শাহাদাতাইন-এর শর্ত সমূহ (পূর্বে প্রকাশিতের পর)
খায়রুল ইসলাম
মুযাফফর বিন মুহসিন 2211 বার পঠিত
ভূমিকা :
আক্বীদা বা বিশ্বাস মানুষের মূল সম্পদ। বিশুদ্ধ আক্বীদা ছাড়া আমলের কোন মূল্য নেই। অথচ সমাজে ইসলামের নামে এমন অসংখ্য ভ্রান্ত আক্বীদা প্রচলিত আছে, যার দ্বারা ঈমান নষ্ট হওয়া খুবই স্বাভাবিক। এ জন্য তাদের ইবাদত কবুল হওয়ার কোনই সম্ভাবনা নেই। তাই নিম্নে কতিপয় ভ্রান্ত আক্বীদা ও তার সঠিক দিক তুলে ধরা হল :
(১) আল্লাহ নিরাকার :
সমাজে প্রচলিত আছে যে, আল্লাহ নিরাকার। অধিকাংশ মানুষ এই আক্বীদায় বিশ্বাসী। অধিকাংশ আলেম এর পক্ষে জোর প্রচারণা চালান।
পর্যালোচনা :
আল্লাহ তা‘আলা নিরাকার নন, তাঁর আকার আছে। তিনি শুনেন, দেখেন এবং কথা বলেন। তাঁর হাত, পা, চেহারা, চোখ ইত্যাদি আছে। তবে তাঁর সাথে সৃষ্টির কোন কিছুই তুলনীয় নয়। আল্লাহ বলেন,لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَهُوَ السَّمِيْعُ الْبَصِيْرُ ‘কোন কিছুই তাঁর সদৃশ নয়, তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা’ (শূরা ১১)। সুতরাং তাঁর আকারের সাথে কোন কিছুর আকারের তুলনা করা যাবে না। যেমন আল্লাহ নিজেই বলেন, فَلَا تَضْرِبُوْا لِلَّهِ الْأَمْثَالَ ‘সুতরাং তোমরা আল্লাহর কোন সাদৃশ্য বর্ণনা করো না’ (নাহল ৭৪)।
অতএব আল্লাহর আকার আছে। তবে কোন কিছুর সাথে তা তুলনীয় নয়। কুরআন ও ছহীহ হাদীছে তাঁর আকৃতি সম্পর্কে যা বলা হয়েছে, তার কোন রূপক বা বিকৃত অর্থ করা যাবে না। বরং বলতে হবে তিনি তাঁর মত। নিম্নে কিছু উদাহরণ দেয়া হল :
(ক) আল্লাহর হাত :
(এক) আল্লাহ তা‘আলা ইহুদীদের বক্তব্য এভাবে তুলে ধরেছেন,
وَقَالَتِ الْيَهُوْدُ يَدُ اللهِ مَغْلُوْلَةٌ غُلَّتْ أَيْدِيْهِمْ وَلُعِنُوْا بِمَا قَالُوْا بَلْ يَدَاهُ مَبْسُوْطَتَانِ.
‘আর ইহুদীরা বলে, আল্লাহর হাত বন্ধ হয়ে গেছে। তাদের হাতই বন্ধ হয়ে গেছে এবং তাদের এ উক্তির কারণে তাদের উপর অভিশাপ করা হয়েছে; বরং তাঁর (আল্লাহর) দুই হাতই প্রসারিত’ (মায়েদাহ ৬৪)।
(দুই) অন্যত্র তিনি বলেন, تَبَارَكَ الَّذِىْ بِيَدِهِ الْمُلْكُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيْرٌ ‘বরকতময় তিনি, যাঁর হাতে সর্বময় কর্তৃত্ব, তিনি সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান’ (মুলক ১)।
(তিন) আল্লাহ বলেন,يَا إِبْلِيْسُ مَا مَنَعَكَ أَنْ تَسْجُدَ لِمَا خَلَقْتُ بِيَدَيَّ ‘হে ইবলীস! আমি যাকে আমার দুই হাত দ্বারা সৃষ্টি করলাম, তাকে সিজদা করতে তোমাকে কিসে বাধা দিল? (ছোয়াদ ৭৫)।
(চার) তিনি আরো বলেন,
وَمَا قَدَرُوا اللَّهَ حَقَّ قَدْرِهِ وَالْأَرْضُ جَمِيْعًا قَبْضَتُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَالسَّمَاوَاتُ مَطْوِيَّاتٌ بِيَمِيْنِهِ.
‘তারা আল্লাহর উপযুক্ত সম্মান করে না। ক্বিয়ামতের দিন গোটা পৃথিবী থাকবে তাঁর হাতের মুঠোয় এবং আকাশ সমূহ ভাঁজ করা অবস্থায় থাকবে তাঁর ডান হাতে’ (যুমার ৬৭)।
(পাঁচ) আল্লাহ তা‘আলা বলেন, يَدُ اللهِ فَوْقَ أَيْدِيْهِمْ ‘আল্লাহর হাত তাদের হাতের উপর’ (ফাতহ ১০)।
পবিত্র কুরআনে উক্ত মর্মে আরো অনেক আয়াত আছে। তাছাড়া রাসূল (ছাঃ)ও বহু স্থানে আল্লাহর হাতের কথা বর্ণনা করেছেন।
(ছয়) রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,
إِنَّ اللهَ تَعَالَى يَبْسُطُ يَدَهُ بِاللَّيْلِ لَيِتُوْبَ مُسِئُ النَّهَارِ وَيَبْسُطُ يَدَهُ بِالنَّهَارِ لِيَتُوْبَ مُسِئُ اللَّيْلِ حَتَّى تَطْلُعَ الشَّمْسُ مِنْ مَغْرِبِهَا.
