আব্দুর রাযযাক বিন ইউসুফ

তাওহীদের ডাক ডেস্ক 1459 বার পঠিত

[‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’-এর কেন্দ্রীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী’ নওদাপাড়া মাদরাসার মাননীয় অধ্যক্ষ আব্দুর রাযযাক বিন ইউসুফ গত ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৩-এ হজ্জব্রত পালনের উদ্দেশ্যে রাজশাহী থেকে রওয়ানা হন। হজ্জ সফর থেকে ফিরে আসার পর তাঁর স্মৃতিচারণমূলক সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন ‘তাওহীদের ডাক’-এর সহকারী সম্পাদক বযলুর রহমান]

তাওহীদের ডাক : মুহতারাম, আপনার হজ্জ সফর কেমন হয়েছে? সফরসঙ্গী কতজন ছিলেন?

আব্দুর রাযযাক বিন ইউসুফ : আল-হামদুলিল্লাহ ওয়াছ ছালাতু ওয়াস সালা-মু আলা রাসূলিল্লাহ। ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৩ হজ্জ সফরের উদ্দেশ্যে রাজশাহী থেকে বের হই। সফরসঙ্গী হিসাবে আমরা ছিলাম মূলতঃ পাঁচজন। আমি, আমার আম্মা এবং মুযাফফর বিন মুহসিন, তার আববা ও আম্মা। রাজশাহী ট্রেন স্টেশনে গিয়ে রাজশাহী শহর ও তার আশেপাশের কয়েক জনের সাথে সাক্ষাৎ হয়। সব মিলিয়ে আমরা প্রায় পনের জন রাজশাহী থেকে রওয়ানা হই। ফজরের সময় ঢাকায় পৌঁছায় এবং হাজী ক্যাম্পে ফজরের ছালাত আদায় করি। অতঃপর ২৭ তারিখ শুক্রবার সন্ধ্যায় জেদ্দার উদ্দেশ্যে রওয়ানা করি।

আমরা ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’ সাতক্ষীরা সাংগঠনিক যেলার সভাপতি আব্দুল মান্নান পরিচালিত ‘আল-ইখলাছ হজ্জ কাফেলা’-এর মাধ্যমে গিয়েছিলাম। উক্ত কাফেলায় আমরা মোট ১২১ জন ছিলাম। উল্লেখ্য যে, ২০০৭ সালে প্রথম হজ্জ সফরে গিয়েছিলাম। এটা বলার কারণ হল, সেবারের চেয়ে এবারের হজ্জ সফরের অনুভূতি অনেকটাই ভিন্ন। কারণ জায়গাগুলো ছিল পরিচিত। চলতে, ফিরতে  ও ঘুরতে কোন অসুবিধা হয়নি। হজ্জের হুকুম-আহকাম পালন এবং এ বিষয়ে আলোচনা খুব বেশী হয়েছে। তাছাড়া বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের সাথে পরিচয়, সাক্ষাৎ, সাংগঠনিক প্রোগ্রাম ইত্যাদি অনেক বেশি হয়েছে। সব মিলিয়ে আগের চেয়ে এবারের সফর অনেক সুন্দর হয়েছে। ফালিল্লা-হিল হামদ।

তাওহীদের ডাক : সুষ্ঠুভাবে হজ্জ  সম্পাদনের ক্ষেত্রে সঊদী সরকারের আয়োজন, ব্যবস্থপনা ও আতিথেয়তা কেমন ছিল?

আব্দুর রাযযাক বিন ইউসুফ : সঊদী সরকার হাজীদের সেবা দানের জন্য খুবই তৎপর। আল-হামদুলিল্লাহ। এ ব্যাপারে সরকারের কোন ঘাটতি ছিল না। জেদ্দা বিমান বন্দরে অবতরণের পর থেকে হাজীদের জন্য বিশ্রাম, পানি, ওযূসহ সার্বিক বিষয়ে ব্যবস্থাপনা ছিল প্রশংসনীয়। মক্কা পৌঁছা পর্যন্ত দীর্ঘ সময়ে তাদের আতিথেয়তা ও আপ্যায়ন ছিল নযর কাড়ার মত। এভাবেই মিনা, ‘আরাফা, মুজদালিফা, জামারা সর্বত্র সরকারের পক্ষ থেকে সার্বিক ব্যবস্থা করা হয়েছে। যেমন সর্বত্র পর্যাপ্ত পরিমাণে পানির ব্যবস্থা এবং তীব্র গরমের কারণে হাজীদের উপর ঠা-া পানি এক্সপ্রে করার সুব্যবস্থা। এছাড়া মাত্র ২/৩ দিনের জন্য তাঁবুগুলো এয়ারকান্ডিশন সেট করা, মাত্র একদিনের জন্য সম্পূর্ণ আরাফার মাঠে সুন্দর তাঁবু, পর্যাপ্ত পানির ব্যবস্থা সত্যিই মুগ্ধ করেছে। ‘আরাফা ও মুজদালিফায় দুই তলা, তিন তলা বিশিষ্ট ওযূ, গোসল সহ টয়লেটের ব্যবস্থাও করেছে খুব উন্নত মানের। সঊদী সরকার মসজিদে হারামের চতুর্পার্শ্বে ছালাতের জায়গা বৃদ্ধি করছে এবং সুন্দর করে বিল্ডিং তৈরি করছে যাতে ভবিষ্যতে হাজীদের কোন সমস্যা হবে না। একই সঙ্গে লক্ষ লক্ষ হাজী সেখানে অবস্থান করলেও প্রাকৃতিক কাজের কোন সমস্যা হয় না। তাদের খাওয়া-দাওয়া ও ছালাতের ব্যবস্থা পর্যাপ্ত পরিমাণে রয়েছে।

