হাফেয ছালাহুদ্দীন ইউসুফ (রহ.)-এর কুরআনী খেদমত
মুখতারুল ইসলাম
ভূমিকা :
পৃথিবীর প্রত্যেকটি বণী আদম সফলতার অমেবষণে ঘুরে বেড়ায়। এমন কোন মানুষ নেই যে জীবনে সফলতা চায় না। তবে সকলে একই ধরনের সফলতা চায় না। কেউ চায় অর্থের সফলতা, কেউ চায় জ্ঞানের সফলতা। কেউ স্বাস্থ্যের, কেউ আত্ম-মর্যাদার আবার কেউ চায় ক্ষমতার। কিন্তু আল্লাহ রাববুল ‘আলামীনের ঘোষণায় সফল একমাত্র তারাই, যারা প্রকৃত মুমিন। তিনি বলেন-قَدْ أَفْلَحَ الْمُؤْمِنُونَ ‘নিশ্চিতভাবে সফলকাম হয়েছে মুমিনরা’ (মুমিনূন ২৩/১)। একজন ছাত্র যখন সফলতার শীর্ষে পৌঁছে যায়, তখন পরিলক্ষিত হয় তার মধ্যে অনেকগুলো আচরণ। যা তাকে সফলতার শীর্ষে পৌঁছে দিয়েছে। আর পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছে ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের অনেকগুলো আচরণের কথা বর্ণিত হয়েছে, যার অনুসরণকারীকে সফল কর্মীদের কাতারে পৌঁছে দিতে পারে। নিমেণ কর্মী পরিচিতি ও সফল কর্মীর আচরণবিধি তুলে ধরা হল :
কর্মীর পরিচয় :
যিনি কাজ করেন তিনিই কর্মী। নেতা-কর্মী পরস্পর সাক্ষাৎ হলে তাৎক্ষণিকভাবে উভয়ের মাঝে যে চেতনা বা অনুভূতির সৃষ্টি হয়, তাকে কর্মী বলে। পৃথিবীর সৃষ্টি থেকে কর্মীর ধারাবাহিকতা চলে আসছে এবং এ ধারাবাহিকতা ক্বিয়ামত পর্যন্ত চলবে। সরকারী-বেসরকারী, ইসলামী-অনৈসলামী, অফিস-আদালত, কল-কারখানা, স্থলপথ, আকাশপথ ও নৌপথ এক কথায় পৃথিবীর সবকিছুই কর্মী দ্বারা পরিচালিত হয়। প্রত্যেক কর্মক্ষেত্রের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আচরণবিধি নির্ধারণ করে। যেখানে কর্মীদের মধ্যে ইসলামের সামান্যতম আচরণ লক্ষ্য করাতো দূরের কথা, বরং অনেক আচরণ ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক। এমতাবস্থায় পৃথিবীর সকল মানুষকে ও সকল কর্মক্ষেত্রের কর্মীদেরকে আল্লাহ প্রদত্ত ও রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) প্রদর্শিত আদর্শের দিকে আহবানকারী আচরণবিধিই মানুষকে মুক্তির সন্ধান দিতে পারে।
১. বিশুদ্ধ নিয়ত :
বীজ যত উন্নত হয়, ফসল তত ভাল হয়। কর্মীর নিয়ত বা সংকল্প যত ভাল ও সুদৃঢ় হবে, তার কর্মফল ততবেশী সাফল্যের আলো দেখবে। যেমন হাদীছে এসেছে,
عَنْ عُمَرَ بْنَ الْخَطَّابِ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم إِنَّمَا الأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ وَإِنَّمَا لِكُلِّ امْرِئٍ مَا نَوَى فَمَنْ كَانَتْ هِجْرَتُهُ إِلَى اللَّهِ وَرَسُولِهِ فَهِجْرَتُهُ إِلَى اللَّهِ وَرَسُولِهِ وَمَنْ كَانَتْ هِجْرَتُهُ لِدُنْيَا يُصِيبُهَا أَوِ امْرَأَةٍ يَتَزَوَّجُهَا فَهِجْرَتُهُ إِلَى مَا هَاجَرَ إِلَيْهِ.
ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেছেন, নিশ্চয়ই সমস্ত আমল নিয়তের উপর নির্ভরশীল এবং প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য তাই হবে, যার জন্য সে নিয়ত করবে। কাজেই যার হিজরত আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে হবে, তার হিজরত আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকেই হবে। আর যার হিজরত হবে দুনিয়া লাভের উদ্দেশ্যে কিংবা কোন নারীকে বিবাহ করার উদ্দেশ্যে, তাহলে তার হিজরত সে দিকেই গণ্য হবে, যে দিকে সে হিজরত করেছে (মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/১)।
২. গঠনতন্ত্র ও কর্মপদ্ধতির পূর্ণ অনুসরণ :
পৃথিবীর প্রত্যেকটি সেক্টরে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ও কর্মপন্থা আছে। স্ব স্ব সেক্টরের নীতিমালা অনুসরণ না করলে কখনোই সফল হওয়া সম্ভব নয়। যেমন বর্তমান অত্যাধুনিক আবিষ্কার হল, কম্পিউটার, যোগাযোগ মিডিয়া মোবাইল বা টেলিফোন। প্রত্যেকটির জন্য একটি গঠনতন্ত্র বা সংবিধান আছে। সেটা অনুসরণ না করলে কম্পিউটার open হবে না। একটেল মোবাইলের কোড নম্বর গ্রামীণ মোবাইলে দিলে বা কোড নম্বর বসাতে ভুল করলে কাঙ্খিত ব্যক্তির সাথে আলাপচারিতায় সফল হওয়া যায় না। তেমনিভাবে আমরা মুসলিম, আমাদের সংবিধান পবিত্র কুরআন। এর পূর্ণ অনুসরণ না করলে প্রকৃত মুসলিম হওয়া সম্ভব নয় এবং পরকালীন মুক্তি পাওয়া একেবারেই অসম্ভব। অতএব একজন কর্মীর একান্ত কর্তব্য হল, সাংগঠনিক গঠনতন্ত্র ও কর্মপদ্ধতি পূর্ণভাবে মেনে চলা। আর এ গঠনতন্ত্রে কর্মীর যে আচরণবিধি বা গুণাবলী রয়েছে তা নিজের মধ্যে বিদ্যমান রাখা।৩. লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নির্ধারণ করা :
প্রত্যেকটি ব্যক্তির প্রতিটি কাজের পিছনে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থাকে। লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যহীন ব্যক্তি কখনো সফল হতে পারে না। একজন পাইলট যেমন ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে যাত্রী ভর্তি বিমান নিয়ে বিভিন্ন দেশে একটি লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সামনে রেখে যাত্রা করে যথাসময়ে গন্তব্যস্থলে পৌঁছায়। অনুরূপভাবে একজন কর্মীকে অবশ্যই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অনুসরণ করতে হবে। আল্লাহর বিধান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে আত্মনিয়োগ করা কর্মীদের একমাত্র উদ্দেশ্য থাকে আল্লাহর জন্য নিবেদিতপ্রাণ হওয়া। এ মর্মে আল্লাহ বলেন- قُلْ إِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ ‘হে নবী (ছাঃ) আপনি বলুন! নিশ্চয়ই আমার ছালাত, আমার কুরবানী, আমার জীবন, আমার মরণ সবই জগৎসমূহের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য নিবেদিত’ (আন‘আম ৬/১৬২)।
৪. সময়ের সদ্ব্যবহার :
প্রকৃতপক্ষে ‘সময়’ হচ্ছে মানুষের জীবনের এমন এক অমূল্য সম্পদ, যার তুলনা পৃথিবীর অন্য কোন সম্পদের সাথে হতে পারে না। মহান আল্লাহ এ সময় সৃষ্টি করে আমাদের জীবনের প্রতিটিক্ষেত্রে স্বতন্ত্রভাবে বণ্টন করে দিয়েছেন। যাতে সময়ের যথাযথ ব্যবহার করে উভয় জীবনে সফলতা লাভ করতে পারে। বলা হয়ে থাকে Time and tide wait for none ‘সময় এবং স্রোত কারও জন্য অপেক্ষা করে না’। অতএব যারা সময়ের সাথে সদ্ব্যবহার করতে পেরেছে, তারাই সফলতা অর্জন করেছে। প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ Dr. Ebrahim Kazim-এর মন্তব্য এক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য- ‘Throughout our lives, Allah has fixed few examinations few hurdles and obstacles to test and judge our real worth and capability to represent him on earth. So that whoever, emerges successful, will enter Allah's party in the Here-after’. ‘আল্লাহ তা‘আলা আমাদের জীবনের প্রতি ক্ষেত্রেই কিছু বাধা-বিপত্তি বা পরীক্ষা নির্ধারণ করে রেখেছেন। যাতে পৃথিবীর বুকে তাঁর প্রতি আমাদের প্রকৃত ঈমান বা বিশ্বাসকে যাচাই করে নিতে পারেন। আর যারা এই পরীক্ষা সমূহে সাফল্যের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে, তারাই পরকালীন জীবনে মহান আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ করতে সক্ষম হবে’।
ঘড়ির কাঁটার টিক টিক শব্দে ক্রমাগত সেকেন্ড পার হচ্ছে। অতঃপর মিনিট, ঘণ্টা, সপ্তাহ, মাস তারপর বছর। এভাবেই ক্রমে আমরা পেঁŠছে যাচ্ছি জীবনের শেষ ক্রান্তিলগ্নে। আল্লাহ বলেন- وَالْعَصْرِ- إِنَّ الْإِنْسَانَ لَفِي خُسْرٍ ‘মহাকালের শপথ। নিশ্চয়ই সকল মানুষ ক্ষতির মধ্যে নিমজ্জিত’ (আছর ১০৩/১-২)। সুতরাং সময় আল্লাহ প্রদত্ত এক মহা মূল্যবান নে‘মত, যা ক্বিয়ামতের দিন মানুষের যাবতীয় কৃতকর্মের সাক্ষ্য বহন করবে।
এজন্য এর সর্বোত্তম ব্যবহারে কর্মীকে সর্বদা উদ্বিগ্ন থাকতে হবে। কারণ প্রতিনিয়তই সময় অতিক্রান্ত হচ্ছে। অতিক্রান্ত সময় আর কখনও কোনদিন ফিরে আসবে না। উদাহরণস্বরূপ, আজকের দিনটিই পরের দিন গতকালে পরিণত হচ্ছে। যদি সময়কে আলোর গতির সাথে তুলনা হয়, তবে প্রতি সেকেন্ডে ১ লক্ষ ৮৬ হাযার মাইল গতিবেগ নিয়ে আমরা আমাদের চূড়ান্ত ঠিকানা মৃত্যুর দিকে ছুটে চলেছি। পরীক্ষার্থী ছাত্রটি যদি পরীক্ষার হলের নির্দিষ্ট সময়টুকু অন্য খেয়ালে ব্যয় করে, তাহলে সে যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়, দুনিয়ার এই পরীক্ষাগারে অজানা আয়ুস্কালের অনির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে মানুষ যদি তার নিজ কর্ম সঠিকভাবে সম্পাদন না করে, তবে সেও চরম ক্ষতির মধ্যে নিমজ্জিত হবে। ইহকালে সে যেমন কল্যাণ লাভে ব্যর্থ হবে, পরকালেও তেমনি জান্নাত হতে মাহরূম হবে। সময়ের গুরুত্ব সম্পর্কে রাসূল (ছাঃ) আমাদেরকে উৎসাহ বাণী উপহার দিয়েছেন।
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ رضى الله عنهما قَالَ قَالَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم نِعْمَتَانِ مَغْبُونٌ فِيهِمَا كَثِيرٌ مِنَ النَّاسِ الصِّحَّةُ وَالْفَرَاغُ.
আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, দু’টি নে‘মতের ব্যাপারে অধিকাংশ মানুষ উদাসীন। আর তা হচ্ছে- স্বাস্থ্য ও অবসর সময় (বুখারী হা/৬৪১২; ইবনু মাজাহ হা/৪১৭০; মিশকাত হা/৫১৫৫)। অতএব সময়ের যথাযথ ব্যবহার করা প্রত্যেক কর্মীর একান্ত কর্তব্য, যা একজন সফল কর্মীর আচরণবিধির অন্যতম শ্রেষ্ঠ গুণাবলী।
৫. নেতার প্রতি আনুগত্য :
নেতৃত্ব-আনুগত্য বা নেতা-কর্মীর সুসম্পর্ক হ’ল, একটি দেহের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ এবং দেহে চলমান রক্তের ন্যায়। পৃথিবী সৃষ্টিলগ্ন থেকে এ কথা দিবালোকের ন্যায় সত্য যে, কোন প্রতিষ্ঠানের সাফল্যের পশ্চাতে আছে উক্ত প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ও তার অধীনস্থ কর্মীদের মাঝে নিবিড় সম্পর্ক। আল্লাহ বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ وَالرَّسُولِ إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ ذَلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيلًا.
‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর, রাসূলের আনুগত্য কর এবং তোমাদের মধ্যকার নেতার আনুগত্য কর। যদি কোন ব্যাপারে তোমাদের মাঝে মতানৈক্য সৃষ্টি হয়, তাহলে আল্লাহ ও তার রাসূলের দিকে বিষয়টিকে ফিরিয়ে দাও, যদি তোমরা আল্লাহ ও পরকালের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে থাক। এটাই কল্যাণকর এবং সর্বোত্তম সমাধান’ (নিসা ৪/৫৯)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,
عَنِ ابْنِ عُمَرَ عَنِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم أَنَّهُ قَالَ عَلَى الْمَرْءِ الْمُسْلِمِ السَّمْعُ وَالطَّاعَةُ فِيمَا أَحَبَّ وَكَرِهَ إِلاَّ أَنْ يُؤْمَرَ بِمَعْصِيَةٍ فَإِنْ أُمِرَ بِمَعْصِيَةٍ فَلاَ سَمْعَ وَلاَ طَاعَةَ.
ইবনু ওমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, প্রত্যেক মুসলিমের উপর নেতার কথা শ্রবণ করা ও আনুগত্য করা আবশ্যক। চাই তা কারো পসন্দ হোক বা অপসন্দ হোক। যতক্ষণ পর্যন্ত না তিনি আল্লাহর নাফরমানীর আদেশ দেন। আল্লাহর নাফরমানীর আদেশ দেওয়া হলে তা শ্রবণ করা ও তার আনুগত্য করার অবকাশ নেই (মুসলিম হা/৪৮৬৯; নাসাঈ হা/৪২০৬)। অতএব সফল কর্মীর সর্বোত্তম আচরণবিধি হল যথাযথভাবে নেতার আনুগত্য করা।
৬. পরিশ্রমী হওয়া :
সফলতার পশ্চাতে রয়েছে কঠিন পরিশ্রম। পরিশ্রম ছাড়া সাফল্য অর্জন সম্ভব নয়। যে যতবেশী পরিশ্রম করে সে ততবেশী সাফল্যের দিকে এগিয়ে যায়। অতএব কর্মীর একটি উল্লেখযোগ্য আচরণবিধি হল পরিশ্রমী হওয়া ও শ্রমকে হাসিমুখে বরণ করা । মহানবী (ছাঃ) অত্যন্ত পরিশ্রমী ছিলেন। যার ফলে মাত্র ২৩ বছরের ব্যবধানে সাফল্যের চরম শীর্ষে উপনীত হয়েছিলেন। মহান আল্লাহ বলেন,
إِنَّا فَتَحْنَا لَكَ فَتْحًا مُبِينًا- لِيَغْفِرَ لَكَ اللَّهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِكَ وَمَا تَأَخَّرَ وَيُتِمَّ نِعْمَتَهُ عَلَيْكَ وَيَهْدِيَكَ صِرَاطًا مُسْتَقِيمًا- وَيَنْصُرَكَ اللَّهُ نَصْرًا عَزِيزًا.
