দক্ষিণ এশিয়ায় আহলেহাদীছ আন্দোলন
প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
তাওহীদের ডাক ডেস্ক 1087 বার পঠিত
অবক্ষয় যুগ
(৩৭৫-১১১৪/৯৮৪-১৭০৩ খৃঃ পর্যন্ত প্রায় সোয়া সাতশো বছর)
৩৭৫ হিজরীতে ভূপর্যটক মাকদেসী যখন সিন্ধু ভ্রমণে আসেন, তখন সেখানে আহলেহাদীছের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ও শাসনকর্তৃত্ব প্রত্যক্ষ করেন।[1] সেখান হ’তে পরবর্তী ৩৯২ হিজরীর মধ্যে যেকোন এক সময়ে মুলতান ও মানছূরার শাসন ক্ষমতা ইসমাঈলী শী‘আদের হাতে চলে যায়। ফলে রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের সাথে সাথে সুদূরপ্রসারী সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পট-পরিবর্তনের সূত্রপাত হয়। শী‘আরা সুন্নীদের উপরে নিষ্ঠুর আচরণ শুরু করে।[2] মুলতানের জামে মসজিদ বন্ধ করে দেয়। মাদরাসাগুলি ধ্বংস করা হয়। মুহাদ্দিছগণকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়। হাদীছ শিক্ষার জন্য ছাত্রদের বিদেশ গমন নিষিদ্ধ করা হয়। দেবল ও মানছূরার হাদীছশিক্ষার কেন্দ্রগুলি স্তিমিত হয়ে পড়ে। হিন্দু হতে ধর্মান্তরিত।[3] স্থানীয় সামূরা (SAMURA) বা সূমরূ (سومرو) ইসমাঈলী শী‘আ গোত্রটি ছিল এ ব্যাপারে খুবই তৎপর ও শক্তিশালী। তাদের প্রচন্ড সুন্নী-বিদ্বেষের ফলে সিন্ধু অঞ্চলে আরবগণ গঠনমূলক যা কিছু করেছিলেন প্রায় সবই ধ্বংস হয়ে যায়। ৩৯২ হিজরী মোতাবেক ১০০০ খৃষ্টাব্দে গযনীর সুলতান মাহমূদ বিন সবুক্তগীন (৩৮৮-৪২১/৯৯৭-১০৩০ খৃঃ) স্থলপথে হিন্দুস্থান বিজয়ের স্বপ্ন নিয়ে লাহোরকে রাজধানী করে পাঞ্জাব ও সিন্ধু এলাকায় স্বীয় অধিকার প্রতিষ্ঠা করলেও সুমরূ শী‘আদের গোপন দৌরাত্ম ঠিকই বজায় ছিল।[4] পরবর্তীতে ঘোরী, মামলূক, খাল্জী ও তুগলক সালতানাতের সময়েও তাদের এই সুন্নীবিদ্বেষ বজায় থাকে।[5] তাছাড়া সুলতান মাহমূদ ইলমে হাদীছের প্রতি যতটুকু দৃষ্টি দিয়েছিলেন, তাঁর পরবর্তী সুলতানগণ তা দেননি।[6] এই ভাবে ইল্মে হাদীছের প্রসার ও
আহলেহাদীছ আন্দোলনের অগ্রগতির ক্ষেত্রে সৃষ্ট অবক্ষয় যুগ দীর্ঘায়িত হতে থাকে। এই ব্যাপক রাজনৈতিক ও সামাজিক অনুদারতার মধ্য দিয়ে আহলেহাদীছ আন্দোলন নিবু নিবু ভাবে হ’লেও ভারতবর্ষের বিভিন্ন মুহাদ্দিছ ও ইল্মে হাদীছের কেন্দ্রসমূহের মাধ্যমে চলতে থাকে। সে হিসাবে আমরা অবক্ষয় যুগে আহলেহাদীছ আন্দোলনকে তিনটি প্রধান এলাকায় বিভক্ত করতে পারি। ১-উত্তর ও পশ্চিম ভারতীয় এলাকা ২- দক্ষিণ ভারতীয় এলাকা এবং ৩- উত্তর ও পূর্ব ভারতীয় এলাকা। এক্ষণে আমরা এইসব এলাকায় আহলেহাদীছ আন্দোলনের কেন্দ্রসমূহের ও সেখানকার মুহাদ্দিছগণের পরিচয় তুলে ধরব।
