নতুন অভিযাত্রার প্রারম্ভে
আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রাযযাক
ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব 1120 বার পঠিত
জাদিপাই ক্লাসিক
২৫ সেপ্টেম্বর’১২ মঙ্গলবার। ঘুম থেকে উঠে দেখি সমস্ত শরীর ব্যথায় টনটন করছে। জোঁকে কামড়ানো স্থানটি থেকে সমানে রক্ত ঝরছে তখনও। ক্ষতের উপর নতুন টিস্যু পেপার বেঁধে দিলাম। মনে ভয় ঢুকে গেলেও কাউকে কিছু বললাম না। নইলে জাদিপাই ঝর্ণা দেখার পরিকল্পনা মাঠে মারা যেতে পারে। ফজরের ছালাত শেষে আবার কেওকারাডং শিখরে উঠলাম সূর্যোদয় দেখতে। শান্ত স্নিগ্ধ ভোর। রাতের আঁধার ফুঁড়ে ভোরের আলো কেবল ফুটতে শুরু করেছে। খন্ড খন্ড মেঘে ঢাকা আকাশ। সূর্য উঠার আগ মুহূর্তে পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে আশ্রয় নেয়া ভাসমান মেঘমালা যেন আক্ষরিক অর্থেই দুগ্ধ ফেনিল সাগর হয়ে দেখা দিল। মনে হচ্ছে এন্টার্কটিকার কোন এক দ্বীপে দাঁড়িয়ে আছি। কেবল পেঙ্গুইনের অপেক্ষা। এরই মাঝে রক্তিম আবেশে সূর্যিমামার শুভাগমন। কাচা রোদের মিষ্টি আলোয় পাহাড়ী ভুবনটা ভরে উঠল আর মেঘদলের শুভ্র বসনে প্রতিফলিত হতে লাগল বর্ণিল আলোকচ্ছটার এক অপূর্ব নাচন। কি যে এক মন্ত্রমুগ্ধকর ভোর! নীচ থেকে গাইডের ডাকে সম্বিত ফিরল। সকাল সকালই বের হতে হবে জাদিপাই ঝর্ণার উদ্দেশ্যে।
সাথে আনা বিস্কুট, পানি খেয়ে নাস্তা সারলাম। সাড়ে ৬টার দিকে যাত্রা শুরু হল। উত্তরমুখী রাস্তা দিয়ে যেতে হবে। ২ ঘণ্টার পথ। গাইড বলল, ‘সামনের পথ কিন্তু শুধুই নামার, সাবধানে আসেন’। আরে আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্নকে জয় করে শেষ করলাম এখন নীচে নামার সহজতম কাজে সাবধান হতে হবে? কি যে বলে লোকটা-মনে মনে হাসলাম। পথের দু’ধারে কুয়াশার মত মেঘে ঘেরা সারি সারি পাহাড়। ক্যাসকেডের মত ধাপে ধাপে নেমে গেছে কোন কোন স্থানে। এরই মাঝে খানিকক্ষণ হাটার পর শুরু হল বিরতিহীনভাবে নেমে যাওয়া ঢালু রাস্তা। বেশ রিলাক্সেই হাটছি। মাঝে মাঝে নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দিয়ে নামছি দৌড়ের গতিতে। আধাঘণ্টার মধ্যে পৌঁছলাম পাসিংপাড়া বা সাইকতপাড়া। আগেই জেনেছিলাম দেশের সর্বোচ্চ গ্রাম এই পাসিংপাড়া। সেখানে লোকালয় ছুঁয়ে ফিরফিরে মেঘ উড়ে বেড়াচ্ছে নির্বিঘ্নে। দারুণ দৃশ্যপট। আড়ামোড়া ভাঙ্গা পাহাড়ী সকালে সদ্য তেতে ওঠা কাঁচা রোদের দুরন্ত খেলা বেশ জমে উঠেছে। কিন্তু গ্রামবাসীদের সকাল হয়নি তখনও। কেবল দু’একটি ঘরের জানালা দিয়ে ব্যোম শিশুদের উকিঝুঁকি নজরে পড়ছে। গ্রামের পথে শূকরের মলের ছড়াছড়ি বেশ বিরক্তিকর ঠেকল।
পাসিংপাড়া ছেড়ে আর কিছু দূর গেলেই কোরিয়ান অর্থায়নে পরিচালিত কানান রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুলটির অবস্থান। পাহাড়ের উপর খেলার মাঠ আর তার এক প্রান্তে ‘এল’ শেপের এই স্কুলটি। ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত ক্লাস হয়। স্কুল থেকে কিছুটা নীচের এক পাহাড়ে ছাত্র-ছাত্রীদের আবাসন ব্যবস্থা। প্রায় ৬০-৭০ জন ছাত্র-ছাত্রী এখানে লেখাপড়া করে। সকলেই পাহাড়ী উপজাতি এবং অধিকাংশই আবাসিক। বাংলা মাধ্যমেই পড়ানো হয়। পড়াশোনার মানও যথেষ্ট উন্নত। ইউনিফর্ম দেখেই বোঝা যাচ্ছে এদের পিছনে ভাল রকম অর্থ ব্যয় করা হয়। চারিদিকে পাহাড় পরিবেষ্টিত স্নিগ্ধ প্রকৃতির কোলে শুনশান স্কুলটি দেখে মনে হল দার্জিলিং-এর সেই বিখ্যাত স্কুলটির কথা। যেখানে বহু অর্থ খরচ করে এ দেশের অর্থশালীরা তাদের সন্তানদের পড়াশোনা করাচ্ছেন। বাংলাদেশ সরকারও ইচ্ছা করলে এই মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশকে ব্যবহার করে অনুরূপ উন্নতমানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে পারত। ওখানকার শিক্ষকদের সাথে কথা হল। অধিকাংশেরই বয়স ২৫-এর নীচে এবং বাঙ্গালী। জেনে অবাক হলাম এই কোরিয়ান স্কুলের প্রধান শাখাটি দিনাজপুরে অবস্থিত। ছাত্র-ছাত্রীরা এখান থেকে পাশ করে সুদূর দিনাজপুরে যায় বাকী পড়াশোনা সম্পন্ন করার জন্য।
