নফল ইবাদতের গুরুত্ব
জাহিদুল ইসলাম
আসাদ বিন আব্দুল আযীয 646 বার পঠিত
প্রথম তওবা : হযরত আদম ও হাওয়া (আঃ) শয়তানের প্ররোরচনায় ভুল করার পর প্রথম তওবা করেছিলেন। মহান আল্লাহ তাদের ভুল স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন,أَلَمْ أَنْهَكُمَا عَنْ تِلْكُمَا الشَّجَرَةِ وَأَقُلْ لَكُمَا إِنَّ الشَّيْطَانَ لَكُمَا عَدُوٌّ مُبِينٌ ‘আমি কি এই বৃক্ষ থেকে তোমাদের নিষেধ করিনি? আর আমি কি তোমাদের একথা বলিনি যে, শয়তান তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু?(আরাফ ৭/২২)।
এরপর তারা যা করেছিলেন, فَتَلَقَّى آدَمُ مِنْ رَبِّهِ كَلِمَاتٍ ‘অতঃপর আদম স্বীয় পালনকর্তার নিকট হ’তে কিছু কথা শিখে নিল’ (বাক্বারাহ ২/৩৭)। অতঃফর অনুতপ্ত হয়ে চমৎকার একটি দো‘আ মহান প্রভুর কাছে করেছিলেন। পবিত্র কুরআনের ভাষায়- رَبَّنَا ظَلَمْنَا أَنْفُسَنَا وَإِنْ لَمْ تَغْفِرْ لَنَا وَتَرْحَمْنَا لَنَكُونَنَّ مِنَ الْخَاسِرِينَ ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা আমাদের নিজেদের উপর যুলুম করেছি। এক্ষণে যদি আপনি আমাদের ক্ষমা না করেন ও দয়া না করেন, তাহ’লে অবশ্যই আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ব’(আ‘রাফ ৭/২৩)।
এরপর আল্লাহ তাদের তওবা কবুল করে তাদের ক্ষমা করে দিলেন। মহান আল্লাহ বলেন,فَتَابَ عَلَيْهِ إِنَّهُ هُوَ التَّوَّابُ الرَّحِيمُ ‘অতঃপর তিনি তার তওবা কবুল করলেন। নিশ্চয়ই তিনি অধিক তওবা কবুলকারী ও দয়াময়’(বাক্বারাহ ২/৩৭)।[1]
প্রথম খাৎনা : মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইবরাহীম (আঃ) প্রথম নিজের খাৎনা নিজে করেছিলেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,اخْتَتَنَ إِبْرَاهِيمُ عَلَيْهِ السَّلاَمُ وَهْوَ ابْنُ ثَمَانِينَ سَنَةً بِالْقَدُّومِ ‘ইবরাহীম (আঃ) ৮০ বছর বয়সের পর কাদুম নামক স্থানে নিজেই নিজের খাৎনা করেন’।[2]
প্রথম মেহমানদারী : মহৎ গুণসমূহের মধ্য থেকে অন্যতম একটি গুণ হ’ল- মেহমানদারিতা। আর এই মহৎ কাজটি প্রথম কে করেছিলেন সম্পর্কে হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত হাদীছে রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, أول من أضَاف الضَّيْف إِبْرَاهِيم ‘প্রথম মেহমানদারী করেছিলেন ইবরাহীম (আঃ)’।[3]
