শায়খ নে‘মাতুল্লাহ তুর্কী

ফরীদুল ইসলাম 842 বার পঠিত

[শায়খ নে‘মাতুল্লাহ তুর্কী তুরস্কের একজন বিখ্যাত আলেম এবং ইসলাম প্রচারক। গত ৩১শে জুলাই ২০২১ তিনি তুরস্কের রাজধানী ইস্তাম্বুলে মৃত্যুবরণ করেন। বরেণ্য এই দাঈ ইলাল্লাহ জীবনের অধিকাংশ সময় কাটিয়েছেন মানুষকে ইসলামের পথে আহবান জানিয়ে। জনপ্রিয় কোন বক্তা বা শিক্ষক তিনি ছিলেন না, ছিলেন না মিডিয়া ব্যক্তিত্ব; কিন্তু বহু মানুষ তাঁর দাওয়াতে ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় পেয়েছেন। ধন্য হয়েছে এক নতুন জীবনের দিশা পেয়ে। বক্ষমান নিবন্ধে এই মহান দাঈ’র সংক্ষিপ্ত জীবনী তুলে ধরা হ’ল।- নির্বাহী সম্পাদক

জন্ম ও শিক্ষাজীবন : শায়খ নে‘মাতুল্লাহ ইবরাহীম ইয়ার্ট  তুর্কী আনুমানিক ১৯৩১ সালে আধুনিক তুরস্কের দক্ষিণ আমাসিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বহির্বিশ্বে নে‘মাতুল্লাহ খোজা নামেই অধিক পরিচিত। ছোটবেলায় তাঁর বোনের কাছে কুরআন শিক্ষার মাধ্যমে তাঁর শিক্ষা জীবনের সূচনা হয়। বড় বড় আলেমদের ছোহবত, দ্বীনী মজলিসে যাওয়া-আসা এবং সেখান থেকে তিনি জীবন চলার পাথেয় হিসাবে প্রচুর তাত্বিক ও আধ্মাতিক জ্ঞান অর্জন করেন। এছাড়াও ওছমানী সাম্রাজ্যের শেষ সুলতান আব্দুল হামীদের শাসনামলে অনেক আলেমের কাছে তিনি জ্ঞানার্জন করেন। তিনি বিংশ শতাব্দীর একজন প্রাজ্ঞ আলেম ও দাঈ ছিলেন।

কর্মজীবন : মক্কার জাবালে হেরা প্রান্তরে ‘আন-নূর’ মসজিদের ইমাম হিসাবে ১৫ বছর দায়িত্ব পালন করেন।  তিনি মদীনার একটি মসজিদেও অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে ১৫ বছর ইমামের দায়িত্ব পালন করেন। এর আগে তিনি ইস্তাম্বুলের বিখ্যাত ‘সুলতান আহমাদ’ মসজিদসহ অনেক মসজিদের ইমাম ও মুয়াযযিন হিসাবে দীর্ঘ দিন দায়িত্ব পালন করেন।

ইসলাম প্রচারে আত্মনিয়োগ : ইউরোপ ও এশিয়ার ৫৫টিরও বেশী দেশে তিনি ইসলাম প্রচার ও প্রসারে কাজ করেছেন। বিশে^র বিভিন্ন প্রান্তে ১০০টির অধিক মসজিদ তিনি প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি সাইবেরিয়াসহ রাশিয়ার বিভিন্ন এলাকায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রার মধ্যেও শুধুমাত্র সাদা জুববা পরে ইসলামের দাওয়াত দিয়েছেন।