স্কুলটি পরিদর্শনের পর আবার ঢালু পথ বেয়ে নামতে শুরু করলাম। দুর্গম পাহাড়ী অঞ্চলগুলো প্রায় জনমানবশূন্য মনে হলেও চলতি পথে বহু পাহাড়ে চাষাবাদ হতে দেখছি। বিশেষ করে শৈল্পিক আর্টে বোনা আদা, হলুদ ও আনারসের গাছ পাহাড়ের ঢালগুলো চমৎকারভাবে শোভামন্ডিত করে রেখেছে। কেওকারাডং-এর চূড়াতেই তো দেখে আসলাম শীষে ভরা ধানের চারা। আজ এই দুর্গম এলাকাতেও দেখছি দূরের পাহাড়ের শীর্ষভাগে আদা ও হলুদ চারার সমাবেশ।
এদিকে নামার পথ যে আর ফুরোয় না। খাড়াভাবে নামছি তো নামছিই। এক পর্যায়ে এত ক্লান্ত হয়ে পড়লাম যে মাহফুয বিশ্লেষণ করতে বসল পর্বতারোহণ নাকি অবরোহন-কোনটা বেশী কঠিন? ঘণ্টা পার হয়ে গেল তবুও যখন নামার পথ শেষ হল না মাহফূযের তখন রীতিমত কেঁদে ফেলার দশা। আর্তনাদের সুরে বলে উঠল, ‘এখন তো নামছি কোন রকমে, ফেরার পথে উঠব কীভাবে?’ লাঠিতে ভর দিয়ে পা টিপে টিপে হাটছি। তীব্র ব্যথায় পা জমে আসছে। হাটার চেয়ে তাই এখন মনে হচ্ছে দৌড়ানোই সহজ। একবার দৌড়ে, একবার হেটে এই কষ্টকর যাত্রার প্রায় শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেলাম। সামনেই দেখা যাচ্ছে পাহাড়ী ঢালের সবুজ পটভূমিতে ছবির মত সাজানো গ্রাম জাদিপাই পাড়া। সেখানে নেমে আসার পর কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে আবার যাত্রা। গোটা রাস্তায় পর্যটক বলতে কেবল আমরাই। আর কেউ নেই। ঝিঁঝিঁ ছাড়াও নাম না জানা কোন এক পোকার বাঁশীর মত তীক্ষ্ণ চিৎকারে কান ঝালাপালা হয়ে আসছে। চলতি পাথে মাঝে মাঝে দেখা মিলছে দু’এক জন পাহাড়ী জুম চাষীর। সবার সাথেই শুভেচ্ছা বিনিময় করছি। কিছুক্ষণের মধ্যেই পাহাড়ী পথ ছেড়ে নেমে আসলাম এক সমতলভূমিতে। চারিদিকে শিহরণ জাগানো জমাট মৌনতায় ঢাকা সুউচ্চ পাহাড়। আর মাঝখানে ধানের ক্ষেত আর নিঃশব্দে বয়ে যাওয়া ঝর্ণার পানির ঝিরি। ক্ষেতের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলছি। আগের দিন বৃষ্টি হয়েছে বলে জোঁকের উৎপাত খুব। গতকাল আমাকে জোঁকে ধরায় এমনিতেই সবাই জোকাতঙ্কে ভুগছে, তার উপর সমতলে নামতেই আমি একসাথে ৩টি জোঁকের কামড় খেলাম। চারিদিকের অসাধারণ নৈসর্গিক শোভা উপভোগ বাদ দিয়ে সবার দৃষ্টি এবার কেবল জোঁকের দিকে। কর্দমাক্ত পথে হাটতে ২ মিনিট পর পর জোঁক ছাড়ানোর জন্য দাঁড়িয়ে যেত হচ্ছে। মনে হল জোঁকের কারখানায় এসে পড়েছি। এমনই জড়সড় অবস্থা আমাদের যে বাঘ-ভাল্লুকের ভয়েও বুঝি কেউ এত অস্থির হয় না। আরো কিছুক্ষণ চলার পর এক পাহাড়ের উপর উঠে আসলাম।
নিঃসঙ্গ ঝর্ণার সশব্দ আবির্ভাব