যারা সরকারীভাবে হজ্জ করতে যান, মক্কায় পৌঁছার পর খাওয়ার বিষয়টি তাদের উপর ছেড়ে দেয়া হয়। আর যারা বিভিন্ন কাফেলার অধীনে যান তাদেরকে কাফেলার পক্ষ থেকেই রান্না করে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা হয়। তবে অনেক কাফেলা হোটেলেও ব্যবস্থা করে থাকে। রান্না করা ঝুঁকির কাজ। স্বাভাবিকভাবে রান্না করতে দেয়া হয় না। তবে যারা কষ্ট করে রান্না-বান্না করে তাদের খাওয়াটা অনেক রুচিসম্মত হয়। যে সমস্ত কাফেলার পক্ষ থেকে হোটেলে খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয় তা অনেক সময় রুচিসম্মত হয় না।

তাওহীদের ডাক : দেশে ও সঊদী আরবে প্রতিষ্ঠিত হাজী ক্যাম্প  এবং হজ্জ কাফেলা সম্পর্কে কিছু বলবেন কি?

আব্দুর রাযযাক বিন ইউসুফ : দুঃখজনক হলেও সত্য যে, দেশে ও বিদেশে যে সমস্ত হজ্জ কাফেলা রয়েছে তারা প্রায়ই বিদ‘আতী এবং প্রতারক। হাজীদের সাথে থেকে, ‘আরাফা, মুজদালিফা ও মিনায় অবস্থান করে আমরা বুঝতে পেরেছি প্রায় শতকরা আটানববই জন মু‘আল্লিমই হাজীদের সাথে খারাপ আচরণ করছে। তারা হাজীদেরকে শিরক-বিদ‘আত করার জন্য বাধ্য করছে। অনেক মু‘য়াল্লিম অসুস্থ হাজীকে মক্কায় হোটেলে রেখে দিচ্ছে। আর মিনা, মুজদালিফা এমনকি ‘আরাফার কাজও মু‘য়াল্লিমরাই করে দিচ্ছে। অথচ ‘আরাফার মাঠে উপস্থিত না হলে হজ্জই হবে না। অন্যদিকে অনেক মু‘আল্লিম হাজীদের নিকট থেকে টাকা নিয়ে কুরবানী না করেই বলছে, আমরা আপনার পক্ষ থেকে কুরবানী করে দিয়েছি। আরেকটি বড় প্রতারণা হ’ল, তারা হাজীদেরকে বলছে, কোথাও কোন ভুল হয়ে যেতে পারে তাই সতর্কতা মূলক সকলকে একটি করে দম (কুরবানী) দিতে হবে। অর্থাৎ একটি দুম্বা ক্রয়ের মত টাকা দিতে হবে। এভাবে টাকার নেশায় সন্দেহের উপর শরী‘আত বাস্তবায়ন করতে তারা বাধ্য করছে। অথচ সন্দেহের উপর কোন ইবাদতই নেই। এটা কত বড় অন্যায়!

হাজী ক্যাম্পগুলোর কথা আর কী বলব! সবই শিরক-বিদ‘আতে পরিপূর্ণ। এবারে হাজী ক্যাম্পে বেশ কিছু আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটেছে। প্রথমতঃ আমি ক্যাম্পে প্রবেশ করেই আসবাবপত্র বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য যাচ্ছি। তখন একজন লোক আমাকে বলছে, আপনার পায়ে চামড়ার স্যান্ডেল কেন? আপনাকে দম দিতে হবে। আমি বললাম, আমার তো হজ্জ-ওমরা চালুই হয়নি? তখন লোকটি বলছে, আপনাকে চপ্পল পরতে হবে। আপনি তো চামড়ার স্যান্ডেল পরে আছেন। আমি বললাম, ইন্না-লিল্লা-হ.. ইহরাম বাঁধার মীক্বাত বা স্থান হল ইয়ালামলাম। যখন বিমান ইয়ালামলামের কাছে পৌঁছবে, তখন ইহরাম বাঁধতে হবে। আমি তখন ইহরাম বাঁধব, যখন বিমানের পক্ষ থেকে মীক্বাতের ঘোষণা করা হবে। সেখান থেকে ওমরা চালু হবে। আর তখন থেকে যদি কোন ভুলত্রুটি হয়ে যায়, তাহলে দম দিতে হবে। লোকটি চলে গেল।

দ্বিতীয়তঃ একটু পরেই দেখছি, বিমানবন্দরেই ‘লাববাইকা আল্লাহুম্মা লাববাইক’ বলে চিৎকার করছে। অথচ হজ্জ-ওমরার কাজই শুরু হয়নি। এই গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতে বিদ‘আত মিশ্রিত হচ্ছে। এই হজ্জ কবুল হবে না। কারণ যখন ইবাদতে বিদ‘আতের মিশ্রণ হয়, তখন তা কবুল হয় না। যতক্ষণ পর্যন্ত সে বিদ‘আত পরিহার না করবে। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি বিদ‘আত করল কিংবা বিদ‘আতীকে আশ্রয় দিল আল্লাহ ক্বিয়ামতের মাঠে তার নফল ও ফরয কোন ইবাদতই কবুল করবেন না (মুসলিম হা/৩৮৬৭)। যারা তালবিয়া পড়াচ্ছে তাদের একজনকে আমি বললাম, আপনারা এখানে কেন তালবিয়া পড়াচ্ছেন? এটাতো হাজী ক্যাম্প। তখন লোকটি উত্তর দিল, ঢাকা হাজী ক্যাম্প শুধু নয়, বাড়ী থেকে ইহরাম বাঁধলেও হবে। কতবড় মূর্খতা। ‘লাববাইকা আল্লাহুম্মা’-এর অর্থ হল, ‘হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে হাযির’। মীক্বাতে যাওয়ার আগেই কিভাবে তালবিয়া পড়া যায়? আল্লাহর কাছে সে কিভাবে হাযির হল? মূলকথা হাজী ক্যাম্পগুলোর অবস্থা খুবই নাজুক, খুবই জটিল। আল্লাহ হেদায়াত দান করুন। আল্লাহুম্মা আমীন!