জাপান, কোরিয়া ও ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশের হাযার-হাযার লোক তাঁর হাতে ইসলাম গ্রহণ করেন। এমনকি তিনি জাপানে তাঁর অসাধারণ প্রচেষ্টার মাধ্যমে প্রায় ৪০১টি মসজিদ ও প্রার্থনা হল প্রতিষ্ঠা করেন এবং তা জাপানের কিছু চ্যানেলে প্রর্দশিত হলে তা দেখে অসংখ্য মানুষ ইসলাম গ্রহণ করে। তিনি ৬টি ভাষা জানতেন। শাহ নে‘মাতুল্লাহ তুর্কীর ঘনিষ্ট বন্ধু ওমর ফারুক আওযাকযাদাহ বলেন, ইসলাম প্রচারের সহজতার জন্য তিনি তুর্কী, আরবী, ফারসী, উর্দূ, আলবেনিয় সহ ইংরেজীতেও ইসলামের দাওয়াত দিতেন। স্থানীয় ভাষায় ইসলামের পরিচিতিমূলক ছোট কার্ড ও বই প্রস্তুত করে সব সময় নিজের পকেটে এসব বই রাখতেন আর রাস্তায় দাঁড়িয়ে তা বিতরণ করতেন। সব স্থানে, সর্বশ্রেণীর মানুষের মধ্যে ইসলামের বাণী পৌঁছে দিতে তিনি বদ্ধ পরিকর ছিলেন। তাঁর ইসলাম প্রচারের পদ্ধতি ছিল খুবই সরল। একটি ছোট ছাপানো কার্ড তাঁর হাতে থাকত, যেখানে লেখা থাকত ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’। আর সাথে নয়টি ভাষায় বাক্যটির অনুবাদ উল্লেখ করা থাকত। অমুসলিম যার সাথেই তাঁর দেখা হ’ত, তিনি কার্ডটি দিতেন। যারা কার্ডটি পড়ার পর তাঁর কাছে ব্যাখ্যা জানতে চাইত, তিনি তাদেরকে ইসলাম সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ধারণা দিতেন। এভাবেই ইসলামের প্রতি তাঁর দাওয়াতের সূচনা হ’ত। শুধু জাপানেই তাঁর প্রভাবে প্রায় লক্ষাধিক মানুষ ইসলাম গ্রহণ করেছেন বলে ধারণা করা হয়।

টোকিওতে ইসলামিক সেন্টার প্রতিষ্ঠা : শায়খ নে‘মাতুল্লাহ জাপানে প্রায় ১৫ বছর অবস্থান করেন। এ সময় রাজধানী টোকিওতে ইসলামী শিক্ষা ও সংস্কৃতি প্রসারে একটি ইসলামিক সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেন। জাপান ইসলামিক সেন্টারের প্রধান ড. ছালেহ সামেরী বর্ণনা করেন, শায়খ নে‘মাতুল্লাহ জাপানে ১৪ বছরের বেশী অবস্থান করেন। এ সময় তিনি উত্তর-দক্ষিণ প্রান্ত চষে বেড়িয়ে অসংখ্য মসজিদ ও মাদরাসা স্থাপন করেন। তাঁর ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’-এর দাওয়াতে অসংখ্য মানুষ সাড়া দিয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। প্রতিদিন ইসলামের পরিচিতিমূলক ছোট বইয়ের শত শত কপি বিতরণ করতেন। সকাল-সন্ধ্যা মানুষ ইসলামিক সেন্টারে এসে তার কথা শুনত। পথে, বাযারে, স্কুল-কলেজ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে চলতে-ফিরতে তিনি ইসলামের দিকে মানুষকে ডাকতেন।

চীনে ২০ হাযার কুরআনের কপি প্রেরণ : কম্যুনিস্ট মতবাদের দেশ চীনেও তিনি তাঁর দাওয়াতী কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন। যেখানে মুসলমানদের সমস্ত ধর্মীয় অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এমনকি ছালাত, ছিয়ামের মত ইসলামের বুনিয়াদী ইবাদতগুলোর উপরও হস্তক্ষেপ করা হয়। পবিত্র কুরআন পাঠের উপর নিষেধাজ্ঞা জারী করা হয়েছে। এমন প্রতিকূল পরিবেশেও তিনি ১৯৮১ সালে চীন সরকারের অনুমতিক্রমে দেশটিতে ২০ হাযারের বেশী পবিত্র কুরআনের কপি পাঠিয়েছেন। যা সত্যিই অবিশ্বাস্য! 

