কুসংস্কারাচ্ছন্ন প্রান্তিক মানুষ
আব্দুল হক্ব
ড. নূরুল ইসলাম 823 বার পঠিত
আল্লাহ তা‘আলা পৃথিবীতে মানুষকে সৃষ্টি করেছেন তাঁর ইবাদতের জন্য (যারিয়াত ৫৬)।
তিনি তাদেরকে ফিতরাতী ধর্ম ইসলামের উপর সৃষ্টি করেছেন। এই ফিতরাতের কোন
পরিবর্তন-পরিবর্ধন নেই। মানুষ সৃষ্টিগতভাবেই এই ফিতরাতকে লালন করে। কিন্তু
পারিপার্শ্বিক নানা কারণ স্বভাবধর্ম গ্রহণে মানুষের জন্য প্রতিবন্ধক হয়ে
দাঁড়ায়। এজন্যইতো রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘প্রত্যেক সন্তান ফিতরাতের
(ইসলাম) উপর জন্মগ্রহণ করে। অতঃপর তাঁর পিতা-মাতা তাকে ইহুদী-খৃষ্টান বা
অগ্নিপূজকে পরিণত করে’ (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৯০)। এ সম্পর্কে একটি ঘটনার অবতারণা করা হল-
ঝিনাইদহ যেলা ‘যুবসংঘ’-এর সভাপতি আসাদুল্লাহ মিলনের বিয়েতে যুবসংঘের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসাবে আমি ও যুবসংঘের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি, ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’-এর কেন্দ্রীয় প্রশিক্ষণ সম্পাদক ও মাসিক ‘আত-তাহরীক’-এর সহকারী সম্পাদক ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম গত ১১ অক্টোবর শুক্রবার অংশগ্রহণ করি। নাছোড়বান্দার মতো চেপে ধরাতেই ঈদের পূর্ব মুহূর্তে নানা ঝক্কি-ঝামেলাকে পিছনে ফেলে আমাদেরকে তার বিয়েতে যেতে হয়েছে। বিয়ে খেয়ে ট্রেনে ফেরার পালা। ঐদিন সন্ধ্যা ৬.২৫ মিনিটের ট্রেনে চুয়াডাঙ্গা থেকে আমাদের রাজশাহী যাত্রা শুরু হল। আমাদের পাশেই বসা ছিল চুয়াডাঙ্গার ছোট্টমণি চপলাচপল বাকপটু বর্ষা। বয়স ৬/৭ হবে। কিন্তু বুদ্ধিতে ইঁচড়ে পাকা। সে তার দাদীর সাথে রাজশাহীতে এক আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে আসছে। আমাদের সাথে তাদের পরিচয় হল। ওর দাদী প্রাইমারির শিক্ষিকা, যিনি অবসর পূর্বকালীন ছুটি ভোগ করছেন। এরপর শুরু হল বর্ষার কথার বান। সে বানকে প্রতিরোধ করার ক্ষমতা কারো নেই। আমরা তার সাথে মেতে উঠলাম খুনসুটিতে। সে প্রচন্ড চঞ্চল। এই বয়সে সবাই তো একটু চঞ্চল হয়েই থাকে। কিন্তু সে ছিল মাত্রাতিরিক্ত চঞ্চল ও বাচাল। সারা পথ সে একটুও ক্লান্ত হয়নি। দাদী তাকে থামাবার চেষ্টা করলে উল্টো সে দাদীকে শাসিয়েছে। অতি আদরের নাতনীকে বেচারা দাদী আর কিইবা বলতে পারেন! আমাদের সাথে গল্পের ফাঁকে ফাঁকে সে সুন্দর বাংলা ও ইংরেজী কবিতা শুনিয়েছে। আরবী পড়তে পারে সে। সূরাও শুনিয়েছে। এভাবে পুরো পথটাই আমরা বেশ মজা করে কাটিয়েছি। সবচেয়ে মজার যে বিষয়টি ঘটেছিল, সেটি ছিল এক হিন্দু দম্পতিকে নিয়ে। আর সেই উপলক্ষেই এ লেখার অবতারণা। আমাদের পাশে বসা ছিলেন বাগমারার হিন্দু দম্পতি। তারা দুর্গোৎসব উপলক্ষে রাজশাহীতে আসছিলেন। বিভিন্ন সময় তারাও আমাদের খুনসুটি পর্বে অংশ নেয়ার চেষ্টা করছিলেন। ছোট্ট বর্ষা হিন্দু ভদ্র মহিলার মাথায় সিঁদুর ও হাতে শাঁখা দেখে বুঝতে পেরেছে যে, ওরা হিন্দু। সে তাদের সাথে খুব একটা আন্তরিকভাবে মিশছে না। যতটা মিশছে আমাদের সাথে। এক পর্যায়ে সে বলেই ফেলল, তোমাদের সাথে কথা বলব না। তোমরা হিন্দু। এ কথায় হিন্দু দম্পতি ভীষণ লজ্জা পেলেন। তাদের চেহারা লাল হয়ে গেল। আমরা ও তার দাদী বর্ষাকে বকুনি দিয়ে বললাম, এভাবে বলতে হয় না। যাহোক, বিদায়ের ঠিক পূর্ব মুহূর্তে দাদী আমাদের সাথে হিন্দু দম্পতিকেও বিদায় জানানো ও তাদের বাড়িতে বেড়াতে আসার কথা বলতে বললেন। কিন্তু সে তাদেরকে যা বলল তা শুনে আমরা রীতিমত হতবাক হয়ে গেলাম। সে বলল, ‘তোমাদের ধর্ম মিথ্যা। তোমরা নিজ হাতে মূর্তি বানিয়ে আবার ওকে লাথি মেরে নদীতে ফেলে দিয়ে আস। এটি ভন্ডামী ছাড়া কিছুই নয়’। সে আরও বলল, ‘আমাদের আল্লাহ তোমাদের ভগবানের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। তিনি এ পৃথিবীর সবাইকে সৃষ্টি করেছেন’। কথাগুলো যেন হিন্দু দম্পতির অন্তরে শেল বিদ্ধ করল। কিন্তু ছোট্ট বাচ্চা হওয়ার কারণে তারা তাকে কিছু বলতেও পারল না। ঈষৎ হাসি দিয়ে পরিবেশকে হালকা করার জন্য মহিলার স্বামী বলেই ফেলল, তোমাদের আল্লাহ সত্যিই শক্তিশালী। স্বামীর চেয়ে হিন্দু মহিলা এ কথা শুনে বেশি অগ্নিশর্মা হয়ে উঠেছিল। কিন্তু অসুস্থ থাকার কারণে তেমন কিছু না বলে তিনি শুধু বললেন, আমি সুস্থ থাকলে তোমার সাথে ঝগড়া করতাম। ট্রেন ইতিমধ্যেই রাজশাহী রেলস্টেশনে এসে পৌঁছল। আমরা ট্রেন থেকে নেমে তাদেরকে বিদায় জানালাম। কিন্তু বর্ষার কথা আজো ভুলতে পারছি না। ছোট্ট একটি বাচ্চার মুখ দিয়ে যে কথাগুলো সেদিন বেরিয়েছিল তা ছিল সত্যিই তার ফিতরাতের বহিঃপ্রকাশ।
নূরুল ইসলাম
ভারপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় সভাপতি
বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