হজ্জ করার জন্য কাফেলা শর্ত নয়। নিজ অভিজ্ঞতার আলোকেও হজ্জ করতে পারে। কিন্তু প্রায় মানুষ অপরিচিত, অজানা। তাই সফরে একজন আরেকজনের সহযোগিতা ছাড়া চলা দুঃসাধ্য ও কষ্টকর। জেদ্দা, মক্কা, ‘আরাফা, মিনা ও মুজদালিফাসহ সবই অপরিচিত জায়গা। প্রায় কোটি মানুষের সমাগম। কে কোথায় যাবে, কোথায় থাকবে বুঝতে পারে না। কাজেই এ অবস্থায় তারা একজন আরেকজনের উপর আশ্রয়ের জন্য জোরালোভাবে স্বরণাপন্ন হয়ে থাকে। এজন্য মানুষ কাফেলা খুঁজে নিচ্ছে।

তাওহীদের ডাক : হজ্জের বিশুদ্ধ হুকুম-আহকাম ও বাস্তবে পালনের মধ্যে কোনরূপ বৈপরীত্য পরিলক্ষিত হয়েছে কী?

আব্দুর রাযযাক বিন ইউসুফ : হ্যাঁ, হজ্জ পালন করা আর বাস্তব নিয়ম-পদ্ধতির মাঝে অনেক বৈপরীত্য পরিলক্ষিত হয়েছে। এজন্য দায়ী মু‘আল্লিমদের হজ্জের আহকাম সম্পর্কে না জানা। এক্ষেত্রে হাজ্জীরাও কম দোষী নন। কারণ তারা অলসতা করে বিশুদ্ধ কাফেলা তালাশ করেন না। কিছু কিছু বিষয়ে সরকারী সিদ্ধান্তের কাছে জিম্মি। যেমন হাদীছ অনুযায়ী আটই যিলহজ্জ ফজরের ছালাতের পরে স্ব স্ব স্থান থেকে মিনায় যেতে হবে। অথচ আগের দিন রাত আটটা নয়টার দিকেই মিনায় নিয়ে যাচ্ছে। আর হাজীরা নতুন হওয়ার কারণে তারা যেতে বাধ্য হচ্ছেন। কারণ রাস্তা-ঘাট যেমন জানা নেই, তেমনি তাঁবুর অবস্থানও চেনেন না। অতঃপর হাদীছ অনুযায়ী মিনাতে স্ব স্ব ওয়াক্তে কছর করে জমা ছাড়াই যোহর, আছর, মাগরিব, এশা এবং শেষে ফজরের ছালাত আদায় করে ‘আরাফার মাঠের দিকে রওনা দিতে হবে। অথচ মু‘আল্লিমরা বলছেন, ৯ তারিখ ফজরের ছালাতের পরে রওনা হয়ে ‘আরাফার মাঠে পৌঁছা যাবে না। কারণ রাস্তায় ভীড় হবে। তাই তারা ৮ই যিলহজ্জ এশার ছালাতের পরপরই মিনা থেকে ‘আরাফায় নিয়ে যাচ্ছে। এভাবে সেখানে সারা রাত থাকতে হচ্ছে। আর ফাঁকা জায়গা হওয়ার কারণে মশার কামড় খেয়ে রাত কাটা হচ্ছে। এটা সুন্নাত পরিপন্থী, যা হাজীদেরকে করাই লাগছে।

অন্যদিকে ‘আরাফার দিনটি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ দিন। এই দিন আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে যত ক্ষমা করেন, অন্যকোন দিনে এত ক্ষমা করেন না। ‘আরাফার দিন যত শেষ হয়ে যেত রাসূল (ছাঃ) তত বিনয়ের সাথে হাত তুলে কান্নাকাটি করতেন। কিন্তু দুঃখজনক হল, মু‘আল্লিমরা যোহরের পর থেকেই কিংবা বিকাল তিনটা, সাড়ে তিনটার পর পরই ‘আরাফার মাঠ ছাড়তে বাধ্য করছে। যখন আল্লাহর কাছে কিছু বলা ও ক্ষমা নেওয়ার সময় তখনই তারা জোর করে গাড়িতে উঠাচ্ছে। এ কারণে সেখানে হৈচৈ, বিতর্ক, অস্থিতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে।

আরো একটি বিষয় হল, রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাত অনুযায়ী আরাফার মাঠে যোহর ও আছর ছালাত এক আযানে দুই ইক্বামতে দুই দুই রাক‘আত করে জমা ও ক্বছর করে পড়তে হয়। কোন সুন্নাত নেই অন্য কোন ছালাতও নেই। কিন্তু অধিকাংশ মু‘আল্লিম উক্ত সুন্নাতের বিরোধিতা করে যোহরের ছালাত সুন্নাত সহ যোহরের সময় চার রাক‘আত পড়ছে। আবার আছরের সময় চার রাক‘আত পড়ছে। এছাড়াও কেউ কেউ অন্য ছালাতও পড়ছে।

তাওহীদের ডাক : পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে হাজীরা সেখানে আগমন করেন। তাদের মধ্যে কোন ভুলত্রুটি লক্ষ্য করলেন কি?

