নেতৃত্বহীন জাতি : মুক্তির পথ কোথায়?

আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম 1701 বার পঠিত

ভূমিকা

মানুষ সামাজিক জীব। সে একাকী বসবাস করতে পারে না। সকলে মিলেমিশে সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করে। মানুষের পারস্পরিক শান্তিপূর্ণ সম্পর্কের দর্শন হ’ল সমাজ দর্শন। মানুষ ও পশু-পক্ষী সবাই সামাজিক চেতনা সম্পন্ন। মানুষের মধ্যে জৈবিক চেতনার সাথে সাথে নৈতিক ও আধ্যাত্মিক চেতনা সংযুক্ত। ফলে তাদের সমাজ জীবনের বন্ধন হয় সুদৃঢ়, দ্যোতনাময় এবং সর্বব্যাপী। পশু-পক্ষীর চেতনা স্রেফ জৈবিক ও রৈপিক। আত্মরক্ষার স্বার্থে তাদের মধ্যে এক ধরনের ঐক্য চেতনা কাজ করে। সেজন্য প্রত্যেক পশু-পক্ষী স্ব স্ব জাতি ও গোত্রের মাঝে বসবাস করে। হরিণ হরিণের সাথে, বাঘ বাঘের সাথে, বানর বানরের সাথে। এই পশু-পক্ষীগুলিও পরস্পর পরস্পরের নেতৃত্ব সশ্রদ্ধচিত্তে গ্রহণ করে। পাখি আকাশে উড়ে সুশৃংখলভাবে একজন নেতাকে সামনে রেখে। পিঁপড়া মাটিতে চলে সুবিন্যন্ত ধারায় তাদের একজন নেতাকে অনুসরণ করে। মৌমাছি মধু সঞ্চয় করে তাদের রাণী মাছিকে ঘিরে। মৌমাছি বা ভিমরুলকে কেউ আঘাত করলে হাযারটা এসে শত্রুকে দংশন করে। এভাবে সর্বত্র রয়েছে এক ধরনের সামাজিক চেতনা। এই সামাজিক চেতনা থেকে তৈরী হয় নেতৃত্ব চেতনা। সমাজ পরিচালনার জন্য নেতৃত্ব একটি অপরিহার্য বিষয়। আর বহুকে একক পথে পরিচালনার দর্শনকে বলা হয় নেতৃত্ব দর্শন (সম্পাদকীয় আত-তাহরীক, জানুয়ারী ২০১০)

নেতৃত্বের গুরুত্ব

মানুষের জন্য আল্লাহ প্রদত্ত নেআমতসমূহের মধ্যে অন্যতম সেরা নেআমত হল নেতৃত্বের যোগ্যতা। এই যোগ্যতা সকল মানুষকে প্রদান করা হয়নি। স্বল্প সংখ্যক মানুয়ের মাঝে এই গুণ সীমায়িত। যাতে তারা সমাজকে সুশৃংখলভাবে পরিচালিত করতে সক্ষম হয়। সমাজ জীবনে দুই ধরনের নেতৃত্ব বিরাজমান। এক প্রকার নেতা সরাসরি আল্লাহ কতৃক মনোনীত। তারা আল্লাহর নবী বা রাসূল হিসাবে পরিচিত। যারা সরাসরি আল্লাহর তত্ত্বাবধানে পরিচালিত। ফলে তাদের প্রতিটি বিধানগত কর্ম, কথা ও আচরণ অন্য মানুষের জন্য একান্তভাবে অনুসরণীয়। আর শেষ নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর পর ক্বিয়ামত পর্যন্ত নবী আগমনের সিলসিলার পরিসমাপ্তি ঘঠেছে। দ্বিতীয় ধরনের নেতা হলেন মানবীয় গুণসম্পন্ন সাধারণ সমাজনেতা (সম্পাদকীয় আত-তাহরীক, জানুয়ারী ২০১০)। তবে মানবীয় গুণসম্পন্ন নেতাদের কর্ম, আচরণ ও কথা অন্য মানুষের জন্য নিঃশর্ত অনুসরণীয় ও অনুকরণীয় নয়। কেবলমাত্র আল্লাহ এবং মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর পথে তাদের নির্দেশ অনুসরণীয়। কেননা নাফরমানী তথা পাপ ও সীমালংঘনের ব্যাপারে কোন আনুগত্য নেই। নেতৃত্বের সাথে তারুণ্য অন্তর্ব্যাপ্ত। তারুণ্যের জয় অবশ্যম্ভাবী। তবে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, আদর্শ, মানসম্পন্ন সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব ছাড়া সেটা কখনো কল্পনা করা যায় না। ইতিহাসে যার দৃষ্টান্ত শত শত। নেতৃত্ব না থাকলে কিছুই সফল হয় না। বাস্তিল দুর্গের পতন হতো না নেতৃত্বের অঙ্গুলি হেলন ছাড়া। সাম্যবাদের বস্ত্তবাদী আদর্শ ও লেনিনের কঠিন নেতৃত্ব ছাড়া রুশ বিপ্লব সত্তর-আশি বছর টিকে থাকত না। মাও সেতুং সময়মতো লংমার্চ না থামালে ইমাম খোমেনির নেতৃত্বে গণচীনের রেযাশাহকে ছুড়ে ফেলে দিত। তিউনিসিয়ায় বেন আলীকে হটাতে ফুসে ওঠা জনতা নেতৃত্ব পেল রশীদ ঘানুশির মতো ব্যক্তিত্বের। বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনে নেলসন ম্যান্ডেলার সফল নেতৃত্ব চিরস্মরণীয়। মুহাম্মাদ বখতিয়ার খিলজি ছিলেন ইতিহাস খ্যাত আফগান সেনানায়ক। যিনি মাত্র সতের জন্য সৈন্য নিয়ে অতর্কিত আক্রমণে নদীয়া দখল করেন। ১২০৩ খ্রিঃ যার নেতৃত্বে বাংলায় মুসলমান রাজত্বের সূচনা হয়। উনসত্তরের রাজপথে মাওলানা ভাসানী, জেলে বঙ্গবন্ধু, মিছিলের সামনে ডজন খানেক জাতীয় নেতা, সাথে অগ্রগামীর ভূমিকায় ছাত্রনেতারা। অতঃপর উদিত হয়েছিল বাংলার আকাশে স্বাধীনতার লাল সূর্যের।

