আহলেহাদীছের পরিচয়
ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব 248 বার পঠিত
অবক্ষয় যুগে আহলেহাদীছ আন্দোলনের কেন্দ্রসমূহ
এই সময় পাঁচজন ছূফী মুহাদ্দিছের নেতৃত্বে ভারতবর্ষে ইলমে হাদীছ ও আহলেহাদীছ আন্দোলনের পাঁচটি প্রধান কেন্দ্র গড়ে ওঠে।[1] যথা (১) বাহাউদ্দীন যাকারিয়া (৫৭৮-৬৬৬ হিঃ/১১৮৩-১২৬৮ খৃঃ) মুলতানে। (২) নিযামুদ্দীন আউলিয়া (৬৩৪-৭২৫ হিঃ/১২৩৬-১৩২৫ খৃঃ) দিল্লীতে। (৩) শারফুদ্দীন আবু তাওয়ামা (মৃঃ ৭০০ হিঃ/১৩০০ খৃঃ) বাংলাদেশের সোনারগাঁয়ে। (৪) শারফুদ্দীন আহমাদ বিন ইয়াহ্ইয়া মুনীরী (৬৬১-৭৮২ হিঃ/১২৬৫-১৩৮০ খৃঃ) বিহারে। (৫) আমীর কবীর আলী বিন শিহাব হামাদানী (৭১৪-৭৮৬ হিঃ/১৩১৪-৮৪ খৃঃ) কাশ্মীরে।
প্রতিটি কেন্দ্রে সৃষ্টি হয় একদল যোগ্য মুহাদ্দিছ শিষ্যমন্ডলী, যারা সর্বত্র আহলেহাদীছ আন্দোলনের মর্মবাণী প্রচার করতে থাকেন এবং বিভিন্ন প্রকারের শিরক ও বিদ‘আতী রসম-রেওয়াজের বেড়াজালে আবদ্ধ মুসলিম সমাজকে নিরপেক্ষভাবে হাদীছ অনুযায়ী জীবনগঠনে উদ্বুদ্ধ করেন।
১ম. মুলতান কেন্দ্র :
ছাহাবী হিবার বিন আস্ওয়াদ (রাঃ)-এর বংশধর শায়খ বাহাউদ্দীন যাকারিয়ার (৫৭৮-৬৬৬ হিঃ/১১৮৩-১২৬৮ খৃঃ) নেতৃত্বে ইল্মে হাদীছের এই কেন্দ্র গড়ে ওঠে। তিনি এখানেই জন্ম ও মৃত্যুবরণ করেন এবং বুখারা, খোরাসান ও মদীনায় ইল্ম হাছিল করেন।[2] তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র ও পৌত্রগণ এই কেন্দ্র চালু রাখেন। উছ-এর অধিবাসী শায়খ জামালুদ্দীন মুহাদ্দিছ (মৃঃ হিজরী ৮ম শতকের প্রথমার্ধে) ও মাখদূম জাহানিয়াঁ সাইয়িদ জালালুদ্দীন বুখারী (৭০৭-৭৮৫ হিঃ/১৩০৭-৮৩ খৃঃ) এই কেন্দ্রের মশহুর আহলেহাদীছ ছাত্র ছিলেন। ‘মাশারেকুল আন্ওয়ার’ ও ‘মাছাবীহুস সুন্নাহ’ থেকে তাঁরা নিয়মিত দরস দিতেন। এই কেন্দ্র হ’তে বহু মুহাদ্দিছ ছাত্র সৃষ্টি হয়। যাঁদের জীবনব্যাপী হাদীছের চর্চা ও নিরলস দাওয়াত ও তাবলীগের ফলে স্রোতে ভেসে যাওয়া মুসলিম জনসাধারণের মধ্যে হাদীছ অনুযায়ী জীবনগঠনের তাকীদ সৃষ্টি হয় এবং আহলেহাদীছ আন্দোলনে জীবন সঞ্চারিত হয়।
২য়. দিল্লী কেন্দ্র :
‘নিযামুদ্দীন আউলিয়া’ নামে প্রসিদ্ধ ছূফী মুহাদ্দিছ শায়খ মুহাম্মাদ বিন আহমাদ বুখারী বাদায়ূনীর (৬৩৪-৭২৫ হিঃ/১২৩৬-১৩২৫ খৃঃ) নেতৃত্বে এই কেন্দ্র গড়ে ওঠে। অনন্য প্রতিভাধর এই সাধক মাত্র বিশ বৎসর বয়সেই আরবী সাহিত্য ও ফিক্হ শাস্ত্রে ব্যুৎপত্তি লাভ করেন ও যুগের নিয়মানুযায়ী ‘ক্বাযী’ হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কিন্তু উস্তাদ কামালুদ্দীন যাহেদ-এর নিকটে ‘মাশারেকুল আন্ওয়ার’ হেফয করার ফলে তাঁর জীবনের মোড় ঘুরে যায়। তিনি প্রচলিত ‘তাক্বলীদী’ নীতি পরিত্যাগ করে ‘মুহাদ্দিছগণের’ নীতি গ্রহণ করেন। ইমামের পিছনে সূরায়ে ফাতিহা পাঠ, গায়েবী জানাযা প্রভৃতির পক্ষে তিনি ফৎওয়া প্রদান করতেন।