স্মৃতির পাতায় মাওলানা বদীউযযামান
তাওহীদের ডাক ডেস্ক
ড. নূরুল ইসলাম 366 বার পঠিত
ছিপছিপে
এক চটপটে তরুণ। দ্রুত হাঁটার গতি। দরাজকণ্ঠ। মেযাজী ও স্পষ্টবাদী।
আমানতদার, সাহসী ও নির্ভীক। আমাদের হৃদয়ের ক্যানভাসে ভাস্বর এই হ’ল আব্দুছ
ছামাদের প্রতিচ্ছবি।
আব্দুছ ছামাদ মারকাযের দীর্ঘকালীন ও প্রাচীন ছাত্রদের অন্যতম। ১৯৯২ সালে যশোর ও সাতক্ষীরার যে কয়জন ছাত্র দ্বীনী ইলম শিক্ষার প্রবল আগ্রহ নিয়ে বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আহলেহাদীছ বিদ্যাপীঠ আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, নওদাপাড়া, রাজশাহীতে ভর্তি হয়েছিল, সে ছিল তাদের একজন। মারকাযে সে আমার এক বছরের জুনিয়র হলেও আমাদের সম্পর্ক ছিল বন্ধুত্বের। মারকায জীবন থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন, সাংগঠনিক জীবন ও পরবর্তীতে সহকর্মী হিসাবে আমাদের হৃদ্যতা ছিল অতলস্পর্শী। এমনকি তার পরিবারের সদস্যদের সাথেও আমাদের পরিচিতি ছিল। তার চাচা অধ্যাপক শেখ রফীকুল ইসলাম তো মারকাযে আমাদের আদর্শস্থানীয় শিক্ষক ছিলেন।
বন্ধুবর আব্দুছ ছামাদের সাথে হৃদ্যতার সুবাদে তার বাড়িতে কয়েকবার বেড়াতে গিয়েছি। বিশেষত স্মৃতির মুকুরে জ্বলজ্বল করছে ২০০৩ সালের সফরের কথা। সে বছর আমি মারকায থেকে মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। মদীনা যাত্রার পূর্বে হাতে পর্যাপ্ত সময় থাকায় ৮/১০ জনের একদল ছাত্রের সাথে যশোর ও সাতক্ষীরা সফর করেছিলাম। সেই যাত্রায় আব্দুছ ছামাদের বাড়িতে ১/২ দিন অবস্থান করেছিলাম। এই সফরের একটা মজার ঘটনা হ’ল, আমরা সাতক্ষীরার ঐতিহ্যবাহী ‘হেলিকপ্টার’ (যাত্রীবাহী সাইকেল) না পেয়ে প্রচন্ড তাপদাহের মধ্যেই ঝাউডাঙ্গা বাজার থেকে পায়ে হেঁটে ৭/৮ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে কাকডাঙ্গায় আব্দুর রশীদের বাড়িতে গিয়েছিলাম। তারুণ্যের উচ্ছল সেই দিনগুলি প্রতিনিয়ত স্মৃতির পাতায় আলোড়িত হয়। আব্দুছ ছামাদের বিয়েতে বরযাত্রী হিসাবে গমনও একটি দারুণ সুখস্মৃতি। তখন তার নতুন পাকা বাড়িটি সদ্য সম্পন্ন হয়েছিল। আমি তাকে বলেছিলাম, ‘শেখ ছাহেব! বেশ চমৎকার বাড়ি করেছ’। গালভরা হাসি দিয়ে সে জবাব দিয়েছিল, ‘জ্বী, নূরুল ভাই’। রাজশাহী থেকে আমি ও যুবসংঘের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মুস্তাকীম আহমাদ তার বিয়েতে যাওয়ায় সে দারুণ খুশি হয়েছিল।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবী বিভাগের ছাত্র হওয়ার সুবাদে আমরা বাসে প্রায় সময় এক সাথে যাতায়াত করতাম। কতো যে স্মৃতি জড়িয়ে আছে তার কোন ইয়ত্তা নেই। বিশেষত আমীরে জামা‘আত প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব স্যারের মুক্তির দাবিতে রাবি ক্যাম্পাসে আয়োজিত মিছিল-সমাবেশের সে ছিল প্রাণ। তার উচ্চকণ্ঠের শ্লোগান এখনও যেন কানে বাজছে।
সাংগঠনিক জীবনে আব্দুছ ছামাদ ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ’-এর কেন্দ্রীয় দফতর সম্পাদক (২০০৭-২০০৯), অর্থ সম্পাদক (২০০৯-২০১১) ও সাংগঠনিক সম্পাদক (২০১৬-২০১৮) হিসাবে নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করেছে। যুবসংঘের কেন্দ্রীয় দায়িত্ব পালনকালে জনৈক দুষ্কৃতিকারীর অপকর্মের জের ধরে ২০০৯ সালের ২০শে নভেম্বর শুক্রবার দুপুর ১২টা ৪০ মিনিটে মারকায থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। তার