সমতলে নামার পর অনেকক্ষণ ধরেই ঝরণার শো শো পতন শব্দ কানে ভেসে আসছিল। এবার পাহাড়ে উঠে সে শব্দ ঝংকার অনেক জোরে শুনতে পাচ্ছি। গাইড বলল, ঝরণা পর্যন্ত পৌছতে পাহাড় থেকে এই বিপজ্জনক পথটি নেমে অতিক্রম করতে হবে। প্রায় খাড়াভাবে ৪৫ ডিগ্রি এঙ্গেলে পিচ্ছিল কর্দমাক্ত জঙ্গলময় ঢালু পথ। সঙ্গে জোঁকের আতঙ্ক। গাইডকে সামনে রেখে ধীরে ধীরে অধঃমুখী যাত্রা শুরু হল। খুব সাবধানে পা ফেলতে হচ্ছে। পিছন থেকে কেউ স্লিপ করে পড়লেই সবাই মিলে একসাথে জীবন হারাতে হবে। নীচে কিছুই দেখা যাচ্ছে না ঘন জঙ্গলের কারণে। কেবল ঝর্ণার শো শো প্রবল শব্দ। জোঁকের ভয়ে সযত্নে গাছের ডালপালা এড়িয়ে চলছি। তবুও রেহাই পেলাম না। আমার ঘাড়ে আর কনুইয়ের উপর বড় দুই জোঁক উঠে রক্ত খাওয়া শুরু করেছে। নিজেকে পতনের হাত থেকে বাঁচাব, না জোঁক ছাড়াব। মাহফুয এসে গামছা দিয়ে জোঁকগুলো ছাড়িয়ে দিল। আরো কিছুদূর নামার পর এক বিপজ্জনক বাঁকের উপর আছাড় খেয়ে পড়ে গেল মাহফুয। ভাগ্যক্রমে এক গাছের ডালে পা আটকাতে পেরে এ যাত্রায় বেঁচে গেল বটে, কিন্তু বেশ ভাল রকম আঘাত পেল। আরো অনেকদূর নামার পর হঠাৎ গাছপালার ফাঁক দিয়ে আবির্ভূত হল সেই কাংখিত জাদিপাই ঝর্ণা। পাশের পাহাড় ভেদ করে যেন আকাশ ফুঁড়ে ধেয়ে আসছে এক প্রবল স্রো্তধারা। উপরাংশে একধাপ নেমে ঝরণাটি প্রায় ৫০ ফুট প্রশস্ত হয়ে পাহাড়ের গা বেয়ে অন্ততঃ ৬০/৭০ ফুট নিচে সবেগে আছড়ে পড়ছে। আরো কিছুটা নেমে আসার পর ঝর্ণার পূর্ণ ভিউটা নজরে এল। সুবহানাল্লাহ! কি যে এক বিস্তীর্ণ ভুবনজয়ী হাসি দিয়ে আমাদের স্বাগত জানাল আল্লাহর এই অসাধারণ সৃষ্টি! আমাদের তো আত্মহারা অবস্থা। চারিপাশ নজরে আসার পর মনে হল বহু বছর পূর্বে এখানে কোন এক দানবীয় ভূমিধ্বস হয়েছিল এবং তাতে পাহাড়ের একটা বিরাট অংশ বিধ্বস্ত হয়ে এই ঝর্ণার সৃষ্টি। ধ্বসে যাওয়া মাটির ঢিবি বিস্রস্তভাবে নিচে বহু দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বিশাল বিশাল পাথরে রূপ নিয়েছে। যার ফাঁক গলিয়ে স্বর্পিল গতিতে অব্যাহত স্রোতধারা হারিয়ে যাচ্ছে অজানার পানে। পাহাড়ের গায়ে ভূমিধ্বসের গভীর চিহ্নগুলো বেশ ভয়ংকর দেখাচ্ছে। যেন ডকুমেণ্টারীতে দেখা সহস্র বছরের অনাবিষ্কৃত কোন প্রাগৈতিহাসিক এলাকা। পাহাড়ের উপরে দাঁড়িয়েই বিভিন্ন এ্যাঙ্গেল থেকে ঝর্ণাটি ক্যামেরাবন্দী করে ফেললাম। দুর্গম হওয়ার কারণে এর নাগাল পেয়েছে দেশের খুব অল্পসংখ্যক মানুষই। ফলে ঝর্ণার আদিম অকৃত্রিমতা অক্ষুণ্ণ রয়ে গেছে। আজও এখানে আমরা ছাড়া আর দ্বিতীয়টি কেউ নেই। এডভেঞ্চার মুডে কাঁপা কাঁপা হৃদয়ে নীচে নেমে এলাম। এক দৃষ্টে দেখছি ঝর্ণার অবিরাম পতন দৃশ্য। বর্ষা মৌসুম শেষ হলেও ঝর্ণাটি এখনও পূর্ণ যৌবনা। আহা, জীবনটা যেন আজ স্বার্থক হয়ে গেল। এক নিমিষেই বুকটা বিশাল চওড়া করে দিল প্রকৃতির এই অকৃত্রিম বুনো উদ্যমতা। প্রতিধ্বনিত শব্দের প্রচন্ডতায় কেউ কারো কথা শুনতে পাচ্ছি না। বাতাসে ঝর্ণার ঝাপটা এসে চোখে-মুখে লাগছে! সে ঝাপটা রোধ করে ঝর্ণার দিকে সরাসরি স্থির চোখে তাকানো দুরূহ। সূর্যের আলো ঝর্ণার গায়ে পড়া মাত্রই নানা মাত্রায় বর্ণিল রংধনু হেসে উঠছে। মেঘমুক্ত দিনে এখানে সারাদিনই রংধনুর খেলা দেখা যায়। ঝর্ণার পতনস্থলে তৈরী হয়েছে এক পুকুর। সাতার জানি না। তাই পার্শ্বের বড় বড় কয়েকটি পাথর ডিঙিয়ে ঝর্ণার একেবারে নিকটে চলে এলাম। গাইড ভয় দেখিয়ে বলল, ‘ঝর্ণার নীচে যাবেন না, উপর থেকে নুড়িপাথর পড়তে পারে’। কে শোনে কার কথা। আক্ষরিক অর্থেই পর্বতসম বাধা জয় করে যখন এতপথ আসতে পেরেছি, শেষ বেলায় এতটুকু বাধা কেন অজেয় হয়ে উঠবে? নাই বা জানি সাতার, তাই বলে কি এই অপরূপ সৌন্দর্যকে নিজের মত করে উপভোগ করার স্বাদ অপূর্ণ রাখব? ঝর্ণার গা ঘেঁসে এক পা দু’পা করে নিজেকে সপে দিলাম অনেক উপর থেকে ধেয়ে আসা প্রবল জলধারার নীচে। পিঠের উপর যেন হাতুড়ির বাড়ি পড়ছে। তবুও কুছ পরোয়া নেহি। ভয়কে জয় করে বীর বেশে আরো সামনে এগুচ্ছি। বাকিরাও সাহস পেয়ে গেল। একে একে সবাই চলে এল ঝর্ণার নিচে। রঙধনু মেখে ঝুকিপূর্ণ পাথরের