মুসলিম জীবনে হিজরী সনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য
যহুরুল ইসলাম
ভূমিকা :
[‘পরশপাথর’ বিভাগে আমরা সচরাচর কোন বিখ্যাত অমুসলিমের ইসলাম গ্রহণের কাহিনী ও কারণ আলোকপাত করে থাকি। এরই ধারাবাহিকতায় ইতিপূর্বে মারয়াম জামীলার জীবনীও প্রকাশিত হয়েছে। তবে আজকের আয়োজন কিছুটা ভিন্ন। এ সংখ্যায় আমরা মারয়াম জামীলার একটি খোলা চিঠি অনুবাদ করলাম যা তিনি তার আমেরিকান বয়োঃবৃদ্ধ পিতা-মাতার উদ্দেশ্যে লিখেছেন। এই চিঠির মাহাত্ম্য হ’ল, এতে তিনি অত্যন্ত যুক্তিগ্রাহ্যরূপে আধুনিক পাশ্চাত্য সমাজে ইসলামের গুরুত্ব ও তাৎপর্য এবং অন্য সব ধর্ম ও মতবাদের উপর ইসলামের শাশ্বত বিজয়ের স্বরূপ উন্মোচন করেছেন তার স্বভাবসুলভ ও ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে। আমাদের আশা এই তত্ত্বীয় পত্র ‘তাওহীদের ডাক’-এর পাঠকদের চিন্তার নতুন দুয়ার খুলে দিবে এবং ইসলামের সার্বজনীনতা ও বিশুদ্ধতা সম্পর্কে তাদের আরো সচেতন করে তুলবে। -অনুবাদক]
প্রিয় মা ও বাবা,
আমি পাকিস্তানে বসবাস করছি ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে। যখন আপনারা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র প্রিয়জনদের নিয়ে গড়া এমন এক পরিবার পেয়েছেন, যা আপনাদের সুখ-শান্তিকে অনেকখানি বৃদ্ধি করেছে। আল্লাহর অশেষ রহমতে আপনারা আজ পরিণত বয়সে উপনীত হয়েছেন এবং স্বাস্থ্যপ্রদ দীর্ঘ জীবন লাভ করেছেন। যা আমার প্রত্যাশার চেয়েও অনেক বেশি। আপনারা ইতোমধ্যে আমার লেখা সব বই এবং ইসলামী সাহিত্য নিশ্চয়ই পড়েছেন, যেগুলো আমি প্রশস্ত হৃদয়ে ও খোলা মনে আপনাদের নিকট পাঠিয়েছি। সুতরাং এখন যে বিষয়টা নিয়ে আলোকপাত করতে যাচ্ছি তার ভূমিকা দেয়া নিষ্প্রয়োজন বলে মনে করছি এবং আমার কথাগুলো কোনভাবেই আপনাদের কাছে আশ্চর্যজনক বা নতুন বলে মনে হবে না।
যদি অনুধাবন করতে পারতেন যে, আপনারা কতটা সৌভাগ্যবান, তবে নিশ্চিতভাবেই বিস্ময়াভিভূত হয়ে পড়তেন। কত লম্বা সময় ধরে শারীরিকভাবে সুস্থ ও সবল আছেন এবং নিজেরাই নিজেদের যত্ন নিতে পারছেন। কিন্তু কখনো কি দীর্ঘস্থায়ী জটিল রোগ ও বার্ধক্যের অভিশাপে জর্জরিত সেই সব শত শত, হাযার হাযার আমেরিকানদের কথা ভেবে দেখেছেন, যারা উপচে পড়ে হাসপাতাল, ক্লিনিক, (যেগুলো আসলে এক একটি মর্গ) বৃদ্ধাশ্রম এবং মানসিক চিকিৎসাকেন্দ্রের বয়স্ক ওয়ার্ডগুলোতে প্রতিনিয়ত ভিড় করছে? একটি বারও কি সেই সব অসংখ্য বৃদ্ধাদের কথা চিন্তা করেছেন যারা বিধবা, যারা তাদের দুর্বিষহ একাকীত্ব জীবন অতিবাহিত করছেন অন্ধকার কুটিরে আবদ্ধ হয়ে এবং যারা নিত্য আতঙ্কগ্রস্থ থাকেন ছিনতাই, ডাকাতি আর শারীরিক আক্রমণের, যা সাধারণত তরুণ সন্ত্রাসীদের দ্বারা সংঘটিত হয়ে থাকে। যারা এই সকল অসহায়, হীনবল বৃদ্ধাদের শিকার করে