অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম
আসাদ বিন আব্দুল আযীয
[আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ-এর রাজশাহী সদর সাধারণ সম্পাদক মাওলানা দুর্রুল হুদা (৫১)। রাজশাহী যেলার মোহনপুর উপযেলার ধূরইল ডি. এস. কামিল মাদ্রাসার ভাইস প্রিন্সিপাল হিসাবে দায়িত্ব পালন করার পাশাপাশি দীর্ঘ প্রায় তিন দশক যাবৎ তিনি অত্র অঞ্চলে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ ভিত্তিক সমাজ সংস্কার আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ খেদমত আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন। রাজশাহী মোহনপুর ও তানোর উপযেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে রয়েছে তাঁর বিস্তৃত পদচারণা। তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের দুয়ারে দুয়ারে হকের দাওয়াত পৌঁছে দিতে তিনি ইখলাছের সাথে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে আসছেন। তাঁর কর্মমুখর সাংগঠনিক জীবন সম্পর্কে জানার জন্য সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন তাওহীদের ডাক-এর নির্বাহী সম্পাদক ড. মুখতারুল ইসলাম]
তাওহীদের ডাক :আপনার জন্মসন ও জন্মস্থান সম্পর্কে জানতে চাই।
মাওলানা দুর্রুল হুদা : আমার জন্ম বর্তমান নওগাঁ যেলার নিয়ামতপুর উপযেলার হাজীনগর ইউনিয়নের মাকলাহাট গ্রামে। যুদ্ধের আগের বছর ১৯৭০ সালে আমার জন্ম।
তাওহীদের ডাক :আপনার শিক্ষাজীবন সম্পর্কে আমরা জানতে চাই।
মাওলানা দুর্রুল হুদা : আমি তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত গ্রামের সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়েছি। এরপর ভর্তি হই নওগাঁ ঐতিহ্যবাহী আলাদীপুর দারুল হুদা সালাফিইয়াহ মাদরাসায়। মাওলানা আব্দুল মান্নান আনছারী (আল্লাহ তাকে জান্নাতবাসী করুন!) মাদ্রাসার কালেকশনের জন্য মাকলাহাটে আসেন। উনার সাথে আমার আববার পূর্ব-পরিচয়ের সুবাদে আলাদীপুর মাদরাসায় ভর্তি হই। আলাদীপুরে কিছুদিন পড়ার পর আবার গ্রামেই ভর্তি হই। যতদূর মনে পড়ে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান মারা যাওয়ার বছর আমি মাকলাহাটে হেদায়াতুন্নাহু পড়ছিলাম। কাকনহাটের পাশে রাজারামপুরের একটি মাদ্রাসাতেও কিছুদিন পড়ি। ১৯৮৭ সালে আমি দাখিল পরীক্ষা দেই মাকলাহাট থেকে। অতঃপর আলাদীপুর মাদ্রাসা থেকে ১৯৮৮ সালের মে মাসে আমি দাওরায়ে হাদীছ শেষ করি। কওমী ধারা শেষ করার পর ১৯৮৯ আমি সালে রাজশাহী দারুস সালাম কামিল মাদরাসা থেকে আলিম ও ফাযিল পাশ করি। তারপর ১৯৯৩ সালে হাদীছ বিভাগ থেকে কামিল পাশ করি। পরবর্তীতে ১৯৯৫ সালে রাজশাহী কলেজে আরবীতে ডিগ্রী (পাস) এবং ১৯৯৭ সালে মাস্টার্স পরীক্ষা দেই এবং উভয় পরীক্ষাতেই ফার্স্ট ক্লাস পাই।
তাওহীদের ডাক : আপনার পরিবার সম্পর্কে জানতে চাই।
মাওলানা দুর্রুল হুদা : আমার আববার নাম মুহাম্মাদ শাকির আলী। মাতার নাম যয়নব বেগম। আমরা পাঁচ ভাই ও দুই বোন। আমিই সবার বড়। আমার মেজ ভাইটা অল্প বয়সেই মারা গেছে। তৃতীয় ভাই আব্দুল হালীম। সে কওমী মাদ্রাসায় পড়ত। পরবর্তীতে জেনারেল থেকে বিএসসি ও মাস্টার্স করে বর্তমানে মোহনপুর উপযেলার মহিষকুন্ডী হাই স্কুলের শিক্ষক। পঞ্চম ভাইও ডিগ্রী পাশ করে প্রাইমারী স্কুলে শিক্ষকতা করছে। ছোট বোন কামিল পাশ করে রাজশাহীস্থ শিতলাই মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করছে।
তাওহীদের ডাক : আপনি আলাদীপুরে দাওরায়ে হাদীছ পড়ার সময় পীর ছাহেব হুযূর ও আব্দুল মান্নান আনছারী ছাহেবকে কেমন দেখেছিলেন?
মাওলানা দুর্রুল হুদা : আল্লাহ তাদের জান্নাতবাসী করুন! হ্যঁা, তারা সেসময় সুস্থ ছিলেন। আমি তাদের খুব প্রিয় ছাত্র ছিলাম। পীর সাহেব হুযূরের বয়স ছিল তখন আনুমানিক ৭০-এর কাছাকাছি। আর আব্দুল মান্নান আনছারী হুযূরের বয়স ৬০-এর কাছাকাছি হবে। তারা উভয়েই খুবই ভাল শিক্ষক ছিলেন।
তাওহীদের ডাক : আপনি রাজশাহীতে কত সালে আসেন?