[3] তাঁর মুরীদান ও খলীফাগণের মধ্যে বহু আলিমের সন্ধান পাওয়া যায়, যাঁরা ইল্মে হাদীছে পারদর্শিতা লাভ করেন ও যাঁদের প্রচেষ্টার ফলে আহলেহাদীছ আন্দোলন বিস্মৃতির তলে হারিয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা পায়। যেমন- (১) অযোধ্যার শামসুদ্দীন মুহাম্মাদ ইয়াহ্ইয়া (মৃঃ ৭৪৭ হিঃ/১৩৪৬ খৃঃ)। ইনিই প্রথম হিন্দুস্থানী মুহাদ্দিছ, যিনি মাশারেকুল আন্ওয়ারের ভাষ্য লেখেন।[4] (২) দিল্লীর ফখরুদ্দীন যাররাদ (মৃঃ ৭৪৮ হিঃ/১৩৪৬ খৃঃ)। হেদায়ার পাঠদানের সময় বিভিন্ন মাসআলায় তিনি সর্বদা হাদীছকে অগ্রাধিকার দিতেন। তিনি বলতেন, ‘নির্দিষ্ট একটি মাযহাব মান্য করা বিদ‘আত’ (إختار المذهب المعين بدعة)।[5] গিয়াছুদ্দীন তুগলকের দরবারে আহূত বিতর্কসভায় তিনিও স্বীয় উস্তাদ নিযামুদ্দীন আউলিয়ার সাথে ছিলেন।[6] (৩) ঐতিহাসিক যিয়াউদ্দীন বিন মুঈদুল মুলক বারনী (মৃঃ ৭৫৮/১৩৫৭-এর পরে) স্বীয় উস্তাদের শিক্ষার ফলে স্বীয় বিশ্ববিখ্যাত ইতিহাসগ্রন্থ ‘তারীখে ফীরোযশাহী’র ভূমিকায় হাদীছ ও ইতিহাসের তুলনামূলক আলোচনায় এই ধারণা ব্যক্ত করেন যে, কুরআন ও হাদীছের চর্চার ফলে মানুষ উদারমনা ও মধ্যপন্থী হয়। দলীয় গোঁড়ামী ও সংকীর্ণতা দূর হয়।[7] (৪) মুহিউদ্দীন বিন জালালুদ্দীন কাশানী (মৃঃ ৭১৯ হিঃ/১৩১৯ খৃঃ) (৫) নিযামুদ্দীন হাশেমী জাফরাবাদী (মৃঃ ৭৩৫ হিঃ/১৩৩৪)। ইনি ‘যুবদাতুল মুহাদ্দেছীন’ নামে খ্যাত ছিলেন। (৬) শায়খ নাছীরুদ্দীন ‘চেরাগে দেহ্লী’ (মৃঃ ৭৫৭ হিঃ/১৩৫৬ খৃঃ)। উস্তাদ নিযামুদ্দীনের মৃত্যুর পর ইনি তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন।[8] (৭) সাইয়িদ মুহাম্মাদ বিন ইউসুফ গেসূদারায (৭২১-৮২৫/১৩২১-১৪২২ খৃঃ) বিখ্যাত অলি ও মুহাদ্দিছ ছিলেন। ইল্মে হাদীছ সহ বিভিন্ন ইসলামী বিষয়ে তিনি একশতের উপরে কিতাব লেখেন।[9] (৮) শায়খ অজীহুদ্দীন দেহলভী (৯) কাযী শিহাবুদ্দীন দৌলতাবাদী (মৃঃ ৮৪৯/১৪৪৫ খৃঃ) প্রমুখ বিদ্বানমন্ডলী।
৩য় কেন্দ্র. সোনারগাঁও (বাংলাদেশ) :
