করোনাকাল আমাদের কি শেখালো?
ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব 2559 বার পঠিত
ক্বিয়ামতের
পূর্বে পৃথিবীর প্রতিটি ঘরে ঘরে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে যাবে। রাসূল (ছাঃ)
বলেন, এ যমীনের উপর এমন কোন মাটি কিংবা পশমের ঘর (তাঁবু) বাকী থাকবে না, যে
ঘরে আল্লাহ রাববুল আলামীন ইসলামের বাণী পৌঁছিয়ে দেবেন না। সম্মানীর ঘরে
সম্মানের সাথে; আর লাঞ্ছিতের ঘরে লাঞ্ছনার সাথে তা পৌঁছাবেন। এদের মধ্যে
কাউকে আল্লাহ তা‘আলা সম্মানিত করবেন এবং (স্বেচ্ছায়) ইসলাম কবূলের জন্য
উপযুক্ত করে দেবেন। আবার কাউকে লাঞ্ছিত করবেন এবং তারা বাধ্য হয়ে এই
দ্বীনের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করবে (অর্থাৎ সকল দ্বীনের উপর ইসলাম বিজয়ী
হবে) (আহমাদ, মিশকাত হা/৪২)।
এই হাদীছের প্রেরণাকে সামনে রেখে ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ’ বর্তমান কার্যকাল (২০২০-২২)-এর জন্য যে লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে তা হ’ল- ‘অহির আলোয় উদ্ভাসিত হোক বাংলার প্রতিটি ঘর’। অর্থাৎ আমরা চাই বাংলার যমীনে প্রতিটি গৃহে, প্রতিটি ঘরে অহির বার্তা পৌঁছে যাক সগৌরবে। ধনী হোক, গরীব হোক; শিক্ষিত হোক কিংবা অশিক্ষিত- কেউ যেন এই মহান দাওয়াত থেকে মাহরূম না হয়। প্রত্যেকের কাছে যেন এই বার্তা পৌঁছে যায় যে, ইসলাম হ’ল তাওহীদ তথা এক আল্লাহর সার্বভৌমত্বের নাম। এতে কোন শরীকানা নেই। হোক তা সৃষ্টি পরিচালনায় কিংবা মানব সমাজের দৈনন্দিন ইবাদত-বন্দেগী, কার্যবিধিতে। রব হিসাবে, ইলাহ হিসাবে, নামে-বৈশিষ্ট্যে-গুণাবলীতে সর্বত্র তাঁর এক ও একক অবস্থান। তাতে না আছে বিন্দুমাত্র ক্ষান্তি ঘটানোর কোন অবকাশ; আর না আছে অংশীদারিত্ব দাবী করার মত কোন ধৃষ্টতার সুযোগ। মহান প্রভূর স্পষ্ট ঘোষণা- জেনে রেখ, সৃজন ও আদেশ তাঁরই। তিনি মহিমাময় বিশ্ব প্রতিপালক (আ‘রাফ ৫৪)।
সুতরাং যাবতীয় সিজদা-আরাধনা, কামনা-বাসনা, আশা-ভরসা, ভক্তি-অনুরক্তি কেবল তাঁরই কাছে হ’তে হবে। মান্য করতে হবে কেবল তাঁরই দেয়া বিধি-বিধান, তাঁরই প্রেরিত প্রত্যাদেশ -নির্দেশনা। এর ব্যত্যয় ঘটানোর কোন সুযোগ নেই। মহান রবের এই একচ্ছত্র আধিপত্য মেনে নেয়া ও তাঁর ইচ্ছার কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের মধ্যেই নিহিত জগৎ সংসারের মূল রহস্য। এতেই রয়েছে বান্দা সফলতা ও মুক্তির চাবিকাঠি। আর এর বিপরীতে স্রষ্টার আধিপত্যে সামান্যতম বিঘ্নতা ঘটায় এমন যা কিছু রয়েছে, তা-ই শিরকের প্রতিভূ, তা-ই পরিত্যাজ্য। তাতেই রয়েছে যাবতীয় অশান্তি আর ধ্বংসের সুলুক।