আব্দুর রাযযাক বিন ইউসুফ : সব দেশের লোকই হজ্জে নিয়ম-কানূনে ভুল করছেন। তারা বিভিন্ন স্থানে যে সমস্ত দো‘আ পড়ছে সেগুলো সবই মানুষের তৈরি করা। কুরআন ও ছহীহ হাদীছের সাথে কোন সম্পর্ক নেই। যেমন ইরান, ইরাক, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, নাইজেরিয়া, সিরিয়া, মিসর, লন্ডন, আমেরিকা প্রভৃতি। তবে সব দেশেরই অল্প কিছু লোক ছহীহ পদ্ধতিতে হজ্জ করছেন এবং বিদ‘আতী কর্মকান্ডকে বাধা দিচ্ছেন। নাইজেরিয়ার ওমর নামের এক হাজীকে হাত ছেড়ে দিয়ে ছালাত পড়তে দেখলাম। তিনি মালেকী মাযহাবের মানুষ। লোকটিকে আলেম মনে হল। পরে আমি সালাম ও কুশল বিনিময়ের পর বললাম, আপনি আরবী বুঝেন? বললেন হ্যাঁ। কথপোকথনে বুঝলাম আরবী সম্পর্কে ভাল জানেন। কুরআন ও হাদীছ সম্পর্কে  ভাল জ্ঞান রাখেন। আমি তাকে বললাম, হাত ছেড়ে ছালাত আদায় করেন কেন? তিনি বললেন, এটা ইমাম মালেক (রহঃ)-এর ফৎওয়া। আমি বললাম, তিনিতো একজন ব্যক্তি মাত্র। যদিও এটা ইমাম মালেকের ফৎওয়া নয়! অতঃপর আমি বললাম, রাসূল (সাঃ)-এর সুন্নাত হল হাত বুকের উপর বেঁধে ছালাত আদায় করা। আর ইমাম মালেকের ফৎওয়া হাত ছেড়ে দিতে হবে। তাহলে রাসূল (ছাঃ)-এর পদ্ধতি আর একজন মানুষের পদ্ধতি কি এক সমান? তখন তিনি বললেন, ইমাম মালেক তো একজন বড় ইমাম, তার কথা উপেক্ষা করতে হবে কেন? হাদীছেও তো কিছু ত্রুটি আছে। যেমন কোনটা জাল, কোনটা যঈফ, আবার কোনটা মুরসাল। সর্বোপরি তিনি বলতে চাইলেন, হাদীছের চেয়ে ইমাম মালেকের বক্তব্যকেও প্রাধান্য দেয়া যায়। আমি বললাম, এটা মহা অন্যায়। কখনোই একজন ব্যক্তির কথাকে হাদীছের উপর প্রাধান্য দেওয়া যাবে না। তখন তিনি আমাকে আল্লাহর কাছে তওবা করতে বললেন। এটা একটি আশ্চর্যজনক ঘটনা। একেই বলে আক্বীদা। এখানে একটি বিষয় বলে রাখা ভাল যে, সমগ্র পৃথিবীতে আহলেহাদীছ বলে যারা যেখানে অবস্থান করছেন তারাই প্রকৃত শরী‘আতকে আজও অাঁকড়ে ধরে আছেন। ইনশাআল্লাহ ক্বিয়ামত পর্যন্ত তারা রাসূল (ছাঃ)-এর রেখে যাওয়া এই আমানতকে যথাযথভাবে সংরক্ষণ করবেন।

তাওহীদের ডাক : কা‘বা ঘর ও মাত্বাফ সম্পর্কে কিছু বলুন।

আব্দুর রাযযাক বিন ইউসুফ : কা‘বা ঘরের পরিধি অনেক বড়। মাত্বাফ হল, যে স্থানে ত্বাওয়াফ করা হয়। মূলতঃ কা‘বা ঘরের চতুর্দিকেই মাত্বা-ফ। হাজীদের সুবিধার জন্য ২য় ও ৩য় তলাতেও ত্বাওয়াফের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এমনকি অবম ব্যক্তিদের জন্য কিংবা হুইল চেয়ারে যারা ত্বাওয়াফ করছেন তাদের জন্য সম্পূর্ণ পৃথকভাবে ২য় তলার মত উপরে ব্যবস্থা করা হয়েছে। মাত্বাফে নারী-পুরুষ এক সাথে ত্বাওয়াফ করছে। এভাবেই রাসূল (ছাঃ)-এর যুগ থেকে চলে আসছে। তবে কোনদিন কখনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। কল্পনাও করা যাবে না। কারণ সবাই আল্লাহর ঘরের কাছে গিয়ে বিনয়ের সাথে শুধু আল্লাহর রহমত, মাগফেরাত ও প্রার্থনার জন্যই ব্যস্ত থাকে। আযানের আধা ঘন্টা আগ থেকে মহিলাদেরকে মাত্বাফ থেকে নির্দিষ্ট স্থানে যাওয়ার জন্য নিয়ন্ত্রণ করা হয়। কারণ আযানের পর মহিলাদের নির্দিষ্ট স্থানে যাওয়া খুবই অসম্ভব।

