দায়িত্বশীলদের গুণাবলী
মুহাম্মাদ আবুল কালাম
ইসলাম
একমাত্র পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। ইসলামের বিধান সকল যুগে সকল মানুষের জন্য
চিরস্থায়ীভাবে চিরকল্যাণকর। মূলতঃ ইসলামের তাওহীদী মূল দর্শনের উপরেই গড়ে
উঠেছে রাষ্ট্র বা রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থার মূল ভিত। মৌলিকভাবে ইসলামী
খেলাফত বিশ্বমানবতাকে এক শান্তিময় সমাজ উপহার দিয়েছে। যা ইতিহাসে
স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ আছে। উল্লেখ্য যে, মানুষের সমাজ জীবনসহ তাদের
সার্বিক জীবনকে পরিপূর্ণভাবে সুন্দর ও সুবিন্যস্ত এবং শান্তিময় করার জন্য
যতগুলো সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তন্মধ্যে রাষ্ট্র হচ্ছে সর্বাধিক
গুরুত্বপূর্ণ ও সর্বোচ্চ সংস্থা। আর নির্দিষ্ট ভূখন্ড, জনসমষ্টি, সরকার ও
সার্বভৌমত্ব হ’ল একটি রাষ্ট্রের মূল উপাদান।
খেলাফতের পরিচয় :
‘খেলাফত’ (اَلْخِلَافَةُ) শব্দটি আরবী, যা اسم مصدر। خَلَفَ يَخْلفُ خِلَافَةً অর্থাৎ স্থলাভিষিক্ত হওয়া। বাব نصر-ينصر। মাছদার اَلْخِلَافَةُ অর্থঃ ইমারত, ইমামত, শাসন, কর্তৃত্ব প্রভৃতি। পারিভাষিক অর্থে ‘আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ও আইনগত কর্তৃত্বকে স্বীকার করে নিয়ে পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহর মৌলিক নীতি ও আদর্শের ভিত্তিতে পরিগঠিত রাষ্ট্র ও প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনাকে ইসলামী খেলাফত বলা হয়। ইমাম শাফেঈ (রহঃ) বলেন, ‘খেলাফত বলতে এমন রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে বুঝায় যা কুরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী প্রতিষ্ঠিত’। মোটকথা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ছাঃ)-এর আদর্শ বাস্তবায়ন করার প্রতিনিধিত্বই হল খেলাফত।
পরিস্থিতি মূল্যায়ন :
আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তির যুগে সমস্ত বিশ্ব এখন মানুষের হাতের মুঠোয়। পৃথিবীর এক প্রান্তের খবর অন্য প্রান্তে পৌঁছানো যেন মুহূর্তের ব্যাপার। তাই নিজ দেশের পরিস্থিতিকে আর বিশ্ব পরিস্থিতি থেকে আলাদা করে দেখার সুযোগ নেই। মাত্র কয়েকদিন পূর্বে মিয়ানমারের গণতন্ত্রের মানসকন্যা খ্যাত ও শান্তিতে নোবেলজয়ী অং সান সূচি তথাকথিত গণতান্ত্রিক বিজয়ের জয়মাল্য পরিধান করেছেন। বুকভরা আশা নিয়ে তাকিয়ে ছিল লাঞ্ছিত, অবহেলিত ও বঞ্চিত আরাকানের অসহায় রোহিঙ্গা মুসলিম মানবতা। কিন্তু বিশ্বকে হতাশ ও বিমূঢ় করে ১৯৪২, ১৯৭৮ ও ১৯৯২-এর ন্যায় ২০১২ সালের ৮ই জুন সূচি’র দেশের নরপশু সদৃশ সামরিক বাহিনী কর্তৃক নিরীহ মযলুম রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর অমানুষিক নির্যাতনের ষ্টীমরোলার চালায়। ছুটে আসে তারা আশ্রয় নেওয়ার জন্য পার্শ্ববর্তী মুসলিম রাষ্ট্রের দিকে। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদীদের পদলেহী আমাদের মুসলিম নামধারী সরকার চূড়ান্ত অমানবিকতা প্রদর্শন করে তাদের এতটুকু আশ্রয় প্রদান করতে সম্মত হয়নি। বিশ্ববাসী এই অমানবিক নিপীড়নের মর্মান্তিক দৃশ্য অসহায়ের মত অশ্রুসজল নেত্রে অবলোকন করেছে। তাদের চোখে অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়েছে যে, মানুষের তৈরী করা বিভিন্ন মতবাদ ও তন্ত্রমন্ত্রের হোতাদের নগ্ন চেহারা কত বীভৎস। তাই সারাবিশ্ব এখন উন্মুখ হয়ে চেয়ে আছে মুক্তির প্রকৃত সত্য পথের দিকে।
উন্নত রাষ্ট্র আর উন্নয়নশীল বিকাশমান রাষ্ট্রের (মুসলিম বা অমুসলিম) দিকে দৃষ্টি দিলে সহজেই বুঝা যায় যে, বিশ্ব সভ্যতার সূচনাকারী এবং বিশ্ব মানবতার সুখ-শান্তি, নিরাপত্তা ও মানবাধিকারের নিশ্চয়তা প্রদানকারী ও অধিকর্তা মুসলিম জাতির অবস্থা আজ অত্যন্ত করুণ। জাতিসংঘ ও ফ্যাসিবাদী সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী সামরিক ও আধা সামরিক বাহিনী লেলিয়ে দিয়ে নিশ্চিহ্ন ও উজাড় করে চলেছে একের পর এক মুসলিম জনপদ ও দেশসমূহকে। পারমাণবিক বোমা নামক মারণাস্ত্রের আঘাতে জর্জরিত অসহায় মানবতা অত্যাচার-নির্যাতনে নিষ্পিষ্ট ও নিগৃহীত হচ্ছে অবিরত। অন্যদিকে চরম অনৈতিকতার বিস্তার ঘটছে তাদের চালু করা আকাশ সংস্কৃতির বিভিন্ন রকমারী আয়োজনের হিংস্র থাবায়। পাশাপাশি রাষ্ট্রের শান্তি-শৃঙ্খলা স্থিতিশীল (?) রাখতে অনুসরণ করছে মস্তিষ্কপ্রসূত নানা মতবাদের। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অনুসরণ করছে গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, জাতীয়তাবাদ প্রভৃতি বস্ত্তবাদী মতাদর্শের। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অনুসরণ করছে সূদ-ঘুষের পুঁজিবাদী অর্থনীতি। ধর্মীয় ক্ষেত্রে অনুসরণ করছে তথাকথিত মাযহাব, মতবাদ, ইযম, তরীকাসহ বিভিন্ন ব্যক্তি ও গোষ্ঠী বিশেষের মতাদর্শ। এছাড়া দেশের আদালতগুলিতে ইসলামী বিধান অনুযায়ী বিচার ব্যবস্থা না থাকায় মানবরচিত আইনে মুমিনকে জেল-ফাঁসি বরণ করতে হচ্ছে। ফলে আইনের প্রতি অশ্রদ্ধা এবং সামাজিক অস্থিতিশীলতা ব্যাপকতা লাভ করেছে। এভাবেই সমস্ত দুনিয়া আজ মিথ্যা, অন্যায়, অকল্যাণের সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে।
ইসলামী খেলাফতের বাস্তবতা :