মাওলানা দুর্রুল হুদা : ১৯৮৮ সালে আমি রাজশাহীতে আসি। তবে আগেও এসেছি রাজশাহীতে বেড়ানোর জন্য। রাজশাহীতে আসার পর আমি ১৯৮৮ সাল থেকেই হড়গ্রাম আমবাগান আহলেহাদীছ মসজিদে ইমামতির দায়িত্ব নেই। ওখানে ইমামতি করার পাশাপাশি রাজশাহী দারুস সালাম কামিল মাদ্রাসায় পড়তাম। আমি সেখানে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত ইমামতি করি।
তাওহীদের ডাক : আপনার কর্মজীবন সম্পর্কে কিছু বলুন।
মাওলানা দুর্রুল হুদা : ১৯৯৩ সালে কামিল শেষ করার পরে রেজাল্ট হওয়ার আগেই আমার এক ওস্তাদ মাওলানা আব্দুন নূর ইছলাহী আমাকে ডেকে পাঠালেন। উনি রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী জামিরা মাদ্রাসার শিক্ষক ছিলেন। তিনি বললেন, তোমার রেজাল্টের দেরি আছে। যতদিন রেজাল্ট না হয় তুমি এখানে পড়াও। তার আহবানে সাড়া দিয়ে আমি জামিরাতে শিক্ষকতা শুরু করি আগস্ট বা সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে। তারপর ডিসেম্বরের শেষ দিকে রেজাল্ট হওয়ার পর সার্টিফিকেট আসতে মার্চ মাস চলে আসল। তারপর বিভিন্ন আলিয়া মাদ্রাসাতে চাকুরীর জন্য দরখাস্ত করতে লাগলাম। ১৯৯৪ সালের ১৪ই জুলাই রাজশাহীর ধূরইল ডি. এস. কামিল মাদ্রাসায় আরবী প্রভাষক হিসাবে যোগদান করি। তারপর ’৯৫-তেই মাদ্রাসা ফাযিল পাঠদানের অনুমতি পায় এবং আমি উক্ত সালের ১লা জুলাই ভাইস প্রিন্সিপাল হিসাবে সেখানেই যোগদান করি। আলহামদুলিল্লাহ আজ অবধি সেখানেই কর্মরত আছি।
তাওহীদের ডাক : আপনার সাংগঠনিক জীবনের শুরুটা কিভাবে হয়?
মাওলানা দুর্রুল হুদা : সেটা বলতে গেলে আমার জীবন পরিবর্তনকারী একটি ঘটনা। আমি রাজশাহী শহরের হড়গ্রামে ইমামের দায়িত্বে থাকাকালীন একটি ইসলামী ছাত্র সংগঠনের সাথে যুক্ত হয়ে পড়ি। সেসময় একদিন আমাদের মসজিদ কমিটির লোকজন আমীরে জামা‘আত প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিবকে নিয়ে গেলেন। কিভাবে নিয়ে গেলেন, কেন নিয়ে গেলেন, সেটা আমি বলতে পারব না। আমীরে জামা‘আত গেলেন। তখন তাঁর সম্পর্কে আমার তেমন কোন ধারণা ছিল না। তবে আমি যেহেতু আহলেহাদীছ, তাই আক্বীদা ও মানহাজের দিক থেকে উনার প্রতি আমার একটা সম্মানবোধ ছিল। তবে সে সময় স্যারের যাওয়াটা আমার খুব একটা ভালো লাগেনি। তখন তিনি হড়গ্রামের আমবাগান এলাকায় সপরিবারে নতুন ভাড়া বাসায় উঠেছিলেন। উনি সেখানে যেয়ে সাপ্তাহিক তা‘লীমী বৈঠক চালু করেন। জুমআ‘র খুৎবাও মাঝে মাঝে দিয়েছেন, তবে খুব কম। তা‘লীমী বৈঠকটা খুব আকর্ষণীয় ছিল। তা‘লীমী বৈঠক চালু করার অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন। আহলেহাদীছদের পাশাপাশি হানাফীরাও শুনতে আসত। তাঁর বক্তব্য শুনে ঐ পাড়ার সব হানাফীরা শবেবরাতের হালুয়া-রুটি খাওয়া বন্ধ করে দিল এবং সর্বতোভাবে তা বর্জন করল। এগুলি দেখে স্বাভাবিকভাবেই আমার মনের ভিতরে একটা দুর্বলতা তৈরী হয়ে গেল। কিন্তু হঠাৎ একদিন সবকিছু পরিবর্তন হয়ে গেল। যারা সসম্মানে আমীরে জামা‘আতকে মসজিদে নিয়ে আসলেন তারাই আকস্মিকভাবে একদিন জমঈয়তে আহলেহাদীছ-এর সভাপতি ড. আব্দুল বারীকে সেখানে নিয়ে গেলেন এবং তিনি জুম‘আর খুৎবায় আমীরে জামা‘আত সম্পর্কে খুব আপত্তিকর ভাষায় নানা কথা বললেন। তখন থেকে উক্ত মসজিদে আমীরে জামা‘আতের আসা বন্ধ হয়ে গেল।
তাওহীদের ডাক : তখন কি জমঈয়ত বা যুবসংঘ-এর ব্যাপারে আপনার কোন ধারণা ছিল?
