একটি সিগন্যাল ও আমার আমি

অলি আহমাদ 886 বার পঠিত

ছেলেটির কোনো স্বপ্ন ছিলনা। কী জানি, ছিল হয়ত! তবে ওর চোখ দুটোতে কখনো স্বপ্নের আলোকচ্ছটা দেখিনি আমি। যে’কটা মুহূর্ত দেখছি, শীর্ণ আর কৃষ্ণবর্ণ ছেলেটিকে, শুধু ক্ষুধা আর অভাবে নিমজ্জিত কিছু কষ্ট দেখেছি। যার বহিঃপ্রকাশ কখনো বিষণ্ণ ছিলনা, ছিল স্মিত এক হাসি।

আমি বেশিদিন নই ঢাকায়, পড়াশোনা করেছি দেশের বাহিরেই। এখন চাকরি করছি, ঢাকায়। নিজের দেশে ফিরে আসবার জন্যে চলে আসা।....তা আমি যেই হই। বাসে, ট্রেনে, গাড়ীতে অথবা রিক্সায়, দু’পাশে চোখ ভরে তাকিয়ে থাকাটাই আমার স্বভাব। আমি দেখতে থাকি, মানুষ, তাদের কাজ, গাছপালা... সব, সবকিছু। প্রতিদিন নিজে গাড়ী করে অফিস যাই আমি। সকাল ৮.৩০। আমি নিয়মিত একটি সিগন্যালে আটকে পড়ি। এখন অভ্যাস হয়ে গেছে মাঝে-মাঝে ওখানে মিনিট পনের থেমে থাকার, কখনো বা বেশি। তিনমাস আগের সোমবার সকালটাও আলাদা কিছু ছিলনা। গুনগুন করে আনমনে কোন গানের কলি ভাজছিলাম, বেসুরো। হঠাৎ ঠক-ঠক শব্দে চমকে উঠলাম, বেশ বিরক্তও হলাম। কাঁচ নামিয়ে একটি নিষ্পাপ মুখ দেখলাম, যেন কাঁদছে, একটি ছেলে। কিছু টকটকে গোলাপ উপরে তুলে বলল, ‘স্যার, ফুল নিবেন, ফুল? তাজা রইছে, নিবেন?’ না লাগবেনা বলে জানালা নামাচ্ছিলাম। ছেলেটি জানালাটা ধরে বলেই চলছিল, ‘নেন না স্যার, দু’টা টাকা পাইলে খাইতে পারতাম, নেন না....স্যার...স্যার...’ খেঁকিয়ে  উঠলাম ‘না রে বাবা, জ্বালাস না তো!’ হাল ছেড়ে দিয়ে, মাথা নিচু করে ছেলেটা দৌড়  দিল। নিঃশব্দে আমি জানালার কাঁচ উঠিয়ে দিলাম, সিগন্যাল সবুজ হয়েছে। পৌঁছে গেলাম, আমার নিয়ত জেলে, আমার কর্মস্থল। কর্মব্যস্ত প্রতিটি দিনে কোনকিছু ভাবার অবকাশ পাইনা কোনদিনই, আজও পেলাম না। দিনশেষে সেই ঘরে ফেরা। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে-উঠতে আনমনে কথা বলছিলাম নিজের সাথেই। নিজেকে বলছিলাম, আমি কতটা একা, কতটা অর্থহীন আমার জীবন। পরিবার থেকে সবসময় দূরে থেকেছি, এখনো তাই করছি....কেন? উত্তর জানা নেই আমার, আমি একা থাকি, স্বেচ্ছায়। তবে আমি একাকিত্ব বোধ করি, আর আমি এটা পছন্দ যে করি, তাও নয়। তবু আমি একা থাকি। নিজেও জানিনা কেন। নিজের জটিল মনের কাছ থেকে কোনদিন উত্তর পাইনি। আজও পাবো না জানি, অনর্থক প্রশ্নগুলো আমাকে পৌঁছে দিল ঘরের দরজার সামনে। কোনকিছু ঘটেনি যেন আজ, প্রতিটি দিনের মতই সবকিছু শূন্য। শুয়ে ছিলাম চোখ বন্ধ করে, আচমকা দুটি নিষ্পাপ চোখ দেখতে পেলাম, সেই ছেলেটির। কেন অযথা খারাপ আচরণ করলাম? ওর তো দোষ নেই কোনো, এটাই ওর কাজ। আমরা সবাই তো ফেরি করে ফিরি। কেউ সামান্য ফুল, কেউ অন্যকিছু। আমি নিজেও যে কিছু অনুভূতির ফেরিওয়ালা........

ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, এলার্ম-ঘড়িটা হিংসেয় জ্বলছিল নিশ্চয়। নয় তো এত গভীর ঘুমে হামলা দেয়ার নির্মমতা কেন? উঠে প্রস্তুত হয়ে  নিলাম দ্রুত, অফিস আছে। সেই সিগন্যাল, আবার আমি। টোকা পড়তেই হেসে ফেললাম, আমার জীবনে সবকিছুই এমন, গৎবাধা, যা হবার, তাই হয়, অবিরাম। জানালা খুলে ছেলেটিকে দেখলাম, আমাকে দেখে চমকে উঠলো, চলে যাচিছল ও। ডাক দিলাম ওকে, ঘুরে বলল, ‘ডাকসেন স্যার??’ ---হুমম, নাম কি তোমার? ‘নাম দিয়া কি করবেন স্যার? ফুল নিবেন??’ একশ টাকা দিলাম ওর হাতে, বললাম ‘নামটা বলো এখন?’ ‘আমারে ছক্কু কয়, ফুল কয়টা দিমু স্যার?’ আমি বললাম, ‘আমার ফুল লাগবেনা।’ ‘তয় কি টেকা ফিরত লইবেন?’ আমি বললাম, ‘রাখো ঐটা, আচ্ছা তুমি এখন যাও।’ এমন নির্মল আনন্দের হাসি আমি বোধ হয় বহুদিন দেখিনি, ওর চোখে-মুখে যেটা দেখেছি সেই মুহূর্তে। একছুটে ভীড়ের মাঝে হারিয়ে গেল ছক্কু। ওর আনন্দ আমাকে স্পর্শ করছিল খুব। কেমন যেন একটা সুখের অনুভব নিয়ে দিনটি কাটালাম আমি, একটু আলাদা।

আজ আমি আটকে পড়িনি সেখানে, একজন ছক্কুকে আমার মনে ছিলনা আদৌ। আমি আমার নিয়ত জীবনে ব্যস্ত হয়েছিলাম। দুদিন পরে, জানালায় উত্তেজিত থপ-থপ, ছক্কু!! ‘কিরে, কেমন আছ তুমি?!’ ‘আমি ভালো আছি স্যার, আপনে ভালো আছেন?’ মাথা নেড়ে সায়  দেই আমি, বলি, কি চাও? ‘কিছুনা স্যার, আপনের দেওয়া টেকা দিয়া মেলা দিন বাদে সেইদিন পেট ভইরা ভাত খাইছি, পত্তেকদিন চায়া খাই, হেইদিন কিন্না খাইসি।’ বললাম, ‘থাক কই?’ ‘ঐদিক।’ কোনো দিক-নির্দেশ পাইনা আমি, হেসে দশ টাকা দিলাম, যাবার সময় হলো।

মাঝে মাঝেই দেখা হতো ওর সাথে, কখনো টাকা দিতাম কিছু, কখনো দিতাম না। একজন আরেকজনের কুশল বিনিময়ের একটা আজব সম্পর্ক ছিল আমাদের। অফিসে যাবার পথে, আমার পরিবার হয়ে দাঁড়ালো একসময়, ছোট্ট ওই হাসিমুখ ছেলেটি। একদিন আমাকে প্রশ্ন করে ও, ‘আপনের অনেক টেকা তাইনা স্যার?’ আমি বলি, ‘ধুর না রে, আমি খুব সাধারণ মানুষ।’ ও বলে, ‘তাইলে আমারে যে টেকা দেন, গাড়িত করি আসেন?’ আমি কিছু বলিনা, হাসি শুধু। ও বলে, স্যার, ‘আপনে খুব ভালা মানুষ।’ ওকে বিদায়  করে আমি কাঁদি আপন মনে, নিজেকে বলি, যদি ছক্কুর কথা সত্য হত!! সবাই তো আমার থেকে দূরে চলে গেছে, বন্ধু, পরিবার। হয়ত.....আমি ভালো হলে যেতনা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবি আমি, হয়ত....ওরা নয়, আমি নিজেই নিজেকে খোলসে গুটিয়ে  রেখেছিলাম.... হয়ত....এই হয়তগুলো আসলে অমিমাংসিত।

যাহোক অফিসে যাওয়ার পথে একদিন ভাবলাম আজ ফুল কিনব। কোনদিন ফুল নেয়া হয় নি ছক্কুর কাছ থেকে, আজ সবগুলো কিনব। সিগন্যালে আমি আটকে ছিলাম, মিনিট বিশেক, না, ছক্কুর টোকা পড়েনি সেদিন আমার গাড়ির কাঁচে। আমি আগে বাড়লাম। পরে আরো কয়েকদিন ফুল কেনার আশায় আমি অপেক্ষায় ছিলাম, সেই সিগন্যালে। কিন্তু না, সে আর আসে না। সপ্তাহের পর সপ্তাহ ওকে না দেখে কষ্ট পেতাম। ভাবতাম, আচমকা হয়ত আবার পড়বে টোকা। কিন্তু ছক্কু আর আসলই না। কোনদিন আর দেখিনি ওর নিষ্পাপ মুখ, ক’টা টাকা পেয়ে নির্মল মধু হাসি। কোনদিন আর সে জিজ্ঞেস করেনি, ‘স্যার, আপনে কেমন আছেন?’

এখন আমার বিয়ে হয়েছে। বিয়ের পর স্ত্রীর একটাই অভিযোগ, আমি ওর জন্যে কোনদিন ফুল আনিনি। আমি উত্তরে বলি, ‘ভালো ফুল পাইনা যে....।’ আমি ছক্কুর ফুলগুলো কিনতে চাই, ওকে অনেক খুঁজেছি, পাইনি কখনো। আজও আমি ওর অপেক্ষা করে থাকি, সেই সিগন্যালে....।  

অলি আহমাদ

ইউনিভার্সিটি অব মালায়া,

কুয়ালালামপুর, মালয়েশিয়া



আরও