‘নিশ্চয়ই আমি আপনার জন্য এমন একটা বিজয় দান করেছি, যা সুস্পষ্ট। যাতে আল্লাহ আপনার অতীত ও ভবিষ্যৎ ত্রুটি সমূহ মার্জনা করে দেন এবং আপনার প্রতি তার নে‘মত পূর্ণ করেন ও আপনাকে সরল পথে পরিচালিত করেন এবং আপনাকে দান করেন বলিষ্ঠ বিজয়’ (ফাতাহ ৪৮/১-৩)। আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন,
إِذَا جَاءَ نَصْرُ اللَّهِ وَالْفَتْحُ- وَرَأَيْتَ النَّاسَ يَدْخُلُونَ فِي دِينِ اللَّهِ أَفْوَاجًا- فَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ وَاسْتَغْفِرْهُ- إِنَّهُ كَانَ تَوَّابًا.
‘যখন আসবে আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় এবং আপনি মানুষকে দলে দলে আল্লাহর দ্বীনে প্রবেশ করতে দেখবেন, তখন আপনি আপনার পালনকর্তার পবিত্রতা বর্ণনা করুন এবং তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন। নিশ্চয়ই তিনি বেশী বেশী তওবা কবুলকারী’ (নাছর ১১০/১-৩)।
৭. সর্বদা আল্লাহর উপর ভরসা :
একজন কর্মী সকল কাজে আল্লাহর উপর ভরসা করবে। কারণ তার কাজটি শুরু ও শেষ করা আল্লাহর সাহায্য ছাড়া সম্ভব নয়। আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন কর্মীর কিছু আচরণের বর্ণনা দিয়ে বলেন-
فَبِمَا رَحْمَةٍ مِنَ اللَّهِ لِنْتَ لَهُمْ وَلَوْ كُنْتَ فَظًّا غَلِيظَ الْقَلْبِ لَانْفَضُّوا مِنْ حَوْلِكَ فَاعْفُ عَنْهُمْ وَاسْتَغْفِرْ لَهُمْ وَشَاوِرْهُمْ فِي الْأَمْرِ فَإِذَا عَزَمْتَ فَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُتَوَكِّلِينَ.
‘আল্লাহর রহমতেই আপনি তাদের জন্য কোমল হৃদয়ের হয়েছেন। পক্ষান্তরে আপনি যদি রূঢ় ও কঠিন হৃদয়ের হতেন, তাহলে তারা আপনার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত। কাজেই আপনি তাদের ক্ষমা করুন এবং তাদের জন্য মাগফিরাত কামনা করুন। কাজে-কর্মে তাদের সাথে পরামর্শ করুন। অতঃপর যখন কোন কাজের সিদ্ধান্ত নিবেন, তখন আল্লাহ তা‘আলার উপর ভরসা করুন। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর উপর ভরসাকারীদের ভালবাসেন’ (আলে ইমরান ৩/১৫৯)।
মহানবী (ছাঃ) মক্কা বিজয়ের সময় ক্ষমার যে দৃষ্টান্ত পেশ করেছেন, তা বিশ্ব ইতিহাসে বিরল। মহানবী (ছাঃ)-এর প্রতিশোধ নেওয়ার ক্ষমতা ছিল। কিন্তু প্রতিশোধ না নিয়ে উদারচিত্তে ক্ষমা করে দিয়ে বিশ্ববাসীর কাছে ক্ষমার নযীর স্থাপন করেন। সুতরাং কর্মীর আচরণে ক্ষমার দৃষ্টান্ত থাকা ও সর্বদা আল্লাহর উপর ভরসা করা যরূরী।
৮. নিজেকে মডেল হিসাবে দাঁড় করানো :
আদর্শবান কর্মী সমাজ সংস্কারে এক অন্যতম অনুষঙ্গ। যে জাতির সদস্য সংখ্যা যতবেশী আদর্শবান, সে জাতি ততবেশী উন্নত ও মডেল। আর সর্বোত্তম আদর্শ বিশ্বনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর মধ্যেই নিহিত রয়েছে। যেমন আল্লাহ বলেন, لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللَّهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ ‘তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের মধ্যে সর্বোত্তম আদর্শ নিহিত রয়েছে’ (আহযাব ৩৩/২১)। কর্মী যে আদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে চায়, সেই আদর্শের মডেল তাকে হতে হবে। যেমন বিশ্ববাসীর জন্য মডেল আমাদের নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)। অতএব ইসলামী আন্দোলনের একজন সফল কর্মীর আচরণবিধি হবে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহ অর্থাৎ রাসূলের ছায়া স্বরূপ।
৯. উন্নত চরিত্র :
বর্তমান যান্ত্রিক সভ্যতার এই ছোট্ট বিশ্বে সবচেয়ে বেশী সংকট দেখা দিয়েছে উন্নত চরিত্রের। ইংরেজিতে একটি কথা আছে-
‘When money is lost, nothing is lost
When health is lost, something is lost
When character is lost, everything is lost’
যে কর্মী চারিত্রিক সংকট দূর করে নৈতিকতার ভিতকে যত বেশী মযবুত করতে পারবে, সে ততবেশী সফলতার দিকে ধাবিত হবে। বিশেষ করে ইসলামী আন্দোলনে নৈতিক ও চারিত্রিক ভিত্তি অত্যন্ত সুদৃঢ় হতে হবে। নতুবা রাসূল (ছাঃ)-এর আদর্শ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।
১০. নিজেকে দায়িত্বশীল মনে করা :
নিজে যেমন কর্মী, তেমনি দায়িত্বশীলও। অর্পিত দায়িত্ব অত্যন্ত সচেতনতার সাথে পালন করা একজন কর্মীর দায়িত্বশীলতার পরিচয়। যে কর্মী দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে, সে সফল হয়। যে দায়িত্ব অলসতা করে, সে সফলতার আলো দেখতে পারে না, বরং সে সংগঠন ও জাতির জন্য বোঝা। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন- أَلاَ كُلُّكُمْ رَاعٍ وَكُلُّكُمْ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ ‘সাবধান! তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল। সুতরাং তোমাদের দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে’ (মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৩৬৮৫)। মহান আল্লাহ বলেন,
يَا أَيُّهَا الرَّسُولُ بَلِّغْ مَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ مِنْ رَبِّكَ وَإِنْ لَمْ تَفْعَلْ فَمَا بَلَّغْتَ رِسَالَتَهُ وَاللَّهُ يَعْصِمُكَ مِنَ النَّاسِ إِنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْكَافِرِينَ.