মদশালা থেকে ইসলামের পথে : নানা শ্রেণী ও পেশার মানুষের কাছে বিচিত্র পদ্ধতিতে ইসলামের সৌন্দর্য তুলে ধরতেন তিনি। থাইল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, জার্মানী, কোরিয়াসহ বিভিন্ন দেশের মদের বার থেকে অসংখ্য নেশাগ্রস্ত মানুষকে মসজিদে আঙিনায় নিয়ে আসেন তিনি। মানুষের কাছে সহজভাবে হাসিমাখা মুখে ইসলামের বার্তা পৌঁছে দেয়া ছিল তুর্কী এই আলেমের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

মক্কায় ‘আন-নূর’ মসজিদে দায়িত্ব পালনকালে এক লোক শায়খকে সালাম প্রদান করে তাঁর কপালে চুমু দেন। যেন শায়খ তাঁর দীর্ঘদিনের পরিচিত। এরপর লোকটি হেসে বলল, শায়খ, আমি ঐ তরুণদের একজন, যাদের আপনি অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনার একটি মদের বারে ইসলামের দাওয়াত দিয়েছিলেন। আপনার কথা শুনে আমি জীবন পরিবর্তনের তাওবা করেছি এবং সব সময় আপনার জন্য দো‘আ করেছি।

১৯৭৯ সালে শায়খ নে‘মাতুল্লাহ জার্মানীর রাজধানী বার্লিনের একটি মসজিদ যান। তিনি স্থানীয় তুর্কীদের বাকি মুসলিমদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তারা বলল, আপনি আমাদের সঙ্গে কথা বলেন। আমরাই পুরো সময় আপনার কথা শুনব। কিন্তু তিনি বার বার বাকিদের কথা জিজ্ঞেস করায় তারা মদের বারে আছে বলে জানানো হ’ল।

শায়খ স্থানীয় একজনকে নিয়ে বারে যান। প্রায় ৪০ জন সেই বার পরিচালনা করে। শায়খ সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘হে মুজাহিদগণ, আস-সালামু আলাইকুম’। মুজাহিদ বলায় সবাই একে অপরের দিকে তাকাল। শায়খ বললেন, ‘আপনারা তিন কারণে মুজাহিদ’। প্রথম কারণ : জার্মানীতে আপনারা ইসলামী নাম ধারণ করে চলাফেরা করেন, যা মানুষকে ইসলামের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। দ্বিতীয় কারণ : আপনারা নিজ পরিবারের রুযী-রোযগারের জন্য জার্মানীতে এসেছেন। এটাও জিহাদের অংশ। তৃতীয় কারণ : আপনাদের পূর্বপুরুষ ওছমানীয়রা মুজাহিদ ছিলেন। আপনারা তাদের উত্তরসূরী।

অতঃপর শায়খ বলেন, আমি মদীনা থেকে আপনাদের জন্য একটি সুসংবাদ নিয়ে এসেছি। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি বলবে, ‘লা ইলাহা ইল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’ সে জান্নাতে প্রবেশ করবে’। এরপর তিনি তাদের ইসলামের পথে ফিরতে উৎসাহিত করে কুরআন ও হাদীছের অনেক কথা বলেন। তাঁর হৃদয়গ্রাহী বক্তব্য শুনে উক্ত ৪০ জনের সবাই জাহেলিয়াতের জীবন ছেড়ে ইসলামী অনুশাসন মেনে জীবন যাপন শুরু করার শপথ করেন।

