ইসলাম বিদ্বেষী ডাচ রাজনীতিবিদের অবশেষে ফেরা

ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব 331 বার পঠিত

[‘শেষ পর্যন্ত ইসলামই গ্রহণ করে ফেললেন আর্নোড ভ্যান ডুর্ন (Arnoud Van Doorn) (৪৬)। তাঁর টুইটার পেজে এখন শোভা পাচ্ছে কালেমা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’। গত ২৭ ফেব্রুয়ারী ২০১৩ তিনি হঠাৎ করেই ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দেন। নেদারল্যান্ডের ইসলামবিদ্বেষী ডানপন্থী রাজনৈতিক দল ‘পিভিভি’-এর সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান এই ডাচ পার্লামেন্টারিয়ান ২০০৮ সালে সারা বিশ্বে প্রতিবাদের ঝড় তোলা ১৭ মিনিটের প্রবল ইসলাম বিদ্বেষী তথ্যচিত্র ‘ফিৎনা’ নির্মাণকারী দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন। ইউরোপ জুড়ে ইসলামের বিস্তারে উদ্বিগ্ন হয়ে এই কুখ্যাত তথ্যচিত্রটি নির্মাণ করা হয়। এর প্রতিবাদে সারাবিশ্বে মুসলমানরা যে ক্ষুব্ধ ও আবেগী প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন, তা-ই তাকে ইসলাম নিয়ে আগ্রহী করে তোলে। অবশেষে ইসলাম ও রাসূল (ছাঃ)-এর জীবন সম্পর্কে প্রায় বছরখানিক পড়াশোনার পর তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দেন। এক বছর পূর্বেই তিনি স্বীয় পার্টি থেকে পদত্যাগ করেন এবং হেগের সিটি হলে একজন পরামর্শক হিসাবে যোগদান করেন। ইসলাম গ্রহণের পর তিনি হেগের মেয়রের নিকট স্বীয় চাকুরীস্থলে ছালাতের জন্য বিরতি চেয়ে আবেদন করেন। গত ২১ এপ্রিল তিনি মক্কায় উমরা হজ্জ পালন করেন এবং মক্কা ও মদীনার প্রখ্যাত আলেম-ওলামাগণের সাথে সাক্ষাৎ করেন। তিনি বলেন, মিডিয়ার কারণে ইউরোপীয়রা ইসলামের সঠিক চিত্রটি জানতে পারে না। যদি তারা জানত যে, ইসলাম ধর্ম কত মাধুর্যময় ও বিজ্ঞতাপূর্ণ, তাহলে তারা প্রত্যেকেই ইসলামগ্রহণ করতে বাধ্য হত। ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত তাঁর নিম্নোক্ত সাক্ষাৎকারটি ইংরেজী থেকে অনুবাদ করে দেয়া হল-নির্বাহী সম্পাদক]      

প্রশ্ন : প্রথমে আপনার ইসলাম গ্রহণের কাহিনীটি বলুন। কিভাবে আপনি ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হলেন?

আর্নোড ভ্যান ডুর্ন : আমি কৌতূহলবশত কুরআন পড়া শুরু করেছিলাম ১ বছর পূর্বে। এর আগে ইসলাম সম্পর্কে কেবল নেতিবাচক গল্পই শুনে এসেছিলাম। কিন্তু কুরআন এবং সাথে সাথে রাসূল (ছাঃ)-এর হাদীছ আমি যতই পড়তে লাগলাম, বুঝতে শুরু করলাম ইসলাম বাস্তবিকই কত সুন্দর ও বিচক্ষণতাপূর্ণ। খৃষ্টান হিসাবে পূর্ব থেকেই ধর্মীয় জ্ঞান আমার যথেষ্ট ছিল। তাই নৈতিক মূল্যবোধের দিক থেকে আমি ছিলাম খুব দৃঢ়। আমার তো মনে হয় একজন অবিশ্বাসীর চেয়ে একজন খৃষ্টান ধর্মাবলম্বীর জন্য ইসলাম গ্রহণ করা অধিকতর সহজ। কেননা নবী, ফেরেশতা এবং ধর্মীয় রীতিনীতি ইত্যাদি সম্পর্কে তাদের একটা প্রাকধারণা থাকে।

প্রশ্ন : ইতিপূর্বে আপনি একটি সুপরিচিত ইসলাম বিদ্বেষী দলের সদস্য ছিলেন। এমনকি আপনার দলের নির্দেশনায় রাসূল (ছাঃ)-কে অবমাননা করে একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করা হয়েছিল। তবে যেটা মনে হয়েছে যে, ইসলাম সম্পর্কে তাদের সঠিক কোন জ্ঞান নেই। এতদসত্ত্বেও কি কারণে তারা ইসলামের বিরুদ্ধে এমন একটি পদক্ষেপ নিল?