ইসলাম একটি বিশ্বজনীন জীবনাদর্শ, যা বিশ্বমানবতার জন্য আল্লাহ প্রদত্ত একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান। এটি মানবজাতির জন্য সর্বাবস্থায় চির কল্যাণকর। যার মধ্যে সকল যুগের সমস্ত মানুষের জন্য জীবনের সকল দিক ও বিভাগের সুস্পষ্ট ও স্থায়ী কল্যাণের পথনির্দেশ রয়েছে। যা সকলের জন্য সমানভাবে অনুসরণীয় ও পালনীয়। আধুনিক বিশ্বের প্রখ্যাত আইনবিদ এ. কে. ব্রোহী, বিশ্বনন্দিত বিচারপতি জাস্টিস কায়ানী, জাস্টিস কর্নোলিয়াস, জাস্টিস মুরশেদ, জ্ঞানতাপস ড. মুঃ শহীদুল্লাহ সকলেই মানবাধিকার, সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠা, বিশ্বশান্তি ও মুক্তি একমাত্র ইসলামী জীবন দর্শন ও মূল্যবোধের বাস্তবায়নের মধ্যেই নিহিত রয়েছে বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন। প্রখ্যাত দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল বলেছেন, `Islam is the fully balanced and complete coad of life’ অর্থাৎ ‘ইসলাম হচ্ছে একটি ভারসাম্যমূলক পরিপূর্ণ জীবন পদ্ধতি’। কতগুলো ব্যক্তিগত নীতি-আদর্শ ও ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে ইসলাম সীমাবদ্ধ নয়। বরং মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক বিধি-বিধানসহ তার ধর্মীয় ও বৈষয়িক জীবনের সকল মৌলিক বিষয়ে এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে খুঁটিনাটি ব্যবহারিক বিষয়েও ইসলাম চিরস্থায়ী হেদায়াত ও সমাধান পেশ করেছে। ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠার মূল প্রয়োজনীয়তা এ কারণে যে, পূর্ণ নিরাপত্তা ও নিশ্চিন্ততার মধ্যে যেন ইসলামী বিধানসমূহ যথাযথভাবে পালন করা সহজ হয় এবং মানবকল্যাণ নিশ্চিত হয়।
পরিপূর্ণ ইসলামী জীবন যাপনের জন্য ইসলামী খেলাফতের কোন বিকল্প নেই। গণতান্ত্রিক বা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রব্যবস্থায় একজন মুসলমান ব্যক্তির জীবনে ইসলাম পূর্ণাঙ্গরূপে পালনের স্বাধীনতা থাকলেও বৈষয়িক জীবনে বস্ত্তবাদী আইনে শাসিত হতে হয়। ব্যক্তি পুঁজিবাদ ও রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদের সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি অনুসরণের ফলে একজন মুমিন ব্যক্তির রিযিক হারাম রিযিকে পরিণত হয়। অন্যদিকে মস্তিষ্কপ্রসূত আইনসমূহের চোরাবালিতে অসহায় ও নির্দোষ ব্যক্তিরা বছরের পর বছর জেলের ঘানি টানে। অবশেষে চূড়ান্ত ফায়সালায় ফাঁসি, না হ’লে যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত হয়ে নির্জন-নিভৃতে নীত হয়। ফলে তথাকথিত আইন মানুষের নিকট ভক্তি-শ্রদ্ধাবোধ হারিয়ে অরুচিকর বিষয়ে পরিণত হয়। যার কারণে সামাজিক স্থিতিশীলতা, শান্তি ও সুবিচারের পথ বিলুপ্ত হয়। ব্যাপকতা লাভ করে বিশৃঙ্খলা আর অস্থিতিশীলতা। আর এ সমস্ত কারণেই একজন মুসলিম সর্বদা দেশে-বিদেশে সর্বত্র ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠায় তৎপর থাকবে। কারণ ইসলামী খেলাফত শুধু মুসলমানদের জন্য নয়, বরং খেলাফতের অধীনে বসবাসরত সকল নাগরিকের জন্য সমানভাবে কল্যাণকর (প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, ইসলামী খেলাফত ও নেতৃত্ব নির্বাচন পৃঃ ৬)।
ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ব্যাপারে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ছাঃ)-এর ভবিষ্যদ্বাণী :
বিশ্বমানবতার সুখ-সমৃদ্ধি ও নিরাপদ জীবনের জন্য ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব অত্যধিক। আর এই খেলাফত প্রতিষ্ঠার জন্য বান্দাকে কতিপয় গুণাবলী অর্জন করতে হয়। যার ফলে সমাজে ভীতির পরিবর্তে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। সর্বোপরি পৃথিবীতে খেলাফত প্রতিষ্ঠার দ্বার উন্মোচিত হয়। মহান আল্লাহ বলেন, وَعَدَ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا مِنْكُمْ وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ لَيَسْتَخْلِفَنَّهُمْ فِي الْأَرْضِ كَمَا اسْتَخْلَفَ الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ وَلَيُمَكِّنَنَّ لَهُمْ دِينَهُمُ الَّذِي ارْتَضَى لَهُمْ وَلَيُبَدِّلَنَّهُمْ مِنْ بَعْدِ خَوْفِهِمْ أَمْنًا يَعْبُدُونَنِي لَا يُشْرِكُونَ بِي شَيْئًا وَمَنْ كَفَرَ بَعْدَ ذَلِكَ فَأُولَئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ. وَأَقِيمُوا الصَّلَاةَ وَآتُوا الزَّكَاةَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ ‘তোমাদের মধ্যকার ঐ সকল লোক যারা ঈমান এনেছে ও সৎকর্ম সম্পাদন করেছে, তাদের প্রতি আল্লাহ পাক ওয়াদা করেছেন এই মর্মে যে, তাদেরকে তিনি অবশ্য অবশ্য পৃথিবীতে খেলাফত দান করবেন। যেমন তিনি পূর্ববর্তীদেরকে দান করেছিলেন, তিনি অবশ্য অবশ্য তাদের দ্বীনকে প্রতিষ্ঠা দান করবেন, যার উপরে তিনি রাযী হয়েছেন মুমিনদের জন্য এবং তিনি অবশ্য অবশ্য তাদেরকে ভীতির পরিবর্তে শান্তি দান করবেন। তারা যেন আমার ইবাদত করে এবং আমার সাথে অন্য কিছুকে শরীক না করে। যারা এর পরে কুফরী করবে (অর্থাৎ খেলাফত প্রাপ্তির উক্ত নে‘মতের না-শোকরী করবে), তারা ফাসেক্ব’। ‘তোমরা ছালাত কায়েম কর, যাকাত আদায় কর এবং রাসূলের আনুগত্য কর, যাতে তোমরা অনুগ্রহ প্রাপ্ত হতে পার’ (নূর ২৪/ ৫৫-৫৬)।
আল্লাহ পাক অত্র আয়াতে মুসলমানদেরকে তিনটি বিষয়ে ওয়াদা দান করেছেন। যেখানে শেষের দু’টিকে প্রথমটির বাস্তব ফল বলা যেতে পারে। (১) পৃথিবীর শাসন ক্ষমতা প্রদান করা (২) ইসলামকে বিজয়ী দ্বীন হিসাবে প্রতিষ্ঠা দান করা (৩) ভীতির বদলে শান্তি দান করা। উল্লেখ্য যে, আল্লাহর এই ওয়াদা খেলাফতে রাশেদাহর ত্রিশ বছরের শাসনকালে পূর্ণতা লাভ করেছে বলে অধিকাংশ মুফাসসির মত প্রকাশ করেছেন (ইসলামী খেলাফত ও নেতৃত্ব নির্বাচন ৪ পৃঃ)।
আলোচ্য আয়াতটি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নবুওয়াতের যথার্থতার অন্যতম প্রমাণ। আয়াতের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী খেলাফতে রাশেদাহর স্বর্ণযুগে নবুওয়াতের আদলে খেলাফত প্রতিষ্ঠা লাভ করে। অতঃপর এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকায় ইসলামী খেলাফত সম্প্রসারিত হয়। বর্তমানে পৃথিবীর ৫৬টি দেশে মুসলমানদের শাসন কায়েম রয়েছে। যদিও ইসলামী শাসন ও আইন বিধান অধিকাংশ দেশেই নেই। আয়াতটি কেবলমাত্র খেলাফতে রাশেদাহ বা ছাহাবায়ে কেরামের যামানার জন্য খাছ নয়। বরং সকল যুগের মুসলিম উম্মাহর জন্য আম। সর্বযুগে পৃথিবীর সর্বত্র মুসলমানগণ এই শক্তি ও ক্ষমতা লাভ করতে পারে (ইসলামী খেলাফত ও নেতৃত্ব নির্বাচন পৃঃ ৬)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, لاَ يَبْقَى عَلَى ظَهْرِ الأَرْضِ بَيْتُ مَدَرٍ وَلاَ وَبِرٍ إِلاَّ أَدْخَلَهُ اللَّهُ كَلِمَةَ الإِسْلاَمِ إِمَّا