কুরবানী : করণীয় ও বর্জনীয়
আব্দুর রহীম
আযীযুর রহমান 2777 বার পঠিত
মুখবন্ধ :
মানব জীবনের সূচনালগ্নে একজন মানুষকে শিশু বলা হয়। আমরা প্রত্যেকে এক সময় শিশু ছিলাম। শিশু-কিশোর বলতে আমরা বুঝি বয়সের স্বল্পতার কারণে যাদের দেহ, মন ও মগজ পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হয়নি। আজকের শিশু আগামী প্রজন্মের নাগরিক। আজ যারা ছোট, কাল তারা হবে বড়। ভবিষ্যতে তারাই হবে সমাজ ও রাষ্ট্রের কর্ণধার। একজন মানব শিশু যখন কথা বলতে পারে না, নিজে খেতে পারে না, নিজের পায়ে চলতে পারে না, নিজের ভাল-মন্দ বুঝে না সে সময় থেকে শুরু করে কিশোর বয়স পর্যন্ত তাদের প্রতি ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, সাংগঠনিক এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে কিছু হক্ব বা অধিকার রয়েছে, এটাই শিশু-কিশোরদের অধিকার। অন্যদিকে সোনামণিরা যাতে মনে-প্রাণে কষ্ট না পায়, বুদ্ধিতে বাঁধাপ্রাপ্ত না হয়, দেহের বৃদ্ধি ও মেধা বিকাশে বিঘ্ন সৃষ্টি না হয়-এরূপ আচরণ করার নামই ‘সোনামণি অধিকার’। তাই আজকের শিশু-কিশোরেরা অনাদর ও অবহেলায় অধিকার বঞ্চিত হয়ে বড় হলে ভবিষ্যতে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে নেমে আসবে চরম অশান্তি ও বিশৃংখলা। অথচ সোনামণিদের অধিকার রক্ষায় প্রায় দেড় হাযার বছর আগে মহানবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) ইসলামের সুমহান জীবনাদর্শের মধ্যে শিশু-কিশোরদের জন্য রেখে গেছেন অধিকার সম্বলিত একটি পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা। ইসলামে শিশু-কিশোরদের উপর সব ধরনের শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার এবং নির্যাতন সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। উৎসাহ দিয়েছে নিরাপদ পরিবেশে জীবন-যাপন করার। নিমেণ পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ এবং আধুনিক বিজ্ঞানের আলোকে ‘সোনামণি বা শিশুদের অধিকার’ বিষয়ে আলোচনা করার প্রয়াস পাব ইনশাআল্লাহ।
শিশু-কিশোরদের অধিকার রক্ষায় গৃহীত নীতিমালা :
সোনামণিদের অধিকার রক্ষায় ইসলামের আলোকে পরিচালিত ‘সোনামণি’ সংগঠন, ‘রাষ্ট্রীয় শিশুনীতি’ এবং ‘জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ’ স্বাধীন এই বাংলাদেশের ৫৬,০০০ বর্গমাইলের অভ্যন্তরে কাজ করে যাচ্ছে। ১৯৯০ সালের ২ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদটি আন্তর্জাতিক আইনের একটি অংশে পরিণত হয়। তৎকালীন জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র ১৯২টি রাষ্ট্রের মধ্যে ১৮৯টি রাষ্ট্র এ সনদটি অনুমোদন করে। এর মধ্যে প্রথম যে ২২টি রাষ্ট্র সনদটি অনুমোদন করে বাংলাদেশ তার অন্যতম। জাতিসংঘ এবং এর অঙ্গ সংগঠন ‘ইউনিসেফ’ (UNICEF) `United Nation Intergrated Children Emergency Fund’ শিশু অধিকার ও তাদের স্বাস্থ্য রক্ষায় বর্তমানে অত্যন্ত বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। যদিও তাদের গৃহীত নীতিমালা ইসলামের দৃষ্টিতে পূর্ণমাত্রায় উপযোগী নয়।
মমতাপূর্ণ আচরণ : প্রেক্ষিত ইসলাম
ইসলামের দৃষ্টিতে সন্তান আল্লাহর দেওয়া বিশেষ নে‘মত ও অনুগ্রহ। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, وَاللَّهُ جَعَلَ لَكُمْ مِنْ أَنْفُسِكُمْ أَزْوَاجًا وَجَعَلَ لَكُمْ مِنْ أَزْوَاجِكُمْ بَنِينَ وَحَفَدَةً وَرَزَقَكُمْ مِنَ الطَّيِّبَاتِ أَفَبِالْبَاطِلِ يُؤْمِنُونَ وَبِنِعْمَتِ اللَّهِ هُمْ يَكْفُرُونَ ‘আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন তোমাদের থেকে তোমাদের জোড়া এবং সৃষ্টি করেছেন তোমাদের জোড়া থেকে তোমাদের পুত্র ও পৌত্রদের আর রিযিক দিয়েছেন তোমাদের উত্তম বস্ত্ত থেকে। তবুও কি তারা বাতিলকে বিশ্বাস করবে এবং আল্লাহর নে‘মত অস্বীকার করবে’? (নাহল ১৬/৭২)। সুতরাং সন্তান আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে বিশ্ব মানবতার জন্য এক বিশেষ দান ও পৃথিবীর সৌন্দর্যের প্রতীক।
ইসলাম শিশু-কিশোরদের অনেক অধিকার দিয়েছে। তাদের জন্ম থেকে শুরু করে জীবন চলার পথে আরো অনেক অধিকার সেখানে স্বীকৃত। শিশু কিশোরদের প্রতি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর আচরণ ছিল অধিক মমতাপূর্ণ। তিনি স্বসেণহে ও সোহাগভরে ইসলামী সকল প্রকার আদব-কায়েদা তাদের শিক্ষা দিতেন। তিনি তাদের দেখলে খুব খুশী হতেন। তাদের নিকটে যেতেন, সালাম দিয়ে কুশল বিনিময় করতেন, খোঁজ-খবর নিতেন, মাথায় হাত বুলাতেন, কোলে নিতেন, কাঁধে উঠাতেন, আদর-সেণহ করতেন, খুব ভালবাসতেন। এমনকি চুমু খেতেন এবং দো‘আ করতেন। তাদের সাথে তিনি আকর্ষণীয়, রসাত্মক ও উপদেশমূলক কথা বলতেন। আবার কিছুটা হাসি-কৌতুকও করতেন। তিনি খাবারে তাদের অংশীদার করতেন, দৌড় প্রতিযোগিতা করাতেন। পথে দেখা হলে নিজের বাহনে চড়াতেন। ভুল করলে ক্ষমা করে সঠিক জিনিসটা বুঝিয়ে দিতেন। তিনি তাদের বকাবকি, মারপিট ও মুখে আঘাত করতে নিষেধ করেন।
ক. সোনামণিদের জন্মোত্তর অধিকার সমূহ :
ইসলাম শিশু-কিশোরদের জন্ম থেকে তাদের অধিকার রক্ষায় সোচ্চার। সোনামণিদের জন্মোত্তর অধিকার সমূহের মধ্যে নিমেণাক্ত অধিকারগুলো প্রণিধানযোগ্য :
১. কানে আযান শুনার অধিকার : সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার সাথে সাথেই তাদের পিতামাতা ও অভিভাবকদের প্রতি কতগুলি কর্তব্য রয়েছে। আবু রাফে‘ (রাঃ) বলেন,
رَأَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم أَذَّنَ فِى أُذُنِ الْحَسَنِ بْنِ عَلِىٍّ حِينَ وَلَدَتْهُ فَاطِمَةُ بِالصَّلاَةِ.