বিন্দুমাত্র অনুশোচনা বা শাস্তির ভয় না করেই? পারিবারিক বন্ধন ও যৌথ পরিবার ভেঙ্গে পড়ার প্রত্যক্ষ ফল হ’ল প্রবীণদের প্রতি এরূপ অমানবিক দুর্ব্যবহার। আপনারা অবশ্যই জানেন, যে সমাজে আপনারা বেড়ে উঠেছেন এবং সমস্ত জীবন অতিবাহিত করেছেন তা আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে। প্রকৃতপক্ষে বর্তমান সভ্যতার পতনের সাথে ১ম বিশ্বযুদ্ধের পূর্বাবস্থার সুস্পষ্ট সাদৃশ্য রয়েছে, যে সময় স্বল্প কিছু বুদ্ধিজীবি এবং শিল্পী ছাড়া খুব কম মানুষই কী ঘটতে যাচ্ছে সে ব্যাপারে সচেতন ছিল। কিন্তু ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে বিশেষ করে বিগত দুই দশকে সভ্যতার এই পতন এতটাই বেড়েছে যে, তখন কারও পক্ষেই তা উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। স্বীকৃত, নির্ধারিত, আদর্শ আচার-ব্যবহারের বিপরীতে চরম নৈতিক অধঃপতন, গণমাধ্যমে প্রচারিত বিকৃত যৌনাচারের প্রতি আসক্ত, প্রবীণদের প্রতি অসদ্ব্যবহার, নতুন প্রজন্মের মধ্যে ক্রমবর্ধমান বিবাহ বিচ্ছেদের হার, বিরল হয়ে পড়া দীর্ঘস্থায়ী সুখী পরিবার, শিশু নির্যাতন, প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংস, দুষ্প্রাপ্য ও মূল্যবান সম্পদের অপচয়, মানসিক ব্যাধি ও যৌনব্যাধির মহামারী আকার ধারণ, মাদকাসক্ততা, সুরাসক্ততা, আত্মহত্যা, সন্ত্রাস ও নৈরাজ্য, অনিয়ম ও দুর্নীতি, বর্বরতা, আইন অবমাননা এই সব কিছুর জন্যই একটি অভিন্ন কারণ দায়ী। আর তা হ’ল ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ও বস্ত্তবাদের চূড়ান্ত ব্যর্থতা এবং সুনির্ধারিত ও সর্বোৎকৃষ্ট ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধের অভাব। কারণ এই মতটি সর্বস্বীকৃত যে, যদি কোন কাজের উদ্দেশ্য বা নিয়ত সঠিক না হয়, তবে তার পরিণামও হয় মন্দ।
নিঃসন্দেহে আপনারা বিরক্ত হচ্ছেন এবং এই চিঠি পড়তে একঘেঁয়েমি লাগছে। তাছাড়া আপনি আপত্তি তুলতে পারেন, যদিও আপনারা কেউই ধর্মতত্ত্ববিদ, দার্শনিক বা সমাজবিজ্ঞানী নন, তবে কেন এমন গুরুগম্ভীর বিষয় আলোচনা করে অহেতুক জ্বালাতন করছি, যখন এগুলোর সাথে আপনাদের কোন প্রত্যক্ষ সম্পর্ক নেই। সর্বোপরি আপনারা যেমনটা চেয়েছেন ঠিক তেমনি সুখী ও পরিতৃপ্ত জীবন-যাপন করছেন এবং বাকি জীবনটুকুও এইভাবে উপভোগ করাই হয়ত আপনাদের একমাত্র কামনা। আমাদের জীবনযাত্রা যদি একটি হয় এমন, তবে এটা কি চরম বোকামি নয় যে, জীবনকে আমরা শুধু আন্দন্দদায়ক ও আরামদায়ক পথচলা হিসাবে বিবেচনা করব এবং যাত্রার পরিসমাপ্তি নিয়ে একদমই চিন্তা-ভাবনা করব না? কেন আমরা জন্মেছি? জীবনের প্রকৃত অর্থ এবং উদ্দেশ্যই বা কী? কেন আমাদেরকে অবধারিতভাবে মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করতে হবে এবং মৃত্যুর পর আমাদের প্রত্যকেরই বা কী পরিণতি ঘটবে?
