করোনাকালে মানবসমাজের জীবনমান উত্তরণে করণীয়

মুহাম্মাদ যয়নুল আবেদীন 1504 বার পঠিত

বিগত ১৯শে ডিসেম্বর ২০১৯ চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে প্রথম শনাক্ত হওয়া সেই করোনা ভাইরাসের ঢেউ আজ সারা বিশ্বের ১৯০টিরও বেশী দেশকে নাড়িয়ে দিয়েছে। যা মূলত মানুষের কর্মেরইফল । বিশ্ব চিরাচরিত যে শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে পরিচিত ছিল এবং অর্থনৈতিকভাবে পৃথিবী বিগত দশকগুলোতে যে অগ্রগতির ধারায় এগুচ্ছিল, কোভিড-১৯ এর কারণে ব্যাপকভাবে তার উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। ইতিপূর্বে পৃথিবী আরও অনেক মহামারির শিকার হয়েছে। যেমন খ্রিষ্টপূর্ব ৪৩০ অব্দে প্লেগ অব এথেন্স, ৫৪১ খ্রিষ্টাব্দে জাস্টিনিয়ার প্লেগ, ১৩৪৬ খ্রিষ্টাব্দে ব্ল্যাক ডেথ, কলেরা, এশিয়ান ফ্লু, গুটি বসন্ত, এইচআইভি, সার্স, ইবোলা, স্প্যানিশ ফ্লু এরকম আরো অসংখ্য রোগ। কিন্তু তা আজকের ন্যায় পুরো পৃথিবীব্যাপী ছিল না। বরং তা কোন দেশ বা অঞ্চল ভিত্তিক সীমাবদ্ধ ছিল।[1] যার ফলে বৈশি^ক অর্থনীতি ও শিক্ষাব্যবস্থায় ভঙ্গুরতার সৃষ্টি হয়েছে। এতে অধিকাংশ মানব সমাজের জীবনমান এক অচল অবস্থার শিকার হয়েছে।

করোনাকালে মানুষের জীবনমান :

ক. দিনমজুরদের অবস্থা : করোনা ভাইরাসে শুধু স্বাস্থ্য ঝুঁকি নয়, বরং গোটা বিশে^র অর্থনীতি বিধ্বস্ত হয়েছে। করোনা প্রতিরোধে প্রচলিত লকডাউন থাকার ফলে একদিকে যেমন অর্থনীতিতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে, অন্যদিকে নিমণ আয়ের শ্রমজীবী কয়েক কোটি মানুষের আহারের চরম অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। বিশ্ব ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০২০ ও ২০২১ এই দুই বছরে সারা বিশে^র ১১ থেকে ১৫ কোটি মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়ে যেতে পারে। যেখানে বাংলাদেশেই দুই কোটি ৪৫ লাখেরও বেশী মানুষ নতুনভাবে গরীব হয়েছে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) বলেছে, কোভিড-১৯-এর কারণে দারিদ্র্যতার হার ১৯ থেকে ২৯ শতাংশ হয়েছে।[2]

খ. কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতের অবস্থা : আমরা জানি যে, বাংলাদেশের অর্থনীতির তিনটি বড় খাত হচ্ছে কৃষি, শিল্প এবং সেবাখাত। প্রত্যেকটির আবার উপখাত রয়েছে। দেশী এবং বিদেশী অর্থনীতি অবরুদ্ধ থাকার কারণে দ্রব্যের মূল্যের উপর নিম্নমুখী প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। ফলে অর্থনীতিতে প্রতিদিন প্রায় ২’শ কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। শিল্প খাতে প্রতিদিনের অনুমিত ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১ হাযার ১ শত ৩১ কোটি টাকা।

অর্থনৈতিক ক্ষতি সবচেয়ে প্রকট আকার ধারণ করেছে সেবাখাতে। যেহেতু সেবাখাতের পরিধি ব্যাপক। তাই এর ক্ষতির আকারও বৃহৎ। সব মিলিয়ে সেবা খাতের দৈনিক অনুমিত ক্ষতির পরিমাণ কমপক্ষে ২ হাযার কোটি টাকা।[3]

