আব্দুল্লাহিল কাফী আল-কুরায়শী (রহঃ) প্রদত্ত্ব ভাষণ

তাওহীদের ডাক ডেস্ক 853 বার পঠিত

রাজশাহীর অভিভাষণ

[বাংলা ১৩৫৫ সাল ২৮শে ফাল্গুন মুতাবেক ১৯৪৯ ইং ১২ মার্চ তারীখে রাজশাহীর উপকণ্ঠ নওদাপাড়ায় অনুষ্ঠিত আহলেহাদীছ কন্ফারেন্সে তৎকালীন ‘নিখিল বঙ্গ ও আসাম জমঈয়তে আহলেহাদীস’-এর সভাপতি মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল্লাহিল কাফী আল-কুরায়শী (রহঃ) প্রদত্ত্ব অভিভাষণ]

অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি, ডেলিগেট বন্ধুগণ, উলামায়ে কেরাম এবং সমবেত ভ্রাতা ও ভগ্নীগণ!

নিখিল বঙ্গ ও আসাম জমঈয়তে আহলেহাদীছ কন্ফারেন্সের দ্বিতীয় অধিবেশন রাজশাহী যেলা টাউনের উপকণ্ঠে অনুষ্ঠিত হইবার জন্য আমি আল্লাহর শুকর করিতেছি এবং যে পরিশ্রম ও প্রচেষ্টার ফলে এই দুঃসাধ্য ব্যাপার সাধিত হইতে পারিয়াছে, তজ্জন্য সমগ্র বাংলা ও আসামের আহলেহাদীছগণের পক্ষ হইতে অভ্যর্থনা সমিতির খেদমতে মুবারকবাদ জানাইতেছি।

একথা গোড়াতেই স্পষ্টভাবে বলিয়া রাখা ভাল যে, মূল অধিবেশনের সভাপতিত্বের আসনকে অলংকৃত করার উদ্দেশ্যে কোন যোগ্য, প্রতিষ্ঠাসম্পন্ন ও দেশ-বিশ্রুত মহাজনকে লাভ করার জন্য মজলিসে ইস্তিকবালিয়া ঐকান্তিকভাবে চেষ্টা করিয়াছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত তাঁহাদের মনস্কামনা পূর্ণ হইবে বলিয়া ভরসা করিয়া ইস্তিকবালিয়া মজলিস কর্তৃক প্রকাশিত ইশতেহার ও পোষ্টার প্রভৃতিতে সভাপতির নাম ঘোষণা করা হয় নাই। এই নৈরাশ্য ও ব্যর্থতার জন্য অভ্যর্থনা সমিতি যে পরিমাণ দুঃখিত, আমার পরিতাপ ও মনোকষ্ট তাহা অপেক্ষা অনেক বেশী। আহলেহাদীছগণের মধ্যে প্রতিষ্ঠাবান উলামা ও জননায়কের অভাব নিবন্ধন যে আপনারা পুনঃ পুনঃ বায়সকে ময়ূরের আসন দিয়া থাকেন, তাহা নয় । আল্লাহর ফযলে সাহিত্য ও রাজনীতি ক্ষেত্রে আহলেহাদীছ নেতৃবৃন্দই আজ পর্যন্ত সুধী সমাজের বরেণ্য হইয়া আছেন এবং তাঁহাদের প্রগাঢ় বিদ্যাবত্তা, দূরদর্শিতা, প্রতিভা ও যোগ্যতার যশোসৌরভে দেশের প্রতিপ্রান্ত আমোদিত রহিয়াছে। তথাপি আপনাদের চরম দুর্ভাগ্য যে, এবারেও এই মহিমান্বিত ইজলাসের পরিচালনার দায়িত্ব অবশেষে আমার ন্যায় অনুপযুক্ত, গুম্নাম, অন্তঃসারশূন্য রোগজীর্ণ ইলম ও আমলের কলঙ্ক স্বরূপ-অভাজন ব্যক্তিকে অর্পণ করিতে আপনারা বাধ্য হইলেন। মহান আল্লাহ বলিয়াছেন, وَكَانَ أَمْرُ اللَّهِ قَدَرًا مَقْدُورًا ‘আল্লাহর বিধান সুনির্ধারিত’ (আহযাব ৩৩/৩৮)। কিন্তু বন্ধুগণ, কী করিবেন?

قسمت كيا هو چيز كو قسام ازل نی،

جس چيز كو جس شخص كے قابل نظر آيا!

بلبل كو ديا رونا پروانے كو جلنا،

غم ہم كو ديا سب سے جو مشكل نظر آيا!

ولنعم  ما قال :-

بار غم او عوض بہر كس كه نمودم،

عاجز شد واين قرعه بنامم زسر افتاد!

 

আব্দুল্লাহিল কাফী আল-কুরায়শী (রহঃ) প্রদত্ত্ব ভাষণ

চতুর্মুখী নৈরাশ্যের কুজ্ঝটিকার ভিতর আশার আলোক এই যে, আল্লাহর অনুকম্পা ও অনুগ্রহকে সম্বল করিতে পারিলে পঙ্গুও পর্বত উল্লঙ্ঘন করিতে পারে, সর্বহারা অপদার্থের দ্বারাও আল্লাহ তাঁহার মনোনীত ‘দ্বীন’-এর সেবা গ্রহণ করিয়া থাকেন। অতএব আসুন, আমরা আমাদের জয়যাত্রা ও কামিয়াবীর জন্য অগ্রতির গতি, সর্ব সিদ্ধিদাতা, রহমা-নুর রহীমের শরণাপন্ন হই :

فيض روح القدس او باز مدد فرمايد

ديگران هم بگنند انچه مسيحامى کرد

وما توفيقي إلا بالله عليه توكلت إليه أنيب، حسبنا الله ونعم الوكيل، نعم المولي ونعم النصير وَقُلْ رَبِّ أَدْخِلْنِي مُدْخَلَ صِدْقٍ وَأَخْرِجْنِي مُخْرَجَ صِدْقٍ وَاجْعَلْ لِي مِنْ لَدُنْكَ سُلْطَانًا نَصِيرًا.

মহোদয়গণ! বক্তব্য পথে অগ্রসর হইবার পূর্বে দু’টি মর্মন্তুদ দুর্ঘটনার কথা উল্লেখ করা আমি-আমার অপরিহার্য কর্তব্য বলিয়া মনে করি। প্রথমটি হইতেছে : নবলব্ধ পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা বর্তমান জগতের অপ্রতিদ্বন্দ্বী ও শ্রেষ্ঠতম কূটনীতিবিশারদ, কায়েদে আযম মুহাম্মাদ আলী জিন্নাহর তিরোভাব।

দ্বিতীয়টি হইতেছে : পাক ভারতের আহলেহাদীছগণের সর্বজনমান্য নেতা, তর্জুমানুল কুরআন, শায়খুল ইসলাম, আল্লামা আবুল ওয়াফা মুহাম্মাদ ছানাউল্লাহ ছাহেবের মহা প্রস্থান।

জ্ঞান ও কর্ম সাধনার এই দুই পূর্ণ চন্দ্রের চরম ক্ষয়প্রাপ্তিতে আমাদের হৃদয়াকাশ বিষাদ ও শোকের অমানিশিতে পরিণত হইয়াছে। নশ্বর জগতে মানুষের শেষ পরিণতির এই ব্যবস্থাকে যে কেহই এড়াইতে পারিবে না। অবিনশ্বর আল্লাহ রববুল ‘আলামীনের ইহাই বিধান।

كُلُّ مَنْ عَلَيْهَا فَانٍ- وَيَبْقَى وَجْهُ رَبِّكَ ذُو الْجَلَالِ وَالْإِكْرَامِ

چون ختم الانبياء هم رفت كسے  باقى نمى ماند

بجز ذات مقدس قادر وقيوم صمدانى-

কিন্তু সত্যই কি মৃত্যু মানব জীবনের শেষ পরিণতি? বন্ধুগণ! আমরা মুসলমান! আমরা মৃত্যুকে জড়দেহের শেষ পরিণাম মনে করিতে পারি। কিন্তু আত্মার মৃত্যু ও কর্ম সাধনার পরিসমাপ্তিকে আমরা কদাচ বিশ্বাস করি না। যদি মৃত্যুই চরম ব্যাপার হয়, তাহা হইলে মানব জীবনের সার্থকতা কি ?

Alas for love

if thou wert all

And naught beyond the Earth?

এইখান হইতেই ইসলামের بعث بعد الموت পুনরুত্থান আক্বীদার বাস্তবতা প্রমাণিত হয়। বন্ধুগণ! মুহাম্মাদ আলী জিন্নাহ ও আল্লামা আবুল ওয়াফা ছানাউল্লাহ কর্মযুগের যে জীবন্ত আদর্শ আমাদের জন্য রাখিয়া গিয়াছেন, আসুন! আমরা তদ্বারা অনুপ্রাণিত হই এবং তাঁহাদের অমরত্ব ঘোষণা করি,

ہرگز نيرد آنكه دلش زننده شد بشق

ثبت است بر جريده عالم دو ام ما!