‘ফাতিমা (রাঃ) যখন হাসান ইবনে আলী (রাঃ)-কে প্রসব করলেন তখন আমি রাসূল (ছাঃ)-কে ছালাতের আযানের ন্যায় তার কানে আযান দিতে দেখলাম’।[1] তাছাড়া বাচ্চার কানের কাছে ধীরে ধীরে নিমণস্বরে যে কেউ এ আযান দিতে পারে। তবে ডান কানে আযান এবং বাম কানে ইক্বামত দেওয়ার প্রচলিত রেওয়াজ ঠিক নয়। বরং এ সম্পর্কিত হাদীছটি জাল ও বনোয়াট।[2]
(২) নবজাতকের জন্য তাহনীক করার অধিকার : তাহনীক হচ্ছে কোন আলিম বা তাক্বওয়াশীল ব্যক্তি কর্তৃক খেজুর কিংবা মধু বা মিষ্টি জাতীয় কোন বস্ত্ত চিবিয়ে স্বীয় লালা মিশ্রিত করে নবজাতক শিশুর মুখে দেওয়া। আয়েশা (রাঃ) বলেন, كَانَ يُؤْتَى بِالصِّبْيَانِ فَيُبَرِّكُ عَلَيْهِمْ وَيُحَنِّكُهُمْ. ‘রাসূল (ছাঃ)-এর কাছে নবজাতক শিশুকে নিয়ে আসা হত। তিনি তাদের জন্য কল্যাণ ও বরকতের দো‘আ করতেন এবং তাদেরকে তাহনীক করতেন’ ।[3]
(৩) ‘বিসমিল্লাহ’ বলে শিশুকে দুধ পান করানো : শিশুর আদর্শ খাবারের মধ্যে মায়ের দুধ অন্যতম। মায়ের দুধের বিকল্প ও সমকক্ষ আর কিছু নেই। তাই শিশুর শারীরিক ও মানসিক যথাযথ বিকাশের জন্য মায়ের দুধের শক্তি অন্যতম উপাদান। এক্ষেত্রে অলসতা ও অবহেলা করা কোন ক্রমেই উচিৎ নয়। মহান আল্লাহ শিশুর জন্য মায়ের দুধ পান করানোর নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন, وَالْوَالِدَاتُ يُرْضِعْنَ أَوْلَادَهُنَّ حَوْلَيْنِ كَامِلَيْنِ لِمَنْ أَرَادَ أَنْ يُتِمَّ الرَّضَاعَةَ ‘মাতাগণ তাদের সন্তানদের পূর্ণ দুই বছর দুধ পান করাবে, যারা দুধ পানের মেয়াদ পূর্ণ করতে চায়’ (বাক্বারাহ ২/২৩৩)।
শিশুকে দুধ পান করানোর সর্বোচ্চ সময়সীমা আড়াই বছর। এরপর তাকে স্বাভাবিক খাদ্য খেতে দিবে। চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মতে, মায়ের দুধ শিশুদের মেধা বিকাশে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। একজন শিশুর দুই-আড়াই বছরের জন্য অন্যতম নে‘মত হচ্ছে তার মায়ের বুকের দুধ। শিশুকে দুধ পান করানোর সময় এবং খাদ্য প্রদানের সময় বিসমিল্লাহ বলে দেয়া পিতা-মাতার কর্তব্য। হুযায়ফাহ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘শয়তান সেই খাদ্যকে নিজের জন্য হালাল করে নেয় যে খাদ্যে বিসমিল্লাহ বলা হয় না’।[4] আসুন, আমরা দুধ পান করানোর দায়িত্ব পালনে মায়েদেরকে সার্বিক সহযোগিতা করি।
(৪) সন্ধ্যার সময় শিশুকে বাড়ীর বাইরে নিয়ে যাওয়া যাবে না : সন্ধ্যার পর শিশুকে বাড়ীর বাইরে বা ছাদের উপরে নিয়ে না যাওয়া বা যেতে না দেওয়া উচিত। কারণ এ সময় শয়তান বিষাক্ত পোকা-মাকড় আহার করার জন্য বের হয় এবং শিশুদের ক্ষতি করে। জাবির (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘যখন সন্ধ্যা হয়, তখন তোমরা তোমাদের শিশুদেরকে বাড়ির বাইরে যেতে দিও না। কারণ সেই সময় শয়তান ছড়িয়ে পড়ে...।[5] অন্য বর্ণনায় আছে, وَاكْفِتُوا صِبْيَانَكُمْ عِنْدَ الْعِشَاءِ فَإِنَّ لِلْجِنِّ انْتِشَارًا وَخَطْفَةً ‘আর সন্ধ্যার সময় তোমাদের শিশুদেরকে ঘরের ভিতরে আবদ্ধ রাখ। কেননা এ সময় জিনেরা ছড়িয়ে পড়ে এবং (শিশুদের) ছিনিয়ে নেয়’।[6]
(৫) শিশুর ভাল বা উত্তম নাম রাখার অধিকার : আদম (আঃ) থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত প্রত্যেক মানুষের একটি সুনির্দিষ্ট নাম আছে। সুন্দর ও মাধুর্যপূর্ণ একটি নাম পিতা-মাতার নিকট সন্তানের একটি অধিকার। ইসলাম এ অধিকার সন্তানকে দিয়েছে। তাই রাসূল (ছাঃ) পিতা-মাতাকে সন্তানদের সুন্দর ও ভাল নাম রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। আর কেউ অপছন্দনীয় বা খারাপ নাম রাখলে রাসূল (ছাঃ) তা পরিবর্তন করে দিতেন। ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরের দিন অথবা সপ্তম দিনে নাম রাখা সুন্নাত। ইবনু ওমর (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, إِنَّ أَحَبَّ أَسْمَائِكُمْ إِلَى اللَّهِ عَبْدُ اللَّهِ وَعَبْدُ الرَّحْمَنِ ‘তোমাদের নাম সমূহের মধ্যে আল্লাহর নিকট সবচেয়ে প্রিয় নাম হচ্ছে আব্দুল্লাহ ও আব্দুর রহমান’।[7] আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) ওমর (রাঃ)-এর কন্যা আছিয়ার নাম পরিবর্তন করে জামীলা রেখেছিলেন’।[8]
(৬) সপ্তম দিনে নবজাতকের আক্বীকা করার অধিকার : সন্তান জন্মের ৭ম দিনে শিশুর অন্যতম অধিকার হল আক্বীকা করা। এটা রাসূল (ছাঃ)-এর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আদর্শ। সপ্তম দিনে ছাড়া অন্যদিনে আক্বীকা করার ছহীহ হাদীছ পাওয়া যায় না। ভেড়া, ছাগল, দুম্বা দ্বারা আক্বীকা করতে হয়। গরু বা উট দ্বারা ভাগে অথবা একটা করে আক্বীকা করার হাদীছটি যঈফ।[9] ছেলের জন্য দুটি আর মেয়ের জন্য একটি পশু যবেহ করতে হবে।[10] অবশ্য ছেলের জন্য একটি করার হাদীছও আছে।[11] আক্বীকার গোশত কুরবানীর গোশতের মত একই ভাবে বণ্টন করতে হয়।
(৭) চুলের ওযন পরিমাণ রূপা ছাদাক্বা করার অধিকার : সপ্তম দিনে আক্বীক্বা করার সময় তার মাথার চুল ফেলে দিতে হবে এবং তার সমপরিমাণ রূপা ছাদাক্বা করতে হবে। এটা তার একটা অধিকার। নবী করীম (ছাঃ) হাসানের পক্ষ থেকে একটি ছাগল আক্বীক্বা করলেন এবং বললেন, হে ফাতিমা! তার মাথাটি কামিয়ে দাও এবং চুলের ওযন পরিমাণ রূপা ছাদাক্বা করো। আলী (রাঃ) বলেন, আমরা তার চুলগুলি ওজন করলাম। তার ওজন এক দিরহাম বা তার চাইতে কিছু কম হল।[12]
(৮) খাৎনা করার অধিকার : খাৎনা করা নবীদের সুন্নাত। ইসলামে অবশ্য পালনীয় একটি যরূরী আদর্শ হচ্ছে খাৎনা করা। অমুসলিম ইসলাম গ্রহণ করলে তার জন্য খাৎনা করা এবং নাভীর নিচের লোম কামিয়ে ফেলা উচিৎ।[13] খাৎনার কোন নির্ধারিত সময় নেই। পুরুষাঙ্গের বর্ধিত চর্মের ভিতরে ময়লা জমে ব্যাকটেরিয়ার সৃষ্টি হতে পারে। এজন্য বিজ্ঞান ও স্বাস্থ্যসম্মত এবং উপকারী বলে খাৎনাকে ইসলাম আবশ্যকীয় করেছে। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, অবশ্য পালনীয় পাঁচটি বৈশিষ্ট্য বা স্বভাব রয়েছে। (১) খাৎনা করা (২) নাভীর নিচের লোম পরিষ্কার করা (৩) গোঁফ ছোট করা (৪) নখ কাটা ও (৫) বগলের লোম উপড়িয়ে খেলা।[14] ইবরাহীম (আঃ) আশি বছর বয়সে কুঠার দ্বারা খাৎনা করেছিলেন।[15] সুতরাং আমাদের সোনামণি বালকদের যথাসময়ে খাৎনার ব্যবস্থা করা পিতা-মাতা ও অভিভাবকদের দায়িত্ব ও কর্তব্য।