মক্কায় প্রথম বসতি স্থাপন : মক্কায় প্রথম বসতি স্থাপন করেন মা হাযেরা এবং পুত্র ইসমাঈল (আঃ)। বুখারীর দীর্ঘ হাদীছে এসেছে, ...ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, নবী (ছাঃ) বলেছেন, ইসমাঈলের মাকে আল্লাহ রহম করুন। যদি তিনি বাঁধ না দিয়ে যমযমকে এভাবে ছেড়ে দিতেন কিংবা বলেছেন, যদি কোষে ভরে পানি মশকে জমা না করতেন, তাহ’লে যমযম একটি কূপ না হয়ে একটি প্রবাহমান ঝর্ণায় পরিণত হ’ত। রাবী বলেন, তারপর হাযেরা (আঃ) পানি পান করলেন, আর শিশু পুত্রকেও দুধ পান করালেন। তখন ফেরেশতা তাঁকে বললেন, আপনি ধ্বংসের কোন আশংকা করবেন না। কেননা এখানেই আল্লাহর ঘর রয়েছে। এ শিশুটি এবং তাঁর পিতা দু’জনে এখানে ঘর নির্মাণ করবেন এবং আল্লাহ তাঁর আপনজনকে কখনও ধ্বংস করেন না। ঐ সময় আল্লাহর ঘরের স্থানটি যমীন থেকে টিলার ন্যায় উঁচু ছিল। বন্যা আসার ফলে তাঁর ডানে-বামে ভেঙ্গে যাচ্ছিল। এরপর হাযেরা (আঃ) এভাবেই দিন যাপন করছিলেন। অবশেষে (ইয়ামান দেশীয়) জুরহুম গোত্রের একদল লোক তাদের কাছ দিয়ে অতিক্রম করছিল, অথবা রাবী বলেন, জুরহুম পরিবারের কিছু লোক কাদা নামক উঁচু ভুমির পথ ধরে এদিক আসছিল। তারা মক্কার নিচু ভুমিতে অবতরণ করল এবং তারা দেখতে পেল একঝাঁক পাখি চক্রাকারে উড়ছে। তখন তারা বলল, নিশ্চয় এ পাখিগুলো পানির উপর উড়ছে। আমরা এ ময়দানের পথ হয়ে বহুবার অতিক্রম করেছি। কিন্তু এখানে কোন পানি ছিল না। তখন তারা একজন কি দু’জন লোক সেখানে পাঠালো। তারা সেখানে গিয়েই পানি দেখতে পেল। তারা সেখান থেকে ফিরে এসে সকলকে পানির সংবাদ দিল। সংবাদ শুনে সবাই সেদিকে অগ্রসর হ’ল। রাবী বলেন, ইসমাঈল (আঃ)-এর মা পানির নিকট ছিলেন। তারা তাঁকে বলল, আমরা আপনার নিকটবর্তী স্থানে বসবাস করতে চাই। আপনি আমাদেরকে অনুমতি দিবেন কি? তিনি জবাব দিলেন, হ্যাঁ। তবে, এ পানির উপর তোমাদের কোন অধিকার থাকবে না। তারা হ্যাঁ, বলে তাদের মত প্রকাশ করল। ইবনু আববাস(রাঃ) বলেন, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, এ ঘটনা ইসমাঈলের মাকে একটি সুযোগ এনে দিল। আর তিনিও মানুষের সাহচর্য চেয়েছিলেন। এরপর তারা সেখানে বসতি স্থাপন করল এবং তাদের পরিবার-পরিজনের নিকটও সংবাদ পাঠাল। তারপর তারাও এসে তাদের সাথে বসবাস করতে লাগল। পরিশেষে সেখানে তাদের কয়েকটি পরিবারের বসতি স্থাপিত হ’ল।[4]
প্রথম বৃদ্ধ : ইবরাহীম (আঃ)
ইসমাঈল বিন আয়াশ বলেন, প্রথম বৃদ্ধ হয়েছিলেন হযরত ইবরাহীম (আঃ)। তিনি যখন তার শুভ্রতা দেখলেন তখন তিনি বললেন, হে আমার প্রতিপালক! এটা কি? তখন আল্লাহ বলেন, এটা وَقَارٌ (ওয়াকার) ‘মর্যাদা’। এরপর ইবরাহীম (আঃ) বললেন, হে আল্লাহ আপনি আমার ‘ওয়াকার’ মর্যাদা বৃদ্ধি করে দিন’।[5] তিনি তাঁর সর্বপ্রথম শুভ্রতা অনুভব করেছিলেন তাঁর দাঁড়িতে’।[6]
চুল দাড়ি সাদা হওয়ার ফযীলত সম্পর্কে রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, لَا تَنْتِفُوا الشَّيْبَ فَإِنَّهُ نُورُ الْمُسْلِمِ مَنْ شَابَ شَيْبَةً فِي الْإِسْلَامِ كَتَبَ اللَّهُ لَهُ بِهَا حَسَنَةً، وَكَفَّرَ عَنْهُ بِهَا خَطِيئَةً وَرَفَعَهُ بِهَا دَرَجَةً ‘তোমরা সাদা চুলগুলো উপড়িয়ে ফেলো না। কেননা এটা মুসলিমদের জন্য নূর। বস্তুতঃ ইসলামের মধ্যে থাকা অবস্থায় যে ব্যক্তির একটি পশম সাদা হবে, এটার ওয়াসীলায় আল্লাহ তা‘আলা তার জন্য একটি নেকী লিপিবদ্ধ করবেন এবং তার একটি গুনাহ মুছে ফেলবেন এবং তার একটি দরজা বুলন্দ করবেন’।[7]