আসুন! আমরা তাঁহাদের এবং আমাদের পরলোকপ্রাপ্ত সহকর্মীদের বিশেষতঃ ইলায়ে কালেমাতুল হক্বের জন্য এবং মুসলমানগণের জাতীয় জীবনের মুক্তি সাধনায় সমগ্র ভারত, কাশ্মীর, ফিলিস্তীন ও ইন্দোনেশিয়ার রণাঙ্গণে যাঁহারা আত্মদান করিয়াছেন অথবা মযলূম অবস্থায় শহীদ হইয়াছেন, তাঁহাদের সকলের আত্মার মুক্তি ও নাজাতের জন্য আল্লাহর দরবারে আকুল প্রার্থনা নিবেদন করি,

بنا كردند خوش رسمے بخاك وخون خلطيدن،

خنا رحمت كند اين تاشتان پاك لينت را!

اللهم اغفرلهم وارحمهم واعافهم واعف عنهم واكرم نزلهم ووسع مدخلهم اللهم امطر عليهم شابيب الرحمة والرضوان اللهم ثبتهم و ثقل موازينهم و حقق ايمانهم وارفع درجتهم، تقبل صلاتهم واغفر خطياتهم ونسالك لهم للدراجات العلي من الجنة. أمين!

আহলেহাদীছ আন্দোলন :

মহোদয়গণ! আহলেহাদীছ মতবাদ কোন অভিনব মতবাদ এবং ইহার আন্দোলন মুসলমানগণের একটি স্বতন্ত্র দলের আন্দোলন নয়। আমরা করাচী বা ঢাকায় আহলেহাদীছগণের জন্য স্বতন্ত্র কোন colony বা উপনিবেশের দাবীদার নই। আমরা পাকিস্তান পার্লামেন্টে আহলেহাদীছগণের জন্য নির্দিষ্ট আসন চাই না, আমরা সরকারী চাকুরী বাকুরীতে আহলেহাদীছের ওয়েটেজ প্রার্থনা করি না। ইসলামের মূল দাবী যাহা, আমরা কেবল তাহাই দাবী করি। ইসলামের আমানতকে জগদগুরু, মানব মুকুট বিশ্বনবী খা-তেমুল মুরসালীন মুহাম্মাদ মুছত্বফা (ছাঃ) যেভাবে, যে আকারে ও যে উদ্দেশ্যে আমাদের হস্তে সমর্পণ করিয়া গিয়াছেন আমরা দুনিয়ার বুকে ইসলামকে সেইভাবে ও সেই উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত দেখিতে চাই।

আমরা পৃথিবীর মুসলমানকে এক ও অভিন্ন জাতিরূপে দেখিতে চাই। কুসংস্কার, গতানুগতিকতা, অন্ধভক্তি এবং মূর্খ বিদ্বেষের যে আবর্জনাপুঞ্জ ইসলামের পবিত্র দেহকে আবৃত করিয়া ফেলিয়াছে, নাস্তিকতা, অংশীবাদ এবং মানুষের রচিত ও কল্পিত নব নব মতবাদ, থিওরী, সাধন-ভজন প্রণালী ও আইন-কানূন ইসলামকে যেভাবে কোণঠাসা করিয়া রাখিতে চাহিতেছে, আমরা তাহা সহ্য করি না। আমরা ইসলামকে চিরঞ্জীব সর্বযুগোপযোগী এবং ইসলামের বাহক শ্রেষ্ঠতম রাসূল (ছাঃ)-কে খা-তেমুল মুরসালীন বিশ্বাস করি। তাঁহার নবুয়তের সাম্রাজ্যকে প্রলয়কাল পর্যন্ত যিন্দা ও অমর প্রমাণিত করিতে হইবে এই গুরুভার প্রত্যেক উম্মতের স্কন্ধে রহিয়াছে বলিয়া স্বীকার করি।

আহলেহাদীছ কেন?

মুসলমানগণের মধ্যে ফির্কাবন্দী বা দলগত ভিন্ন ভিন্ন গন্ডি কায়েম হইবার পূর্বে আহলেহাদীছ এবং মুসলমান উভয় শব্দের তাৎপর্য এক ও অভিন্ন ছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে যখন রাজনৈতিক কারণে খারেজী ও শী‘আদের অভ্যুদয় ঘটিল এবং তথাকথিত যুক্তিবাদের নামে এ‘তেযাল ও এর্জার ফেৎনা সৃষ্টি হইল, তখন ছাহাবা বিদ্বেষের ফলস্বরূপ তাঁহাদের বাচনিক বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর হাদীছ কতিপয় দল কর্তৃক পরিত্যক্ত হইল। এমনকি তাহাদের কোন কোন ফের্কা কুরআনের বিশুদ্ধতা পর্যন্ত অস্বীকার করিতে পশ্চাদপদ হইলেন না। কারণ কুরআনের রেওয়ায়েত ও প্রচারকার্যও ছাহাবাগণ কর্তৃক সাধিত হইয়াছিল; তখন হইতে গুপ্ত কুরআন ও সিনা-বসিনার কিংবদন্তী কানে কানে প্রচারিত হইতে থাকে। তথাকথিত যুক্তিবাদী দল হাদীছে বর্ণিত অনেক বিষয়বস্ত্তর সমাধান করিতে না পারিয়া মূল হাদীছকেই অস্বীকার করিয়া বসেন। ফলতঃ তখন মুসলমানগণ দু’টি প্রধান দলে বিভক্ত হইয়া পড়েন এবং তাঁহাদের বিভাগের সীমারেখা হয় হাদীছ ও সুন্নাত। ছাহাবা ও তাবেঈগণ কুরআনের ন্যায় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর বিশুদ্ধ ও প্রমাণিত হাদীছের সমর্থক ও অনুসরণকারী ছিলেন বলিয়া রাসূলে কারীম (ছাঃ)-এর পবিত্র মুখে উচ্চারিত ও মনোনীত আহলেহাদীছ নামে অভিহিত হন (সাখাবী, আল-কাউলুল বাদী‘, পৃঃ ১৮৯; হাকেম, আল-মুস্তাদরাক ১ম খ- ৮৮ পৃঃ; খত্বীব, শারফু আছহাবিল হাদীছ, পৃঃ ২১)। উস্তায আবু মনছূর আব্দুল ক্বাহের বাগদাদী (৪২০ হিঃ) তাঁহার ‘উছূলুদ্দীন’  নামক গ্রন্থে বলিয়াছেন, أصل ابي حنيفة في الكلام كأصول أصحاب الحديث إلا في مسئلتين ‘মতবাদের দিক দিয়া ইমাম আবু হানীফার উছূল, দু’টি মাসআলা ছাড়া সমস্তই আহলেহাদীছগণের অনুরূপ’ (১ম খ- ৩১২ পৃঃ)। ইসলামের যে সকল বীর সৈনিকের সাহায্যে রুম, আলজিরিয়া, সিরিয়া, পারস্য, আফ্রিকা, স্পেন এবং হিন্দের সীমান্ত বিজিত হইয়ছিল, তাঁহারা সকলেই ছাহাবা ও তাবেঈন ছিলেন। ফলে উল্লিখিত দেশ সমূহের সীমান্তবাসী সকল মুসলমান সাম্রাজ্যের ভিতর সকল বিদ্রোহ ও অশান্তি সৃষ্টি করিয়াছেন বটে, কিন্তু ফতুহাতে ইসলামিয়ার এক ইঞ্চি জমিও তাঁহাদের সাহায্যে অধিকৃত হয় নাই। ইমাম আবু মনছূর বাগদাদী বলেন,

ثغور الروم والجزيرة ثغور الشام ثغور واذربيجان وباب الابواب كلهم علي مذهب الهل الحديث من أهل السنة وكذالك ثغور أفريقية وأندلس وكل ثغور وراء بحر المغرب اهله من اصحاب الحديث وكذالك ثغور اليمن علي ساحل الزنج  واما ثغور أهل ما وراء النهر في وجوه الترك والصين فهم قريقان : إما شافعية و إما من أصحاب أبي حنيفة-

‘রূম সীমান্ত, আলজিরিয়া, সিরিয়া, আযারবাইজান, বাবুল-আবওয়াব (মধ্য তুর্কিস্থান) প্রভৃতি স্থানের সকল মুসলমান অধিবাসী আহলেহাদীছ মাযহাবের উপর ছিলেন। অনুরূপভাবে আফ্রিকার সীমান্ত, স্পেন এবং পন্ডিম সাগরের পশ্চাদবর্তী সকল সীমান্তের মুসলমান অধিবাসীবর্গ আহলেহাদীছ ছিলেন। পুনশ্চঃ আবিসিনিয়ার উপকূলবর্তী ইয়ামেনের সমুদয় সীমান্তবাসী আহলেহাদীছ ছিলেন। তবে তুরস্ক ও চীন অভিমুখী মধ্য তুর্কিস্থান সীমান্তের অধিবাসীদের মধ্যে দুইট দল ছিলঃ একদল শাফেঈ ও একদল আবু হানীফার অনুসারী’ (উছূলুদ্দীন ১/৩১৭ পৃঃ)