(৯) উত্তম পোশাকের অধিকার : ঈমান আনার পর মানুষের জন্য সর্বপ্রথম ফরয হল লজ্জাস্থান আবৃত করা বা পোশাক পরিধান করা। মানুষ ও জন্তু-জানোয়ারের মধ্যে পার্থক্য হল পোশাক। ইসলামে পুরুষ ও মহিলাদের পোশাকের ব্যাপারে পৃথক পৃথক নীতিমালা বর্ণিত হয়েছে। তাই আমাদের সোনামণিদেরকে শালীনতা যেন বজায় থাকে এমন ধরনের উত্তম পোশাক পরিধান করাতে হবে। মহান আল্লাহ বলেন, يَا بَنِي آدَمَ قَدْ أَنْزَلْنَا عَلَيْكُمْ لِبَاسًا يُوَارِي سَوْآتِكُمْ وَرِيشًا وَلِبَاسُ التَّقْوَى ذَلِكَ خَيْرٌ ذَلِكَ مِنْ آيَاتِ اللَّهِ لَعَلَّهُمْ يَذَّكَّرُونَ ‘হে আদম সন্তান! আমি তোমাদের জন্য অবতীর্ণ করেছি এমন পোশাক যা তোমাদের লজ্জাস্থানকে আবৃত করে ও অবতীর্ণ করেছি সাজ-সজ্জার পোশাক এবং পরহেযগারীর পোশাক (তাক্বওয়ার পোশাক)। এটা সর্বোত্তম (পোশাক)। আর এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ নির্দেশনা, যাতে তোমরা চিন্তা-ভাবনা কর’ (আ‘রাফ ৭/২৬)। এ আয়াতে পোশাকের ৩টি গুণের কথা বলা হয়েছে। যথা : (১) তাক্বওয়া বা পরহেযগারিতার পোশাক (২) যা লজ্জাস্থানকে আবৃত করে (৩) সাজ-সজ্জার পোশাক। এ আয়াতটি বিশ্ব মানবতার জন্য, শুধুমাত্র মুসলমানদের জন্য নয়। পোশাক আঁটসাট, ছোটখাটো ও ফিটফাট হবে না। পোশাক তুলনামূলক ঢিলেঢালা ও লম্বা হবে; যা শরীর ঢেকে রাখে ও ভদ্রতার পরিচয় দেয়। আর এ বিষয়ে পিতা-মাতাসহ অভিভাবকদের খেয়াল রাখতে হবে। অন্যদিকে মহান আল্লাহ বলেন, يَا بَنِي آدَمَ خُذُوا زِينَتَكُمْ عِنْدَ كُلِّ مَسْجِدٍ وَكُلُوا وَاشْرَبُوا وَلَا تُسْرِفُوا إِنَّهُ لَا يُحِبُّ الْمُسْرِفِينَ ‘হে আদম সন্তান! তোমরা প্রত্যেকটি ইবাদতের স্থানে (ছালাতের সময়) সুন্দর পোশাক পরিধান কর। আর খাও ও পান কর কিন্তু অপচয় করনা। কেননা আল্লাহ অপচয়কারীকে ভালবাসেন না’ (আ‘রাফ ৭/৩১)। সুতরাং পিতা-মাতা ও অভিভাবকদের দায়িত্ব ও কর্তব্য হচ্ছে রাসূল (ছাঃ)-এর নির্দেশিত পোশাক পরিধানে সোনামণিদেরকে অভ্যস্থ করে গড়ে তোলা।
উত্তম পোশাকের কতিপয় গুণাবলী নিমণরূপ :
(১) পোশাক পরিধানের শুরুতে বিসমিল্লাহ বলা। ডান দিক থেকে শুরু করা।[16] (২) ঢিলা-ঢালা, সাদা, মার্জিত ও পরিস্কার পোশাক পরিধান করা।[17] (৩) ছেলেদের জন্য রেশমী পোশাক ও স্বর্ণালংকার নিষেধ আর মেয়েদের জন্য হালাল।[18] (৪) ছেলেরা মেয়েদের পোশাক আর মেয়েরা ছেলেদের পোশাক পরিধান করবে না।[19] (৫) কাপড়ে কোন প্রাণীর ছবি থাকবে না। (৬) পোশাক টাইট ফিট ও পাতলা হবে না। (৭) পুরুষদের পোশাক গিটের উপরে থাকবে আর মেয়েদের পোশাক গিটের নীচে নামবে।[20] (৮) পোশাক খোলার সময় বিসমিল্লাহ বলবে। (৯) নতুন পোশাক পরলে দো‘আ পড়বে।
(১০) সুষম খাদ্যের অধিকার : সুস্বাস্থ্য ও রোগমুক্ত সোনামণি পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক সম্পদ। আমরা যদি সুস্থ নাগরিক, সন্তান ও কর্মী পেতে চাই তবে প্রথম থেকে সুষম ও পরিমিত খাদ্যের মাধ্যমে সোনামণিদের গড়ে তুলতে হবে। শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশ এবং সুপ্ত প্রতিভা জাগ্রত করতে শুধুমাত্র দামী খাদ্য নয়, অপেক্ষাকৃত কম মূল্যের পুষ্টিকর ও সমৃদ্ধ খাদ্যেরও প্রয়োজন। পড়াশুনা ও কাজ করতে সুস্বাস্থ্য অবশ্যই প্রয়োজন। খাদ্য হলেই যে খেতে হবে তা নয়। বরং হালাল-হারাম বিবেচনা পূর্বক খেতে হবে। শৈশব বয়স থেকেই ভাল ও সুষম খাদ্যের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। নেশা জাতীয় খাদ্য ও হারাম পানীয় এবং অতিভোজন শরীরের পক্ষে যে ক্ষতিকর সে সম্পর্কে শিশুদের সর্তক করতে হবে। সঙ্গ দোষে শিশু-কিশোর, যুবক-যুবতী এমনকি বৃদ্ধরা পর্যন্ত মাদকদ্রব্য সেবন, কোল্ড ড্রিংকিস সহ যাবতীয় নেশা জাতীয় জিনিস গ্রহণ করে থাকে। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنَّمَا الْخَمْرُ وَالْمَيْسِرُ وَالْأَنْصَابُ وَالْأَزْلَامُ رِجْسٌ مِنْ عَمَلِ الشَّيْطَانِ فَاجْتَنِبُوهُ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ ‘হে ঈমানদারগণ! মদ, জুয়া, মূর্তিপূজার বেদী ও ভাগ্য নির্ণয়ক তীর সবই ঘৃণ্য বস্ত্ত ও শয়তানী কাজ। অতএব তোমরা তা পরিহার করো। যাতে করে তোমরা সফলকাম হতে পার’ (মায়িদা ৫/৯০)। অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন, তিনি (আল্লাহ) তোমাদের জন্য মৃত প্রাণী, রক্ত, শূকরের মাংস এবং যে সকল প্রাণী আল্লাহ ব্যতীত অন্যের নামে যবেহ করা হয়, সে সকল প্রাণীর গোশত হারাম করেছেন’ (বাক্বারাহ ২/১৭৩)। ১টি আপেলের চেয়ে ১টি পিয়ারা ও টমেটোর মধ্যে ভিটামিন অনেক বেশী। ১০০ গ্রাম চিপসের টাকা দিয়ে ১ কেজি শাক বা সবজি পাওয়া যায়। সুতরাং আমরা আমাদের সন্তানের জন্য প্রাণ খুলে ব্যয় করব, কিন্তু অপব্যয় করব না। অথচ আবার ভাল ও সুষম খাদ্য খাওয়াব।
খ. সোনাণিদের বিকাশের অধিকার :
মহান আল্লাহ আমাদের সৃষ্টি করেছেন। যার ধারাবাহিকতা হল মানবাত্মা। অতঃপর মায়ের উদরে শিশু, নবজাতক হিসাবে দুনিয়াতে আগমন। তারপর শৈশব, কৈশর, যুব, পৌঢ়, বৃদ্ধ এবং অবশেষে মৃত্যু। সোনামণিদের সুস্থ বিকাশের জন্য অভিভাবক, পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রের অনেক দায়-দায়িত্ব ও করণীয় রয়েছে। বিকাশ অর্থ বর্ধন, বৃদ্ধি পাওয়া বা পরিবর্তন। অর্থাৎ ছোট থেকে আস্তে আস্তে বড় হওয়াকে বিকাশ বলে। ধাপে ধাপে বড় হওয়ার পারিবারিক ও সামাজিক পরিবেশই বিকাশ। সুস্থ, সুষ্ঠু ও মর্যাদাপূর্ণ নাগরিক পেতে হলে সোনামণিদের সুন্দর সুষ্ঠু বিকাশের প্রয়োজন। এক্ষেত্রে যে উপাদানগুলো প্রয়োজন তা হ’ল- খাদ্য, পোশাক, বাসস্থান, সুশিক্ষা ও চিকিৎসা, খেলাধূলা, বিশুদ্ধ পানি, তাজা ফলমূল ইত্যাদি যথাযথভাবে প্রদান নিশ্চিত করা। তবেই একজন সুস্থ, বুদ্ধিসম্পন্ন ও ধার্মিক মানুষ হিসাবে সোনামণিদের গড়ে তোলা সম্ভব হবে। সোনামণিদের বিকাশের অধিকারের ক্ষেত্রে ৬টি বিষয়কে প্রাধান্য দেওয়া যরূরী। যথা : (১) শারীরিক বিকাশ : বৃদ্ধি, ওজন ও শক্তি ইত্যাদির বিকাশ। (২) মানসিক