‘আল্লাহ তা‘আলা রাত্রে তাঁর হাত প্রসারিত করে রাখেন, যাতে দিনে পাপকারী তওবা করে। তিনি দিনে তাঁর হাত প্রসারিত করে রাখেন, যাতে রাতে পাপকারী তওবা করে। পশ্চিম দিকে সূর্যোদয় না হওয়া পর্যন্ত অর্থাৎ ক্বিয়ামত পর্যন্ত এটা তিনি জারী রাখবেন।[1]
(সাত) অন্যত্র তিনি বলেন,
مَنْ تَصَدَّقَ بِعَدْلِ تَمْرَةٍ مِّنْ كَسْبٍ طَيِّبٍ وَلاَيَقْبَلُ اللهُ إِلاَّ الطَّيِّبَ وَإِنَّ اللهَ يَتَقَبَّلُهَا بِيَمِيْنِهِ ثُمَّ يُرَبِّيْهَا لِصَاحِبِهِ كَمَا يُرَبِّيْ أَحَدُكُمْ فَلُوَّهُ حَتَّى تَكُوْنَ مِثْلَ الْجَبَلِ.
‘যে ব্যক্তি তার হালাল রোযগার থেকে একটি খেজুর পরিমাণ দান করবে-কারণ আল্লাহ হালাল বস্ত্ত বৈ কোন কিছুই কবুল করেন না, আল্লাহ তা তাঁর ডান হাতে গ্রহণ করবেন। অতঃপর দানকারীর জন্য তা প্রতিপালন করতে থাকেন যেরূপ তোমাদের কেউ তার ঘোড়ার বাচ্চাকে লালন-পালন করে বড় করে থাকে। অবশেষে তা পাহাড় সমতুল্য হয়ে যায়’।[2] উল্লেখ্য যে, উক্ত মর্মে আরো অনেক হাদীছ বর্ণিত হয়েছে।[3]
(খ) আল্লাহর পা :
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, يَوْمَ يُكْشَفُ عَنْ سَاقٍ وَّيُدْعَوْنَ إِلَى السُّجُوْدِ فَلاَيَسْتَطِيْعُوْنَ ‘সেদিন পায়ের নলা উন্মোচিত করা হবে এবং তাদেরকে (কাফেরদেরকে) সিজদা করার জন্য আহবান করা হবে। কিন্তু তারা সিজদা করতে সক্ষম হবে না’ (ক্বলম ৪২)। রাসূল (ছাঃ) বলেন,
يَكْشِفُ رَبُّنَا عَنْ سَاقٍ فَيَسْجُدُ لَهُ كُلُّ مُؤْمِنٍ وَّمُؤْمِنَةٍ فَيَبْقَى كُلُّ مَنْ كَانَ يَسْجُدُ فِى الدُّنْيَا رِيَاءً وَّسُمْعَةً فَيَذْهَبُ لِيَسْجُدَ فَيَعُوْدُ ظَهْرُهُ طَبَقًا وَّاحِدًا.
‘(ক্বিয়ামতের দিন) আমাদের প্রভু পায়ের নলা উন্মুক্ত করে দিবেন। অতঃপর সকল মুমিন পুরুষ ও নারী তাঁকে সিজদা করবে। কিন্তু বাকী থাকবে ঐ সমস্ত লোক, যারা দুনিয়ায় সিজদা করত লোক দেখানো ও প্রচারের জন্য। তারা সিজদা করার জন্য যাবে, কিন্তু তাদের পৃষ্ঠদেশ একখন্ড তক্তার মত শক্ত হয়ে যাবে’।[4] আল্লাহর পা সম্পর্কে রাসূল (ছাঃ) বলেন,
لاَيَزَالُ يُلْقَى فِيْهَا وَتَقُوْلُ هَلْ مِنْ مَّزِيْدٍ حَتَّى يَضَعَ فِيْهَا رَبُّ الْعَالَمِيْنَ قَدَمَهُ فَيَنْزَوِىْ بَعْضُهَا إِلَى بَعْضٍ ثُمَّ تَقُوْلُ قَدْ قَدْ بِعِزَّتِكَ وَكَرَمِكَ.
‘জাহান্নামে (জাহান্নামীদের) নিক্ষেপ করা হতে থাকবে আর সে (জাহান্নাম) বলবে, আরো আছে কি? শেষ পর্যন্ত জগৎ সমূহের প্রতিপালক তাতে পা রাখবেন। ফলে জাহান্নামের একাংশ আরেকাংশের সাথে মিশে যাবে। অতঃপর জাহান্নাম বলবে, আপনার প্রতিপত্তি ও মর্যাদার শপথ! যথেষ্ট হয়েছে, যথেষ্ট হয়েছে’।[5]
(গ) আল্লাহর চোখ :
আল্লাহ তা‘আলা মূসা (আঃ)-কে বলেন, وَأَلْقَيْتُ عَلَيْكَ مَحَبَّةً مِنِّىْ وَلِتُصْنَعَ عَلَى عَيْنِيْ ‘আমি আমার পক্ষ থেকে তোমার প্রতি ভালবাসা ঢেলে দিয়েছিলাম, যাতে তুমি আমার চোখের সামনে প্রতিপালিত হও’ (ত্বো-হা ৩৯)। রাসূল (ছাঃ) বলেন, إِنَّ اللهَ لَيْسَ بِأَعْوَرَ أَلاَ إِنَّ الْمَسِيْحَ الدَّجَّالَ أَعْوَرُ الْعَيْنِ الْيُمْنَى كَأَنَّ عَيْنَهُ عِنَبَةٌ طَافِيَةٌ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ অন্ধ নন। সাবধান! দাজ্জালের ডান চোখ কানা। তার চোখটা যেন ফুলে যাওয়া একটি আঙ্গুরের মত’।[6]
(ঘ) আল্লাহর চেহারা :
আল্লাহ বলেন, فَأَيْنَمَا تُوَلُّوْا فَثَمَّ وَجْهُ اللهِ ‘তোমরা যে দিকেই মুখ ফিরাও সে দিকেই আল্লাহর চেহারা রয়েছে’ (বাক্বারাহ ১১৫)। অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, كُلُّ مَنْ عَلَيْهَا فَانٍ وَّيَبْقَى وَجْهُ رَبِّكَ ذُوا الْجَلاَلِ وَالْإِكْرَامِ ‘ভূ-পৃষ্ঠের সবকিছুই ধ্বংসশীল। একমাত্র আপনার মহিমাময় ও মহানুভব পালনকর্তার চেহারা ব্যতীত’ (আর-রহমান ২৬-২৭)।