সুবহা-নাল্লাহ! ছাহাবা (রাঃ) ও তাবেঈন (রহঃ) এমনকি মহামতি ইমামগণ পর্যন্ত যে আহলেহাদীছ মতবাদের অনুসরণ করিতেন, দুইশত হিজরী ও তাহার পরবর্তী যুগ পর্যন্ত যাহা এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের হেদায়াতপ্রাপ্ত মুসলিমগণের পরিগৃহীত একমাত্র মতবাদ ছিল; যে শাশ্বত সনাতন আহলেহাদীছ মতবাদ রাসূলে কারীম (ছাঃ)-এর প্রচারিত মৌলিক ইসলামের নামান্তরমাত্র, আমাদের একদল বন্ধুর কাছে সেই আহলেহাদীছরাই নাকি লা-মাযহাব! আবার কেহ কেহ আহলেহাদীছ মতবাদের উল্লেখ নাকি ইতহাসের পৃষ্ঠাতেই খুঁজিয়া পান না! এবং কোন কোন উদারনৈতিক মহাপ্রাণ ব্যক্তি আহলেহাদীছরূপে পরিচিত হইবার দুষ্কার্যকে নাকি ফের্কাবন্দীর পরিচায়ক বলিয়া মনে করেন।

انا لله وانا اليه راجعون

برى نهفته رخ وديودر كرشمه وناز!

بموخت عقل زحيرت كه اين چو بوالعجبى لست!

হিন্দ সীমান্তে আহলেহাদীছ :

১৪ হিজরীতে দ্বিতীয় খলীফা ওমর ফারূক (রাঃ) কর্তৃক ওছমান বিন আবিল আস (রাঃ) (মৃত ৫১হিঃ) বাহরাইনের শাসনকর্তা নিযুক্ত হন। তাঁহার নির্দেশক্রমে সর্বপ্রথম ছাহাবাগণ ও তদীয় ছাত্রবৃন্দ বর্তমান বোম্বাই নগরীর ২১ মাইল দূরবর্তী থানা বন্দর আক্রমণ করেন (বালাযূরী, ফৎহুল বুলদান, পৃঃ ৪৩৮)। ১৭ হিজরীতে বছরার শাসনকর্তা মুগীরা সিন্ধুর বন্দর ‘দিবলের’ উপর সৈন্য পরিচালনা করেন এবং জয়লাভ করিতে সমর্থ হন (ঐ)। দিবল বন্দর সিন্ধুর মোহনায় অবস্থিত। ইহার সঠিক অবস্থান সম্বন্ধে যথেষ্ট মতভেদ আছে। Le Strange বলেন, বর্তমান করাচীর পূর্ব দক্ষিণ ৪৫ মাইল দূরে সিন্ধু নদের মোহনায় ‘দিবল’ অবস্থিত ছিল (Muir’s Caliphate p. 353)। Burns Burton ‘ঠট্ট নগর’-কে দিবল বলিয়া অনুমান করিয়াছেন। Elphin stone ও Remaud করাচীকেই দিবল বলিয়াছেন। Mr. Thomas এই অভিমত সমর্থন করিয়াছেন (Encyclopaedia of India, part-1. p. 902)। বালাযূরী দিবলকে বিশাল বৌদ্ধ মন্দির বলিয়াছেন। Elliot ছাহেব তাঁহার History of India-তে দিবল মন্দিরকে টাঙ্গামুরা নামক জলদস্যু বংশের অধিকৃত মন্দির লিখিয়াছেন। তৃতীয় খলীফা ওছমান বিন আফ্ফান (রাঃ)-এর খেলাফতকালে জলপথে একদল আরব সৈন্য উপরোক্ত বন্দরগুলি দেখাশুনা করিয়া চলিয়া যায়।

৪র্থ খলীফা আলী (রাঃ)-এর সময় ৩৯ হিজরী হইতে হিন্দের সীমান্ত অঞ্চল সমূহের ব্যবস্থার জন্য একজন করিয়া শাসনকর্তা নিযুক্ত হইতে থাকেন। ৪৪ হিজরীতে আমীর মু‘আবিয়া (রাঃ) মুহাল্লাব বিন আবু ছুফরাকে (৭-৮০) সিন্ধুর সীমান্ত অঞ্চলের পরিদর্শক ও ব্যবস্থাপক নিযুক্ত করেন। তখন হইতে খেলাফতে ইসলামিয়ার অধীন সিন্ধুর শাসনকর্তার পদ স্থায়ী হয়।

মুসলমানগণকে ৪৪ হিজরীতে মুহাল্লাবের সেনাপতিত্বে সিন্ধুর সীমান্তে যুদ্ধ করিতে হইয়াছিল (ইবনে কাছীর, আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ৬/২২৩)। ইয়াফেয়ী লিখিয়াছেন, ৪৪ হিজরীতে আব্দুর রহমান বিন সামূরা (রাঃ) কাবুল শহর জয় করেন এবং মুহাল্লাব হিন্দে সৈন্য চালনা করিয়া শত্রু দলকে পরাভূত করেন (মাওয়াতুল জিনান ১/১২১)

আজ আল্লাহর ফযলে সিন্ধুর প্রধান নগরী করাচী দাওলতে পাকিস্তানের রাজধানীতে পরিণত হইয়াছে; ইসলামের ইতহাসের ইহা একটি চমৎকার ঘটনা যে, হিন্দের সর্বপ্রথম ইসলামী হুকুমতও এই সিন্ধু প্রদেশে স্থাপিত হইয়ছিল। আশা করি তাহা অপ্রাসঙ্গিক এবং শ্রোতৃবৃন্দের ধৈর্যচ্যুতির কারণ হইবে না।

৮৬ হিজরীতে খলীফা ওয়ালীদ বিন আব্দুল মালেক যখন সিংহাসনারূঢ় হন, তখন হাজ্জাজ বিন মুনাবিবহ ছাক্বাফী ইরাকের শাসনকর্তা ছিলেন। ন্যূনাধিক ৯০ হিজরীতে সিন্ধু নদের উপকূলবর্তী দেশ সমূহের সম্রাট ছিলেন দাহির। তিনি দিবল বংশীয় ও দিবলের প্রধান পুরোহিত ছিলেন। মুলতান এবং সমগ্র সিন্ধুদেশ ও কালাবাগ পর্যন্ত তাঁহার সাম্রাজ্য বিস্তৃতি লাভ করিয়াছিল। এই সময় সিংহলের মুসলিম উপনিবেশে কতিপয় আরব ব্যবসায়ীর মৃত্যু হয়। সিংহলের রাজা তাঁহাদের অনাথ স্ত্রী ও কন্যাদিগকে নানারূপ মূল্যবান উপঢৌকন সহ জাহাজযোগে হাজ্জাজের নিকট প্রেরণ করেন। দিবলের নিকটবর্তী হইলে জলদস্যুরা জাহাজের সমস্ত মূল্যবান সামগ্রী ও মুসলিম মহিলাদিগকে লুণ্ঠন করিয়া লইয়া যায়। ঐতিহাসিক ইয়াকুৎ রুমী লিখিয়াছেন, ‘একজন মুসলিম মহিলাকে যখন হিন্দে ক্রীতদাসীতে পরিণত করা হইতেছিল, তখন তিনি উচ্চৈঃস্বরে হাজ্জাজকে আহবান করেন ও তাঁহার দোহাই দেন। হাজ্জাজ যখন ইরাকে সেই নারীর আহবানের কথা শ্রুত হইলেন, তখন শশব্যস্তে পুনঃ পুনঃ উচ্চৈঃস্বরে প্রত্যুত্তর দিতে থাকেন। হাজ্জাজ বিন ইউসুফ ৭০ লক্ষ দিরহাম ব্যয় করিয়া শেষ পর্যন্ত উক্ত মুসলিম মহিলার উদ্ধার সাধন করিয়াছিলেন’।

হাজ্জাজ দস্যুদলের দ-বিধান ও জাহাজের ক্ষতিপূরণ দাবী করেন এবং মুসলিম মহিলাদের প্রত্যার্পণের জন্য আদেশ দেন। সম্রাট দাহির উত্তর করেন যে, তিনি জলদস্যুদের দুষ্ক্রিয়ার প্রতিকার করিতে অসমর্থ। দাহির স্বয়ং দস্যুদলের সর্দার ছিলেন কিনা, তাহা নিশ্চিতরূপে বলা যায় না। কিন্তু তৎকালে এমনকি পঞ্চম শতাব্দীর অর্ধভাগ পর্যন্ত উপকূলবর্তী সমুদয় মন্দিরগুলি দস্যুদের আড্ডা ছিল। ঐতিহাসিক আবু রায়হান বিরুণা ‘কিতাবুল হিন্দে’ লিখিয়াছেন, কচ্ছ ও সোমনাথের এলাকাকে বেওয়ারেজ বলার কারণ এই যে, বেড়া নামক ছোট ছোট সমষ্টিগত জাহাজ লইয়া তাহারা সমুদ্রে দস্যুবৃত্তি করিত, (প্রোঃ Sachau-এর ইংরেজী অনুবাদ ১/২০৮)। দিবলের মন্দিরকে Elliot ছাহেবও দস্যুদলের অধিকৃত বলিয়া মত প্রকাশ করিয়াছেন।