৩- উত্তর ও পূর্ব ভারতীয় এলাকা। এক্ষণে আমরা এইসব এলাকায় আহলেহাদীছ আন্দোলনের কেন্দ্রসমূহের ও সেখানকার মুহাদ্দিছগণের পরিচয় তুরে ধরব।
(১) উত্তর-পশ্চিম ভারতে আহলেহাদীছ আন্দোলন
সুলতান মাহমূদের সময়কাল (৩৯২-৪২১/১০০০-১০৩০ খৃঃ) বাদে পঞ্চম শতাব্দী হিজরীর প্রথমার্ধ হতে দশম শতাব্দী হিজরীতে মাখদূম আব্দুল আযীয আবহারীর (মৃঃ ৯২৮/১৫২১ খৃঃ) সময়কাল[7] পর্যন্ত প্রায় সাড়ে চারশো বছর যাবৎ উত্তর-পশ্চিম ভারত তথা সিন্ধু, পাঞ্জাব ও তৎসন্নিহিত এলাকায় ইল্মে হাদীছের কেন্দ্রগুলির সাথে সিন্ধুর ইল্মী যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল।[8] তবুও এই সময় কিছু কিছু আহলেহাদীছ বিদ্বান বিভিন্ন সময়ে ইল্মে হাদীছের খিদমত করেছেন ও মানুষকে পবিত্র কুরআন ও হাদীছের আলোকে জীবন গড়ার আহবান জানিয়ে গেছেন। নিম্নে এযুগের কয়েকজন খ্যাতনামা মুহাদ্দিছ সম্পর্কে আলোকপাত করা হ’ল।
১- ইসমাঈল লাহোরী (মৃঃ ৪৪৮/১০৫৬ খৃঃ)ঃ[9] কুরআন ও হাদীছে ব্যুৎপত্তিসম্পন্ন এই খ্যাতনামা আলিম ৩৯৮/১০০৬ খৃষ্টাব্দে বুখারা হতে লাহোর আসেন এবং ইল্মে হাদীছের চর্চা শুরু করেন। তাঁর ওয়াযের এমন প্রভাব ছিল যে, লাহোরের বহু অমুসলিম বাশিন্দা ইসলাম গ্রহণ করেন। লাহোর শহরের বহু মুসলমান হাদীছ অনুযায়ী জীবন গঠনে উদ্বুদ্ধ হন। ৪১২/১০২১ খৃষ্টাব্দে লাহোর জয় করে[10] হাদীছভক্ত সুলতান মাহমূদ পাঞ্জাবের শী‘আ প্রভাবিত অন্যান্য শহরকে বাদ দিয়ে হাদীছ প্রভাবিত লাহোরকে উত্তর ভারতের রাজধানী হিসাবে মানোনীত করার পিছনে মুহাদ্দিছ ইসমাঈলের প্রভাব একটি কারণ হিসাবে ধারণা করা যেতে পারে।
২- আলী বিন আমর বিনুল হাকাম লাহোরী (মৃঃ ৫২৯/১১৩৪ খৃঃ)ঃ ইনি খ্যাতনামা মুহাদ্দিছ, কবি ও সাহিত্যিক ছিলেন। হাদীছজ্ঞ হিসাবে তাঁর খ্যাতি বাগদাদ পর্যন্ত পৌঁছে যায়। বিখ্যাত সংকলক সমরকন্দের মুহাদ্দিছ সাম‘আনীকে তাঁর ছাত্রদলের মধ্যে গণ্য করা যায়।[11]
৩- আবদুছ ছামাদ লাহোরীঃ ইনি মুহাদ্দিছ আলী বিন আমর লাহোরীর ছাত্র ছিলেন। সমরকন্দে গিয়ে সাম‘আনীর নিকটেও হাদীছ শিক্ষা করেন।[12]