বিকাশ : মনোযোগ, চিন্তাশক্তি, সহনশীলতা, সুষ্ঠু আচরণ, একাগ্রতা, সমস্যা সমাধানের শক্তি এবং আল্লাহভীতি ইত্যাদির বিকাশ। (৩) ভাষাগত বিকাশ : কথা বলার ক্ষমতা, কাজ করার ক্ষমতা, প্রশ্ন করার ক্ষমতা ইত্যাদির বিকাশ। (৪) সামাজিক বিকাশ : অন্যের সাথে মিশতে পারা, সামাজিক রীতিনীতি জানা, মানা ও শেখা, কুশল বিনিময়, দলীয় কার্যক্রমে অংশগ্রহণ, আবেগের নিয়ন্ত্রণ, সামাজিক ও নাগরিক কর্তব্য পালন, খেলাধূলায় অংশগ্রহণ ও জামা‘আতে ছালাত আদায় প্রভৃতি সামাজিক বিকাশের অন্তর্ভুক্ত। (৫) অনুভূতির বিকাশ : সুখ, দুঃখ, হাসি, কান্না, আনন্দ-বেদনা, উচ্ছ্বাস, আগ্রহ ইত্যাদির বিকাশ। (৬) নৈতিক বিকাশ : ন্যায়-অন্যায়, ভাল-মন্দ, নৈতিক-অনৈতিক, অন্যের জন্য ভাল কিছু করা, অন্যের ক্ষতি হবে এমন কাজ না করা প্রভৃতি নৈতিক বিকাশের অন্তর্ভুক্ত। অতএব সোনামণিদের সুস্থ বিকাশের জন্য, তাদের বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয় উপকরণের জন্য এবং অংশগ্রহণ ও অংশীদারিত্বের জন্য পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সুরক্ষার স্বার্থে তাদের সুষ্ঠু ও নিরাপদ বিকাশে আমাদের সকলের যথাযথ দায়িত্ব পালন করা একান্ত কর্তব্য।
গ. সোনামণিদের শিক্ষার অধিকার :
ইসলাম শিক্ষার ব্যাপারে অত্যধিক গুরুত্বারোপ করে। মহান আল্লাহ আমাদের শিক্ষার আলো স্বরূপ মহাগ্রন্থ আল-কুরআন নাযিল করেছেন। কুরআন নাযিলের প্রথম শব্দই ছিল ‘ইক্বরা’ অর্থ পড়। শিক্ষা ব্যতীত কোন জাতির উন্নতি কল্পনা করা যায় না। জাগতিক ও পারলৌকিক উভয় জগতের উন্নতি, অগ্রগতি ও সফলতার জন্য শিক্ষা একান্ত প্রয়োজন। তবে অবশ্যই ইসলামী নৈতিকতা ও আদর্শভিত্তিক শিক্ষা হতে হবে। শিক্ষা এমন এক আলো যা অজ্ঞতা ও অন্ধকারকে দূরীভূত করে, মানুষকে কল্যাণ ও সমৃদ্ধির পথ দেখায়। শৈশবকাল থেকেই পিতা-মাতা ও অভিভাবককে সোনামণিদের শিক্ষা-দীক্ষার ব্যাপারে সচেতন ও যত্নবান হতে হবে। মুসলিম মনীষী ও পন্ডিতগণ জ্ঞান-বিজ্ঞানের সকল শাখায় সফলভাবে বিচরণ করেছেন। শিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,فَاسْأَلُوا أَهْلَ الذِّكْرِ إِنْ كُنْتُمْ لَا تَعْلَمُونَ- بِالْبَيِّنَاتِ وَالزُّبُرِ ‘যদি তোমরা কোন বিষয়ে না জানো, তবে জ্ঞানীদেরকে জিজ্ঞাসা কর স্পষ্ট দলীল সহকারে’ (নাহল ১৬/৪৩)। রাসূল (ছাঃ) আরও বলেন, طَلَبُ الْعِلْمِ فَرِيضَةٌ عَلَى كُلِّ مُسْلِمٍ ‘বিদ্যার্জন করা সকল মুসলিমের জন্য ফরয’।[21]
বর্ণমালা দিয়ে শিক্ষা শুরু হয়না। বরং মায়ের উৎসাহপূর্ণ দৃষ্টি, পিতার প্রশংসনীয় শব্দ ও অনুমোদন, বোনের সহানুভূতি, ভাইয়ের সদয় সহযোগিতা; ময়দান, মাঠ কিংবা কুঞ্জবন থেকে আহরিত পাখির সাথে সোনামণির শিক্ষা হয়। শিশু-কিশোরেরা অবশ্যই অনুভব করতে, পর্যবেক্ষণ করতে কিংবা প্রভাবিত হতে শিখবে। আর এভাবে লুকিয়ে থাকা মন বিকশিত হবে এবং গ্রহণ, মগ্ন ও স্মরণ করতে প্রজ্ঞাত হবে। কেননা যে মন যতবেশী সর্তক ও সচেতন, সে মন তত সহজে ও দ্রুত অজ্ঞাত বিষয়সমূহকে শিখে নিবে। এটাই শিশুর প্রাথমিক শিক্ষার হাতে খড়ি। শিশু-কিশোরদেরকে শিক্ষা অর্জনে বিভিন্নভাবে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করতে হবে।
অন্যদিকে শিশুদেরকে শুধু কর কর এবং পড় পড় বললেই শিশু করবেনা বা পড়বেনা। এ ক্ষেত্রে পারিবারিক ও সামাজিক পরিকল্পনা ও পরিবেশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য ছালাতের গুরুত্ব অপরিসীম। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘তোমরা তোমাদের সন্তানদেরকে ৭ বছর বয়সে ছালাতের শিক্ষা দাও এবং ১০ বছর বয়সে ছালাত না পড়লে (হালকা) প্রহার কর এবং তাদের বিছানা আলাদা করে দাও’।[22] ছালাত সময়ানুবর্তিতা, পরিচ্ছন্নতা ও শৃংখলা শিক্ষা দেয়। আর এর কার্যকারিতা দীর্ঘমেয়াদী ও চিরকল্যাণকর। এ মর্মে আল্লাহ বলেন, قُلْ هَلْ يَسْتَوِي الَّذِينَ يَعْلَمُونَ وَالَّذِينَ لَا يَعْلَمُونَ ‘যারা জানে এবং যারা জানে না, তারা কি কখনও সমান হতে পারে’? (যুমার ৩৯/৯)। তিনি আরও বলেন, ‘আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে যারা জ্ঞানী, তারাই কেবলমাত্র তাকে ভয় করে’ (ফাতির ৩৫/২৮)। রাসূল (ছাঃ) বলেন, مَنْ يُرِدِ اللَّهُ بِهِ خَيْرًا يُفَقِّهْهُ فِى الدِّينِ ‘আল্লাহ যার কল্যাণ চান তাকেই কেবল দ্বীনের জ্ঞান দান করেন’।[23] আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ইসলামের আলোকে ঢেলে সাজাতে হবে। প্রয়োজনীয় কারিকুলাম ও সিলেবাস অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিতে হবে। অভিভাবকগণ শিশুদের পোশাক-পরিচ্ছদ, শিষ্টাচার, খেলাধূলা, স্কুল, মাদরাসা ও মসজিদে যাওয়াকে নিশ্চিত করবে। শিক্ষকগণ ছাত্রদেরকে আমানত মনে করবেন এবং ভারসাম্য বিধান করবেন। এক্ষেত্রে ‘সোনামণি’ সংগঠন অতিসহজে আপনার সোনামণিকে আদর-সেণহের মাধ্যমে সঠিক ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তুলবে ইনশাআল্লাহ।
ঘ. পরিচর্চা, সুরক্ষা ও রক্ষণাবেক্ষণের অধিকার : আমরা যখন বুঝতে শিখি, পড়াশুনা করি এবং নিজেদের ভাল-মন্দ নিজেরা বুঝি তখন নিজেদের নিরাপত্তা নিজেরাই গ্রহণ করতে পারি। কিন্তু একজন বৃদ্ধ ও শিশু যারা নিজেদের নিরাপত্তা নিজেরা করতে অক্ষম, তাদের ক্ষেত্রে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের ভূমিকা অধিক গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো তাদের নিরাপত্তা বিধানে বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। যথা : (১) গর্ভকালীন নিরাপত্তা (২) শৈশবকালীন শিশুদের পারিবারিক নিরাপত্তা (৩) শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাতায়াত ও অবস্থানকালীন নিরাপত্তা (৪) বয়ঃসন্ধিকালীন নিরাপত্তা (৫) পরিবেশ দূষণ থেকে নিরাপত্তা (৬) দুর্যোগকালীন নিরাপত্তা (৭) গোলমাল, মারামারি ও যুদ্ধকালীন নিরাপত্তা।
(১) গর্ভকালীন নিরাপত্তা : গর্ভকালীন নিরাপত্তা বলতে গর্ভকালীন মায়ের স্বাস্থ্যগত, খাদ্যগত এবং দাম্পত্য ও পারিবারিক নিরাপত্তাকে বুঝায়। সংক্ষেপে গর্ভবতী মায়ের পুষ্টিকর খাদ্য, সঠিক সময়ে চিকিৎসা, টিকা গ্রহণ, সঠিক সময়ে চেকআপ ইত্যাদি প্রয়োজন। উল্লেখ্য যে, শিশু জন্মের পরবর্তী অবস্থায় আতুর ঘর নামে ৬/৭ দিন নানারকম কুসংস্কার পরিলক্ষিত হয়। তাই এগুলি থেকে বিরত থাকতে হবে। বরং সর্বক্ষেত্রে ইসলামী সঠিক আদর্শ অনুসরণ করতে হবে।