এই কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা মুহাদ্দিছ শারফুদ্দীন আবু তাওয়ামা (মৃঃ ৭০০ হিঃ/১৩০০ খৃঃ) বুখারা হ’তে ইল্মে হাদীছের প্রচার ও প্রসারের উদ্দেশ্যে প্রথমে দিল্লী আসেন। অল্পদিনে তাঁর সুনাম চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লে স্থানীয় আলেমগণ সক্রিয় হয়ে ওঠেন ও অবশেষে মামলূক সুলতান গিয়াছুদ্দীন বলবনের (৬৬৪-৬৮৭ হিঃ/১২৬৬-১২৮৭ খৃঃ) নির্দেশে তাঁকে দিল্লী ছাড়তে বাধ্য করা হয়।[10] তিনি বিহার হ’য়ে বাংলাদেশের সোনারগাঁয়ে ৬৬৭হিঃ/১২৬৯ খৃষ্টাব্দে উপনীত হন।[11] আবু তাওয়ামাই সর্বপ্রথম হিন্দুস্থানের মাটিতে ‘ছহীহায়েন’ নিয়ে আসেন এবং সোনারগাঁয়ে তার দরস শুরু করেন। এদিক দিয়ে বাংলাদেশ সত্যিই গৌরবধন্য দেশ। আমৃত্যু তিনি এখানে ইল্মে হাদীছের দরস দেন্। অসংখ্য দেশী-বিদেশী ছাত্রের এখানে আগমন ঘটে। আধুনিক পরিভাষায় যা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপ নেয়। মৃত্যুর পূর্বে তিনি ছহীহ বুখারীর একটি ভাষ্যগ্রন্থ রচনা করেন।[12] সপ্তম শতাব্দী হিজরী শেষে মুহাদ্দিছ আবু তাওয়ামার মৃত্যুর পর তাঁর শিক্ষার আলোকবর্তিকা পরবর্তী আড়াইশত বৎসর যাবত বাংলার যমীনে নিভু নিভু ভাবে হ’লেও আহলেহাদীছ আন্দোলনকে বাঁচিয়ে রাখে। দশম শতাব্দী হিজরীর প্রথম দিকে বার ভূঁইয়াদের সময়ে (৯০০-৯৪৫ হিঃ/১৪৯২-১৫৩৮ খৃঃ) তৎকালীন পূর্ব বাংলার রাজধানী হিসাবে সোনারগাঁও একটি সমৃদ্ধিশালী নগরী হওয়ার সাথে সাথে ইসলামী শিক্ষার কেন্দ্র হিসাবেও খ্যাত ছিল। ঐ সময় মুহাদ্দিছগণের কদর ছিল।[13] এতদ্ব্যতীত বাংলার স্বাধীন হুসেন শাহী সালতানাতের প্রতিষ্ঠাতা আলাউদ্দীন হুসাইন শাহ বিন আশরাফ মাক্কী (৯০০-৯৪৫/১৪৯২-১৫১৮ খৃঃ) ইল্মে হাদীছের প্রসারে উদার পৃষ্ঠপোষকতা দান করেন। রাজধানী একডালাতে মুহাম্মাদ বিন ইয়াযদান বখ্শ ওরফে ‘খাজেগী শিরওয়ানী’র ন্যায় মুহাদ্দিছগণের অবস্থান ও ছহীহ বুখারী শরীফের লিপির লিপিকরণ-এর স্পষ্ট প্রমাণ বহন করে। সুলতান মালদহের ‘পান্ডুয়া’তে নূর কুতবে আলমের (৭৫০-৮৫০/১৩৪৯-১৪৪৬ খৃঃ) স্মরণে একটি এবং ‘গোরাশহীদ’ এলাকায় একটি মাদরাসা স্থাপন করেন। যেখানে প্রচলিত ফেক্হী ও মা‘কূলাতভিত্তিক সিলেবাসের বিপরীতে ইলমে হাদীছকে আবশ্যিক সিলেবাসে পরিণত করেন। এজন্য তাঁকে সমসাময়িক গুজরাটের মুযাফ্ফরশাহী সুলতানদের সাথে তুলনা করা হয়ে থাকে।[14] মুহাদ্দিছ শারফুদ্দীন আবু তাওয়ামার কোন বাংগালী ছাত্রের নাম জানা না গেলেও বাংলাদেশ অঞ্চল যে ইল্মে হাদীছের প্রভাবে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছিল, একথা বলা চলে।
৪র্থ কেন্দ্র. মুণীর (বিহার) :