পৃথিবীতে কোন পরিবর্তন নেতৃত্ব ছাড়া হয়নি। আবার নেতা ছাড়া কোন ধর্মও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। পৃথিবীতে ইসলাম ধর্ম ছাড়া সমস্ত ধর্ম সৃষ্টির পেছনে নেতৃত্ব সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। ফলে দলে দলে মানুষ বিভিন্ন ধর্মের অনুসারী হয়েছে। অথচ একমাত্র ইসলাম ছাড়া সকল প্রকারের ধর্মীয় মতবাদ ও মস্তিস্ক প্রসূত মতবাদসমূহ বাতিল ও পরিত্যাজ্য। পৃথিবীর প্রারম্ভ থেকে ক্বিয়ামতের পূর্ব পর্যন্ত প্রতিটি মুসলমান আল্লাহর আনুগত্যে নেতৃত্ব মানতে বাধ্য। কিন্তু পাপের কাজে আনুগত্য বা নেতৃত্ব মেনে নিতে বাধ্য নয় (মাযেদা ৫/২)। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘প্রত্যেক মুসলিম ব্যক্তির নেতার নির্দেশ শ্রবণ করা এবং আনুগত্য করা অপরিহার্য কর্তব্য। চাই সে নির্দেশ তার পছন্দ হোক কিংবা অপছন্দ হোক, যতক্ষণ না তাকে নাফরমানীর নির্দেশ দেয়া হয়। কিন্তু যদি নাফরমানীর নির্দেশ দেওয়া হয়, তখন সেখানে কোন অনুগত্য নেই (মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৩৬৬৪)। অন্য বর্ণনায় রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘পাপ ও সীমালংঘনের ব্যাপারে কোন আনুগত্য নেই। আনুগত্য কেবলমাত্র ন্যায় ও সৎ কাজের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য’ (মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৩৬৬৫)

আমীর কর্তৃক মা’মূরকে আগুনে ঝাপ দিয়ে আনুগত্যের পরকাষ্ঠা দেখাতে বললে কতিপয় ছাহাবী আগুনে ঝাঁপ দেওয়ার মনস্থির করে এবং কতিপয় ছাহাবী অস্বীকার করে অতঃপর তারা বললেন যে, আমরা তো (ইসলাম গ্রহণের মাধ্যমে) আগুন থেকে বাঁচার জন্যই মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর নিকট পলায়ন করেছি। এমতাবস্থায় আগুন নিভে গেল এবং আমীরের রাগও প্রশমিত হল। অতঃপর নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকট খবর পৌঁছে গেল। তখন তিনি বললেন, যদি তারা আগুনে ঝাঁপ দিত তাহ’লে ক্বিয়ামত পর্যন্ত তাতেই অবস্থান করত। আনুগত্য শুধুমাত্র সৎ কাজে (বুখারী হা/৪১৬৯; মুসলিম হা/৪৭৬৫-৬৬)। উপরোক্ত হাদীছের দিকে দৃষ্টিপাত করলে আমরা বুঝতে পারি যে, নেতার বা নেতৃত্বের আনুগত্য শুধুমাত্র সৎ কাজের প্রতি। কোন অন্যায় কাজের প্রতি নয়। রাসূল (ছাঃ) অন্যত্র বলেছেন, সৃষ্টিকর্তার অবাধ্যতায় সৃষ্টির কোন আনুগত্য নেই (শারহু সুন্নাহ, মিশকাত হা/৩৬৯৬)

বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় যে রাজনৈতিক নেতৃত্ব বিরাজ করছে তা মানব মস্তিষ্ক প্রসূত বিভিন্ন মতবাদ ভিত্তিক। ফলে আমরা এই জাতিকে নেতৃত্বহীন এক অসহায় জাতি বলতে পারি। কেননা এই মতবাদগুলোর প্রতিটি বিধান, কর্ম, কথা আল্লাহর অবাধ্যতায় পরিপূর্ণ। আর নেতৃত্বহীন জাতির অবস্থা ভয়ঙ্কর ও বিপজ্জনক। নেতৃত্বহীন অবস্থা নৈরাজ্য ও অরাজকতার জন্ম দেয়। বিপদ অনিবার্য করে তোলে। লক্ষ্যহীন হয়ে উঠে নেতৃত্বহীন জনতা। ফলে ভাই ভাইয়ে রক্তের হোলি খেলায় মত্ত হয়। নিজের বা দলের অভিসন্ধি হাসিল করার জন্য গুপ্ত হত্যা, নির্বিচারে মানুষকে গুলি করে হত্যা করা হয়। তাই তো শান্তি ও জনগণের দাবী আদায়ের নামে হরতাল করে মানুষের ক্ষতি সাধন, দেশের সম্পদ উৎসাদন করতেও তাদের হৃদয় প্রকম্পিত হয় না।

নেতৃত্বের বাস্তবতা

নেতৃত্ব একটি ব্যক্তিক ও সামষ্টিক বিষয়। নেতৃত্ব ব্যক্তির সেই কাঙ্খিত গুণাবলী যা সমষ্টির অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য অন্যদের উদ্দীপ্ত ও উদ্দিষ্ট করতে পারে। যেমন C I Berrand বলেন, `Leadership refers to the quality of behavior of individuals where by they guide people a nation by their activities in an organized efforts'.

