩৯ পৃঃ; আহলেহাদীছ আন্দোলন ১৬৬ পৃঃ)

৫. শায়খুল ইসলাম সাইয়িদ নাযীর হুসাইন বিহারী দেহলভী (১২২০-১৩২০ হিঃ/১৮০৫-১৯০২ খ্রিঃ) তাক্বলীদকে চারভাগে ভাগ করেছেন (ক) ওয়াজিব : জাহিল ব্যক্তির জন্য। যে আহলে সুন্নাত বিদ্বানগণের মধ্যে অনির্দিষ্টভাবে যে কোন বিদ্বানের নিকট হ’তে প্রয়োজন মাফিক মাসআলা জেনে নিবে। তবে এই তাক্বলীদ হবে হাদীছের অনুকূলে হওয়ার শর্তসাপেক্ষে। যদি পরে দেখা যায় যে, ফৎওয়াটি ছিল হাদীছ বিরোধী। তবে তখনই সেটা পরিত্যাগ করে তার জন্য হাদীছের অনুসরণ আবশ্যক হবে।

(খ) মুবাহ : কোন একটি মাযহাবের তাক্বলীদ করা এই নিয়তে যে, এই তাক্বলীদ কোন শারঈ বিষয় নয়। অন্য মাযহাবের হাদীছ সম্মত কোন মাসআলার ইনকার করবে না। বরং নিজেও কখনও কখনও তার উপরে আমল করবে।

(গ) হারাম : ওয়াজিব মনে করে কোন একটি মাযহাব নির্দিষ্টভাবে তাক্বলীদ করা।

(ঘ) শিরক : অজ্ঞতার কারণে কোন একজন মুজতাহিদের কথা অনুযায়ী আমল করা। কিন্তু পরে ছহীহ ও গায়র মানসূখ হাদীছ পাওয়া গেলেও তা প্রত্যাখ্যান না করা অথবা তাহরীফ বা তাবীল করে যেকোন ভাবেই হোক হাদীছকে ঐ মুজতাহিদের কথার অনুকূলে নিয়ে যাওয়া। কিন্তু কোন অবস্থাতেই অনুসরণীয় বিদ্বানের কথাকে পরিত্যাগ না করা (সৈয়দ নযীর হুসাইন দেহলভী, মি‘আরুল হক্ব (উর্দু) (দিল্লী : রহমানী প্রেস ১৩৩৭ হিঃ/১৯১৯ খ্রিঃ, ৪১-৪২ পৃঃ)

৬. ইমাম মুহাম্মাদ বিন আলী শাওকানী (১১৭২-১২৫০ হিঃ) বলেন,

وقد علم كل عالم أنهم (أي الصحابة والتابعين وتابعهم) لم يكونوا مقلدين ولا منتسبين إلي فرد من افراد العلماء بل كان الجاهل يسئل العالم عن الحكم الشرعي الثابت في كتاب الله او بسنة رسوله صلي الله عليه وسلم فيفتيه به ويرويه له لفظا أو معني فيعمل بذلك من باب العمل بالرواية لا بالرأي و هذا اسهل من التقليد-

প্রত্যেক বিদ্বান এ কথা জানেন যে, ছাহাবা, তাবেঈন ও তাবে তাবেঈন কেউ কারো মুক্বাল্লিদ ছিলেন না। ছিলেন না কেউ কোন বিদ্বানের প্রতি সম্বন্ধযুক্ত। বরং জাহিল ব্যক্তি আলেমদের নিকট থেকে কিতবা ও সুন্নাহ হ’তে প্রমাণিত শরী‘আতের হুকুম জিজ্ঞেস করতেন। আলেমগণ সেই মোতাবেক ফৎওয়া  দিতেন। কখনও শব্দে শব্দে বলতেন, কখনও মর্মার্থ বলে দিতেন। সে মতে লোকেরা আমল করত (কুরআন ও হাদীছের) রেওয়ায়াত (বর্ণনা) অনুযায়ী কোন বিদ্বানের রায় অনুযায়ী নয়। বলা বাহুল্য কারও তাক্বলীদ করার চেয়ে এই তরীকাই সহজতর (শাওকানী, আল-ক্বাওলুল মুফীদ (মিসরী ছাপা ১৩৪০/১৯২১ খ্রিঃ, ১৫ পৃঃ; তিনটি মতবাদ ১৮ পৃঃ)