৪- হাসান বিন মুহাম্মাদ বিন হাসান ছাগানী লাহোরী (৫৭৭-৬৫০/১১৮১-১২৫২ খৃঃ)ঃ ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ)-এর বংশধর রাযিউদ্দীন হাসান বিন মুহাম্মাদ ছাগানী লাহোরী উপমহাদেশের সর্বাপেক্ষা প্রসিদ্ধ ও খ্যাতনামা মুহাদ্দিছ ছিলেন। তিনি বাগদাদ, ইয়ামন, হিজায প্রভৃতি স্থানের শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিছগণের নিকটে ইল্মে হাদীছে বুৎপত্তি লাভ করেন।[13] বুখারী ও মুসলিম হতে সংকলিত কওলী হাদীছের গ্রন্থ ‘মাশারেকুল আনওয়ার’ তাঁকে বিশ্বজোড়া খ্যাতি এন দেয়। অনাবশ্যক মাসায়েলী বিতর্ক থেকে দূরে ছহীহ হাদীছ অনুযাযী জীবন পরিচালনার জন্য এবং হাদীছকে জনগণের নাগালের মধ্যে এনে দেওয়ার জন্য তিনি এই কঠিন প্রচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছিলেন।[14] এমনিভাবে কেউ যাতে মওযূ হাদীছ অনুসরণ না করে সেজন্য ‘আল-মাওযূআত’ নামে তিনি একটি পৃথক প্রন্থ রচনা করেন।[15] ফেক্হী বিষয় ভিত্তিক সংকলিত হাদীছ গ্রন্থ ‘মাশারেকুল আনওয়ার’-কে মুহাদ্দিছ খুররম আলী বালহারী (মৃঃ ১২৬০ হিঃ) এমন একটি ফুলবাগিচার সাথে তুলনা করেছেন, যার রং এক কিন্তু সুগন্ধি পৃথক পৃথক।[16] ডঃ মুহাম্মাদ ইসহাক বলেন- ‘তৎকালীন সময়ে ফিক্হের জালে আবদ্ধ হিন্দুস্থান ও মধ্য এশিয়ায় এই কিতাবখানিই মাত্র ইল্মে হাদীছের পতাকা উড্ডীন রেখেছিল।’[17]
(২) দক্ষিণ ভারতে আহলেহাদীছ আন্দোলন
দক্ষিণ ভারতীয় আন্দোলনকে দক্ষিণাত্যে বাহমনী যুগ ও গুজরাটে মুযাফ্ফর শাহী যুগ দু’ভাগে ভাগ করা চলে।
ক-বাহমনী যুগ (৭৮০-৮৮৬ হিঃ/১৩৭৮-১৪৭২ খৃঃ)
অনেক পন্ডিত এই যুগটিকে ভারতবর্ষে ইল্মে হাদীছের ‘নবজন্ম লাভের যুগ’ বলেছেন।[18] বাহমনী সুলতান ২য় মুহাম্মাদ শাহ (৭৮০-৭৯৯/১৩৭৮-১৩৯৭ খৃঃ) ইল্মে হাদীছের ব্যাপক পৃষ্ঠপোষকতা দান করেন। হেজায ও মিসর হতে দাক্ষিণাত্যে অগণিত মুহাদ্দিছের আগমন ঘটে। ফলে গুলবর্গা, বেদার, দৌলতাবাদ, ইলিচপুর, চৌল, যাবিল প্রভৃতি শহর গুলি ইল্মে হাদীছের কেন্দ্রে পরিণত হয়।[19] ২য় মুহাম্মাদ শাহের পর থেকে তাঁর যোগ্য উত্তরাধিকারীদের সময়ে ও বিশেষ করে সুলতান ২য় আলাউদ্দীনের (৮৩৮-৮৬২/১৪৩৪-৫৮) সময়ে ইরান হ’তে আগমন করেন ইল্মে হাদীছে গভীর পান্ডিত্যের অধিকারী ও পরবর্তীতে দীর্ঘ ৩৫ বৎসর যাবৎ বাহমনী সালতানাতের খ্যাতনামা উযীর ও প্রধানমন্ত্রী মাহমূদ গাওয়ান (৮১৩-৮৮৬/১৪১০-১৪৮২ খৃঃ)। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় আরব বিশ্ব হ’তে বহু খ্যাতনামা মুহাদ্দিছ দক্ষিণ ভারতে আগমন করেন। তিনি হাফেয ইবনু হাজার আসক্বালানী (৭৭৩-৮৫২/১৩৭২-১৪৪৮ খৃঃ)-এর ছাত্র ছিলেন। মৃত্যুর পূর্বে তিনি রাজধানী বিদরে একটি বৃহদায়তন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন এবং নিজস্ব কুতুবখানার তিনি হাজার কিতাব ছাড়াও অন্যান্য সূত্র হ’তে ৩৫,০০০ হাজার কিতাব সংগ্রহ করে উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরীকে সমৃদ্ধ করেন।[20] কিন্তু অবশেষে তিনি সুলতান ৩য় মুহাম্মাদ শাহ (৮৬৭-৮৮৬/১৪৬৩-৮২ খৃঃ) কর্তৃক মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত হন।[21] তাঁর মৃত্যুর সাথে সাথে শুধু বাহমনী রাজ্যেরই পতন শুরু হয়নি বরং দাক্ষিণাত্যে ইল্মে হাদীছের প্রসার ও আহলেহাদীছ আনোদালনের গতি মন্থর হয়ে যায়। একটি যুগের অবসান ঘটে। পরবর্তীতে দক্ষিণ ভারতে শী‘আ অধিকার কায়েম হয় ও সেখানে সিন্ধুর ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটতে শুরু হয়।
খ- মুযাফ্ফর শাহী যুগ (৮৬৩-৯৮০/১৪৫৮-১৫৭২ খৃঃ)
দাক্ষিণাত্যের বাহমনী রাজ্যে শী‘আ অধিকার কায়েম হবার ফলে সেখানে আহলেহাদীছ আন্দোলন স্তিমিত হয়ে আসে। সেখানকার মুহাদ্দিছগণ পার্শ্ববর্তী গুজরাট রাজ্যের হাদীছভক্ত সুলতান আবুল ফৎহ খান ওরফে মাহমূদ বেগরহা (৮৬৩-৯১৭/১৪৫৮-১৫১১ খৃঃ) এর উদারতায় আকৃষ্ট হয়ে সেখানে আশ্রয় নিতে থাকেন। সুলতানের গুণগ্রাহিতার সুবাদে ইতিপূর্বেই সেখানে আরব বিশ্ব হতে বহু খ্যাতিমান মুহাদ্দিছের আগমন ঘটেছিল। মিসরের মুহাদ্দিছ অজীহুদ্দীন মুহাম্মাদ (৮৫৬-৯১৯/১৪৫২-১৫১৩ খৃঃ)-কে সুলতান মাহমূদ বেগরহা মালিকুল মুহাদ্দেছীন’ খেতাবসহ মহামূল্যবান উপঢৌকন দিয়ে গুজরাটে আনেন ও রাজ্যের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তার দায়িত্ব প্রদান করেন। ৯১৮/১৫১২ খৃষ্টাব্দে যখন ইয়ামন হ’তে ফাৎহুল বারীর হস্তলিখিত কপি সর্বপ্রথম ভারতবর্ষে আসে[22] এবং সুলতান মুযাফ্ফর শাহ (৯১৭-৩২/১৫১১-২৫ খৃঃ)-কে উপঢৌকন দেওয়া হয়, তখন তিনি এতই খুশী হয়েছিলেন যে, হাদিয়া দাতাকে সমৃদ্ধ বন্দরনগরী ‘ভ্রুচ’ জায়গীর স্বরূপ দান করেন।[23]