بِعِزِّ عَزِيزٍ وَإِمَّا بِذُلِّ ذَلِيلٍ إِمَّا يُعِزُّهُمُ اللَّهُ فَيَجْعَلُهُمْ مِنْ أَهْلِهِ فَيَعِزُّوا بِهِ وَإِمَّا يُذِلُّهُمْ فَيَدِينُونَ لَهُ ‘ভূপৃষ্ঠে এমন কোন মাটির ঘর বা ঝুপড়িও থাকবে না, যেখানে ইসলামের কলেমা প্রবেশ করবে না। হয় তারা ইসলাম কবুল করে সম্মানিত হবে, নয় কবুল না করে অসম্মানিত হবে ও ইসলামের আনুগত্য স্বীকারে বাধ্য হবে। এইভাবে আল্লাহর দ্বীন পরিপূর্ণতা লাভ করবে’ (আহমাদ হা/২৩৮৬৫, মিশকাত হা/৪২, সনদ ছহীহ)। অত্র হাদীছ ইসলামের বিশ্বব্যাপী প্রসারের সাথে সাথে তার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামগ্রিক বিজয়ের ইঙ্গিত বহন করে। যেমন অন্য বর্ণনায় এসেছে, وَاللَّهِ لَيُتِمَّنَّ اللَّهُ هَذَا الأَمْرَ حَتَّى يَسِيرَ الرَّاكِبُ مَا بَيْنَ صَنْعَاءَ وَحَضْرَمَوْتَ مَا يَخَافُ إِلاَّ اللَّهَ تَعَالَى وَالذِّئْبَ عَلَى غَنَمِهِ وَلَكِنَّكُمْ تَعْجَلُونَ ‘আল্লাহর কসম! নিশ্চয়ই এই (ইসলামী) শাসন পূর্ণতা লাভ করবে। এমনকি ছান‘আ থেকে হাযারামাউত পর্যন্ত একজন সওয়ারী একাকী ভ্রমণ করবে। কিন্তু আল্লাহ ব্যতীত সে কাউকে ভয় পাবে না। তবে ভয় পাবে তার ছাগল পালের উপরে নেকড়ের আক্রমণের। কিন্তু তোমরা খুব তাড়াহুড়া প্রকাশ করছ’ (আবুদাঊদ, হা/২৬৪৯, তাফসীর কুরতুবী ১২/২৯৯ পৃঃ)। অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, إِنَّ اللَّهَ زَوَى لِىَ الأَرْضَ فَرَأَيْتُ مَشَارِقَهَا وَمَغَارِبَهَا وَإِنَّ أُمَّتِى سَيَبْلُغُ مُلْكُهَا مَا زُوِىَ لِى ‘আল্লাহ পাক আমাকে সমগ্র পৃথিবীকে একত্রিত করে দেখালেন। আমি তার পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্ত পর্যন্ত দেখলাম। সত্বর আমার উম্মতের শাসন ঐ সমস্ত এলাকা পর্যন্ত পৌঁছানো হবে, যতদূর পর্যন্ত এলাকা আমাকে দেখানো হয়েছে’। ইবনু কাছীর (রহঃ) বলেন, আমরা এখন সেই যুগ অতিবাহিত করছি, যার ওয়াদা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল আমাদেরকে দান করেছেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সত্য কথা বলেন (মুসলিম হা/৭৪৪০, তাফসীরে ইবনে কাছীর ৩/৩১২ পৃঃ, তাফসীরে কুরতুবী ১২/২৯৮ পৃঃ)।
ইসলামের রাজনৈতিক বিজয়ের ধারা উল্লেখ করতে গিয়ে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বলেন, تَكُونُ النُّبُوَّةُ فِيكُمْ مَا شَاءَ اللَّهُ أَنْ تَكُونَ ثُمَّ يَرْفَعُهَا إِذَا شَاءَ أَنْ يَرْفَعَهَا ثُمَّ تَكُونُ خِلاَفَةٌ عَلَى مِنْهَاجِ النُّبُوَّةِ فَتَكُونُ مَا شَاءَ اللَّهُ أَنْ تَكُونَ ثُمَّ يَرْفَعُهَا إِذَا شَاءَ أَنْ يَرْفَعَهَا ثُمَّ تَكُونُ مُلْكاً عَاضًّا فَيَكُونُ مَا شَاءَ اللَّهُ أَنْ يَكُونَ ثُمَّ يَرْفَعُهَا إِذَا شَاءَ أَنْ يَرْفَعَهَا ثُمَّ تَكُونُ مُلْكاً جَبْرِيَّةً فَيَكُونُ مَا شَاءَ اللَّهُ أَنْ يَكُونَ ثُمَّ يَرْفَعُهَا إِذَا شَاءَ أَنْ يَرْفَعَهَا ثُمَّ تَكُونُ خِلاَفَةٌ عَلَى مِنْهَاجِ نُبُوَّةٍ ثُمَّ سَكَتَ ‘তোমাদের মধ্যে নবুওয়াত থাকবে যতদিন আল্লাহ ইচ্ছা করেন। অতঃপর তা উঠিয়ে নেবেন। এরপর নবুওয়াতের তরীকায় খেলাফত কায়েম হবে। আল্লাহ পাক যতদিন ইচ্ছা তা রেখে দেবেন। অতঃপর উঠিয়ে নেবেন। অতঃপর অত্যাচারী রাজাদের আগমন ঘটবে। আল্লাহ পাক স্বীয় ইচ্ছামত তাদেরকে বহাল রাখবেন। তারপর উঠিয়ে নিবেন। অতঃপর জবর দখলকারী শাসকদের যুগ শুরু হবে। আল্লাহ পাক স্বীয় ইচ্ছামত তাদেরকে বহাল রাখবেন। অতঃপর উঠিয়ে নেবেন। এরপরে নবুওয়াতের তরীকায় পুনরায় খেলাফত কায়েম হবে। এই পর্যন্ত বলার পর আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) চুপ হয়ে গেলেন’ (আহমাদ হা/১৮৪৩০, সিলসিলা ছহীহাহ হা/৫; মিশকাত হা/৫৩৭৮)। উপরোক্ত হাদীছ থেকে একথা স্পষ্ট করে বলা যায় যে, বর্তমানে বিশ্বব্যাপী নামে ও বেনামে জবর দখলকারী শাসকদের যুগ চলছে। এরপরেই আসবে শান্তিময় ও কল্যাণময় ইসলামী সমাজ ও খেলাফত। আলোচ্য আয়াতে সৎকর্মশীল মুমিনদের জন্য যার ওয়াদা করা হয়েছে।
প্রচলিত রাষ্ট্রব্যবস্থা : একটি পর্যালোচনা
বর্তমান বিশ্বে যেসব রাজনৈতিক মতবাদ প্রচলিত আছে এবং যে মতবাদের উপর ভিত্তি করে বিশ্বের রাষ্ট্র ব্যবস্থা চলমান তন্মধ্যে পুঁজিবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থার ভূমিকা অগ্রগামী। পুঁজিবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থা দু’ভাগে বিভক্ত। (১) পুঁজিবাদী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র (২) পুঁজিবাদী অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র (একনায়কতান্ত্রিক ও রাজতান্ত্রিক পুঁজিবাদী রাষ্ট্র) (মাসিক আত-তাহরীক, নভেম্বর ১৯৯৯, ৩য় বর্ষ ২য় সংখ্যা ১৩ পৃঃ)। আর প্রত্যেক ইজম বা মতবাদের মধ্যে যেমন আদর্শিক স্বাতন্ত্র বিদ্যমান তেমনি কর্মপদ্ধতিতেও রয়েছে বিস্তর পার্থক্য। পার্থক্যের ভিন্নতা ও বৈশিষ্ট্যের স্বাতন্ত্রবোধ একটি অপরটি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং এর নেতিবাচক প্রভাব প্রস্ফুটিত। যেমন গণতন্ত্র, রাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ও জাতীয়তবাদ প্রভৃতি।
গণতন্ত্র (Democracy) :
গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা বর্তমান বিশ্বের শ্রেষ্ঠ শাসন ব্যবস্থা হিসেবে অমুসলিমদের কাছে স্বীকৃত। যা পুঁজিবাদী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে চিত্রিত করা হয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ ‘গণতন্ত্রের’ বিভিন্ন সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। কেউ একে বিশেষ রাষ্ট্র ব্যবস্থা হিসেবে রূপায়িত করেছেন। কেউ দেখিয়েছেন একটি সমাজ ব্যবস্থা হিসেবে। আবার কেউবা এটাকে বিশেষ ধরনের জীবনপন্থা (Way of life) বলে আখ্যায়িত করেছেন। আমেরিকান প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন ১৮৬৩ সালে গেটিসবার্গের এক জনসভায় বক্তব্য প্রদানের সময় প্রচলিত পুঁজিবাদী ও ধর্মহীন সেক্যুলার জাতীয়তাবাদী মতবাদ ‘গণতন্ত্র’-এর একটি রাষ্ট্রীয় রূপরেখার বর্ণনা দেন। যার মূল কথা ছিল, Democracy is the goverment of the people by the people and for the people. অর্থাৎ ‘গণতন্ত্র এমন একটি সরকার ব্যবস্থা যা, মানুষের উপর মানুষের দ্বারা পরিচালিত মানুষের প্রভুত্বভিত্তিক শাসন ব্যবস্থাকে বুঝায়’ (সৈয়দ মকসুদ আলী, রাষ্ট্রবিজ্ঞান; ঢাকা : বাংলা একাডেমী, ৩য় সংস্করণ, জুন ১৯৮৩; পৃঃ ২৮৫)। লর্ড ব্রাইস (Lord Bryce) তাঁর 'Modern Democracies' গ্রন্থে বলেছেন, ‘গণতন্ত্র এমন এক প্রকার শাসন ব্যবস্থা যেখানে ক্ষমতা বিশেষ কোন ব্যক্তি বা শ্রেণীসমূহের হাতে না থেকে সমাজের সমস্ত সদস্যের উপর ন্যস্ত থাকে’ (দ্বীপক কুমার আঢ্য, রাষ্ট্রবিজ্ঞান; দিকদর্শন প্রকাশনী, ডিসেম্বর ২০১১ : ষষ্ঠ সংস্করণ, ঢাকা; পৃঃ ২১৯)। অধ্যাপক সিলী (Prof. Selley) বলেন, Democracy is a form of goverment in which every one has a share in it. অর্থাৎ ‘যে সরকার ব্যবস্থায় সাধারণ জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত থাকে তাকে গণতন্ত্র বলে’ (মোঃ মকসুদুর রহমান, রাষ্ট্রীয় সংগঠনের রূপরেখা; রাজশাহীঃ ইমপিরিয়াল বুকস্, প্রথম প্রকাশ জানুয়ারী ১৯৯১; পৃঃ ৭৬)। সুতরাং এক কথায় বলা যায়, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় দেশের জনগণ নিজেদের ইচ্ছামত রাষ্ট্রকে এমন একটি ‘জবরদস্তী শক্তি’ (Coercive power) সংগ্রহ করে দেয়, যার আনুগত্য করতে সকল নাগরিক বাধ্য থাকে। তাছাড়া ‘জনগণ সকল ক্ষমতার উৎস’ ও ‘অধিকাংশের রায়ই চূড়ান্ত’ ইলাহী সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে এই দুই মূর্তিমান শিরকী মতবাদ গণতন্ত্রের প্রাণ সদৃশ। পুঁজিবাদী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় কোন ব্যক্তি কিংবা বিশেষ কোন জনগোষ্ঠীকে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী মনে করা হয়। সেখানে সরকার প্রধান ও জনগণের প্রতিনিধি হওয়ার ক্ষেত্রে স্বেচ্ছায় পদপ্রার্থী হওয়ার জন্য ভোট ভিক্ষা করতে হয় এবং বিজয়ী হওয়ার জন্য বিভিন্ন কূট-কৌশল অবলম্বন করতে হয়। প্রার্থীকে নিজেই সেই পদের একজন যোগ্য প্রার্থী বলে প্রচার-প্রচারণা চালাতে হয়। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নীতি-নৈতিকতার কোন স্থান নেই। থাকে না মানবিক ও নৈতিক উৎকর্ষ সাধনের কার্যকরী কোন পদক্ষেপ। বরং নীতি বা নৈতিকতা বিরোধী সকল প্রকার কর্মকান্ড বিদ্যমান থাকে। এ রাষ্ট্রে মানুষকে কেবল চরম স্বেচ্ছাচার, ব্যক্তি স্বাধীনতা ও ভোগবাদিতার সর্বোচ্চ আসনে সমাসীন করে। পুঁজিবাদী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় মস্তিষ্কপ্রসূত আইন দ্বারা শাসন ও বিচারকার্য পরিচালিত হয়। এখানে কোন আদর্শ ও ধর্মীয় আইন-বিধানের তোয়াক্কা করা হয় না। পুঁজিবাদী অর্থনীতির সাথে সম্পৃক্ত থাকার কারণে রাষ্ট্র মুষ্টিমেয় পুঁজিপতিদের খেয়ালখুশি মত নিয়ন্ত্রিত হয়। কেননা পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থায় ব্যক্তিকে পুঁজির নিরংকুশ মালিক হিসেবে গণ্য করা হয়। ফলে ব্যবসায়িক ও অর্থনৈতিক নীতি আদর্শকে সেখানে অনুসরণ করা হয় না। বরং অধিক মুনাফা অর্জনের জন্য তারা সুদী কারবার অব্যাহত রাখে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় আইন রচনার নিরংকুশ অধিকার প্রকৃতপক্ষে ক্ষমতাসীন দলের হাতেই ন্যস্ত থাকে। এতে দলীয় প্রধানের ব্যক্তিগত ও দলীয় স্বার্থই প্রাধান্য পায় এবং জনসাধারণ ও জাতীয় স্বার্থ ভূলুণ্ঠিত হয়। পাশ্চাত্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় নেতা নির্বাচনের ক্ষেত্রে কোন জাতি-গোষ্ঠি ভেদাভেদ ও গুণাগুণের বিচার করা হয় না। যে কেউই নেতা হতে পারে। এখানে মগজের সন্ধান না করে মাথা গণনা করা হয়। ফলে নিরক্ষর, অজ্ঞ এবং জ্ঞানী-গুণী উভয়ের ভোটের মূল্য সমান হয়। রাতারাতি কলাগাছ ফুলে পরিণত হয় বটগাছে। সর্বোপরি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা একটা ধর্মহীন সেক্যুলার জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা। এখানে ক্ষমতার উৎস জনগণ বা বিশেষ কোন ব্যক্তি।
পর্যালোচনা :
আব্রাহাম লিংকন-এর সংঙ্গায়িত গণতন্ত্রের মাধ্যমে জানা যায় যে, বিশ্ব মানবতা তার সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তা‘আলার দাসত্ব থেকে মুখ ফিরিয়ে মানুষের দাসত্বকে কবুল করে নিয়ে তার সার্বিক জীবন পরিচালনা করবে। জীবনের বিস্তীর্ণ ময়দানে মানব রচিত বিধানের অন্ধ অনুসরণ করবে। ভুলে যাবে তাদের অতীত ঐতিহ্য ও গৌরবান্বিত ইতিহাস। আল্লাহর শক্তি-ক্ষমতা ও একত্বকে করবে ভূলুণ্ঠিত। কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব? মানুষের তৈরী বিধান দ্বারা মানুষ কিভাবে পরিচালিত হতে পারে? কিভাবে হক্ব ও ইনছাফ প্রতিষ্ঠিত হতে পারে? মানুষ কেন মানুষের গোলামী করবে? মানব রচিত বিধানের আনুগত্য করার অর্থ কি মানুষের গোলামী নয়? কেন মস্তিষ্ক প্রসূত বিধানের নিকট মাথা নিচু করবে? কখনো কি মানুষের তৈরী বিধান চূড়ান্ত সফলতা ও স্থায়ী শান্তি আনয়ন করতে পারে? কখনো কি মানুষের মাথা থেকে অভ্রান্ত সত্যের দিকনির্দেশনা আসতে পারে? একটাই উত্তর, না। কারণ মানুষ কখনো ভুলের ঊর্ধ্বে নয়। ভুল করাটাই তাদের স্বাভাবিক প্রবণতা। সুতরাং মানুষের তৈরী বিধান দ্বারা কখনো মানুষের জন্য কল্যাণকর কিছু আশা করা যায় না। আর গণতন্ত্রের সকল নীতিমালা মস্তিষ্ক প্রসূত। তাছাড়া গণতন্ত্রের যাবতীয় নিয়মাবলী আদর্শিকভাবে ইসলামের সাথে পুরোপুরিভাবে সাংঘর্ষিক। বর্তমান আমাদের সম্মুখে এই অগ্নিগর্ভ বিশ্ব পরিস্থিতি তার জ্বাজল্য প্রমাণ। ১৯৪৫ সালে ২৪ অক্টোবর জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে স্বাধীন রাষ্ট্রের সদস্য সংখ্যা বর্তমান ১৯৪টি। তন্মধ্যে অধিকাংশ রাষ্ট্রে এই মানবতা হরণের হাতিয়ার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত। আপাত মধুর আবেশ নিয়ে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রায় প্রতিটি দেশেই জনগণের মাঝে অশান্তির আগুন দাউ দাউ করে জ্বালিয়ে চলেছে। যা ওপেন সিক্রেট!