গা বেয়ে আমরা ঝর্ণাধারার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত চলে এলাম। মাথার উপর অবিরাম ঝাঁপিয়ে পড়া জলধারায় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসছে, তবুও তাতে সিক্ত হচ্ছি বাধ না মানা অবোধ শিশুর মত। ঘণ্টাখানিক অনিন্দ্য সুন্দর এই ঝর্ণার কলকাকলীর সাথে কাটল এক অসাধারণ মুহূর্ত। শেষের বেলায় ঝর্ণার স্রো্তধারা যেদিক দিয়ে নিচে নেমে গেছে সেদিকে এগিয়ে কিছু দূর যাওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু সাহসে কুলালো না। এই নির্জনালোকের সর্বত্রই এক অদ্ভুত গা ছমছমে আবহ। একান্ত সাহসীও এখানে বীরত্ব দেখাতে দু’বার ভাববে।
দুর্বিষহ যন্ত্রণায় ওষ্ঠাগত জীবন
বেলা সাড়ে ৯টার দিকে জাদিপাই ঝর্ণাকে গহীন বনে একলা নিঃসঙ্গ রেখে আমাদের ফিরতি যাত্রা শুরু হল। আসার সময় সারা পথ নামতে নামতে মনটা বিষিয়ে ছিল। এবার উঠতি যাত্রায় তাই বেশ স্বস্তি বোধ করছি। তেমন বিপদ ছাড়াই উঠে এলাম পাহাড়ের মাথায়। সেখান থেকে নীচে নেমে আসতেই আবার সেই জোঁকের রাজ্যে। সমতল ভূমি না আসা পর্যন্ত জোঁকের ভয়ে একটানা দৌড়ে এই পথটুক অতিক্রম করলাম। কিছুক্ষণ পরই শুরু হল পাহাড়ে উঠার পালা। আসার সময় যে পথ বেয়ে বরাবর নেমে এসেছিলাম এবার সে পথে বরাবর উঠার পালা। গোটা সফরে এই অংশটিই ছিল আমাদের সবচেয়ে কষ্টকর পর্ব। সকালের সামান্য নাস্তাটুকু বহু আগেই হজম হয়ে গেছে। অতিরিক্ত কোন খাবার সাথে নিয়ে আসিনি। এ অবস্থায় উঠছি তো উঠছিই। শক্তি ক্রমেই নিঃশেষ হয়ে আসছে। আধাঘণ্টা হাঁটতেই সবার অবস্থা একেবারে কাহিল। কারো দিকে আর তাকানো যাচ্ছে না। বাংলা পাঁচের মত হয়ে উঠা করুণ চেহারাগুলোতে যেন গুমরে ফিরছে ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ হাহাকার রব। সেই সাথে সারা রাস্তায় শূকরের মলের উৎকট দূর্গন্ধে প্রাণটা ওষ্ঠাগত হওয়ার জোগাড়। কোনক্রমে জাদিপাই পাড়া পর্যন্ত পৌঁছতেই এক বাড়ীর উঠোনে মাটির বিছানায় শুয়ে পড়লাম। মনে হল সামনে আর না এগিয়ে আজকের দিনটা এখানেই থেকে যাই। এদিকে গতকালের ক্ষত থেকে রক্ত তখনও অনবরত ঝরছে। বন্ধ হওয়ার কোন লক্ষণ নেই। ব্যান্ডেজ আর পাজামা লালে লাল। গাইডের একটাই কথা, ধৈর্য ধরেন, জোঁকের কামড়ে এমনই হয়, এক সময় এমনিতেই বন্ধ হয়ে যাবে। যে বাড়ীর উঠোনে বসে চা পান করছিলাম, তাদেরকে বললাম আপনারা কি করেন জোঁকে কামড়ালে? ওরা প্রথমে তামাক পাতার পানি দিয়ে ধুতে বলল। তাই করলাম। কোন কাজ হল না। পরে ভিতর থেকে ছাই নিয়ে এসে এক মহিলা ক্ষতস্থানে লাগিয়ে দিল। আল্লাহর কি রহমত, ২ মিনিটেই রক্ত বন্ধ হয়ে গেল। সবকিছুকে হারিয়ে দিয়ে শেষ পর্যন্ত এই তুচ্ছ ছাই যে মহৌষধ হয়ে উঠবে তা কে জানত! মনে মনে আল্লাহর অশেষ শুকরিয়া আদায় করে ওদেরকে ধন্যবাদ জানালাম। এই উপকারটা না করলে আগামীকাল রুমা বাজার পৌছে ডাক্তার না দেখানো পর্যন্ত হয়তবা রক্ত ঝরতেই থাকত। জোঁকের জন্য সবাই উপদেশ দেয় লবণ রাখার জন্য। এই অভিজ্ঞতার পর আমার তো মনে হল লবণের চেয়ে ছাই রাখাই অধিক যরূরী। কৃতজ্ঞতাস্বরূপ বাড়ির বাচ্চাদের হাতে চকলেট ধরিয়ে দিলাম। ওরা এতই খুশী হল যে, মনে হল পরবর্তীতে আর কখনো এদিকে এলে চকলেটের আলাদা ব্যাগ নিয়ে আসতে হবে। দুর্গম পাহাড়ে এসব ছোট্ট উপহারও এদের কাছে মহার্ঘ্যই। ব্যোম পরিবারটিকে বিদায় জানিয়ে আমরা আবার যাত্রা শুরু করলাম।
