হতাশা থেকে মুক্তি
ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
ইসলাম মহান আল্লাহ
প্রদত্ত এক সার্বজনীন জীবন বিধান। মানব জাতির সার্বিক কল্যাণে নিয়োজিত।
পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের মধ্যে এর বাস্তব নমুনা বিদ্যমান। তবে এসবের
মৌলিক উদ্দেশ্য মানুষকে পরীক্ষা করা। এজন্য আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রজ্জুকে
আকঁড়ে ধরে ‘ছিরাতে মুস্তাক্বীমে’ চলার নির্দেশ দিয়েছেন। সেই সাথে ভ্রান্ত
পথে চলতে নিষেধ করেছেন (আলে ইমরান ১০১, ১০৩; আন‘আম ১৫৩)। সৎ আমলের নির্দেশ দেয়ার সাথে সাথে ক্ষতিগ্রস্ত আমল সম্পর্কে জাহান্নামের হুমকি দিয়েছেন (কাহফ ১০৩-১০৬)। আল্লাহর উক্ত পথনির্দেশ গ্রহণ করে আত্মসমর্পণ করবে বলে তিনি নাম রেখেছেন মুসলিম (হজ্জ ৭৮)।
কিন্তু মুসলিম নামে ভূষিত হওয়া সত্ত্বেও ছিরাতে মুস্তাক্বীম থেকে বিচ্যুত
হয়ে দলে দলে বিভক্ত হয়েছে। রাসূল (ছাঃ)-কে লক্ষ্য করে আল্লাহ বলেন, ‘আপনি
বলুন! নিশ্চয় এই সোজা পথটি আমার পথ। তোমরা এই পথেরই অনুসরণ করবে। অন্যান্য
পথের অনুসরণ কর না। অন্যথা এই সোজা পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে যাবে। এ ব্যপারে
আল্লাহ তোমাদেরকে অছিয়ত করছেন, যেন তোমরা সতর্কতা অবলম্বন কর (আন‘আম ১৫৩)। উক্ত আয়াতে অন্য যাবতীয় পথ বর্জন করে একটি পথে চলতে বলা হয়েছে।
প্রশ্ন হতে পারে মুসলিমদের মাঝে এত বিভক্তি ও দলাদলি কেন? এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ চাইলে তোমাদেরকে এক উম্মতভুক্ত করতেন। কিন্তু তিনি তোমাদেরকে যে বিধান দিয়েছেন সে ব্যাপারে পরীক্ষা করার জন্য তা করেননি। সুতরাং তোমরা কল্যাণের দিকে প্রতিযোগিতা কর। তোমাদের প্রত্যাবর্তনস্থল আল্লাহ। আর তোমরা কী বিষয়ে মতভেদ করছ সে বিষয়ে তিনি তোমাদেরকে জানিয়ে দিবেন’ (মায়েদাহ ৪৮)।
উক্ত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য রাসূল (ছাঃ) ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যে, আমার উম্মত ৭৩ দলে বিভক্ত হবে। একটি ব্যতীত সবই জাহান্নামে যাবে। উক্ত জান্নাতী দলের পরিচয় সম্পর্কে বলেন, ‘আমি এবং আমার ছাহাবীরা যার উপর আছি তার উপর যারা থাকবে’ (তিরমিযী হা/২৬৪১)। অন্য বর্ণনায় এসেছে, সেটা হল, ‘জামা‘আত’ বা ঐক্যবদ্ধ একটি দল’ (আবুদাঊদ হা/৪৫৯৭)। রাসূল (ছাঃ) উক্ত হাদীছদ্বয়ে ছিরাতে মুস্তাক্বীমের পথিকদের দুইটি পরিচয় তুলে ধরেছেন। আর উক্ত জান্নাতী দল ক্বিয়ামত পর্যন্ত হক্বের উপর বিজয়ী থাকবে। তাদেরকে কেউ ক্ষতি করতে পারবে না (মুসলিম হা/৫০৫৯)।