গ. বেসরকারি চাকুরিজীবীদের অবস্থা : করোনা মহামারীর কারণে বিশে^র প্রতি দু’জনের একজনের আয় কমেছে। ওয়াশিংটন ভিত্তিক জনমত জরিপ প্রতিষ্ঠান গ্যালাপ বলছে, জরিপে অংশগ্রহণকারী বাংলাদেশসহ ৫৭টি দেশের ৬৫ শতাংশ মানুষ বলেছে, মহামারীতে তাদের কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। গ্যালাপ ১১৭টি দেশের ৩ লাখ মানুষের উপর জরিপ চালিয়ে জানায়, করোনা মহামারীর কারণে তাদের মধ্যে অর্ধেক মানুষের আয় কমে গেছে। তবে এমনটি বিশে^র প্রায় ১৬০ কোটি মানুষের ক্ষেত্রে ঘটেছে।

গবেষকরা এক বিবৃতিতে বলেন, আয় কমে যাওয়া বা চাকরি হারানোর এই হার থাইল্যান্ডে বেশী, যা ৭৬ শতাংশে পৌঁছেছে। আর সুইজারল্যান্ডে এই হার কম, যা ১০ শতাংশে রয়েছে। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ৩৪ শতাংশ মানুষও কর্মহীন হয়ে পড়েছে।[4]

এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (ADB) বলেছে, বাংলাদেশের জিডিপি সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে ১.১ ভাগ কমে যেতে পারে। তাদের হিসাবে এতে মোট ৩০০ কোটি ডলারের ক্ষতি হবে, ৮ লাখ ৯৪ হাযার ৯৩০ জন চাকরি হারাবে।[5]

ঘ. সরকারী চাকরিজীবীদের অবস্থা : মহামারীর এই লকডাউন চলাকালে শ্রমজীবী মানুষের যেখানে দিনে সামান্য অর্থ উপার্জন ও আহার যোগান দিতে হিমশিম খাচ্ছেন, ঠিক সেই মুহূর্তে সরকারী চাকরিজীবিদের জীবন যাত্রার মান পূর্বের অবস্থাতেই রয়েছে। কর্ম হারানোর অসুবিধা বিন্দুমাত্র তারা আঁচ করেনি।

ঙ. শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষার্থীদের অবস্থা : বিশ্ব চিরাচরিত যে শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে পরিচিত ছিল মানুষ, কোভিড-১৯-এর কারণে আগামী প্রজন্মের স্বপ্নসৌধ নির্মাণের মূলকেন্দ্র শিক্ষা ব্যবস্থায় বিঘ্নিত হচ্ছে। পৃথিবীর ইতিহাসে শিক্ষা ব্যবস্থায় এতবড় আঘাত এটাই প্রথম। গত বছরের জুলাই পর্যন্ত ১৬০ টিরও বেশী দেশের স্কুল বন্ধ ছিল। এতে ১০০ কোটিরও বেশী শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দীর্ঘদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় মোট শিক্ষার্থীর ৯৪ ভাগ কোন-না কোনভাবে ক্ষতির শিকার হয়েছে।[6]

সম্প্রতি এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোভিডের কারণে বিশ্বের প্রায় ২.৫ কোটি শিশু কখনো শিক্ষার আলো দেখবে না। এদিকে জাতিসংঘ উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছে, মহামারীতে ক্ষতির শিকার প্রায় ১৬ কোটি শিশু। এভাবে জাতিসংঘ শিশু তহবিল ইউনিসেফের গত ২৪শে আগষ্ট প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বংলাদেশে করোনা মহামারির পুরোটা সময় জুড়েই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। কোভিড-১৯এর কারণে স্কুল বন্ধের ক্ষেত্রে বংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় দীর্ঘ। এই বন্ধের ফলে প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা স্তর পর্যন্ত চার কোটির বেশী শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।[7] দীর্ঘদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিশু-কিশোরদের মাঝে বিভিন্ন অনৈতিক ও অসামাজিক কর্মকান্ড যেমন- চুরি, ছিনতাই, আত্মহত্যা, মারামারি, পালিয়ে গিয়ে বাল্য বিবাহ, অসামাজিক বিবাহ, এমনকি কিশোরগ্যাং-এর মত অন্যায় কাজে জড়িয়ে পড়েছে। ফলে সমাজ এক অশান্ত ও অস্বস্তিকর পরিবেশের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করছে।

