ইসলামে নারীর অবস্থান
কামাল হোসাইন
যহীরুল ইসলাম 1152 বার পঠিত
ছালাত এমনই একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত যা সম্পাদনের জন্য প্রত্যেকের উপর জোরালো তাকীদ এসেছে। এটি সঠিকভাবে আদায়ের জন্য ইসলামে নির্দিষ্ট দায়বদ্ধতার পরিধিও রচিত হয়েছে। যেমন শাসকগণ প্রজাগণের উপর দায়িত্বশীল, পিতা পরিবার-পরিজন ও সন্তান-সন্তানাদির দায়িত্ব পালন করবে। প্রত্যেকের নিজ নিজ দায়িত্বশীলতার জন্য ইসলাম পুণ্য প্রাপ্তির নিশ্চয়তাও দিয়েছে। যে ব্যক্তির ছালাত যত সুন্দর ও পরিপাটি, সে ততই জান্নাতের পথে অগ্রগামী। কেননা বিচার দিবসে ছালাতই সকল ইবাদতের মানদন্ড হিসাবে বিবেচিত হবে। দৈনন্দিন পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত ইসলামের মূল স্তম্ভ, যা ছিন্ন হলে ইসলামের সর্বশেষ রশি ছিন্ন হবে। নিম্নে এ বিষয়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হ’ল-
১. ছালাত ইসলামের অন্যতম রুকন : হাদীছে এসেছে, ত্বালহা ইবনে উবায়দুল্লাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নাজদ (রিয়াদ এলাকার) অধিবাসীদের একজন আলুলায়িত কেশী রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট উপস্থিত হল। আমরা তার ভন ভন শব্দ শুনছিলাম, আর তার কথা বুঝতে পারছিলাম না। শেষ পর্যন্ত সে রাসূল (ছাঃ)-এর সন্নিকটে পৌঁছালো এবং (তখন বুঝলাম) সে ইসলাম সম্পর্কে প্রশ্ন করছে। রাসূল (ছাঃ) বললেন, (ইসলাম হল) خَمْسُ صَلَوَاتٍ فِى الْيَوْمِ وَاللَّيْلَةِ ‘পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত দিনে-রাতে’। সে বলল, তা ছাড়া আমার উপর অন্য ছালাত আছে কি? তিনি বললেন, না। তবে নফল আদায় করতে পার। এরপর রাসূল (ছাঃ) তাকে ছিয়াম ও যাকাত সম্পর্কে বললেন। ছালাতের ন্যায় একই রকম কথপোকথন হ’ল। অবশেষে বর্ণনাকারী বলেন, সেই ব্যক্তি এই বলে চলে গেলেন, وَاللَّهِ لاَ أَزِيدُ عَلَى هَذَا وَلاَ أَنْقُصُ আল্লাহর শপথ! আমি এর চেয়ে অধিকও করব না, কমও করব না। তখন রাসূল (ছাঃ) বললেন, أَفْلَحَ إِنْ صَدَقَ সে সফলকাম হবে যদি সে সত্য বলে থাকে’।[1]