পুঁজিবাদী অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র (একনায়কতান্ত্রিক ও রাজতান্ত্রিক পুঁজিবাদী রাষ্ট্র) :
একনায়কতান্ত্রিক ও রাজতান্ত্রিক পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে রাজার হাতেই থাকে সার্বভৌম ক্ষমতার উৎস। তার রচিত আইন হয় রাষ্ট্রের অধীনে বসবাসরত সকল সাধারণ নাগরিকের আইন। রাজতন্ত্রে রাজার ইচ্ছাই চূড়ান্ত। রাজতন্ত্রে রাজা নিজ বাহুবলে রাজ্য জয় করেন ও নিজ ইচ্ছা অনুযায়ী রাষ্ট্র শাসন ও পরিচালনা করেন। রাজা সৎ, যোগ্য ও সুশাসক হ’লে রাজ্যে সুখ-শান্তি বিরাজ করে। এমনকি রাজা ইসলামপন্থী হ’লে তাঁর দ্বারা ইসলামী বিধান প্রতিষ্ঠা লাভ করাও অসম্ভব কিছু নয়। বিগত দিনে এমনকি বর্তমান বিশ্বেও এর নযীর বিদ্যমান রয়েছে। এর বিপরীতটা হ’লে বিপরীত হওয়াই স্বাভাবিক। যদিও বর্তমান বিশ্বে কোন রাজাই একক ইচ্ছায় দেশ চালান না। সর্বত্রই রয়েছে একটা নির্বাচিত অথবা মনোনীত মন্ত্রণাপরিষদ (ইসলামী খেলাফত ও নেতৃত্ব নির্বাচন ১১ পৃঃ)। উল্লেখ্য যে, অনেকে মু‘আবিয়া (রাঃ) কর্তৃক স্বীয় পুত্র ইয়াযীদকে খলীফা হিসেবে মনোনয়ন দেওয়াকে খেলাফত থেকে রাজতন্ত্রে সমর্পণ বলে মনে করে থাকেন। অথচ ইয়াযীদকে তিনি পিতৃসেণহের বশবর্তী হয়ে মনোনয়ন দেননি। বরং তার অন্যতম কারণ ছিল তিনটি : প্রথমতঃ ইসলামী খেলাফত ভেঙ্গে টুকরো টুকরো না হয়, দ্বিতীয়তঃ ইয়াযীদের ব্যাপারে আব্দুল্লাহ ইবনু যুবায়ের (রাঃ) ব্যতীত সকল ছাহাবীদের ঐক্যমত, তৃতীয়তঃ সমকালীন সময়ে প্রভাব বিস্তারকারী বনু উমাইয়াগণ ইয়াযীদ ব্যতীত অন্য কারো নেতৃত্বে রাযী ছিল না। তাছাড়া মু‘আবিয়া (রাঃ) ইয়াযীদকে তাঁর স্থলাভিষিক্ত করার ব্যাপারে তার পক্ষ থেকে কোন প্রস্তাবও ছিল না। যাহোক ইয়াযীদ যখন খলীফা নির্বাচিত হয়েই গেলেন তখন মু‘আবিয়া জনসমক্ষে যে ভাষণ দেন, সেখানে তিনি বলেছিলেন, হে আল্লাহ! তুমি সবকিছু জানো। হে আল্লাহ! যদি আমি তাকে এজন্য স্থলাভিষিক্ত করে থাকি যে, সে যথার্থভাবেই এর যোগ্য, তাহলে তুমি তাকে সফলতা দান কর। আর যদি এর মধ্যে আমার কোন পুত্রসেণহের আতিশয্য কার্যকর থাকে, তাহলে তুমি তোমার সাহায্যের হাত গুটিয়ে নাও। তুমি তাকে সফল হতে দিয়ো না (আল-বিদায়াহ-এর বরাতে ‘ খেলাফত ও মুলূকিয়াতঃ একটি ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় পর্যালোচনা’ পৃঃ ৪১৫; গৃহীত : ইসলামী খেলাফত ও নেতৃত্ব নির্বাচন ১৬ পৃঃ)। অতএব পিতা কর্তৃক স্বীয় পুত্রকে খলীফা হিসেবে মনোনয়ন দেওয়াকে খেলাফত থেকে রাজতন্ত্রে সমার্পণ বলে মনে করা যাবে না। পরিস্থিতির বিবেচনায় মু‘আবিয়া (রাঃ) সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বলে আমাদের বিশ্বাস করতে হবে। আর এটিই সঠিক।
পর্যালোচনা :
রাজতন্ত্রে সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক যেহেতু রাজা বা রাণীরূপে একজন ব্যক্তির হাতে থাকে, সেকারণ এই শাসন ব্যবস্থা আদর্শিক ভাবে ইসলামের সাথে সংঘর্ষশীল। সুতরাং এই মতবাদের মাধ্যমে ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠা হওয়া সম্ভব নয়।
জাতীয়তাবাদ (Nationalism) : বিংশ শতাব্দীতে আবিষ্কৃত মানবতা বিধ্বংসী অভিশপ্ত আরেকটি মতবাদ হচ্ছে বর্ণ, ভাষা ও অঞ্চলভিত্তিক সংকীর্ণ ‘জাতীয়তাবাদ’ (Nationalism)। এ জাতীয়তাবাদের হোতা ছিলেন ইটালির মুসোলীনি ও জার্মানির ফ্যাসিবাদের অন্যতম প্রবক্তা হিটলার। একই স্বার্থ ও ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে একটি জাতি বলে। আর ‘জাতি’ ভিত্তিক মতবাদকে ‘জাতীয়তাবাদ’ বলে। যা নির্দিষ্ট একটি জাতির স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য তৈরী হয়। প্রাচীন জাতীয়তাবাদ ও আধুনিক জাতীয়তাবাদের ব্যবহারিক অর্থ ও উপাদান এক ও অভিন্ন। প্রাচীন ও আধুনিক জাতীয়তাবাদের মৌলিক উপাদান মূলতঃ ৬টি। সেগুলো হল- বংশ, অঞ্চল, ভাষা, বর্ণ, অর্থনৈতিক ঐক্য ও শাসনতান্ত্রিক ঐক্য। উল্লেখ্য, এই ছয়টি উপাদানের মধ্যে ধর্ম অনুপস্থিত। মূলতঃ উপরোক্ত ছয়টি উপাদানই বিশ্ব পরিমন্ডলে বিদ্যমান রয়েছে এবং তা বিশেষ স্বার্থবাদিতার জন্য মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হতে উদ্বুদ্ধ করে। প্রাচীন যুগে ১০৯৫ থেকে ১২৯১ খৃঃ প্রায় দু’শো বছর ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের দোহাই পেড়ে খৃষ্টানরা মুসলামানদের বিরুদ্ধে ক্রসেডের জন্ম দিয়েছিল। তেমনি আধুনিক যুগে খৃষ্টান জাতীয়তাবাদ বসনিয়া, সোমালিয়া, ইরাক, আফগানিস্তানকে মুসলিম ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে। ইসরাঈল, মিয়ানমার, কাশ্মীর, শ্রীলংকায়ও ঠিক একইভাবে মুসলমানদের বিরুদ্ধে জাতিগত সন্ত্রাস চলছে। ইহুদী জাতীয়তাবাদ ফিলিস্তিনী মুসলমানদের উপর বিগত অর্ধশত বছর ধরে অত্যাচারের স্টীমরোলার চালাচ্ছে ও তাদেরকে নিজ ভূখন্ড থেকে উৎখাত করার সর্বপ্রকার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। হিন্দু জাতীয়তাবাদ সংখ্যালঘু কাশ্মীরী মুসলমানসহ খৃষ্টান সম্প্রদায়ের উপরেও অনুরূপ হামলা চালিয়ে যাচ্ছে বছরের পর বছর ধরে। অন্যদিকে হিন্দুদের নিম্ন জাত দলিতরা উচ্চ জাত ব্রাক্ষ্মণদের অত্যাচারে নিস্পিষ্ট ও নিগৃহীত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। তেমনিভাবে ধর্মহীন পাশ্চাত্য জাতীয়তাবাদই তুরস্কের দীর্ঘদিনের লালিত খেলাফত ধ্বংস করেছিল। এই ধ্বংসাত্মক মতবাদই হিরোশিমা ও নাগাসাকির ৪ লক্ষ অসহায় বনু আদমকে কয়েক মিনিটের মধ্যে পৃথিবীর আলো বাতাস থেকে বঞ্চিত করেছিল। এভাবেই পাশ্চাত্য জাতীয়তাবাদ মানবজাতির ধ্বংসাত্মক আদিম স্বার্থলিপ্সাকে প্ররোচিত করে তাকে আপন স্বার্থ চরিতার্থে পাগলপারা করে তোলে (মাসিক আত-তাহরীক, ঐ, পৃঃ ৭, সংক্ষেপায়িত)।