বাবা আপনি আমাকে একাধিকবার বলেছেন, আপনি প্রচলিত কোন ধর্ম গ্রহণ করতে পারেন না। কারণ আপনাকে বোঝানো হয়েছে যে, ধর্ম ও আধুনিক বিজ্ঞান পরস্পর সাংঘর্ষিক। বস্ত্তত, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি আমাদের বস্ত্তগত বিশ্বের অনেক অজানা তথ্য জানিয়েছে, পর্যাপ্ত আরাম-আয়েশের ব্যবস্থা করেছে এবং অনেক মারাত্মক রোগের প্রতিকার আবিষ্কার করেছে। কিন্তু বিজ্ঞান জীবন ও মৃত্যুর প্রকৃত অর্থ ব্যাখ্যা করেনি বা করতে পারেনি। বিজ্ঞান বলে-‘কিভাবে ঘটে’। কিন্তু ‘কেন ঘটে’-তার উত্তর বিজ্ঞান কখনোই দিতে পারে না। বিজ্ঞান কি নিশ্চিতভাবে জানাতে পারে কোন্টি ঠিক এবং কোন্টি বেঠিক? কোন্টি ভাল এবং কোন্টি মন্দ? কোন্টি সুন্দর এবং কোন্টি কুৎসিত? এবং এমন কেউ কি আছে, যার নিকট আমাদের সমস্ত কৃতকর্মের জবাবদিহি করতে হবে? (মানব হৃদয়ে জন্ম নেয়া) এ সকল চিরন্তন প্রশ্নের সদ্দুত্তর একমাত্র ধর্মই দিতে পারে। চূড়ান্ত ধ্বংস ও পতনের পূর্বে প্রাচীন রোম সাম্রাজ্যের যে করুণ অবস্থা হয়েছিল তার সাথে আজকের আমেরিকার বহু মিল লক্ষণীয়। চিন্তাশীল ব্যক্তিবর্গ ইতিমধ্যে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছেন যে, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ একটি সুশৃঙ্খল সমাজ বিনির্মাণের মজবুত ভিত্তি গঠনে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে তারা উদ্বিগ্নভাবে অন্য কোন পথনির্দেশের সন্ধান পেতে উন্মুখ হয়ে আছেন। কিন্তু কোথায় তা পাওয়া সম্ভব তা তাদের অজানা। ব্যাপারটি শুধুমাত্র কতিপয় সমাজ বিজ্ঞানীদের সাথেই সংশ্লিষ্ট নয়। জাতীয় বিভাজনের এই ব্যাধি আমাকে, আপনাদেরকে এবং আমাদের প্রত্যেককেই আক্রান্ত করছে।
প্রাচীন রোম সাম্রাজ্য তার সংকটপূর্ণ অবস্থা হতে পরিত্রাণ পেতে খ্রিষ্টান ধর্মের আশ্রয় নেয় এবং তার ফলে প্রায় এক সহস্র বছরেরও অধিক কাল ব্যাপী ইউরোপ শাসন করে গির্জা। গির্জার শাসন তৎকালীন রোমের অসংখ্য সামাজিক ও নৈতিক অধঃপতনের অবসান ঘটায় এবং মানুষের নৈতিক ও আত্মিক গুণাবলীর মানদন্ডকে অনেক উচ্চস্থানে অধিষ্ঠিত করে। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে গির্জা তার গৌরবময় ইতিহাস সৃষ্টির সময়েই পৌত্তলিকতা ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের সাথে আপোস করে ফেলে। এছাড়া গির্জা বিশাল যাজক সম্প্রদায় এবং এমন এক দুর্বোধ্য ধর্মতত্ত্ব বেছে নেয় যা রেনেসাঁর প্রভাব, প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের পুনর্জাগরণ এবং ফরাসী বিপ্লবের প্রগতিবাদকে