উফ্..কি বিভীষিকাময় এ যাত্রা। হাটার কোনই বিকল্প নেই। ক্লান্তিতে রাস্তার উপরই কয়েকবার শুয়ে পড়তে বাধ্য হলাম আমরা। মাহফুয বলল, ‘জীবনের কোন কোন সময় মৃত্যুকেই অধিক শ্রেয় মনে হয়, আজ আমার সেই অবস্থা’। পা লোহার মত ওজনদার হয়ে উঠেছে। চোখে দেখছি সর্ষে ফুল। এ অবস্থাতেই কোন রকমে হাচড়ে পাচড়ে যখন কোরিয়ান স্কুলে পৌঁছলাম তখন বেলা সাড়ে এগারোটা পার হয়ে গেছে। দোকানের সামনে বেঞ্চের উপর সটান শুয়ে পড়লাম অচেতনের মত। ‘এই তো আর সামান্য পথ’-গাইডের অভয়বাণী বড়ই পরিহাস্য শোনালো। ইস্, বাকি পথটা যদি কেউ স্ট্রেচারে নিয়ে যেত! বিরতির পর টলতে টলতে আবার যাত্রা শুরু। পাসিংপাড়ায় সামান্য বিরতি। আবার যাত্রা। ঠিক দুপুর সাড়ে বারোটায় কেওকারাডং শীর্ষে এসে পৌঁছলাম ফ্যাকাশে বিধ্বস্ত চেহারা নিয়ে। আমাদের করুণ দশা দেখে লালাবাবু যারপরনেই বেদনাহত বোধ করলেন।
মিশন কেওকারাডং টু বগালেক
চূঁড়ায় উঠার পর পায়ের ব্যথা আর ক্ষুধায় মরণাপন্ন অবস্থা। হাত-পা ধুয়ে ডাইনিং-এ বসেই হাঙরের পেট নিয়ে গোগ্রাসে খাওয়া শুরু করলাম। মেন্যু খুব সাধারণ। বেগুনের তরকারী আর ডাল। আগের দু’বেলায় তেমন বেশী খায়নি। তাই ভাব বুঝে বাড়িওয়ালী ভাত অল্পই রান্না করেছে। কিন্তু ক্ষুধার প্রচন্ডতায় কয়েক মিনিটের মধ্যে সে ভাত সাবাড় হয়ে গেল। তখনও মাহফুয খেতে বসেনি। বাড়িওয়ালীর তো মাথায় হাত। অনভ্যস্ত বাংলায় রসিকতা করে বলল, ‘এত খেলে ২০০ টাকা করে নেব’। নাজীব যখন বলল আজ আপনার বাড়িতে যা কিছু আছে সব খেয়ে ফেলব, তখন তার সে কি হাসি! আমাদের টেবিলে রেখে মহিলা পাহাড়ে ফলানো বিন্নী ভাত চড়াতে গেল। আমরা এঁটো হাতে অধীর অপেক্ষায় বসে রইলাম। অবশেষে ভাত আসলে শুধু ডাল দিয়েই হাভাতের মত খেলাম। জীবনে এত খাওয়া আর খেয়েছি কি না মনে পড়ে না।
খাওয়ার পর গাইড বলল, দেড়টার মধ্যে বগালেকের উদ্দেশ্যে রওনা দিতে হবে, নয়ত রাত হয়ে যাবে। কিন্তু কটেজে ঢুকে আমি অচেতনের মত ধপ করে শুয়ে পড়লাম। ক্লান্ত শরীর আর এক ইঞ্চিও নড়তে চাইছে না। ‘সর্বাঙ্গে ব্যথা, ঔষধ দেব কোথা’-প্রবাদটি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। প্রায় ৪০ মিনিট পর উঠে দু’টো পেইনকিলার আর কাফী ভাইয়ের বানানো শরবত-গ্লুকোজ খেয়ে একটু চাঙ্গা হওয়ার চেষ্টা করলাম। বাইরে তাকিয়ে দেখি ঘন কালো মেঘ। প্রবল ঝড়বৃষ্টি নামার পূর্বমুহূর্ত। মেঘ ধেয়ে আসছে ভয়ংকর দর্শনে। ব্যালকনিতে যেতেই অনুভব করলাম মেঘেরা আমাদের গা ছুয়ে অতিক্রম করছে। ঝুম বৃষ্টি নামল পাহাড়ে। সে এক দারূণ অভিজ্ঞতা। প্রায় আধাঘণ্টা একটানা বৃষ্টি হল (সম্ভবতঃ পাহাড়ের এত উপরে ঝড় হয় না, কেননা পরদিন রুমা বাজারে শুনি গতকালের প্রবল ঝড়ে সেই যে বিদ্যুৎ চলে গেছে আর আসেনি, অথচ কেওকারাডং-এ সামান্য বাতাস ছাড়া ঝড়ের লেশমাত্র ছিল না)। বৃষ্টির প্রকোপ কমলে বেলা ২টার দিকে আমরা কটেজ ছেড়ে বের হলাম। লালা বাবুকে ৫ জনের থাকা-খাওয়ার বিল বাবদ ২৭০০ টাকা মিটিয়ে দেয়া হল। বাবুর ছোট্ট একবছরের নাতিটার সাখে আমাদের খুব খাতির জমে গিয়েছিল। কিন্তু ঘুমিয়ে থাকায় ওর হাতে কিছু দেয়া হল না। লালা বাবু ও তার স্ত্রী আমাদেরকে আন্তরিকভাবে বিদায় জানালেন। উপহার হিসাবে পেলাম পাহাড়ে চাষ করা এক ব্যাগ আদা।