২. ছালাত জান্নাতের পথ দেখায় ও জাহান্নাম থেকে বাঁচায় : হাদীছে এসেছে, আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, এক বেদুঈন নবী (ছাঃ) নিকটে এসে নিবেদন করল, হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে এমন এক আমলের কথা বলে দিন, যার উপর আমল করলে আমি জান্নাতে প্রবেশ করতে পারব। তিনি বলেন, تَعْبُدُ اللَّهَ لاَ تُشْرِكُ بِهِ شَيْئًا، وَتُقِيمُ الصَّلاَةَ الْمَكْتُوبَةَ، وَتُؤَدِّى الزَّكَاةَ الْمَفْرُوضَةَ، وَتَصُومُ رَمَضَانَ- ‘আল্লাহর ইবাদত করবে ও তার সাথে কোন কিছুকে শরীক করবে না। ছালাত কায়েম করবে, ফরয যাকাত আদায় করবে, রামাযানের ছিয়াম রাখবে’। তখন লোকটি রাসূল (ছাঃ)-এর উক্ত বক্তব্য শুনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে বলেন, সেই সত্তার শপথ! যার হাতে আমার জীবন বিদ্যমান, আমি এর চেয়ে বেশী করব না। অতঃপর সে পিঠ ফিরে চলতে লাগল। তখন নবী (ছাঃ) বললেন, مَنْ سَرَّهُ أَنْ يَنْظُرَ إِلَى رَجُلٍ مِنْ أَهْلِ الْجَنَّةِ فَلْيَنْظُرْ إِلَى هَذَا ‘যে ব্যক্তি জান্নাতবাসীদের কোন লোক দেখতে আগ্রহী, সে যেন এই লোকটিকে দেখে’।[2]
অপর এক হাদীছে এসেছে, মু‘আয বিন জাবাল (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমি এক সফরে রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে ছিলাম। একদিন ভোর বেলা আমি তার সাথে পথ অতিক্রমকালে তাকে বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে একটি কাজের কথা বলেন, যা আমাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে এবং জাহান্নাম থেকে দূরে রাখবে। তিনি বললেন, ‘তুমি বিরাট একটি বিষয়ে প্রশ্ন করলে। তবে এটা তার পক্ষে সহজ হবে, যার জন্য আল্লাহ সহজ করে দিবেন’। আর তা হ’ল- تَعْبُدُ اللَّهَ وَلَا تُشْرِكْ بِهِ شَيْئًا، وَتُقِيمُ الصَّلَاةَ، وَتُؤْتِي الزَّكَاةَ، وَتَصُومُ رَمَضَانَ، وَتَحُجُّ البَيْتَ ‘তুমি আল্লাহর ইবাদত করবে এবং তার কোন অংশী স্থাপন করবে না। ছালাত কায়েম করবে, যাকাত প্রদান করবে, রামাযানে ছিয়াম পালন করবে এবং কাবা ঘরে হজ্জ করবে।’ অতঃপর তিনি বললেন, তোমাকে কল্যাণের দ্বার সমূহ বলে দিব কি? তা হ’ল- الصَّوْمُ جُنَّةٌ، وَالصَّدَقَةُ تُطْفِئُ الخَطِيئَةَ كَمَا يُطْفِئُ المَاءُ النَّارَ، وَصَلَاةُ الرَّجُلِ مِنْ جَوْفِ اللَّيْلِ- ‘ছিয়াম হ’ল ঢাল স্বরূপ, আর ছাদাক্বা মিটিয়ে দেয় পাপ যেমন পানি নিভিয়ে দেয় অগ্নি। আর মধ্যরাতে মানুষের ছালাত (যখন মানুষ ঘুমিয়ে থাকে)। অতঃপর তিনি (তার কথার স্বপক্ষে) তেলাওয়াত করলেন, تَتَجَافَى جُنُوبُهُمْ عَنِ الْمَضَاجِعِ يَدْعُونَ رَبَّهُمْ خَوْفًا وَطَمَعًا وَمِمَّا رَزَقْنَاهُمْ يُنْفِقُونَ- فَلَا تَعْلَمُ نَفْسٌ مَا أُخْفِيَ لَهُمْ مِنْ قُرَّةِ أَعْيُنٍ جَزَاءً بِمَا كَانُوا يَعْمَلُونَ- ‘তারা তাদের শয্যা থেকে পিঠকে পৃথক করে তাদের প্রতিপালককে ডাকে আশায় ও আশংকায় এবং আমি তাদেরকে যে রিযিক দান করেছি তা হতে তারা ব্যয় করে। কেউ জানেনা তাদের জন্য নয়ন প্রীতিকর কী সকল লুক্কায়িত রাখা হয়েছে তাদের কৃত কর্মের পুরষ্কার স্বরুপ’ (সাজদাহ ৩২/১৬, ১৭)। অতঃপর বললেন, আমি তোমাকে সব বিষয়ের (দ্বীনের) মস্তক, তার খুঁটি ও তার উচ্চতম চূড়া বাতলে দেব নাকি? মু‘আয বললেন, হ্যাঁ (অবশ্যই বলেন) হে আল্লাহর রাসূল! তিনি বললেন, সমস্ত বিষয়ের মস্তক হ’ল ইসলাম, তার স্তম্ভ হ’ল ছালাত এবং উচ্চতম চূড়া হ’ল জিহাদ।[3]
৩. ছালাত শিক্ষাদানে দুনিয়ায় ফেরেশতার আগমন : ছালাত এতই গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত যে, রাসূল (ছাঃ)-কে ছালাতের বাস্তব প্রশিক্ষণ দিতে দুনিয়ায় আল্লাহ ফেরেশতা নামিয়ে দিয়েছেন ও হাতে কলমে শিখিয়েছেন। হাদীছে এসেছে, আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা রাসূল (ছাঃ) জনসমক্ষে উপবিষ্ট ছিলেন, এমন সময় তাঁর নিকটে এক ব্যক্তি এসে জিজ্ঞেস করল, ঈমান কি? তিনি বললেন, ঈমান হ’ল আপনি বিশ্বাস রাখবেন আল্লাহর প্রতি, তাঁর ফেরেশ্তাগণের প্রতি, তাঁর কিতাব সমূহের প্রতি, বিচার দিবসের প্রতি, তাঁর রাসূলগণের প্রতি, আপনি আরও বিশ^াস রাখবেন পুনরুত্থানের প্রতি। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ইসলাম কী? তিনি বললেন, الإِسْلاَمُ أَنْ تَعْبُدَ اللَّهَ وَلاَ تُشْرِكَ بِهِ، وَتُقِيمَ الصَّلاَةَ، وَتُؤَدِّىَ الزَّكَاةَ الْمَفْرُوضَةَ، وَتَصُومَ رَمَضَانَ ‘ইসলাম হ’ল আপনি আল্লাহর ইবাদত করবেন, আর তাঁর সাথে শিরক করবেন না। ছালাত প্রতিষ্ঠা করবেন, ফরয যাকাত আদায় করবেন, রামাযানে ছিয়াম পালন করবেন। এরপর আরও দু’টি প্রশণ করলেন, ইহসান ও ক্বিয়ামত সম্পকে’। অবশেষে যখন তিনি চলে গেলেন তখন রাসূল (ছাঃ) বললেন, তোমরা তাকে ফিরিয়ে আন। তারা তাকে খুঁজে পেল না। তখন তিনি বললেন, هَذَا جِبْرِيلُ جَاءَ يُعَلِّمُ النَّاسَ دِينَهُمْ- ‘ইনি জিব্রীল (আঃ), লোকদেরকে তিনি দ্বীন শেখাতে এসেছিলেন’।[4]