প্রথম গোফ ছোটকারী : সাঈদ ইবন মুসাইব (রহঃ) বলেছেন, كَانَ إِبْرَاهِيمُ خَلِيلُ الرَّحْمَنِ أَوَّلَ النَّاسِ ضَيَّفَ وَأَوَّلَ النَّاسِ اخْتَتَنَ وَأَوَّلَ النَّاسِ قَصَّ شَارِبَهُ ‘ইবরাহীম (আঃ) সর্বপ্রথম মেহমানদারী করেছেন, সর্বপ্রথম খাৎনা করেছেন এবং সর্বপ্রথম গোঁফ কেটেছেন’।[8]
প্রথম ইবরাহীমী দ্বীন পরিত্যাগকারী : প্রথম ইবরাহীমী একনিষ্ঠ দ্বীন পরিত্যাগকারী সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, সে হ’ল- আমর বিন লুহাই বিন ক্বমআ বিন জিনদিফ বিন মুজা‘আ।[9]
প্রথম(أَمَّا بَعْدُ) আম্মা বা‘দ এর প্রচলনকারী : স্পষ্ট ভাষা দ্বীন প্রচারের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য একটি বিষয়। বক্তব্যের ক্ষেত্রে ‘আম্মা বা‘দ’ এর প্রচলন সম্পর্কে রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, أَوَّلُ مَنْ قَالَ أَمَّا بَعْدُ دَاوُدُ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَهُوَ فَصْلُ الْخطاب ‘আম্মা বা‘দ বলা প্রথম ব্যক্তি হলেন দাঊদ (আঃ)। তিনি ছিলেন স্পষ্টভাষী বাগ্মী’।[10]
প্রথম বায়তুল মুকাদ্দাস মসজিদ নির্মাণ : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, সুলায়মান ইবনু দাঊদ (আঃ) যখন বায়তুল মুকাদ্দাস নির্মাণ করলেন, তখন তিনি আল্লাহ তা‘আলার কাছে তিনটি বস্ত্ত চাইলেন, (১) এমন ফয়ছালা, যা তাঁর ফয়ছালার মত হয়। তা তাঁকে প্রদান করা হ’ল। (২) এমন রাজ্য, যার অধিকারী তারপর আর কেউ হবে না। তাও তাঁকে দেয়া হ’ল। আর যখন তিনি মসজিদ নির্মাণের কাজ সমাপ্ত করলেন তখন তিনি আল্লাহ তা‘আলার নিকট প্রার্থনা করলেন, যে ব্যক্তি তাতে ছালাতের জন্য আগমন করবে, তাকে যেন পাপ থেকে ঐদিনের মত মুক্ত করে দেন, যেদিন সে তার মাতৃগর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হয়েছিল’।[11]
প্রথম বিসমিল্লাহ লেখা : ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, প্রথম ব্যক্তি হিসাবে ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম’ লিখেছিলেন হযরত সুলাইমান (আঃ)।[12] ইবনু জুরায়েয বলেন, সুলাইমান বিন দাঊদ (আঃ) তিনি চিঠিপত্রে বৃদ্ধি করেছিলেন যা মহান আল্লাহ বলেছেন, إِنَّهُ مِنْ سُلَيْمَانَ وَإِنَّهُ بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ ‘এটা সুলায়মানের পক্ষ হ’তে। আর তা হ’ল, পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে (শুরু করছি)’(নামল ২৭/৩০)।[13]