মুযাফ্ফর শাহী সুলতানগণ ইল্মে হাদীছকে জনসাধারণের মধ্যে পৌছে দেওয়ার জন্য ব্যাপক অনুবাদ ও সংকলনের ব্যবস্থা করেন। সূলতান ৩য় মাহমূদ (৯৪৪-৬১/১৫৩৭-৫৩ খৃঃ) নিজ খরচে মক্কাতে একটি মাদরাসা কায়েম করেন। তিনি ‘কানযুল উম্মাল’ সংকলক শায়খ আলী মুত্তাক্বী জৌনপুরী (মৃঃ ৯৭৫/১৫৬৮ খৃঃ) ও শায়খ আব্দুল্লাহ সিন্ধী (৯৯৩/১৫৮৪ খৃঃ)-এর জগদ্বিখ্যাত মুহাদ্দিছগণকে গুজরাটে ফিরিয়ে আনতে সমর্থ হন। বাহমনী উযীর মাহমূদ গাওয়ান (৮১৩-৮৬/১৪১০-৮২ খৃঃ)- এর ন্যায় তিনিও ভাগ্যক্রমে আছফ খান নামে এক গুণবান উযীরের সাহচর্য লাভ করেছিলেন। কিন্তু ৯৬১ হিজরীতে তাঁর হত্যাকান্ডের পর গুজরাটে চরম অরাজকতা গুরু হয়ে যায়।[24] অবশেষে ৯৮১/১৫৭২ খৃষ্টাব্দে মুঘল সম্রাট আকবরের (৯৬৩-১০১৪/১৫৫৬-১৬০৫ খৃঃ) হতে মুযাফ্ফরশাহী সালতানাতের পতন ঘটে।[25] এইভাবে অবক্ষয় যুগে দক্ষিণ ভারতে আহলেহাদীছ আন্দোলনের আরেকটি প্রধান কেন্দ্রের তৎপরতা স্তিমিত হয়ে পড়ে।
দক্ষিণ ভারতে আহলেহাদীছ আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালনকারী মুহাদ্দিছগণের কয়েক জনের নাম উল্লেখ করা চলে। যেমন- (১) শায়খ ইয়াকুব বিন আব্দুর রহমান হাশেমী (৭৪৯-৮৪৩/১৩৮৭-১৪৩৯ খৃঃ) মক্কায় জন্মগ্রহণকারী ও ইবনু হাজার আসক্বালানী (৭৭৩-৮৫২/১৩৭২-১৪৪৮ খৃঃ)- এর ছাত্র এই মুহাদ্দিছ ৮৩০ হিজরীতে গুজরাটের খাম্বাইতে আসেন ও ৮৪৩ হিজরীতে দক্ষিণ বেরারে ইন্তেকাল করেন।[26] (২) মাহমূদ গাওয়ান (৮১৩-৮৮৬/১৪১০-১৪৮২ খৃঃ) ইরানের এই ক্ষণজন্মা মনীষী কায়রোতে গিয়ে ইবনু হাজার আসকালানীর নিকটে ছহীহ বুখারী এবং যয়নুদ্দীন যরকেশী (মৃঃ ৮৪৫/১৪৪১ খৃঃ)-এর নিকটে ছহীহ মুসলিম এবং সিরিয়া গমন করে সেখানকার মুহাদ্দিছগণের নিকট থেকে ইল্মে হাদীছ শিক্ষা করেন ও পরবর্তীতে রাহমনী উযীর হিসাবে খ্যাতিলাভ করেন।[27] (৩) আব্দুল আযীয বিন মাহমূদ তূসী (৮৩৬-৯১০/১৪৩২-১৫১৪ খৃঃ)ঃ ইনিও ইরানের অধিবাসী ছিলেন। ইবনু হাজারের ছাত্র মুহাম্মাদ বিন আব্দুল আযীয আবহারীর শিষ্য ছিলেন। পরে মক্কায় গিয়ে হাফেয আব্দুর রহমান সাখাবী (মৃঃ ৯০২ হিঃ/১৪৯৬ খৃঃ)-এর নিকটে ইল্মে হাদীছ শিক্ষা করেন। মাহমূদ গাওয়ানের পুত্রের গৃহশিক্ষক ছিলেন।[28] (৪) ওমর বিন মুহাম্মাদ দামেস্কী (৮২৯-৯০০/১৪২৫-৯৪ খৃঃ)ঃ ইনিও হাফেয সাখাবীর ছাত্র ছিলেন। গুজরাটের খাম্বাইতে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন।[29] (৫) অজীহুদ্দীন মুহাম্মাদ মালেকী মিসরী (৮৫৬-৯১৯/১৪৫২-১৫১৩ খৃঃ) (৬) জামালুদ্দীন মুহাম্মাদ বিন ওমর হাযরামী (৮৬৯-৯৩০/১৪৬৪-১৫২৪ খৃঃ) হাযরামাউতের অধিবাসী। (৭) হুসাইন বিন আব্দুল্লাহ কিরমানী (মৃঃ ৯৩২/১৫২৫ খৃঃ) মক্কার অধিবাসী (৮) রফীউদ্দীন সিরাযী সাফাবী (মৃঃ ৯৫৪/১৫৪৭ খৃঃ) ইরানের অধিবাসী (৯) আব্দুল মু‘তী বিন হাসান হাযরামী (৯০৫-৮৯/১৪৯৯-১৫৮১ খৃঃ) মক্কার অধিবাসী (১০) শিহাবুদ্দীন আহমাদ আবাসী মিসরী (৯০৩-৯২/১৪৯৭-১৫৮৪ খৃঃ) (১১) আব্দুল্লাহ ঈদরূসী (৯১৯-৯০/১৫১৩-৮২) হাযারামাউতের অধিবাসী (১২) সাঈদ বিন আবু সাঈদ হাবাশী (মৃঃ ৯৯১/১৫৮৩ খৃঃ) (১৩) মুহাম্মাদ বিন আবদুল্লাহ ফাকেহী হাম্বলী (মৃঃ ৯৯২-১৫৮৪ খৃঃ)। এঁরা দু’জনই মক্কায় ইবনু হাজার হায়ছামী (৯০৯-৯৭৪/১৫০৩-১৫৬৭ খৃঃ)-এর ছাত্র ছিলেন।
উপরের মুহাদ্দিছগণের সকলেই ছিলেন বিদেশী এবং যুগের চারজন সেরা মুহাদ্দিছ ইবনু হাজার আসকালানী (৭৭৩-৮৫২/১৩৭২-১৪৪৮ খৃঃ), যয়নুদ্দীন যাকারিয়া আনছারী (৮২৬-৯২৫/১৪২৩-১৫১৯ খৃঃ), আব্দুর রহমান সাখাবী (মৃঃ ৯০২-১৪৯৬ খৃঃ) ও ইবনু হাজার হায়ছামী (৯০৯-৯৭৪/১৫০৩-১৫৬৭ খৃঃ)-এর ছাত্র ছিলেন। প্রথমোক্ত দু’জনের নেতৃত্বে মিসরে ও শেষোক্ত দু’জনের নেতৃত্বে মক্কাতে ইল্মে হাদীছের মারকায কায়েম হয়।[30] এক্ষণে আমরা দক্ষিণ ভারতের স্বদেশী মুহাদ্দিছবৃন্দের নাম উল্লেখ করব, যাঁরা এতদঞ্চলে ইল্মে হাদীছের প্রসারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন-
(১) রাজিহ বিন দাঊদ গুজরাটি (মৃঃ ৯০৪/১৪৯৬ খৃঃ) (২) কুতুবুদ্দীন আববাসী গুজরাটি (৩) আব্দুল মালিক আববাসী গুজরাটি (মৃঃ ৯৭০/১৫৬৩ খৃঃ) (৪) আব্দুল আউয়াল হুসাইনী জৌনপুরী (মৃঃ ৯৬৮/১৫৬১ খৃঃ) (৫) শায়খ ত্বাইয়িব সিন্ধী (মৃঃ ৯৯৯/১৫৯০ খৃঃ) (৬) ত্বাহির বিন ইউসুফ সিন্ধী (মৃঃ ১০০৪/১৫৯৫ খৃঃ) (৭) অজীহুদ্দীন আলুবী গুজরাটি (৯১০-৯৯৮/১৫০৪-১৫৯০) (৮) আবু বকর বিন মুহাম্মাদ ভ্রুচী গুজরাটি (মৃঃ ৯১৫/১৫০৯) (৯) উছমান বিন ঈসা সিন্ধী (মৃঃ ১০০৮/১৬০০ খৃঃ) (১০) ‘কানযুল উম্মাল’ সংকলয়িতা শায়খ আলী বিন হুসামুদ্দীন ওরফে আলী মুত্তাক্বী জৌনপুরী (৮৮৫-৯৭৫/১৪৮১-১৫৬৮ খৃঃ) ও তাঁর স্বনামধন্য ছাত্রমন্ডলী যেমন- (১১) শায়খ জামালুদ্দীন মুহাম্মাদ বিন ত্বাহির ওরফে ত্বাহির পাট্টানী গুজরাটি (৯১৪-৯৮৬/১৫০৮-১৫৭৮ খৃঃ) (১২) কাযী আবদুল্লাহ বিন ইদরীস সিন্ধী (মৃঃ ৯৫৫/১৫৪৮ খৃঃ) (১৩) রহমাতুল্লাহ বিন আবদুল্লাহ সিন্ধী (মৃঃ ৯৯৩-১৫৮৫ খৃঃ) (১৪) শায়খ হামীদ বিন আবদুল্লাহ সিন্ধী (১৫) আবদুল হক দেহলভীর উস্তাদ শায়খ আবদুল ওয়াহ্হাব