সোনারগাঁও বিশ্ববিদ্যালয়ের দীর্ঘ বাইশ বৎসরের স্বনামধন্য ছাত্র ও আল্লামা শারফুদ্দীন আবু তাওয়ামা (মৃঃ ৭০০/১৩০০ খৃঃ)-এর জামাতা মুহাদ্দিছ শারফুদ্দীন আহমাদ বিন ইয়াহ্ইয়া মুণীরীকে (৬৬১-৭৮২/১২৬৩-১৩৮০ খৃঃ) কেন্দ্র করে ইল্মে হাদীছের এই কেন্দ্র গড়ে ওঠে। তিনি শ্বশুরের নিকট থেকে প্রাপ্ত ‘ছহীহায়নের’ হাফেয ছিলেন এবং সনদ ও রিজালশাস্ত্র সহ ইল্মে হাদীছের বিভিন্ন শাখায় পারদর্শী ছিলেন। ‘ছহীহায়েন’ ছাড়াও হাদীছের অন্যান্য গ্রন্থাবলী তিনি হেজায হ’তে আনয়ন করেন। তিনি ‘আমল বিল হাদীছ’-এর উত্তম নমুনা ছিলেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কিভাবে ‘খরবূযাহ’ খেতেন জানতে পারেননি বলে তিনি জীবনে ‘খরবূযাহ’ খাননি।[15] আযানের মধ্যে রাসূলের নাম শুনে চোখে আঙ্গুল রাখা সম্পর্কে তিনি বলতেন, ‘এদেশে প্রচলিত এই নিয়মটি কোন হাদীছে পাওয়া যায় না’।[16] মুণীর কেন্দ্রের শ্রেষ্ঠ ছাত্রবৃন্দের মধ্যে শায়খ মুযাফ্ফর বল্খী (মৃঃ ৭৮৬/১৩৮৪ খৃঃ), হুসাইন বিন মুইয বিহারী (মৃঃ ৮৪৪/১৪৪১ খৃঃ) ‘নওশাহে তাওহীদ’ (তাওহীদের বরপুত্র), আহমাদ বিন হাসান বিন মুযাফ্ফর ‘লঙ্গরে দরিয়া’ (মৃঃ ৮৯১-১৪৮৬ খৃঃ) প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।[17] বিহারের মুণীর কেন্দ্র মূলতঃ সোনারগাঁ কেন্দ্রেরই প্রতিনিধিত্ব করে এবং বিহার ও আশপাশ এলাকায় আহলেহাদীছ আন্দোলনে গতি সঞ্চার করে। ‘লঙ্গরে দরিয়ার’ মৃত্যুর সাথে সাথে এই কেন্দ্রের তৎপরতা স্তিমিত হয়ে যায়।
(খ) ফলওয়ারী শরীফ
মুণীর-এর কেন্দ্র স্তিমিত হ’য়ে যাওয়ার পর বিহারের ‘ফলওয়ারী শরীফ’ ইল্মে হাদীছের কেন্দ্র হিসাবে গড়ে ওঠে। ইয়াহ্ইয়া মুণীরীর শিষ্য মিনহাজুদ্দীন রাস্তীর মাধ্যমে ৮ম শতাব্দী হিজরীতে এই কেন্দ্রের গোড়াপত্তন হ’লেও দশম শতাব্দী হিজরীতে ‘শায়খুল মুহাদ্দেছীন’ ইয়াসীন গুজরাটির আগমনের পরেই এই কেন্দ্রের সুনাম চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে।[18] মূলতঃ তাঁর প্রচেষ্টায় এটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ হাদীছ শিক্ষাকেন্দ্রে পরিণত হয়, যা এই অঞ্চলে আহলেহাদীছ আন্দোলনের প্রসারে সহায়ক হয়।
৫ম কেন্দ্র. কাশ্মীর :
খোরাসানের বিখ্যাত অলি ও মুহাদ্দিছ আমীর কবীর সাইয়িদ আলী বিন শিহাব হামাদানী (৭১৪-৭৮৬/১৩১৪-৮৪ খৃঃ) ও তাঁর শিষ্যদের মাধ্যমে কাশ্মীর আহলেহাদীছ আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্রে পরিণত হয়। ৭৭৩/১৩৭১ খৃষ্টাব্দে তিনি ৭০০ শত শিষ্য নিয়ে ইরান হ’তে কাশ্মীর আগমন করেন এবং খুবই সফলতার সাথে ইল্মে হাদীছের প্রসার ঘটান। কাশ্মীরের শাসক স্বয়ং তাঁর মুরীদ হন। তাঁর মৃত্যুর পরে সাইয়িদ জামালুদ্দীন, কাযী হুসাইন সিরাযী, হাজী মুহাম্মাদ কাশ্মীরী (মৃঃ ১০০৬/১৫৯৭ খৃঃ) প্রমুখ মুহাদ্দিছগণের মাধ্যমে বিশেষ করে শেষোক্ত ‘হাজী কাশ্মীরী’র মাধ্যমে এতদঞ্চলে ইল্মে হাদীছের প্রসার ও আহলেহীছ আন্দোলনের প্রভূত অগ্রগতি সাধিত হয়।[19]