সাধারণ নেতৃত্ব থেকেই রাষ্ট্র নেতৃত্ব বিকশিত হয়ে থাকে। প্রথম মহাযুদ্ধকালীন ফরাসী প্রধানমন্ত্রী জি ক্লেমেন স্যু বলেছেন, ‘একজন রাষ্ট্রনায়ক রাষ্ট্রের জন্য জীবন উৎসর্গ করবে। আর একজন রাজনীতিবিদ বড় জোর সেবা দিয়েই সন্তুষ্ট থাকবে’। একইভাবে টমাস জেফারসন বলেছিলেন, `A politcian thinks for the next election, but statesman thinks for the next generation'. যে কোন রাষ্ট্র ব্যবস্থায় নেতৃত্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পাশ্চাত্যের যে সমস্ত রাষ্ট্রাভ্যান্তরে কাঠামোগত স্থায়িত্ব (structural stability) রয়েছে, সে সমন্ত দেশে আইনের শাসন  (Rule of law) সুপ্রতিষ্ঠিত রয়েছে। সেখানে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নেতৃত্বকে পরিচালনা করা হয়। আমাদের মতো স্বল্পোন্নত দেশে বিকারগ্রস্থ ব্যক্তিতন্ত্র এবং নিকৃষ্ট দলতন্ত্র রাষ্ট্রযন্ত্রের বাহনে পরিণত হয়েছে। ফলে বর্তমান রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যর্থতা, অযোগ্যতা, অদূরদর্শিতা, দুর্নীতি, দলপ্রীতি, গুম, হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ প্রভৃতি নির্মমতা গোটা জাতিকে একটি গৃহযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে উপনীত করেছে। কারণ আমরা যে থিওরী বা দর্শনের নেতৃত্ব গ্রহণ করেছি তা মানব মস্তিষ্ক প্রসূত। যা কখনো শান্তির কথা বলে না। তা মানুষকে কখনও মুক্তির পথ দেখায় না।

ইসলামের দৃষ্টিতে প্রকৃত নেতৃত্ব হল সেই নেতৃত্ব যা মানুষকে আল্লাহর পথে ধাবিত করে এবং ইসলামী আইন-অনুশাসন অনুযায়ী রাষ্ট্র ও সমাজ পরিচালনা করে। কেননা ইহকালীন ও পরকালীন জীবনে মুক্তির একমাত্র পথ হল অহির বিধানের অনুসরণ করা। এর বাইরে ইসলামী নেতৃত্বের কাছে কোন মানব মস্তিষ্কপ্রসূত মতবাদ কখনই গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ বাহ্যত যত সুন্দরই মনে হোক না কেন মানবরচিত সকল মতবাদের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হ’ল ‘জনগনই সার্বভৌম ক্ষমতার উৎস’ ও ‘অধিকাংশের রায়ই চূড়ান্ত’। যা পরিষ্কার শিরকী আক্বীদা। তাই এই মতবাদগুলোর প্রতি যারা মানুষদেরকে আহবান জানাবে তারা জাহান্নামের অধিবাসী হবে। কারণ এগুলো জাহেলিয়াতের প্রতি আহবানের শামিল। যদিও এরা ছালাত আদায় করে, ছিয়াম পালন করে ও ধারণা করে যে, সে একজন মুসলমান (আহমাদ, তিরমিযী, মিশকাত, হা/৩৬৯৪)। অন্যত্রে আল্লাহ তাদেরকে চতুষ্পদ জন্তুর সাথে তুলনা করেছেন, যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আদর্শ ব্যতীত স্বীয় প্রবৃত্তিকে ইলাহ গণ্য করেছে। আল্লাহ বলেন, ‘হে নবী! আপনি কি দেখেছেন ঐ ব্যক্তিকে, যে স্বীয় প্রবৃত্তিকে ইলাহ গণ্য করেছে? আপনি কি ঐ লোকটির কোন দায়িত্ব নিবেন? আপনি কি মনে করেন ওদের অধিকাংশ লোক শুনে বা বুঝে? ওরা তো চতুষ্পদ জন্তুর মত বরং তার চেয়েও অধম’ (ফুরক্বান ২৫/৪৩)

বাংলাদেশে চলমান নেতৃত্বের ভয়াবহতা

বর্তমানে বাংলাদেশ এমন একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে যখন শাসক সম্প্রদায় পরিণত হয়েছে সমাজের সবচেয়ে নিকৃষ্ট শ্রেণীতে। কথায় বলা হয়রোম যখন পুড়ছে নীরো তখন বাঁশি বাজাচ্ছে’। ঠিক তেমনিভাবে বাংলাদেশ যখন সরকারী বাহিনী তান্ডবে জ্বলছে তখন সরকার বলছে দেশে আইন-শৃংখলা সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক রয়েছে। অথচ টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া, জকিগঞ্জ থেকে শরণখোলা ৫৬ হাজার বর্গমাইল এই দেশটির যেখানে যে দিক যতদূর চোখ যায় এখন কেবল লাশ আর লাশ। সর্বত্র বুকফাঁটা মায়ের আহাজারী, অসহায় ছেলের আর্তনাদে ভারাক্রান্ত আজ দেশের আকাশ বাতাস। পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠেছে সরকার ও বিরোধী দল। গুম হচ্ছে একের পর এক রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ। বাংলাদেশ এখন আর কোন মানবিক ভূখন্ড নয়। যেন নৃশংস এক বধ্যভূমি, সরকার এবং বিরোধীদলের কসাইখানা ও লাশের পাহাড়। আইন-কানুন, রীতি-রেওয়াজ ও সভ্যতা-ভব্যতাকে উপেক্ষা করে হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছে সরকারের পেটোয়া বাহিনী। অন্য দিকে বিরোধী দল সরকারকে হটাতে বদ্ধ পরিকর। মেয়াদী তন্ত্রমন্ত্রের সরকার পরিবর্তন হওয়ার সাথে সাথে সরকার হয়ে উঠে রক্তপিপাসু। আর বিরোধীদল হয়ে উঠে নৃশংস। ফলে সাধারণ মানুষ হয় বিপন্ন। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা যদি মানুষের কল্যাণ বয়ে আনতে সক্ষম হত তাহ’লে কেন আজ মানবতা বিপর্যস্ত? সর্বত্র কেন এই মানবিক বিপর্যয়? অহির বিধানের পরিবর্তে মস্তিষ্কপ্রসূত মতবাদ আপাতত যত সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধির বুলি খয়রাত করুক না কেন, প্রকৃত শান্তি ও মুক্তির স্বাদ কখনই বয়ে আনতে পারবে না। পৃথিবীতে যত অশান্তির কালো ছায়া বিরাজ করছে তার পিছনে রয়েছে মানবরচিত মতবাদের হিংস্রতা। স্বাধীনতার পর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত যত সহিংসতা ঘটেছে সেই সব ঘটনাবলি কি এই দলবাজ তন্ত্রমন্ত্রের ব্যর্থতার রাজস্বাক্ষী নয়?

ব্যর্থ নেতৃত্বের রূঢ় বাস্তবতা

গত ২৮ ফেব্রুয়ারী থেকে ৬ মার্চ পর্যন্ত এক সপ্তাহে সারাদেশে যে রণক্ষেত্র সৃষ্টি হয়েছিল তাতে সরকারী হিসাবেই সাধারণ নাগরিক ৩৩, জামায়াত-শিবির ৪৬, বিএনপি ৬, আওয়ামীলীগ ৫, পুলিশ ৭ অর্থাৎ প্রায় শতাধিক মানুষ গণহত্যার শিকার হয়েছে। বেসরকারী হিসাবে তা প্রায় দুই শতাধিক। আহত হয়েছে হাজার হাজার সাধারণ মানুষ। এই পরিস্থিতিতে জাতি আজ স্তম্ভিত, ক্ষুব্ধ ও মর্মাহত। পাকিস্তানের ২৪ বৎসরের শাসনকালে এবং স্বাধীনতা পরবর্তী ৪২ বছরে স্বাধীনতা যুদ্ধ ছাড়া স্বৈরাচারবিরোধী সর্বদলীয় গণআন্দোলনেও এক সপ্তাহে এত মানুষ মরেনি। না পুলিশ, না জনতা। এখন যারা ভাগাভাগি হয়েছেন, তারা গত ত্রিশ বছরে নিজেদের প্রয়োজনে কখনো একত্রিত হয়েছেন, কখনো বা এপার-ওপার করেছেন। মাঝখান দিয়ে শুধু প্রাণ গেল কিছু ভক্ত, অনুসারী, চাকুরিজীবী, পুলিশ ও অহসায় সাধারণ জনতার। এই সকল তন্ত্র-মন্ত্র নাকি শান্তির কথা বলে? অথচ স্বাধীনতার পর থেকে বর্তমান পর্যন্ত এই তন্ত্র-মন্ত্র জনগণকে শান্তিপূর্ণ স্বচ্ছল নিরাপদ জীবন যাপনের নিশ্চয়তা নিশ্চিত করতে পারেনি। বরং তার পরিবর্তে উপহার দিয়েছে সমস্যা জর্জরিত সন্ত্রাসযুক্ত এক নিরাপত্তাহীন জনপদ। প্রশাসনের সর্বক্ষেত্রে দুর্নীতি দলীয়করণ সর্বগ্রাসী রূপ নিয়েছে। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে গণমামলা, গনগ্রেফতারের ছেলেখেলা। বিদ্যমান রাজনৈতিক হাঙ্গামায় সুযোগ নিচ্ছে এক শ্রেণীর অপরাধীচক্র। ব্যক্তিগত আক্রোশ, পূর্ব শক্রতা,  প্রতিশোধ, অবৈধ উপার্জন, লুণ্ঠন, স্থায়ীভাবে প্রভাববলয় বিস্তার, চাঁদাবাজি, ধর্ষণ, জবর-দখল, চুরি-ডাকাতি-রাহাজানি, সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণসহ হেন অপরাধ নেই যা এখন প্রকাশ্যে সংগঠিত হচ্ছে না। রাজনৈতিক দলের সদস্যরা অপরাধ করলেও সেটা অপরাধ নয়, হত্যা করলেও সেটা হত্যা নয়। কারণ সে রাজনৈতিক কোন দলের নেতা বা কর্মী। অপরাধী যত বড় অপরাধ করুক না কেন তার দল ক্ষমতায় আসলে তার ক্ষমা হয়ে যায়। ‘জজ মিয়া’ নাটক, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুলের নামে ৩৭ মামলার নাটক তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ।

দেশের শীর্ষস্থানীয় মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী গত মার্চ মাসে রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত হয়েছে ৭৫ জন, বিচারবহির্ভূত হত্যা হয়েছে ৫২ জন, বিএসএফের  গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছে ২ জন, গুলি ও ককটেল নিক্ষেপে আহত হয়েছে ৪ জন এবং অপহৃত হয়েছে ১৬ জন । ১৫ জনকে যৌতুকের কারণে হত্যা করা হয়েছে। ৬৬ জন নারী ও মেয়ে শিশুকে ধর্ষণ করা হয়েছে। ২৩ জন প্রাপ্ত ও ৪১ জন শিশু ধর্ষিত হয়েছে। সেখানে ২৩ জনের মধ্যে দুজনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে এবং ৯ জনকে গণধর্ষণ করা হয়েছে। ৪১ জন শিশুর মধ্যে ৪ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে এবং ১০ জনকে গণধর্ষণ করা হয়েছে। এই হ’ল দেশের বর্তমান অবস্থা। স্বাধীনতার পর থেকে এই অবস্থা চলে আসছে। ১৯৭২ সালের জানুয়ারী হ’তে ১৯৭৩ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ১৫ মাসে এদেশে ৪ হাযার ৯২৫ গুপ্তহত্যার শিকার হয়, রাজনৈতিক হত্যাকান্ড ঘটে ২০৩৫ টি, নারী অপহরণ হয় ৩৩৭ টি, ধর্ষিতা হয় ১৯০ জন মহিলা। স্বাধীনতার শুরুর এবং বর্তমানের অবস্থা যদি এই হয় তাহ’লে মাঝে ৪২ বছরে জাতি কি পেয়েছে? এইটা বলার প্রয়োজন বোধ করছি না। যখন যে সরকার আসে তখন তার নিকটে এ কাজগুলো স্বাভাবিক রুটিনে পরিণত হয়। আর স্রেফ সরকার নিজেকে টিকে রাখার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায়। রক্ত ঝরলেও তাদের কাছে তা রক্ত মনে হয় না বরং সেটা আবর্জনা মনে হয়। বর্তমান সরকারের পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী আব্দুল লতীফ ছিদ্দীকী বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে এক মতবিনিময় সভায় বলেন, ৪২ বছরের আবর্জনা পরিষ্কার করতে যাচ্ছি। এতে একটু ধুলা উড়বে, একটু ভেঙ্গে পড়বে, কিছুটা রক্তপাত তো হবেই (দৈনিক আমার দেশ,  ৬ মার্চ ২০১৩)

