নি শা ন -ব র দা র
ফররুখ আহমদ
আমি গাহি তারি গান
কাজী নজরুল ইসলাম
আমি গাহি তারি গান----
দৃপ্ত-দম্ভের রে-যৌবন আজি ধরি অসি খরসান
হইল বাহির অসম্ভবের অভিযানে দিকে দিকে।
লক্ষ যুগের প্রাচীন মমির পিরামিডে গেল লিখে
তাদের ভাঙ্গার ইতিহাস-লেখ! যাহাদের নিঃশ্বাসে
জীর্ণ পুঁথির শুষ্ক পত্র উড়ে গেল এক পাশে!
যারা ভেঙ্গে চলে অপ-দেবতার মন্দির আস্তানা,
বক-ধার্মিক নীতি-বৃদ্ধের সনাতন তাড়ি-খানা।
যাহাদের প্রাণ-স্রোতে ভেসে গেল পুরাতন জঞ্জাল,
সংস্কারের জগদল-শিলা, শাস্ত্রের কঙ্কাল।
মিথ্যা মোহের পূজা-মন্ডপে যাহারা অকুতোভয়ে
এল নির্মম---মোহ মুদ্গর ভাঙ্গেনের গদা লয়ে।
বিধি-নিষেধের চীনের প্রাচীরে অসীম দুঃসাহসে,
দু’হাতে চালাল হাতুড়ি শাবল! গোরস্থানে চষে
ছুঁড়ে ফেলে যত সব কঙ্কাল বসাল ফুলের মেলা,
যাহাদের ভিড়ে মুখর আজিকে জীবনের বালু-বেলা।
গাহি তাহাদের গান
বিশ্বের সাথে জীবনের পথে যারা আজি আগুয়ান।---
--- সেদিন নিশীথ-বেলা
দুস্তর পারাবারে যে যাত্রী একাকী ভাসালো ভেলা,
প্রভাতে সে আর ফিরিল না কুলে। সেই দুরন্ত লাগি
আঁখি মুছি আর রচি গান আমি আজিও নিশীথে জাগি
আজো বিনিদ্র গাহি গান আমি চেয়ে তারি পথ-পানে।
ফিরিল না প্রাতে যে-জন সে-রাতে উড়িল আকাশ-যানে
নব জগতের দূর-সন্ধানী অসীমের পথ-চারী,
যার ভয়ে জাগে সদা-সতর্ক মৃত্যু-দুয়ারে দ্বারী!
সাগর গর্ভে, নিঃসীম নভে, দিগদিগন্ত জুড়ে
জীবনোদ্বেগ, তাড়া করে ফেরে নিতি যারা মৃত্যুরে,
মানিক আহরি আনে যারা খুঁড়ি পাতাল যক্ষলপুরী,
নাগিনীর বিষ-জ্বালা সয়ে করে ফণা হ’তে মণি চুরি।
হানিয়া বজ্র-পানির বজ্র উদ্ধত শিরে ধরি,
যাহারা চপলা মেঘ-কন্যারে করিয়াছে কিঙ্কারী!
পবন যাদের ব্যজনী দুলায় হইয়া আজ্ঞাবাহী---
এসেছি তাদের জানাতে প্রণাম তাহাদের গান গাহি!
গুঞ্জরি ফেরে ক্রন্দন মোর তাকে নিখিল ব্যেপে---
ফাঁসির রজ্জু ক্লান্ত আজিকে যাহাদের টুঁটি চেপে!
যাহাদের কারাবাসে
অতীত রাতের বন্দিনী ঊষা ঘুম টুঁটি ঐ হাসে!
গাহি তাহাদের গান----
ধরণীর হাতে দিল যারা আনি ফসলের ফরমান।
শ্রম-কিণাঙ্ক-কঠিন যাদের নির্দয় মুঠি-তলে
ত্রস্তা ধরণীর নজ্রানা দেয় ডালি ভরে ফুলে ফুলে!
বন্য-শ্বাপদ-শঙ্কুল জরা মৃত্যু ভীষণা ধরা
যাদের শাসনে হ’ল সুন্দর কুসুমিতা মনোহরা!
যারা বর্বর হেথা বাঁধে ঘর পরম অকুতোভয়ে
বনের ব্যাঘ্র মরুর সিংহ বিবরের ফণী লয়ে!
এল দুর্জয় গতি-বেগ সম যারা যাযাবর শিশু
তারাই গাহিল নব প্রেম গান ধরণী-মেরীর যিশু
যাহাদের চলে লেগে
উল্কার মত ঘুরিছে ধরণী শূন্যে অমিত বেগে!
খেয়াল-খুশিতে কাটি অরণ্য রচিয়া অমরাবতী
যাহারা করিল ধ্বংস সাধন পুনঃ চঞ্চলমতি,
জীবন-আবেগ রুধিতে না পারি যারা উদ্ধত-শির
লঙ্ঘিতে গেল হিমালয় গেল শুষিতে সিন্ধু-নীর!
নবীন জগত সন্ধানে যারা ছুটে মেরু-অভিযানে,
পক্ষ বাঁধিয়ে উড়িয়া চলেছে যাহারা ঊর্ধ্ব পানে!
তবুও থামে না যৌবন-বেগ জীবনের উলস্নাসে
চলেছে চন্দ্র মঙ্গল-গ্রহে স্বর্গে অসীমাকাশে।
যারা জীবনের পসরা বহিয়া মৃত্যুর দ্বারে দ্বারে
করিতেছি ফিরি, ভীম রণবুমে প্রাণ বাজি রেখে হারে।
আমি মোর-কবি-গাহি সেই বেদে বেদুঈনদের গান,
যুগে যুগে যারা করে অকারণ বিপ্লব-অভিযান।
জীবনের আতিশয্যে যাহারা দারুন উগ্রসুখে
সাধ করে নিল গরল-পিয়ালা, বর্শা হানিল বুকে।
আষাঢ়ের গিরি-নিঃস্রাব সম কোন বাধা মানিল না,
বর্বর বলি যাহাদের গালি পড়িল ক্ষলুদ্রমনে,
কূপ-মন্ডুক ‘অসংযমী’র আখ্যা দিয়াছে যারে,
তারি তবে ভাই গান রচে যাই বন্দনা করি তারে!
---০০---