৪. ছালাত আল্লাহর নিকট সর্বাধিক প্রিয় আমল : ছালাত ইসলামের অন্যান্য সকল আমলের চেয়ে মহান আল্লাহর নিকট অধিকতর প্রিয় আমল। তাই ছালাতের ভুলভ্রান্তি কোনভাবেই গ্রহণীয় নয়। নবী করীম (ছাঃ)-কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল সর্বোত্তম আমল সম্পর্কে। তিনি বলেন, ‘কোন আমল আল্লাহর নিকট খুবই প্রিয়? তিনি বললেন, যথাসময়ে (ওয়াক্তমত) ছালাত আদায় করা। তিনি বললেন, তারপর কোন আমল? তিনি বললেন, পিতা-মাতার অনুগত হওয়া। তিনি বললেন, তারপর কোন আমল? তিনি বললেন, আল্লাহর পথে জিহাদ করা। তিনি বললেন, এ পর্যন্ত তিনি আমাকে বলেছেন। আমি যদি আরও জিজ্ঞাসা করতাম তাহলে তিনি আমাকে আরও বলতেন’।[5]
উপরোক্ত পাঁচটি প্রশ্নোত্তরে ছালাতের বিষয়টি মূখ্য, যা আমাদেরকে ছালাতের গুরুত্ব অনুধাবনের নির্দেশ দেয়। আওয়াল ওয়াক্তে ছালাত করার প্রেরণা যোগায়। আর চূড়ান্তভাবে জানিয়ে দেয় ঈমানের পর সর্বোত্তম ইবাদত ছালাত।
৫. ছালাত যুগে যুগে সৎকর্মশীল বান্দাগণের চিরাচরিত অভ্যাস :
বান্দা যখন ছালাত আদায় করে, তখন যেন সে তার রবের সাথে চুপি চুপি কথা বলে। রাসূল (ছাঃ)-একদিন বায়তুল্লায় ছালাত আদায় করছিলেন। এমতাবস্থায় মক্কার কাফেরেরা তাকে উটের ভুঁড়ি চাপা দিয়ে মেরে ফেলতে চেয়েছিল। কারণ কাফেররা জানত যে, মুহাম্মাদ (ছাঃ) ছালাতে বেখবর নিমগ্ন হয়ে যেতেন। ফলে তারা এই সুযোগটাই কাজে লাগাতে চেয়েছিল। অবশেষে যে মহান আল্লাহর প্রতি তাঁর এতটা ভালোবাসা ও নিগূঢ় প্রেম, সেই প্রভুর ইচ্ছাই বাস্তবায়িত হয়েছিল। কাফেরদের চক্রান্ত ভন্ডুল হয়ে গিয়েছিল। শুধু রাসূল (ছাঃ) নয়, সকল ছাহাবী, তাবেঈ, তাবে-তাবেঈসহ পূর্বেকার সকল আম্বিয়ায়ে কেরামের মাঝে ছালাতের পাবন্দীর গুণ যুগে যুগে অক্ষুণ্ণ ছিল। নিম্নে এর কিছু দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করা হ’ল-
ইবরাহীম (আঃ)-এর ছালাতের প্রতি অনুরাগ : দূর অতীতে যখন মক্কায় ইবরাহীম (আঃ) তার বৃদ্ধ বয়সের একমাত্র প্রাণপ্রিয় দুগ্ধপোষ্য পুত্র ইসমাঈল (আঃ) ও স্ত্রী হাযেরাকে কা‘বাতে আল্লাহর নির্দেশে রেখে যান, সে সময় ইসমাঈলের মা তাকে অনুসরণ করে বহুবার জিজ্ঞাসা করছিলেন ‘হে ইবরাহীম! আপনি কোথায় যাচ্ছেন আমাদের এই উপত্যাকায় রেখে, যেখানে কোন জনমানব নেই, নেই কোন জীবনোপকরণ? কিন্তু তিনি তার দিকে একবারও ফিরে তাকালেন না। অবশেষে ব্যর্থ ব্যাকুলতায় পুনরায় জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কি আল্লাহর নির্দেশে এরূপ করছেন? তখন ইবরাহীম (আঃ) শুধুমাত্র একটি শব্দ উচ্চারণ করলেন, হ্যাঁ। এই কথা শুনে ইসমাঈলের মা বলে উঠলেন, তাহলে আল্লাহ আমাদের ধ্বংস করবেন না এবং ফিরে গেলেন যেখানে ইবরাহীম (আঃ) তাকে রেখে আসছিলেন। ব্যাথা