আর্নোড ভ্যান ডুর্ন : আমি আসলে কখনই কট্টর ডানপন্থী ছিলাম না। এমনিতে অন্যান্য অনেক মানুষের মত মুসলমানদের সম্পর্কে পক্ষপাতদুষ্ট বাজে ধারণা ছিল। যেমন- তারা হল ধর্মান্ধ, নারী নির্যাতনকারী, অসহিষ্ণু, পশ্চিমাবিদ্বেষী, উগ্র ইত্যাদি। আমার পার্টির সদস্যরা মানুষ হিসাবে খুব বন্ধুবাৎসল ও সৌহার্দ্যপূর্ণ ছিল। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, অর্থনীতি এবং চলমান অর্থনৈতিক সংকট নিয়ে আমার পার্টির সমালোচনাগুলো আমার কাছে খুব যুক্তিগ্রাহ্য ছিল। কিন্তু ইসলাম ও আরব বিশ্ব সম্পর্কে যে নেতিবাচক মনোভাব আমার দল পোষণ করত, তা সত্যিই অবর্ণনীয়। কোন বাছ-বিচার ছাড়াই নির্বিশেষে সকল মুসলমানকে তারা কলংকিতভাবে চিত্রিত করত। আর এভাবে ভীতির সঞ্চার করে এবং মেরুকরণ করে মানুষকে বিশেষ কোন উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা খুব সহজ। কারণ এর মাধ্যমে মানুষের মধ্যে জাত্যাভিমান, একদেশদর্শিতা ও পক্ষপাতিত্ব জাগ্রত হয়।

প্রশ্ন :  ইসলাম গ্রহণের পর আপনার প্রতি আপনার প্রাক্তন দলীয় সহকর্মীদের প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল?          

আর্নোড ভ্যান ডুর্ন : আসলে গত বছর পার্টি ছাড়ার পর থেকে তাদের সাথে আর যোগাযোগ রাখিনি। তাই তাদের প্রতিক্রিয়াও জানতে পারিনি। আর মূলতঃ যারা ‘পিভিভি’’ থেকে পদত্যাগ করে তাদেরকে এক প্রকার ‘অস্তিত্বহীন’ হিসাবে গণ্য করা হয়। এজন্য আমার প্রাক্তন সহকর্মীরা আমার সাথে যোগাযোগ রাখতে ভয়ও পান। এতে পার্টিতে তাদের অবস্থান হুমকির মুখে পড়তে পারে।

প্রশ্ন : আপনি কি এখন অনুতাপ বোধ করেন এমন একটি দলের সদস্য হয়েছিলেন বলে?

আর্নোড ভ্যান ডুর্ন : না, কারণ আমি এটাই শিখেছি যে, জীবনের প্রতিটি অভিজ্ঞতা অর্জনের পিছনে একটা উদ্দেশ্য থাকে। যাইহোক, এর মাধ্যমে যে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে, তার বদৌলতেই তো আজ আমি সন্দেহহীন চিত্তে এমন একটি ভিন্নধর্মী সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছি।   

প্রশ্ন :  সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া?          

আর্নোড ভ্যান ডুর্ন : কোন কোন মানুষের চোখে আমি একজন বিশ্বাসঘাতক। তবে অধিকাংশই মনে করে যে আমি খুব ভাল সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সর্বোপরি সাধারণভাবে মানুষের প্রতিক্রিয়া ইতিবাচকই ছিল। আর আমার টুইটার পেজেও মানুষের কাছ থেকে খুব সমর্থন পেয়েছি। এটা খুব ভাল লাগছিল যে, যে সব মানুষ আমাকে ব্যক্তিগতভাবে চেনেন না, তারাও আমার অবস্থানটি বুঝতে পেরেছেন এবং আমার সিদ্ধান্তে সমর্থন জুগিয়েছেন।

প্রশ্ন :  যদি কোন অমুসলিমের কাছে আপনাকে ইসলামের দাওয়াত দিতে বলা হয়, তবে কোন বিষয়টিকে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হিসাবে তাদের কাছে উপস্থাপন করবেন?          

আর্নোড ভ্যান ডুর্ন : আমি আগেই বলেছি, ইসলাম সম্পর্কে পড়াশুনা করুন। নিজেকে পক্ষপাতিত্ব মুক্ত করুন। তাহলে আপনি নিশ্চিতভাবে দেখতে পাবেন যে, ইসলাম সত্যিই মহান ইতিহাসসমৃদ্ধ এবং উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন সুন্দর ও বিশুদ্ধতম একটি ধর্ম। আমরা এখানে পরস্পরের সুবিধা-অসুবিধা ভাগাভাগি করি। এই ধর্ম আপনাকে আত্মিক প্রশান্তি আর প্রজ্ঞা দিয়ে সমুন্নত করবে, বিকশিত করবে। আপনার আধ্যাত্মিক জীবনকে আরো সুগভীর করবে। পশ্চিমাদের চোখে সাফল্যের সাধারণ যে উপকরণ তথা অর্থ ও বস্ত্তবাদ; তার চেয়ে জীবনের প্রকৃত মর্মার্থ আরো অনেক গভীর। মুসলিম হওয়ার মাধ্যমে তাই আপনি আরো বলিষ্ঠ ও উত্তম মানুষে পরিণত হবেন।

প্রশ্ন :  পশ্চিমা দেশগুলোতে ইসলামকে জঙ্গীবাদ, মানবাধিবার লংঘন ও নারীর প্রতি অসদাচরণ সংক্রান্ত সমস্যা বিস্তারের জন্য অভিযুক্ত করা হয়। এ সব অভিযোগের ব্যাপারে আপনার প্রতিক্রিয়া কি?            