আরব বিজেতাগণের দিবলের মন্দির এবং সুলতান মাহমূদের সোমনাথের মন্দির কেন প্রধান লক্ষ্যস্থলে পরিণত হইয়াছিল, উপরোক্ত ঘটনা হইতে তাহা অনুমান করা যায়। হাজ্জাজ তাঁহার সপ্তদশ বর্ষীয় ভ্রাতুষ্পুত্র বা পিতৃব্য পুত্র ইমাদুদ্দীন মুহাম্মাদ বিন কাসিমকে (মৃত ৯৬ হিঃ) দাহিরের বিরুদ্ধে নিযুক্ত করেন। মুহাম্মাদ বিন কাসিম ৯০ হিজরীতে যুদ্ধ ঘোষণা করেন এবং ৯৩ হিজরীতে দাহির নিধনপ্রাপ্ত হন।

মুয়র বলিয়াছেন, রাজধানী দিবল অধিকার করিয়া ইবনে কাসিম তথায় একদল সৈন্য রাখিয়া দাহিরের পশ্চাদ্ধাবন করেন এবং মিহ্রান অতিক্রম করিয়া দাহিরের সহিত প্রচ- সম্মুখ যুদ্ধে প্রবৃত্ত হন। দাহির তাঁহার হস্তীবাহিনীসহ পরাজয় বরণ করেন ও নিহত হন। ইবনে কাসিম ঝটিকাবেগে ব্রাহ্মণাবাদ অধিকার করেন এবং আলওয়ারের সহিত সন্ধি স্থাপন করিয়া ব্যাস নদী অতিক্রম করেন ও মুলতানে হানা দেন। সুদীর্ঘ অবরোধের পর ইবনে কাসিম মুলতান জয় করিয়া লন। ইবনে কাছীর বলেন যে মুহাম্মাদ বিন কাসিম ৯৫ হিজরীতে মুলতান জয় করিয়াছেন। ইবনে জারীরের বর্ণনানুসারে ঐ সালে ইবনে কাসিম কচ্ছ ও মালওয়া অধিকার করেন। আল-বেরুণী লিখিয়াছেন যে, ইবনে কাসিম সিন্ধুতে প্রবেশ করিয়া বাহ্মানওয়া ও মুলস্থানা নামক নগরীদ্বয় জয় করিয়া লন। তিনি প্রথমটিকে ‘আল-মনছূরা’ ও দ্বিতীয়টিকে ‘আল-মামূরা’ নামে অভিহিত করেন। অতঃপর তিনি কনোজ পর্যন্ত প্রবেশ করেন। যাত্রাকালে গান্ধার প্রদেশের ভিতর দিয়া সৈন্য চালনা করেন এবং কাশ্মীরের ধার দিয়া প্রত্যাবর্তিত হন। যে দেশ জয় করিতেন, তাঁহার অধিবাসীবর্গকে তাঁহাদের ধর্মের উপর ছাড়িয়া দিতেন। কেবল যাঁহারা স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ করিতে চাহিতেন, তাঁহারাই মুসলমান হইতে পারিতেন।

৯৩ হিজরীতে খলীফা সুলায়মান বিন আব্দুল মালেক সিংহাসনে উপবেশন করেন। হাজ্জাজ তাঁহার বিরুদ্ধাচরণ করায় তিনি তাঁহার উপর অতিশয় রুষ্ট ছিলেন। সুতরাং সিংহাসন লাভ করার পর তিনি হাজ্জাজের আত্মীয়-স্বজনগণের নিধনসাধনে কৃতসংকল্প হন। মুহাম্মাদ বিন কাসিম হাজ্জাজের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়, প্রতিনিধি ও পক্ষপাতী ছিলেন। সুলায়মান তাঁহাকে সিন্ধু হইতে ডাকাইয়া আনিয়া হত্যা করেন। খলীফা সুলায়মান কর্তৃক মুহাম্মাদ বিন কাসিমকে হত্যা করার ইহাই প্রকৃত কারণ। আর টড্ প্রভৃতি দাহিরের কন্যাদ্বয়ের নামে যে কাহিনী রচনা করিয়াছেন তাহা মুসলিম বিদ্বেষের আগুন প্রজ্জ্বলিত করার ইন্ধন মাত্র। ইহা প্রণিধানযোগ্য যে, মুহাম্মাদ বিন কাসিম যখন শেষবার সিন্ধু পরিত্যাগ করিয়া যাইতেছিলেন, বালাযূরী লিখিয়াছেন যে, সিন্ধুর অমুসলমান অধিবাসীবৃন্দ তাহাদের মহানুভব শাসনকর্তার জন্য অশ্রু সম্বরণ করিতে পারেন নাই এবং তাঁহার স্মৃতি রক্ষার্থে কচ্ছে ইবনে কাসিমের প্রতিমা স্থাপন করিয়াছিলেন (ফৎহুল বুলদান, পৃঃ ৪৪৬)

মুক্রান, ইমকরান বা বেলুচিস্তান ওমর ফারূকের সময় ২৩ হিজরীতে অধিকৃত হয়। হাকাম বিন আমর তগলবী নামক ছাহাবী শিহাব ইবনুল মাভারেক, সুহায়ল বিন আদী ও আব্দুল্লাহ বিন উতবান সহ মুক্রান নদীর উপকূলে শিবির স্থাপন করেন। মুক্রানের অধিপতি তাঁহার সৈন্যদলসহ নদী পার হইয়া আসেন ও মুসলিম বাহিনীর সম্মুখীন হন। কয়েক দিনব্যাপী প্রচ- সংগ্রামের পর মুসলমানগণ জয়লাভ করেন (ইবনে জারীর ৫/৭)। মুহাম্মাদ বিন কাসিম কর্তৃক স্থাপিত সিন্ধুর রাজধানী সম্পর্কে শামসুদ্দীন মুহাম্মাদ বিন আহমাদ বেশারী মাক্দেসী ৩৭৫ হিজরীর লিখিত তদীয় ভ্রমণ বৃত্তান্তে বলেন, অধিবাসীবর্গ যোগ্য ও সদাশয়। এই স্থানে ইসলাম সজীব আছে এবং বিদ্যা ও বিদ্বানগণ বিদ্যমান আছেন। তাঁহারা ধীশক্তি সম্পন্ন, পুণ্যবান ও ধর্মভীরু। অমুসলমানগণ প্রতিমাপূজক, মুসলমানগণ অধিকাংশই আহলেহাদীছ। মানছূরা রাজ্যের বড় বড় নগরে অল্প সংখ্যক হানাফীও দৃষ্টিগোচর হইয়া থাকে। কিন্তু মালেকী ও হাম্বলী আর মু‘তাযিলা মাযহাবের লোক একদম নাই। মানছূরার অধিবাসীবর্গ সরল ও সঠিক মাযহাবের উপর কায়েম আছেন। তাঁহাদের ভিতর সচ্চরিত্রতা ও ধর্মপরায়ণতা বিদ্যমান আছে (আহসানুত তাক্বসীম ফী মা‘রেফাতি আকালীম, পৃঃ ৪৮১)। ৩৬৭ হিজরীতে ইবনে হাওকাল বাগদাদী মুলতানে উপস্থিত হন। তখনো মুলতানের মুসলমান আহলেহাদীছ ছিলেন।

