বিচক্ষণ বিচারক

মুহাম্মাদ আব্দুর রঊফ 677 বার পঠিত

অনেক দিন আগের কথা। এক ব্যক্তি একজনকে ১০০ স্বর্ণমুদ্রা ধার দিয়েছিল। কিন্তু কোন চুক্তিপত্রে লিখেনি। যখন সে টাকা ফেরত চায় তখন ঋণগ্রহীতা অস্বীকার করে বলে, কিসের টাকা? কোন বইয়ে লেখা আছে? নিরুপায় হয়ে পাওনাদার বিচারকের কাছে অভিযোগ করে। বিচারক ঐ ব্যক্তিকে উপস্থিত করে বলেন, এই লোকের কাছ থেকে যে টাকা নিয়েছ তা দিচ্ছ না কেন?

ঋণগ্রহীতা : আমি কোন টাকা নেইনি। সে মিথ্যা কথা বলছে। সে আমার সম্মান নষ্ট করতে চায়। বিচারক এদের দু’জনের বিচারের জন্য তার ঊর্ধ্বতন বিচারকের কাছে পাঠান।

বিচারক : তোমাদের অভিযোগ বল। একজন তার পাওনা টাকার কথা বলল, আর অন্যজন তা অস্বীকার করল।

একজন পাওনাদার আর অন্যজন অস্বীকারকারী। শরী‘আতের আদেশমতে পাওনাদারের অবশ্যই সাক্ষী থাকতে হবে আর যে অস্বীকার করবে তাকে কসম করতে হবে। অতঃপর পাওনাদারকে বলল, তোমার কোনো সাক্ষী আছে, যে বলবে এই লোক টাকা নিয়েছে? পাওনাদার বলল, না, সাক্ষী নেই।

বিচারক : তাহ’লে কোন উপায় নেই। অবশ্যই অভিযুক্ত কসম করুক। যদি কসম করে বলে টাকা নিইনি তাহ’লে আর কিছুই করার থাকবে না। কিন্তু অপরাধীরা আল্লাহকে ভয় পায় এবং মিথ্যা কসম করে না। কারণ একদিন সত্য ফাঁস হলে অপমান ও শাস্তির বোঝা তাকে বইতে হবে।

পাওনাদার : এ কথা শুনে কান্নাকাটি শুরু করে। অনুনয় বিনুনয় করে বিচারককে বলে, এই কাজ করবেন না। এই লোকের কসমের প্রতি কোন বিশ্বাস নেই। সে মিথ্যা কসম করবে এতে আমার অধিকার পদদলিত হবে। অন্য উপায় বের করে একটি সমাধান করুন।

বিচারক : তুমি বলছো তোমার কোন সাক্ষী নেই আর আমিও তো গায়েব জানি না। তাহ’লে টাকা ধার দেওয়ার ঘটনাটা তার সামনেই বলো দেখি, সত্য ঘটনা বের হয় কিনা।

পাওনাদার : ঘটনা হ’ল আমরা কয়েক বছর ধরে পরস্পরের বন্ধু ছিলাম। আমি তার মধ্যে কোন অসৎ কাজ দেখিনি এবং সে প্রচন্ড গরীবও ছিল না। বাগান, বাড়ি ও জমানো পুঁজি ছিল। হঠাৎ বিবাহের প্রস্তাব পেয়ে সেখানে যায়। ঐ সময় এক সপ্তাহ পরে বিবাহের দিনক্ষণ ঠিক হয়। মেয়েটির আরো বিবাহের প্রস্তাব ছিল। ঐ দিনগুলোতে আমার বন্ধু প্রেমাসক্ত, অস্থির ও চিন্তায় পড়ে থাকত। আমরা একদিন এক বনে ঘুরতে যাই। আমরা দু’জনই এক জায়গায় বসে ছিলাম। সে আমাকে তার অবস্থা খুলে বলে। আমার কাছে নগদ টাকা নেই। এক টুকরা জমি যেটা গ্রামে আছে সেটা বিক্রি করে বিবাহের খরচ জোগাড় করবো। কিন্তু সময় নেই। আমি এই কথাগুলো শুনে চিন্তায় পড়লাম। তার জন্য আমার কষ্ট লাগলো। দুনিয়ার সম্পদ বলতে আমার সেই ১০০ স্বর্ণমুদ্রা। কি বলছি আমি তা না ভেবেই তাকে বললাম, হে বন্ধু! আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারি। আমার কাছে ১০০ স্বর্ণমুদ্রা আছে। কিন্তু সেটাই আমার একমাত্র সম্বল। যদি তা তোমাকে ধার দিই তাহ’লে কতদিন পর ফেরত দিবে? সে বললো,  এক মাস। আমাকে ধন্যবাদ দিয়ে ও দো‘আ করে কথা দিল এক মাসের মধ্যে ঐ জমি বিক্রি করে টাকা ফেরত দিবে। আমি তাকে ঐ নগদ টাকা দিলাম আর সে তার কাজ করলো। এক মাস, দু‘মাস, এক বছর, দু‘বছর চলে গেল। আমি আমার কাজ করতাম। টাকার ব্যাপারে কোন কথায় বলতাম না। সেও কোন কথা বলতো না। আমি খেয়াল করলাম তার কাছে তখনও কোন টাকা ছিল না।