(২) শৈশবকালীন শিশুদের পারিবারিক নিরাপত্তা : শিশু যখন আধো আধো কথা বলে তখন থেকে তার সাথে ভাল আচরণ করা ও শুদ্ধ কথা বলা শেখাতে হবে। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, সুবহানাল্লাহ, আল-হামদুলিল্লাহ, আল্লাহু আকবার ইত্যাদি বলা শিখাতে হবে। তাদের সামনে মিথ্যা বলা, প্রতারণা করা, গালি দেওয়া, রাগ করা বা ঝগড়া বাঁধানো উচিৎ নয়। কারণ শিশু দেখে ও শুনে শেখে। হাঁটা ও চলার সময় তার সঙ্গে থাকতে হবে। ময়লা-আবর্জনা মুখে দেওয়া থেকে, নদী, পুকুর-ডোবার পানি থেকে ও আগুন থেকে সাবধান রাখতে হবে। কারণ সামান্য অসচেতনতাই শিশুর সাময়িক ও দীর্ঘমেয়াদী সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে।
(৩) শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাতায়াতকালীন নিরাপত্তা : অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের দেশে বিদ্যালয়ে শিশুদের যাতায়াতকালীন নিরাপত্তা একেবারে অপ্রতুল। তাই পিতা-মাতাসহ অভিভাবকগণ সর্বদা দুশ্চিন্তাগ্রস্থ থাকেন। শিশু-পাচার, দৈহিক নির্যাতন, যৌন নির্যাতন প্রতিনিয়ত ঘটছেই। সুতরাং অসৎ চরিত্রের এমন ব্যক্তিদের শাস্তি অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। যা সরকার সহ প্রত্যেক সচেতন ব্যক্তির দায়িত্ব। আর এভাবেই তাদের নিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব হবে।
(৪) বয়ঃসন্ধিকালীন নিরাপত্তা : একজন শিশুর শৈশব পেরিয়ে কৈশরে পদাপর্ণ করাকে বয়ঃসন্ধিক্ষণ বলা হয়। এটা মানব জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর সময়। এ সময় সামগ্রিক ও শারীরিক পরিবর্তন ঘটে। জীবনে এক নতুনত্বের আনন্দ ও অনুভূতির জন্ম দেয়। এ সময়ে আবার পদে পদে বিপদ-আপদও আছে। তখন পরিপূর্ণ বুঝ ও বিবেচনা শক্তি থাকে না। এ সময় পিতা-মাতা সহ অভিভাবকদের তাদের প্রতি সর্বদা সর্তক দৃষ্টি রাখতে হবে। এক্ষেত্রে ইসলামী মূল্যবোধ ও সামাজিক সচেতনতাই নিরাপত্তা দিতে পারে।
(৫) পরিবেশগত নিরাপত্তা : একজন শিশুর সার্বিক বিকাশের ক্ষেত্রে তার অবস্থান ও পারিপার্শ্বিক পরিবেশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মায়ের কোল, বাড়ীর উঠান, খেলার মাঠ, পুকুরপাড় এমনকি বিছানাপত্র পর্যন্ত নিরাপত্তাহীনতার কারণ হতে পারে। তাদেরকে আবর্জনামুক্ত ও দুর্গন্ধমুক্ত এবং স্বাস্থ্যসম্মত সুন্দর একটি পরিবেশের ব্যবস্থা করা ইসলামী নির্দেশনার অন্তর্ভুক্ত।
(৬) দুর্যোগকালীন নিরাপত্ত : বন্যা, ভূমিকম্প, ঘূর্ণিঝড় ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও দুর্বিপাকে শিশুরা বেশী সমস্যায় পড়ে ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সুতরাং বিভিন্ন দুর্যোগের সময় তাদের ব্যাপারে অভিভাবকদের বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করা একান্ত প্রয়োজন।
(৭) গোলমাল, মারামারি ও যুদ্ধকালীন নিরাপত্তা : গোলমাল, মারামারি বা যুদ্ধ হিংসা, পরশ্রীকাতরতা ও মানবিক দুর্বলতার কারণে ঘটনা ঘটে থাকে। এক্ষেত্রে নারী, শিশু ও বৃদ্ধ মানুষেরা বেশী দুর্ভোগের শিকার হয়। শিশু-কিশোরদের নিরাপত্তা বিধান সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আসুন আমরা সামর্থ্যানুযায়ী শিশুর আহার, তাদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও পোশাক-পরিচ্ছদ প্রভৃতি সকল বিষয়ে নিরাপত্তা বিধানে বিশেষভাবে সচেষ্ট হয়।
ঙ. উত্তম চারিত্রিক গুণাবলী অর্জনের অধিকার :
ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে, Charactor is crown of life. ‘চরিত্র হ’ল জীবনের রাজমুকুট স্বরূপ’। মহান আল্লাহ আমাদেরকে উত্তম স্বভাব-চরিত্র ও আচার ব্যবহারের জ্ঞান দ্বারা সৃজন করেছেন। জীবন গড়ার প্রথম স্তরেই শিশু-কিশোরদেরকে প্রকৃত ইসলামী শিক্ষার পাশাপাশি সাধারণ শিক্ষা, শিষ্টাচার ও চরিত্র গঠন করাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। কেননা চরিত্রবান ব্যক্তির নিকট সমাজের অন্যরা নিরাপদ থাকে। পক্ষান্তরে দুশ্চরিত্রবান ব্যক্তি থেকে সবাই শঙ্কিত থাকে। তার ক্ষতি থেকে বাঁচার জন্য মানুষ সর্বদা নিরাপদ দূরে অবস্থান করে। উত্তম চরিত্র সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, وَإِنَّكَ لَعَلَى خُلُقٍ عَظِيمٍ ‘নিশ্চয়ই আপনি মহান চরিত্রের উপর প্রতিষ্ঠিত’ (ক্বলম ৬৮/৪)। তিনি আরো বলেন, لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللَّهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ ‘তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-এর জীবনে সর্বোত্তম আদর্শ রয়েছে’ (আহযাব ৩৩/২১)। অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, إِنَّ مِنْ أَحَبِّكُمْ إِلَىَّ أَحْسَنَكُمْ أَخْلاَقًا ‘তোমাদের মধ্যে আমার কাছে সর্বাধিক প্রিয় সেই ব্যক্তি যে সর্বাধিক উত্তম চরিত্রের অধিকারী’।[24] মানবজীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ উপাদান হল সচ্চরিত্র। আর সচ্চরিত্রের মূল উপাদান হল-সময়ানুবর্তিতা। বিনম্রতা, সত্যবাদিতা, সহনশীলতা, সহিষ্ণুতা, শৃঙ্খলাবোধ, সুশিক্ষা, পরিমিত আহার, পরিমিত ব্যয়, শালীন ও পরিমার্জিত পোশাক, মিষ্ট ভাষা আর মুচকি হাসি ইত্যাদি গুণাবলী সবই সচ্চরিত্রের অন্তর্ভুক্ত। এর বিপরীত দিকগুলো মানুষকে কলুষিত ও কলঙ্কিত করে। অন্যদিকে আল্লাহ যাকে সচ্চরিত্র প্রদান করেন সে সৌভাগ্যবান। চরিত্রবান ব্যক্তির দ্বারাই দেশ ও জাতির প্রভূত কল্যাণ সাধিত হয়। চরিত্রহীন ব্যক্তির নিকট থেকে অকল্যাণ ছাড়া কিছু পাওয়া যায় না। আসুন আমরা সকলে আমাদের সোনামণিদেরকে উল্লেখিত গুণাবলীর আলোকে সৎচরিত্র গঠনে প্রশিক্ষণ দিয়ে আদর্শ ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজ গঠনে উৎসাহিত করি। আমাদের সকলের উচিত চরিত্র গঠনের এ চলমান কাফেলা অব্যাহত রাখা। আল্লাহ আমাদের এ প্রচষ্টাকে কবুল করুন। আমীন!