দ্বিতীয়তঃ পার্থিব জীবনে আমাদের একমাত্র চলার পথ রাসূল (ছাঃ) আনীত রবের প্রত্যাদেশ আর তাঁর প্রদর্শিত সুন্নাত। আমাদের যাবতীয় ইবাদত-আমল, আইন-সংবিধান, আচার-বিধি, সাহিত্য-সংস্কৃতি, লাইফস্টাইল-সবই পালিত হবে কুরআন ও সুন্নাহ বর্ণিত পন্থায়। এতেই রয়েছে যাবতীয় কল্যাণের দিশা, মানবীয় সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের সঠিক পরিচর্যা। এর বিপরীতে যত পথ ও মত, যত বুযুর্গ ও আকাবির, যত মান্য ও শ্রদ্ধেয়- সবই অগ্রহণযোগ্য, মানবতা বিধ্বংসী ও অকল্যাণের দিশারী। তা আপাতঃদৃষ্টিতে যতই গ্রহণযোগ্য ও শ্রুতিমধুর হোক না কেন। সুতরাং নির্ভেজাল তাওহীদের বিশ্বাস এবং পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহর পূর্ণাঙ্গ অনুসরণের নামই হ’ল ইসলাম। এর বাইরে ইসলামের নামে যত পথ ও মতের দিকে আহবান করা হোক না কেন, তা কখনই প্রকৃত ইসলাম নয়; বরং ইসলামের নামে মিথ্যাচার ও প্রতারণা। এই বার্তাটুকুই আমরা এদেশের সকল মুসলমানের ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে চাই। তাদেরকে জানাতে চাই- ‘আসুন! পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে জীবন গড়ি’। ‘সকল বিধান বাতিল কর অহীর বিধান কায়েম কর’। কতজন এই দাওয়াত গ্রহণ করল বা না করল, তা আমাদের বিবেচ্য নয়; বরং কতজনের কাছে তা পৌঁছানো গেল সেটাই মূল বিবেচ্য।
এই দাওয়াতের ময়দানে যারা বার্তাবাহক হবেন, তাদের উদ্দেশ্যে আমাদের উদাত্ত আহবান হ’ল, যাবতীয় ষড়যন্ত্র-বিভ্রান্তি, অলসতা-বিলাসিতা দু’পায়ে দলে যার যতটুকু জ্ঞান, যোগ্যতা ও ক্ষমতা আছে সবটুকু ব্যয় করে সাধ্যমত মানুষের কাছে হকের দাওয়াত তুলে ধরুন। স্মরণ করুন আল্লাহর বাণী- ‘আর তার চেয়ে কার কথা উত্তম যে আল্লাহর দিকে আহবান জানায় এবং সৎকাজ করে। আর বলে, আমি তো আত্মসমর্পণকারী’ (মুসলিম) (হা-মীম সাজদাহ ৩৩)। অন্তরে জাগ্রত রাখুন রাসূল (ছাঃ)-এর সেই চিরন্তন প্রেরণাবাণী- ‘আল্লাহর কসম! তোমার দ্বারা যদি একটি মানুষও হেদায়েত লাভ করে, তা হবে তোমার জন্য (আরবের মূল্যবান সম্পদ) লাল উট লাভের চেয়ে উত্তম (বুখারী হা/৩৭০১; মুসলিম হা/২৪০৬)। সেই সাথে এই মহান দায়িত্ব পালনের জন্য বিশেষ কিছু গুণাবলীর অধিকারী হ’তে হবে। যেমন-
(১) লক্ষ্যের দৃঢ়তা এবং হকের উপর সদা ইস্তিকামাত থাকা। লক্ষ্যহীন ও দুর্বলচিত্ত মানুষ কখনও হকের দাওয়াত প্রচারের জন্য উপযুক্ত নয়। যিনি দাঈ হবেন, তাকে অবশ্যই লক্ষ্য সচেতন হ’তে হবে, সাহসী হ’তে হবে, আত্মবিশ্বাসী হ’তে হবে। কোন দুনিয়াবী স্বার্থে ও প্রলোভনে হক থেকে তার অবস্থান বিন্দুমাত্র নড়চড় হবে না। বাতিলের চাকচিক্য দেখে তিনি প্রতারিত হবেন না। বিপদ কিংবা সমস্যার ঘনঘটা তাকে লক্ষ্যভ্রষ্ট করবে না।