(ঙ) আল্লাহর কথা ও সাক্ষাৎ :
আল্লাহ তা‘আলা মূসা (আঃ)-এর সাথে কথা বলেছেন, وَكَلَّمَ اللَّهُ مُوسَى تَكْلِيمًا ‘আর আল্লাহ মূসার সাথে কথা বলেছেন’ (নিসা ১৬৪)। অন্যত্র বলেন,وَلَمَّا جَاءَ مُوْسَى لِمِيْقَاتِنَا وَكَلَّمَهُ رَبُّهُ قَالَ رَبِّ أَرِنِىْ أَنْظُرْ إِلَيْكَ، قَالَ لَنْ تَرَاِنِىْ ‘মূসা যখন আমার নির্ধারিত সময়ে উপস্থিত হল, তখন তাঁর প্রতিপালক তাঁর সাথে কথা বললেন। তিনি তখন বললেন, হে আমার প্রতিপালক! আমাকে দর্শন দিন, আমি আপনাকে দেখব। তখন আল্লাহ বললেন, তুমি আমাকে আদৌ দেখতে পাবে না’ (আ‘রাফ ১৪৩)। হাদীছেও এ মর্মে অনেক দলীল রয়েছে।[7]
অপব্যাখ্যা ও তার পর্যালোচনা :
কিছু বাতিল ফের্কা এবং আক্বীদাভ্রষ্ট কিছু মুফাস্সির আল্লাহর হাত, পা, চোখ, চেহারা ইত্যাদির রূপক অর্থ করেছেন। আল্লাহর হাত বলতে, ‘কুদরত’ ও নে‘মত’ বুঝানো হয়েছে। আল্লাহর চেহারা বলতে ‘সত্তা’ ইত্যাদি অর্থ করা হয়েছে।[8] যামাখশারী (৪৬৭-৫৩৮হিঃ) সূরা ফাত্হর ১০ নং আয়াতের অর্থ করেছেন, يُرِيْدُ أَنَّ يَدَ رَسُوْلِ اللهِ الَّتِىْ تَعْلُوْ أَيْدِى الْمُبَايِعِيْنَ هِىَ يَدُ اللهِ وَاللهُ تَعَالَى مُنَزِّهٌ عَنِ الْجَوَارِحِ وَعَنْ صِفَاتِ الْأَجْسَامِ ‘তিনি ইচ্ছা করেছেন রাসূল (ছাঃ)-এর হাত বায়‘আতকারীদের হাতগুলোর উপর থাকবে। আর সেটাই আল্লাহর হাত। কারণ আল্লাহ তা‘আলা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এবং শরীরের আকৃতি থেকে মুক্ত’।[9] তিনি প্রথমাংশে সঠিক উদ্দেশ্য বর্ণনা করেছেন। কিন্তু পরের অংশে আল্লাহকে নিরাকার সাব্যস্ত করেছেন। অনুরূপ অর্থ করেছেন আবুল বারাকাত আন-নাসাফী।[10] তাফসীরে বায়যাভীতেও রূপক অর্থ করা হয়েছে।[11] এধরনের রূপক অর্থ করা আদৌ ঠিক নয়।
দ্বিতীয়ত : উক্ত শব্দগুলোর রূপক অর্থ করা হলে মূল অর্থের সাথে মিলবে না। যেমন- সূরা মায়েদার ৬৪ ও সূরা ছোয়াদের ৭৫ নং আয়াতে ‘দুই হাত’ বলা হয়েছে। হাতের রূপক অর্থ ‘কুদরত’ বা ‘শক্তি’ করলে কখনো দ্বিবচন করা যাবে না।
সুধী পাঠক! আল্লাহর পরিচয় যখন আল্লাহ নিজেই ব্যক্ত করেছেন, তখন তার রূপক অর্থের প্রশ্নই আসে না। উক্ত আয়াতগুলো দ্বারা রাসূল (ছাঃ) এবং ছাহাবী-তাবেঈগণ তথা সালাফীগণ যা অর্থ নিয়েছেন, আমাদেরকেও সেই অর্থ নিতে হবে। তারা কখনো এ ধরনের বিকৃত অর্থ করেননি। মূল কথা হল, তাফসীরে কাশ্শাফ, বায়যাভী, জালালাইন, মাদারেকুত তানযীল, মা‘আরেফুল কুরআন ইত্যাদি তাফসীরে এ ধরনের রূপক অর্থ করা আছে। আর উপমহাদেশের সমস্ত মাদরাসায় উক্ত তাফসীরগুলোই পড়ানো হয়। ফলে উক্ত ভ্রান্ত আক্বীদার প্রচলন ঘটেছে। কিন্তু ছহীহ আক্বীদা সম্পন্ন শ্রেষ্ঠ তাফসীর হিসাবে পরিচিত তাফসীরে ইবনে আববাস, তাফসীরে তাবারী, ইবনে কাছীর, কুরতুবী, ফাৎহুল ক্বাদীর প্রভৃতি তাফসীর বিশ্বের অন্যান্য মুসলিম দেশে সমধিক পরিচিত হলেও উপমহাদেশে সেগুলোর কোন গুরুত্ব নেই। একশ্রেণীর মাযহাবী আলেমের কারণেই এই মর্মান্তিক পরিণতি হয়েছে। ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) আরো বলেন,
وَلَهُ يَدٌ وَوَجْهٌ وَنَفْسٌ كَمَا ذَكَرَهُ اللهُ تَعَالَى فِى الْقُرْآنِ فَمَا ذَكَرَهُ اللهُ تَعَالَى فِى الْقُرْآنِ مِنْ ذِكْرِ الْوَجْهِ وَالْيَدِ وَالنَّفْسِ فَهُوَ لَهُ صِفَاتٌ بِلاَ كَيْفٍ وَلاَ يُقَالُ إِنَّ يَدَهُ قُدْرَتُهْ أَوْ نِعْمَتُهُ لِأَنَّ فِيْهِ إِبْطَالُ الصِّفَةِ وَهُوَ قَوْلُ أَهْلِ الْقَدْرِ وَالْاِعْتِزَالِ وَلَكِنَّ يَدَهُ صِفَتُهُ بِلاَ كَيْفٍ وَغَضَبَهُ وَرِضَاهُ صِفَتَانِ مِنْ صِفَاتِ اللهِ تَعَالَى بِلاَ كَيْفٍ.