বিন ওয়ালিউল্লাহ বুরহানপুরী (৯৪৩-১০০১/১৫৩৬-৯২ খৃঃ) (১৬) শাহ মুহাম্মাদ বিন ফযলুল্লাাহ গুজরাটি (মৃঃ ১০০৫/১৫৯৬ খৃঃ) প্রমুখ মুহাদ্দেছীনে কেরাম। এই সকল সেরা মুহাদ্দিছের মাধ্যমে দক্ষিণ ভারতে প্রায় দুইশত বৎসর (৭৮০-৯৮০/১৩৭৮-১৫৭২ খৃঃ) পর্যন্ত আহলেহাদীছ আন্দোলন ভারতবর্ষ ও দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য সমস্ত অঞ্চলের তুলনায় বেশী ছিল বলা চলে।[31]
(বিস্তারিত দ্রষ্টব্য : প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন : উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ, দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষিতসহ, পৃঃ ২২৩-২২৯)।
[1]. শামসুদ্দীন মুহাম্মাদ বিন আহমাদ বেশারী মাকদেসী প্রণীত ভ্রমণ গ্রন্থ ‘আহসানুত তাক্বাসীম’ (লন্ডনঃ ই, জে, ব্রীল, ২য় সংস্করণ ১৯০৬) পৃঃ ৪৮১।
[2]. Dr. Muhammad Ishque, INDIA’S CONTRIBUTION TO THE STUDY OF HADITH LITERATURE (Dacca University, 2nd ed. 1976) p. 42.
[3]. ইশতিয়াক হুসাইন কুরায়শী, উর্দূ অনুবাদঃ হেলাল আহমাদ যোবায়রী, ‘বার্রে আযীম পাক ও হিন্দ কি মিল্লাতে ইসলামিয়াহ’ (করাচী বিশ্ববিদ্যালয়, ১ম প্রকাশ ১৯৬৭) পৃঃ ৫১।
[4]. শাহেদ হুসাইন রায্যাক্বী, ইল্মে হাদীছ মেঁ বার্রে আযীম পাক ও হিন্দ কা হিছ্ছা’ (লাহোরঃ ইদারা ছাক্বাফাতি ইসলামিয়াহ, ১৯৭৭খৃঃ) পৃঃ ৬১-৬৩।
[5]. সমরূগণ ১৪শ খৃষ্টাব্দে এসে ‘সুন্নী’ হয়ে যায়।-‘বার্রে আযীম পাক ও হিন্দ’ পৃঃ ৫৩।
[6]. সুলতান মাহমূদ (মৃঃ ৪২১/১০৩০ খৃঃ) একজন উঁচুদরের হানাফী আলিম ছিলেন। তাঁর রচিত ‘আত্-তাফরীদ’ হানাফী ফিক্হের একটি উলেস্নখযোগ্য গ্রন্থ (আব্দুর রহমান ফিরিওয়াঈ, ‘জুহুদ মুখ্লিছাহ’ পৃঃ ৩১-৩২)। একদা নিজ দরবারে ইমাম ক্বাফ্ফাল মারওয়াযীর নিকটে তিনি হানাফী ও শাফেঈ উভয় মাযহাবের দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেন এবং ছহীহ হাদীছ ভিত্তিক প্রমানিত হওয়ায় তিনি সংগে সংগে ‘শাফেঈ’ মাযহাব গ্রহণ করেন।- আহমাদ ইবনু খাল্লিকান (৬০৮-৬৮১/১২১২-১২৮৩), ‘অফইয়াতুল আ‘ইয়ান’ (মিসরঃ মায়মানিয়াহ প্রেস ১৩১০/১৮৯২ খৃঃ) ২য় খন্ড পৃঃ ৮৬; তাজুদ্দীন সুব্কী, ‘তাবাকাতুশ শাফেঈয়াহ’ (বৈরুতঃ দারুল মা‘রিফাহ অফসেট ছাপা, মূল মুদ্রণকাল ১৩২৪/১৯০৬, ২য় সংস্করণ, ৪র্থ খন্ড পৃঃ ১৪)। ছহীহ হাদীছকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কারণে ঐতিহাসিক মোল্লা মুহাম্মাদ কাসিম হিন্দুশাহ ঈরানী ওরফে ফিরিশ্তা (৯৭৮-১০২১/১৫৭০-১৬১২ খৃঃ) সুলতান মাহমূদকে ‘আহলেহাদীছ’ বিদ্বানদের মধ্যে গণ্য করেছেন।- তারীখে ফিরিশতা (কানপুর, ভারতঃ নওলকিশোর ছাপা ১৩০১/১৮৮৩ খৃঃ) ১ম মাক্বালাহ, ১ম খ- পৃঃ ২৩।