বন্ধুগণ!  ছাহাবা ও তাবেঈগণ কর্তৃক বিজিত অন্যান্য দেশের ন্যায় চতুর্থ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত হিন্দ ভূমিও যে আহলেহাদীছ অধ্যুষিত ছিল, আপনারা ঐতিহাসিকভাবে তাহার প্রমাণ প্রাপ্ত হইয়াছেন। পরবর্তীকালে এই দেশে কী কী কারণে আহলেহাদীছ মতবাদ ও ইলমে হাদীছের আন্দোলন মন্থর হইয়া যায়, তাহার আলোচনা এখানে অনাবশ্যক; আমি আমার বিরচিত ‘আহলেহাদীছ আন্দোলনের ইতিহাস’-এ তাহা সবিস্তার লিপিবদ্ধ করিয়াছি। ছাহাবা, তাবেঈন ও তদীয় আহলেহাদীছ শিষ্যম-লীর সাহায্যে সকল দেশ বিজিত হইয়াছিল। তথায় ইসলামের মৌলিক আদর্শ ও শিক্ষা শিকড় গাড়িয়া বসিয়াছিল। কুরআন ও সুন্নাতের পবিত্র প্রভাবে ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিজিত জাতি ও দেশসমূহের ধর্ম ও দৃষ্টিভঙ্গীকে আমূল পরিবর্তিত করিতে সমর্থ হইয়াছিল। কিন্তু ইসলাম পারসিক, তুর্কী, গজনভী, সলজোকী, গওরী, মোগল ও আফগানদের মারফত বহু পথ ঘুরিয়া এবং বহু হস্তে ফিরিয়া দ্বিতীয় পর্যায়ে যখন হিন্দ ভূমিতে প্রবেশ করে, তখন মুহাম্মাদী ইসলামের সম্মোহন ও আকর্ষণ শক্তি মুসলমানগণ হারাইয়া ফেলেন। গগনচুম্বী প্রাসাদ, সুবর্ণ সিংহাসন, বাগে-ফেরদওস্ এবং অতুলনীয় সমাধিসৌধ তাঁহারা অল্পই সাধন করিতে পারিয়াছিলেন। ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’-এর প্রতি এই ঔদাসীন্যের ফলেই আজ দিল্লীর জামে মসজিদ, কুতূব মিনার, আগ্রার তাজমহল এবং আজমীরে খাওয়াজা মঈনুদ্দীন চিশ্তির এবং দিল্লী, পা-ুয়া ও গৌড়ের শত সহস্র মুসলিম মনীষী ও সাধকদলের রওযার দাবী পাকিস্তান রাষ্ট্রকে পরিত্যাগ করিতে হইয়াছে। দুই শত বৎসর পূর্বে হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম ওয়ালীউল্লাহ দেহলভী বড় দুঃখেই বলিয়াছিলেন :

تا انقراض دولت شام هيچ كون خودرا حنفى شافعى نمى گفت‘ بلكه ادله را بروفق مذهب اصحاب خود تاويل مى كردند،  در دولت عراق هو كسے برائے خود نامى معين نمود ‘ تانص اصحاب خود نيابد٬ بادله كتاب و سنت بكم تكند ٬ اختلافى كه مقتضائے  تاويل كتاب و سنت لازم مي آمد، في الحال محكم الاساس گشت،  چون دولت عرب امنتقاض گشت ومردم دربلاد مختلفه افتادند، هريكے انچه زمذهب ياد كردند بود، همانرا اصل ساخت ولنبچيه مذهب مستنبط سابق بود، والحال سنت مستقره شد، علم ايشان تخريج بر تخريج تفريع بر تفريع، دولت ايشان مانند دولت مجوسى الا انكه نماز غزار ند ومتكلم بكلمه شهادت مى شدند، مامردم درزمانه هممين  تغير پيدا شديمم دانيم خدائے تعالى  بعد  ازين   چه خراسته  است؟          

‘উমাইয়া বংশীয়দের রাজত্বের বিধ্বস্তিকাল পর্যন্ত কোন মুসলমান নিজেকে হানাফী বলিতেন না। স্ব স্ব গুরুগণের সিদ্ধান্ত অনুসারে কুরআন ও হাদীছের ব্যাখ্যা করিতেন। আববাসী খলীফাদের শাসনযুগে মধ্যভাগের প্রত্যেকেই নিজেদের জন্য এক একটি করিয়া নির্দিষ্টরূপে নাম বাছিয়া লইলেন এবং স্বীয় গুরুগণের উক্তি না পাওয়া পর্যন্ত কুরআন ও হাদীছের নির্দেশ মান্য করার রীতি পরিহার করিলেন। কুরআন ও হাদীছের ব্যাখ্যা লইয়া যে মতভেদ দেখা দিয়াছিল, এক্ষণে সেই মতভেদ মাযহাবের বুনিয়াদ রূপে দৃঢ় হইল। আরব রাজত্বের অবসানের পর (৬৫৬ হিঃ) মুসলমানগণ বিভিন্ন দেশে ছড়াইয়া পড়িলেন। প্রত্যেকে স্ব স্ব মাযহাবের যতটুকু অংশ স্মরণ রাখিতে পারিয়াছিলেন, তাহাকেই ভিত্তিরূপে গ্রহণ করিলেন আর যাহা পূর্ববর্তীগণের উক্তির সাহায্যে পরিকল্পিত হইয়াছিল। এক্ষণে তাহা অবিসম্বাদিত সুন্নাতরূপে পরিগৃহীত হইল। ইহাদের বিদ্যা হইতেছে এক অনুমানের উপর গঠিত আর এক অনুমান। এক পরিকল্পনার ভিত্তির উপর নির্মিত আর এক পরিকল্পনা, যাহা পুনশ্চ তাহাকে অবলম্বন করিয়া হয় আর এক অনুমান গঠিত। ইহাদের রাজত্ব অগ্নিপূজকদের ন্যায়। তফাৎ শুধু এইটুকু যে, ইহারা ছালাত আদায় করে ও শাহাদতের কালেমা উচ্চারণ করিয়া থাকে! আমরা এই যুগ সন্ধিক্ষণে জন্মগ্রহণ করিয়াছি, জানি না অতঃপর আল্লাহর অভিপ্রায় কী ?’ (ইযালাতুল খাফা, ১/১৫৮ পৃঃ)

শাহ ছাহেব এই দেশে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হইবার পূর্ববর্তী অবস্থার জন্য বিলাপ করিয়াছেন। কিন্তু তখনো মুসলমানরা ছালাত আদায় করিত ও শাহাদত মন্ত্র উচ্চারণ করিত। দুইশত বৎসর যাবৎ ইংরাজী গোলামীর জগদ্দল নিষ্পেষণে আজ আমাদের নৈতিক অবস্থার যে ভয়াবহ পতন ঘটিয়াছে, ছালাত ও উহার জামা‘আতের প্রতিষ্ঠার প্রতি মুসলিম জননায়ক ও সংস্কারকদের যে নিদারুণ অশ্রদ্ধা ও অবহেলা দেখা যাইতেছে। শাহ ছাহেব আমাদের বর্তমান ভয়াবহ ও মারাত্মক অবস্থা স্বচক্ষে দেখিতে পাইলে যে কি মন্তব্য করিতেন কে জানে?

অনুমানের উপর অনুমান ও পরিকল্পনার ভিত্তির উপর পরিকল্পনার কার্যে কুরআন ও সুন্নাতের মৌলিক এবং সার্বভৌম প্রাধান্য নষ্ট হইয়াছে বটে, কিন্তু অনুমান ও পরিকল্পনার জন্য আংশিক ভাবেও ইজতেহাদ বা Assertion এর শক্তি কখনো সঞ্জীবিত ছিল এবং অনুমান যতই বেঠিক হউক, কুরআন ও সুন্নাতের অপ্রত্যক্ষ সংযোগের দাবী কেহই পরিত্যাগ করেন নাই। কিন্তু বড়ই পরিতাপের কথা যে, আজ যেরূপ একদল নবুয়তের ন্যায় ইজতেহাদের অবিদ্যমানতার কথা ঘোষণা করিতেছেন এবং সকল প্রকার নবজাত রাষ্ট্রীয়, তামাদ্দুনী ও অর্থনৈতিক সমস্যার জন্য ছয়শত হইতে হাযার বৎসর পূর্বকার অচল ও নিষ্ফল অনুমান ও সিদ্ধান্ত সমূহের আশ্রয় লইতে উপদেশ দিতেছে, সেইরূপ আর একদল ক্বিয়াস ও ইজতেহাদের ভিত্তি এবং সমুদয় শর্তের সকল বালাইকে অস্বীকার করিয়া নাস্তিকতা, ইলহাদ, Secularism, Imperialism, Nationalism-Communism, Capitalism প্রভৃতির ভিত্তিতে গভীর গবেষণায় প্রবৃত্ত হইয়াছেন এবং কুরআন ও সুন্নাতের সর্বযুগীয় উপযুক্ত ও সার্বজনীনতার অচলতা সাব্যস্ত করিতেছেন।

لانه ساغر گير و نرگيس مت وبر ما نام فسق!

داورے خواهم مگر بارے كرا داورگنم!

‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’-এর অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হল ব্যবহারিক বৈষম্যের ভিত্তিতে মুসলিম জাহানকে নানারূপ দলে ও গোষ্ঠিতে বিভক্ত হইতে না দিয়া কুরআন ও সুন্নাতের ভারকেন্দ্রে সমগ্র মুসলমানকে একত্রিত (Consolidate) করা এবং মুসলিম জাতি গঠিত করা। কিন্ত আহলেহাদীছ মতবাদ হইতে বিচ্যুতি ঘটায় অতিভক্তি ও অতিবিদ্বেষের মড়ক জাতীয় জীবনে প্রবেশ লাভ করে। এই রোগের নিদারুণ পরিণতি স্বরূপ শী‘আ-সুন্নীর যুদ্ধ ও মাযহাব চতুষ্টয়ের উদ্দাম অবিশ্রান্ত ও নির্মম আপোষ সংঘর্ষ মুসলিম জগতের দিকে দিকে আরম্ভ হইয়া যায়। এই কাহিনী অতিশয় হৃদয়বিদারক। ইহার বিস্তৃত আলোচনার এখন সময় নাই। সংক্ষিপ্ত কথা এই যে, হানাফী ও শাফেঈ সংঘর্ষের বিষময় ও ভয়াবহ পরিণতি স্বরূপ সপ্তম হিজরীর মধ্যভাগে তাতারী নর রাক্ষসের দল মুসলিম জাহানে হানা দেয় এবং কোটি কোটি মুসলমানকে হত্যা করে। ৬৫৬ হিজরীতে হালাকু খান বাগদাদে প্রবেশ করিয়া খলীফাতুল মুসলিমীন এবং ৮ লক্ষ হইতে ৪০ লক্ষ মুসলমানকে হত্যা করে এবং সাতশত বৎসরের সঞ্চিত ও সংগৃহীত জ্ঞান ও রত্ন ভা-ার জ্বালাইয়া পোড়াইয়া লুট করিয়া অবশেষে দজলার বুকে ডুবাইয়া দেয়। শায়খুল ইসলাম ইবনে তায়মিয়াহ তদীয় রেসালায়, ইমাম ইবনুল ইয্ দামেষ্কী হানাফী হেদায়ার টীকা ‘তমবীহাৎ’ নামক গ্রন্থে এবং আল্লামা সৈয়দ রশীদ রিযা ‘কিতাবুল মুহাবেরাৎ’ নামক পুস্তকে ও ‘তাফসীর আল-মানার’-এ হানাফী এবং শাফেঈদের মাযহাবী কোন্দলকে এই হৃদয়বিদারক দুর্ঘটনার মূল কারণ বলিয়া নির্ণয় করিয়াছেন।

ইবনে আবিল হাদীদ ‘নিহিজ্জুল বালাগাহ’ গ্রন্থের ভাষ্যে লিখিয়াছেন : খোরাসানেও বাগদাদের মত হানাফী ও শাফেঈদের মধ্যে কলহ ও সংঘর্ষ তুমুলভাবে চলিতেছিল। হালাকু তখনো খিলাফতে ইসলামীয়ার চতুঃসীমা অতিক্রম করিতে দ্বিধাবোধ করিতেছিল। কিন্তু তুস শহরের হানাফীরা শাফেঈদের যিদে পড়িয়া হালাকুকে আমন্ত্রিত করিল এবং নগরের সিংহদ্বার নিজেরাই খুলিয়া দিল। খলীফাতুল মুসলিমীনের শী‘আ উযীর ইবনু আল-কামী স্বয়ং হালাকুকে বাগদাদে ডাকিয়া আনিয়াছিল।

বাগদাদের পতনের পর হইতে মুসলমানদের জাতীয় জীবন ক্রমশঃ অধিকতর জটিল ও ভারাক্রান্ত হইতে থাকে। কুরআন ও হাদীছের কেন্দ্র হইতে বিচ্যুতি ঘটিবার সাথে সাথে রাষ্ট্রিক কেন্দ্রও মুসলমানরা হারাইয়া ফেলেন। তাওহীদের স্থলে বহুরূপী শিরক, ইজতিহাদের (Assertion) স্থানে তাক্বলীদ এবং জাতীয় স্বার্থ, সংহতি ও সংগঠনের পরিবর্তে ব্যক্তিগত ও দলীয় স্বার্থপরতা, স্বেচ্ছাচার এবং ফের্কাবন্দী মুসলমানদের মধ্যে বদ্ধমূল হইয়া পড়ে। সপ্তম শতক হইতে ইসলামের প্রথম সহস্রকের অব্যবহিতকাল পর পর্যন্ত যে সকল মুজাদ্দিদ ও সংস্কারক ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’-এর নেতৃত্বভার গ্রহণ করিয়াছিলেন, শায়খুল ইসলাম ইমামুল হুদা ইমাম তাক্বীউদ্দীন ইবনে তায়মিয়াহ ও মুজাদ্দিদে আলফে ছানী শায়খুল ইসলাম আহমাদ সারহিন্দ-এর নাম তাঁহাদের সকলের পুরোভাগে উল্লেখযোগ্য। পুঁথি বাড়িয়া যাওয়ার ভয়ে আমি এখন হিন্দের  ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’-এর কথাই শুধু আলোচনা করিব। 

বিংশ শতকের হিন্দী ঐতিহাসিক আল্লামা শিবলী তৎকালীন হিন্দী মুসলমানগণের সামাজিক অবস্থা সম্মন্ধে লিখিয়াছেন : ‘ইসলামী সংস্কৃতির সম্পূর্ণরূপে বিলোপ সাধিত হইয়াছিল। মোগল দরবারের সাধারণ পোষাক ছিল ঘেরদার পাজামা আর হিন্দুয়ানী পাগড়ী। হিন্দু রাজাদের মত মুসলমান আমীর উমারা ও বাদশাহরা অলঙ্কার ব্যবহার করিতেন। সালামের পরিবর্তে সিজদা ও দ-বৎ প্রচলিত হইয়াছিল। মুসলমানেরা অসঙ্কোচে হিন্দুদিগকে কন্যাদান করিতে আরম্ভ করিয়াছিল’ (আওরঙ্গযেব আওর আলমগীর পার এক নযর, পৃঃ ৫২)। আক্বাইদ ও মতবাদের দিক দিয়া মুসলমানগণ যে কত দলে বিভক্ত হইয়া পড়িয়াছিল, তাহার সংখ্যা নিরূপণ করা দুঃসাধ্য। শী‘আ, নাসেবী, মু‘তাযিলা, জাহ্মিয়া, মুরজিয়া, মু‘আত্তিলা ও মুশাবিবহা প্রভৃতি পুরাতন দল ব্যতীত শুধু তাছাওউফের নামে শতাধিক দলের অভ্যুদয় ঘটিয়াছিল। জুনায়দিয়া, আদহামিয়া, মওলবিয়া, হাল্লাজিয়া, ওযূদিয়া, আহমাদিয়া, কলন্দরিয়া, মাদারিয়া, নিযামিয়া। এছাড়া শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিছ তদীয় গ্রন্থে শোহাগী, সন্দ্রোশী ও ঋষী প্রভৃতি ৮টি অভিনব দলের নাম উল্লেখ করিয়াছেন (তাফহীমাতুল ইলাহিয়াহ ১/১১২-১১৫ পৃঃ)। বাঙ্গালায় ফকীর ও দেহতত্ত্বের নামে যে সকল দলের উদ্ভব হইয়াছে, তন্মধ্যে কয়েকটির নাম উল্লেখ করিতেছি : বাউল, সাহেবধনী, সত্যধর্মী, নাগর্দ্দী, কীর্তি, নিয়া, চিত্রকার, ন্যাড়া, মালেকানা, মোতিয়া, মোমেনা, শেখজী, মওলিছালাম সংঘর, সংযোগী, কবিরপন্থী, দাউদপন্থী, পাঁচপীরিয়া, জালালিয়া, বদরশাহী ইত্যাদি’।  প্রম্নশিয়ার বন ইউনিভার্সিটির Semetic philology-এর প্রফেসর রেভারেন্ড হর্টন বলেন যে, ৮ শত হইতে ১১ শত খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত অন্ততঃ একশতটি ধর্মীয় মতবাদ ইসলামে আত্মপ্রকাশ করিয়াছিল (মুন্তাখাবুত তাওয়ারীখ, পৃঃ ২৫০-৪০০)

ন্যাশনালিষ্ট মুসলমানগণের আদর্শ মানব সম্রাট আকবরের সময়ে হিন্দ ভূমিতে এক জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠাকল্পে আরবী ভাষা, ফিক্হ, তাফসীর ও হাদীছের পঠন ও পাঠন নিষিদ্ধ এবং হিন্দু সাহিত্য ও হিন্দি ভাষা অবশ্যই পাঠ্য করা হয়। আকবর স্বয়ং প্রত্যহ সূর্যের সহস্র ও এক নাম জপ করিতেন। তিলক ফোটা কাটিতেন ও উপবীত ধারণ করিতেন, গরু ও গোবরের পূজা করা হইত, সালামের পরিবর্তে মৃত্তিকা চুম্বন প্রবর্তিত হইয়াছিল। আর মদ্যপান করার অনুমতি এবং তজ্জন্য উৎসাহ প্রদত্ত হইত। স্ত্রী সহবাসের সণান ও খাৎনার প্রথা রহিত করা হইয়াছিল, পর্দা ও হিজাব আকবর তুলিয়া দেন এবং গরু কুরবানী কঠোরভাবে নিষিদ্ধ হয়। মসজিদ ও মাদরাসা সমূহ জনমানবশূন্য হইয়া পড়ে। বিস্তারিত জানিতে হইলে মোল্লা আব্দুল কাদের বাদায়ূনীর ইতিহাস পড়িয়া দেখুন (Reconstruction of religious thought, P-228)। 

আকবর ও জাহাঙ্গীরের সময় হিন্দে মুসলমানদের জাতীয় জীবনের সুর্যে কিরূপভাবে রাহুগ্রস্ত হইয়াছিল, তাহার সংক্ষিপ্ত বিবরণ সাধক চুড়ামণি, আলেমকুল গৌরব, সত্যবাদিগণের অবিসংবাদিত নেতা মুজাদ্দিদে আলফেছানীর (৯৭১-১০৩৪ হিঃ)  বাচনিক শ্রবণ করুন :   

غربت اسلام نزديك پك قران بنهج قرار يافتد است كه اهل كفر بمجرد اجراے احكام كفريه يوملادر بلاد اسلام راضى نمى شوند، من خواهند كه اسلام بالكل زائل گردند واثرے آز مسلماني  ومسلمانى پيدا ندث ود كار تابعى مرحد رسانيد واندكسه مسلمانے آز شعائر اسلام الهارة فما يد بقتل من   رسد.  