‘তাঁর (আল্লাহর) হাত, মুখমন্ডল এবং নফস রয়েছে। যেমন পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা‘আলা উল্লেখ করেছেন। কুরআনে আল্লাহ তাঁর মুখমন্ডল, হাত ও নফসের যে কথা উল্লেখ করেছেন সেগুলো তাঁর গুণ। কিন্তু কারো সাথে সেগুলোর সাদৃশ্য নেই। আর একথা বলা যাবে না যে, তাঁর হাত অর্থ তাঁর ‘কুদরত’ বা ‘নে‘মত’। কারণ এতে আল্লাহর গুণকে বাতিল সাব্যস্ত করা হয়। আর এটা ক্বাদারিয়া ও মু‘তাযিলাদের বক্তব্য। বরং কারো হাতের সাথে সাদৃশ্য ছাড়াই তাঁর হাত তাঁর গুণ। আর আল্লাহর রাগ ও সন্তুষ্টি কারো রাগ ও সন্তুষ্টির সাথে সাদৃশ্য ছাড়াই তাঁর দু’টি ছিফাত বা গুণ।[12]
সুধী পাঠক! আল্লাহ্কে নিরাকার সাব্যস্ত করার অর্থই হল তাঁর মর্যাদাকে ক্ষুণ্ণ করা। তাঁর হাত, পা, চোখ, চেহারা আছে, তিনি কথা বলেন, শুনেন, দেখেন বলে নিজের পরিচয় নিজেই দিয়েছেন অথচ তাঁকে অস্তিত্বহীন প্রমাণ করার হীন চেষ্টা করা হয়। এটা মহান আল্লাহ সম্পর্কে চরম বাড়াবাড়ি।
(২) আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমান :
আল্লাহ সব জায়গায় অবস্থান করেন, তিনি প্রত্যেক মানুষের মাঝে বিরাজমান এই ভ্রান্ত আক্বীদা অধিকাংশ মানুষের মাঝে প্রচলিত।
পর্যালোচনা : পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে উক্ত বিশ্বাস সঠিক নয়। বরং আল্লাহ আরশে সমুন্নীত। আল্লাহ তাঁর পরিচয় দিয়ে বলেন, الرَّحْمَنُ عَلَى الْعَرْشِ اسْتَوَى ‘দয়াময় (আল্লাহ) আরশে সমুন্নীত’ (ত্ব-হা ৫)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন,
إِنَّ رَبَّكُمُ اللهُ الَّذِىْ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ فِىْ سِتَّةِ أَيَّامٍ ثُمَّ اسْتَوَى عَلَى الْعَرْشِ.
‘নিশ্চয়ই তোমাদের প্রতিপালক হচ্ছেন সেই আল্লাহ, যিনি আসমান ও যমীনকে ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তিনি আরশে সমুন্নীত হয়েছেন’ (আ‘রাফ ৫৪)।
এছাড়া সূরা ইউনুস-৩, সূরা রা‘দ-২, সূরা ফুরক্বান-৫৯, সূরা সাজদাহ-৪, সূরা হাদীদ-৪ আয়াতসহ মোট ৭টি আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় আল্লাহ তা‘আলা আরশে সমুন্নীত। হাদীছ দ্বারাও প্রমাণিত হয় যে আল্লাহ আরশের উপর।
عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَمَّا قَضَى اللهُ الْخَلْقَ كَتَبَ فِىْ كِتَابِهِ فَهُوَ عِنْدَهُ فَوْقَ الْعَرْشِ إِنَّ رَحْمَتِىْ غَلَبَتْ غَضَبِىْ.
আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘যখন আল্লাহ মাখলূক্ব সৃষ্টির ইচ্ছা করলেন, তখন আরশের উপর তাঁর কাছে রক্ষিত এক কিতাবে লিপিবদ্ধ করেন যে, অবশ্যই আমার করুণা আমার ক্রোধের উপর জয়লাভ করেছে’।[13] আনাস বিন মালেক (রাঃ) বলেন,
كَانَتْ زَيْنَبُ تَفْخَرُ عَلَى أَزْوَاجِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ تَقُوْلُ زَوَّجَكُنَّ أَهَالِيْكُنَّ وَزَوَّجَنِى اللهُ تَعَالَى مِنْ فَوْقِ سَبْعِ سَمَاوَاتٍ.
‘যয়নব (রাঃ) নবী করীম (ছাঃ)-এর অন্যান্য স্ত্রীগণের উপর গর্ব করে বলতেন, তাঁদের বিয়ে তাঁদের পরিবার দিয়েছে, আর আমার বিয়ে দিয়েছেন স্বয়ং আল্লাহ সপ্ত আসমানের উপর থেকে’।[14]
عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ يَنْزِلُ رَبُّنَا تَبَارَكَ وَتَعَالَى كُلَّ لَيْلَةٍ إِلَى السَّمَاءِ الدُّنْيَا حِيْنَ يَبْقَى ثُلُثُ اللَّيْلِ الْآخِرُ يَقُوْلُ مَنْ يَّدْعُوْنِىْ فَأَسْتَجِيْبَ لَهُ مَنْ يَسْأَلُنِىْ فَأُعْطِيَهُ مَنْ يَسْتَغْفِرُنِىْ فَأَغْفِرَ لَهُ.
আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘প্রতি রাতের শেষ তৃতীয়াংশে মহান আল্লাহ দুনিয়ার আসমানে অবতরণ করেন এবং বলেন, কে আছ যে আমাকে ডাকবে আর আমি তার ডাকে সাড়া দিব? কে আছ যে আমার কাছে কিছু চাইবে আর আমি তাকে তা দান করব। কে আছ যে আমার কাছে ক্ষমা চাইবে আর আমি তাকে ক্ষমা করব’।[15]
আল্লাহ তা‘আলা আসমানে আছেন এটাও স্পষ্টভাবে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত। আল্লাহ বলেন,
أَأَمِنْتُمْ مَنْ فِى السَّمَاءِ أَنْ يَّخْسِفَ بِكُمُ الْأَرْضَ فَإِذَا هِيَ تَمُوْرُ، أَمْ أَمِنْتُمْ مَنْ فِى السَّمَاءِ أَنْ يُّرْسِلَ عَلَيْكُمْ حَاصِبًا فَسَتَعْلَمُوْنَ كَيْفَ نَذِيْرِ.
‘তোমরা কি (এ বিষয়ে) নিরাপদ হয়ে গেছ যে, যিনি আসমানে আছেন তিনি তোমাদের সহ ভূমিকে ধসিয়ে দিবেন না? আর তখন ওটা আকস্মিকভাবে থরথর করে কাঁপতে থাকবে। অথবা তোমরা কি নিরাপদ হয়ে গেছ যে, আসমানে যিনি রয়েছেন তিনি তোমাদের উপর পাথর বর্ষণকারী ঝঞ্ঝাবায়ু প্রেরণ করবেন না? তখন তোমরা জানতে পারবে কিরূপ ছিল আমার সতর্কবাণী’? (সূরা মুলক ১৬-১৭)। এছাড়া সূরা আলে ইমরান-৫৫ এবং নিসা-১৫৮ আয়াত দ্বারাও তাঁর আসমানে অবস্থানের কথা প্রমাণিত হয়। হাদীছেও এ ব্যাপারে স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে। মু‘আবিয়া বিন হাকাম আস-সুলামী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
كَانَتْ لِىْ جَارِيَةٌ تَرْعَى غَنَمًا لِىْ قِبَلَ أُحُدٍ وَالْجَوَّانِيَّةِ فَاطَّلَعْتُ ذَاتَ يَوْمٍ فَإِذَا الذِّئْبُ قَدْ ذَهَبَ بِشَاةٍ مِنْ غَنَمِهَا وَأَنَا رَجُلٌ مِنْ بَنِىْ آدَمَ آسَفُ كَمَا يَأْسَفُوْنَ لَكِنِّىْ صَكَكْتُهَا صَكَّةً فَأَتَيْتُ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَعَظَّمَ ذَلِكَ عَلَيَّ قُلْتُ يَا رَسُوْلَ اللهِ أَفَلاَ أُعْتِقُهَا؟ قَالَ ائْتِنِىْ بِهَا فَأَتَيْتُهُ بِهَا فَقَالَ لَهَا أَيْنَ اللهُ؟ قَالَتْ فِي السَّمَاءِ قَالَ مَنْ أَنَا؟ قَالَتْ أَنْتَ رَسُوْلُ اللهِ قَالَ أَعْتِقْهَا فَإِنَّهَا مُؤْمِنَةٌ.
‘আমার একজন দাসী ছিল। ওহুদ ও জাওয়ানিয়্যাহ নামক স্থানে সে আমার ছাগল চরাত। একদিন দেখি, নেকড়ে বাঘ একটি ছাগল ধরে নিয়ে গেছে। আমি একজন আদম সন্তান হিসাবে অনুরূপ রাগান্বিত হই যেভাবে তারা হয়। ফলে আমি তাকে এক থাপ্পড় মারি। অতঃপর রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট আসলে একে তিনি বড় অন্যায় মনে করলেন। তাই আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমি কি তাকে আযাদ করব না? তিনি বললেন, তাকে আমার নিকট নিয়ে আস। আমি তাকে রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট নিয়ে আসলাম। তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, আল্লাহ কোথায়? সে বলল, আসমানে। তিনি তাকে আবার জিজ্ঞেস করলেন, আমি কে? তখন সে বলল, আপনি আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)। তখন নবী করীম (ছাঃ) বললেন, তাকে মুক্ত করে দাও, কারণ সে একজন ঈমানদার মেয়ে’।[16]
عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرٍو قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم الرَّاحِمُوْنَ يَرْحَمُهُمُ الرَّحْمَنُ ارْحَمُوْا مَنْ فِى الأَرْضِ يَرْحَمْكُمْ مَنْ فِى السَّمَاءِ.
আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, দয়াশীল মানুষদের উপর দয়াময় আল্লাহ রহম করেন। সুতরাং তোমরা পৃথিবীবাসীর উপর দয়া কর, যিনি আসমানে আছেন তিনি তোমাদের উপর অনুগ্রহ করবেন।[17]
রাসূল (ছাঃ) আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের জন্য মি‘রাজে গিয়েছিলেন সপ্তম আসমানের উপরে এবং বার বার মূসা (আঃ)-এর নিকট থেকে আল্লাহর কাছে যাওয়ার বিষয়টি সবারই জানা।[18] আরো অনেক দলীল আছে যার মাধ্যমে প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ আরশের উপর সমুন্নীত।[19] তাছাড়া মানুষের স্বভাবজাতও প্রমাণ করে আল্লাহ উপরে আছেন। কারণ কোন বিষয়ে আল্লাহকে সাক্ষী রাখতে চাইলে মানুষ আগে উপরের দিকে হাত উঠায়। দুই হাত তুলে দু‘আ করার সময়ও মানুষের লক্ষ্য থাকে উপরের দিকে।
জাল হাদীছ ও অপব্যাখ্যা :
আল্লাহ আরশে সমুন্নীত এই ছহীহ আক্বীদাকে ভূলুণ্ঠিত করার জন্য একশ্রেণীর আক্বীদাভ্রষ্ট মহল এর অপব্যাখ্যা করেছে এবং মিথ্যা হাদীছ রচনা করেছে। এভাবে আল্লাহকে সর্বত্র বিরাজমান প্রমাণ করার অপচেষ্টা করা হয়েছে।
জাল হাদীছ সমূহ :
(ক) قَلْبُ الْمُؤْمِنِ عَرْشُ اللهِ ‘মুমিনের হৃদয় আল্লাহর আরশ’। বর্ণনাটি মিথ্যা ও উদ্ভট।[20] উক্ত ভিত্তিহীন বর্ণনার মাধ্যমে প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয় যে, আল্লাহ সব মুমিনের অন্তরে বিরাজমান। যেহেতু পবিত্র কুরআন দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে যে, আল্লাহ আরশের উপর সমুনীণত। তাই মুমিনের অন্তরকে আল্লাহর আরশ কল্পনা করা হয়েছে।
(খ) اَلْقَلْبُ بَيْتُ الرَّبِّ ‘অন্তর রবের ঘর’। এ বর্ণনাও মিথ্যা ও বাতিল।[21] উক্ত বর্ণনা দ্বারা বুঝানো হয় যে, যার অন্তর আছে তার মধ্যেই আল্লাহ আছে। সুতরাং ‘যত কল্লা তত আল্লাহ’। এভাবে সবকিছুর মধ্যেই আল্লাহর অস্তিত্ব ও উপস্থিতি সাব্যস্ত করা হয়েছে।
কুরআনের আয়াতের অপব্যাখ্যা :
(ক) وَلِلَّهِ الْمَشْرِقُ وَالْمَغْرِبُ فَأَيْنَمَا تُوَلُّوْا فَثَمَّ وَجْهُ اللَّهِ ‘আল্লাহর জন্যই পূর্ব ও পশ্চিম। সুতরাং তোমরা যে দিকেই মুখ ফিরাও সেদিকেই আল্লাহর চেহারা রয়েছে’ (বাক্বারাহ ১১৫)।
(খ) وَنَحْنُ أَقْرَبُ إِلَيْهِ مِنْ حَبْلِ الْوَرِيْدِ ‘আমি তার ঘাড়ের শাহ রগ অপেক্ষাও নিকটতর’ (ক্বাফ ১৬)। (গ) অন্যত্র আল্লাহ বলেন, وَنَحْنُ أَقْرَبُ إِلَيْهِ مِنْكُمْ وَلَكِنْ لاَّ تُبْصِرُوْنَ ‘আর আমি তোমাদের অপেক্ষা তার নিকটতর। কিন্তু তোমরা দেখতে পাও না’ (ওয়াক্বি‘আহ ৮৫)। (ঘ) অন্যত্র রয়েছে, আল্লাহ তা‘আলা মূসা ও হারূণ (আঃ)-কে লক্ষ্য করে বলেন, لاَ تَخَافَا إِنَّنِىْ مَعَكُمَا أَسْمَعُ وَأَرَى ‘তোমরা ভয় করো না, আমি তো তোমাদের সঙ্গে আছি। আমি শুনি এবং দেখি’ (ত্বো-হা ৪৬)।
(ঙ) অন্য এক আয়াতে আল্লাহ বলেন, وَهُوَ مَعَكُمْ أَيْنَ مَا كُنْتُمْ وَاللهُ بِمَا تَعْمَلُوْنَ بَصِيْرٌ ‘তোমরা যেখানেই থাক না কেন-তিনি তোমাদের সঙ্গেই আছেন। তোমরা যা কিছু কর আল্লাহ তা দেখেন’ (হাদীদ ৪)। এছাড়া আরশে অবস্থান বলতে ‘মালিক হওয়া’ ও ‘আরশ সৃষ্টির ইচ্ছা করা’ ইত্যাদি রূপক অর্থ করা হয়েছে।[22]
পর্যালোচনা :
(ক) উক্ত আয়াতগুলো পেশ করে প্রমাণ করা হয় স্বয়ং আল্লাহ সবার সাথেই আছেন। তিনি সর্বত্র বিরাজমান। যেমন- ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ প্রকাশিত কুরআনের সূরা বাক্বারার ১১৫ নং আয়াতটির অনুবাদে বলা হয়েছে, ‘যেদিকেই তোমরা মুখ ফিরাও না কেন, সেদিকই আল্লাহর দিক’।[23] আর মাসিক মদীনার সম্পাদক মাওলানা মুহিউদ্দীন খান অনূদিত মা‘রেফুল কুরআনে অনুবাদ করা হয়েছে, ‘অতএব তোমরা যেদিকেই মুখ ফেরাও, সেদিকেই আল্লাহ বিরাজমান’।[24] দুই ধরনের অর্থ পরিলক্ষিত হচ্ছে। অথচ কোনটিই সঠিক হয়নি।