মাওলানা দুর্রুল হুদা : জমঈয়ত সম্পর্কে আমার আগে থেকেই ধারণা ছিল। কিন্তু ভিতরে এত সমস্যা ছিল সেটা আমার জানা ছিল না। জমঈয়ত সভাপতি ড. আব্দুল বারী ছাহেবকে আমি খুব সম্মান করতাম। আমি যখন দাওরায়ে হাদীছ পড়ি আলাদীপুর মাদরাসায়, তখন ড. আব্দুল বারী ছাহেব একবার সেখানে গিয়েছিলেন। উনাকে তখন দেখার সুযোগ হয়েছিল। আমি নিজ হাতে উনার খেদমত করেছি। কিন্তু যেদিন ড. আব্দুল বারী ছাহেব হড়গ্রামে আসলেন এবং সবাইকে নিয়ে মিটিং করলেন, তখন উনার বক্তব্য আমার ভালো লাগেনি। পুরোটাই আমীরে জামা‘আতের বিপক্ষে বক্তব্য দিয়েছিলেন এবং ভাষাগুলো ছিল আক্রমণাত্মক। এমন ভাষা বা আচরণ প্রয়োগ করছিলেন, যা তাঁর জন্য মোটেও শোভনীয় ছিল না। ফলে উনার প্রতি আমার ভক্তি কমে গেল। আমীরে জামা‘আতের প্রতি ভক্তি আরো বেড়ে গেল। এটা ১৯৯১ সালের ঘটনা। ঐ দিন প্রোগ্রাম শেষ করে ড. আব্দুল বারী ছাহেব চলে গেলেন। তারপর থেকে যারা আমীরে জামা‘আতকে ঐ মসজিদে আমন্ত্রণ করেছিলেন, তারাই তাঁর উপর রীতিমত অত্যাচার করা শুরু করল। এমনকি আমীরে জামা‘আত বাজার করতে গেলেও সেখানে তারা ঝামেলা করত।
তাওহীদের ডাক : ইমাম হিসাবে সেখানে আপনার ভূমিকা কি ছিল?
মাওলানা দুর্রুল হুদা : উপরোক্ত ঘটনার পর থেকে আমি স্পষ্ট বুঝতে পারলাম আমীরে জামা‘আতের বিরুদ্ধে কিভাবে ষড়যন্ত্র চলছে। তিনি যে হকের উপরে আছেন, তাও অনুধাবন করতে পারলাম। ফলে তাঁর প্রতি ভক্তি যেমন বাড়ল, তেমনি সংগঠনের সাথেও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরী হ’ল। আমীরে জামা‘আত তখন আমার মসজিদ থেকে ৫ মিনিটের দূরত্বে হড়গ্রাম আমবাগানের অ্যাডভোকেট আব্দুল মান্নান ছাহেবের ভাইয়ের বাসায় ভাড়া থাকতেন। ফলে আমি মাঝে মধ্যে গিয়ে স্যারের বাসার বাজার করে দিতাম। এভাবে স্যারের পরিবারের সাথে ঘনিষ্ঠতার সুযোগ হয়েছিল। এর আগেও আমি অনেক আলেম-ওলামার সান্নিধ্যে ছিলাম। উনাদের পারিবারিক পরিবেশ দেখেছি এবং স্যারেরটাও দেখলাম। আমীরে জামা‘আতের পারিবারিক পরিবেশ দেখার পর উনার পরিবারের প্রতি আমার একটা সম্মানবোধ তৈরী হয়েছিল। আমীরে জামা‘আতের বড় ছেলে ছাকিব ও নাজীব তখন খুব ছোট ছিল। তামান্না তখন পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ে। শাকিরের তখনও জন্ম হয়নি। আমীরে জামা‘আতের বাসার কাজে সহযোগিতার কারণে মসজিদ কমিটি আমার উপরও চড়াও হ’ল। তারা আমীরে জামা‘আতের বাসা থেকে মসজিদে আসার সোজা রাস্তাটা বন্ধ করে দিলেন যাতে তিনি মসজিদে আসতে না পারেন। কেননা অন্য রাস্তা দিয়ে ঘুরে আসতে অনেক সময় লাগত। এসব দেখে আমি আর সহ্য করতে পারলাম না। ইমামতি ছেড়ে দিলাম এবং মেসে থাকতে শুরু করলাম। মেসে যখন থাকতাম তখন আমি রাণীবাজারে যুবসংঘ অফিসে আসতাম। তখন যুবসংঘ অফিস নিয়ে জমঈয়তের সাথে খুব দ্বন্দ্ব চলছিল। অন্যদিকে নওদাপাড়ায় বিল্ডিংয়ের কাজ ও শিক্ষক নিয়োগ শুরু হয়। ১৯৯১ সালে জমিজমা কেনা হয় এবং বিল্ডিংয়ের কাজ অনেকটাই হয়ে যায়। ১৯৯১ সালেই ১ম জাতীয় সম্মেলন ও তাবলীগী ইজতেমা হয়। আমি তখনও সেই ইসলামী ছাত্র সংগঠন করলেও ইজতেমার জন্য কালি দিয়ে ওয়াল রাইটিং করেছিলাম। আমার রাতের বেলায় ওয়াল রাইটিং করার অভ্যাস ছিল। আহলেহাদীছের কয়েকটা ছেলে আমার সাথে উক্ত সংগঠন করত। তাদেরকে সাথে নিয়ে এশার ছালাত আদায় করে খাওয়া-দাওয়া সেরে সবাই বের হয়ে গেছি। সারারাত ওয়াল রাইটিং শেষে ফজরের আযানের আগে এসে ছালাতে ইমামতি করেছি। মেডিকেল, লক্ষ্মীপুর, ফায়ার সার্ভিস মোড়, সাহেব বাজার থেকে পশ্চিম দিকে জিরো পয়েন্টে ‘যুবসংঘে’র মনোগ্রামের যে ছাপ মারা ছিল সবগুলো আমার করা।
তাওহীদের ডাক : আপনি দীর্ঘদিন যাবৎ সংগঠনের সাথে জড়িত আছেন। রাজশাহী যেলার মোহনপুর ও তানোর উপযেলায় আপনি দাওয়াতী খেদমতে যথেষ্ট সময় দিয়েছেন। এ বিষয়ে আপনার কিছু অভিজ্ঞতা কি আমাদের সাথে শেয়ার করবেন?