[7]. ‘ইল্মে হাদীছ’ পৃঃ ১৩২।
[8]. প্রাগুক্ত পৃঃ ৬৩।
[9]. প্রাগুক্ত পৃঃ ৭১; কাযী আতহার মুবারকপুরী মুহাদ্দিছ ইসাঈল লাহোরীর মৃত্যুসন ৪০৮ হিজরী বলেছেন।-রিজালুস সিন্দ পৃঃ ৭৭।
[10]. ‘ইল্মে হাদীছ’ পৃঃ ৯৯।
[11]. প্রাগুক্ত পৃঃ ৭৩।
[12]. ‘রিজালুস সিন্দ’ পৃঃ ১৬৫।
[13]. আব্দুর রহমান ফিরিওয়াঈ, জুহুদ মখ্লিছাহ পৃঃ ৩৩-৩৪, রিজালুস সিন্দ পৃঃ ৯৪।
[14]. ‘ইল্মে হাদীছ’ পৃঃ ২৫৭-৬৯।
[15]. ‘জুহুদ মুখলিছাহ’ পৃঃ ৩৪।
[16]. ‘ইল্মে হাদীছ’ পৃঃ ২৬৭।
[17]. প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৬৮ [‘Suffice it to say that it was the `Mashariq ai Anwar’ which kept aloft the banner of the sunnah in the fiqh-ridden country of India and central Asis of the day; INDI’S CONTRIBUTION TO THE STUDY OF HADITH LITERATURE. pp.230]
[18]. প্রাগুক্ত পৃঃ ১০৮; জুহুদ মুখলিছাহ পৃঃ ৩৭।
[19]. ‘ইল্মে হাদীছ’ পৃঃ ১২৬।
[20]. প্রাগুক্ত পৃঃ ১১৬-১১৭।
[21]. ডঃ সৈয়দ মাহমূদুল হাসান, ‘ভারতবর্ষের ইতহাস-মুসলিম ও বৃটিশ শাসন’ (ঢাকাঃ গ্লোব লাইব্রেরী, ৪০ নর্থব্রুক হল রোড, ৩য় সংস্করণ পূণর্মুদ্রণ জুন ১৯৮৪)পৃঃ ২১৯।
[22]. ‘ইল্মে হাদীছ’ পৃঃ ১৩০।
[23]. প্রাগুক্ত পৃঃ ১১৯।
[24]. প্রাগুক্ত পৃঃ ১৩০-৩১।
[25]. ‘ভারতবর্ষের ইতিহাস’ পৃঃ ২১৫।
[26]. ‘জুহুদ মুখলিছাহ’ পৃঃ ৪০; ‘ইল্মে হাদীছ’ পৃঃ ১১৫।
[27]. ‘ইল্মে হাদীছ’ পৃঃ ১১৬-১১৭।
[28]. প্রাগুক্ত পৃঃ ১১৮।
[29]. প্রাগুক্ত পৃঃ ১১৮।
[30]. প্রাগুক্ত পৃঃ ১১২।
[31]. এ বিষয়ে সমস্ত আলোচনার জন্য ডঃ মুহাম্মাদ ইসহাক -এর পি,এইচ-ডি থিসিস INDIAN’S CONTRIBUTION TO THE STUDY OF HADITH LITERATURE (Dacca Univerisity 2nd Ed. 1976; আবদুর রহমান ফিরিওয়াঈ, ‘জুহুদ মুখ্লিছাহ’ (বেনারসঃ মাতবা‘আ সালাফিইয়াহ, ২য় সংস্করণ ১৪০৬/১৯৮৬; সুলায়মান নাদ্ভী (১৮৮৪-১৯৫৩ খৃঃ) আযমগড় (ইউ,পি, ভারত)ঃ ‘মা‘আরিফ’ গবেষণা পত্রিকা ২২শ বর্ষ ৪ ও ৫ সংখ্যায় প্রকাশিত দীর্ঘ প্রবন্ধ ‘হিন্দুস্তান মেঁ ইল্মে হাদীছ’ দ্রষ্টব্য।