‘প্রায় এক শতাব্দী ধরিয়া ইসলামের দুর্গতি এরূপ চরমে পেঁŠছিয়াছে যে, কাফেরের দল কুফরী বিধানসমূহ ইসলামী রাজ্যে প্রকাশ্যভাবে বলবৎ করিয়াই সন্তুষ্ট নহে-ইসলামের নির্দেশগুলিকে সম্পূর্ণরূপে মুছিয়া ফেলাই তাহাদের অভিপ্রায়। যাহাতে মুসলমানগণের মুসলমানির কোন চিহ্নই প্রকাশ হইতে না পারে। তাহারা এতদূর অগ্রসর হইয়াছে যে, কোন মুসলমান ইসলামের কোন সংস্কার যদি প্রকাশ্যভাবে প্রতিপালন করে, তাহা হইলে তাহাকে হত্যা করা হইয়া থাকে’।

সাড়ে তিনশ’ বৎসর পরেও অর্থাৎ ইংরেজ রাজত্ব ইউরোপীয় গণতন্ত্র এবং রাশিয়ার কমিউনিজম প্রভৃতির সহিত অঙ্গাঙ্গী ঘনিষ্ঠতা ও অন্তরঙ্গতা সত্ত্বেও হিন্দু ভাইদের রুচি, ধর্মীয় সংকীর্ণতা ও ইসলাম বিদ্বেষের যে কোন পরিবর্তন সাধিত হইয়াছে তাহা বুঝা যায় না। হিন্দু ভ্রাতারা অর্ধশতাব্দী ধরিয়া ন্যাশনালিজম পরম সহিষ্ণুতা, অহিংসা ও সকল ধর্ম মতবাদ, সংস্কৃতি ও সাহিত্যের সংরক্ষণের যে বড় বড় বুলি আওড়াইয়া আসিতেছিলেন, আজ স্বাধীনতা লাভ করিবার পর তাঁহাদের রাজ্যে হতভাগ্য মুসলমানের বেলায় তার কোন একটার সত্যতা ও যথার্থতা তাঁহারা প্রমাণিত করিতে পারিয়াছেন কি? কিন্তু হিন্দুদের মজ্জাগত  ও ঐতিহাসিক ইসলাম বিদ্বেষ ও পরধর্ম ভয়াবহ নীতি বিস্ময়ের বিষয় নয়। সর্বাপেক্ষা পরিতাপের বিষয় এই যে, তথাকথিত ন্যাশনালিষ্ট মুসলমানরাই হিন্দুদের যুগ-যুগান্তরের সঞ্চিত অভিলাষকে সার্থক করিয়া তোলার বা মিশনারী সাজিয়াছেন। সর্বস্বান্ত হিন্দুয়ানী মুসলমানদিগকে আজ পর্যন্ত অসাম্প্রদায়িকতা ও আত্মবিস্মৃতির যে সকল সদুপদেশ তাঁহারা বিতরণ করিয়া বেড়াইতেছেন, তাহা শুনিয়া অতি বড় নির্লজ্জকেও মাথা হেঁট করিতে হয়।

যাহারা পাকিস্তান রাষ্ট্রের নাগরিক তাহারা যেমন পাকিস্তানী, হিন্দুস্তান রাষ্ট্রের অধিবাসিবৃন্দও ধর্ম, গোত্র ও বর্ণ নির্বিশেষে যে সেইরূপ হিন্দুস্তানী। একথা কাহারো নিকট হইতে শিখিবার বিষয় নয়। কিন্তু মুসলমানের পরিবর্তে হিন্দুস্তানী বা পাকিস্তানী হইবার প্রশ্ন উত্থাপিত হইলে স্বভাবতঃ বুঝা যায় যে, মুসলমান হওয়া হিন্দুস্তানী বা পাকিস্তানী হইবার পরিপন্থী এবং সম্পর্ক দুইটি পরস্পর বিরুদ্ধ। সুতরাং একটিকে বাছিয়া লওয়া ছাড়া গত্যন্তর নাই। কিন্তু সম্রাট আকবরের অন্ধ অনুসারীদের স্মরণ রাখা উচিত যে, আকবরের ইসলাম বৈরী নীতিও হিন্দুদিগকে সন্তুষ্ট করিতে পারে নাই এবং তাঁহার সুর্ষোপসনা মহারাষ্ট্রের হিন্দু রাজন্যবর্গকে সান্তবনা দিতে সক্ষম হয় নাই। যে জাতি ভারতের মুক্তির আন্দোলনের অগ্র্রনায়ক গান্ধীকে পৈশাচিক ভাবে হত্যা করিতে কুণ্ঠিত হয় নাই এবং হত্যাকারী নরপিশাচদিগকে আজ পর্যন্ত যে জাতি রক্ষা করিবার জন্য কৃতসংকল্প, ভারত ডমিনিয়নের মুসলমানরা হিন্দুস্তানী বলিয়া খাতায় নাম লিখাইলেই যে সেই হিন্দুরা তাহাদিগকে সহজে নিস্কৃতি দিবে, ইহা আদৌ বিশ্বাসযোগ্য নয়। কিন্তু  ন্যাশনালিজমের মুসলিমরূপী অবতারদের দোষ দিয়া লাভ কী? কবি রুমীর ভাষায় তাঁহারা বাঁশী ছাড়া কিছুই নন, বংশীবাদকরা যে সুর ভাঁজিতেছেন বাঁশীর মুখে তাহাই ঝঙ্কৃত হইতেছে।

لغمه از لائى ست نشے آز لشى بدان

متي  آز سافى است لئے ازمشے بدان

প্রকৃত কথা এই যে, সুন্নাতের আদর্শ অনুসরণ করিয়া রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে ইসলাম ও কুফরে Confederation স্থাপিত হইতে পারে বটে, কিন্তু উভয়ের সংযোগে এক অখ- জাতি গঠন করার ফর্মূলা ভ্রান্তিমূলক ও অচল। মুজাদ্দিদে আলফে ছানী কুফর ও ইসলামের খিচুড়ি একজাতীয়তার ফর্মূলার কঠোর প্রতিবাদ করিয়া লিখিয়াছেন :

‘রাসূলুল্লাহ্ (ছাঃ)-এর অনুসরণের তাৎপর্য হইতেছে ইসলামী আদেশের অনুসরণ ও কুফরী প্রথা সমূহের বিলোপ সাধন। ইসলাম ও কুফর পরস্পর বিরুদ্ধভাবে সম্পর্কিত, একের প্রতিষ্ঠায় অপরের ধ্বংস অনিবার্য; পরস্পর বিপরীত দুই বস্ত্তর সম্মিলন সম্পূর্ণ অসম্ভব। একের   গৌরব বৃদ্ধির কারণ হইবে, অবশ্যম্ভাবীরূপে তাহারা ইসলামকে লাঞ্ছিত করিবে।  কাফের দলের সহযোগ আবশ্যক বিবেচিত হইলে তাহাদের চিরন্তন বিশ্বাসঘাতকতার অভ্যাসকে মনে রাখিয়া তাহাদের সহিত প্রয়োজনমত যোগাযোগ স্থাপন করিতে হইবে। আল্লাহ ও তদীয় রাসূল (ছাঃ)-এর যাহারা শত্রু, তাহাদের সহিত প্রণয় ও ঘেঁষাঘেঁষি গুরুতর পাপরাজির অন্যতম। ইহার সর্বনিমণ ক্ষতি এই যে, ইহার দ্বারা শরী‘আতের প্রতিষ্ঠা ও কুফরী সংস্কার সমূহের উচ্ছেদ সাধনের কার্য বাধাপ্রাপ্ত হয়। ইসলাম ও মুসলিম জাতির বিদ্রূপ করা কাফেরদের স্বভাব। সুযোগ পাইলেই মুসলমানদিগকে ইসলাম হইতে টানিয়া বাহির করিতে অথবা তাহাদিগকে ব্যাপকভাবে হত্যা করিতে কিংবা শুদ্ধি করিয়া লইতে তাহারা কৃতসংকল্প। অতএব মুসলমানদেরও আত্মসম্মানবোধ থাকা উচিত। হাদীছে বর্ণিত হইয়াছে যে, লজ্জা ও আত্মসম্মানবোধ ঈমানের অন্যতম লক্ষণ (বুখারী হা/২৪)