টিপটিপ বৃষ্টির মধ্যে আমাদের ট্রেকিং শুরু হল। অভিযাত্রী মুড অবশ্য অনেক আগেই বিদায় নিয়েছে। প্রতিটি পদক্ষেপে টনটন করে প্রতিবাদ জানাচ্ছে দুই হাটু। তবে ভেজা আবহাওয়ায় আগের মত কষ্টটা আর নেই। রাস্তাও বেশ সমতল। মাঝে মাঝেই অদৃশ্য ঝর্ণার দূরাগত গর্জন ভেসে আসছে। বৃষ্টির কারণে জেগে উঠেছে এসব ঝর্ণা। ভেজা কর্দমাক্ত রাস্তায় বার বার স্লীপ করছি। জোঁকের উৎপাতও বেড়েছে খুব। মাঝে মাঝেই স্যান্ডেল খুলে জোঁক ছাড়াতে হচ্ছে। তবে আগের মত আতংকে নেই। ছাইয়ের টোটকা পেয়ে আমাদের মনোবল এখন অনেক শক্ত। টানা হেঁটে মাঝে মাত্র ১ বার বিরতি নিয়ে বিকাল সাড়ে চারটার দিকে আমরা চিনরি ঝর্ণার কাছে পৌঁছলাম। বৃষ্টির কারণে ফুলে ফেপে উঠেছে ঝর্ণাধারা। ভিতরে ঢুকে ঝর্ণার আসল চেহারাটা দেখে তো আমরা একেবারে মুগ্ধ। দুই-তিন দিকে পাহাড়ী নালা দিয়ে পানি পতিত হয়ে দুটি ধাপে নিচে নেমে এসেছে। সেই সাথে শব্দের তুমুল ঝংকার। অসাধারণ এই ঝর্ণাটিতে বেশ কিছু সময় কাটালাম। সেখান থেকে বের হয়ে মাগরিবের কিছু পূর্বে সাড়ে ৫টার দিকে বগালেক পৌঁছে গেলাম। মাহফুয ততক্ষণে সিয়াম দিদির কটেজ ঠিক করে ফেলেছে। সেখানে ব্যাকপ্যাক রেখেই গোসলের জন্য ছুটলাম। পানিতে নামার সময় গাইড বলল, জীবনে অনেক জায়গায় গোসল করেছি; তবে বগালেকের মত এত প্রশান্তি কোথায় পাই না। সিঁড়ি বাধানো পুকুরে দু’পা ফেলতেই গাইডের কথার সত্যতা পেলাম। ঝকঝকে পানিতে গা ডুবাতেই সমস্ত ক্লান্তি যেন ঝরে পড়ল। চমৎকার ওম ওম গরম পানিতে এ যেন প্রাকৃতিক হটশাওয়ার। কাফী ভাই সাঁতরে অনেক দূর গেল। আর তীরে দাঁড়িয়ে আমরা অসহায় দৃষ্টিতে তার জলকেলি দেখলাম। জীবনের প্রায় মধ্য গগণে এসে আজ বগা লেকের পাশে দাঁড়িয়ে সাতার না শিখতে পারার আক্ষেপ বড্ড বেশী যন্ত্রণা দিল। লেকের পাড়ে অাঁধার নেমে এলে সিয়াম দিদির কাঠের দোতলা সরাইখানায় ফিরে আসলাম। মাগরিব-এশা পড়েই ঘুম। রাত সাড়ে আটটার দিকে খাওয়ার ডাক পড়ল। খুব সুস্বাদু ডিম ভূনা দিয়ে ভাত খেলাম। ডাইনিং-এ বসে দেখলাম পাড়ার নারী-পুরুষ ভিড় করে সৌরবিদ্যুত চালিত রঙ্গিন টেলিভিশনে মিজোরামের ভাষায় কোন সিনেমা দেখছে। সম্ভবত অত্র অঞ্চল জুড়ে এটাই একমাত্র টেলিভিশন। ভেবেছিলাম রাতের খাওয়ার পর বগালেকপাড়ে বসে চাঁদ দেখব, জমাট অন্ধকারে গহীন বনের পথে হেঁটে বেড়াব। কিন্তু সন্ধ্যার পর থেকে সেই যে নেমেছে বেরসিক বৃষ্টি, থামার কোন লক্ষণ নেই। শেষমেষ ব্যথার ডিপোতে পরিণত হওয়া শরীরটাকে বিশ্রাম দেয়ারই সিদ্ধান্ত নিলাম। ১৮ জনের জন্য বরাদ্দ ঘরটা আমাদের ৫ জনের দখলে। ইচ্ছেমত জায়গা করে নিয়ে মহা ঘুম। এ সুখ দেখলে পর্যটন মৌসুমে ভীড়ের মধ্যে এখানে আসার কথা কোন বোধহয় পাগলেও চিন্তা করত না!
বগালেক টু চট্টগ্রাম
২৬ তারিখ ভোর। দীর্ঘ ঘুমের পর শরীরটা ঝরঝরে হবে কি তীব্র ব্যথায় পা মাটিতে ফেলতে পারছি না। কোনরকমে ছালাতটা আদায় করলাম। ছালাতের পর মাহফুয আবার গা এলিয়ে দিল। কিন্তু ভোরের বগালেক দেখার লোভ সামলাতে না পেরে শরীরের তীব্র ব্যথা নিয়েও আমরা বাইরে বেরিয়ে এলাম। আঁধার তখন প্রায় কেটে গেছে। স্বচ্ছ বগালেক প্রতিবিম্বিত পাহাড়ের সবুজে সবুজাভ। লেকের ওপারে মারমা পাড়া দেখা যাচ্ছে। হাতে সময় আছে দেখে লেকের ধার ঘেঁষে পাহাড়ী পথ ধরে মারমা পাড়ার দিকে এগুলাম। ওপারে পৌঁছে দেখি মূল গ্রামটি অনেক নীচে। সেখানে একটি প্যাগোডাও দেখা যাচ্ছে। পিচ্ছিল পথ ধরে অনেকটা পথ হেটে গ্রামের ভিতর নেমে এলাম। সেখানে দু’তিন জন লোকের সাথে কথা হল। একজন মাছ ধরতে যাচ্ছিল বগালেকে। তার কাছে অনেক তথ্য পেলাম। জানা গেল বগালেকে কখনও মাছ ছাড়া হয় না, এমনিতেই হয়। যে যার খুশী মত মাছ ধরে, কেউ বাধা দেয় না।