এক সপ্তাহ পূর্বে সে ঐ জমিটা ভালো দামে বিক্রয় করেছে। আমি জানতাম তার কাছে নগদ টাকা রয়েছে। একদিন আমি তাকে ঐ ১০০ স্বর্ণ মুদ্রার কথা বললাম। আর সে অন্য কথা বলে কাটিয়ে দিল। আমার সন্দেহ হ’ল। আমি পরিপূর্ণ বিবরণ দিয়ে বলতেই সে অস্বীকার করে বললো, কিসের হিসাব, কোথায় লেখা আছে, কিসের টাকা? যখন দেখলাম, তার সম্পর্কে ভালো ধারণা করাটা আমার ভুল ছিল। নিরুপায় হয়ে বিচারকের কাছে অভিযোগ করলাম। এটাই আমাদের গল্প ছিল।

বিচারক : যেদিন তাকে ১০০ স্বর্ণমুদ্রা দিয়েছিলে সেদিন কোথায় বসে ছিলে? বলল, আমরা এক গাছের নিচে বসেছিলাম। সেখানে নদীভরা পানি আর জায়গাটা খুবই মনোরম ছিল। এ পর্যন্ত বলার পর বিচারক আসামীকে বললেন, এই ঘটনা সত্য? সে বললো, পুরোটাই মিথ্যা।

বিচারক : পাওনাদার, তুমি যখন বলছো গাছের নীচে বসে টাকা দিয়েছিলে। তাহ’লে কেন বলছো সাক্ষী নেই? ঐ গাছটাই তো সাক্ষ্য দিবে। সে বললো, গাছ কিভাবে সাক্ষ্য দিবে? আমি যেভাবে বলছি। এখানে আমি আসামীকে আটক রাখছি। তুমি এখন ঐ গাছের কাছে যাও, তাকে আমার সালাম দাও এবং বল, বিচারক বলেছে এখানে এসে সাক্ষ্য প্রদান করতে। এই সময় আসামী কথাগুলো শুনে উপহাস মনে করে মুচকি হাসে। বিচারকও তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে।

পাওনাদার : আমি গাছকে এ কথা বললে, গাছ বিশ্বাস করবে কি না সে ভয় পাচ্ছি।

বিচারক : এসো আমার নাম লেখা এই সীলমোহর নাও এবং গাছকে দেখিয়ে বল, চল আমার সাথে। বাদী বিচারকের সীলমোহর নিয়ে গাছের কাছে যাওয়ার জন্য ঘর থেকে বের হ’ল। বাদী বের হয়ে গেলে, কাজী বই পড়া শুরু করলেন। অতঃপর নরম স্বরে আসামীর সাথে কথা বলা শুরু করলেন।

বিচারক : বাযারের পরিস্থিতি ভালো নয়। ঐ লোকটি বললো, হ্যাঁ, কাজ-কর্মে মন্দা চলছে। মানুষের ঝগড়া করারও মেজাজ নাই। আমরাও প্রায়শই বেকার বসে থাকি, বই পড়ি। আসলে বিচারক বলতে চাচ্ছেন আমাদের কাজেও মন্দা। আসামীও সে জায়গায় কিছু কথা বলল। বিচারকের কথা বলা দেখে মনে মনে ভাবল, বিচারক হয়ত ঘুষ নিয়ে তাকে কসম করিয়ে বিচার করে দিবে। সে ভাবল, বিচারক বোধহয় বাদীর সাথে উপহাস করেছে। আস্তে আস্তে তার ভয় ভেঙ্গে যায়।

বিচারক আরো কয়েক পৃষ্ঠা বই পড়ে ফিসফিস করে বললেন, ‘(এই বিচারের) মানসিকতাই নষ্ট হয়ে গেল। এই লোকটা গেল আর আসল না। আমার মনে হয় স্থানটি অনেক দূর। তাই সে নিরুপায় হয়ে রাগ করে চলে গেছে। তারপর আসামীর দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার বন্ধু কি এতক্ষণে ঐ গাছের কাছে পৌঁছে গেছে? তোমার কি মনে হয়?