বনু ইস্রাইলীদের প্রথম ফিৎনা : বনু ইস্রাইল জাতি মহান প্রভুর পক্ষ থেকে নানাবিধ ফিৎনার সম্মুখীন হয়েছিল। তন্মধ্যে প্রথম ফিৎনা হ’ল- নারী। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,الدُّنْيَا حُلْوَةٌ خَضِرَةٌ وَإِنَّ اللهَ مُسْتَخْلِفُكُمْ فِيهَا فَيَنْظُرُ كَيْفَ تَعْمَلُونَ فَاتَّقُوا الدُّنْيَا وَاتَّقُوا النِّسَاءَ فَإِنَّ أَوَّلَ فِتْنَةِ بَنِي إِسْرَائِيلَ كَانَتْ فِي النِّسَاءِ ‘দুনিয়া টাটকা মিষ্ট ফলের মত লোভনীয়। আল্লাহ তা‘আলা সেখানে তোমাদের খলীফা হিসাবে পাঠিয়েছেন। তিনি দেখতে চান যে, তোমরা কি কর? তোমরা দুনিয়া ও নারী থেকে সাবধান থাক। কেননা বনী ইস্রাঈলদের মধ্যে যে প্রথম ফিৎনা দেখা দিয়েছিল তা ছিল নারীকে কেনদ্র করে’।[14]
প্রথম মুছাফাহা প্রচলন : প্রথম মুছাফাহা করার প্রচলন শুরু করেছিল ইয়ামনবাসী। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, তোমরা ইয়ামনবাসীর নিকট থেকে এসেছ। তারা নরম হৃদয়ের অধিকারী। তারাই প্রথম মুছাফাহা প্রচলন চালু করেছে।[15] ইয়ামনবাসীর মর্যাদা সম্পর্কে হাদীছে এসেছে, يَدْخُلُ الْجَنَّةَ أَقْوَامٌ أَفْئِدَتُهُمْ مِثْلُ أَفْئِدَةِ الطَّيْرِ ‘এমন কতিপয় লোক জান্নাতে যাবে, যাদের হৃদয় পাখীর হৃদয়ের ন্যায়’।[16] (ক্রমশঃ)
আসাদ বিন আব্দুল আযীয
লেখক : সহকারী সম্পাদক, তাওহীদের ডাক
[1]. হাকেম হা/২৫৪৫; তাফসীরে তাবারী ১/২৪৩ পৃ.; তারিখে ইবনু আসাকির ৭/৪৩৩ পৃ:।
[2]. বুখারী হা/৩৩৫৬; মুসিলম হা/২৩৭০; মিশকাত হা/৫৭০৩।
[3]. মুয়াত্তা হা/৯২২; ছহীহুল জামে‘ হা/৪৪৫১।
[4]. বুখারী হা/৩১৮৪; নাসাঈকুবরা ৮৩৭৯; আব্দুর রাযযাক হা/৯১০৭; আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া ১/১৫৪।
[5]. আল-মুহাযারা ৩২ পৃঃ; কাশফুল খাফা ১/১৩২ পৃঃ।
[6]. আল-মুহাযারা ৩২ পৃঃ; কাশফুল খাফা ১/১৩২ পৃঃ।
[7]. আবুদাঊদ হা/৪২০২; মিশকাত হা/৪৪৫৮।
[8]. মুয়াত্তা হা/১৬৭৭; বায়হাক্বী হা/৬৩৯২; মিশকাত হা/৪৪৮৮।
[9]. কানযুল উম্মাহ ১২/৮২ পৃঃ; তাইসীরুল উসূল ১/১২২; ফৎহুল বারী ৮/২৮৫; আল ফৎহুল কাবীর ১/২৭৯ পৃঃ।
[10]. কাশফুল খাফা ১/২২৩ পৃঃ; কানযুল উম্মাহ হা/২৯২৯২; ফৎহুল বারী ৬/৪৫৬; ইবনু জারীর ৩/৫৩৩, তিনি ছহীহ সনদে বর্ণনা করেছেন।
[11]. নাসাঈ হা/৬৯৩; ইবনু মাজাহ হা/১৪০৮; ইবনু খুজায়মা হা/১৩৩৪; ইবনু হিববান হা/১৬৩৩।
[12]. সীয়ারু আলামিন নুবালা ১/২৬০ পৃঃ; ছুবহুল আশা ১/৪২২ পৃঃ।
[13]. ফাজায়িলুল কুরআন লি ইবনু উবাইদ ৪৫২ পৃ; কুরতুবী ১/৯২ পৃঃ।
[14]. মুসলিম হা/২৭৪২; ইবনু মাজাহ; মিশকাত হা/৩০৮৬।
[15]. আদাবুল মুফরাদ, (ইমাম বুখারী) হা/৯৬৭; আলবানী হাদীছটিকে ছহীহ বলেছেন।
[16]. মুসলিম হা/২৮৪৯; মিরকাত ৯/৩৫৮৪ পৃঃ. মিশকাতের ৫৬২৫ নং হাদীছের ব্যাখ্যা দ্র.।