সাথে মারকাযের তৎকালীন ছাত্র (বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত বোর্ডিং সুপার) মুহাম্মাদ আরীফুল ইসলামও গ্রেফতার হয়েছিল। আমরা তাদেরকে থানা থেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু থানার লোকজন তাদেরকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার দেখিয়ে কোর্টে চালান করে দিয়েছিল। পাঁচদিন হাজতবাস শেষে ২৪শে নভেম্বর ২০০৯ মঙ্গলবার বিকাল ৫টার সময় তারা জেলখানা থেকে ছাড়া পেয়েছিল। অথচ সেই দুষ্কৃতিকারীর দুষ্কর্মের সাথে তাদের বিন্দুমাত্র সংস্রব ছিল না। বিনা দোষে জেল খাটায় সে প্রচন্ড কষ্ট পেয়েছিল।
আব্দুছ ছামাদের সবচেয়ে বড় গুণ ছিল তার আমানতদারিতা। যুবসংঘের কেন্দ্রীয় অর্থ সম্পাদক ও মারকাযে ৫ বছর (২০১১-২০১৫) বোর্ডিং সুপারের দায়িত্ব পালনকালে সে যে সততা ও আমানতদারিতার পরিচয় দিয়েছে তা সত্যিই বিরল। তার মৃত্যুর পরের দিন ২৮শে মে’২১ তারিখের জুম‘আর খুৎবায় আমীরে জামা‘আত তার এ বিশেষ গুণের কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘আমাদের দায়িত্বশীল ভাইয়েরা আমাকে রিপোর্ট দিয়েছেন, তার পাঁচ বছরের বোর্ডিং সুপারের দায়িত্ব পালনকালে একদিনের একটা হিসাবেরও খেয়ানত আমরা পাই নাই। আলহামদুলিল্লাহ। টাকা-পয়সার খেয়ানত তো প্রায়ই হয়, তাই না? কিন্তু তার কোন বদনাম পাওয়া যায়নি’। আমীরে জামা‘আত খুৎবায় তার মাগফিরাতের জন্য অশ্রুসজল নয়নে কাতরকণ্ঠে আল্লাহর নিকট দো‘আ করেছিলেন।
আব্দুছ ছামাদ মারকাযের বোর্ডিং সুপারের দায়িত্ব হস্তান্তর কালে ৩,২৫,৫২৬/- (তিন লক্ষ পঁচিশ হাযার পাঁচশত ছাবিবশ) টাকা নগদ উদ্বৃত্ত রেখে গিয়েছিল। বোর্ডিং পরিচালনায় তার আন্তরিকতা, দক্ষতা, সততা ও আমানতদারিতার এটি ছিল এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত।
আব্দুছ ছামাদ মেধাবী ছাত্র ছিল। সে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরবী সাহিত্যে প্রথম শ্রেণীতে এম.এ পাশ করেছিল। সেই সাথে মারকায থেকে দাওরায়ে হাদীছও শেষ করেছিল। দারুল হাদীছ আহমাদিয়াহ সালাফিইয়াহ (বাঁকাল, সাতক্ষীরা) মাদ্রাসার শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় সে ১ম স্থান অধিকার করে ২০১৬ সালের ১লা জানুয়ারী বাঁকাল মাদ্রাসায় যোগদান করেছিল। সেখানে সে একইসাথে হোস্টেল সুপারের দায়িত্ব্ও পালন করত। আহলেহাদীছ আন্দোলন পরিচালিত এই প্রতিষ্ঠানই ছিল তার আমৃত্যু কর্মস্থল। তাছাড়া সে সাতক্ষীরা যেলা ‘আল-‘আওন’-এর সাধারণ সম্পাদক হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেছে।
নওদাপাড়া মারকাযের পুরনো ছাত্র হিসাবে এখানকার বহু ঘটনা ও বিষয়ের সে বিশ্বস্ত স্বাক্ষী ও জীবন্ত ইতিহাস ছিল। নওদাপাড়া মাদ্রাসার সাবেক ছাত্রদের ফেসবুক গ্রুপ ‘সাবেক মারকাযিয়ান’ খোলা হলে সে আমাদের সাথে অনেক অজানা তথ্য শেয়ার করত। মারকায ও সংগঠনের বহু দুর্লভ তথ্য ও ছবি তার কাছে আছে বলে এক আলাপচারিতায় আমাদেরকে জানিয়েছিল।
ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার পূর্বে তার পাইলসের অপারেশন হয়েছিল। এ সময় একদিন তার সাথে ফোনে কথা হয়। ‘কেমন আছ’ জানতে চাইলে সে তার পাইলসের অপারেশনের কথা বলেছিল। এর কিছুদিন পর হঠাৎ তার ব্লাড ক্যান্সার ধরা পড়ে। ঢাকার ইবনে সীনা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় ফোনে তার সাথে একবার কথা হয়। সে আকুতি জানিয়ে বলে, ‘নূরুল ভাই! আমার অবস্থা ভালো না। আপনারা আমার চিকিৎসার জন্য যা যা করণীয় তা করেন। আর আমার জন্য দো‘আ করেন, আল্লাহ যেন আমাকে দ্রুত সুস্থতা দান করেন’।