আইন-শৃংখলার এই দুরবস্থার সাথে যুক্ত হয়েছে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের অন্যান্য সকল ক্ষেত্রের বিপর্যয়।

অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সহিংসতা

তন্ত্র-মন্ত্রের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ মূলতঃ খুনী স্টালিনের নব্য অনুসারী। স্টালিন বলতেন, ‘হত্যা সব সমস্যার সমাধান’। বন্দীদের কাছ থেকে যারা স্বীকারোক্তি নিত তাদেরকে স্টালিন বলত, There is a man, there is a problem. No men no problem. সরকার স্টালিনের অনুসরণ করে যাকে ইচ্ছা তাকে হত্যা করছে, গুম করছে। বিরোধী দলও হত্যা, লুণ্ঠন অগ্নিসংযোগ করছে। সরকারের পতন ঘটাতে দেশকে অচল ও পঙ্গু করে দেওয়ার জন্য হরতাল আহবান করছে। অথচ একদিনের হরতালে দেশের অর্থনীতিতে দেড় হাযার কোটি টাকার ক্ষতি। বিজিএমই-এর তথ্য মতে, একদিনের হরতালে পোষাক খাতে ক্ষতির পরিমাণ ১৪০ কোট টাকা । পরিবহন মালিকদের মতে, গাড়ি চলাচল বন্ধ থাকায় ১ দিনের হরতালে কমপক্ষে ২৫০ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়। ২-৩ মাসের চলমান সহিংসতায় স্থানীয় সরকারে ক্ষতি হয়েছে ৩০ কোটি টাকা। ২৫ উপযেলায় ৩৫ সরকারী দপ্তরে ভাঙচুর ও আগুনে ১০ কোটি টাকা ক্ষতি হয়। ১০টি সরকারী গাড়ীতে আগুন ও ভাঙচুর করা হয়েছে। গাছ কেটে ও রাস্তা খনন করে ২০ কোটি টাকার বেশী ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে ১২৯টি যানবাহন এবং ৩৭টি হয়েছে ভস্মিভূত। ফলে অর্থনৈতিক মেরুদন্ড ভেঙ্গে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়েছে। ডিসিসিআই সভাপতি আব্দুছ ছবুর খান বলেন, ‘১৫ দিনের হরতালে যে পরিমাণ ক্ষতি হয় তা দিয়ে আনায়াসে একটি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা সম্ভব’। দেশের এত ক্ষতি হওয়া সত্ত্বেও সরকার তার আসনকে স্থায়ী রাখার জন্য বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের উপর যুলুম, নির্যাতন ও গ্রেফতার অব্যাহত রেখেছে। ঠিক বিরোধী দলও হিংস্র ও মারমুখী হয়ে উঠেছে। আসলে তারা কেউ দেশের উন্নতি ও মঙ্গল কামনা করে না। দেশকে তারা নিজেদের ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করছে। তাই দেশ আজ রসাতলের দিকে ক্রমান্বয়ে ধাবমান।

শিক্ষা ক্ষেত্রে সহিংসতা

শিক্ষা ক্ষেত্রে সহিংসতা আরো প্রকট আকার ধারণ করেছে। সেখানে ইসলামী সংস্কৃতির পরিবর্তে পাশ্চাত্যের অপসংস্কৃতির অনুকরণে যুক্ত করা হয়েছে যৌনতামূলক আলোচনা। ষষ্ঠ শ্রেণীর পাঠ্য বইয়ে শিশুদের দেওয়া হয়েছে যৌনতার কুৎসিত ধারণা। ৮ম শ্রেণীর পাঠ্য বইয়ে কিশোর অপরাধ প্রতিরোধের উপায় সম্পর্কে যে আলোচনা করা হয়েছে তা পড়াতে গিয়ে শিক্ষকরা বিব্রতবোধ করছেন। অন্য দিকে ৯ম শ্রেণীর ‘ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা’ বইয়ে উল্লেখিত হয়েছে ‘দেব-দেবী বা আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারও নামে উৎসর্গকৃত পশুর মাংস খাওয়া হারাম’ (নাঊযুবিল্লাহ)। অথচ আল্লাহর সাথে দেব-দেবীর তুলনা করা জঘন্যতম শিরক। পাশাপাশি উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে বস্ত্তবাদী শিক্ষা দেওয়ার কারণে একের পর এক ছাত্রহত্যা, অপহরণ, যৌন হয়রানি, ছাত্র কর্তৃক শিক্ষক লাঞ্ছিত, বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পদ নষ্ট, ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ড, আভ্যন্তরীণ কোন্দল ও ছাত্র সহিংসতা সর্বদা বিরাজ করছে। ফলে পরিমল, চন্দলা কুমার পোদ্দারের মত লম্পটরা আমাদের শিক্ষক হিসাবে আবির্ভূত হচ্ছেন! ধর্ষণের সেঞ্চুরি করা মানিক আমাদের সুযোগ্য ছাত্র! আফসোস! বড়ই আফসোস!! যারা আমাদের সঠিক পথে চলার নির্দেশ দিবে তারা যদি ধর্ষক হয় এবং রক্ষক যদি ভক্ষকের ভূমিকায় আবির্ভূত হয় তাহলে তাদের কাছ  কি আশা করা যায়? এই প্রকৃতির কুলাঙ্গার শিক্ষক এবং ছাত্রের জন্য শিক্ষার সকল পর্যায়ে আদর্শবান শিক্ষক ও ছাত্ররা বিব্রত ও লজ্জিত। ৪-৫ বছরের শিশু পর্যন্ত আজ পাশবিক নির্যাতনের হাত থেকে নিরাপদ নয়। অথচ ছাহাবীদের যুগে একজন নারী একাকী ‘হেরা’ থেকে মক্কায় গিয়েছে ও বায়তুল্লাহ তাওয়াফ শেষে পুনরায় নিঃসঙ্গ অবস্থায় নিরাপদে ফিরে এসেছে (বুখারী, মিশকাত, হা/৫৮৫৭)। অতএব বস্ত্তবাদী শিক্ষার পরিবর্তে ইসলামী শিক্ষা তথা রাসূল (ছাঃ)-এর শিক্ষা অনুসরণ করে তার নেতৃত্ব মেনে নিলেই আমরা নিরাপদে থাকতে পারব ইনশাআল্লাহ!