মাওলানা দুর্রুল হুদা : যুবসমাজের বিষয়ে একটা কথা আমাকে বলতেই হবে যে, যৌবনকালটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়। এই গুরুত্বপূর্ণ সময়টাতে যদি তারা ইসলামের পথে থাকে, হক পথে থাকে, তাহ’লে এখানে আল্লাহ রাববুল আলামীনের একটা বিশেষ সাহায্য আসে। এটা তার ইহকাল ও পরকালেও কামিয়াবী বয়ে আনবে। আমার যৌবনকালের কিছু অভিজ্ঞতা উল্লেখ করব।
(১) আমি ধূরইল ডি.এস. কামিল মাদ্রাসায় যোগদান করলাম ১৯৯৪ সালে। তখন আমি তেইশ/চবিবশ বছরের টগবগে যুবক। সেসময় মাঠে-ময়দানে কাজ করা খুবই কঠিন ছিল। মোহনপুর এলাকায় কাজ করতে গিয়ে আমি প্রথম বাধাগ্রস্ত হই মারেফতী পীর-ফকীরদের দ্বারা। সেসময় সমাজে তাদের ভীষণ দাপট ছিল। তারা এলাকাতে ছালাত আদায় করা লাগবে না, কীসের ছালাত? ইত্যাদি ভ্রান্ত কথাবার্তা প্রচার করত।
১৯৯৬ সালে একদিন ধূরইল বাজারে গেলাম। সেখানে হানাফী মসজিদে মাগরিবের ছালাত পড়লাম। ছালাতের আগেই কয়েকটা লোক এসে জানাল এলাকায় ফকীরেরা বলছে যে, ছালাত পড়া লাগবে না। ছালাত না পড়ার অনেক দলীল আছে। সেদিন হাটের দিন ছিল। শনিবার অথবা বুধবারের দিন হবে। মাগরিবের ছালাত শেষে দেখি আমার জন্য অনেকেই দাঁড়িয়ে আছে। সেখানে যাওয়ার পরে দেখি লোকে লোকারণ্য। তার নাম হ’ল আকবর ফকীর, মোহনপুরেই বাড়ি। আমি বললাম, কথা কী আপনি শুরু করবেন, না আমি শুরু করব? উনি আমাকে অহংকারের স্বরে বললেন, আপনার ইচ্ছা! আমি বললাম আপনি কিছুক্ষণ আগেও বলেছেন যে, শরীয়ত, তরীকত, হাকীকত এবং মারেফতের উপর ঘণ্টার পর ঘণ্টা বক্তব্য দিতে পারবেন। এবার আপনি বলুন, শরীয়ত, তরীকত, হাকীকত ও মারেফতের অর্থ কী? এবার সে কথা বন্ধ করে দিল।
আমি আবার বললাম, আপনাকে বলতে হবে শরীয়ত শব্দটা বাংলা, ইংরেজী, আরবী না ফার্সী? এভাবে আরো অনেক প্রশ্ন করলাম। কিন্তু সে কোন জবাব দিতেই পারল না। আমি তখন জনগণকে লক্ষ্য করে বললাম, ইংরেজীতে ওয়াটার, আরবীতে মা-উন এবং বাংলায় জল বা পানি মানে পানি। অনুরূপভাবে শরীয়ত, তরীকত, হাকীকত এবং মারেফত সবই ইসলাম। কোনটিই কোনটি থেকে আলাদা কিছু নয়। পীর-ফকীররা এসব নিয়ে মানুষদের বিভ্রান্ত করছে। তখন কি আর জনগণকে থামানো যায়? জনগণ তখন একেবারে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে। যাই হোক কিছু লোক ছিল তারা উক্ত ফকীরকে এক বাড়িতে তুলে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করল। আর এভাবেই সেদিন হকের বিজয় হয়ে গেল আলহামদুলিল্লাহ।
এই ঘটনার কয়েকদিন পরেই আকবর ফকীর কয়েকজন ছেলে নিয়ে আমাকে মোহনপুর থানায় আক্রমণ করে। তারা আমাকে ঘিরে ফেললে আমি বললাম, দেখেন ঘটনা তো ধূরইলের। আপনারা মোহনপুরের। আমি নেয়ামতপুর, নওগাঁর লোক। আপনাদের কি মনে হয় আমি বাইরের লোক হয়ে, ধূরইলের জামাই হয়ে মোহনপুরের লোকের ওপর টর্চার করতে পারি? মূল ঘটনাটা জানার পর ছেলেগুলোও ফকীরের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে গেল। একটা ছেলে তাকে গাল-মন্দ করে বলল, গাজা খেয়ে তুমি হুযূরের সাথে লাগতে এসেছ? তারপর আকবর ফকীরসহ সবাই চলে গেল।
(২) এর কয়েকদিন পর হঠাৎ আমার মাদ্রাসার কিছু ছাত্র একটু উজ্জীবিত হয়ে এলাকার সদের ফকীরের সাথে বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে। বিতর্কের আগে তারা ঠিক করে, যে হেরে যাবে তার মাথা ন্যাড়া করা হবে। বিতর্কে আমার মাদ্রাসার ছেলেদের প্রশ্নবানের উত্তর দিতে না পারলে তার মাথা ন্যাড়া করে দেওয়া হয়। এ ঘটনা আমি পরে জেনেছি। এর দিন কয়েক পরে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়্যারম্যান আব্দুল মজীদ মোল্লা আমাকে ডেকে বললেন যে, ওসি ছাহেব আমাকে চুল কাটার ঘটনা তদন্তের দায়িত্ব দিয়েছেন।