কা‘বা ঘরের বড় একটি বৈশিষ্ট্য হল, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, তোমরা দিন-রাতে কোন সময়ই মানুষকে কা‘বা ঘরে ছালাত আদায় করতে ও ত্বাওয়াফ করতে নিষেধ করো না। তবে ব্যতিক্রম দেখলাম যে, মানুষ দিন-রাত ত্বাওয়াফ করছে কিন্তু ছালাত আদায় করছে না। হয়ত তারা এটা জানে না। সেখানে অধিকাংশ মানুষই বেশী বেশী কুরআন তেলাওয়াত করছে। কিন্তু ছালাত আদায় করছে না। অথচ সেখানে যেকোন ছালাত আদায় করলে এক লক্ষ গুণ বেশী নেকী হবে। আর কুরআন যেখানেই পড়া হোক নেকী সমান। অথচ কা‘বা ঘর সর্বদা নফল ছালাত ও ত্বাওয়াফ করারই জায়গা। তারা মনে করে তিন সময়ে এখানে ছালাত আদায় করা যাবে না। অথচ এটা ভুল। উল্লেখ্য যে, কা‘বা ঘরের উপর পাখি উড়ে না, তার দিকে তাকিয়ে থাকলে নেকী হবে, এগুলো সব কুসংস্কার। কারণ দিন-রাত কাবা ঘরের উপর দিয়ে পাখি উড়ছে, পাখি বসছে।

তাওহীদের ডাক : ত্বাওয়াফ, সাঈ, হাজরে আসওয়াদ চুম্বন, যমযমের পানি পানের সময় নিজের মধ্যে কেমন অনভূত হয়েছে? একটু বলবেন কি?

আব্দুর রাযযাক বিন ইউসুফ : ইহজগতে এটা এক অন্য অনুভূতি, যা অন্যকে বুঝানো বা দেখানো সম্ভব নয়। যারা একনিষ্ঠভাবে হজ্জ সম্পাদন করেন তারাই বিষয়টি উপলব্ধি করেন। সকলেই হাজারে আসওয়াদে চুম্বন করার চেষ্টা করেন। তবে এটা সবার পক্ষে সম্ভব হয় না। সরকারীভাবে সিরিয়াল করে ব্যবস্থা করা হলে, হয়তো সারাদিনে কয়েক লক্ষ মানুষ চুম্বন করার সুযোগ পেতেন। নারী-পুরষ মিলে অসংখ্য মানুষ আবেগে ঠেলে ঢুকছে, হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। যার যত শক্তি আছে তা প্রয়োগ করছে। যা শরী‘আত সম্মত নয়। অনুকূল পরিবেশ হলে চুম্বন করবে, নইলে হাত দিয়ে স্পর্শ করবে অন্যথা দূর থেকে ‘আল্লাহু আকবার’ বলে হাত দ্বারা ইশারা করবে। এটাই সুন্নাত। আমরা শরী‘আতকে মেনে চলারই চেষ্টা করেছি। জোর করে ভিতরে যাওয়ার চেষ্টা করিনি। তবে মানুষ অনেক দূর-দূরান্ত থেকে আসে। এটা তাদের দ্বীনি বা ধর্মীয় আবেগ। যদি চুম্বন করতে পারতাম! তাহলে মনটা তৃপ্তি পেত, শান্তি পেত! উল্লেখ্য যে, রুকনে ইয়ামনী স্পর্শ করা এবং হাজারে আসওয়াদে চুম্বন বা স্পর্শ কিংবা হাত দ্বারা ইশারা করা সুন্নাত। আর ‘মুলতাযাম’ অর্থাৎ হাজারে আসওয়াদ ও কা‘বা ঘরের দরজার মাঝের অংশে বুক ও গাল লাগিয়ে একটু সময় অবস্থান করাও সুন্নাত। এ কারণে এখানে মানুষ বেশী ভীড় করছে। কিন্তু মানুষ না বুঝে কা‘বা ঘরের দরজার কাছে ভিড় করছে, হাত উপরে দিয়ে ঝুলে থাকছে। এছাড়া কা‘বা ঘরের অন্যত্র চুম্বন করা, জায়মানায, রুমাল দিয়ে স্পর্শ করা এবং বরকতের জন্য অন্য কোন বস্ত্ত স্পর্শ করে বাড়ী নিয়ে আশা এগুলো সব কুসংস্কার।

যমযম কূপ কোথায় আছে তা মানুষকে জানতে দেওয়া হয় না। অন্য জায়গা থেকে পাইপের মাধ্যমে পানি উঠানো হয়। তবে হাদীছের দৃষ্টিতে বুঝা যায়, যে দিকে হাজারে আসওয়াদ আছে সে দিকেই যমযম কূপ ও ছাফা-মারওয়া পাহাড়। আমরা অবশ্য যাদুঘরে গিয়ে সেখানে যমযম কূপ বিভিন্ন সময়ে কেমন ছিল, কিভাবে মানুষ পানি উঠাত, কিভাবে পান করত, কিভাবে পাথরের ভিতর থেকে কূপে পানি জমা হয় সবগুলোর দৃশ্য সংরক্ষণ করা হয়েছে। আমরা সেগুলো দেখেছি। মাত্বাফের চারেদিকে, ছাফা-মারওয়া মাঝে এবং হারামের বহু জায়গায় ড্রামের মাধ্যমে পানি সরবরাহ করা হয়। কোন হাজীকে যমযমের পানির জন্য বেগ পেতে হয় না। এই পানি হাজীগণ হোটেলে নিয়ে যান। তারা পুরো সফরে যমযমের পানিই পান করেন। গাড়ির মাধ্যমে মদীনাসহ বাইরে সরবরাহ করা হয়।

তাওহীদের ডাক : ‘আরাফা, মুযদালিফা ও মিনা সম্পর্কে কিছু বলুন?