প্রকৃতির নিবিড় যত্নে এভাবেই লালিত-পালিত হচ্ছে পাহাড়ীরা। জীবন-জীবিকা সম্পর্কে তাদের মধ্যে কোন রকম অপ্রাপ্তি বা হতাশা নেই। বনের পাখির মত মনের আনন্দে দিন আনে দিন খায়। জীবনের ভেলা বয়ে যায় তাদের নিশ্চিন্তে, নির্বিঘ্নে। এ ক’দিনে পাহাড়ী অধিবাসীদের সহজ সরল প্রাণবন্ত জীবন-যাপন দেখে মনে হল প্রকৃতির রাজ্যে এরাই বুঝি সবচেয়ে সুখী মানুষ। কোন অভাব নেই, অনুযোগ নেই। বাচ্চাগুলোকে কী আদর-স্নেহেই না তারা মানুষ করে তুলছে। এমন কোন বাড়ি নেই যেখানে দু’চারটি শিশু দেখা যায় না। মা কিংবা বাবার কোলে-পিঠে পরম মমতায় দুধের শিশুগুলো বিশেষ পদ্ধতিতে ঝুলে আছে। সেখানে বসে কী সুন্দর টুক টুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। কোন কান্নাকাটি বা অস্বস্তির চিহ্ন নেই চেহারায়। ভোরের আলোতে দিনের শুরু আর সারাদিন হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের পর সন্ধ্যা নামতেই ঘুমের আয়োজন। নেই ভাববিলাসের এতটুকু ফুরসৎ। এভাবেই অতিবাহিত হয় পাহাড়ী জীবনের প্রতিটি দিন। পাসিংপাড়ার এক দোকানে বসে এসবই ভাবছিলাম আর বহু দূরের এক পাহাড়ে অবস্থিত রুমনা পাড়ার দিকে ইঙ্গিত করে গল্প করছিলাম। এসময় আমাদের কথার ফাঁকে নিছক ফকীরী বেশে উঠানে বসে থাকা মহিলাটি ভাঙা বাংলায় স্বগতোক্তি করল- রুমনার ঝর্ণাটি খুব সুন্দর। কেমন যেন অদ্ভুত শোনালো। বুঝতে পারলাম, সৌন্দর্যাভূতি জিনিসটা কতটা সহজাত, কতটা মানবীয়, কতটা সার্বজনীন। নইলে এই ভূস্বর্গের অপরূপ সৌন্দর্য কাননে যাদের নিত্য বসবাস, তাদের কাছে সুন্দরের আবেদন পৃথকভাবে ধরা পড়বে কেন!
এদের কষ্টসহিষ্ণুতার ইতিহাস তো প্রবাদবাক্যের মত। বাজারে যাওয়ার প্রয়োজন পড়লে দুর্গম পাহাড়ী পথে ঘন্টার পর ঘন্টা, মাইলের পর মাইল নির্বিবাদে হেটে যায়। এমনকি রুমা বাজার থেকে বগামুখপাড়া পর্যন্ত এই ১৩ কিঃমিঃ রাস্তা, যেখানে চাঁদের গাড়ি হরহামেশা মেলে, তাতে বিনা পয়সায় চড়ার আমন্ত্রণ জানালেও অনেকে উঠতে চায় না। মাথায় ভারী বোঝাবাহী তোরণ নিয়ে নারী-পুরুষ, ছেলে-বুড়ো নির্বিশেষে কীভাবে মাইলের পর মাইল পাহাড়ী পথ অতিক্রম করে চলে, চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। পুথিজ্ঞানহীন এসব প্রকৃতির সন্তানদের মধ্যে এখন এনজিওদের প্রচেষ্টায় শিক্ষার আলো ছড়াতে শুরু করেছে। কিন্তু বিনিময়ে তাদেরকে দিতে হচ্ছে চড়া মূল্য। পূর্বে তারা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ছিল। কিন্তু অধিকাংশই এখন খৃষ্টান হয়ে গেছে। যাওয়া-আসার পথে যতগুলো গ্রাম পড়ে তার প্রায় সবগুলোতেই সুসজ্জিত চার্চের দেখা মেলে। কেবল বগালেকের মারমাপাড়াটি এখনো বৌদ্ধ রয়ে গেছে। এক দোকানী বলল, পাহাড়ীরা একসময় সবাই বৌদ্ধই ছিল। গত দু’এক পুরুষ থেকে তারা খৃষ্টান হয়ে গেছে। খৃষ্টান মিশনারীরা এসব এলাকায় খুব তৎপর। তাবলীগ জামাআত সারাবিশ্বে ইসলাম প্রচারের জন্য সময় লাগাচ্ছে। কিন্তু দেশের মধ্যে এই এলাকাগুলো কেন তাদের দৃষ্টির আড়ালে রয়ে গেল তা আল্লাহই মা‘লূম। এই সুন্দর মনের মানুষগুলোকে কীভাবে এই মিশনারীদের হাত থেকে রক্ষা করা যায় এবং কী উপায়ে ইসলামের সত্য দাওয়াত এদের কাছে পৌঁছানো যায়, এ বিষয়টিই বার বার মনে ধাক্কা দিয়েছে এদের সাথে সাক্ষাতকালে।
মারমাপাড়ার প্রবেশমুখেই একটা প্যাগোডা। সেখানে ঢোকার পর দেখলাম ১৪/১৫ বছরের নাদুস-নুদুস ন্যাড়া মাথা একজন হবু ভিক্ষু শুয়ে আছে। মুখে কথা নেই। কেবল ইশারা করছে। সম্ভবত কোন ব্রত পালনে রত। ওর ভাবভঙ্গিতে মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল। ছোট্ট একটি বুদ্ধ মূর্তির সামনে দেশী-বিদেশী টাকার নোট ঝুলছে। কৌতূহলবশত বিদেশী টাকাগুলো কোন দেশের তা বোঝার জন্য হাত দিয়ে দেখছিলাম। এসময় প্রধান ভিক্ষু ভিতরে প্রবেশ করে তাতে স্পর্শ করতে নিষেধ করল হাসিমুখেই। সাথে একটি বাটিতে বেশ কয়েকটি ভুট্টা নিয়ে এসেছেন। সেখান থেকে একটি বুদ্ধমূর্তির সামনে রেখে আমাদের তিনজনের হাতেও তিনটি দিলেন। আমরা না নিতে চাইলেও তার জোরাজুরিতে নিতে হল। ভিতরে টানানো অনেক ছবির মধ্যে রাখাইন স্টেটের একটি ক্যালেন্ডার দেখতে পেলাম। ক্যালেন্ডারটির ছবি তোলার জন্য ক্যামেরা হাতে নিয়েছি। হাত নাড়িয়ে বাধ সাধল ঐ পিচ্চি হবু ভিক্ষুটাই।
