আসমানী সাহায্য
লতিফুল ইসলাম শিবলী, ঢাকা
[১]
পড়ন্ত বিকেল। সমস্ত পশ্চিম আকাশটা জুড়ে লালের সমারোহ। সেই লাল ছড়িয়ে পড়েছে মাঠে, পুকুরে ও গাছপালায়। সময়টা জৈষ্ঠ্যের মাঝামাঝি। তখনও আমি হিন্দু ছিলাম, মুসলিম হইনি। ধার্মিক হিন্দু নয়, বলতে গেলে নামেমাত্র হিন্দু। তখন পূজা মানেই আমার কাছে আনন্দ-ফূর্তি ছিল। তবে মা বলতো, ছোটবেলায় আমি কৃষ্ণের অনেক ভক্ত ছিলাম। এখন তার ছিটেফোঁটাও নেই।
আমি একটা টিভি চ্যানেলে চাকুরী করি। উপর ধাপের কর্মকর্তা। মিডিয়ার সাথে অনেক আগেই জড়িয়েছি। শুটিং, আনন্দ-ফূর্তি, মৌজ-মাস্তি ছিল নিত্য দিনের রুটিন। স্রষ্টাকে কখনও খোঁজার চেষ্টা করিনি। তবে চরম মুসলিম বিদ্বেষী ছিলাম। মুসলিমদের সাথে উঠা-বসা, চলাফেরায় খুবই বিরক্ত বোধ করতাম। সেইবার চ্যানেলে এক ভাইয়ের চাকুরী হয়। তার নাম মুনীর। ধর্মীয় পরিচয়ে সে ছিল মুসলিম। চরম মুসলিম বিদ্বেষী হওয়া সত্ত্বেও মুনীর ভাইয়ের সাথে আমার ভালো একটা সম্পর্ক তৈরী হয়। মুসলিমদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে আমার সেরকম জানা ছিল না। সত্যি বলতে আমি কোন ধর্ম সম্পর্কে শিক্ষাদীক্ষা পাইনি। বাবা মা হিন্দু, তাই আমিও হিন্দু। মুসলিম শিশুরা যেমন ছোটবেলায় মক্তবে যায়, হিন্দু ধর্মে সেরকম কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। মাঝে মাঝে অবসর সময়ে মুনীর ভাই তার ধর্মের কিছু নবী-রাসূলের কাহিনী শোনাতো। রূপকথার গল্প ভেবে আমি সেগুলো শুনতাম। ইসলাম সম্পর্কে জানার জন্য নয়; বরং অবসরের বিরক্তিকর সময়গুলো পার করার জন্য।
[২]
সময়টা ছিল গা ঝিমঝিমে ভরদুপুর। অফিসের জানালার ফাঁক ভেদ করে উত্তরীয় দমকা হাওয়া প্রবেশ করছে। মধ্যাহ্নভোজে মুনীর ভাইয়ের সাথে একই টেবিলে বসেছি। নাঈম, রাফি ওরাও আমাদের সাথে যোগ দিল। নাঈম গরুর গোশত এনেছে। সেদিকে তাকাতেই আমার গা রি রি করে উঠল । খানিক পরে রাফি, মুনীর ভাই দু’জনে গোশতে ভাগ বসালো। বাদ পড়লাম আমি। নাঈম আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘অজয় দাদা! আপনাকেও দু’পিস গোশত দেই?
নাঈমের কথাটা বজ্রাঘাতের মতো আমায় আঘাত করল। চড়াৎ করে শরীরের সমস্ত রক্ত মাথায় গিয়ে উঠল। রক্তবর্ণ চোখে ধমকিয়ে উঠলাম। অকস্মাৎ আমার রূঢ় আচরণে উপস্থিত সকলে অবাক দৃষ্টিতে তাকাল। নাঈম মাথা নিচু করে অপরাধী ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইল। আমার এই আচরণে মুনীর ভাই খুব ব্যথিত হ’ল। শান্ত অথচ দৃঢ় কন্ঠে বলল, ‘আপনার ধর্মগ্রন্থে কোথায় আছে, গরুর গোশত খাওয়া যাবে না? দেখাতে পারবেন? এই যে আপনারা মূর্তিপূজা করেন এটাও কী কোথাও লেখা আছে’?