পর্যালোচনা :
মানব রচিত কোন ধর্ম বা মতবাদ কখনো চূড়ান্ত সত্যের সন্ধান দিতে পারে না। বিগত দিনে যত ধর্মীয় বিধান নাযিল হয়েছিল তা আল্লাহ প্রেরিত সর্বশেষ এলাহী ধর্ম ‘ইসলাম’ আগমনের পর রহিত হয়ে গেছে। বিশ্ব পরিচালনার পদ্ধতিগত নীতিমালা ইসলামেই উল্লেখিত হয়েছে। তাই ইসলাম বিশ্বধর্ম এবং সেইজন্য ইসলামী জাতীয়তাবাদই হচ্ছে বিশ্ব জাতীয়তাবাদ। আর এটা শুধু ইসলাম ধর্মেরই বিশেষত্ব যে, পারস্পরিক গর্ব ও আত্ম অহংকারে স্ফীত হয়ে মানুষে মানুষে, গোত্রে-গোত্রে বিভক্ত হওয়া ও ভেদাভেদ করা একটি জঘন্যতম অপরাধ হিসেবে ইসলামে নির্দেশিত হয়েছে। অথচ তা জাতীয়তাবাদের মৌলিক উপাদান সমূহের অন্যতম। আর এ বিষয়ে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) তাঁর ছাহাবীদের মাধ্যমে তাদের বাস্তব জীবনে প্রতিফলন দেখিয়ে গেছেন। ফলে দেখা গেছে যে, মক্কা থেকে হিজরত করে মদীনায় গেলে ভূখন্ডগত ও অঞ্চলগত পার্থক্য সত্ত্বেও তারা পরস্পরে এমন ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন যে, সহোদর ভাইকেও হার মানিয়ে দেয়। আবার একই ধর্মের অনুসারী হওয়া সত্ত্বেও নিয়মবিরুদ্ধ কাজ করলে তাদের ব্যাপারে যে কঠোরতা অবলম্বন করা হয়েছিল তা ইতিহাস বিখ্যাত। এভাবে আদর্শিক জাতীয়তাবাদকে অক্ষুণ্ণ রেখে মদীনার ইয়াহুদী-নাছারাদের সাথে সমাজবদ্ধভাবে বসবাসের জন্য ঐতিহাসিক ‘মদীনা সনদ’ করতেও কোন বাধার সৃষ্টি হয়নি। তাছাড়া পাশ্চাত্য জাতীয়তাবাদ ধর্মহীন স্যেকুলার বস্ত্তবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত বলেই ইসলামের সাথে তা সাংঘর্ষিক। অতএব এই বস্ত্তবাদী মতবাদের ভিত্তিতে রাষ্ট্র ও সমাজে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। সুতরাং প্রচলিত এই সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠা হওয়া অসম্ভব।
ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ (Secularism) :
ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী চিন্তাধারা মুসলিম বিশ্বে গভীরভাবে অনুপ্রবেশ করেছে। বর্তমান সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ফেলেছে। চলতি সময়ে এ মতাদর্শ মুসলিম বিশ্বসহ সারা বিশ্বের শাসন-পদ্ধতির মানদন্ডরূপে বরিত হচ্ছে। অথচ ‘ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ’ বলতে ধর্মহীনতা বা ধর্মবিমুখতাকে বোঝায়। অর্থাৎ ‘ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ’ ঐ মতাদর্শকে বলা হয় ‘যা কোন ধর্মের অপেক্ষা রাখে না’ অথবা ‘যে মতাদর্শের সাথে ধর্মের কোন সম্পর্ক নেই’। ‘ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ’-কে ইংরেজীতে ‘সেক্যুলারিজম’ (Secularism) বলা হয়। Encyclopadia of Britenica- তে Secularism-এর সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, Any movement in society directed away from the worldliness to life on earth... ‘এটি এমন একটি সামাজিক আন্দোলনের নাম, যা মানুষকে আখেরাতের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে কেবলমাত্র পার্থিব বিষয়ের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করায়’। (Encyclopadia of Britanica, 15th Edn. 2002.Vol-X. p. 594). ‘ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ-এর মূল কথা হল Religion should not be allowed to come into politics. It is merely a matter between man and god. অর্থাৎ ‘ধর্মকে রাজনীতির অঙ্গনে প্রবেশাধিকার দেওয়া উচিত নয়। এটি মানুষ ও ঈশ্বরের মধ্যকার একটি (আধ্যাত্মিক) বিষয় মাত্র’। (ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, পৃঃ ২৬)। ড. আলী জারীশা বলেন, العلمانية هو فصل الدين عن الدولة ‘রাষ্ট্রযন্ত্র থেকে দ্বীন তথা ধর্মকে পৃথক করা হ’ল ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ’ (আল-ইত্তিজা-হাতুল ফিকরিইয়াহ আল-মু‘আছারাহ, ৮৩ পৃঃ)। এক কথায় বলা যায় যে, জীবনের বিস্তীর্ণ ময়দান থেকে ধর্মকে উৎখাত করে তা কেবল ব্যক্তি জীবনে পালনীয় একটি বিষয় মাত্র বলে ধারণা ও অনুসরণ করাকে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ বলে। অর্থাৎ মানুষের পারিবারিক, সাংসারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাষ্ট্রিক, রাজনৈতিক প্রভৃতি জীবন থেকে ধর্মকে নিশ্চিহ্ন করে মসজিদ বা ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বাধীন জীবন গঠনের মাধ্যম হল ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ। একটি দার্শনিক মতবাদ হিসেবে ১৮৪৬ সালে জ্যাকব হালেক ইংল্যান্ডে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের ধারণা প্রথম প্রবর্তন করেন। যদিও চার্লস সাউথওয়েল, থমাসকুপার, থমাস পিয়ারসন, স্যার ব্রেডলে প্রমুখের মাধ্যমে এর পূর্বে ১৮৩২ সালে সারা বিশ্বে আন্দোলনটি জোরালো রূপ ধারণ করে। অন্যদিকে আধুনিক গণমাধ্যম মানুষে মানুষে সম্পর্ককে স্বার্থপরতা ও আর্থিক লেনদেনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখেছে। আবার পাশ্চাত্য সভ্যতা চারিত্রিক শুদ্ধচারিতার উপর স্থান দিয়েছে অর্থকে। পারিবারিক বন্ধনের ক্ষেত্রে সেণহ-ভালবাসা, মায়া-মমতা ও সৌহার্দ্যকে উৎখাত করে সেখানে শুধু অর্থের সম্পর্ক স্থাপন করেছে। ফলে পাশ্চাত্য সভ্যতার উপরিউক্ত বীভৎসতায় বীতশ্রদ্ধ হয়ে ইউরোপের কার্ল মার্ক্স একটি আর্থ-সামাজিক মতবাদের তত্ত্ব উপস্থাপন করেন। যা মার্ক্সবাদী ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ বলে বিশ্ব ইতিহাসে স্বীকৃতি লাভ করেছে। ‘উনবিংশ শতাব্দিতে প্রচারিত বিভিন্ন প্রকার ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের মধ্যে মার্ক্সবাদই সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী মতবাদ’ (আবদুল রশিদ মতিন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ইসলামী প্রেক্ষিত, অনুবাদ : এ কে এম সালেহউদ্দীন পৃঃ ১৪)। এই কার্লমার্ক্স তার গ্রন্থের ভূমিকায় বলেছেন, ‘এক কথায় আমি সব ধরনের ঈশ্বরকে ঘৃণা করি’। তিনি আরো বলেন, ‘ধর্ম হচ্ছে মানুষের কাল্পনিক সুখের অন্বেষা’। আরো বলেন, ‘ধর্ম একটি আফিম’। কেননা মানুষ প্রবৃত্তির পূজারী। কোন নির্দিষ্ট গন্ডির মধ্যে সে জীবন অতিবাহিত করতে চায় না। তাই কার্লমার্ক্সের উপস্থাপিত এই ধর্মহীন মতবাদের তীব্র প্রচার-প্রপাগান্ডার ফলে বিশ্বময় তা প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়। ফলে মুসলিম বিশ্বের তথাকথিত নেতৃবৃন্দদের কেউ কেউ এ কথিত নব্য হিব্রু নবী কার্লমার্ক্সের কথাকে ঐশীগ্রন্থের মত ভক্তি করতে থাকে। তারা তাকে এমন এক ইশ্বর রূপে পূজার নৈবেদ্য নিবেদন করেছে যে, অন্যান্য সকল ধরনের ঈশ্বরের ধারণাকে বাতিল বলে ঘোষণা করেছে। (রাষ্ট্রবিজ্ঞান : ইসলামী প্রেক্ষিত, পৃঃ ১৬)। ফলশ্রুতিতে ১৯২৪ সালে মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক তুরস্কে ‘ইসলামী খেলাফত’ উৎখাত করে সেখানে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। তিনি রাষ্ট্রের অধিবাসীদের উপর পাশ্চাত্য পোশাক পরিধান ও রোমান বর্ণমালা অধ্যয়ন বাধ্যতামূলক করেন। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ নিষিদ্ধ করেন। আরবী আযান তুলে দিয়ে হিব্রু ভাষার আযান চালু করেন। আর এ সব নীতির বিরোধিতা করলে নিপীড়ন বা মৃত্যুদন্ড দ্বারা দমন করতেন। তিউনিশিয়ার হাবিব বরগুইবা রাষ্ট্রধর্ম ইসলামকে অব্যাহত রাখলেও মহিলাদের পর্দাপ্রথা নিষেধ করেন। ১৯৬১ সালে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার নামে তিউনিশীয় জনগণকে রামাযান মাসে ছিয়াম পালন না করার আহবান করেন। এটিই হল ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের বাস্তব ফল। কারণ ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের উৎসস্থল হল সম্পূর্ণরূপে ইহজগতমুখিতা। মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ছাঃ)-এর নির্দেশিত পন্থাকে বাদ দিয়ে যুক্তি, পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা নির্ভর, বল্গাহীন প্রবৃত্তির ইচ্ছাভিত্তিক মানবতাবাদে বিশ্বাসী এবং সর্বোপরি এটি ধর্ম ও রাজনীতিকে বিচ্ছিন্ন ও পৃথকীকরণে বিশ্বাসী। সুতরাং এর সারনির্যাস হ’ল, ব্যক্তি জীবনে ধর্ম স্বীকৃত কিন্তু বৈষয়িক জীবনের বিস্তীর্ণ পরিমন্ডলে মানব রচিত বিধান স্বীকৃত। যেকোন মূল্যে জাগতিক উন্নয়নই এর মৌলিক লক্ষ্য।
পর্যালোচনা :
ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ দু’টি কারণে গ্রহণযোগ্য নয়। এক : ধর্মবিমুখতা। মানুষ এখানে তার বিবেকের স্বাধীনতাকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে। আর তারা ধর্মীয় বিশ্বাসের জন্য স্বীয় বিবেক ছাড়া অন্য কোন সত্তার নিকট জবাবদিহি করতে বাধ্য নয় (অর্থাৎ পরকালীন জীবনকে তারা অস্বীকার করে থাকে)। ফলে ধর্মনিরপেক্ষ জীবনে ধর্ম কোনই প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয় না। অথচ ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। মানুষের আধ্যাত্মিক ও বৈষয়িক জীবনের সকল বিষয়ের হেদায়েত এতে মওজুদ রয়েছে। দুই : দুনিয়াপূজা। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের মূল রূহ হল ‘দুনিয়া’। এখানে ধর্মীয় কোন কিছুরই প্রবেশাধিকার নেই। যেনতেন প্রকারে দুনিয়া হাছিল হলেই যথেষ্ট। এই জন্যেই তারা জনগণকে সার্বভৌম ক্ষমতার উৎস বলে মনে করে। রাষ্ট্রযন্ত্রে আল্লাহর আইনের কোন প্রবেশেধিকারকে তারা তোয়াক্কা করে না। মানবিক জ্ঞান-বুদ্ধি হয় তাদের আইন রচনার মূল ভিত্তি। যা ভুলের ঊর্ধ্বে নয়। সুতরাং ‘ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ’ নামক অতি প্রাচীন এই মতবাদের মাধ্যমে আর যাই হোক ‘ইসলামী খেলাফত’ প্রতিষ্ঠা হওয়া কোনমতেই সম্ভব নয়।
বস্ত্ততঃ ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের মাধ্যমে প্রথমে মুসলমানকে ধর্মের গন্ডিমুক্ত করে। অতঃপর জাতীয়তাবাদের বিষ ছড়িয়ে তাদের ঐক্য ছিন্নভিন্ন করে। অতঃপর গণতন্ত্রের মাধ্যমে তাদেরকে মানুষের গোলাম বানায়। ফলে মানুষ এখন মানুষের দাসত্বের অধীনের চরমভাবে পিষ্ট হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী চলছে এই শয়তানী হানাহানির বহ্ন্যুৎসব। সুতরাং মুসলমানের উচিত সর্বাগ্রে মানুষকে তাওহীদের শিক্ষা দানের মাধ্যমে আল্লাহর দাসত্বে ফিরিয়ে আনা। তার পরেই মানুষ সত্যিকার অর্থে স্বাধীনতার সুখ পাবে। মুক্তি পাবে মানবতা। (মাসিক আত-তাহরীক ১৫ তম বর্ষ ১১ তম সংখ্যা, আগস্ট ২০১২, পৃঃ ৩৩-৩৪, দিশারী কলাম দ্রষ্টব্য)। এটিই ইসলামী খেলাফতের মৌলিক দাবী।
খেলাফত প্রতিষ্ঠার উপায় :