কথাগুলো যখনই মনে পড়ে তখন বুকের ভিতরটা হাহাকার করে উঠে। আমরা তাকে আশ্বস্ত করে বলেছিলাম, ‘চিকিৎসার অর্থের যোগান নিয়ে তোমাকে কোন চিন্তা করতে হবে না। আমরা আমাদের সাধ্য অনুযায়ী যা যা করণীয় তা করব ইনশাআল্লাহ’। আসলেই তার চিকিৎসার জন্য অর্থের কোন অভাব হয়নি। ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’, ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ’, নওদাপাড়া মাদ্রাসার সাবেক ও বর্তমান ছাত্র-শিক্ষকবৃন্দ, বাঁকাল মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকবৃন্দ, রাবির আরবী বিভাগে তার সহপাঠীবৃন্দ, প্রবাসী ভাইয়েরা সবাই তার সাহায্যে ব্যাপকভাবে এগিয়ে এসেছিল। যা ছিল অভূতপূর্ব। ইতিপূর্বে কারো চিকিৎসা সহায়তায় এ ধরনের স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া পাওয়া গেছে বলে আমরা জানি না। তার চিকিৎসার সব আয়োজনই চলছিল ঠিকঠাক। কিন্তু ওদিকে তার জীবনঘড়ির কাঁটা তার নির্দিষ্ট ও সুনির্ধারিত যাত্রার সংকেত দিচ্ছিল। তার আয়ুষ্কাল ফুরিয়ে এসেছিল। সেজন্য কোন আয়োজনই তার বেঁচে থাকার জন্য যথেষ্ট হয়নি। অবশেষে ৩৮ বছরের তরুণ আব্দুছ ছামাদের জীবনপ্রদীপ ২৭শে মে রাত ১১টা ৩৫ মিনিটে দপ করে নিভে গেল। সবাইকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে সে চলে গেল তার আপন ঠিকানায়।
প্রত্যেককে একদিন মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করতে হবে। কিন্তু আব্দুছ ছামাদ আমাদের ছেড়ে এতো তাড়াতাড়ি এভাবে চলে যাবে, তা স্বপ্নেও ভাবিনি। তার মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার পর গভীর রাত পর্যন্ত ঘুমাতে পারিনি। বার বার তার স্মৃতি মানসপটে ভেসে উঠছিল। আপনজন হারানোর বেদনায় মনের ভেতরটা দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছিল।
পরদিন তার জানাযায় শরীক হওয়ার জন্য সাতক্ষীরায় গমন করি। জানাযায় তার সাড়ে চার বছরের চটপটে ও ফুটফুটে পুত্র সন্তান আফীফ আব্দুল্লাহ ফুয়াদকে দেখে দু’চোখ বেয়ে অশ্রুধারা গড়িয়ে পড়ে। সে তখনো ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি, কি মূল্যবান জিনিস তার জীবন থেকে হারিয়ে গেল। সে জীবনের মতো পিতৃত্বের স্নেহছায়া থেকে বঞ্চিত হ’ল। সে যত বড় হবে ততই পিতার শূন্যতা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করবে। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! আব্দুছ ছামাদের পিতাও একই রোগে আক্রান্ত হয়ে এই বয়সেই তাকে রেখে এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গিয়েছিল। তার সন্তানকেও একই পরিস্থিতির শিকার হতে হ’ল।
পরিশেষে মহান আল্লাহর কাছে বিনম্র প্রার্থনা, আমাদের এই প্রিয় ভাইটিকে তিনি যেন তার রহমতের ছায়াতলে আশ্রয় দিয়ে পরকালীন জীবনে তাকে উত্তম পারিতোষিকে ভূষিত করেন। জান্নাতুল ফেরদাঊস যেন হয় তাঁর চিরস্থায়ী নিবাস। সাতক্ষীরা থেকে ফেরার আগে আমরা তার পরিবারের সাথে সাক্ষাৎকালে বিশেষত তার সন্তানের ভরণ-পোষণ ও শিক্ষা-দীক্ষার জন্য যা যা করণীয় তা করার আশ্বাস দিয়ে এসেছিলাম। আমরা দো‘আ করি, তাঁর সন্তানকে যেন আল্লাহ ‘নেক সন্তান’ হিসাবে কবুল করেন।-আমীন!