আমার মুসলিম বিদ্বেষী মনোভাবটা আবারও মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। সাঁই করে মুনীর ভাইয়ের প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে হঠাৎ থমকে গেলাম। আমার মনের রঙিন আকাশে মুহূর্তেই কালো মেঘের ঘনঘটা দেখা দিল। অদ্ভুত তো! কোন দিন নিজের ধর্মগ্রন্থটাই পড়ে দেখিনি! এই প্রথম নিজেকে জ্ঞানশূন্য মনে হ’তে লাগল। ডাইনিং রুমে অফিসের সকল স্টাফ হা করে তাকিয়ে আমাদের দেখছে। জুনিয়র একজন কর্মচারীর প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারায় লজ্জায়, অপমানে হনহন করে বেরিয়ে এলাম।
শেষ বিকেলে সূর্যের স্বর্ণাভা যখন মেঘের ফাঁক গলে পৃথিবীর বুকে উঁকি দিল, তখন অফিস শেষে বেরিয়ে পড়লাম। গন্তব্য আমাদের এলাকার মন্দির। সেখানে পুরোহিত কাকা আছেন। তার কাছে সব উত্তর জানতে হবে। তারপর সকলের সামনে মুনীর ভাইকে উচিত জবাব দিয়ে অপমানের বদলা নেব।
মন্দিরে ঢুকে পুরোহিত কাকাকে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি আমার উত্তরের সপক্ষে কিছু যুক্তি দাঁড় করালেন। কিন্তু ধর্মগ্রন্থ থেকে কোন রেফারেন্স দিতে পারলেন না। এছাড়াও তিনি আমাকে সবসময় ‘হরেকৃষ্ণ’ নাম জপতে বললেন। তার যুক্তিতে সন্তুষ্ট হ’তে পারলাম না। আমার মনটা আগের চেয়ে বেশী চঞ্চল হয়ে উঠল। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম, যে কোন উপায়েই হোক আমাকে জানতে হবে। মুনীর ভাইকে উচিত জবাব দিতে হবে। তবেই এই চঞ্চল মন শান্ত হবে।
[৩]
ইদানীং কোন কিছুতেই মন বসছে না। পুরোহিত কাকার কথামতো সকাল-সন্ধ্যা জপ করেও মনে শান্তি মিলছে না। বুকের কোথাও একটা চাপা অস্থিরতা ভর করে আছে। হয়তো মুনীর ভাইয়ের প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারার অস্থিরতা। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। পাখিরা ফিরছে আপন নীড়ে। গোধূলির রক্তিম আভাও ফিকে হ’তে শুরু করেছে। ইউটিউবে চোখ বুলাচ্ছিলাম। হঠাৎ একটি ভিডিওতে চোখ দু’টো স্থির হ’ল। একটি ডিবেট। হিন্দু স্কলারের বিপরীতে মুসলিম স্কলার। অনেক লম্বা সময় হলেও দেখার জন্য মন স্থির করলাম। লম্বা মতো লোকটি কোর্ট, টাই, প্যান্ট পরা। উনি মুসলিম স্কলার। সব ধর্মগ্রন্থ তার মুখস্থ। শত শত মানুষের সামনে পটাপট রেফারেন্স দিচ্ছেন। অপরদিকে ভারতবর্ষের আরেক বিখ্যাত হিন্দু স্কলার। উনি সেই লোকটির সাথে পারছেন না। বিষয়টি আমাকে ভাবিয়ে তুলল।
সেই ডিবেট থেকে অনেক কিছুই জানতে পারলাম। আমার ঈশ্বর এবং ধর্ম সম্পর্কে বিস্ময়কর কিছু তথ্য, যা আমার ভিতকে নাড়িয়ে দেবার জন্য যথেষ্ট ছিল। সেদিনের পর থেকে আমার জ্ঞানের স্পৃহা আরও বেড়ে গেল। ধর্ম নিয়ে পড়াশোনা শুরু করলাম।
[৪]
কিছুদিন হ’ল আমি মূর্তিপূজা ছেড়ে দিয়েছি। মূর্তিকে নমষ্কার করছি না। বিষয়গুলো বাবা-মায়ের নযর এড়িয়ে যাচ্ছে না। তারা সন্দেহের চোখে তাকায়। ছেলে তাদের পাগল হয়ে গেছে। কিন্তু আমি জেনে গেছি, হিন্দু ধর্মগ্রন্থে মূর্তিপূজার কথা বলা হয়নি। তবে কেন হিন্দুরা মাটির প্রতিমাকে পূজা করে? তাদেরকে ঈশ্বর মনে করে? একজন মানুষের কি অনেক ঈশ্বর থাকতে পারে?