চ. বৈষম্যহীন আচরণ পাবার অধিকার :
ইসলাম সকল প্রকার বৈষম্যহীন সমাজ গঠনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। জন্মগত, বংশগত, ভাষাগত বা আঞ্চলিকতার বিচারে কোন মানুষের মর্যাদা ও প্রাধান্য স্বীকার করে না। সমাজে সবাই সমান ও সবাই একই মর্যাদার অধিকারী। এর বাস্তব দৃষ্টান্ত হল ছালাত। এখানে ধনী-গরীব, রাজা-বাদশাহ, মন্ত্রী-এমপি, ডিসি, ভিসি, ম্যাজিস্ট্রেট সবাই সমান। কারণ ছালাতে ফকির আগে আসলে সে প্রথম কাতারে দাঁড়াবে এবং মন্ত্রী বা রাজা যেই হোক পরে আসলে, সে পরেই দাঁড়াবে। আল্লাহ বলেন, إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ ‘নিশ্চয়ই মুমিনগণ পরস্পর ভাই ভাই’ (হুজুরাত ৪৯/১০)।
মানুষ পরস্পর সহনশীল, মমত্ববোধ, আন্তরিকতাপূর্ণ ও হৃদ্যতাপূর্ণ পরিবেশে বসবাস করবে। ইসলাম পূর্ব যুগে নারীদের অবস্থা ছিল অত্যন্ত শোচনীয়। কন্যা সন্তান জন্ম হওয়া তখনকার যুগে ছিল অভিশাপ। তাই কন্যা সন্তান জন্ম হওয়া মাত্র তাদেরকে জীবন্ত প্রোথিত করা হত। কিন্তু পিতা নামের নর পশুদের নিকটে ঐ সন্তানের আর্তচিৎকার তার পাষাণ হৃদয়ে কোন দয়ার উদ্রেক করত না। অথচ রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘কেউ যদি ২/৩ জন মেয়ে অথবা বোনকে লালন-পালন করে, তাদেরকে শিষ্টাচার শেখায়, তাদের বিবাহের ব্যবস্থা করে ও তাদের সাথে ভাল ব্যবহার করে, তবে তার জন্য জান্নাত রয়েছে’।[25] আল্লাহ বলেন, وَإِذَا الْمَوْءُودَةُ سُئِلَتْ- بِأَيِّ ذَنْبٍ قُتِلَتْ ‘যখন জীবন্ত প্রোথিত কন্যাকে জিজ্ঞেস করা হবে, তাকে কোন অপরাধে হত্যা করা হয়েছিল’ (তাকভীর ৮১/৮-৯)। অন্যদিকে আল্লাহ তা‘আলা স্বামীদের লক্ষ্য করে বলেন, ‘তোমরা তাদের সাথে সৎভাবে জীবন যাপন কর’ (নিসা ৪/১৯)। কর্মক্ষেত্রেও নারীদের সমান মর্যাদা ও অধিকার রয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদের পুরুষেরা যা উপার্জন করবে তা তোমাদের থাকবে, আর নারীরা যা উপার্জন করবে তা তাদের জন্য থাকবে’ (নিসা ৪/৩২)। পারিবারিক ব্যয় নির্বাহের জন্য দায়িত্ব পুরুষদের উপর। নারী বা স্ত্রীর দায়িত্ব নয়। রাসূল (ছাঃ) নারীদের লাঞ্ছনা ও অবহেলার মূলোৎপাটন করেছেন। নারীদের সাথে সদ্ব্যবহারের প্রতি উৎসাহিত করেছেন। নারীদের দায়িত্ব যারা পালন করবে তাদের জন্য রাসূল (ছাঃ) জান্নাত লাভের ঘোষণা দিয়েছেন। অথচ ছেলে সন্তানের কারণে জান্নাতে যাবে এমন হাদীছ নেই। আয়েশা (রাঃ)-এর নিকট এক মহিলা ও দুই কন্যা আসার বুখারী ও মুসলিমের হাদীছটি এক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য। সুতরাং ইসলামে পুরুষ ও নারী, ছেলে বা মেয়েদের ক্ষেত্রে কোন প্রকার বৈষম্যের স্থান নেই। সোনামণি ছেলে-মেয়ে সবার সাথে সমান আচরণ করতে হবে। সমানভাবে তাদের খাওয়া-দাওয়া, পড়াশুনা ও পোশাক-পরিচ্ছদের ব্যবস্থা করতে হবে। অতএব আমাদেরকে শিশু-কিশোরদের প্রতি সমান ভালবাসা ও সহানুভূতিশীল আচরণ করার ব্যাপারে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।
ছ. উত্তম বন্ধুদের সাহচর্যের অধিকার :
জাহেলিয়াতের চরম চারিত্রিক অবক্ষয়ের যুগে আমাদের প্রিয় নবী (ছাঃ)-এর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে যারা ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করেছিল, তারাই হয়েছিল সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সোনার মানুষ। এর মূল কারণ ছিল তাঁরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে উত্তম সাথী হিসাবে গ্রহণ করেছিল। সুতরাং মানব জীবনে উত্তম বন্ধু বা সাথীর প্রয়োজন অপরিসীম। উত্তম বন্ধুর গুণাবলী সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, فَإِنْ تَابُوا وَأَقَامُوا الصَّلَاةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ فَإِخْوَانُكُمْ فِي الدِّينِ ‘যারা ভুল করার পর তওবা করে, ছালাত কায়েম করে, যাকাত প্রদান করে, তারাই হ’ল তোমার দ্বীনী ভাই ও বন্ধু’ (তাওবা ৯/১১)। বন্ধু অর্থ সাথী, মিত্র, সখা, সুহৃদ, স্বজন, হিতৈষী বা কল্যাণকামী। বন্ধু ছাড়া শিশু-কিশোর তথা যুবক-যুবতীরা নিজেদেরকে খুবই অসহায় মনে করে। একজন ভাল বন্ধু থাকলে জীবনে আর কিছুর প্রয়োজন হয় না। জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভের জন্য প্রয়োজন ৩টি জিনিস। যথা : (১) কঠোর অধ্যবসায় (২) কর্ম-নিষ্ঠা এবং (৩) ভাল বন্ধুর সাহচর্য। আর ভাল বন্ধুর পরিচয় হবে (১) মহৎ হৃদয় (২) অন্যের মঙ্গলকামী। কারণ আমরা সাধারণত দেখতে পাই ভাল লোকের সাথে ভাল লোকের বন্ধু, চোরের সাথে চোরের বন্ধুত্ব হয়ে থাকে। প্রাথমিক বা ইবতেদায়ীর বন্ধুরা সাধারণত লেখাপড়া ও খেলার সাথী হয়ে থাকে। দাখিল বা উচ্চবিদ্যালয়ের বন্ধুরা সাধারণত লেখাপড়া ও খেলার সাথী হয়ে থাকে। এ সময় থেকে তাদের শারীরিক ও মানসিক কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। এ সময়চর্চা জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান। এ সময় ভাল বন্ধুর সাহচর্য ও সঠিক ইসলামী শিক্ষা পেলেই সে প্রকৃত ভাল মানুষ হিসাবে গড়ে উঠে। তাই তো এ সময় পিতা-মাতা ও বড় ভাই স্কুল/মাদরাসা থেকে একটু দেরী করে ফিরলেই বকুনী দেয় বা রাগ করে বা ধমক দেয়। আর কলেজ ও ভার্সিটির জীবন তো অবাধ স্বাধীনতার জীবন। এখানে এসে তারা মনে করে, দুনিয়াটা মস্তবড়। খাও, দাও ফূর্তি কর। যেখানে খুশী সেখানে যাও, বাধা নেই, মানা নেই। মন যা চায় তাই কর, তাই সব খাও। এই সুযোগে প্রায় ৯০% ছাত্র-ছাত্রীরা খারাপের দিকে ধাবিত হয় এবং ১০% ছাত্র-ছাত্রী ইসলামের আদর্শে জীবন গড়ে বলে আমার ব্যক্তিগত জরীপে মনে হয়।