আন্দোলনের অন্যান্য কেন্দ্র :
ইতিপূর্বে বর্ণিত উত্তর ও পূর্ব ভারতের পাঁচটি প্রধান কেন্দ্র ছাড়াও ভারতবর্ষের আরও কয়েকটি স্থানে ইল্মে হাদীছের কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল। সেসবের মাধ্যমে শিরক-বিদ‘আতে আচ্ছন্ন মুসলিম সমাজ হাদীছের আলোকে জীবন গড়ার তথা আহলেহাদীছ আন্দোলনে উদ্ধুদ্ধ হয়। যেমন- (১) মালব : সুলতান মাহমূদ খাল্জীর সময়ে (৮৪০-৮৭৪/১৪৩৬-৬৯ খৃঃ) মালবের রাজধানী ‘মান্ডু’ ইল্মে হাদীছের কেন্দ্রে পরিণত হয়। শায়খুল মুহাদ্দেছীন সা‘আদুল্লাহ মান্ডুবী ও আলীমুদ্দীন মান্ডুবী এখানকার খ্যাতনামা মুহাদ্দিছ ছিলেন।[20] (২) সিন্ধু : ইরান হ’তে বিতাড়িত মাখদূম আবদুল আযীয আব্হারীর (মৃঃ ৯২৮/১৫২২ খৃঃ) মাধ্যমে দীর্ঘ সাড়ে চারশত বৎসরের বিরতি শেষে সিন্ধুতে পুনরায় ইল্মে হাদীছের পুনরুজ্জীবন ঘটে। তিনি মিশকাতের ভাষ্য লেখেন।[21] (৩) ঝাঁসি ও কাল্পী : বাগদাদের মুহাদ্দিছ সাইয়িদ মুহাম্মাদ ইবরাহীম দশম শতাব্দী হিজরীর মধ্যভাগে এখানে এসে প্রথমে ঝাঁসি ও পরে কাল্পীতে ইল্মে হাদীছের কেন্দ্র গড়ে তোলেন। (৪) আগ্রা : দশম শতাব্দী হিজরীতে আগ্রায় ইল্মে হাদীছের তিনটি কেন্দ্র গড়ে ওঠে। যথা : (ক) মাদরাসা রফীউদ্দীন ছাফাবী (মৃঃ ৯৫৪-১৫৪৬) (খ) মাদরাসা হাজী ইবরাহীম মুহাদ্দিছ আকবরাবাদী (মৃঃ ১০১০/১৬০০ খৃঃ) (গ) মাদরাসা সাইয়িদ শাহ মীর (মৃঃ ১০০০/১৫৯১ খৃঃ) [22] (৫) লাক্ষ্ণৌ : মদীনা হ’তে শায়খ যিয়াউদ্দীন মুহাদ্দিছ দশম শতাব্দী হিজরীতে এখানে আগমন করলে লাক্ষেনŠ ইল্মে হাদীছের কেন্দ্রে পরিণত হয়। (৬) জৌনপুর : শারকী শাসনামলে (৭৯৭-৮৮৬/১৩৯৪-১৪৭৯ খৃঃ) মুহায্যাবুদ্দীন জৌনপুরী নামে এখানে একজন মুহাদ্দিছের সন্ধান পাওয়া যায়, যিনি মক্কার হাফেয আবদুর রহমান সাখাবীর (মৃঃ ৯০২/১৪৯৫ খৃঃ) ছাত্র ছিলেন। তাছাড়া এখানকার কিছু আলিমকে ‘যুবদাতুল মুহাদ্দেছীন’ খেতাব দেওয়াতে ধারণা হয় যে, ফিক্হ ও মা‘কূলাত শিক্ষার এই শহরে দক্ষিণ ভারত অথবা হেজায হ’তে সমৃদ্ধিময় শারকী শাসনামলে কিছু মুহাদ্দিছের আগমন ঘটেছিল।[23]
দু’জন আপোষহীন ব্যক্তিত্ব :