ভারাক্রান্ত ইবরাহীম (আঃ) যখন ছানিয়ার (মদীনার নিকটবর্তী একটি স্থান মদীনার উপকন্ঠে) পৌঁছলেন, যেখান থেকে তাদের আর দেখা যায় না, তখন কিবলামুখী হয়ে দু’হাত আল্লাহর দিকে উঠালেন, তাদের জন্য দীর্ঘ প্রার্থনা করলেন। তিনি প্রার্থনার মধ্যে যতকিছু তাদের কল্যাণ কামনায় ব্যক্ত করলেন তার মধ্যে অন্যতম হ’ল তারা যেন ছালাত কায়েম করে, যা সূরা ইবরাহীমের ৩৫-৪০ নং আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। ছালাতের বিষয়টি তাঁর প্রার্থনায় দু’বার উল্লেখিত হয়েছে’।[6] মহান আল্লাহ বলেন, رَبَّنَا إِنِّي أَسْكَنْتُ مِنْ ذُرِّيَّتِي بِوَادٍ غَيْرِ ذِي زَرْعٍ عِنْدَ بَيْتِكَ الْمُحَرَّمِ رَبَّنَا لِيُقِيمُوا الصَّلَاةَ- ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমি আমার এক সন্তানকে তোমার এ পবিত্র (কা‘বা) গৃহের সন্নিকটে চাষাবাদহীন উপত্যকায় বসবাসের জন্য রেখে এসেছি। হে আমাদের পালনকর্তা! যেন তারা ছালাত কায়েম করে।
অতঃপর তিনি সর্বশেষে আবারও বললেন, رَبِّ اجْعَلْنِي مُقِيمَ الصَّلَاةِ وَمِنْ ذُرِّيَّتِي رَبَّنَا وَتَقَبَّلْ دُعَاءِ ‘হে আমার প্রতিপালক! আমাকে ছালাত কায়েমকারী কর এবং আমার সন্তানদের মধ্য থেকেও। হে আমাদের পালনকর্তা! আমার দো‘আ কবুল কর!’ (ইবরাহীম ১৪/৪০)। তিনি ঐ কষ্ঠদায়ক মুহূর্তেও ছালাতকে ভুলেননি। তারই ফলশ্রুতিতে ইসমাঈল (আঃ) স্বীয় পরিবারে ছালাত প্রতিষ্ঠা করে মহান রবের রেযামন্দী অর্জন করেন। পরবর্তীতে তাঁর দো‘আর স্বীকৃতি স্বরূপ আল্লাহ বলেন, وَاذْكُرْ فِي الْكِتَابِ إِسْمَاعِيلَ إِنَّهُ كَانَ صَادِقَ الْوَعْدِ وَكَانَ رَسُولًا نَبِيًّا- وَكَانَ يَأْمُرُ أَهْلَهُ بِالصَّلَاةِ وَالزَّكَاةِ وَكَانَ عِنْدَ رَبِّهِ مَرْضِيًّا- ‘স্মরণ কর এই কিতাবে উল্লেখিত ইসমাঈলের কথা। সে তো ছিল প্রতিশ্রুতি পালনে সত্যাশ্রয়ী এবং সে ছিল রাসূল ও নবী। সে তার পরিবারবর্গকে ছালাত ও যাকাতের নির্দেশ দিত এবং সে ছিল তাঁর প্রতিপালকের সন্তোষভাজন’ (মারিয়াম ১৯/৫৪-৫৫)।
মুহাম্মাদ (ছাঃ) ছালাতকে যেভাবে মহববত করতেন : রাসূল (ছাঃ) একদিন একান্ত পারিবারিক আলাপে তাঁর তিনটি সর্বাধিক পসন্দনীয় বিষয় ব্যক্ত করলেন। যার অন্যতম একটি ছালাত। আর তার এই পসন্দের বিষয়টি যদি আমরা পর্যালোচনা করি তাহলে তার গোটা নবুঅতী যিন্দেগীতে পুঙখানুপুঙ্খ প্রমাণ পাওয়া যাবে। যেমন এই ছালাতকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে তিনি তায়েফে মার খেয়েছেন। অনুকুল পরিবেশে তিনি ছালাত এতই দীর্ঘ করতেন যে, তাঁর দু’পা ফুলে যেত। রাসূল (ছাঃ)-এর ছালাতের প্রতি মহববতের প্রগাঢ়তা ছিল অত্যন্ত প্রবল, যা ছিল ঐকান্তিক ও স্বতঃস্ফূর্ত। যার বাস্তব নমুনা তাঁর মুমূর্ষুকালীন অবস্থাতেও প্রস্ফূটিত হয়েছে। রাসূল (ছাঃ)-এর জীবনের অন্তিম মুহূর্তেও ছালাত ছালাত বলে জাতিকে হুঁশিয়ার করেছেন।
রাসূল (ছাঃ)-এর জামা‘আতে আসার আগ্রহ বুঝতে পেরে আবুবকর (রাঃ) পিছিয়ে আসতে চান। কিন্তু আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ইশারায় তাঁকে থামিয়ে দেন এবং দরজার পর্দা ঝুলিয়ে দেন।[7] সোমবার ফজরের জামা‘আত চলা অবস্থায় আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ঘরের পর্দা উঠিয়ে একদৃষ্টে মসজিদে জামা‘আতের দিকে তাকিয়ে থাকেন। কিন্তু রাসূল (ছাঃ)-এর ভাগ্যে যোহরের ওয়াক্ত আসার সুযোগ আর হয়নি। উল্লেখ্য যে, মৃত্যুর চার দিন পূর্বে বৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃহস্পতিবার তিনি সর্বশেষ ইমামতি করেন মাগরিবের ছালাত আদায় করেন। অসুখ বৃদ্ধি পাওয়াতে এশার ছালাত থেকে আর ইমামতি করতে পারেন নি। তবুও তাঁর সর্বশেষ প্রচেষ্টা অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী। তিনি তিন তিনবার করে এশার ছালাতের জন্য ওযূ করেন ও অজ্ঞান হয়ে যান। রাসূল (ছাঃ) স্বয়ং ছালাতের মহববতে পাগলপারা ছিলেন। তিনি বলেন, حُبِّبَ إِلَىَّ مِنَ الدُّنْيَا النِّسَاءُ وَالطِّيبُ وَجُعِلَ قُرَّةُ عَيْنِى فِى الصَّلاَةِ. ‘সুগন্ধি ও নারীকে আমার কাছে অতি প্রিয় করে দেয়া হয়েছে। আর আমার চোখের শীতলতা রাখা হয়েছে ছালাতের মধ্যে’।[8]
আবু বকর (রাঃ)-এর ছালাতের ব্যাপারে ছিলেন দৃঢ়চিত্ত : রাসূল (ছাঃ)-এর ওফাতের পর তিনিই দৃঢ়চিত্ত হয়ে ইসলামী খিলাফতের হাল ধরেন এবং ইসলামী বিধানাবলী অস্বীকারীদের বিরুদ্ধে রীতিমত জিহাদ ঘোষণা করেন। তিনি দৃপ্ত কন্ঠে বলেন ঘোষণা করেন, وَاللَّهِ لأُقَاتِلَنَّ مَنْ فَرَّقَ بَيْنَ الصَّلاَةِ وَالزَّكَاةِ- ‘আল্লাহর শপথ! ‘যে ব্যক্তি ছালাত ও যাকাত এর মাঝে পার্থক্য করবে আমি তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব’।