আব্দুর রাযযাক বিন ইউসুফ : মিনা হজ্জের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এখান থেকে হজ্জ শুরু হয়। যেখানে প্রথমে যোহর, আছর, মাগরিব, এশা আদায় করতে হয়। এটা হ’ল মিনার সুন্নাত। অতঃপর ফজরের ছালাত আদায় করে ‘আরাফার মাঠে যেতে হয়। সেখান থেকে মুজদালিফার মাঠে অবস্থান করে সকালে জামারায় এসে পাথর নিক্ষেপ ও কুরবানী করার পরে মাথা ন্যাড়া করতে হয়। তারপর ত্বাওয়াফ ও সাঈ করে আবার মিনায় আসতে হয় এবং যিলহজ্জ মাসের এগারো, বারো ও তের এ তিনদিন মিনায় থাকতে হয়। অবশ্য সরকারের পক্ষ থেকে সেখানে সুন্দর ও স্থায়ীভাবে ব্যবস্থা করা আছে। বেশ সুন্দর ও মযবুত করে তাঁবু দিয়ে ঘর তৈরী করা আছে এবং তাতে ইয়ারকা--শনেরও ব্যবস্থা আছে।

‘আরাফা খোলা একটা মাঠ। সেখানে একদিনের জন্য তাঁবু টানানো হয়। ‘আরাফা মাঠের আশেপাশে অনেক পাহাড় আছে। মধ্যে একটি পাহাড় আছে যেখানে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) খুৎবা প্রদান করেছিলেন। এটাকে ‘জাবালে রহমত’ বলে। আরাফার মাঠ একটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গা হলেও সেখানে কোন ইবাদত নেই, কোন ছালাত নেই। শুধু দো‘আই সেখানের প্রধান ও একমাত্র কাজ। যত দিন যাবে তত দো‘আর গতি বেশি হবে। আর হজ্জের জন্য ‘আরাফার মাঠ যরূরী। এই মাঠে উপস্থিত হতে না পারলে তার হজ্জ হবে না।

তাওহীদের ডাক : আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-এর জন্মভূমি হিসাবে মক্কা নগরী, বদর, ওহুদ, বায়যা পাহাড়সহ তার অভ্যন্তরীণ অবস্থা সম্পর্কে কিছু বলুন?

আব্দুর রাযযাক বিন ইউসুফ : আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-এর জন্ম ভূমি মক্কা। তিনি মক্কা ছেড়ে মদীনায় হিজরত করেছিলেন। মক্কা নগরী পুরোটায় বরকতময় নগরী। ইবরাহীম ও ইসমাঈল (আঃ)-এর স্মৃতিবিজড়িত মক্কা পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বাধিক পবিত্র নগরী। সেখানেই কা‘বা ঘর, যমযম কূপ, ছাফা-মারওয়া, মিনা, আরাফাহ, মুজদালিফা, জামারাহ, গারে হিরা, গারে ছাওর ইত্যাদি অবস্থিত। মদীনা মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর স্মৃতিবিজড়িত পবিত্র নগরী। রাসূল (ছাঃ)-এর দো‘আর কারণে এ নগরীর ফলমূলের বরকত অনেক বেশী। এখানেই মসজিদে নববী, মসজিদে কূবা, মসজিদে ক্বিবলাতাইন, বাক্বীউল গারক্বাদ কবরস্থান, শহীদদের স্মৃতি বিজড়িত ওহুদ পাহাড় এখানেই আছে। তার পাশেই ৭০ জন শহীদের কবর রয়েছে। মদীনা থেকে বের হয়ে ৩/৪ কিলোমিটার পরেই এই পাহাড়। এর প্রস্থ প্রায় ৪ কিলোমিটার এবং দৈর্ঘ্য ৮ কিলোমিটার। বদর অবশ্য মদীনা থেকে প্রায় ১৫০ কিলোমিটার দূরে। তবে ওহুদ পাহাড়ের একটু পরেই রয়েছে বিশাল বায়যা পাহাড়। এই পাহাড়ে এক আশ্চর্য স্মৃতি লুকিয়ে আছে। মসজিদে নববী থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই পাহাড়। আশ্চর্য বিষয় হ’ল, বায়যা পাহাড়ের শেষ প্রান্তে পৌঁছে ফেরার পথে গাড়ীর স্টার্ট বন্ধ করে দিলেও গাড়ি এমনিতেই চলতে থাকে। বন্ধ গাড়ী এমনিতেই চলতে চলতে এক পর্যায়ে প্রায় ১২০, ১৩০, ১৪০, ১৫০ কিলোমিটার গতিতে চলতে থাকে। তারপর গতি কমতে থাকে। এক পর্যায়ে গাড়ি থেমে যায়। এভাবে গাড়ী চলে প্রায় ৭ কিলোমিটার। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানের লোকেরা এই পাহাড়ের নাম রেখেছে ‘জিন পাহাড়’। এটা বিদ‘আতীদের কথা। স্থানীয় ব্যক্তিদের সাথে কথা বলে জানা গেল যে, জার্মানী কিছু বিজ্ঞানী এসে বলেছেন পাহাড়ের নীচে ম্যাগনেট বা আকর্ষণীয় চুম্বক জাতীয় কিছু পদার্থ আছে বলে মনে করেছেন। কিন্তু প্রশ্ন হল, আকর্ষণীয় চুম্বক থাকলে শুধু গাড়ীকে টেনে নিয়ে আসবে কেন? লোহা জাতীয় অন্যান্য বস্ত্তও টেনে নিয়ে আসবে। কিন্তু তা তো হয় না। তবে পানি ছেড়ে দিলেও রাস্তার উপরের দিকে গাড়িয়ে যায়। এটা একটা আশ্চর্য স্মৃতি। এর মূল কারণ আল্লাহই ভাল জানেন।

তাওহীদের ডাক : মসজিদে নববী ও রওযা সম্পর্কে কিছু বলুন?