আমার কাছ থেকে বিষয়টা শোনার পর উনি আমাকে একটা তারিখ দিলেন যে, অমুক তারিখে আপনি ইউনিয়ন কাউন্সিলে আসবেন। যাওয়ার পরে চেয়ারম্যান ছাহেব উনার পাশের চেয়ারে আমাকে বসালেন। বিচারে শুরুতেই চেয়ারম্যান ছাহেব সদের ফকীরকে জিজ্ঞাস করলেন, তোমার চুল কেটেছে কে? তখন সে বলল, দুরুল কেটেছে দুরুল। চেয়ারম্যান ছাহেব বললেন, তুমি কি তাকে চেন? সদের ফকীর বলছে চিনব না মানে? আমাদের এক ছাত্র আব্দুল বারীকে দেখিয়ে যেই বলেছে এইটা দুরুল, তেমনি বিচার ওখানেই শেষ হয়ে গেল। চেয়ারম্যান ছাহেব ফাইনাল রিপোর্ট দিলেন, এটা হয়রানীমূলক অভিযোগ ছিল। ফালিল্লাহিল হামদ। এভাবে ধূরইল এলাকায় ফকীরদের দৌরাত্ম্য কমে গেল।
(৩) ১৯৯৬/৯৭ সালের বিদ‘আতী হুযূররা আমার ওপর টর্চার শুরু করল। তারা ফরজ ছালাতের পর মুনাজাত, ঈদের ছালাত শেষে মুনাজাত, জানাযা শেষে মুনাজাত, কবরকেন্দ্রিক নানা বিদ‘আতে জড়িত ছিল। এটা আমার জীবনে খুব বড় ধাক্কা ছিল। তখন আমি ধূরইল হাজীপাড়া মসজিদে ছালাত আদায় করি ও সেখানেই থাকি। ১৯৯৬ সালের কথা। একদিন হাজীপাড়া মসজিদের দায়িত্বশীলরা আমাকে বলছেন, আপনি ফেৎনা করেন কেন? এই কথাটা আমার আজও মনে আছে যে, আপনি দো‘আ করেন না কেন? আমি বললাম, আমি দো‘আ করিনা কিন্তু আমি কি আপনাদের মসজিদে ইমামতি করি? আমি কি কাউকে বলেছি যে, তোমরা মুনাজাত করবে না? আপনার মুছল্লীদের জিজ্ঞাসা করেন তো? আপনাকে কি এ বিষয়ে কিছু বলেছি? আপনাকে আমি বলিনি, আপনার মুছল্লীদের কাউকেও কিছু বলিনি। আমি ইমামতিও করিনা। তাহলে কি ফেৎনা আমি করলাম? না আপনারা আমাকে জোর করে মুনাজাত করিয়ে নিবেন? আর নিজেরাই ফেৎনা সৃষ্টি করবেন? তারপর তারা চুপ হয়ে গেল। আর কিছু বলল না।
১৯৯৭ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে মাগরিবের পর ত্রিমোহনী থেকে ভ্যানগাড়িতে উঠেছি বাড়ীর উদ্দেশ্যে। ভ্যানে বসা অন্য যুবকরা আমার বিষয়ে অনেক আলোচনা করছে। তখন আমি বললাম, কি হয়েছে বাবা? তারা বলল, নওদাপাড়া থেকে দুরুল নামে এক হুযূর এসে আমাদের এলাকায় ধর্ম-কর্ম সব বাদ দিয়ে দিচ্ছে। আজ ধূরইল বাজারে বাহাছ আছে। আমি বললাম, শুনেছি যে ফেব্রুয়ারীর ২২/২৩ তারিখে হবে? তারা জানাল, না না, আজকেই হবে। আপনি ওখানে যাবেন না? তারপর আমি নেমে গেলাম। বাসায় ঢুকতেই আমাদের কিছু ছেলের মুখ শুকনো। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, কি হয়েছে? তারা বলল, আজকে বাহাছ হবে। আপনি যাবেন না। আমি বললাম, আমাকে তো তারা দাওয়াত দেয়নি; আর আমি এমনিতেই যাব না। আমি বললাম, তোমরা কেউ কি তাদের বক্তব্যটা টেপ রেকর্ড করে আনতে পারবে? একজন বলল, আমি পারব। ফজরের আগে আমি ক্যাসেট হাতে পেলাম। ছালাত শেষ করার পর ক্যাসেট কিছুটা শুনলাম। তাদের সমস্ত বক্তব্য ছিল হিংসাত্মক ও উগ্রতায় ভরা। আমি তাদেরকে জ্ঞিসাসা করলাম, উনারা আছেন কোথায়? ওরা জানাল যে, রেফ্যুজী পাড়াতে তারা আছে।
আমি হাজীপাড়া আহলেহাদীছ মসজিদের মুওয়ায্যিন আব্দুস সাত্তারকে বললাম সাইকেল নাও। আমার কাছে যেসব মূল কিতাব ছিল, সেগুলো সাইকেলে বাঁধলাম। ফেব্রুয়ারী মাস। ঝলমলে রোদ উঠেছে। হালকা ঠান্ডাও আছে। এভাবে আমাদের দেখে ১৫-২০ সঙ্গীও হয়ে গেছে। মেহমানরা যে বাড়িতে আছেন সে বাড়ির গেটের কাছেই বাড়িওয়ালা বলছে কোথায় যাবেন? আমি বললাম, রাতে যারা তাফসীর করেছে তাদের সাথে দেখা করতে যাব। তারা দাঁড়াতে বলল। আমি দাঁড়ালাম। কিছুক্ষণ পরে এসে বলল, এখন যাওয়া হবে না। উনারা কথা বলতে পারবেন না। আমি বললাম, উনাদেরকে বলেন যে, তারা গত রাতে যে বক্তব্য দিয়েছে সে বিষয়ে আমি কিছু কথা বলব, আর আমার সাথে কেউ থাকবে না। এর মধ্যে উৎসুক অনেক লোক জড়ো হয়ে গেছে। কারণ তারা রাতে চ্যালেঞ্জ করে বলেছিল যে, আমরা সকাল পর্যন্ত আছি, কারো যদি সাহস থাকে, সে যেন আসে। তখন আমার সাহস বহু গুনে বেড়ে গেছে। আমি বললাম, উনারা যাই বলুক, উনাদের সাথে কথা বলতেই হবে। উনারা যেভাবে কথা বলতে চায়, সেভাবেই বলব। আর সেক্ষেত্রে একটা টেপ রেকর্ডার থাকবে আর কথাগুলো রেকর্ড হবে। কিন্তু তারা কোনভাবেই বসতে রাযী না হওয়ায় এক অভাবিত বিজয় হয়ে গেল।