ঘড়িতে ৭টা বেজে গেছে। প্যাগোডা থেকে বের হয়ে হাটতে হাটতে ব্যোমপাড়ায় ফিরে এলাম। ঘন্টাখানিক পূর্বেই সূর্যোদয় হয়েছে। কিন্তু পাহাড়ের চূড়া পেরিয়ে সূর্য তখন কেবলই উঁকি দেয়া শুরু করেছে বগালেকপাড়ায়। শরতের মেঘমুক্ত ঝকঝকে নীল আকাশ। আর তার শোভাবর্ধনে নিয়োজিত কাচা রোদের আলো ঝলমলে টুকরো মেঘের অসংখ্য ফুটফুটি। দুর্দান্ত এই আকাশটাই কি কবিগুরুর কল্পনার সেই নীলাম্বরী! সত্যিই সভ্যতার কোলাহলমুক্ত শান্ত-সুনিবিড় পাহাড়ী ভুবনে কেবল এই স্বচ্ছ সুনীল আকাশ দেখতেই বুঝি বার বার আসা যায়।
বগালেকেই গোসল করলাম। গোসলের পর আলুভর্তা, ডিমভাজি আর ডাল দিয়ে খুব তৃপ্তিভরে নাস্তা সারলাম। চা পান করার সময় সিয়াম দিদি এসে হাজির। দিদির বাবা এই পাড়ার সর্দার। তার স্বামী বাঙালী এবং একজন ব্যাংক কর্মকর্তা। থাকেন নারায়ণগঞ্জে। শিক্ষিতা এই মহিলার আভিজাত্য ও অত্যন্ত অমায়িক আচরণ সত্যিই মুগ্ধ করার মত। আঁচ করতে পারলাম সিয়াম দিদির কেন এত নাম-ডাক কেওকারাডং ভ্রমণে আসা পর্যটকদের কাছে।
ফেরার বেলা
সিয়াম দিদির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেলা ৮টার দিকে আমরা এই পর্বের সর্বশেষ হন্টনযাত্রা শুরু করলাম। পাহাড়ের উপর উঠে আরেকবার দৃষ্টি ফিরালাম বগালেকের দিকে। রহস্যে ঘেরা সুনীল জলরাশির সাথে কিছুক্ষণ নিঃশব্দ বাক্যবিনিময়ের পর বিদায়ী দীর্ঘশ্বাস ফেলে পাহাড়ের ওপারে নামতে লাগলাম। বগামুখপাড়া পৌঁছতে ৪০ মিনিট লাগল। সেখানে পাহাড়ী কমলা কেনার পর চাঁদের গাড়ীর স্টান্ডে এসে অপেক্ষা করতে থাকলাম। বেলা সাড়ে ৯টার দিকে দুটো চাঁদের গাড়ী আসল। একটি ছিল পর্যটকবাহী। সেটিতেই উঠলাম আমরা। গাড়ীতে যাত্রী কেবল আমরা ক’জনই। বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে উচু-নিচু পাহাড়ী রাস্তাটি অতিক্রম করে বেলা ১১টার দিকে রুমা বাজার পৌঁছলাম। আর্মী ক্যাম্পে রিপোর্ট করে ‘আরণ্যক রিসোর্টে’ রাখা আমাদের লাগেজগুলো গুছিয়ে নিলাম। হোটেল মালিক ও চেইন মাস্টারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সাঙ্গুর ঘাটে অপেক্ষমান নৌকায় উঠে বসলাম। ঘাটে আসার সময় নাজীব রুমাবাজার মসজিদের লাইব্রেরীতে ছালাতুর রাসূল (ছাঃ) বইটি ঢুকিয়ে দিল। নৌকা ছাড়ল ঠিক ১১.৫০ শে। ঘাট থেকে তখন হাত নাড়াচ্ছে আমাদের ৩ দিনের সাথী গাইড আলমগীর ভাই।
ভাটির পথে মাত্র ৪০ মিনিটেই কাইখ্যাংঝিরি ঘাটে পৌঁছে গেলাম। সেখান থেকে বেলা ১টায় বান্দরবানের উদ্দেশ্যে গাড়ী ছাড়ল। বেলা ৩টার ২/৩মিনিট পূর্বে বান্দরবান পৌঁছেই চট্টগ্রামগামী পূর্বাণী বাস পেয়ে গেলাম। ঠিক ৩টায় গাড়ী ছাড়ল। চলতি পথে বাস থেকেই স্বর্ণমন্দির ও মেঘলা অবকাশকেন্দ্র দেখলাম। অতঃপর চট্টগ্রামের বহদ্দারহাট বাসস্টান্ডে এসে নামলাম বিকাল সাড়ে পাঁচটায়। সেখান থেকে এক সিএনজি নিয়ে কর্ণেলহাটে পৌঁছে শ্যামলী কাউন্টার থেকে রাজশাহীগামী ৭টার বাসে টিকিট কাটলাম। বাসে উঠেই ঘুম। পরের দিন সকাল সাড়ে ৮টায় নিরাপদেই ফিরে এলাম চিরচেনা রাজশাহী শহরে ফালিল্লাহিল হামদ। কিন্তু ‘ব্যথার রাজ্যে জীবন গদ্যময়’ রয়ে গেল পরবর্তী আরো কয়েকটা দিন। আর মনের গহীনে ক্ষণে ক্ষণে উঁকি দিয়ে যেতে লাগল সদ্য ফেলে আসা পাহাড়ী রাজ্যের স্বপ্নালু স্মৃতিগুলো।