আব্দুর রাযযাক বিন ইউসুফ : রাসূল (ছাঃ)-এর বাড়ী থেকে মিম্বর পর্যন্ত মাঝের জায়গাটুকু ‘রওযাতুম মিন রিয়াযিল জান্নাহ’ অর্থাৎ জান্নাতের বাগান সমূহের একটি টুকরা (বুখারী হা/১১৯৫)। সেখানে সাদা ধূসর রংয়ের রঙিন কার্পেট দেওয়া আছে। অন্য স্থানের কার্পেট একটু ভিন্ন। রাসূল (ছাঃ) যেখানে দাঁড়িয়ে খুৎবা দিতেন সেই মিম্বরটি পৃথক ও সুন্দর করে রাখা হয়েছে। বর্তমানে সেখানে খুৎবা দেয়া হয় না। বর্তমানে তার পাশেই পৃথক স্থানে খুৎবা দেয়া হয়। দুঃখজনক হল, এদেশের মানুষ রওযাকেই রাসূল (ছাঃ)-এর কবর বলে মনে করে থাকে। যার কারণে দেশে ইসলামের নামে বিদ‘আতী গান প্রচলিত আছে, আমার সালাম পৌঁছে দিও নবীজীর রওযায়। অথচ রওযার সাথে কবরের কোন সম্পর্ক নেই। রাসূল (ছাঃ)-এর কবরটি বাউন্ডারি থেকে প্রায় আট দশ হাত ভিতরে আছে। অবশ্য তুর্কীরা কবরের উপর যে গম্বুজ তৈরি করেছিল তা এখনো বহাল আছে। সঊদী সরকারের আক্বীদা অনুযায়ী তারা ভেঙ্গে দিতে চায়। কিন্তু বৃহত্তর ফেৎনার আশঙ্কায় এখনো ভেঙ্গে দেয়নি। তবে সময়েই কথা বলবে ইনশআল্লাহ। মসজিদ থেকে পূর্বে-দক্ষিণ কোণে অনতিদূরে ‘বাক্বীউল গারকাদ’ কবরস্থান রয়েছে। সেখানে বহু ছাহাবীর কবর রয়েছে।

তাওহীদের ডাক : মক্কা ও মদীনাতে হজ্জ প্রোগ্রাম ব্যতীত অন্যকোন প্রোগ্রাম হয়েছে কি? সেগুলো সম্পর্কে কিছু বলুন।

আব্দুর রাযযাক বিন ইউসুফ : আমরা অনেক প্রোগ্রাম করেছি। মক্কা, আযীযিয়া, জেদ্দা, আসফান, তায়েফ, মদীনা ইত্যাদি স্থানে অনেক হয়েছে। প্রবাসী ভাইদের ব্যাপক উপস্থিতি প্রোগ্রামগুলো আরো প্রাণবন্ত করেছে। আমি, আমানুল্লাহ বিন ইসমাঈল মাদানী ও মুযাফফর বিন মুহসিন মিলে সেখানে উপস্থিত ছিলাম। অবশ্য আমরা সঊদী আরবে পৌঁছার পূর্বেই উক্ত এলাকা সমূহের আহলেহাদীছ আন্দোলনের দায়িত্বশীলগণ মুযাফফর বিন মুহসিনের সাথে যোগাযোগ করে অনেক প্রোগ্রাম নির্ধারণ করেছিলেন। সেখানে গিয়েও নতুন নতুন প্রোগ্রাম হয়েছে। এ জন্য আমরা সাংগঠনিক দায়িত্বশীল ভাইদের প্রতি একান্ত কৃতজ্ঞ। বিশেষ করে জেদ্দার আহলেহাদীছ আন্দোলনের সভাপতি মুহাম্মাদ সাঈদসহ নিযামুদ্দীন, ছাদিক, সিরাজুল ইসলাম, মাহদী, রাশেদুল ইসলাম, মুহাম্মাদ বাশার, তাহের, মনীর, আল-আমীন, মীযান; মক্কার সভাপতি হাসানসহ ইউসুফ আলী, আব্দুল মান্নান যাকীর, খোকন, তুফায়েল, ইউসুফ, ফরহাদ, শওকত; আসফান এলাকার সভাপতি মুহিউদ্দীনসহ আব্দুল আওয়াল, আবুবকর, নূরুল ইসলাম; মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি হাফেয আব্দুল মতিনসহ, মুকাররম, গোলাম কিবরিয়া, শাহাদত, আবু সাঈদসহ আরো দায়িত্বশীলদের প্রচেষ্টা কখনো ভুলার নয় । দায়িত্বশীলগণ চরম আন্তরিকতার সাথে দাওয়াতী কার্যক্রম পরিচালনা করছে। আল্লাহ তাদেরকে উত্তম প্রতিদান দান করুন। এর মাঝে বিশেষ আকর্ষণ হল মতিউর রহমান মাদানী। তিনি হজ্জের পর ওমরা করা এবং আমাদের সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য এসেছিলেন। তার সাথে আমরা হারামে বৈঠক করেছি।

তাওহীদের ডাক : সেখানকার মানুষের মাঝে কোনরূপ ধর্মীয় কুসংস্কার পরিলক্ষিত হয়েছে কি এবং সেখানের সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি কেমন বলে বলে হয়েছে? আর তাদের আক্বীদা কেমন?