৭. মোল্লা আলী ক্বারী (রহঃ) বলেন,

ومن المعلوم أن الله تعالي ما كلف احدا ان يكون حنيفا أو مالكيا أو شافعيا أو حنبليا بل كلفهم ان يعلموا السنة-

এটা জানা কথা যে, নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা কাউকে বাধ্য করেননি এ জন্য যে, সে হানাফী, মালেকী, শাফেঈ বা হাম্বলী হোক। বরং বাধ্য করেছেন এ জন্য যে, তারা সুন্নাত অনুযায়ী আমল করুক।

৮. ইমাম ত্বাহাবী বলেন,  لا يقلد الا عصبي او غبي- গোঁড়া অথবা নির্বোধ ছাড়া কেউ তাক্বলীদ করে না (ছিফাতু ছালাতিন নাবী (ছাঃ), অনুবাদ ২৩ পৃঃ)

৯. ইবনু আবেদীন ইবনুল হুমামের উস্তাদ ইবনুশ শাহানা আল-কাবীরের شرح الهداية থেকে উদ্ধৃত করেন, ‘যখন হাদীছ বিশুদ্ধ সাব্যস্ত হয়ে যাবে আর তা মাযহাবের বিপক্ষে থাকবে তখন হাদীছের উপরই আমল করা উচিত হবে এবং এটাই তার (ইমামের) মাযহাব বলে বিবেচিত হবে। উক্ত হাদীছের উপর আমল করাটা তাকে বহিস্কার করবে না। কেননা ইমাম আবু হানীফা  থেকে বিশুদ্ধ সূত্রে এসেছে যে,  হাদীছ ছহীহ হ’লে এটাই আমার অনুসৃত পথ বলে জানতে হবে। একথা ইমাম ইবনু আব্দিল বার্র, ইমাম আবু হানীফাসহ অন্যান্য ইমামদের থেকেও বর্ণনা করেন (ছিফাতুন নাবী, অনুবাদ ২৪ পৃঃ)

১০. ইবনু হাযম (রহঃ) বলেন, ‘ যে ফক্বীহের তাক্বলীদ করা হয় তাঁরা নিজেরাই তাক্বলীদ খন্ডন করেছেন। তারা স্বীয় সাথীদেরকে নিজেদেরকে নিজেদের তাক্বলীদ থেকে নিষেধাজ্ঞা শুনিয়েছেন। এ ব্যাপারে ইমাম শাফেঈ ছিলেন কঠিনতম। ছহীহ হাদীছ অনুসরণ ও দলীল দ্বারা অপরিহার্য করে তা গ্রহণের গুরুত্ব তাঁর কাছে যত বেশী ছিল তা অন্যদের কাছে ছিল না। তাঁকে অন্ধ অনুসরণ করার প্রতিও তিনি অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন এবং তিনি তা ঘোষণাও করেছেন। আল্লাহ তাঁর মাধ্যমে উপকার করুন এবং তাঁকে বড় ধরনের প্রতিদান দান করুন। তিনি বহু মঙ্গল বয়ে নিয়ে আসার সোপান ছিলেন (ছিফাতুন নাবী, অনুবাদ ২৯ পঃ)