প্রতিরোধ করতে পারেনি। বর্তমানে ইউরোপীয় এবং আমেরিকান খ্রিষ্টানরা যেখানে গণহারে তাদের বিশ্বাস হারিয়ে ফেলছে এবং গির্জা ত্যাগ করছে, তখন মিশনারীরা এশিয়া ও আফ্রিকায় পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদ ও শোষণের জয়গান ঘোষণা করছে। খ্রিষ্টানদের পর ইহুদীরা বর্তমানে আমেরিকার ২য় বৃহত্তম ধর্মীয় গোষ্ঠী যারা আমেরিকার রাজনীতি, অর্থনীতি এবং প্রচার মাধ্যমকে ব্যাপকভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে। কিন্তু ইহুদিরা এতই সংকীর্ণমনা যে, ধর্মান্তরিত নব্য ইহুদিদের তারা কদাচিৎ স্বাগত জানিয়ে থাকে। এটা বিশ্বজনীন ধর্ম নয় এবং তা হওয়া কখনো সম্ভবও নয়। ‘ইহুদীবাদী আন্দোলন’ হল ইহুদী জাতীয়তাবাদ এবং তাদের সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির এক নগ্ন প্রকাশ, যার ফলশ্রুতিতে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাঈল নামক ভুঁইফোড় রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন হয়েছে। ফিলিস্তীনে ইসরাঈলীদের দ্বারা সংঘটিত ভয়াবহ নৃশংসতা, লেবানন ও তার আশেপাশের এলাকায় চালানো অবর্ণনীয় আগ্রাসন, ফিলিস্তীনী আরবদের গণহত্যা এবং তাদের সকল মানবিক ও রাজনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখা সংকীর্ণ ইহুদীবাদের দুঃখজনক ফলাফল। এ জন্যই গোঁড়া ইহুদী পুরোহিতগণ কখনোই স্বীকার করে না যে, ইসরাঈল কোন পাপ করতে পারে এবং আশ্চর্যজনকভাবে তারা ইসরাঈলের সমস্ত কাজেই সমর্থন যোগান। এই সুস্পষ্ট নৈতিক এবং আধ্যাত্মিক ত্রুটিগুলোই স্বংয়ক্রিয়ভাবে ইহুদী ধর্মকে ভবিষ্যতের ধর্ম হিসাবে অযোগ্য করেছে। বর্তমানে মুসলিমরা আমেরিকার তৃতীয় বৃহত্তম এবং সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল জাতি। ইসলাম আজ শুধু এশিয়া ও আফ্রিকার সুদূর অরণ্য ও মরুভূমি অঞ্চলগুলোতে সীমাবদ্ধ নেই। আমেরিকাতেও ইসলাম আজ সুপরিচিত। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে ৩০ লাখেরও বেশি মুসলিম বাস করছেন এবং তাদের সংখ্যা অত্যন্ত দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পাচেছ। মুসলিম রাষ্ট্রগুলো থেকে আসা হাযার হাযার ছাত্র আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোতে অধ্যয়ন করছে এবং সুশিক্ষিত ও উচ্চ প্রশিক্ষিত মুসলিমরা পেশাতে নিয়োজিত আছে। বিগত দুই দশকে শত শত আমেরিকান বংশোদ্ভূত নওমুসলিম তাদের সামাজিক মর্যাদার যথেষ্ট উন্নতি ঘটিয়েছে। প্রথম দিকে অধিকাংশ নওমুসলিম কৃষ্ণাঙ্গ ছিল, যারা ইসলামের ছায়াতলে খুঁজে পেয়েছিল সম্মান, স্বীকৃতি, আত্মমর্যাদা আর জাতিগত ভ্রাতৃত্ব যেমনটা পেয়েছিলেন ম্যালকম এক্স। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অধিক সংখ্যক ইউরোপীয় বংশোদ্ভূত শ্বেতাঙ্গরা তাদের দুর্বিষহ জীবনের উত্তপ্ত জ্বালা হতে মুক্তির পথ অনুসন্ধান করতে করতে ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় নিচ্ছে, যদিও এতে তাদের অপরিসীম ত্যাগ স্বীকার করতে হচ্ছে এবং অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট সহ্য করতে হচ্ছে। তাদের মধ্যে খুব অল্প সংখ্যকই আমার মত সৌভাগ্যবান, যারা আপনাদের মত সেণহশীল পিতা-মাতা পেয়েছে। ইসলাম গ্রহণের ফলে অধিকাংশ নওমুসলিমদের সাথে তাদের অমুসলিম বাবা-মা এবং আত্নীয়-স্বজনের চরম বিরোধ ও দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। যাই হোক , গির্জা ও সিনাগগ দিন দিন প্রায় সম্পূর্ণরূপে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। কিন্তু নতুন নতুন মসজিদ ও ইসলামিক সেন্টার আমেরিকার প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ শহরে বন্দরে দ্রুত গড়ে উঠছে। মজার ব্যাপার হল, অধিকাংশ আমেরিকান নওমুসলিমরা বয়সে তরুণ এবং তারা বুদ্ধিমান ও সুশিক্ষিত। কিন্তু কী এই অধিক সংখ্যক আমেরিকানদের ইসলাম গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করছে?
প্রকৃতপক্ষে, তরুণ, বৃদ্ধ সব বয়সের আমেরিকান আজ উন্মত্ত হয়ে মুক্তির উপায় অনুন্ধান করছে। জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে তারা বুঝতে পেরেছে, যে ব্যক্তি-স্বাধীনতা তারা উপভোগ করে তা সম্পূর্ণ অর্থহীন এবং আত্মবিধ্বংসী যাতে না আছে কোন সঠিক দিকনির্দেশনা আর না আছে কোন উপকার। বাস্তবিকই, আমেরিকানদের ব্যক্তি ও জাতীয় জীবনে ধর্ম-নিরপেক্ষতাবাদ ও বস্ত্তবাদ গঠনমূলক ও যথার্থ মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। আর ইহুদী ও খ্রিষ্ঠান ধর্মও এক্ষেত্রে সফল হতে পারেনি। তাই দলে দলে মুক্তিকামী মানুষ আজ স্বভাবধর্ম ইসলামে ফিরে আসতে বাধ্য হচ্ছে। ইসলামে এসে তারা পরিপূর্ণ সুস্থ, সুন্দর, সৎ ও স্বচ্ছ জীবনাদর্শের সন্ধান পাচ্ছে। মুসলিমদের কাছে মৃত্যুই সব কিছুর পরিসমাপ্তি নয়। মুসলিমরা অধীর আগ্রহে চেয়ে থাকে এক শাশ্বত-পূর্ণাঙ্গ সুখী ও আনন্দময় জীবনের দিকে (যা আছে পরকালে)। কুরআনে আল্লাহ প্রদত্ত পথনির্দেশ এবং পূতপবিত্র নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) এর অমূল্য বাণী ও কর্ম শুধুমাত্র প্রাচ্যের কিছু মানুষের জন্যই অনুকরণীয় আদর্শ নয়। বরং