আব্দুর রাযযাক বিন ইউসুফ : সেখানকার লোকের আক্বীদা খুব ভাল। তারা তাওহীদপন্থী মানুষ। বর্তমান হয়তো সরকার পৃথিবীর অন্যান্য দেশ তথা পাশ্চাত্যের সাথে মিল দিয়ে কিছু কিছু করছে। যেমন জেদ্দায় ছেলে-মেয়ে অবাধে পড়তে পারবে এরকম একটি প্রতিষ্ঠান খোলা হচ্ছে। রাস্তায় এতদিন কোন ছবি বা মূর্তি দেখা যেত না, এখন কোথাও কোথাও বাদশাদের কিছু ছবি দেখা যায়। দিন-রাত চললেও রাস্তা ঘাটে কোন গানের আওয়াজ নেই, বরং সব জায়গাতে কুরআন তেলাওয়াত চলছে। সর্বত্র বিভিন্ন দো‘আ, কুরআনের আয়াত লেখা আছে। চোখে পড়লেই আল্লাহকে স্মরণ হয়।

তাওহীদের ডাক : সঊদী প্রবাসী বা স্থানীয় ভাইদের মধ্যে ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’-এর কার্যক্রম কেমন দেখলেন?

আব্দুর রাযযাক বিন ইউসুফ : আল-হামদুলিল্লাহ। জেদ্দা, তায়েফ, মক্কা, মদীনার সাংগঠনিক কার্যক্রম আমরা স্বচক্ষে দেখে এসেছি। দায়িত্বশীলদের দূরদর্শিতা ও বুদ্ধিমত্তা দেখে মুগ্ধ হয়েছি। আর দাম্মাম, রিয়াদ, আল-খাফযী, আল-ক্বাসিম, আল-যুবায়েল প্রভৃতি এলাকায় না গেলেও তাদের কার্যক্রম আমরা উপলব্ধি করেছি। আমরা হজ্জ সফরে যাওয়ার কারণে এ সমস্ত সাংগঠনিক এলাকা থেকে বিভিন্ন পর্বে বিভিন্ন সময়ে দায়িত্বশীল ও কর্মী ভাইয়েরা সাক্ষাৎ করতে এসেছিলেন। কখনো তারা নিজ নিজ এলাকায় বড় বড় প্রোগ্রামের আয়োজন করে মোবাইলের মাধ্যমে আমাদের আলোচনা শুনেছেন। তাদের ভালবাসা ও আন্তরিকতায় আমরা মুগ্ধ। এভাবে তারা দাওয়াতী কাজ করছেন। মাসিক আত-তাহরীক, মুহতারাম আমীরে জাম‘আত প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিবসহ আমাদের বক্তব্য ও বইপত্র বিতরণের মাধ্যমে  আক্বীদা সংশোধন করার প্রাণপণ চেষ্টা করছে। সঊদীদের পক্ষ থেকেও মোটামুটি সহযোগিতা পাচ্ছেন। যদিও অনেক সময় বিভিন্ন বিদ‘আতী সংগঠনের কর্মীদের পক্ষ থেকে তারা বাধারও সম্মুখীন হন। এরপরেও আল-হামদুলিল্লাহ ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’-এর কাজ দুর্বারগতিতে চলছে, যা খুবই প্রশংসনীয়।

তাওহীদের ডাক : সর্বোপরি সঊদী আরব রাষ্ট্রটি কেমন দেখলেন?

আব্দুর রাযযাক বিন ইউসুফ : পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের বাস্তব নমুনা যদি কেউ এখনো পৃথিবীতে দেখতে চায় তাহলে তাকে সঊদী আরবের দিকে দেখতে হবে। পাশ্চাত্যের অপসংস্কৃতির আগ্রাসনের এই যুগে এটা ভাবা স্বপ্নের মত। সেখানে নিয়মিত কুরআনের হুকুম বাস্তবায়ন করা হয়। এদিক থেকে সঊদী সরকারে নীতি অতুলনীয়।  যদিও সেখানেও কিছু ত্রুটি লক্ষ্য করা যায়। পাশ্চাত্যের কিছু নীতি তারা বিভিন্ন স্বার্থে গ্রহণ করছে। এটা দুঃখজনক। এরপরেও সঊদী আরব নিরাপদ দেশ। কোন সমস্যা, মারামারি, দাঙ্গামা-হাঙ্গামা কেউ করতে পারে না। আইনের প্রয়োগ যথাযথভাবে হয়। এক দিনের ঘটনা, আমরা একটি গাড়িতে উঠতেই গাড়িটি সামনের গাড়ির সাথে একটু ধাক্কা লাগল। তারপর আমাদেরকে চালক বলল, আপনারা নেমে যান। পুলিশ এ গাড়িটি নিয়ে যাবে। অথচ যার গাড়িতে ধাক্কা লেগেছে সে কিছুই বলল না। তর্কও করল না। ব্যবস্থা সরকারের পক্ষ থেকে নিবে। নিয়ম-কানূনের ব্যাপারে যথেষ্ট কঠোরতা আছে। সেখানে নিয়ম না মেনে বাঁচার কোন পথ নেই।

তাওহীদের ডাক : হজ্জ সম্পাদনে আপনার বিশেষ কিছু অভিজ্ঞতার কথা বলুন?

আব্দুর রাযযাক বিন ইউসুফ : হজ্জ সফরের বিশেষ অভিজ্ঞতা হ’ল, বায়যা পাহাড়। এটা একটা বিশেষ অভিজ্ঞতা ও আশ্চর্যজনক ঘটনা।

তাওহীদের ডাক : ‘তাওহীদের ডাক’কে গুরুত্বপূর্ণ সময় দেয়ার জন্য আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ। আল্লাহ আপনাকে উত্তম প্রতিদান দান করুন।

আব্দুর রাযযাক বিন ইউসুফ : শুকরিয়া জাযাকুমূল্লাহু খায়ের। তোমাদের অসংখ্য ধন্যবাদ। সুবহা-নাকা আল্লাহুম্মা ওয়াবি হামদিকা আশহাদু আনলা ইলাহা ইল্লা আনতা আসতাগফিরুকা ওয়াতূবু ইলায়ক।



আরও