(৪) সেসময় ইফতারের সময় ৬/৭ মিনিট কমবেশী হত। হাজীপাড়াতে আমি একদিন ইফতার করছি, ঠিক সেইসময় মসজিদের ইমাম নযরুল ছাহেব আযান দিতে উঠল। তিনি মাইকে আযান শুরু করবে এমন সময় যহীর (বছর দুয়েক আগে সে মারা গেছে। আল্লাহ তাকে জান্নাতবাসী করুন) নামে একজন ব্যক্তি মাইক কেড়ে নিল। মাইক কেড়ে নেওয়ার পর বলল, আমাদেরও হুযূর আছে। বেলা থাকতে সব ইফতার করবে, সব ইহুদী-খ্রিষ্টানের দালাল। ইহুদী-খ্রিষ্টানদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে এরা বেলা থাকতে ইফতার করে। একটা চরম বিপর্যয়কর অবস্থা।
বাদ মাগরিব ঐ এলাকার গণ্যমান্য লোক আলহাজ্জ আনীসুর রহমান এলেন। তাঁর অন্যান্য আক্বীদা ঠিক থাকলেও এ বিষয়ে তিনি ঐ পক্ষের। সবার সামনে আমি বললাম, দেখেন হাজী ছাহেব, এর একটা ফায়ছালা আছে, সমাধান আছে। এটা যদি আপনি করতে পারেন, সমাধান হয়ে যাবে। আমি বললাম, নযরুল আযান দেয় হাজীপাড়ায় বেলা থাকতে আর পন্ডিতপাড়া আযান দেয় বেলা ডুবে গেলে। এটাই অভিযোগ। এটাই যদি অভিযোগ হয়, তাহলে তো এর একটা তদন্ত আছে? এত হট্টগোল আর ভালো লাগছে না। মানিকডাঙ্গা ঈদগাহ মাঠের চারিদিকে ফাঁকা। একদিন চলেন আমি আর আপনি আরও দু’একজনকে নিয়ে সেখানে ইফতার করব। মসজিদের আযান সব শোনা যাবে এখানে। ইফতার যখন করব আকাশ ফাঁকা থাকবে। যেদিন বলবেন, সেদিনই যাব। ইফতারী আমি দিব। যদি দেখা যায় যে, বেলা ডোবার আগেই নযরুলও আযান দিচ্ছে, তাহ’লে অবশ্যই নযরুল সবার ছিয়াম নষ্ট করছে। তাহ’লে কি আপনি বলতে পারবেন যে, আমি স্বচক্ষে দেখে আসলাম নযরুল বেলা থাকতে তুমি আযান দিচ্ছ? আর ওকে দু’থাপ্পড় দিয়ে ইমামতি থেকে বাদ দিতে পারবেন না? তিনি বললেন, হ্যঁা পারব।
আমি বললাম, ঠিক আছে এটার একটা পরীক্ষা-নিরীক্ষা হবে হাজীপাড়াতেই। অবশেষে দু’পক্ষের হুযূর নিয়ে একটা তারিখ ঠিক করে আমরা খোলা মাঠে ইফতার করতে বসলাম। পরে যাচাই-বাছাই করতে গিয়ে বিষয়টি সকলেই বুঝতে পারে এবং সত্যের বিজয় হয়। আলহামদুলিল্লাহ। আমীরে জামা‘আত বলেন, ‘সাহস না করলে কিছু হয় না’। যুবকদের ঝুঁকি নেওয়ার বয়স। যুবকরা সমাজ সংস্কারের কাজে এগিয়ে এলেই আল্লাহর সাহায্য আসবে ইনশাআল্লাহ।
তাওহীদের ডাক : ২০০৫ সালে আমীরে জামা‘আত গ্রেফতার হওয়ার পর একটা ঝড় এসেছিল আহলেহাদীছদের উপর। সেদিনগুলো আপনার কিভাবে কেটেছিল?
মাওলানা দুর্রুল হুদা : ২০০৫ সালের সেই কঠিন দিনগুলিতে তখন আমি মোহনপুর উপযেলার সভাপতির দায়িত্ব পালন করছিলাম। কর্মীদের মধ্যে একটা ভীতিকর অবস্থা ছিল। সে সময় কিছু সুযোগসন্ধানী লোক আমাদের ব্যাপারে প্রশাসনের কান ভারী করত। ফলে প্রশাসনের লোকেরা আমাদেরকে সন্দেহ করত। আমি সব কর্মীদের ডেকে বললাম, আমীরে জামা‘আত গ্রেফতার হয়েছেন, কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ গ্রেফতার হয়েছেন, তাই বলে কি আপনার ধর্ম বদলে ফেলবেন? তখন আমি ওহোদ যুদ্ধের ঘটনা বলে কর্মীদের উজ্জীবিত করলাম। কারো না কারোর উপর বিপদ আসতেই পারে। আর যদি মোহনপুরের কারো উপর মামলা হয়ে যায়, তার পরিবারের দেখাশোনা ও মামলা খরচের ব্যবস্থা আমরা সবাই মিলে করব ইনশাআল্লাহ। তারপর কর্মীরা পূর্বের মত সৎসাহস নিয়ে আবার মাঠে-ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
উপযেলা পর্যায়ে আমরা আমীরে জামা‘আতের মুক্তির দাবিতে একটা বড় ধরনের সম্মেলনের প্রস্ত্ততি নিলাম। হঠাৎ সম্মেলনের দিন তৎকালীন কৃষি মন্ত্রী রাজশাহীতে এসেছেন। সেদিন আবার জুম‘আর দিনও ছিল। ওসি ফোন দিয়ে বললেন, উপরের নির্দেশ রয়েছে আপনাদের প্রোগ্রাম বাতিল করতে হবে। আমি বললাম, আমরা সব ব্যবস্থা করে ফেলেছি। জুম‘আর পরপরই আমাদের কর্মীরা চলে আসবে। এটা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। ওসি ছাহেব কথা শুনে বুঝতে পারলেন, এরা অনুষ্ঠান করবে। এরপর উনি একটি সংকেত বা পরোক্ষ হুমকিও দিয়ে বসলেন যে, আমি শুনেছি ধূরইল মাদ্রাসার একজন ভাইস প্রিন্সিপাল আছে। উনি নাকি এর উদ্যোক্তা। যদি কোন অঘটন ঘটে, তাহলে সব দায়-দায়িত্ব তার ঘাড়ে পড়বে। আমি বললাম, যেসব লোকজন আসবে, ইনশাআল্লাহ তাদের দ্বারা কোন প্রকার অঘটন ঘটবে না। এ বিষয়ে নিশ্চিত থাকুন যে, আমার কোন কর্মী কোন প্রকার বিশৃংখলা ঘটাবে না ইনশাআল্লাহ। এরপর তিনি এতটুকু বললেন, পুরোটা আপনাদের রিস্ক।