সেই দিক থেকে মুসলিমরা সম্পূর্ণ আলাদা। তারা এক স্রষ্টায় বিশ্বাসী। অন্যকে স্রষ্টার সমকক্ষ মনে করাকে জঘন্য পাপ মনে করে। বিষয়গুলো গভীরভাবে নাড়িয়ে দিল আমায়। সত্য-মিথ্যা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল। ভেতর থেকে কী এল স্রষ্টাকে খুঁজে নেয়ার। ধামাচাপা দেয়া বোধগুলো জ্বালাতন করে উঠল।
কৃষ্ণ কি আমার ঈশ্বর? আমার সৃষ্টিকর্তা? কিন্তু কৃষ্ণ যে রাঁধার সাথে প্রণয়ের সম্পর্কে জড়িয়েছিল! ঈশ্বর কি তার সৃষ্টির সাথে সম্পর্কে জড়াতে পারে? প্রশ্নগুলো কুঁরে কুঁরে খাচ্ছিল বারবার। আমি ভুলে যাই মুনীর ভাইকে উচিত জবাব দিয়ে অপমানের বদলা নেয়ার কথা। হঠাৎ চোখ দু’টো জ্বালা করে এল। এই জ্বালা করাকে আমি চিনিনা। এ অনুভূতি সম্পূর্ণ নতুন, সম্পূর্ণ আকস্মিক।
ছুটলাম নাঈম এবং রাফির কাছে। জানতে চাইলাম ঈশ্বর সম্পর্কে। নাঈম আমতা আমতা করছিল। আমার সেদিনের রাগের কথাটা হয়তো মনে পড়েছে। তবে রাফি খানিক ভেবে বলল, ‘দাদা! আপনি বরং একটা কাজ করুন! আপনার ঈশ্বরকে ডাকুন। তিনি যদি সত্যি আপনার ডাক শুনে থাকে, তাহ’লে অবশ্যই সাড়া দেবে’। রাফির কথাটা আমার মনের ছিন্ন ভিন্ন ক্ষতে সুখের প্রলেপ লাগিয়ে দিল। এরকমটা তো ভেবে দেখিনি! মুহূর্তেই আমার কম্পিত হৃদয়ে আশার ক্ষীণ আলো জ্বলে উঠল।
[৫]
কেটে গেছে কয়েক পক্ষকাল। আমি আজও সত্যের দিশা পায়নি। ছুটছি পথহারা পথিকের মতো। মনের গহীন থেকে কেউ একজন বলে, সৃষ্টিকর্তা আছে। সেই ভাবনা থেকে আজও শয়নে, জাগরণে, চলাফেরায় তাঁকে স্মরণ করি। যদি সত্যিই তুমি থেকে থাকো, তবে নিদর্শন দেখাও! কথা দিচ্ছি, তোমার জন্য আমি সবকিছুই বিসর্জন দিতে রাযী। এভাবেই স্রষ্টাকে রোজ বলতাম।
মুনীর ভাই বলেছিল, তাদের নবী-রাসূলদের সাথে অলৌকিক কিছু ঘটনা ঘটত। তাই আমিও ভাবি, আমাকেও ঈশ্বর নিদর্শন দেখাবে। তাই তো কত বিনিদ্র রাত কেটেছে আকাশ পানে তাকিয়ে। এই বুঝি ঈশ্বর বিদ্যুৎ ঝলকের মতো তার অস্তিত্বের জানান দেবে! কিন্তু না, সেরকম কিছুই ঘটেনি!