(২) নৈতিক চরিত্রের অধিকারী হওয়া। চারিত্রিক পবিত্রতা একজন দাঈর অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য। যে ব্যক্তি পাপ ও অন্যায় কাজ থেকে বাঁচার চেষ্টা করে না, কুপ্রবৃত্তিকে দমনে সতর্ক থাকে না, তাক্বওয়া অবলম্বন করে না, সে ব্যক্তি খুব সহজেই শয়তানের ফাঁদে আটকা পড়ে যায়। সুতরাং দাঈকে অবশ্যই দৃঢ় নৈতিক চরিত্রের অধিকারী হ’তে হবে।
শয়তানের হাত থেকে আত্মরক্ষার জন্য সদা সতর্ক প্রহরীর ভূমিকা পালন করতে হবে। যেখানে অনৈতিকতার হাতছানি, যেখানে পাপের সম্ভাবনা, সেখান থেকে নিজেকে যোজন যোজন দূরে রাখতে হবে।
(৩) সততা ও ন্যায়পরায়ণতা। এই গুণে গুণান্বিত ব্যক্তি পৃথিবীর সর্বত্রই সফল। যার মধ্যে উক্ত গুণাবলীর প্রভাব যত বেশী, সে লক্ষ্য অর্জনে তত বেশী সফল। সুতরাং দাঈর জন্য সর্বাবস্থায় সৎ, নীতিবান ও ন্যায়পরায়ণ থাকা অপরিহার্য।
(৪) ধৈর্য। বিপদসংকুল পৃথিবীতে প্রতিনিয়ত নানা মাত্রার প্রতিকূল পরিবেশ আমাদেরকে সদা আচ্ছন্ন করে। হতাশা, কষ্ট, ভয়-ভীতি আঁকড়ে ধরে। এমতাবস্থায় আমাদের রক্ষাকবচ অস্ত্র হ’ল ধৈর্য। ধৈর্যশীলতার একমাত্র পরিণাম সফলতা। সুতরাং একজন দাঈকে সমাজ সংস্কারের ময়দানে ধৈর্যশীলতার মূর্ত প্রতীক হ’তে হবে।
(৫) সদাচরণ। দাঈ যত জ্ঞানী বা পরহেযগার হোক না কেন, তার ভাষা ও আচরণ যদি হয় অসংযত, যদি তার অন্তর হয় অপরের প্রতি শুভকামনাহীন ও বিদ্বেষপরায়ণ; তার পক্ষে দাওয়াতী ময়দানে নামাই অর্থহীন। দাঈকে অবশ্যই সদাচরণকে রপ্ত করতে হবে। মানুষের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখার মত উত্তম গুণাবলীসম্পন্ন হতে হবে।
পরিশেষে কর্মী সম্মেলন ২০২১ উপলক্ষ্যে প্রাণপ্রিয় কর্মী ভাইদের প্রতি আমাদের আহবান থাকবে, অহীভিত্তিক বিশুদ্ধ ইসলামের বার্তাকে সমাজের সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়ার মিশনকে যেন আমরা আমাদের জীবনের মহত্তম লক্ষ্য বানিয়ে নেই এবং এই মহান সংস্কার আন্দোলনের যোগ্য কর্মী হিসাবে নিজেদের গড়ে তুলি। আমাদের সমাজ ও আমাদের পরিপার্শ্বকে আল্লাহর বিধান অনুযায়ী পরিচালনার জন্য সর্বাত্মক ভূমিকা গ্রহণ করি। বাংলার প্রতিটি ঘরে ঘরে যেন পৌঁছে যায় হকের আওয়াজ। বাংলার যমীন যেন একদিন পরিণত হয় বিশুদ্ধ দ্বীনের এক উর্বর চারণক্ষেত্রে। আল্লাহ রাববুল আলামীন আমাদেরকে সেই তাওফীক দান করুন এবং আমাদের সকলকে তাঁর দ্বীনের মর্দে মুজাহিদ হিসাবে কবুল করে নিয়ে জান্নাতের চিরশান্তির আবাসস্থলের অধিকারী হওয়ার তাওফীক দিন। আমীন!