সম্মেলন শুরু হ’ল। মোহনপুর সরকারী কলেজ মাঠ একেবারে লোকে লোকারণ্য। আছরের পূর্বেই মাঠ পরিপূর্ণ। প্রধান অতিথি হিসাবে তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত আমীর ড. মুছলেহুদ্দীন ছাহেব উপস্থিত ছিলেন। আলহামদুলিল্লাহ কোন বাধা ছাড়াই মাগরিবের আগে সম্মেলন শেষ করে দিলাম।
পরিশেষে যে সমস্ত পুলিশ ছিল তারা বলল যে, ‘আমরা যেটা মনে করেছিলাম সেরকম না। আপনাদের কর্মীরা খুবই ভদ্র। তারপর জাতীয় পত্রিকায় রিপোর্ট হ’ল। মানুষের মধ্যে দারুণ উদ্দীপনা সৃষ্টি হ’ল। অতঃপর রাজশাহী সাহেব বাজারে আমীরে জামা‘আতের মুক্তির দাবিতে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হ’লে আমাদের এলাকা থেকে অসংখ্য মানুষ পাগলপারা হয়ে ছুটে গিয়েছিল। তারপর ঢাকার মুক্তাঙ্গনের সমাবেশে আমার প্রচন্ড জ্বর থাকায় ইচ্ছা থাকার পরেও যেতে পারিনি। সেখানেও আমাদের কর্মীরা গিয়েছিল এবং প্রতিটি প্রোগ্রামে আমাদের লোকজন অংশগ্রহণ করেছিল।
২০০৭ সালের একটা স্মৃতি না বললেই নয়। একদিন আমি ট্রেনে ঢাকা যাচ্ছি বোর্ডের কাজে। সাথে আমার মাদ্রাসার চার জন শিক্ষক আছেন। পথিমধ্যে আমীরে জামা‘আতের বড় ছেলে আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিবের সাথে দেখা হ’ল। সেও আমাদের সাথে রাজশাহী স্টেশন থেকে বিকালের ট্রেনে উঠেছে। ট্রেন যমুনা ব্রীজ পার না হ’তেই দেখি একজন লোক তাকে সাথে নিয়ে আমাদের কাছে আসলেন। ছাকিব আমার দিকে ইশারা করে বলল, ইনি আমার পরিচিত। লোকটি কিছু বুঝতে না বুঝতেই আমাকে আমার সঙ্গীসাথীসহ ছাকিবকে নিয়ে ট্রেন থেকে নেমে গেল। পরবর্তীতে বুঝতে পারলাম, তারা মূলত র্যাবের লোক। পরে তারা তাদের গাড়িতে করে আমাদেরকে সিরাজগঞ্জ শহরে র্যাবের দফতরে নিয়ে গেল। সেখানে প্রায় ঘণ্টাখানেক জিজ্ঞাসাবাদ শেষে আবার ছেড়ে দিল।
সেদিন জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে একটা মজার ঘটনা ঘটল। আমরা সবাই নিজ নিজ পরিচয় আহলেহাদীছ হিসাবে দিলাম। কিন্তু আমাদের একজন শিক্ষক তার পরিচয় দিতে গিয়ে ভয়ে নিজেকে আহলেহাদীছ না বলে মালেকী বলল। এ কথা শুনে র্যাব অফিসার বিস্ময় নিয়ে বললেন, বাংলাদেশে মালেকী মাযহাবের কেউ আছে নাকি? উক্ত শিক্ষক কিছু বলতে না পেরে নিরুত্তর রইলেন। আরেকটি বিষয় ছিল, গ্রেফতার হ’তে পারি এমন স্পষ্ট আশংকা নিয়েও আমরা তাদের প্রশ্নের মুখে কোন অবস্থাতেই সাহস হারাইনি। কেননা আমরা জানতাম, আমরা অপরাধী নই। সুতরাং নৈতিক দৃঢ়তার সাথে আমাদের মানহাজ, আমাদের কর্মপদ্ধতি নির্দ্বিধায় তাদের কাছে ব্যক্ত করলাম। আমীরে জামা‘আতকে যে মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে সে কথাও বললাম। এমনকি প্রচলিত গণতন্ত্র কেন সমর্থনযোগ্য নয়- এমন স্পর্শকাতর বিষয়েও ছাকিব উদাহরণসহ সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দিল। আমাদের স্পষ্টবাদিতায় তারা বরং খুশীই হলেন এবং সম্মানের সাথে চা-নাশতা করালেন। পরবর্তীতে তাদের গাড়ীযোগে শহর থেকে কড্ডার মোড়ে এনে নামিয়ে দিলেন। আমরা সেখান থেকে রাত প্রায় ১১টার দিকে বাস যোগে আবার ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। ফালিল্লাহিল হামদ।
তাওহীদের ডাক : অনেকে বলেন, আহলেহাদীছরা দলে নয় বরং দলীলে বিশ্বাস করে। অনেক আলেম বলে, সংগঠন করার কোন প্রয়োজন নেই এবং সাংগঠনিক ঐক্য ভেঙ্গে দেওয়াটাকে ধর্মীয় দায়িত্ব এবং এটিই জাতীয় ঐক্যের রূপরেখা বলে তারা মনে করেন। সংগঠনের দীর্ঘদিনের সহযাত্রী এবং তৃণমূল পর্যায়ের দায়িত্বশীল ও কর্মী হিসাবে আপনি কিভাবে তাদের বক্তব্যগুলো ব্যাখ্যা করবেন?