এখন আমার কল্পনা জুড়ে শুধুই স্রষ্টার বাস। কে আমার স্রষ্টা? কৃষ্ণ নাকি অন্য কেউ? এখন নাঈম, রাফির সাথে যদি কখনও আলোচনা হয় তবে স্রষ্টা ও জীবনই থাকে আমাদের আলোচনার মূল বিষয়। স্রষ্টাকে ভাবতে গিয়ে কখন যে আমি নিজেই মিডিয়া থেকে বেরিয়ে গেছি, তা ছিল কল্পনাতীত। কয়েক মাস থেকে বন্ধু মহলেও আমাকে খুঁজে পাওয়া যায় না। পার্থিব জগতের অনেক কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছি নিজের অজান্তেই। যেন অদৃশ্য কিছু আমায় নেশার মতো টানছে। আমি ছুটছি টালমাটাল। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। আজও আকাশের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম। খানিক পরে চোখ দু’টো লেগে এল। ক্লান্ত আমি বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে গেলাম।
রাতের শেষাংশ। অদ্ভুত একটা ঘটনা ঘটে। একেবারে অভাবিত, অপ্রত্যাশিত। মাথার কাছে রাখা মুঠোফোনটি বেজে উঠল। ঘুম ঘুম চোখে ফোন তুললাম। অপর পাশ থেকে অচেনা একটা কন্ঠস্বর ভেসে আসলো। বলল, ‘তুমি যেটা মনে মনে ভাবছো সেটাই করো’। চমকে উঠলাম আমি। মুহূর্তেই ঘুম উবে গেল। চোখ খুলে মুঠোফোনটিকে হাতের মধ্যখানে আবিষ্কার করলাম। কল লিস্ট চেক করে কোন নম্বর পেলাম না। এটা কিভাবে সম্ভব? কিছুক্ষণ আগেই তো আমাকে কেউ ফোন করেছিল! তাহলে নম্বরটা কোথায়? অজানা এক আতংকে আমার সমস্ত লোমকূপ দাঁড়িয়ে গেল। সহসা বুকের ভেতরটা হিম হয়ে উঠল। হাত-পা বার কতক কেঁপে কেঁপে উঠল। বুঝি কাঁপাবার ক্ষমতাটুকু হারিয়ে অবশ হয়ে গেছে। তখনই সুমধুর কন্ঠে ভেসে আসলো মুসলিমদের চিরন্তন বাণী ‘আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার’! অদ্ভুত এক শক্তি তাড়িত করল আমায়। বুকের ভেতর জমে থাকা ভয়টা ক্রমশঃ কমতে লাগল। হ্যাঙ্গার থেকে শার্টটি লুফে নিয়ে ছুটলাম।
রাফি আমাকে মসজিদের ইমাম ছাহেবের নিকট নিয়ে গেল। তার কাছে সবটুকু বর্ণনা করলাম। তিনি বললেন, ‘হয়তো আপনি সৃষ্টিকর্তার কাছে কিছু চেয়েছিলেন। তাই তার পক্ষ থেকে আপনার নিকট ইলহাম এসেছে। এ ঘটনা সেদিকেই ইঙ্গিত করে’। তখন ভালো করেই বুঝতে পারছিলাম আমার মনের ভিতরে কী চলছিল! আমার মুসলিম বিদ্বেষী মনটা অবচেতন মনেই ঘোষণা দিচ্ছিল কালিমায়ে তাইয়িবার মর্মকথার। স্রষ্টার সমস্ত নকল রূপকে বাদ দিয়ে এক ইলাহের।
তখন মনে হচ্ছিল আমি স্থির হয়ে দাঁড়িয়েও কোথায় যেন ভেসে যাচ্ছি! সত্য-মিথ্যা যা কিছু মিলেমিশে ছিল, তার সবটা আমার মস্তিষ্কে স্বচ্ছ পানির মতো পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। একদিকে আমার ক্যারিয়ার, মিডিয়া, পরিবার; অন্যদিকে আমার স্রষ্টা। তিনি সবটা আমার সামনে স্পষ্ট করা সত্ত্বেও কী করে তাকে ধোঁকা দেই?