১. শায়খ মুনাওয়ার বিন আবদুল মজীদ লাহোরী (মৃঃ ১০১০/১৬০০ খৃঃ) অতুলনীয় প্রতিভার অধিকারী এই মুহাদ্দিছ প্রথমে সম্রাট আকবর (৯৬২-১০১২/১৫৫৬-১৬০২ খৃঃ) কর্তৃক ৯৮৫/১৫৭৭ খৃষ্টাব্দে মালবের ‘ছদর’ নিযুক্ত হন। কিন্তু আপোষহীন তাওহীদী আকীদার কারণে তিনি আকবরের কোপ দৃষ্টিতে পড়েন। ৯৯৫/১৫৮৭ খৃষ্টাব্দ হ’তে গোয়ালিয়র দূর্গে পাঁচ বছর কারাবাস ছাড়াও তাঁর সকল সহায়-সম্পদ ও কিতাবপত্র বাযেয়াফ্ত করা হয়। কারাগারে থেকেও তিনি তাফসীর ও হাদীছের উপরে কয়েকখানা মূল্যবান গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। এইভাবে সরকারী নির্যাতন ভোগ করতে করতে অবশেষে তিনি দেহত্যাগ করেন।[24] আকবরের দ্বীনে এলাহীর বিরুদ্ধে সম্ভবতঃ তিনিই ছিলেন প্রথম সার্থক প্রতিবাদী কন্ঠ।
২. শায়খ আহমাদ বিন আবদুল আহাদ সারহিন্দী ওরফে ‘মুজাদ্দিদে আল্ফে ছানী’ (৯৭১-১০৩৪/১৫৬৪-১৬২৪ খৃঃ)ঃ ওমর ফারূক (রাঃ)-এর বংশধর পূর্ব পাঞ্জাবের সারহিন্দে জন্মগ্রহণকারী এই আপোষহীন ব্যক্তিত্ব ছিহাহ সিত্তাহ ও তাফসীর শাস্ত্রে ব্যুৎপত্তি অর্জনের পর ১০০৮/১৫৯৮ খৃষ্টাব্দে দিল্লী আগমন করেন।[25] এই সময় রাজদরবারে ধর্মের নামে প্রচলিত বিভিন্ন শেরেকী রেওয়াজ এবং খান্ক্বাহগুলিতে মা‘রেফাত শিক্ষার নামে তাওহীদবিরোধী শিরক ও বিদ‘আতী রসম-রেওয়াজ দেখে তাঁর প্রতিবাদী কন্ঠ সোচ্চার হয়ে ওঠে। স্বাভাবিকভাবেই তিনি দরবারী আলেম ও খানক্বাহী ছূফীদের কোপদৃষ্টিতে পড়েন। সম্রাট জাহাঙ্গীর (১০১৩-৩৫/১৬০৫-২৭ খৃঃ) তাঁকে গোয়ালিয়র দূর্গে আটক করেন। দুই তিন বৎসর পরে ভুল বুঝতে পেরে তিনি তাঁকে মুক্ত করে দিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করেন ও স্বীয় দরবারে ‘সিজদায়ে তাযীমী’সহ চালুকৃত ১১টি শেরেকী প্রথার সবগুলি বাতিল করার ওয়াদা করেন।[26] এই ঘটনার পর তিনি সর্বত্র ‘মুজাদ্দিদে আল্ফে ছানী’ বা দ্বিতীয় সহস্র হিজরী সনের ধর্মসংস্কারক’ হিসাবে খ্যাতিলাভ করেন।[27]
মুজাদ্দিদের বড় কৃতিত্ব ছিল এই যে, ফিক্হ ও মা‘কূলাতের ইল্মে অভ্যস্ত আলেমসমাজ ও জনগণকে তিনি সরাসরি কুরআন ও সুন্নাহর দিকে ফিরে আসার অনুপ্রেরণা সৃষ্টিতে সক্ষম হন। দ্বিতীয়তঃ শরীয়ত ও তরীকতকে পৃথকভাবে চিত্রিত করে মুসলিম সমাজেকে যেভাবে দ্বিধাবিভক্ত করে ফেলা হয়েছিল, নিরলস দাওয়াত ও চিঠিপত্রের মাধ্যমে এবং নিজের জীবনের বাস্তব দৃষ্টান্তের মাধ্যমে তা নিরসনে তিনি অনেকটা সক্ষম হয়েছিলেন।