কোভিড-১৯-এর কারণে ৮০ শতাংশের বেশী শিক্ষার্থীর শিক্ষা কার্যক্রম বিঘ্নিত হওয়ায় করোনাকালীন শিক্ষাকার্য যাতে অব্যাহত থাকে তজ্জন্য আন্তর্জাতিক সংস্থা ইউনিসেফ রেডিও, টিভি ও ইন্টারনেটে লাইভ ক্লাস এবং অ্যাসাইনমেন্ট জমাদানের মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে আসছে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হ’ল, বাংলাদেশের মত দরিদ্র দেশের জন্য ইউনিসেফের দেওয়া পরামর্শ বা উদ্যোগ কতটা কার্যকর হবে তা অনুমেয়। যেখানে অনেকেরই উন্নত মোবাইল, টিভি, ল্যাপটপ, কম্পিউটারের মত এসব জিনিস নেই।

এসব প্রযুক্তি হাতের নাগালে আসার ফলে শিশুরা লাইভ ক্লাসের নামে বা ক্লাসের অপেক্ষায় থেকে ইন্টারনেট জগতে প্রবেশ করে ফেইসবুকসহ বিভিন্ন গেইম যেমন- পাবজি, ফ্রি-ফায়ার ইত্যাদিতে আসক্ত হচ্ছে। ফলশ্রুতিতে না ঘরকা না ঘাটকা অবস্থার সৃষ্টি হয়ে তরুণ সমাজ অধঃপতনের অতল গহববরে নিপতিত হচ্ছে।

অনলাইন লেখাপড়ার যেমন অনেক অসুবিধা রয়েছে, তেমনি স্বাস্থ্যগত অনেক সমস্যার আশংকা রয়েছে। স্বাস্থ্যবিদদের তথ্য অনুযায়ী অনলাইনে ক্লাসের ফলে হিতে বিপরীত অবস্থার সৃষ্টি হবার আশংকা বেশি। এতে দীর্ঘক্ষণ এক দৃষ্টিতে দৃশ্যমান প্রযুক্তির দিকে তাকিয়ে থাকায় চোখ, মন, মগজ ও স্বাস্থ্য ঝুঁকি রয়েছে। অথচ এর বিপরীতে সরাসরি পাঠদান মানসিক গঠনের পাশাপাশি শারীরিক উন্নতি এবং রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলে।

চ. চাকরি প্রত্যাশীদের অবস্থা : করোনাভাইরাস মহামারীতে কেবল শ্রমজীবী ও বিভিন্ন পেশাজীবীরাই মহাসংকটাপন্ন অবস্থার মধ্যদিয়ে দিনাতিপাত করছে না, বরং চাকরি প্রত্যাশীরাও মহাসংকটে রয়েছেন। যাদের অনেকেই প্রাইভেট-টিউশনি করে কোনরকম চলত, আজ তাদের সেই শেষ সম্বলটুকুও হারিয়ে পিতা-মাতার নিকট বোঝায় পরিণত হয়েছে। এদিকে পিতা-মাতা আশায় বুক বেঁধে আছেন সন্তান লেখাপড়া শেষ করে চাকরি পেয়ে সংসারের হাল ধরবে। সন্তান ভাবছে চাকরি পেয়ে বৃদ্ধ পিতা-মাতার খেদমতে মনোনিবেশ করবে। কিন্তু না, সে আশা হতাশায় পরিণত হয়েছে। সম্প্রতি এক গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, করোনাকালে দীর্ঘদিন কোন প্রকার সার্কুলার ও নিয়োগ না থাকায় সরকারী চাকরিতে প্রবেশের বয়স হারিয়েছে ২ লাখ চাকরি প্রত্যাশী। যেখানে প্রতিবছর প্রায় ২০ লাখ শিক্ষার্থী বাংলাদেশের চাকরির বাজারে যোগদান করেন। করোনায় অনেকের বয়সসীমা অতিক্রম করেছে। এখন কি হবে এই বিশাল বেকার জনগোষ্ঠীর?