স্বার্থবাদী নেতৃত্বের কুৎসিত আপোষকামিতা  

মানুষ তার কার্যক্রম যতই গোপনে বা নির্জনে করুক না কেন সময়ের ব্যবধানে সত্য তার স্বকীয়তা বা নিজস্ব অবয়বে উন্মোচিত হবেই। বর্তমান রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের বৈশিষ্ট্য হ’ল স্বার্থ উদ্ধারের জন্য হেন কিছু নেই যা তারা করতে পারে না। উদাহরণস্বরূপ আজকে মতিয়া চৌধুরী, হাসানুল হক ইনু, রাশেদ খান মেনন হলেন বর্তমান সরকারে পরম বন্ধু ও অভিভাবক সদৃশ। তারা একই মঞ্চে বসে দেশ চালাচ্ছেন। আর জামায়াত হল সরকারের চরম শত্রু। অথচ একসময় জাসদের হাযার হাযার তরুণকে বঙ্গবন্ধুর রক্ষীবাহিনী হত্যা করেছিল। এক সময়ের বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের নামে গণবাহিনী সৃষ্টি করে বহু আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীকে নৃশংসভাবে হত্যা করে যার হাত রক্তাক্ত হয়ে আছে সেই হাসানুল হক্ব ইনু এখন আওয়ামীলীগের কর্ণধার। আজকের কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী ১৯৭৩ সালে বায়তুল মোকাররমের এক জনসভায় বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিবের চামড়া দিয়ে ডুগডুগি বাজাব’। যারা গোপনে বঙ্গবন্ধুর শত্রু বা বৈরী ছিল এখন তারাই আওয়ামী সরকারের সবচেয়ে বেশী প্রিয় ও কাছের মানুষ।

গত ১৫ বছর পূর্বেও জামায়াত ছিল আওয়ামী লীগের সুহৃদ বন্ধু। ১৯৮৬ সালে এরশাদের পাতানো নির্বাচনে বিএনপিকে বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ ও জামায়াত একসঙ্গে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিল। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াত যুগপৎ আন্দোলনে শরীক হয়। ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর সরকার গঠনে জামায়াত বিএনপিকে সমর্থন দিলে তাদের উপর আওয়ামী লীগ ক্ষুব্ধ হয়। ১৯৯২ সালে জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ‘ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’ গঠন করে গোলাম আযমের ফাঁসির দাবীতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সামনে গণ আদালত বসে। এ কারণে বিএনপি সরকার যখন গোলাম আযমকে গ্রেফতার করে বসে। তখন বিএনপির উপর জামায়াত ক্ষুব্ধ হয়। অতঃপর ১৯৯৬ সালে বিএনপির বিরুদ্ধে যৌথ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে জামায়াত ও আওয়ামী লীগ। শেখ হাসিনা গোলাম আযমকে তসবীহ, জায়নামায ও কুরআন শরীফ উপহার দিয়ে দো‘আ নেন। এই হল আমাদের সেক্যুলার ও ইসলামী রাজনীতির কর্ণধারদের চরিত্র!

১৯৯৬ সালে বিএনপির বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ, জামায়াত ও জাতীয় পার্টি যুগপৎভাবে আন্দোলনের নামে এক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে বিএনপির পতন ঘটায়। সময়ের বিবর্তনে সেই জামায়াত আজকে বিএনপির প্রাণের বন্ধু আর আওয়ামী লীগের শত্রু। সে শত্রুতা এমনই যে আওয়ামী লীগ জামায়াত নেতাদের একে একে ফাঁসিতে ঝোলানোর আয়োজন সম্পন্ন করে ফেলেছে। কাজেই চলমান রাজনীতি হল সঙ্গে থাকলে সঙ্গী আর বিরোধী হলে জঙ্গী। ফলে সঙ্গীকে রক্ষা করতে এবং জঙ্গী অর্থাৎ বিরোধীকে দমন করতে মাঠে নেমেছে রাজনৈতিক নেতা নামধারী গুন্ডারা। এই নেতৃত্বের চরিত্রহীনতা ও আপোষকামিতার হাতে বন্দী দিশেহারা মানুষ দিগ্বিদিকশূন্য হয়ে পড়েছে। দেশে আইনের কোন শাসন নেই। চলছে জঙ্গলের শাসন। ‘জোর যার মুল্লুক তার’। আছে শুধু নেতা ও দলের মনগড়া আইন। দেশের কল্যাণে-অকল্যাণে যেন তাদের কোনই যায় আসে না।

শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের উন্নাসিক নেতৃত্ব

বাংলাদেশে চালবাজী নেতৃত্বের ধারাবাহিকতায় নতুন মাত্রা যোগ করল শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চের নেতৃত্ব। জামায়াত নেতা আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসি না হওয়ায় এ বছর ফেব্রুয়ারীর ৫ তারিখে যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসির দাবিতে গণজাগরণ মঞ্চের কার্যক্রম শুরু হল। তারা শুরু করল আপাদমস্তক মুক্তিযুদ্ধ ব্যবসা। হঠাৎ করেই তারা মিডিয়ায় আবির্ভূত হল জাতীয় চেতনার প্রতীক হিসাবে। মাসাধিককাল ব্যাপী মিডিয়া তাদেরকে ফুলিয়ে ফাপিয়ে একেবারে বাজিমাত করে দিল। বাংলাদেশে নাকি এবার তথাকথিত আম জনগণের নেতৃত্ব শুরু হতে যাচ্ছে। বেলুন, মোমবাতির ছেলেখেলা প্রোগ্রাম নিয়ে তাদের কি আস্ফালন!! বাংলাদেশকে নাকি এবার তারা স্বাধীনতার প্রকৃত স্বাদ দেবে!! তারপর? এদের মুখোশ উন্মোচিত হয়ে গেল। কথিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবির আড়ালে তারা একশ্রেণীর নাস্তিক ধর্মদ্রোহী ব্লগার যুবকদের হাত দিয়ে যে স্বয়ং ইসলামকে এ দেশের রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থা থেকে চিরতরে উচ্ছেদের জন্য উঠেপড়ে লেগেছে-তা প্রমাণিত হয়ে যায়। শাহবাগীদের অন্যতম উদ্যোক্তা রাজীব হায়দার, আসিফ মহিউদ্দীন, আশরাফুল ইসলাম রাতুল ও নিঝুম মজুমদার শোভনসহ প্রভৃতি স্বঘোষিত নাস্তিতকরা বিভিন্ন ব্লগে আল্লাহ, রাসূল ও ইসলাম সম্পর্কে চরম অবমাননাকর লেখা ও মন্তব্য করে আসছে দীর্ঘদিন যাবৎ। সাথে সাথে নারী-পুরুষের প্রকাশ্য মেলামেশা, উদ্দাম নৃত্য, অবাধ যৌনাচার, অশ্লীলতা, মদ, গাজা ইত্যাদি অসামাজিক ও অনৈতিক কর্মকান্ড চালানো হয়েছে শাহবাগ চত্বরে। মুসলমাদের ফরজ বিধান পর্দাকে কটাক্ষ করে ‘হোটেলের পতিতার’ পোশাক বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। অন্যদিকে শাহবাগ মঞ্চ থেকে ওলামা-মাশায়েখদের জঙ্গী মৌলবাদী ও জারজ সন্তান বলে গালি দেয়া হয়েছে। দ্বীন ইসলামের বিরোধিতার প্রতীক এই শাহবাগের বিরুদ্ধে সরকার কোন ব্যবস্থা তো নেয়ই নি, বরং বিভিন্নভাবে সর্বাত্মক সহযোগিতাই করেছে। বিলম্বিত পর্যায়ে দু’একটি লোক দেখানো পদক্ষেপ কেবল গ্রহণ করেছে। যেখানে ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রীর সমালোচনাকারীদের একদিনের মধ্যে গ্রেফতার করার কৃতিত্ব রয়েছে, জনাব মহীউদ্দীন খান আলমগীর স্বাধীনতার সময় পাকিস্তানী হানাদারদের দোসর ছিল, এই ধ্রুব সত্য বলায় বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীকে কোর্টে যেতে হয়েছে, সেখানে আল্লাহ, রাসূল ও ইসলামকে অপমান করার কারণে তারা শাহবাগে জামাই আদর পায়। ধিক! এই সরকার ও তার বিবেকহীন নেতৃত্বের। গণমানুষের মনে প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে- কোন সরকার দেশ চালাচ্ছে? এ দেশের প্রধানমন্ত্রী নাকি শাহবাগ মঞ্চের নাস্তিক্যবাদীরা? কারণ একটি প্রতিষ্ঠিত সরকার থাকা অবস্থায় গণজাগরণ মঞ্চের নির্দেশে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকারী অফিস আদালত বাড়িঘরসহ সর্বত্র জাতীয় পতাকা উত্তোলিত হচ্ছে ও তিন মিনিট দাঁড়িয়ে থাকছে। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা জাগরণ মঞ্চের নির্দেশে নীরবতা পালনসহ সব কর্মসূচী পালন করছে। আজকে জামায়াতকে গালি দিতে গিয়ে কটাক্ষ করা হচ্ছে ইসলামকে। ফলে জনগণ অচিরেই এই হঠাৎ অধীশ্বর হয়ে বসা নেতৃত্বকে আস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করেছে। তাদের নিদারুণ হিংসাবাণে অতিষ্ঠ হয়ে ব্যাকুলভাবে সন্ধান করেছে ইসলামের নিঃস্বার্থ সেবায় এগিয়ে আসা কোন শক্তির। ফলে ৬ই মার্চে শাপলা চত্বরে হেফাজত ইসলামী যখন সম্মেলন আহবান করল, তখন সারাদেশের ইসলামপ্রেমী জনতা প্রবল তৃষ্ণা নিয়ে ও শাহবাগীদের ইসলামবিদ্বেষী প্রচারণার বিরুদ্ধে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ করতে ছুটে গেল ঢাকার দিকে। কোন বাঁধাই তাদেরকে আর আটকিয়ে রাখতে পারল না। এভাবেই পতন ঘটল শাহবাগের সদম্ভ হুংকারের। মিইয়ে গেল মাটির সাথে তাদের যতসব হিংস্র আস্ফালন। সত্যিই যখনই ইসলাম আপন শক্তিতে দাঁড়িয়ে যায়, তখন পৃথিবীর কোন শক্তি নেই তাকে পরাজিত করবার। তাইতো ইসলামের বিজয় নিশান দেখে সভয়ে, সশ্রদ্ধচিত্তে রোমের সম্রাট হিরাক্লিয়াস রোমের অধিবাসীকে ডেকে বলেছিলেন, يَا مَعْشَرَ الرُّومِ هَلْ لَكُمْ فِى الْفَلاَحِ وَالرُّشْدِ وَأَنْ يَثْبُتَ مُلْكُكُمْ فَتُبَايِعُوا هَذَا النَّبِىَّ  ‘হে রোমের অধিবাসী! তোমরা কি মঙ্গল ও সুপথ চাও? তোমাদের রাষ্ট্রের স্থায়িত্ব চাও? তাহলে এই নবী (মুহাম্মাদ ছাঃ)-এর বায়‘য়াত গ্রহণ কর’ (ছহীহ বুখারী হা/৭ ও ৪৫৫৩)