‘হে রাসূল (ছাঃ)! আপনার প্রতিপালকের নিকট হতে যা অবতীর্ণ করা হয়েছে, তা প্রচার করুন। যদি না করেন, তবে আপনি রিসালাতের দায়িত্ব পালন করলেন না। আর আল্লাহ আপনাকে মানুষ হতে রক্ষা করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ কাফেরদেরকে সৎপথ প্রদর্শন করেন না’ (মায়েদা ৫/৬৭)।
১১. কথা ও কাজে মিল থাকা :
কর্মীর আচরণবিধির মধ্যে উল্লেখযোগ্য আচরণ হল, কথা ও কাজের মিল থাকা। আল্লাহ বলেন-يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لِمَ تَقُولُونَ مَا لَا تَفْعَلُونَ- كَبُرَ مَقْتًا عِنْدَ اللَّهِ أَنْ تَقُولُوا مَا لَا تَفْعَلُونَ ‘হে মুমিনগণ! তোমরা যা কর না, তা কেন বল? তোমরা যা কর না, তা বলা আল্লাহর কাছে খুবই অসন্তোষজনক’ (ছফ্ফ ৬১/২-৩)। হাদীছে এসেছে,
عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم َمَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ فَلْيَقُلْ خَيْرًا أَوْ لِيَصْمُتْ.
আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান রাখে, সে যেন ভাল কথা বলে, নতুবা চুপ থাকে (মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৪২৪৩)।
১২. আদর্শের উপর দৃঢ়ভাবে অটল থাকা :
আদর্শ আল্লাহর পক্ষ থেকে আসে। অনাদর্শ মানুষের মস্তিষ্কপ্রসূত। আদর্শ-অনাদর্শ, সত্য-মিথ্যা, আলো-অন্ধকার, হক্ব-বাতিল প্রত্যেকটি বিপরীতমুখী। তাই সরল সোজা পথ থেকে কোনভাবেই বিচ্যুত হওয়া যাবে না। শত বাধার পাহাড় যেন মূল আদর্শ থেকে চুল পরিমাণ টলাতে না পারে। তাই দ্বীন প্রতিষ্ঠার কর্মীদের আচরণ হবে মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর জীবনের ত্যাগপুত আদর্শ। ইমাম ইবনে তাইমিয়া, শাহ ইসমাঈল শহীদ (রহঃ) এবং বাংলার মানচিত্রে ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’-এর আমীর প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল গালিব-এর উপর ২০০৫-২০০৮ পর্যন্ত যে অত্যাচার নির্যাতন ত্যাগের জ্বলন্ত উদাহরণ। তাদেরকে বিন্দুমাত্র আদর্শচ্যুত করা যায়নি।
১৩. কাজ করা ও করানো :
নিজে কাজ করার পাশাপাশি অন্যকে দিয়ে কাজ করানোর বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সার্বিক কাজকে দু’টি অংশে ভাগ করে একভাগ নিজের অংশে রাখা এবং বাকী অংশ অন্যদের দিয়ে করানো। যেমন সহকর্মী, কর্মচারী, বন্ধু-বান্ধব, স্বামী-স্ত্রী, ভাই-বোন এমন পর্যায়ে দ্বিতীয়জনকে কাজ দিয়ে সাফল্যের দিকে এগিয়ে যাওয়া।
১৪. পরিকল্পনা মাফিক কাজ করা :
পরিকল্পনা প্রত্যেক সেক্টরে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পরিকল্পনা ছাড়া কোন কাজের সফলতা প্রত্যাশা করা যায় না। আল্লাহর ঘোষণা-
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَلْتَنْظُرْ نَفْسٌ مَا قَدَّمَتْ لِغَدٍ وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ خَبِيرٌ بِمَا تَعْمَلُونَ.
‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। প্রত্যেক ব্যক্তির উচিত আগামীকালের জন্য সে কী প্রেরণ করে, তা চিন্তা করা। আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় কর। তোমরা যা কর আল্লাহ সে সম্পর্কে খবর রাখেন’ (হাশর ৫৯/১৮)।
পরিকল্পনাকে প্রধান তিনটি অংশে ভাগ করা যায়। যথা : (ক) কী কাজ করা হবে? (খ) কিভাবে করা হবে? (গ) কত সময়ে করা হবে? কর্মী তার লক্ষ্যে পেঁŠছার জন্য কী কী করতে চাই, কোন্ কাজ কত সময়ে করতে চাই, সেটা নির্ধারণ করা। যেমন আমরা সময়কে হিসাব করি বছর, মাস, পক্ষ, সপ্তাহ, ঘণ্টা, মিনিট ও সেকেন্ড ইত্যাদিতে। আর একজন সফল কর্মীও তার কাজকে সময়ের এসব ধাপের সাথে সমন্বিত করে নিবে।
১৫. ক্যালেন্ডারযুক্ত ডাইরি ব্যবহার করা :
কর্মীর জীবন সময়ের সাথে যুক্ত ও বিভক্ত থাকে। সুতরাং তার কাছে ক্যালেন্ডার সংযুক্ত ডাইরি রাখা অত্যন্ত যরূরী। একজন কর্মীর যে যে তারিখে বিশেষ বিশেষ কর্মসূচী থাকবে, তা চিহ্নিত ও লিপিবদ্ধ করে রাখবে। এ ডাইরি কর্মীর প্রতিদিনের কর্মসূচীগুলো স্মরণ করে দিবে। এছাড়া একটি ইয়ার পস্নানার ক্যালেন্ডার সামনে টানিয়ে রাখা যেতে পারে। এর মাধ্যমেও উপকৃত হওয়া যায়।
১৬. তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহারের যোগ্যতা অর্জন :
বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ একটি বিন্দু থেকেও ছোট। তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহারে বিশ্ব আজ হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। একজন কর্মী বর্তমান সময়ে এ উন্নত প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে সফলতার দিকে এগিয়ে যেতে পারে। একজন কৃষক সারা দিন কঠোর পরিশ্রম করে ভাল ফসল ফলাতে পারছে না। আবার একই অঞ্চলের অন্য একজন কৃষক কম শ্রমে একই পরিমাণ জমিতে কাঙ্খিত ফলন লাভ করছে। কারণ সে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়োগ করেছে। কর্মী তার সহকর্মীর নিকট একটি পত্র পাঠাবে। দেশে যে ‘ডাক প্রথা’ আছে তাতে রাজশাহী থেকে ঢাকা যেতে দ্রম্নতগামী সার্ভিসে মিনিমাম একদিন লাগবে। সেখানে যদি তার প্রযুক্তির ব্যবহার জানা থাকে, তাহলে সে ১/২ সেকে-- পত্রটি ই-মেইল করে কাঙ্খিত ব্যক্তির নিকট পৌঁছাতে পারে। অতএব বর্তমান সময়ের অত্যাধুনিক আবিষ্কার মোবাইল, কম্পিউটার, ফোন, ফ্যাক্স, ল্যাপ্টপ ইত্যাদি ব্যবহারের দক্ষতা থাকলে কর্মী তার কাজে সফলতা দেখতে পারে।
১৭. সহজ-সরল ভাষায় বক্তব্য :
মানুষের মধ্যে যত ভাল আচরণ আছে তন্মধ্যে অন্যতম হল সুন্দর করে কথা বলা। শ্রেষ্ঠ মনীষীগণ সুভাষী। আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) ছিলেন শ্রেষ্ঠ সুভাষী। তিনি সহজ-সরল ভাষায় ও হৃদয়স্পর্শী কথা বলতেন। ছাহাবায়ে কেরামও সুভাষী ছিলেন। সুন্দর কথা দিয়ে তারা বিশ্ব জয় করেছিলেন। যে সব মনীষী বিশ্বজোড়া জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন, তারা সবাই সুভাষী কিংবা সুলেখক। এ মর্মে মূসা (আঃ)-কে লক্ষ্য করে মহান আল্লাহ বলেন,
اذْهَبَا إِلَى فِرْعَوْنَ إِنَّهُ طَغَى- فَقُولَا لَهُ قَوْلًا لَيِّنًا لَعَلَّهُ يَتَذَكَّرُ أَوْ يَخْشَى ‘তোমরা দু’জন ফেরাউনের কাছে যাও। নিশ্বয়ই সে বিদ্রোহী হয়ে গেছে। আর তার সাথে কোমলভাবে কথা বলবে। যাতে করে সে উপদেশ গ্রহণ করে কিংবা ভীত হয়ে যায়’ (ত্বোয়া-হা ২০/৪৩-৪৪)। আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন, وَقُولُوا لِلنَّاسِ حُسْنًا ‘মানুষের সাথে ভাল ও সুন্দর কথা বল’ (বাক্বারাহ ২/৮৩)। অন্যত্র বলেন- فَقُلْ لَهُمْ قَوْلًا مَيْسُورًا ‘তাদের সাথে দয়া, সহানুভূতির সাথে কথা বল’ (বনী ইসরাঈল ১৭/২৮)।
১৮. ধৈর্য ধারণ :