মূলতঃ রাসূল (ছাঃ) এবং কতিপয় ছাহাবী ফজরের ছালাতের সময় ক্বিবলা বুঝতে না পেরে অন্য দিকে মুখ করে ছালাত আদায় করেন। তারই প্রেক্ষিতে উক্ত আয়াত নাযিল হয়।[25] অন্য হাদীছে এসেছে, রাসূল (ছাঃ) সওয়ারীর উপর নফল ছালাত আদায় করতেন। আর সওয়ারী যেদিকে ইচ্ছা সেদিকে যেত। তখন উক্ত আয়াত নাযিল হয়।[26] তাই ইবনু আববাস, মুজাহিদ প্রমুখ উক্ত আয়াত সম্পর্কে বলেন, এর উদ্দেশ্য ‘আল্লাহর ক্বিবলা’।[27]
অনুরূপভাবে সূরা ত্বো-হার ৩৯ নং আয়াতে আল্লাহর চোখের অনুবাদ করা হয়েছে ‘দৃষ্টি’।[28] যা কুরআনের আয়াতের অর্থের বিকৃতি। এভাবে প্রায় স্থানে পবিত্র কুরআনের অনুবাদ ও ব্যাখ্যায় ছাহাবীদের অর্থ ও ব্যাখ্যা গ্রহণ করা হয়নি।
(খ) অনুরূপ সূরা ক্বাফ ও ওয়াক্বি‘আর মধ্যে আল্লাহর নিকটবর্তী থাকার যে কথা এসেছে তার উদ্দেশ্য হল, ফেরেশতাদের নিকটবর্তী হওয়া। অর্থাৎ ফেরেশতারা আল্লাহর পক্ষ থেকে নিযুক্ত বলেই আল্লাহর দিকে সম্পর্কিত করা হয়েছে।[29] যেমন আল্লাহ বলেন, فَإِذَا قَرَأْنَاهُ فَاتَّبِعْ قُرْآنَهُ ‘যখন আমি উহা পাঠ করি, তখন আপনি সেই পাঠের অনুসরণ করুন’ (ক্বিয়ামাহ ১৮)। এখানে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট জিবরীল (আঃ)-এর কুরআন পাঠ উদ্দেশ্য। অথচ আল্লাহ নিজের দিকে সম্পর্কিত করেছেন। আল্লাহর নির্দেশে যেহেতু জিবরীল রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট কুরআন পাঠ করেন, সেহেতু আল্লাহ কুরআন পাঠকে নিজের দিকে সম্পর্কিত করেছেন (ঐ)।
(গ) আল্লাহ সাথে থাকার উদ্দেশ্য হল, তাঁর দৃষ্টি ও ক্ষমতা সর্বত্র থাকা। যেমন সূরা হাদীদের ৪ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় হাফেয ইবনু কাছীর (রহঃ) বলেন,
أَى رَقِيْبٌ عَلَيْكُمْ شَهِيْدٌ عَلَى أَعْمَالِكُمْ حَيْثُ أَنْتُمْ وَأَيْنَ كُنْتُمْ مِنْ بَرٍّ أَوْ بَحْرٍ فِىْ لَيْلٍ أَوْ نَهَارٍ فِى الْبُيُوْتِ أَوِ الْقَفَارِ الْجَمِيْعِ فِىْ عِلْمِهِ عَلَى السَّوَاءِ وَتَحْتَ بَصَرِهِ وَسَمْعِهِ فَيَسْمَعُ كَلاَمَكُمْ وَيَرَى مَكَانَكُمْ وَيَعْلَمُ سِرَّكُمْ وَنَجْوَاكُمْ.
‘অর্থাৎ তিনি তোমাদের উপর পর্যবেক্ষক এবং তোমরা যেখানেই থাক না কেন, তিনি তোমাদের আমলসমূহের সাক্ষী। তোমরা ভূভাগে বা সমুদ্রে, রাতে বা দিনে, বাড়িতে বা মরুভূমিতে যেখানেই অবস্থান কর না কেন, সবকিছুই সমানভাবে তাঁর জ্ঞান এবং তাঁর শ্রবণ ও দৃষ্টির মধ্যে আছে। তিনি তোমাদের কথা শোনেন, অবস্থান দেখেন এবং গোপন ও প্রকাশ্য বিষয় সম্পর্কে জানেন’।[30] হক্বপন্থী সালাফী ওলামায়ে কেরাম এটাই বুঝেছেন।
সুধী পাঠক! অসংখ্য মুসলিম ছালাত আদায় করে, ছিয়াম পালন করে, হজ্জ করে, যাকাত দেয়, ইসলামী আন্দোলন করে, দাওয়াতী কাজ করে কিন্তু আল্লাহ সম্পর্কে তাদের ধারণা ভুল। তারা অন্য দিকে যত পরিশ্রম করে আক্বীদার ক্ষেত্রে এতটুকুও করতে আগ্রহী নয়। তারা যে আল্লাহর ইবাদত করে, যে আল্লাহর কাছে সাহায্য চায় সে আল্লাহ অস্তিত্বহীন, নিরাকার। অথচ উক্ত আক্বীদার সাথে আল্লাহর গুণের দূরতম কোন সম্পর্ক নেই। মূলতঃ আল্লাহ সম্পর্কে তাদের উক্ত আক্বীদা পরস্পর বিরোধী। কারণ একদিকে তারা নিরাকার সাব্যস্ত করতে আপ্রাণ চেষ্টা করে, অন্যদিকে তাঁকে সর্বত্র বিরাজমান প্রমাণ করতে যাথাসাধ্য চেষ্টা করে। এটা কেমন নীতি? অতএব সবাইকে আল্লাহ সম্পর্কে বিশুদ্ধ আক্বীদা পোষণ করতে হবে। এক্ষেত্রে কোনরূপ অবহেলা ও অলসতা করা যাবে না। যেমন ইমাম আবু হানীফা (রহঃ)-এর মন্তব্য লক্ষণীয়।
قَالَ أَبُوْ حَنِيفَةَ عَمَّنْ قَالَ لَا أَعْرِفُ رَبِّىْ فِي السَّمَاءِ أَمْ فِي الْأَرْضِ فَقَدْ كَفَرَ لِأَنَّ اللَّهَ يَقُوْلُ الرَّحْمَنُ عَلَى الْعَرْشِ اسْتَوَى وَعَرْشُهُ فَوْقَ سَبْعِ سَمَوَاتٍ.