১১. হাফেয ইবনু রজব বলেন, যার কাছেই নবী করীম (ছাঃ)-এর হাদীছ পৌঁছে যায় এবং তিনি তা বুঝতে পারেন তাহ’লে তার উপর এটাকে উম্মতের জন্য বিশদভাবে বর্ণনা করার আদেশ প্রদান করা ওয়াজিব যদিও উম্মতের বিরাট কোন ব্যক্তিত্বের বিরোধী হয়। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর আদেশ যেকোন বড় ব্যক্তির মতামত অপেক্ষা অধিক শ্রদ্ধা ও অনুসরণযোগ্য। যিনি (বড় ব্যক্তিত্ব) ভুলবশত কোন কোন ক্ষেত্রে নবীর আদেশের বিরুদ্ধচারণ করেন। এজন্যই ছাহাবগণ ও তৎপরবর্তী লোকেরা ছহীহ হাদীছের বিরুদ্ধচারণকারীদের প্রতিবাদ করেছেন (ছিফাতুন নাবী (ছাঃ), অনুবাদ ৩৫ পৃঃ)

১২. শায়খ নাছিরুদ্দীন আলবানী তাক্বলীদ সম্পর্কে চার ইমামের বক্তব্য তুলে ধরার পর বলেন, ... এসবই হ’ল ইমামগণের বক্তব্য যাতে হাদীছের উপর আমল করার ব্যাপার নির্দেশ রয়েছে এবং তাদের তাক্বলীদ করা থেকে নিষেধ রয়েছে। কথাগুলো এতই স্পষ্ট যে, এগুলো কোন তর্ক বা ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না।

অতএব যে ব্যক্তি ইমামের কিছু কথার বিরুদ্ধে গেলেও সকল সুসাব্যস্ত হাদীছ আঁকড়ে ধরবেন তিনি ইমামদের মাযহাব বিরোধী হবেন না এবং তাদের ত্বরীকা থেকে বহিষ্কৃতও হবেন না বরং তিনি হবেন তাদের প্রত্যেকের অনুসারী। আরো হবেন, শক্ত হাতল মযবুতভাবে ধারণকারী, যে হাতল ছিন্ন হবার নয়। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি শুধু ইমামদের বিরোধিতার কারণে সুসাব্যস্ত হাদীছ প্রত্যাখ্যান করে তার অবস্থা এমনটি নয় বরং এর মাধ্যমে তাদের অবাধ্য হ’ল  এবং তাদের পূর্বোক্ত কথাগুলোর বিরোধিতা করল (ছিফাতু ছালাতিন নাবী (ছাঃ), অনুবাদ ৩৪ পৃঃ)। এ মর্মে মহান আল্লাহ বলেন, فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤْمِنُونَ حَتَّى يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لَا يَجِدُوا فِي أَنْفُسِهِمْ حَرَجًا مِمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيمًا ‘ তোমার প্রতিপালকের ক্বসম তারা ঈমানদার হ’তে পারবে না যতক্ষণ না তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদ নিরসনে তোমাকে বিচারক মানবে, অতঃপর তোমার মীমাংসায় নিজেদের মনে কোন সংকীর্ণতা অনুভব করবে না এবং তা হৃষ্টচিত্তে মেনে নিবে’ (নিসা ৪/৬৫)

উপসংহার :

উপরের আলোচনা হ’তে একথা দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হয়ে গেল যে, বিগত কোন ইমাম বা আলেম তাক্বলীদ করতে বলেননি। তাই পরবর্তীকালে সৃষ্ট বিভিন্ন মাযহাবী ফের্কাবন্দীর জন্য তারা দায়ী নন বরং দায়ী মুক্বাল্লিদগণ নিজেই। যেমন ঈসা (আঃ)-কে ইলাহ বানানোর জন্য তিনি দায়ী ছিলেন না। দায়ী ছিলেন পরবর্তীকালে তাঁর কিছুসংখ্যক তথাকথিত ভক্তের দল। তাই সর্বাবস্থায় তাক্বলীদ অবশ্যই পরিত্যাজ্য।

আব্দুল হালীম বিন ইলিয়াস

কেন্দ্রীয় অর্থ সম্পাদক, বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ




বিষয়সমূহ: তাওহীদ
আরও