সংকটময় মুহূর্তে করণীয় :

আল্লাহর উপর ভরসা : আল্লাহর উপর ভরসা মুমিন জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ও আবশ্যকীয় একটি বিষয়। যা ব্যতীত তাঁর নৈকট্য হাছিল করা যায়না। যাকে দ্বীনের অর্ধেক হিসাবে গণ্য করা হয়। করোনা মহামারীতে আমাদের উচিত আরো বেশি তাক্বওয়া অর্জন করা। করোনা মহামারী থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় হল আল্লাহকে অধিকহারে স্মরণ করা। বিপদে আল্লাহকে বেশি বেশি ডাকলে তিনিই আমাদের জন্য যথেষ্ট হবেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَمَنْ يَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ فَهُوَ حَسْبُهُ ‘আর যে আল্লাহর উপর ভরসা করে তিনি তার জন্য যথেষ্ট হন’ (ত্বলাক্ব ৬৫/৩)।

ইবনুল ক্বাইয়্যিম (রহঃ) বলেন, বান্দা যদি কোন পাহাড় সরাতে আদিষ্ট হয় আর যদি সে কাজে সে আল্লাহ তা‘আলার উপর যথার্থভাবে ভরসা করতে পারে, তবে সে পাহাড়ও সরিয়ে দিতে পারবে।[8]

এছাড়াও এমতাবস্থায় মানসিক দৃঢ়তাও প্রবলভাবে দরকার। করোনায় আতঙ্কিত না হয়ে বিপদে ধৈর্য ধারণ ও নিজের উপর আস্থা রেখে সব সময় নেতিবাচক চিন্তা বাদ দিয়ে সর্বত্রভাবে আল্লাহ ভরসা করতে হবে।

জীবনমান উত্তরণে করণীয় :

মানবসমাজের জীবনমান উত্তরণে সবাইকে এক যোগে এগিয়ে আসতে হবে এবং মানবতার বৃহত্তর সেবায় নিজেদেরকে আত্মনিয়োগ করতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, مَنْ ذَا الَّذِي يُقْرِضُ اللَّهَ قَرْضًا حَسَنًا فَيُضَاعِفَهُ لَهُ أَضْعَافًا كَثِيرَةً وَاللَّهُ يَقْبِضُ وَيَبْسُطُ وَإِلَيْهِ تُرْجَعُونَ ‘কে আছে, যে আল্লাহকে উত্তম ঋণ দেবে? ফলে তিনি তার জন্য বহুগুণে বাড়িয়ে দিবেন, আর আল্লাহ সংকীর্ণ করেন ও প্রসারিত করেন এবং তাঁরই নিকট তোমাদেরকে ফিরানো হবে’ (বাক্বারাহ ২/২৪৫)।

এছাড়া হাদীছে রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘কোন বান্দা যতক্ষণ তার ভাইয়ের সাহায্যে রত থাকে আল্লাহ তা‘আলাও ততক্ষণ তাকে সাহায্য করতে থাকেন’।[9] অন্যত্র রাসূল (ছাঃ) বলেন, مَنْ نَفَّسَ عَنْ مُؤْمِنٍ كُرْبَةً مِنْ كُرَبِ الدُّنْيَا، نَفَّسَ اللَّهُ عَنْهُ كُرْبَةً مِنْ كُرَبِ الآخِرَةِ، وَمَنْ سَتَرَ عَلَى مُسْلِمٍ ‘যে ব্যক্তি দুনিয়াতে তার কোন মুমিন ভাইয়ের একটি কষ্ট বা বিপদ দূর করবে, আল্লাহ তা‘আলাও ক্বিয়ামতের দিন তার একটি বিপদ দূর করে দিবেন।[10]

‘বর্তমানে মানুষ মানুষের সহযোগিতার মানসিকতা থেকে বিমুখ হয়ে নিজেরা ভোগ-বিলাসে মত্ত হচ্ছেন। যার দিকে ইঙ্গিত করে কবি মুছত্বফা লুত্বফী আল-মান ফালুত্বী বলেন- بطنه الغني انتقام لجوع الفقير‘ধনীদের অতিভোজ জনিত পীড়া ক্ষুধার্ত দরিদ্রের প্রতিশোধ মাত্র’।[11]

ক. ব্যক্তিগত উদ্যোগ : করোনাকালীন সংকটময় পরিস্থিতিতে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের পাশে দাঁড়াতে বিত্তশালী ব্যক্তিরা এগিয়ে এসে মানবসেবার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রাখতে পারেন। যুগে যুগে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে মানব সেবার মাধ্যমে ইতিহাসের পাতায় স্মরণীয় হয়ে আছেন অনেকেই। আপনিও হ’তে পারেন তাদের একজন। যেমন তাদের অন্যতম হাজী মুহাম্মাদ মুহসীন, হাজী মুহাম্মাদ দানেশ, নওয়াব সলীমুল্লাহ, প্রতিবেশী রাষ্ট্রের জনক হিসাবে খ্যাত মাহাত্মা গান্ধী ও আলবেনীয় বংশোদ্ভুত মাদার তেরেসাসহ আরো অনেকেই।