মসজিদ থেকে বাড়ির পথ ধরেছি। বাবা-মাকে সবার প্রথমে জানাব, স্রষ্টার কাছে আমার আত্মসমর্পণের কথা। জানি না তারা কিভাবে নেবে! হয়তো প্রলয়ঙ্কারী কোন ঝড় উঠবে! তবে স্রষ্টাকে পাওয়ার তুলনায় সেই ঝড় নিতান্তই তুচ্ছ। মা আমার কথা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেল। দৌড়ে এসে আমার পা দু’টা জড়িয়ে হাউ মাউ করে কেঁদে উঠল। বাবাকে কখনও কাঁদতে দেখিনি। আজ তিনিও দরজায় দাঁড়িয়ে কাঁদছেন। শত চেষ্টা করেও বাবা-মা পারেনি আমাকে ফেরাতে। শেষে বাবা ক্ষুব্ধ হয়ে জুতা দিয়ে থাপ্পড় বসিয়ে দেয় আমার গালে।
আজ পৃথিবীর কেউই আমাকে আটকে রাখতে পারবে না। আমি ছুটলাম স্রষ্টার কাছে নিজেকে সঁপে দিতে। সর্বপ্রথম আমার যোহরের ছালাত আদায় করার সৌভাগ্য হয়। যখন প্রথম সিজদায় যাই, সে এক অদ্ভুত অনুভূতি! নিজেকে এই গ্রহের সবচেয়ে সুখী মানুষ মনে হচ্ছিল। অদ্ভুত এক প্রশান্তি! যা মুহূর্তে আমার হৃদয়কে প্রশান্ত করে দেয়। আমি ভুলে যাই এইমাত্র ফেলে আসা আমার ক্যারিয়ার, মিডিয়া, পরিবারের কষ্টকে। ওয়াল্লাহি, আমি সারাটি জীবন মনে রাখব জীবনের প্রথম সিজদার অনুভূতি।
[৬]
আমার ইসলাম গ্রহণের কিছুদিন পেরিয়ে গেছে। এর মাঝে ঘটেছে কয়েকটি বিস্ময়কর ঘটনা। একদিন ইশরাকের ছালাত শেষে আমি বেরিয়ে পড়ি। আকস্মিক একটি প্রাইভেট কার আমার সামনে চলে আসে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমার ডান পায়ের উপর দিয়ে গাড়ির সামনের চাকাটা চলে যায়। গাড়ি যখন ব্রেক কষলো তখন পিছনের চাকাটা পায়ের উপর উঠে গেছে। আমার হাতের ইশারায় ড্রাইভার চাকা নামালো। ভেবেছিলাম পা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাবে। ছুটতে হবে হাসপাতালে। কিন্তু এর কিছুই হয়নি। ওয়াল্লাহি, আমার পায়ে সামান্য চাকার দাগ ছাড়া আর কিছুই হয়নি!
অপর একদিন। মাগরিবের ছালাত আদায় করতে মসজিদে গিয়েছি। হঠাৎ প্রচন্ড ঝড় উঠল। আমার মনে পড়ল, বাড়িতে বেলকনির দরজা, জানালা সবকিছুই খোলা। বৃষ্টি হ’লে ঘরে পানি আসে। সব কিছুই ভিজে যায়। আমি সিজদায় রবকে বললাম। যখন বাড়ি ফিরলাম তখন হৃদয়টা শীতল হয়ে গেল। আল্লাহর শপথ করে বলছি, এতো ঝড় হওয়ার পরও ঘরে পানি ঢুকেনি। দরজার পর্দাটাও ভিজেনি। আল্লাহুছ ছামাদ। এ আমার রব ছাড়া আর কার ক্ষমতা হ’তে পারে?
আজ আমি বাড়িতে যাচ্ছি। বাবা মায়ের সাথে দেখা করতে। আমি হাঁটছি আর ভাবছি, জীবন কত অদ্ভুত তাইনা! গত মাসেও আমি ছিলাম পথহারা। কিছু সময়ের ব্যবধানেই সব কেমন পাল্টে গেছে। এখন আমার কোন কিছু হারিয়ে ফেলার ভয় নেই।
দূর থেকে আববার কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে। তিনি পাড়ার মুসলিম ছেলেদের বলছেন, ‘এই ছেলে তোমরা ছালাত পড় না? জানো, আমার ছেলে মুসলিম হয়েছে। পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত পড়ে’।
আমি হাসছিলাম আববার কথা শুনে। একসময় যিনি আমার ইসলাম গ্রহণের চরম বিরোধী ছিলেন, আজ তার মুখ থেকে এই কথা শুনে হৃদয়টা আবারও রবের দরবারে কৃতজ্ঞতায় নুইয়ে পড়ল। আশা রাখি, আববাও একদিন ইসলামে প্রবেশ করবে। আজ আবারও আববাকে বলব, ‘সত্য এসেছে এবং মিথ্যা বিলুপ্ত হয়েছে। নিশ্চয়ই মিথ্যা বিলুপ্ত হওয়ারই ছিল’ (বণী ইসরাইল-১৭/৮) ।
[গল্পটি বাংলাদেশী নওমুসলিম মুহাম্মাদ আল-আমীনের ইসলাম গ্রহণের সত্য কাহিনী অবলম্বনে রচিত]
নিশাত তাসনীম
কারমাইকেল কলেজ, রংপুর।