[9] এখন আমরা বলছি ঈমানের পর ছালাত আদায়কারী যাকাত দিতে শৈথিল্য করার প্রেক্ষিতে যদি আবু বকর (রাঃ) এরূপ কঠোর হন। তাহলে ঈমানের পর ছালাত আদায়ে কেউ শৈথিল্য দেখালে তিনি কতটাই না ক্রোধান্বিত হতেন! এই ঘটনার প্রেক্ষিতে ওমর (রাঃ) বলেন, فَوَاللَّهِ مَا هُوَ إِلاَّ أَنْ رَأَيْتُ اللَّهَ قَدْ شَرَحَ صَدْرَ أَبِى بَكْرٍ لِلْقِتَالِ فَعَرَفْتُ أَنَّهُ الْحَقُّ ‘আল্লাহর শপথ! অচিরেই আমি দেখলাম যে, ‘নিঃসন্দেহে আল্লাহ আবু বকরের হৃদয়কে যুদ্ধের জন্য প্রশস্ত করেছেন। সুতরাং আমি বুঝতে পারলাম যে, তাঁর সিদ্ধান্তই যথার্থ’।[10]
ওমর (রাঃ)-এর ছালাতের প্রতি মহববত : ওমর (রাঃ) ছালাতকে অত্যন্ত মহববত করতেন। একদিকে তিনি ছিলেন শাহাদাৎপিয়াসী অন্য দিকে তিনি দো‘আ করতেন তিনি যেন মদীনাতেই মৃত্যুবরণ করেন। আল্লাহ তার দু’টি দো‘আই কবুল করেন। একদা মসজিদে নববীতে ফজরের ছালাতে ইমামতিকালীন সময় আবু লু-লু নামের কুখ্যাত খারেজী তাঁকে ছুরির আঘাতে আহত করে ফেলে। তখন তিনি বলেন, আমাকে কোন কুত্তায় কামড় মেরেছে? অতঃপর তিনি বসে ছালাত সম্পাদনের শেষ চেষ্টা করেন এবং অবশেষে তিনি অন্যজনকে ইমামতির দায়িত্ব দেন। কিন্তু প্রচন্ডভাবে জখম হওয়ার ফলে রক্তক্ষরণের এক পর্যায়ে তিনি বেহুঁশ হয়ে যান। এদিকে আবু লুলু ধরা পড়ে যাওয়া মাত্রই আত্মহত্যা করে ফেলে। অতঃপর ছালাতের জামা‘আত সম্পন্ন হয়। ওমর (রাঃ)-এর যখন চেতনা ফিরে আসল, তখন যে কথা তিনি বলেছিলেন তা হল, মুসলিমদের ইমাম কি ছালাত সম্পন্ন করেছে? আল্লাহু আকবার! এ কেমন মহববত! আর কেনইবা এই মহববত ছালাতের প্রতি সকল সৎকর্মশীল বান্দাগণের? ছালাত প্রতিষ্ঠার জন্য জীবনের শেষ মুহূর্তে পর্যন্ত তিনি এক ঈর্ষণীয় অনুরাগের অনুপম ইতিহাস আমাদের জন্য রচনা করে গেলেন’।[11]
উপরোক্ত ইতিহাস সমূহ আমাদের ছালাতের প্রতি আন্তরিক হবার আহবান জানায়। সাথে সাথে জানিয়ে দেয় ছালাতের অপরিসীম গুরুত্বের কথা। এমনিভাবে কুরআন ও হাদীছের নির্দেশনা বলী এবং বর্ণনারীতি ছালাতের অপরিহার্যতা প্রকাশ করে। (ক্রমশঃ)
যহীরুল ইসলাম
লেখক: দাওরা ১ম বর্ষ, আল মারকাযুল ইসলামী আস সালাফী নওদাপাড়া, রাজশাহী
[1]. বুখারী হা/৪৬ ।
[2]. আহমাদ হা/৮৩১০; বুখারী হা/১৩৯৭; মুসলিম হা/১৮।
[3]. আহমাদ হা/ ২১৫১১; তিরমিযী হা/২৬১৬, ইবনু মাজাহ হা/ ৩৯৭৩।
[4]. বুখারী হা/৫০, ৪৭৭৭; মুসলিম হা/৯ ।
[5]. বুখারী হা/ ৫২৭; মুসলিম হা/ ৮৫।
[6]. বুখারী হা/৩০৮৩; আবু দাউদ হা/২৭৮১।
[7]. সীরাতুর রাসূল (ছাঃ) পৃ: ৭৪১।
[8]. নাসাঈ হা/৩৯৩৯; মিশকাত হা/৫২৬১।
[9]. বুখারী হা/১৪০০; মিশকাত হা/১৭৯০।
[10]. বুখারী হা/৭২৮৫, ১৪০০; মুসলিম হা/২০; তিরমিযী হা/ ২৬০৭; নাসাঈ হা/২৪৪৩।
[11]. বুখারী হা/ ১৮৯০।