তাই আমার উপদেশ বন্ধুত্ব করার পূর্বে বিয়ের পাত্র দেখার মত তার জীবনের তথ্য মিলিয়ে জেনে, শুনে ও বুঝে একজন প্রকৃত ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত বন্ধু খুঁজতে হবে। সৎ, যোগ্য, ঈমানদার ভাল বন্ধু খুজুন, না পেলে নিঃসঙ্গ থাকুন। এটাই বন্ধুত্বের জন্য চূড়ান্ত ও শেষ উপদেশ।
জ. শ্রমজীবি শিশু-কিশোরদের অধিকার :
মহান আল্লাহ আমাদেরকে শ্রম, কর্মোদ্যম এবং ন্যায়নিষ্ঠার জ্ঞান দান করেছেন। আমাদের প্রিয়নবী (ছাঃ) সহ তাঁর সকল ছাহাবীরা ছিলেন অত্যন্ত পরিশ্রমী। রাসূল (ছাঃ) শ্রমের মূল্যায়ন করতে সকলকে তাগিদ দিয়েছেন। যার আগমন হয়েছিল বঞ্চিত ও অধিকার হারাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে সুন্দর সমৃদ্ধশালী শান্তির সমাজ ও দেশ প্রতিষ্ঠা করা। মহান আল্লাহ বলেন, لَقَدْ خَلَقْنَا الْإِنْسَانَ فِي كَبَدٍ ‘নিশ্চয়ই আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি শ্রমনির্ভর করে’ (সূরা বালাদ ৯০/৪)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন, ‘যখন ছালাত শেষ হয়ে যাবে তখন তোমরা ভূপৃষ্ঠে ছড়িয়ে পড়বে এবং আল্লাহ প্রদত্ত রিযিক অন্বেষণ করবে’ (জুমু‘আ ৬২/৯)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘শ্রমিকের ঘাম শুকানোর আগেই তার পারিশ্রমিক দিয়ে দাও’ (ইবনু মাজাহ হা/২৪৪৩; মিশকাত হা/২৯৮৭)। তিনি আরও বলেন, مَطْلُ الْغَنِىِّ ظُلْمٌ ‘স্বচ্ছল ব্যক্তির জন্য পাওনা পরিশোধে টাল বাহানা বা বিলম্ব করা যুলুমের নামান্তর’।[26] তাই যথাসম্ভব শ্রম সমাপ্তির পরপর শ্রমিকের প্রাপ্য পরিশোধ করে দেওয়া উচিৎ। সাধ্যাতীত শ্রম নিষিদ্ধ এবং শিশু-কিশোরদের উপর কঠোর বোঝা চাপানোও নিষেধ। শিশু-শ্রম যদি একান্ত প্রয়োজন হয় তবে কর্মঘন্টা নির্ধারণ, বিশ্রাম ও বিনোদন এবং শিক্ষার সুব্যবস্থা থাকতে হবে। এক্ষেত্রে তাদের অধিকারের সার্বিক দিক বিবেচনা করা একান্ত কর্তব্য। নবী (ছাঃ) শ্রমিকের পারিশ্রমিক নির্ধারণ না করে শ্রমিক নিয়োগ দিতে নিষেধ করেছেন। তিনি আরও বলেন, ‘অধীনস্তদের জন্য খাবার ও পোশাকের ব্যবস্থা করবে, তাদের উপর সাধ্যাতীত কাজ চাপিয়ে দিবে না (মুসলিম)। সুতরাং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর আদর্শ অনুসরণ করলে এবং ইসলামী শ্রমনীতি বাস্তবায়িত হলে আমাদের সমাজ, দেশ ও জাতি সমৃদ্ধ হবে। প্রতিভাবান শ্রমজীবি শিশু-কিশোরদের উপযুক্ত শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। ফলশ্রুতিতে তারা তাদের সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ঘটিয়ে দেশ ও জাতির কল্যাণ বয়ে আনতে সক্ষম হবে ইনশাআল্লাহ।
ঝ. খেলাধূলা, বিনোদন ও শিশুর শরীর চর্চার অধিকার :
মহান আল্লাহ অত্যন্ত সুন্দরভাবে আমাদের শারীরিক অবকাঠামো তৈরী করেছেন। অতঃপর সুস্থ থাকার জন্য খেলাধূলা, বিনোদন ও স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য খাদ্য-খাবার, আহার-বিহার ও শরীর চর্চার ব্যবস্থা করেছেন। আমাদের এই সুন্দর শরীর আল্লাহ প্রদত্ত নে‘মত। আল্লাহ বলেন, لَقَدْ خَلَقْنَا الْإِنْسَانَ فِي أَحْسَنِ تَقْوِيمٍ ‘আমি মানুষকে সুন্দর অবয়বে সৃষ্টি করেছি’ (ত্বীন ৯৫/৪)। শরীর সুস্থ থাকলে মন ভাল থাকে আর শরীর অসুস্থ থাকলে পারিবারিক ও মানসিক চাপ বৃদ্ধি পায় এবং দুঃশ্চিন্তা বাড়ে। ফলে ইবাদত, আনুগত্য, পরিশ্রম, বিনোদন ইত্যাদি কোন কিছুই ভাল লাগে না। এক্ষেত্রে ভাল স্বাস্থের জন্য প্রয়োজন পর্যাপ্ত ব্যয়াম করা।
শিশুরা অবোধ। তাই তাদের স্বাস্থ্যের, বিনোদনের ও খেলাধূলার জন্য পিতা-মাতা ও অভিভাবকদের যথাযথ ভূমিকা রাখতে হবে। খেলাধূলার উপকারিতা ও অপকারিতা সম্পর্কে তাদেরকে জানাতে হবে। খেলাধূলার পরিশ্রমের কারণে রক্ত সঞ্চালন হেতু পরিপাকতন্ত্র সবল হয়, খাদ্য হজমে সহায়ক হয় এবং ঘাম নির্গত হয়ে শরীরের দূষিত পদার্থ বেরিয়ে যায়। সাময়িক ক্লান্তি হলেও দৈহিক শক্তি সঞ্চয় হয়। খাদ্যের চাহিদা বাড়ে এবং শরীর সুস্থ থাকে। এটা শিশুদের অধিকার। এ সম্পর্কে রাসূল (ছাঃ) বলেন, وَلِجَسَدِكَ عَلَيْكَ حَقًّا ‘তোমার শরীরের প্রতি তোমার কর্তব্য ও অধিকার রয়েছে’।[27] শরীরের হক যেমন আরাম করা, তেমন পরিশ্রম করাও একটি অধিকার। খেলবে শিশুরা, খেয়াল রাখবে অভিভাবকগণ। তাস, পাশা, জুয়া, দাবা, কেরাম, লুডু ইত্যাদি খেলা বাচ্চাদের অলস, দুর্বল ও নেশাগ্রস্ত করে তোলে। সুতরাং এ সমস্ত খেলা পরিত্যাগ করে শ্রমনির্ভর খেলা দৌড়, সাঁতার, ফুটবল, ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন ও ভলিবল ইত্যাদি খেলায় অভ্যস্ত করে গড়ে তুলতে হবে। শিশুদের শরীরের যত্ন নেয়া ও নিয়মিত শরীর চর্চার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করে দেয়া পিতা-মাতা ও অভিভাবকের দায়িত্ব ও কর্তব্য। তবে পড়াশুনা ও ইবাদতে যেন কোন প্রকার ব্যাঘাত না ঘটে সেদিকে সর্বদা লক্ষ্য রাখবেন। হে আল্লাহ! তোমার মদদ কামনা করি। আমীন!