ঋণগ্রহীতা : লোকটি দ্রুত জবাব দেয়- এখনো না, জনাব। বিচারক কোন জবাব না দিয়ে বই পড়তে ব্যস্ত হয়ে যান। পাওনাদার : ঘণ্টা খানিক পরে বাদী মন খারাপ করে ফিরে এসে বলে, ‘হুজুর, গিয়েছিলাম, আপনার সালাম দিলাম, আপনার সীলমোহর দেখালাম, আপনার কথাও গাছকে বললাম। কিন্তু গাছ কোন উত্তরই দিল না। আমি যতই ধৈর্য ধরে বসে ছিলাম, সে তার জায়গা থেকে নড়লো না। আমি ফিরে আসলাম। এই নিন আপনার সীলমোহর, এখন কি করা উচিত?’

বিচারক : এইমাত্র গাছ এসে সাক্ষ্য দিয়ে চলে গেল। তারপর আসামীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘হে অত্যাচারী, নিজের বন্ধুর কাছ থেকে যে টাকা ধার নিয়েছিলে তা দিয়ে দাও নতুবা আমি হুকুম দিয়ে তোমাকে হাকীমের (প্রধান বিচারক) কাছে পাঠাবো। কীভাবে টাকা আদায় করতে হয়, তিনি ভালোই জানেন।

ঋণগ্রহীতা : হে বিচারক! কেন অবিচার করছেন? আমি এখানেই আছি। কই গাছ এসে তো সাক্ষী দিল না! 

বিচারক : যখন আমি তোমাকে জিজ্ঞাসা করলাম ওমুক লোক গাছের কাছে পৌঁছেছে? তুমি বললে, এখনো না। তুমি নিজেই বাদীর সাক্ষ্য দিয়েছ। যদি কোন টাকা, ঐ গাছ বা সাক্ষীর ব্যাপার না থাকত। তাহ’লে তুমি বলতে কোন গাছ? জানি না বাদী কোথায় গেছে? কিন্তু তুমি বলেছিলে, বাদীর সব কথাই মিথ্যা। তাহ’লে কীভাবে গাছ চিনলে?’ 

বিচারকের বিচক্ষণতায় আসামী দোষী প্রমাণিত হ’ল। আসামী লজ্জিত হ’ল। নিরুপায় হয়েই বিচারকের কথা মেনে নিল এবং অবশেষে ধারের টাকা পরিশোধ করল।

শিক্ষা :

(১) আমাদের জীবন চলার পথে বন্ধুত্ব নামক আত্মিক, বিশ্বাসী ও মযবুত বন্ধন তৈরী হয়। এ বন্ধন আস্থা, ভরসা, পরস্পরের প্রতি সহযোগিতা, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার বন্ধন। যদি সেখানে মিথ্যা ও বিশ্বাসঘাতকতার ধাক্কা লাগে তাহ’লে কাঁচের পাত্রের মত সে বন্ধন নিমিষেই ভেঙ্গে টুকরো হয়ে যায়। সৎ বন্ধু যেমন আমাদের হক্ব পথে চলতে শেখায়, তদ্রূপ সুবিধাভোগী, অসৎ বন্ধু অনেক ক্ষেত্রে আমাদের জীবনের একমাত্র সম্বলটা কৌশলে হাতিয়ে নিয়ে সীমাহীন ক্ষতি সাধন করে বসে। কথায় আছে ‘অর্থই অনর্থের মূল’। কিন্তু অর্থের লেনদেনই অনেকাংশে প্রকৃত বন্ধু চিনতে সাহায্য করে।  সেজন্য বন্ধুত্ব করার ক্ষেত্রে আমাদের সচেতন হওয়া উচিত।

(২) একজন বিচারককে গ্রন্থগত বিদ্যা অর্জনের পাশাপাশি উপস্থিত বুদ্ধির দক্ষতাও অর্জন করতে হয়। এতে অনেক বিচারকার্যে সেই দক্ষতার ব্যবহার মযলুমকে তার প্রকৃত অধিকার ফিরিয়ে দিতে সাহায্য করে।

(৩) এই গল্পটি ছাগপালের মালিক ও শস্যক্ষেত্রের মালিকের বিরোধ মীমাংসায় কুরআনে বর্ণিত হযরত দাউদ (আঃ) এবং তদীয় পুত্র হযরত সুলায়মান (আঃ)-এর ন্যায়বিচারের বিচক্ষণতার কথা স্বরণ করিয়ে দেয় (নবীদের কাহিনী ২য় খন্ড ১৪৫ পৃঃ দ্রষ্টব্য)(গল্পটি ফারসী ভাষা থেকে অনূদিত)

মুহাম্মাদ আব্দুর রঊফ

লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ, রাজশাহী বিশ্বিবিদ্যালয়



বিষয়সমূহ: গল্প
আরও