[28] তৃতীয়তঃ প্রচলিত তাক্বলীদী রেওয়াজের বিরুদ্ধে কঠোর মত প্রকাশ করায় মুসলমানদের মধ্যে প্রচলিত দীর্ঘকালের এই প্রথায় একটা দারুণ ধ্বস নামে,[29] যা পরবর্তী অলিউল্লাহ যুগের শুভ সূচনায় সহায়ক হয়। শায়খ আহমদের মৃত্যুর পরে তাঁর পুত্র ও শিষ্যগণ তাঁর সংস্কার কার্যক্রম চালু রাখতে চেষ্টা করেন। ১. পুত্র শায়খ মুহাম্মাদ সাঈদ (১০০৩-৭০/১৫৯৪-১৬৫৯ খৃঃ) ২. পৌত্র ফররূখ শাহ বিন সাঈদ (১০৩৮-১১১২/১৬৩৪-১৭০০ খৃঃ)। ইনি সনদসহ ৭০,০০০ হাযার হাদীছের হাফেয ছিলেন।[30] ৩. অন্যতম পুত্র মা‘ছূম বিন শায়খ আহমাদ (১০০৯-১০৮০/১৫৯৯-১৬৬৮ খৃঃ)। ৪. পৌত্র সায়ফুদ্দীন বিন মাছূম (মৃঃ ১০৯৮/১৬৮৭ খৃঃ)। ইনি ‘মুহিউস্ সুন্নাহ’ (সুন্নাতের পুনর্জীবন দানকারী) নামে খ্যাতি লাভ করেন।[31] ৫. খাজা আযম বিন সায়ফুদ্দীন (১০৬৬-১১১৪/১৬৫৫-১৭০৩ খৃঃ)। ‘ফায়যুল বারী’ নামে ইনি ছহীহ বুখারীর ভাষ্য লেখেন। ৬. শাহ আবু সাঈদ বিন ছফিউল ক্বদর (১১৯৬-১২৫০/১৭৮২-১৮৩৪) ইনি সায়ফুদ্দীন সারহিন্দীর প্রপৌত্র এবং শাহ আবদুল আযীয (১১৫৯-১২৩৯/১৭৪৬-১৮২৩) ও শাহ রফীউদ্দীন বিন অলিউল্লাহ দেহলভীর (১১৬২-১২৩৩/১৭৫০-১৮১৭) ছাত্র ও শহীদে মিল্লাত’ শাহ ইসমাঈল (১১৯৩-১২৪৬/১৭৭৯-১৮৩১)-এর সহপাঠী ও সমসাময়িক ছিলেন। এইভাবে সারহিন্দের মুজাদ্দিদ পরিবারের সাথে দিল্লীর মুজাহিদ পরিবারের মণিকাঞ্চন যোগ ঘটে, যা পরবর্তীতে ‘দাওয়াত ও জিহাদের’ কর্মসূচীর মাধ্যমে উপমহাদেশে আহলেহাদীছ আন্দোলনে আধুনিক যুগের শুভ সূচনা করে। এই সাথে আমরা দিল্লীর আরেকজন ব্যতিক্রমধর্মী মুহাদ্দিছের নাম উল্লেখ করতে পারি, যিনি ছহীহ আকীদা ও সুন্নাতের পুনর্জাগরণের জন্য দিনরাত পরিশ্রম করেছেন এবং সমসাময়িক আলেম সমাজের তাক্বলীদী আচরণের বিরুদ্ধে সদা সোচ্চার থাকতেন। যিনি ছিলেন মির্যা মাযহার জানাজানাঁ (মৃঃ ১১৯৫/১৭৮১ খৃঃ)। তাক্বলীদপন্থী আলেমদের একদেশদর্শী আচরণে বিস্ময় ও ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলতেন- ‘কি তাজ্জবের ব্যাপার যে, মা‘ছূম রাসূলের ছহীহ গায়র-মানসূখ হাদীছ মওজূদ থাকতে কাযী ও মুফতীদের ভুলের আশংকাযুক্ত ফেক্হী ফৎওয়ার উপরে আলম করা হচ্ছে।[32] অবক্ষয়ের যুগের আলোচনা শেষে আমরা এবার আহলেহাদীছ আন্দোলনের আধুনিক যুগে প্রবেশ করতে চেষ্টা পাব।
[বিস্তারিত দ্রষ্টব্য : প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব প্রণীত আহলেহাদীছ আন্দোলন : উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ, দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষিতসহ’ শীর্ষক গ্রন্থ। পৃঃ ২৩৩-২৪০]
[1]. ডঃ মুহাম্মাদ ইসহাক চারটি কেন্দ্র বলেছেন। ইলমে হাদীছ, প্রাগুক্ত পৃঃ ৮০।
[2]. প্রাগুক্ত পৃঃ ৭৬।
[3]. প্রাগুক্ত পৃঃ ৯৪-৯৫।
[4]. প্রাগুক্ত পৃঃ ৮২।