অনুসরণীয় নেতৃত্ব

মেয়াদী দলতন্ত্রের হুতাশনে দেশ আজ রক্তাক্ত। একে অন্যের সাথে রক্তের হোলি খেলায় মত্ত। সমাধানের পথ যেন কারো জানা নেই। হতাশাগ্রস্ত, আতংকিত সাধারণ মানুষ তাই শান্তির জন্য আজ আল্লাহর নিকট ফরিয়াদ করছে, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! এই অত্যাচারী যালেম শাসকগণের হাত থেকে আমাদের রক্ষা কর। হে আল্লাহ! তোমার পক্ষ হতে আমাদের জন্য একজন অভিভাবক ও সাহার্যকারী পাঠাও’ (নিসা ৭৫)। এমন একজন অভিভাবক ও সাহায্যকারী যিনি আমাদেরকে রাসূল (ছাঃ)-এর আদর্শে আদর্শিত করবেন। কেননা রাসূল (ছাঃ)-এর মধ্যে নিহিত রয়েছে উত্তম আদর্শ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ’ (আহযাব ২৫)। আল্লাহর এই ঘোষণার পরিপেক্ষিতে রাসূল (ছাঃ)-এর আদর্শকে ছাহাবাগণ মনে প্রাণে, বিশ্বাসে ও কর্মে বাস্তবায়ন করার ফলে বিশ্বে প্রকৃত শান্তি ও সমৃদ্ধি প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। পক্ষান্তরে এই আদর্শ গ্রহণ করার পূর্বে সেখানে পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক সর্বত্রই চলছিল শুধু অশান্তি, অপশাসন, অন্যায়-অত্যাচার, হানাহানি, মিথ্যা, প্রতারণা ও ধোঁকাবাজির জয়জয়কার। Might is Right ছিল যার মূল শ্লোগান। অবশেষে ইসলামকে খুঁজে পাবার মাধ্যমে তারা এমন একটি আদর্শের অনুসারী হতে সক্ষম হয়েছিল, যে আদর্শ প্রতিষ্ঠায় তাঁরা নিজের জীবন পর্যন্ত বিসর্জন দিতে সংকুচিত হয়নি। হযরত খুবাইব (রাঃ) যখন শূলদন্ড প্রাপ্ত হলেন। শাহাদৎ বরণ করে জান্নাতের অমীয় সুধা পানের অপেক্ষা করছেন। ঠিক তার পূর্বে দ্ব্যর্থহীনভাবে বজ্রকঠিন কণ্ঠে ঘোষণা করলেন, فَلَسْتُ أُبَالِى حِينَ أُقْتَلُ مُسْلِمًا عَلَى أَىِّ جَنْبٍ كَانَ لِلَّهِ مَصْرَعِى وَذَلِكَ فِى ذَاتِ الإِلَهِ وَإِنْ يَشَأْ يُبَارِكْ عَلَى أَوْصَالِ شِلْوٍ مُمَزَّعِ ‘যেহেতু আমি মুসলিম হিসাবে মৃত্যুরবণ করছি তাই আমার কোন শঙ্কা নেই। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে যেকোন পার্শ্বে আমি ঢলে পড়ি। আমি যেহেতু আল্লাহর পথেই মৃত্যুবরণ করছি তাই ইচ্ছা করলে, আল্লাহ আমার ছিন্নভিন্ন প্রতিটি অঙ্গে বরকত দান করতে পারেন’ (ছহীহ বুখরী হা/৩৯৮৯; মুসনাদে আহমাদ হা/৭৯১৫)

সেই তথাকথিত ‘মধ্যযুগে’ তারা এমন এক সভ্যতম সমাজব্যবস্থা, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা চালু করেছিলেন, যেখানে যাকাত গ্রহণ করার মত একজন ব্যক্তির সন্ধানও পাওয়া ছিল দুষ্কর। সুতরাং বিশ্বশান্তির পথ খুঁজতে হলে আল্লাহ প্রদত্ত সংবিধান এবং মুহাম্মাদ (ছাঃ) প্রদর্শিত কুরআন ও ছহীহ হাদীছ ভিত্তিক নেতৃত্বের কোন বিকল্প নেই। মানুষ যদি এই আর্দশ মনেপ্রাণে গ্রহণ করে তাহলে সমগ্র বিশ্ব আবারও ইসলামের দিগ্বিজয়ী আদর্শের নিকটে মাথা নত করতে বাধ্য হবে ইনশাআল্লাহ। যে আদর্শের কাছে বিশ্বের প্রতাপশালী শাসক নমরুদ, শাদ্দাদ, ফেরাউন, হামান, আবু জেহেল, আবু লাহাবের দাপট খর্ব হয়েছে। যে আদর্শের পদচম্বুন করেছে রূম ও পারস্য সাম্রাজ্যের মত পরাশক্তিরা।  

অতএব অভ্রান্ত সত্যের একমাত্র চূড়ান্ত উৎস পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ ভিত্তিক নেতৃত্বই দেখাতে পারে আমাদেরকে আশার আলো। কারণ এই অভ্রান্ত সত্যই মানব জাতিকে শান্তি ও সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যাবে। তাইতো খৃষ্টান রাষ্ট্রনায়ক নেপোলিয়ান বলেছেন, ‘আমি বিশ্বাস করি সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন পৃথিবীর সমস্ত দেশের জ্ঞানী ও শিক্ষিত মানুষকে কুরআনের নীতি ও আদর্শের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ করে একটি সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা যাবে। কারণ একমাত্র পবিত্র কুরআনের নীতিগুলোই সত্য যা মানবজাতিকে শান্তি ও সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যেতে পারে’। পরিশেষে দেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই হেরাক্লিয়াসের সেই উদাত্ত আহবান, আপনারা যদি কল্যাণ ও সত্যের পথে পরিচালিত হতে চান, যদি এদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ণণ রাখতে চান তাহ’লে মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর নেতৃত্ব মেনে নিন এবং তাঁর আদর্শ অনুসারে জীবন ও সমাজ পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিন। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন। আমীন!!

আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম

 লেখক : সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়



বিষয়সমূহ: সংগঠন
আরও