তিন বছর পর শায়খ একদিন মসজিদে নববীতে বসা ছিলেন। পাগড়ী মাথায় এক তুর্কী এসে জিজ্ঞেস করল, শায়খ আপনি আমাকে চেনেন? তিনি বললেন, কেন চিনব না। তুমি হয়ত তুরস্কের বড় কোনো ইমাম বা আলেম হয়ে থাকবে! লোকটি বলল, শায়খ, হাযার বছর গেলেও আপনি আমাকে চিনবেন না। আমি বার্লিনের মদের বারের শেষ ব্যক্তি। নেশাগ্রস্ত অবস্থায় মদশালা থেকে দুজন লোক আমাকে মসজিদে নিয়ে যায়। আপনি আমার মাথা স্পর্শ করে বলেছিলেন, ‘আপনার মূল্য আল্লাহর কাছে অনেক বেশী। তিনি আপনাকে তাঁর ঘরের জন্য কবুল করেছেন। আমি নেশাগ্রস্ত হলেও আপনার কথা বুঝতে পারি। এরপর নিজের জীবন পরিবর্তন করে নিয়মিত ছালাত আদায় শুরু করি। সস্ত্রীক ওমরাহ পালন করে ফের আপনার সান্নিধ্যে এসেছি।

সব মানুষের জন্য কল্যাণ কামনা : রাতের বেলা টোকিওর কেন্দ্রীয় মসজিদে তিনি মানুষকে ছালাতের জন্য ডেকে আনতেন। কারো সঙ্গে তার কোনো বিরোধ-বৈরী মনোভাব ছিল না। সব মুসলিমকে ঐক্যবদ্ধ করার কাজে নিমগ্ন থাকতেন। সবার কাছে তিনি অত্যন্ত প্রিয় ব্যক্তি। তিনি কারো প্রতি অভিশাপ বা বদ দো‘আ করতেন না। বরং সবার জন্য কল্যাণের দো‘আ করতেন। তিনি দো‘আয় বলতেন, ‘হে আল্লাহ, ইসলামের শত্রুদের হেদায়াত দিন। ইসলামের শত্রুদের বিদ্বেষকে ওমর (রাঃ), খালিদ (রাঃ), ইকরামা (রাঃ)-এর মতো পরিবর্তন করে তাদেরকে ইসলামের সহযোগী হিসাবে কবুল করুন।

মৃত্যুবরণ : মুত্যৃর ছয় মাস পূর্বে হৃদরোগে আক্রান্ত হ’লে নে‘মাতুল্লাহ খাযা ইস্তাম্বুলে একটি অপারেশন করিয়েছিলেন। অতঃপর তাঁর স্বাস্থ্যের অবনতি হওয়া সত্ত্বেও তিনি ইস্তাম্বুলের ‘সারি ইয়ার’ মসজিদে তাঁর ছাত্রদের পাঠদান বন্ধ করেননি। অবশেষে তাঁর স্বাস্থ্য একেবারেই নাযুক হয়ে পড়লে তাকে ইস্তাম্বুলের ‘গেনকেলকয়’ হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে তিনি ৩১শে জুলাই ২০২১ মারা যান এবং রবিবারের দিন তাকে ‘আইয়ূব সুলতান’ কবরস্থানে দাফনের পূর্বে ‘আল-ফাতেহ’ মসজিদে তাঁর জানাযা অনুষ্ঠিত হয়।

যমীনের উপর মাটি বা পশমের একটি ঘরও বাকী থাকবে না, যে ঘরে আল্লাহ রববুল আলামীন ইসলামের বাণী পোঁছাবেন না। সে লক্ষ্যে শায়খ নে‘মাতুল্লাহ বিশ্বের সকল মানুষের কাছে ইসলামের সুমহান আদর্শ পৌঁছে দিতে সর্বাত্মক চেষ্টা করে গেছেন। তিনি দুঃখবোধ করতেন এবং আকুতিভরা কন্ঠে বলতেন, ‘ক্বিয়ামতের দিন আমি নবীর মুখের দিকে কিভাবে তাকাব? আমাকে পৃথিবীর সকল মানুষের কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে দিতে বলা হয়েছিল’। মহান আল্লাহ তাঁর ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করুন এবং তাঁকে জান্নাতুল ফেরদাউস নছীব করুন-আমীন!

ফরীদুল ইসলাম

লেখক : ছানাবিয়া ২য় বর্ষ, আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী নওদাপাড়া, সপুরা, রাজশাহী



বিষয়সমূহ: মনীষীদের জীবনী
আরও