‘আবু হানীফা (রহঃ) ঐ ব্যক্তি সম্পর্কে বলেন, যে বলে আল্লাহ আসমানে আছেন, না যমীনে আছেন আমি তা জানি না, সে কুফরী করবে। কারণ আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, রহমান আরশের উপর সমুন্নীত’। আর তাঁর আরশ সপ্তম আসমানের উপরে’।[31]
[1]. মুসলিম হা/৭১৬৫, ‘তওবা’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৫।
[2]. বুখারী হা/১৪১০, ‘যাকাত’ অধ্যায়।
[3]. বুখারী হা/৭৪১২; বুখারী হা/৩৩৪৮, ‘তাফসীর’ অধ্যায়; মুসলিম হা/৬৯২১, ‘তাক্বদীর’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৩।
[4]. বুখারী হা/৪৯১৯, ‘তাফসীর’ অধ্যায়।
[5]. বুখারী হা/৭৩৮৪, ২/৭১৯ পৃঃ, ‘তাওহীদ’ অধ্যায়।
[6]. বুখারী হা/৩৪৩৯, ‘নবীদের ঘটনাবলী’ অধ্যায়।
[7]. ইবনু মাজাহ হা/১৯০।
[8]. ইবনুল ক্বাইয়িম, মুখতাছার ছাওয়ায়েকুল মুরসালাহ ২/১৫৩ পৃঃ।
[9]. তাফসীরে কাশ্শাফ ৪/৩৩৭ পৃঃ, সূরা ফাতাহ ১০-এর তাফসীর দ্রঃ।
[10]. আব্দুল্লাহ বিন আহমাদ বিন মাহমূদ হাফেযুদ্দীন আবুল বারাকাত আন-নাসাফী, মাদারেকুত তানযীল ওয়া হাক্বায়েকুত তা’বীল ৩/৩৩২ পৃঃ সূরা ফাত্হ ১০-এর তাফসীর দ্রঃ ও সূরা মায়েদা ৬৪-এর ব্যাখ্যা দ্রঃ।
[11]. নাছিরুদ্দীন আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ বিন ওমর বিন মুহাম্মাদ আল-বায়যাভী, আনওয়ারুত তানযীল ও আসরারুত তা’বীল ২/৯২ পৃঃ, সূরা আল-মায়েদা ৬৪-এর ব্যাখ্যা দ্রঃ।- أي هو ممسك يقتر بالرزق وغل اليد وبسطها مجاز عن البخل والجود ولا قصد فيه إلى إثبات يد وغل وبسط
[12]. আল-ফিক্বহুল আকবার, পৃঃ ৬৬-৬৭।
[13]. ছহীহ বুখারী হা/৩১৯৪, ‘সৃষ্টির সূচনা’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-১; মিশকাত হা/২৩৬৪, ‘দু‘আ’ অধ্যায়, ‘আল্লাহর রহমতের প্রশস্ততা’ অনুচ্ছেদ।
[14]. বুখারী হা/৭৪২০, ‘তাওহীদ’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-২০।
[15]. বুখারী হা/১১৪৫; মুসলিম হা/৭৫৮; মিশকাত হা/১২২৩, ‘ছালাত’ অধ্যায়, ‘তাহাজ্জুদের প্রতি উৎসাহ প্রদান’ অনুচ্ছেদ।
[16]. ছহীহ মুসলিম হা/৫৩৭, ‘মসজিদ সমূহ’ অনুচ্ছেদ।
[17]. আবুদাঊদ হা/৪৯৪১; তিরমিযী হা/১৯২৪, ‘সৎ আমল ও সদাচারণ’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-১৬; মিশকাত হা/৪৯৬৯।
[18]. বুখারী হা/৩৮৮৭, ‘মর্যাদা’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৪২।
[19]. বুখারী হা/৪৩৫১, ‘মাগাযী’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৬১; মুসলিম হা/২৫০০, ‘যাকাত’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৪৮; ছহীহ মুসলিম হা/১২১৮ ‘হজ্জ’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-১৯; মুত্তাফাক্ব আলাইহ; মিশকাত হা/৫৮৬২।
[20]. কাশফুল খাফা হা/১৮৮৬; ইমাম ছাগানী, আল-মাওযূ‘আত হা/৭০।
[21]. আব্দুর রহমান সাখাবী, আল-মাক্বাছিদুল হাসানাহ হা/৭৭৬, পৃঃ ৪৯২; মোল্লা আলী ক্বারী, আল-মাছনূ ফী মা‘রেফাতিল হাদীছিল মাওযূ হা/২১৭, পৃঃ ১৩১; কাশফুল খাফা হা/১৮৮৪ ও ১৮৮৫।
[22]. ইবনুল ক্বাইয়িম, মুখতাছার ছাওয়ায়েকুল মুরসালাহ ২/১৫৩ পৃঃ।
[23]. আল-কুআনুল করীম (ঢাকা : ইফাবা, জুন ১৯৯৮), পৃঃ ২৯।
[24]. মুফতী মুহাম্মদ শাফী, অনুবাদ ও সম্পাদনা : মাওলানা মুহিউদ্দীন খান, তাফসীর মাআরেফুল ক্বোরআন (সঊদী আরব : খাদেমুল হারামাইন বাদশাহ ফাহদ, কোরআন মুদ্রণ প্রকল্প, তাবি), পৃঃ ৫৫।
[25]. তিরমিযী হা/৩৪৫, ‘ছালাত’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-১৪৫; ইবনু মাজাহ হা/১০২০।
[26]. ছহীহ মুসলিম হা/১৬৪৪ ও ১৬৪৬, ‘মুসাফিরের ছালাত’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৪।
[27]. তিরমিযী হা/২৯৫৮, ‘তাফসীর’ অধ্যায়, সূরা বাক্বারা ১১৫; তাফসীরে ইবনে কাছীর ১/৩৯১ পৃঃ; ফাতাওয়া লাজনা দায়েমাহ ২/৩৬০।
[28]. মাআরেফুল কুরআন পৃঃ ৮৫১।
[29].শায়খ উছায়মীন, আল-কাওয়াইদুল মুছলা ফী ছিফাতিল্লাহি ওয়া আসমায়িহিল হুসনা, পৃঃ ৭০-৭১।
[30]. তাফসীর ইবনে কাছীর, ৭ম খ-, পৃঃ ৫৬০।
[31]. ইবনু তায়মিয়াহ, মাজমূঊ ফাতাওয়া ৫/৪৭ পৃঃ।