মাওলানা দুর্রুল হুদা : এমন বক্তব্যের সাথেই আমি মোটেও একমত নই। এটা আহলেহাদীছ আন্দোলনের বিরুদ্ধে ঈর্ষান্বিত মহলের দুঃখজনক অপপ্রয়াস এবং সংগঠনকে বাধাগ্রস্ত করার সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্র বৈ কিছু নয়। আহলেহাদীছরা দল ও দলীল উভয়টাতেই বিশ্বাসী। আহলেহাদীছ আন্দোলনের অগ্রযাত্রার পিছনে যে বড় শক্তি নিহিত, তা বিশুদ্ধ দলীল অনুযায়ী আমলের চেষ্টা এবং সুশৃংখল সাংগঠনিক জীবনের ফলাফল।
এটা মনে রাখতে হবে যে, একটা ইট দিয়ে যেমন একটা বিল্ডিং হয় না। আবার তার ফাউন্ডেশন নীচ থেকে ভাল না হলে মযবূত বিল্ডিং তৈরী হয়না। সুতরাং আহলেহাদীছের দাওয়াত বা সালাফী দাওয়াত দিতে গেলে যেমন বিশুদ্ধ দলীলের প্রয়োজন, তেমনিই একটি সংঘবদ্ধ প্লাটফর্ম প্রয়োজন। উভয়মুখী প্রচেষ্টার মাধ্যমেই সফলতা আসবে। এটাই ছিল নবী-রাসূলদের কর্মনীতি। এই জিনিসটাই আমাদের মনে রাখতে হবে। কারো ষড়যন্ত্রমূলক বিদ্বেষী প্রচারণার পাতা ফাঁদে মোটেই পা দেয়া সমীচীন না।
তাওহীদের ডাক : আপনি ‘আহলেহাদীছ শিক্ষক সমিতি’র সভাপতি। এই সমিতি কোন প্রেক্ষাপটে তৈরী করা হয়েছে?
মাওলানা দুর্রুল হুদা : মূলতঃ মুহতারাম আমীরে জামা‘আত একটি স্বপ্ন নিয়ে এটি গঠন করেছেন। তাঁর ভাবনার একটি অংশ হচ্ছে যে, আমরা মানুষের আক্বীদা ও আমল সংস্কারের জন্য দাওয়াতী ময়দানে কাজ করছি। শিক্ষার সাথে যারা জড়িত, বিশেষতঃ শিক্ষকদের মাঝেও এই দাওয়াতটা যদি আমরা ছড়িয়ে দিতে পারি তাহলে আমাদের আন্দোলন আরেকটু ত্বরান্বিত হবে। বিশেষতঃ সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে শিক্ষাবিষয়ক দাবী-দাওয়া পেশ করার ক্ষেত্রে প্লাটফর্মটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। সুতরাং এটা খুবই উপযুক্ত একটি ভাবনা। এ ভাবনার আলোকেই মজলিসে শূরার পরামর্শক্রমে ২০১৮ সালে ‘আহলেহাদীছ শিক্ষক সমিতি’ গঠিত হয়।
তাওহীদের ডাক : জাতি গঠনে শিক্ষকদের ভূমিকা কি হবে বলে আপনি মনে করেন?
মাওলানা দুর্রুল হুদা : জাতি গঠনের জন্য একজন শিক্ষকের নিজের দায়িত্বের ব্যাপারে সচেতন থেকে সর্বদা আল্লাহর প্রতি নির্ভরশীল হ’তে হবে। ঈমানের দৃঢ় বিশ্বাসটা যেকোন পরিস্থিতিতে মাথায় রাখতে হবে। সাথে সাথে জবাবদিহিতা থাকতে হবে, পরকালীন জবাবদিহিতা। এটাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় কথা। তাহলে বাকী গুণাবলী এমনিতেই অর্জিত হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।
তাওহীদের ডাক : ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘে’র মুখপত্র তাওহীদের ডাক পাঠকদের উদ্দেশ্যে যদি কিছু বলতেন?
মাওলানা দুর্রুল হুদা : সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধিতে আমাদের প্রচারটা বেশী দরকার। আর আমাদের প্রচার মাধ্যম হচ্ছে ‘আত-তাহরীক’ পত্রিকা, ‘আত-তাহরীক টিভি’ ইত্যাদি। অনুরূপভাবে ‘তাওহীদের ডাক’ সংগঠনের প্রচার মিডিয়ার একটি অনন্য অংশীদার। যুবকদের মাঝে এটি বেশ সাড়া জাগিয়েছে। পাঠকদের বলব আপনারা ‘তাওহীদের ডাক’ নিজে পড়ুন, অপর ভাইয়ের কাছে পৌঁছে দিন এবং হকের দাওয়াত প্রচারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করুন।
তাওহীদের ডাক : জাযাকাল্লাহ খায়রান, অনেক ধন্যবাদ আপনার মূল্যবান সময় দেওয়ার জন্য।
মাওলানা দুর্রুল হুদা : আল্লাহ আপনাদেরকেও ভালো রাখুন। আমীন!