[5]. প্রাগুক্ত পৃঃ ৮৩।
[6]. রঈস আহমাদ নাদবী ও সাথীগণ, ‘জামা‘আতে আহলেহাদীছ কি তাছনীফী খিদমাত’ (বেনারস-ভারত : মাকতাবা সালাফিইয়াহ, ১ম প্রকাশ ১৪০০/১৯৮০), পৃঃ ৭।
[7].‘ইল্মে হাদীছ’ পৃঃ ৮৪।
[8]. প্রাগুক্ত পৃঃ ৮৪-৮৫।
[9]. প্রাগুক্ত পৃঃ ৮৬।
[10]. প্রাগুক্ত পৃঃ ৮৬-৮৭।
[11]. ডঃ আতীকুর রহমান কাসেমী, ‘আল্লামা শাওক নীমবী : হায়াত ও খিদমাত’ (পাটনা-ভারত ১৯৮৭) পৃঃ ১৫।
[12]. প্রাগুক্ত পৃঃ ১৫।
[13]. ফরুক মাহমুদ, প্রবন্ধ : সোনার বাংলার অঙ্গনে (ঢাকাঃ দৈনিক ইনকিলাব ৯ই আষাঢ় ১৩৯৫, ২৪শে জুন ১৯৮৮, শুক্রবার) পৃঃ ৮-৯; ১৯৮০ সালে বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন জাতীয় দৈনিক ‘ইত্তেফাক’-এর তৎকালীন সম্পাদক জনাব আখতার-উল-আলম বাগদাদ সফরের সময়ে সেখানকার লাইব্রেরীতে উক্ত পান্ডুলিপিটি দেখেন, ঐ।
[14]. বর্তমানে ঢাকার জাদুঘরে রক্ষিত নুছরত শাহের আমলে (৯২৪-৩৯/১৫১৯-৩৩ খৃঃ) সোনারগাঁয়ে ১৫২৩ খৃষ্টাব্দে নির্মিত একটি মসজিদের উৎকীর্ণ আরবী শিলালিপি হ’তে একথা অনুমান করা চলে। ঢাকা জাদুঘর, ২য় তলা ২০ নং গ্যালারী, সংগ্রহ নং ৬৬.২৬২।
[15]. Dr. Muhammad Ishaque, INDIA’S CONTRIBUTION, p 115-116; ‘ইল্মে হাদীছ’ পৃঃ ১৩৫-১৩৬।
[16]. সুলায়মান নাদভী, মা‘আরেফ (আযমগড়, উত্তর প্রদেশ-ভারত) ২৩ বর্ষ ৪র্থ সংখ্যা পৃঃ ২৯৫-৯৬; ‘ইল্মে হাদীছ’ পৃঃ ৮৯-৯০; আতীকুর রহমান, ‘শাওক নীমবী’ পৃঃ ২২।
[17]. প্রাগুক্ত টীকা সমূহ।
[18]. Dr. Muhammad Ishaque, INDIA’S CONTRIBUTION, p 66-71. ‘ইল্মে হাদীছ’ পৃঃ ৯০-৯২।
[19]. প্রাগুক্ত পৃঃ ১১৪-১৫; ঐ উর্দূ পৃঃ ১৩৫; ‘শাওক নীমবী’ পৃঃ ২৪।
[20]. ‘ইল্মে হাদীছ’ পৃঃ ৯২-৯৩, ১৬১।
[21]. প্রাগুক্ত পৃঃ ১৩১।
[22]. প্রাগুক্ত পৃঃ ১৩২।
[23]. প্রাগুক্ত পৃঃ ১৩৩।
[24]. প্রাগুক্ত পৃঃ ১৩৪।
[25]. ‘ইল্মে হাদীছ’ পৃঃ ১৬৩।
[26]. ইবরাহীম মীর শিয়ালকোটি, ‘তারীখে আহলেহাদীছ’ (ওখ্লা, নয়াদিল্লীঃ মাকতাবা তাওহীদ, ২য় সংস্করণ ১৯৮৩) পৃঃ ৩৯৮-৯৯।
[27]. প্রাগুক্ত পৃঃ ৪০০; মুহাম্মাদ হালীম, মুজাদ্দিদে আ‘যম (লাহোরঃ আশরাফ প্রেস, ৪র্থ সংস্করণ ১৯৬৮) পৃঃ ৬৯; ‘ইল্মে হাদীছ’ পৃঃ ১৬৬।
[28]. সর্বপ্রথম মাওলানা আবদুল হাকীম শিয়ালকোটি তাঁকে এই ‘লকব’ প্রদান করেন। পরে তা সর্বসাধারণ্যে চালু হয়ে যায়।-তারীখে আহলেহাদীছ পৃঃ ৩৯৯।
[29]. ‘ইলমে হাদীছ’ পৃঃ ১৬৭।
[30]. যেমন ‘তাক্বলীদ’-এর বিরুদ্ধে তাঁর প্রদত্ত বক্তব্য দ্র. মাকতূবাতে ইমাম রববানী ১/৩১৩, ১/৪৮, ১/৪০,।
[31]. ‘জুহুদ মুখ্লিছাহ’ পৃঃ ৫৭।
[32]. ‘ইল্মে হাদীছ’ পৃঃ ১৬৯।