এই আসমানী পথনির্দেশে আজকের ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ, অস্থিতিশীল পশ্চিমা সমাজের সকল অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও নৈতিক সমস্যারও সুন্দর সমাধান রয়েছে। উপরন্তু ইসলাম কোন গতিহীন, শীতল, নিষ্পৃহ ও নৈর্ব্যক্তিক জীবনব্যবস্থার নাম নয়। মুসলিমরা এক আল্লাহর প্রতি দৃঢ় বিশ্বাসী যিনি শুধু সৃষ্টি করেননি বরং এই মহাবিশ্ব প্রতিপালন ও শাসন করছেন। যিনি আমাদের প্রত্যেককে ভালবাসেন এবং সবকিছুর নিয়তি নির্ধারণ করেন। পবিত্র কুরআন মনে করিয়ে দেয় যে, আল্লাহ আমাদের ঘাড়ের শাহরগ অপেক্ষাও অতি নিকটতর। যেহেতু কুরআন আল্লাহর কালাম, তাই তা কখনোই পরিবর্তিত হবে না। এটা এক পূর্ণাঙ্গ বিধান যার সংশোধন, পরিমার্জন বা পরিবর্ধন করা অসম্ভব। আর মুহাম্মাদ (ছাঃ) যেহেতু শেষ নবী, তাই অন্য কোন মতবাদ তাঁর আদর্শের স্থলাভিষিক্ত হতে পারে না। কুরআন ও সুন্নাহ পাশ্চাত্য কিংবা প্রাচ্য সকল দেশের সকল বর্ণের বনু আদমের প্রতি প্রেরিত হয়েছে। কাজেই তা সর্বযুগে এবং সর্বাবস্থায় সমভাবে প্রযোজ্য যা কোনমতেই সেকেলে, অবৈজ্ঞানিক বা অনুপযুক্ত বলে পরিগণিত হতে পারে না। আপনারা দুজনেই ইতিমধ্যে বার্ধ্যক্যে উপনীত হয়েছেন এবং আপনাদের হাতে খুব একটা দীর্ঘ সময় হয়ত নেই। তথাপি এখনও সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ হারিয়ে যায়নি। যদি আপনাদের মতামত হ্যাঁ-সূচক হয়, তবে পাকিস্তান প্রবাসী এই তনয়ার সাথে আপনাদের রক্ত সম্পর্কের সাথে সাথে বিশ্বাসের সম্পর্কও যুক্ত হবে। আর তখন আমরা শুধু ইহকালেই নয় বরং পরকালের প্রতি ভালবাসাপূর্ণ চিরস্থায়ী জীবনযাপন করতে পারব। আর যদি আপনাদের সিদ্ধান্ত না-সূচক হয়, তবে আমি অত্যন্ত শঙ্কিত যে, অচিরেই আপনাদের এই সুখী, আনন্দদায়ক ও আরামপ্রদ পার্থিব জীবনের ইতি ঘটবে। আর মরণ নামক সেই অনিবার্য পরিণতি উপস্থিত হলে অনুশোচনা, অনুতাপ, আফসোস কোনই কাজে আসবে না এবং শাস্তি এতই ভয়াবহ হবে যে, তা থেকে বাঁচার কোন উপায় থাকবে না। মেয়ে হিসাবে আমি কামনা করছি যে, শেষ পর্যন্ত আপনারা এই ভয়ানক দুর্ভাগ্যের আক্রমণ হতে নিজেদের রক্ষা করতে সমর্থ হবেন। কিন্তু যে কোন সিন্ধান্ত গ্রহণের পূর্ণ স্বাধীনতা আপনাদের রয়েছে এবং পুরো ব্যাপারটাই আপনাদের অভিরুচির উপর নির্ভর করছে। আজ যে পথ বেছে নেবেন, তার উপর আপনাদের অনাগত ভবিষ্যত নির্ভর করবে। অনেক ভালবাসা ও শুভকামনা রইল।
ইতি,
আপনাদের অনুরক্ত দুহিতা
মারয়াম জামীলা
৭ম সেমিস্টার, ইংরেজী বিভাগ, নর্দার্ন ইউনিভার্সিটি, রাজশাহী ক্যাম্পাস