ঞ. শিশু-কিশোরদের বিভিন্নভাবে নির্যাতনসহ যৌন নির্যাতন থেকে রক্ষা পাবার অধিকার :
স্বতঃসিদ্ধ কথা এই যে, আমরা সবাই একদিন ঐ ছোট্ট কোমলমতি ফুটফুটে শিশু হয়ে এ ধরায় এসেছিলাম। কিন্তু আজ একথা সবাই আমরা ভুলতে বসেছি। বর্তমানে ভাবতে অবাক ও কষ্ট লাগে আমরা সোনামণিদের বিভিন্নভাবে নির্যাতন, নিপীড়ন ও অধিকার বঞ্চিত করছি। অথচ মহান আল্লাহর অন্যতম সৃষ্টি হিসাবে আদর, সোহাগ, সেণহ ও মমতার বন্ধনে আবদ্ধ থেকে নিজেকে যোগ্য হিসাবে গড়ে ওঠাই তাদের অধিকার। সোনামণিরা নিজ পরিবারে, আত্মীয়-স্বজনদের বাড়ী (যেমন-খালা, মামা, চাচা, ফুফু এবং দুলাভাই), শিক্ষক ও বন্ধু এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের অসৎ ও দুশ্চরিত্র ব্যক্তিদের মাধ্যমে শারীরিক ও মানসিক এবং নানাভাবে প্রতিনিয়ত নির্যাতিত হচ্ছে। শিশু-কিশোরদের বিভিন্নভাবে নির্যাতনসহ যৌন নির্যাতন থেকে মুক্ত রাখতে হবে। এ ব্যাপারে সামাজিকভাবে গণসচেতনতা এবং প্রশাসনিকভাবে জোরালো আইনগত ভূমিকা পালন করা একান্ত যরূরী।
ট. শিশু-কিশোরদের হত্যা ও পাচার রোধের অধিকার :
পাচার শব্দটি বর্তমানে বেশ সুপরিচিত একটি পরিভাষা। মানব পাচার, মহিলা ও শিশু পাচার এখন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। পাচার বলতে এক শ্রেণির অসাধু ও দুষ্টচক্রকে বুঝায়। যারা অর্থের লোভে মানবতাকে বিসর্জন দিয়ে তাদেরকে ফুসলিয়ে বা অচেতন করে ভিনদেশে পাচার করে দেয়। পরবর্তীতে তাদেরকে হত্যা করে বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ চড়ামূল্যে বিক্রি করা হয় অথবা তাদেরকে অনৈতিক কাজে ব্যবহার করা হয়। এটা অত্যন্ত ঘৃণ্য, জঘন্য ও নিন্দনীয় কাজ। পাচার একটি পরিবারকে ধ্বংস করে দেয়। বাবা-মা, আত্মীয়স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীর সুস্বপ্নকে ভেঙ্গে চুরমার করে দেয়। এটা বাংলাদেশের একটি জাতীয় সমস্যা, যার দ্রুত নিষ্পত্তি ও অবসান হওয়া একান্ত প্রয়োজন। বিদেশে ভাল চাকুরীর, বিয়ের, লেখাপড়ার, বেড়ানোর এবং অসৎ বন্ধুদের মিথ্যা প্রলোভনের আশ্বাসে প্রতিনিয়ত পুরুষ ও মহিলা এবং শিশু-কিশোর পাচার হচ্ছে। ইসলামে প্রতারণা একটি গর্হিত অপরাধ। মহান আল্লাহ বলেন, وَالَّذِينَ يَمْكُرُونَ السَّيِّئَاتِ لَهُمْ عَذَابٌ شَدِيدٌ وَمَكْرُ أُولَئِكَ هُوَ يَبُورُ ‘যারা অন্যায় কাজের চক্রান্তে লেগে থাকে তাদের জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি। তাদের চক্রান্ত ব্যর্থ হবে’ (ফাত্বির ৩৫/১০)।
শিশু-কিশোরদের পাচার রোধে করণীয় :
শিশু-কিশোর পাচাররোধে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো সর্বাধিক প্রাধান্য দেওয়া দরকার। (১) নির্জন স্থানে একাকী বেড়ানো, ঘোরাফেরা ও অবস্থান না করা। (২) সর্বদা সচেতনতা ও সাবধানতার নীতি অবলম্বন করা। (৩) আইন-শৃংখলা বাহিনীকে দ্রুত অবহিত করা। (৪) অপহৃত হলে দ্রুত প্রচার মাধ্যম বিশেষত রেডিও, টিভি ও পত্রিকায় তার ছবিসহ বায়োডাটা প্রচার করা। (৫) সীমান্ত প্রহরীদের যথাযথ দায়িত্ব পালন করা (আলে-ইমরান ২৩/২০০)। (৬) ধরা পড়লে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। যাতে পরবর্তীকালে কেউ এ কাজের দুঃসাহস দেখাতে না পারে। (৭) আত্মরক্ষার জন্য সোনামণিদের ব্যায়াম বা শরীর চর্চা ও সাঁতারসহ বিভিন্ন কৌশল শিক্ষা দেওয়া।
উপসংহার :
গোলাপের মত সুন্দর, হাসনাহেনার মত সুগন্ধি ছড়ানো নিষ্পাপ, নিষ্কলুষ আমাদের অতি আদরের হৃদয়ের বাঁধন, নয়নের পুত্তলি সোনামণি তথা শিশু-কিশোরদের অধিকার বিষয়ে আলোচনার প্রেক্ষিতে অবগত হলাম যে, এ অধিকারগুলি যথাযথভাবে বাস্তবায়নের দায়িত্ব পিতা-মাতা, অভিভাবক, শিক্ষক সংগঠন, সমাজ ও রাষ্ট্রের। তাই আসুন! আমরা আমাদের সোনামণিদের সাথে আন্তরিকভাবে মিশে পবিত্র মন নিয়ে তাদেরকে প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তুলি। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর আদর্শ হাতে-কলমে জীবন গড়ার বাস্তব প্রশিক্ষণ দেই। যাতে করে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, নৈতিক, সাংগঠনিক ও সামাজিকভাবে সময়, শ্রম, মেধা ও অর্থ ব্যয় করার মানসিকতা নিয়ে শিশু-কিশোরদের সুপ্ত প্রতিভার দীপ্ত প্রভাব জাগ্রত করি। জাতির কাছে তাদের এ অধিকারগুচ্ছ তুলে ধরে ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে জান্নাতের পথ সুগম করি। মহান আল্লাহ আমাদের সকলকে শিশু-কিশোরদের অধিকারগুলি বাস্তবায়নের শক্তি, সামর্থ্য ও তাওফীক দান করুন। আমীন!
মুহাম্মাদ আযীযুর রহমান
প্রথম কেন্দ্রীয় পরিচালক, সোনামণি
[1]. আবুদাঊদ হা/৫১০৫; তিরমিযী হা/১৫১৪, মিশকাত হা/৪১৫৭। হাদীছ হাসান।
[2]. সিলসিলা যঈফাহ হা/৬১২১।
[3]. মুসলিম হা/৫৭৪৩; মিশকাত হা/৪১৫০।
[4]. মুসলিম হা/৫৩৭৮; মিশকাত হা/৪১৬০ ও ৪২৩৭।
[5]. বুখারী হা/৫৬২৩ ‘বাসন ঢেকে রাখা’ অনুচ্ছেদ; মুসলিম হা/৫৩৬৮; মিশকাত হা/৪২৯৪; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৪১০৯ ‘বাসন ঢেকে রাখা’ অনুচ্ছেদ; সিলসিলা ছহীহাহ হা/৪০।
[6]. বুখারী হা/৩৩১৬; মুসনাদে আহমাদ হা/১৫২০৬; মুসনাদু আবী ই‘য়ালা হা/২১৩০; জামেউছ ছগীর হা/৫৫৬৭; মিশকাত হা/৪২৯৫; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৪১০৯।
[7]. মুসলিম হা/৫৭০৯; মিশকাত হা/৪৭৫২।
[8]. মুসলিম, মিশকাত হা/৪৭৫৮।
[9]. মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীরন আলবানী, ইরওয়াউল গালীল হা/১১৬৮।
[10]. নাসাঈ, মিশকাত হা/৪১৫২।
[11]. আবুদাঊদ, মিশকাত হা/৪১৫৫।
[12]. তিরমিযী হা/১৫১৯, মিশকাত হা/৪১৫৪।
[13]. আবুদাঊদ, ইরওয়া হা/৭৯।
[14]. বুখারী হা/৫৮৯১; মুসলিম হা/৬২০; মিশকাত হা/৩৭৯।
[15]. বুখারী হা/৩৩৫৬; মুসলিম হা/৬২৯০; মিশকাত হা/৫৭০৩।
[16]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৪১৫৯।
[17]. আবুদাঊদ, মিশকাত হা/১৬৩৮।
[18]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৪৩২১ ও ১৪২৯।
[19]. বুখারী, মিশকাত হা/৪৪২৯।
[20]. বুখারী ও মুসলিম মিশকাত হা/৪৩১১-১৪।
[21]. ইবনু মাজাহ হা/২২৪; মিশকাত হা/২১৮।
[22]. আবুদাঊদ হা/৪৯৫; মিশকাত হা/৫৭২।
[23]. বুখারী হা/৭১; মুসলিম হা/২৪৩৬; মিশকাত হা/২০০।
[24]. বুখারী হা/৩৭৫৯; মিশকাত হা/৫০৭৪।
[25]. আহমাদ হা/১১৮৬৩ ও ১১৩২৩।
[26]. বুখারী হা/২২৮৭; মুসলিম হা/৪০৮৫; মিশকাত হা/২৯০৭।
[27]. মুসলিম হা/২৭৮৭।