অতএব আমাদেরকে রাসূল (ছাঃ) প্রদর্শিত সরল সোজা জান্নাতী পথে চলতে হবে এবং হক্বপন্থীদের অন্তর্ভুক্ত হতে হবে। কারণ হক্বপন্থী জামা‘আতের সাথে অবস্থানকে শরী‘আত অত্যধিক গুরুত্ব দিয়েছে (বুখারী হা/৭০৮৪; আহমাদ হা/১৮৪৭২; ছহীহাহ হা/৬৬৭)। রাসূল (ছাঃ)-এর পরিচিতির আলোকে উক্ত পথ ও আক্বীদার কয়েকটি নাম মুহাদ্দিছ ওলামায়ে কেরাম উল্লেখ করেছেন। (১) সালাফী। রাসূল (ছাঃ) ও তাঁর ছাহাবী তথা পূর্বসুরীদের অনুসারী হিসাবে সালাফী (২) আহলুল হাদীছ বা (৩) আছহাবুল হাদীছ। ছাহাবায়ে কেরাম কুরআন ও হাদীছের উপর সুপ্রতিষ্ঠিত ছিলেন বলে আহলেহাদীছ বা আছহাবুল হাদীছ। আর কুরআন ও হাদীছ উভয়কে শরী‘আতে হাদীছ বলা হয়েছে (যুমার ২৩; মুসলিম হা/২০৪২) (৪) আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আত। এখানে দুই হাদীছে বর্ণিত দুইটি গুণ এক সঙ্গে যুক্ত হয়েছে (মুক্বাদ্দামা মুসলিম হা/২৭; আবুদাঊদ হা/৪৫৯৭) (৫) আহলুল ইলম (বুখারী ২/১০৭৮ পৃঃ)। রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যুর পর থেকে সকল যুগের বরেণ্য মুহাদ্দিছ ওলামায়ে কেরাম উক্ত নামগুলোই উল্লেখ করেছেন। ভিন্ন কোন নাম বলেননি (বিস্তারিত দ্রঃ আলবানী, সিলসিলা ছহীহাহ হা/২৭০-এর আলোচনা)। মূলতঃ স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের কারণে বিভিন্ন স্বনামধন্য নামে ভূষিত করা হয়েছে। যেমন স্বয়ং রাসূল (ছাঃ) নিজেই দু’টি পরিচয় ব্যক্ত করেছেন। তাই শুধু মুসলিম পরিচয় দেয়া রাসূল (ছাঃ)-এর হাদীছের সঙ্গতিপূর্ণ নয়। তেমনি যুগে যুগে পরিচিত ছাহাবায়ে কেরাম বা পূর্বসুরী সালাফীদের রীতিও নয়। আর এটা বলে পরিচয় দেয়ার কোন প্রয়োজনীতাও নেই। কারণ সকলে মুসলিম হয়েই জন্মগ্রহণ করে। অতঃপর বৈশিষ্ট্যের কারণে বিভিন্ন শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায় (রূম ২০; বুখারী হা/১৩৮৫)। এ জন্য আল্লাহ বৈশিষ্ট্যগত নামকেই বেশী গুরুত্ব দিয়েছেন। যেমন মুহাজির ও আনছার। এর অর্থ তাঁদেরকে মুসলিম থেকে বের করে দেয়া নয়। বহু স্থানে মুমিন, মুত্তাক্বী, মুহসিন বলে পরিচয় তুলে ধরেছেন। তার অর্থ মুসলিম থেকে বের করা নয়। মূলতঃ ‘মুসলিম তত্ত্ব’ এটি নতুন থিউরী। বেশী উৎসাহিত কিছু রোগ গ্রস্ত মহল এটাকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করছে। যুগ যুগ ধরে পরিচিত বিশ্বনন্দিত নামগুলো নিয়েই খেলা করা হচ্ছে। টিভিতে এ্যাড আকারে প্রচার করা হচ্ছে। কিন্তু সমাজে প্রচলিত অসংখ্য বিদ‘আতী নাম নিয়ে ঐ মহলের ততটা মাথা ব্যথ্যা নেই। যদিও নামকে গুরুত্ব না দিয়ে বৈশিষ্ট্যকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। কারণ অনেক ক্ষেত্রে নামের সাথে কাজের মিল থাকে না, যা বর্তমানে স্পষ্ট। সুতরাং ‘ছিরাতে মুস্তাক্বীমের’ পরিচয়টা হল আসল পরিচয়।
রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যুর পর থেকেই তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী মুসলিমদের মধ্যে বিভিন্ন বিদ‘আতী ও ভ্রান্ত দলের আবির্ভাব ঘটতে থাকে। বর্তমানে সেই পথভ্রষ্ট দলের সংখ্যা হাযার হাযার গুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। তাদের মধ্যে প্রথম চারটি দল সম্পর্কে রাসূল (ছাঃ) স্পষ্ট ভাষায় ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন। (ক) খারেজীরা জাহান্নামের কুকুর (ইবনু মাজাহ হা/১৭৩)। (খ) মুরজিয়া (গ) ক্বাদারিয়া। এই দুইটি দল কাওছারের পানি পান করতে পারবে না এবং জান্নাতেও প্রবেশ করতে পারবে না (তাবারাণী আওসাত্ব হা/৪২০৪; সিলসিলা ছহীহাহ হা/২৪৪৮)। (ঘ) শী‘আ (বুখারী হা/৩১০৪; ছহীহাহ হা/২৪৯৪)। এই দলগুলো মুসলিমদেরই অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু রাসূল (ছাঃ) তাদের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিয়ে গেছেন। এছাড়া উক্ত বাতিল ফের্কাগুলোর শাখ-প্রশাখা হিসাবে রাফেযী, জাবরিয়া, জাহমিয়া, মু‘তাযিলা ইত্যাদি দলও রয়েছে। হানাফী, শাফেঈ, মালেকী, হাম্বলী নামে প্রসিদ্ধ চারটি মাযহাব চালু আছে। শুধু হানাফী মাযহাবের অনেক দলের জন্ম হয়েছে। শরী‘আত, তরীক্বত, হাক্বীক্বত, মা‘রেফত নামে ছূফী দর্শন। দেওবন্দী, ব্রেলভী, নকশাবন্দিয়া, ক্বাদারিয়া, চিশতিয়া, মুজাদ্দেদিয়া ইত্যাদি। লক্ষ্য লক্ষ পীর-ফকীরও হানাফী মাযহাবের পরিচয় দেয়। যদিও পরস্পরে যেমন মিল নেই তেমনি ইমাম আবু হানীফা (রহঃ)-এর সাথেও কোন সম্পর্কে নেই। অতএব মুসলিম নামধারী দল হলেই যে সেখানে ভর্তি হতে হবে তা নয়। এজন্য ইমাম ইবনু হাযম আন্দালুসী বলেন, ‘ইসলামী দলসমূহের মধ্যে অনেক ফের্কারই ইসলামের নামে নামকরণ করা হয়েছে। মূলতঃ সেগুলো ইসলামী দল নয়। যেমন চরমপন্থী খারেজী জোট’। অন্যত্র তিনি অনেক বাতিল ফের্কার বর্ণনা দিয়ে বলেন, ‘ঐ দলগুলো সবই ইসলাম বহির্ভূত। আমরা তাদের প্রতারণা হতে আল্লাহ্র নিকট পরিত্রাণ ভিক্ষা করছি’ (কিতাবুল ফাছল ১/৩৭১-৭২)। আব্দুল করীম শহরাস্তানী বলেন, ‘শী‘আদের দাবীর পক্ষে কুরআনে যেমন দলীল নেই তেমনি মুসলিমদের মাঝেও নেই। কারণ তারা মুসলিম নয়’। রাফেযীদের সম্পর্কেও একই রকম মন্তব্য করেন (আল-মিলাল ২/৭৮ পৃঃ)।
পূর্বের মত এখনো অসংখ্য দল গজিয়ে উঠছে। আধুনিক ব্যাখ্যার নামে নতুন নতুন উদ্ভট তথ্য দিয়ে সাধারণ জনগণকে বিভ্রান্ত করছে। তবে বিশ্লেষণের বিষয় হল, হাযারো ভ্রান্ত ফের্কা ও আক্বীদা সৃষ্টি হলেও আল্লাহ্র গযবে তা ধ্বংস হয়েছে, মুখ থুবড়ে পড়েছে, অসংখ্য মাযহাব নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। শুধু সালাফী বা আহলুল হাদীছ আক্বীদা ও পথকে