কর্মীর অন্যতম আচরণ হল, পাহাড়সম ধৈর্যের দৃষ্টান্ত স্থাপন করা। ব্যক্তি পৃথিবীতে জীবিত অবস্থায় যেখানেই অবস্থান করুক না কেন তাকে ছবর করতেই হবে। উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, অহি-র বিধান তথা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর আদর্শ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যাবতীয় বাধা উপেক্ষা করে সামনে অগ্রসর হতে ধৈর্যের বিকল্প নেই। যেমন আমাদের নবী (ছাঃ) ছিলেন ধৈর্যের পাহাড়। তিনি সর্বপ্রকার বিপদাপদে ধৈর্য ধারণ করতেন। বিপদ, মুছীবত, দুঃখ-কষ্ট, অত্যাচার-নির্যাতন, ক্ষুধা-দারিদ্র, অভাব-অনটন, মানুষের দেওয়া জ্বালা-যন্ত্রণা সবই অকাতরে সহ্য করেছেন। কোন কিছুই তার ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙ্গতে পারেনি। বরং তা কাজের গতিকে আরো বাড়িয়েছিল। এ মর্মে আল্লাহর ঘোষণা-
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اسْتَعِينُوا بِالصَّبْرِ وَالصَّلَاةِ إِنَّ اللَّهَ مَعَ الصَّابِرِينَ- وَلَا تَقُولُوا لِمَنْ يُقْتَلُ فِي سَبِيلِ اللَّهِ أَمْوَاتٌ بَلْ أَحْيَاءٌ وَلَكِنْ لَا تَشْعُرُونَ- وَلَنَبْلُوَنَّكُمْ بِشَيْءٍ مِنَ الْخَوْفِ وَالْجُوعِ وَنَقْصٍ مِنَ الْأَمْوَالِ وَالْأَنْفُسِ وَالثَّمَرَاتِ وَبَشِّرِ الصَّابِرِينَ- الَّذِينَ إِذَا أَصَابَتْهُمْ مُصِيبَةٌ قَالُوا إِنَّا لِلَّهِ وَإِنَّا إِلَيْهِ رَاجِعُونَ.
‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা ধৈর্য ও ছালাতের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন। আর যারা আল্লাহর রাস্তায় নিহত হয়, তাদেরকে তোমরা মৃত বল না, বরং তারা জীবিত। কিন্তু তোমরা তা বুঝ না। অবশ্যই আমি তোমাদেরকে পরীক্ষা করব কিছুটা ভয়, ক্ষুধা, মাল, জানের ক্ষতি ও ফল-ফসল বিনষ্টের মাধ্যমে। তবে সুসংবাদ দাও ছবরকারীদের। যখন তারা বিপদে পতিত হয় তখন বলে, নিশ্চয়ই আমরা সবাই আল্লাহর জন্য এবং আমরা সবাই তারই সান্নিধ্যে ফিরে যাব’ (বাক্বারাহ ২/১৫৩-১৫৬)।
১৯. বৈধ পন্থায় আয়-ব্যয় সম্পন্ন করা :
হালাল রূযী উপার্জন করা কর্মীর অন্যতম আচরণ। যা খেয়ে মানুষকে বাঁচতে হয় এবং জীবনের সার্বিক খরচ বহন করতে হয়। রিযিক বৈধ পন্থায় আয় করতে হবে। অনুরূপভাবে বৈধ পথে খরচ করতে হবে। অবৈধ পন্থায় আয় করা বৈধ নয়। তেমনি হালাল জীবিকা অপচয় করাও বৈধ নয়। সার্বিক ইবাদত কবুলের আবশ্যিক পূর্বশর্ত হল হালাল রূযী। হালাল রূযী থেকে আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করতে হবে। কোনভাবে কার্পণ্য করা যাবে না। মানুষ ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি-বাকরি ও শ্রমের মাধ্যমে যে অর্থ সম্পদ উপার্জন করে, সেটাকে আল্লাহ তা‘আলা ‘আল্লাহর অনুগ্রহ’ বলে অভিহিত করেছেন। এ মর্মে আল্লাহ বলেন,
فَإِذَا قُضِيَتِ الصَّلَاةُ فَانْتَشِرُوا فِي الْأَرْضِ وَابْتَغُوا مِنْ فَضْلِ اللَّهِ وَاذْكُرُوا اللَّهَ كَثِيرًا لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ
‘অতঃপর ছালাত সমাপ্ত হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহর অনুগ্রহ তালাশ কর ও আল্লাহ্কে অধিক স্মরণ কর, যাতে তোমরা সফলকাম হও’ (জুম‘আ ৬২/১০)।
২০. জ্ঞানার্জন :
কর্মী যে বয়সেরই হোক না কেন তার জন্য জ্ঞানার্জনের ধারা অব্যহত রাখা অত্যন্ত যরূরী। প্রতিদিনের সময়সূচীতে আদর্শিক শিক্ষা অর্জন করা যায় এমন বিষয়াবলী অন্তর্ভুক্ত করে জ্ঞানার্জন করা। বিশেষ করে তাওহীদ ও শিরক, সুন্নাত ও বিদ‘আত, ইত্তেবা ও তাক্বলীদ, ইসলাম ও জাহেলিয়াত ইত্যাদি বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা অর্জন করা। আল্লাহ পাক সর্বপ্রথম যে আয়াত অবতীর্ণ করে পবিত্র কুরআনের সূচিনা করেছিলেন তা হল,
اقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِي خَلَقَ- خَلَقَ الْإِنْسَانَ مِنْ عَلَقٍ- اقْرَأْ وَرَبُّكَ الْأَكْرَمُ- الَّذِي عَلَّمَ بِالْقَلَمِ- عَلَّمَ الْإِنْسَانَ مَا لَمْ يَعْلَم.