ইসলামী খেলাফত কেবলমাত্র ইসলামী তরীকার মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব, পাশ্চাত্য হ’তে আমদানী করা শেরেকী তরীকার মাধ্যমে নয়। সুতরাং ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠার উপায় হ’ল দু’টি : দাওয়াত ও জিহাদ। কেননা পৃথিবীতে প্রেরিত সকল নবী ও রাসূল তাদের সুদীর্ঘ জীবনে শুধুমাত্র দাওয়াতী জীবন পরিচালনা করে গেছেন। পরিধিগত তারতম্যের ধারাবাহিকতায় প্রত্যেক নবী ও রাসূলের দাওয়াতী মিশন ছিল এক ও অভিন্ণ। আর এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, কোন বিপ্লব সংগঠিত করতে হলে উদ্দিষ্ট বিষয়ের জোরালো প্রচার-প্রচারণা চালানের কোন বিকল্প নেই। নীতি, আদর্শ আর কর্মসূচী অক্ষুণ্ণ রেখে জনমত সৃষ্টি করতে হয়। যাতে করে মানুষের চিন্তা জগতে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। যা সকল আম্বিয়ায়ে কেরামগণ করে গেছেন। বিশ্বনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)ও তার আদর্শ প্রচার করে যিন্দাদিল মর্দে মুজাহিদরূপী একদল নিবেদিতপ্রাণ কর্মীবাহিনী তৈরী করেছিলেন। তাদের ত্যাগপুত মানসিকতায় ইসলাম একদিন মক্কা-মদীনার গন্ডি পেরিয়ে সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিল। প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল মুসলমানদের কাংখিত খেলাফত। আজকের দিনেও ঐ একই পদ্ধতি অনুসরণ করলে আবারও খেলাফত প্রতিষ্ঠিত হবে ইনশাআল্লাহ। সুতরাং প্রথমোক্তটির মাধ্যমে ‘খেলাফত’ প্রতিষ্ঠার পক্ষে ব্যাপক জনমত সৃষ্টি করতে হবে। তাদের চিন্তাধারায় বিপ্লব আনতে হবে। কথা, কলম ও সংগঠনের মাধ্যমে এবং সেই সাথে যাবতীয় আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে নিজ দেশ ও বিশ্বব্যাপী ইসলামের দাওয়াত পেশ করতে হবে। যেন ইসলামী খেলাফতের কল্যাণকারিতা সম্পর্কে মানব জাতির সকল স্তরে স্পষ্ট ধারণা ও মঙ্গল চেতনা সৃষ্টি হয়। দ্বিতীয়টির জন্য ব্যাপক বস্ত্তগত যোগ্যতা ও ক্ষমতা অর্জন করতে হবে। এজন্য ইসলাম বিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে প্রথমে সীসাঢালা সাংগঠনিক শক্তি অর্জন করতে হবে। এটাই হবে জিহাদের সর্বপ্রধান হাতিয়ার। সমাজের প্রতিটি স্তরে, গ্রামে ও মহল্লায় যখন একদল সচেতন আল্লাহভীরু ও যোগ্য মুজাহিদ তৈরী হয়ে যাবেন এবং স্রেফ আল্লাহকে রাযী-খুশী করার জন্য ন্যায়ের আদেশ ও অন্যায়ের প্রতিরোধে ঐক্যবদ্ধভাবে নিজেদেরকে নিয়োজিত করবেন। তখন সংখ্যায় যত নগণ্যই হৌক না কেন, আল্লাহর সাহায্যে তারাই জয়লাভ করবেন। এভাবে সাংগঠনিক শক্তি অর্জনের উদ্দেশ্যে এমনকি তিনজন মুমিন একস্থানে থাকলেও তাদেরকে একজন আমীরের অধীনে ঐক্যবদ্ধ থাকার জন্য হাদীছে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। (মুসনাদে আহমাদ হা/৬৬৪৭; আবুদাঊদ হা/২২৭২) এই ইমারতের মাধ্যমে সুশৃংখলভাবে দেশব্যাপী দাওয়াত ও সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালিত হবে। এই ধরনের সাংগঠনিক ও জিহাদী ইমারতের পথ বেয়েই একদিন জাতীয় ভিত্তিক ‘খেলাফত’ প্রতিষ্ঠিত হবে ইনশাআল্লাহ। যদিও পূর্ণাঙ্গ ‘ইসলামী খেলাফত’ কেবলমাত্র ইমাম মাহ্দীর আবির্ভাবের পরেই সম্ভব হবে (ইসলামী খেলাফত ও নেতৃত্ব নির্বাচন ১৮-১৯ পৃঃ)।
সুতরাং শাসনতান্ত্রিক ভিত্তি এবং শরীয়তভিত্তিক বিশুদ্ধ আইন-কানুনসহ যাবতীয় দিক ও বিভাগের সূক্ষ্ম বিশ্লেষণপূর্বক সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয় যে, ইসলামী খেলাফত ও রাষ্ট্রব্যবস্থাই সর্বোত্তম ও আদর্শভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা। যেখানে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ও নিরঙ্কুশ আনুগত্যের ঘোষণা দিয়ে সর্বত্র ন্যায় ও ইনছাফভিত্তিক সুবিচারের মাধ্যমে সকল নাগরিকের মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়। তাছাড়া ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থায় ধনী-নির্ধন, ছোট-বড়, নারী-পুরুষসহ প্রত্যেক নাগরিকের পূর্ণ কল্যাণ নিশ্চিত করণের বিধান পূর্ণাঙ্গরূপে রয়েছে।
উপসংহার :
পরিশেষে বলব যে, তথাকথিত আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তি ইসলামের স্বকীয়তা ও প্রাণসঞ্জিবনী শক্তির ক্রমবর্ধমান ধারাকে চরমভাবে বাধাগ্রস্থ করছে। যদিও তা রকমারী বিভিন্ন দৃষ্টিনন্দন উপাদানে ভরপুর। প্রচলিত পাশ্চত্য পন্ডিতদের রচিত অসংখ্য রাষ্ট্রীয়, অর্থনৈতিক ও সামাজিক মতবাদসমূহ ইসলামকে অক্টোপাসের ন্যায় আষ্টেপৃষ্ঠে ধরে রেখেছে। ইসলামের আদর্শবাদী চিন্তা ও সংস্কারমূলক কর্মকান্ড ইহুদী-খ্রীস্টান সাম্রাজ্যবাদী চক্র নানা অজুহাতে অবদমিত করছে। অন্যদিকে ইসলামের নামে সামাজিক কুসংস্কার, উছূলী বিতর্ক, দলীয় বিভক্তি অখন্ড মুসলিম উম্মাহকে আরো বহুগুণে ক্ষত-বিক্ষত করেছে। ফলে আজ ইসলামের পুনর্জীবনী শক্তির সমুন্নত ধারা চরমভাবে হুমকির সম্মুখিন। তারা ইসলামকে নিছক একটি আচার- অনুষ্ঠান, ভাবাবেগ ও কিছু বিশ্বাসের সমষ্টির নাম বলে আখ্যায়িত করে। অথচ ইসলাম একটি জীবন্ত জীবন বিধান, জীবনের সকল অস্তিত্ব ও সমস্ত কর্মপরিসর ঘিরে এর আবর্তন। সমগ্র মানবতার আর্থ-সামাজিক নীতিমালার একটি পূর্ণাঙ্গ ধারাপাত ও একটি সামগ্রিক বৈশিষ্ট্যমন্ডিত সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। এমতাবস্থায় বিশ্ব মানবতাকে মুক্তির অভয়বাণী শুনাতে, স্থিতিশীল সমাজ বিনির্মাণে, শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠায় সমস্ত নব্য জাহেলিয়াতের খড়গকে মুসলিম সমাজ থেকে উৎখাত করে সমাজের সর্বস্তরে খাঁটি তাওহীদবাদী নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হবে। প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠার দ্বার উন্মোচনের। আর এর জন্য বিশ্ব মানবতার মুক্তির দূত বিশ্বনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে জীবনের সর্বক্ষেত্রে যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গ অনুসরণ করতে হবে। তাহ’লেই মুসলিম জাতি তাদের হারানো গৌরবান্বিত ইতিহাস-ঐতিহ্য ও শক্তিমত্তা পুনরায় ফিরে পাবে। অর্জন করবে বিশ্ব পরিচালনার নেতৃত্ব। মানুষের আইনের পরিবর্তে আল্লাহর আইনই হবে মানবজীবন পরিচালনার মূল ভিত্তি। যা ইসলামী খেলাফতের মৌলিক বক্তব্য। শান্তি, স্বস্তি ও নিরাপত্তা হবে জীবন পরিচালনার মূল চালিকাশক্তি। যার ওয়াদা আল্লাহ মুমিন বান্দাদের জন্য নির্দিষ্ট করেছেন। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন। আমীন!
লেখক : কেন্দ্রীয় সহ-পরিচালক, সোনামণি।