খ. সামাজিক উদ্দ্যোগ : করোনাকালীন ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের জন্য সামাজিক বিভিন্ন সংস্থাকে এগিয়ে আসতে হবে। এ সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, كُنْتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ ‘তোমরাই শ্রেষ্ঠ জাতি, মানুষের কল্যাণের জন্য তোমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে’ (আল-ইমরান ৩/১১০)।

রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘মানুষের কল্যাণ সংশ্লিষ্ট যত কাজ আছে, তার মধ্যে সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ও সর্বোত্তম কাজ হচ্ছে দরিদ্র ও ক্ষুধার্তকে খাবার দান করা।[12]

গ. রাষ্ট্রীয় বা সরকারী উদ্যোগ : বর্তমান পরিস্থিতিতে ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের জন্য সরকারীভাবে ব্যাপকহারে সহায়তা প্রদান করতে হবে। এক্ষেত্রে এ খাতের জন্য আলাদা উচ্চতর বাজেট নির্ধারণ করে তার সুষ্ঠু বাস্তবায়ন কমিটি গঠন করে ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে সুষ্ঠুভাবে বণ্টন করতে হবে। দুর্নীতি ও আত্মসাৎকারী ব্যক্তিদের আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি বিধান করতে হবে। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের ব্যাপক সহায়তার জন্য করোনাকালীন সরকারকে কিছু নবপদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে। যেমনভাবে অন্যান্য দেশেও এধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের তেলেঙ্গানা রাজ্যে প্রথম এ ক্ষেত্রে সরকারী চাকরিজীবী ও অবসরপ্রাপ্তদের পেনশনের ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ থেকে ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত বেতন কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।[13]

ঘ. আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর উদ্দ্যোগ : করোনাকালে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অতিব যরূরী। একই সাথে সব দেশ ব্যাপক ক্ষতির শিকার নয়। তাই তুলনামূলক অধিক ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে সহযোগিতা দানের জন্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো (WHO, OIC, G-7 ইত্যাদি)-কে সর্বাধিক দায়িত্ব পালন করতে হবে।

উপসংহার : সর্বাগ্রে একথা বিশ^াস করতে হবে যে, রোগ আল্লাহর সৃষ্টি। মুক্তি দেওয়ার মালিকও তিনি। রাসূল (ছাঃ) বলেন, আল্লাহ তা‘আলা এমন কোনো রোগ পাঠাননি, যা আরোগ্যের ব্যবস্থা দেননি।[14] করোনা প্রতিরোধক এবং প্রতিষেধক উপকরণ আল্লাহ তা‘আলা আমাদের প্রদান করেছেন, যা সুষ্ঠু গবেষণার মাধ্যমে বের করতে হবে। আল্লাহর রহমতে ইতোমধ্যে অনেক দেশ ভ্যাকসিন তৈরীতে সক্ষম হয়েছে। যা মানবজাতির জন্য আল্লাহ প্রদত্ত সুসংবাদও বটে। অতএব মানবসমাজের জীবনমান উত্তরণে দরকার দায়িত্বশীল, সমাজ ও রাষ্ট্রের ইখলাছপূর্ণ আন্তরিকতা ও পরিকল্পনা মাফিক কাজের পরিধি তৈরী করা। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সহায় হৌন- আমীন!

[ লেখক : এম. ফিল গবেষক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়]


[1]. যুগান্তর : ৩ ফেব্রুয়ারী ২০২১।

[2]. ঐ।

[3]. www.du.ac.bd

[4]. আত-তাহরীক/জুন ২০২১।

[5]. https://m.dw.com

[6]. যুগান্তর : ৩ ফেব্রুয়ারী ২০২১।

[7]. প্রথম আলো: ২৭আগষ্ট ২০২১।

[8]. মাদারিজুস সালিকীন ১/৮১

[9]. মুসলিম হা/২৬৯৯।

[10]. মুসলিম হা/তিরিমিযি ১৪২৫; ইবনু মাজাহ ২২৫।

[11]. https://al-maktaba.org/book/11400/82

[12]. বুখারী হা/১২।

[13]. দৈনিক ইত্তেফাক ৩১ মার্চ ২০২০

[14]. বুখারী হা/৫৬৭৮।



বিষয়সমূহ: বিধি-বিধান
আরও