‘পাঠ করুন, আপনার পালনকর্তার নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাটবদ্ধ রক্ত থেকে। পাঠ করুন, আপনার পালনকর্তা মহা দয়ালু, যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন। শিক্ষা দিয়েছেন যা সে জানত না’ (আলাক্ব ৯৬/১-৫)। এছাড়াও হাদীছে জ্ঞানার্জন সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা আছে। অতএব কর্মীকে জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে সফলতার দিকে এগিয়ে যেতে হবে। এটি তার প্রধান আচরণ।
২১. সংগ্রামী মনীষীদের ইতিহাস আয়নার মত স্মরণ রাখা :
কর্মীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ আচরণ হল হক্বপন্থীদের অনুসরণ এবং হক্ব প্রতিষ্ঠায় তাদের ইতিহাসকে আয়নার ন্যায় সামনে রাখা। হক্ব ও বাত্বিলের চিরন্তন দ্বন্দ্বে হক্বকে বিজয়ী করতে অদম্য সাহস, দৃঢ় মনোবল ও সীমাহীন ত্যাগের দৃষ্টান্ত একান্ত প্রয়োজন। আল্লাহর ঘোষণা وَلَا تَهِنُوا وَلَا تَحْزَنُوا وَأَنْتُمُ الْأَعْلَوْنَ إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ ‘তোমরা হীনবল হয়োনা, দুঃখিত হয়োনা, বিশ্বাসী হলে তোমরাই শ্রেষ্ঠ’ (আলে ইমরান ৩/১৩৯)। এক্ষেত্রে ঈমানের বলে বলিয়ান হয়ে, তাওহীদের অতন্দ্রপ্রহরী হয়ে যারা শিরক, বিদ‘আত ও কুসংস্কার মুক্ত পৃথিবী গড়তে অগ্রণী ভূমিকা রেখে গেছেন তাদের কথা প্রণিধানযোগ্য। পৃথিবী আজ তাদেরকে চিরস্মরণীয় ও বরণীয় করে রেখেছে। অনুসরণীয় ব্যক্তিগণ হলেন- আবুবকর, ওমর, ওছমান, আলী, খালিদ বিন ওয়ালীদ, মূসা বিন নুছায়ের, তারিক বিন যিয়াদ, ইমাম ইবনে তাইমিয়া, ইমাম আহমাদ, ইমাম বুখারী, শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিছ দেহলভী, আল্লামা নাছিরুদ্দীন আলবানীসহ শাহ ইসমাইল শহীদ, নেছার আলী তিতুমীর প্রমুখ।
তাই বলব, পৃথিবী আজ অন্যায়-অশান্তি, হানাহানি, দ্বন্দ-সংঘাত, যুদ্ধ-বিগ্রহ, ভেদাভেদ, বিবাদ-বিসম্বাদ, যুলুম-শোষণ, নির্যাতন-নিপীড়ন, শিরক-বিদ‘আত, তাক্বলীদের মহামারী, স্বার্থবাদী দ্বান্দ্বিক রাজনীতি, সূদ ভিত্তিক অর্থনীতির বিষমাখা ছোবলে বিধ্বস্ত। এ অবস্থার অবসানের জন্য প্রয়োজন ইসলামী সমাজ বিপস্নব। আর সেই অনিবার্য বিপস্নবের জন্য চাই আল্লাহর কাছে সাহায্যপ্রার্থী নিবেদিত প্রাণ একদল সুদক্ষ কর্মীবাহিনী। সফল কর্মীর আচরণবিধির উপর স্বল্পপরিসরে আলোচনা উপস্থাপন করা হল। মহান আল্লাহর নিকট ফরিয়াদ, হে আল্লাহ! তোমার যমীনে তোমার দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য ছাত্র ও যুবসমাজকে ইসলামী আচরণে সমৃদ্ধ করে দাও। তাদেরকে শক্তি, সাহস ও আসমানী সাহায্য দান কর-আমীন। মহান আল্লাহর বাণী,
وَلَقَدْ أَرْسَلْنَا مِنْ قَبْلِكَ رُسُلًا إِلَى قَوْمِهِمْ فَجَاءُوهُمْ بِالْبَيِّنَاتِ فَانْتَقَمْنَا مِنَ الَّذِينَ أَجْرَمُوا وَكَانَ حَقًّا عَلَيْنَا نَصْرُ الْمُؤْمِنِينَ
‘আপনার পূর্বে আমি রাসূলগণকে তাঁদের নিজ নিজ সম্প্রায়ের কাছে প্রেরণ করেছি। তারা তাদের কাছে সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী নিয়ে আগমন করেন। অতঃপর যারা পাপী ছিল, তাদের আমি শাস্তি দিয়েছি। সুতরাং মুমিনদের সাহায্য করা আমার দায়িত্ব’ (রূম ৩০/৪৭)। [চলবে]
অধ্যাপক মুহাম্মাদ আকবার হোসাইন
আরবী বিভাগ, হামিদপুর আল-হেরা কলেজ, যশোর ও সাবেক কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