আল্লাহ হেফাযত করেছেন। অতএব ভ্রান্ত দর্শন যতই সৃষ্টি হোক তার ধ্বংস অনিবার্য। কারণ তারা আল্লাহ ও রাসূল (ছাঃ)-এর দেখানো সালাফীদের পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে। পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছে বর্ণিত আক্বীদা ও আমল এবং ছাহাবায়ে কেরামের ব্যাখ্যা ও বুঝকে তারা পরওয়া করেনি। তারা ইসলাকে টুকরো টুকরো করেছে (আন‘আম ১৫৯)। এরাই ক্বিয়ামতের মাঠে কাওছারের পানি থেকে বঞ্চিত হবে। রাসূল (ছাঃ) তাদের প্রতি অভিশাপ করবেন এবং বিতাড়িত করবেন (বুখারী হা/৬৫৮৩)। সুতরাং হঠাৎ আবির্ভূত হওয়া কোন রাস্তায় পা দেয়া যাবে না। কারণ এগুলো সব জাহান্নামের রাস্তা। ইসলামে নতুন রাস্তা হওয়ার কোন সুযোগ নেই। আমাদেরকে ইসলামের নামে সৃষ্ট যাবতীয় দল-উপদল প্রত্যাখ্যান করতে হবে। প্রতি ছালাতের প্রত্যেক রাক‘আতে সূরা ফাতিহার মাধ্যমে সেই সরল পথের জন্য আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করতে হবে। প্রকৃতার্থে যারা সালাফী, আহলেহাদীছ, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের আক্বীদায় বিশ্বাসী তাদের সাথে অবস্থান করতে হবে। ‘উলুল আমর’ হিসাবে শরী‘আত অভিজ্ঞ শ্রেষ্ঠ আলেমের দলীল ভিত্তিক নির্দেশনায় পথ চলতে হবে (নিসা ৫৯; নাহল ৪৩-৪৪), যার নির্দেশনা ছাহাবীদের সাথে মিল থাকবে।
নির্ভেজাল তাওহীদের অপ্রতিরোধ্য আপোসহীন কাফেলা হিসাবে ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ’ এবং ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’ রাসূল (ছাঃ) প্রদর্শিত ‘ছিরাতে মুস্তাক্বীমের’ উপর অটল থেকে সোনালী যুগের আদর্শ পুনরুদ্ধাদের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বিশ্ব মানবতাকে সেই প্লাটফরমের দিকে আহবান করছে। তাই রাসূল (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরামের আক্বীদা বিরোধী আধুনিক কোন ভুঁইফোড় চরমপন্থী বা নরমপন্থী মতবাদকে বরদাশ্ত করে না। সেটা কথিত ইসলামের নামে হোক বা নব্য জাহেলিয়াতের নামে হোক। এই অনন্য বৈশিষ্ট্যের কারণে শিকড়হীন উদ্ভট ফের্কাগুলো এই দ্বীনী সংগঠনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে আসছে। অনেক মিডিয়া না জেনেই মিথ্যাচার করছে। অনেক সময় প্রশাসনের লোকেরা ঐ মিথ্যাচারে প্ররোচিত হয়ে বিভিন্ন কাজে বাধা সৃষ্টি করছে এবং কর্মীদের হয়রানি করছে। আমরা বিশ্বাস করি সত্য চিরদিন বিজয়ী আর মিথ্যা চিরদিন পরাজিত। নমরূদ, ফেরাঊন, আবু জাহাল চির লাঞ্ছিত, ইবরাহীম, মূসা, মুহাম্মাদ (ছাঃ) চির সম্মানিত। অতএব বাতিল ফের্কা নিপাত যাক, চির সত্য প্রতিষ্ঠিত থাক। আল্লাহ আমাদেরকে ‘ছিরাতুল মুস্তাক্বীমে’ পরিচালিত করুন- আমীন!!