আর্নোড ভ্যান ডুর্ন : আমি আবারও বলছি এসব পক্ষপাতদুষ্ট ধারণার সৃষ্টি হয় অজ্ঞতার কারণে। পৃথিবীর যে কোন ধর্মেই উগ্র ও চরমপন্থী রয়েছে। এদের সংখ্যা মাত্র ১%। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই ১% চরমপন্থীর কথা টিভি ও অন্যান্য গণমাধ্যমে খুব ফলাও করে প্রচারিত হয় এবং অনেক বড় করে দেখানো হয়। বাকি ৯৯% মুসলিম যারা কঠোর পরিশ্রমী ও শান্তিকামী তারা রয়ে যায় আড়ালে। মূলতঃ সত্যিকার ইসলাম সম্পর্কে একজন যতই পড়াশোনা করবে, ততই সে তার মধ্যে সৌন্দর্যের অাঁধার খুঁজে পাবে।

প্রশ্ন :  বর্তমানে নাস্তিকতার প্রসারে যত সব প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে তার পিছনে কারণ কি? আর যারা বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে ভুগছে তাদের প্রতি আপনার উপদেশ কি? 

আর্নোড ভ্যান ডুর্ন :  আমার কেবলই মনে হয় প্রভাবশালী পশ্চিমারা এবং অধিকাংশ রাজনীতিবিদরা ধর্মের কোন প্রভাবকে পছন্দ করতে পারেন না। আর বিশ্বাস বা ধর্মের উপর টিকে আছে এমন মানুষের সংখ্যা প্রকৃতপক্ষে খুব কমই। বেশীরভাগই অর্থোপার্জন, ভোগবাদিতা আর জাগতিক উন্নতিকে একমাত্র ধ্যানজ্ঞান করে চলেছে। পশ্চিমা শিল্পপতিরা মূলতঃ চায় জনগণ আত্মিক শক্তি অর্জনের পথ থেকে সরে এসে ভোগমুখী হোক। তাদের মতে, ‘সম্পদ ব্যয় এবং ভোগ’ই সকল সুখের মানদন্ড। কিন্তু বিশ্বাসী ও ধর্মপরায়ণরা আত্মিকভাবে শক্তিশালী হয় এবং বস্ত্তবাদী বিষয়াদির উপর কম নির্ভর করে। তাই রাজনীতিবিদ এবং অন্যান্য প্রভাবশালী মহল কখনই চায় না যে মানুষ তাদের উপর নির্ভরশীল না হয়ে অধিকতর আত্মনির্ভর হোক এবং নিজেদের অন্তর্জগতকে বলিষ্ঠ করে তুলুক। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের ঘেরাটোপে আটকে থাকা সংশয়বাদীদের উদ্দেশ্যেও আমি এই কথাটিই বলব।

প্রশ্ন : যে সব লোক আপনার ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারে এখনও সন্দিহান তাদের ব্যাপারে কি বলবেন?

আর্নোড ভ্যান ডুর্ন :  আমি বুঝতে পারছি অনেকেই এ ব্যাপারে সন্দিহান। কেননা অনেকের কাছে এটা অপ্রত্যাশিত। তবে যারা আমার কাছাকাছি থাকেন তারা জানেন আমি গত এক বছর থেকেই কুরআন, হাদীছ এবং অন্যান্য ইসলামী বইসমূহ নিয়ে গবেষণা করছি। একই সাথে আমি মুসলমানদের সঙ্গে অনেকবারই ধর্ম নিয়ে আলোচনায় বসেছি। সুতরাং এটা অনেক বড় একটা সিদ্ধান্ত। আমি মোটেও এটা হালকাভাবে গ্রহণ করিনি।            

প্রশ্ন : আপনি কি আর কিছু বলতে চান?

আর্নোড ভ্যান ডুর্ন : অনেকের মত আমিও জীবনে অনেক ভুল করেছি। এ সব ভুল থেকে আমি অনেক কিছু শিখেছি। তবে ইসলাম গ্রহণ করার পর আমার অনুভূতি হল আমি অবশেষে আমার পথ খুঁজে পেয়েছি। আমি উপলব্ধি করছি যে, এটা আমার জীবনে এক নব দিগন্তের সূচনা এবং আমার আরো বহু কিছু শেখার আছে। আমি জানি আমাকে আরো অনেক বাঁধার সম্মুখীন হতে হবে, বিশেষতঃ কিছু সরকারী প্রতিষ্ঠান থেকে। কিন্তু আমি দৃঢ় বিশ্বাসী আল্লাহ সেই মুহূর্তগুলোতে আমাকে সাহায্য করবেন এবং সঠিক পথ দেখাবেন।



বিষয়সমূহ: বিবিধ
আরও