মুজাদ্দিদের কর্মবহুল জীবনকথা বিস্তৃতভাবে আলোচনা করা এখন সম্ভবপর নয়। ইলায়ে কালেমাতুল হক্বের জন্য শেষ পর্যন্ত তিনি কারাবরণ করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন। তাঁহার তাজদীদী কার্যাবলীর কয়েকটি শিরোনাম এই স্থানে উল্লেখ করিয়া ক্ষান্ত হইতেছি।

(১) জাহাঙ্গীরের রাজত্বের শেষভাগে হিন্দ ভূমিতে কুফরী প্রভাবের অবসান ঘটাইয়া শারঈ শাসনের পুনঃপ্রতিষ্ঠা।

(২) সিজদা ও দ-বৎ প্রথার উচ্ছেদ।

(৩) অদ্বৈতবাদ বা ওয়াহ্দাতুল ওজুদের খ-ন।

(৪) বাদ্যভা- ও  নৃতাগীতের প্রতিবাদ।

(৫) হাদীছের পঠন ও পাঠন এবং সুন্নাতের প্রতিষ্ঠাকল্পে উৎসাহ দান।

(৬) নিছক ছূফীগিরির অসারতা প্রতিপন্ন করিয়া শরী‘আতের অনুসরণের জন্য আহবান।

(৭) তাক্বলীদ ও অন্ধ গতানুগতিকতার  প্রতিবাদ।

(৮) মীলাদ ও অন্যান্য বিদ‘আতের খ-ন।

(৯) জাতি গঠন ও জাতীয় স্বার্থের সংরক্ষণ কল্পে আহবান।

মুজাদ্দিদের উক্তি শ্রবণ করিয়া কোন বাস্তবাগীশ ধারণা করিতে পারে যে, ইসলামী স্টেটের যে সকল অমুসলমান প্রজা বশ্যতা স্বীকার করিয়াছে, তাহাদের সহিত দুর্ব্যবহার করাই ইসলামী বিধান। কিন্তু প্রকৃত ব্যাপার তাহা নয়। ইসলামী আদর্শবাদের নিধনকল্পে এবং ইসলামী স্টেটের বিরুদ্ধে সর্বদা ষড়যন্ত্র করিতে যে সকল অমুসলমান অভ্যস্ত মুজাদ্দিদের বর্ণিত ব্যবস্থা তাহাদের উপর প্রযোজ্য। কিন্তু যে সকল অমুসলমান ইসলামী স্টেটের বশ্যতা স্বীকার করিয়াছে এবং বিদ্বেষ ও ষড়যন্ত্র যাহাদের স্বভাব নয়, তাহাদের প্রতি সদ্ব্যবহার করাই কুরআনে নির্দেশিত হইয়াছে। কুরআনের পরিগৃহীত নীতি এই যে,

لَا يَنْهَاكُمُ اللَّهُ عَنِ الَّذِينَ لَمْ يُقَاتِلُوكُمْ فِي الدِّينِ وَلَمْ يُخْرِجُوكُمْ مِنْ دِيَارِكُمْ أَنْ تَبَرُّوهُمْ وَتُقْسِطُوا إِلَيْهِمْ إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُقْسِطِينَ.

‘যাহারা তোমাদের সঙ্গে ধর্মের বৈষম্যের জন্য যুদ্ধে প্রবৃত্ত হয় না এবং তোমাদিগকে তোমাদের গৃহ হইতে বিতাড়িত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় না, তাহাদের সহিত সদ্ব্যবহার ও ন্যায়নিষ্ঠ আচরণ করিতে আল্লাহ তোমাদিগকে নিষেধ করেন নাই। বস্ত্ততঃ আল্লাহ ন্যায়নিষ্ঠগণকে ভালবাসেন’ (মুমতাহানা ৬০/৮)। স্বজাতি প্রীতির জন্য ন্যায়বিচারে ব্যতিক্রম করা ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। কুরআনের নির্দেশ এই যে, وَلَا يَجْرِمَنَّكُمْ شَنَآنُ قَوْمٍ عَلَى أَلَّا تَعْدِلُوا اعْدِلُوا هُوَ أَقْرَبُ لِلتَّقْوَى  ‘কোন জাতির পক্ষপাতিত্ব যেন তোমাদিগকে ন্যায়বিচার না করার জন্য প্ররোচিত না করে। সকল সময়ে ন্যায়বিচার করিবে, ইহাই তাক্বওয়ার নিকটবর্তী আচরণ’ (মায়েদা ৫/৮)। ইসলামী স্টেটের অমুসলমান প্রজার রক্তের মূল্য একজন মুসলমানের রক্তের সমতুল্য। আর তাহার ক্ষতিপূরণের (Compensation) পরিমাণ মুসলমানের দিয়তের সমান। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) স্বয়ং অমুসলিম প্রজাকে হত্যা করার জন্য মুসলমান হত্যাকারীকে মৃত্যুদ--র আদেশ দিয়াছিলেন। বকর বিন ওয়ায়েল গোত্রের জনৈক মুসলমান জাবরা নামক স্থানের জনৈক অমুসলিম প্রজাকে হত্যা করায় ওমর ফারূক (রাঃ) অপরাধীকে মৃত ব্যক্তির অমুসলমান আত্মীয়-স্বজনদের হস্তে সমর্পণ করেন এবং তাহারা মুসলমান অপরাধীকে মারিয়া ফেলে আলী মর্তুযা (রাঃ)-এর শাসনকালেও অনুরূপ ব্যাপার ঘটিয়াছিল। কিন্তু নিহত অমুসলমানের আত্মীয়বর্গ হত্যার ক্ষতিপূরণ গ্রহণ করিয়া অপরাধীকে ছাড়িয়া দেয়। দেশরক্ষার (Defence) জন্য সৈন্যদলে ভর্তি হওয়া মুসলমান নাগরিকদের জন্য অবশ্য কর্তব্য (Compulsory)। কিন্তু অমুসলমান প্রজাদের জন্য নয়। তাহাদের রক্ষা ও হেফাযতের জন্য ওমর ফারূকের সময়ে ধনীদের নিকট হইতে মাথা পিছু মাসিক ১ টাকা, মধ্যবিত্তগণের নিকট হইতে ১০ আনা ও শ্রমজীবীদের নিকট হইতে ১০ চারি আনা করিয়া ট্যাক্স লওয়া হইত। শিশু, নারী, পাগল, অন্ধ, আতুর, বৃদ্ধ, চিররোগী, দাসদাসী এবং ধর্মযাজকদের নিকট হইতে উক্ত ট্যাক্স আদায় করার শরী‘আতে বিধান নাই। যাহারা যুদ্ধ করিতে সক্ষম, শুধু তাহাদের জন্য উক্ত ট্যাক্সের ব্যবস্থা আছে। ইয়ারমুকের যুদ্ধে রোমক বাহিনীর বিরুদ্ধে মুসলিম সেনাবাহিনীর কেন্দ্রীভূত (Concentration) হওয়া আবশ্যক বিবেচিত হওয়ায় জেনারেল আবু উবায়দাহ (রাঃ) অমুসলমান প্রজাবৃন্দকে তাহাদের ট্যাক্স ফিরাইয়া দিয়াছিলেন এবং বলিয়াছিলেন যে, তোমাদের হিফাযতের প্রতিভু স্বরূপ তোমাদের নিকট হইতে জিযিয়া গ্রহণ করা হইয়াছিল। এক্ষণে সে দায়িত্ব বহন করিতে অসমর্থ হওয়ায় তোমাদের ট্যাক্স তোমাদিগকে ফেরত দেওয়া হইল।

ইসলামী হুকুমতে দ-বিধি আইনে মুসলমান ও অমুসলমানের মধ্যে কোনরূপ প্রভেদ নাই। চুরি, ব্যভিচার প্রভৃতি অপরাধের জন্য উভয় শ্রেণীর নাগরিকের নিমিত্ত তুল্যদ- নির্দেশিত হইয়াছে। আলী মর্তুযার (রাঃ)  উক্তি :

‘তাহাদের ধন আমাদের ধনের ন্যায়’ اموالهم كاموالنا অনুসারে দেওয়ানী কার্যবিধিতেও মুসলমান ও অমুসলমান প্রজার মধ্যে তারতম্য নাই। এমনকি অমুসলমান প্রজার মদ্য ও শূকর যদি কোন মুসলমান প্রজা নষ্ট করে ইসলামী বিধানমত তাহাকে তজ্জন্য ক্ষতিপূরণ দিতে হইবে। ইসলামী স্টেটে অমুসলমান প্রজাদের ব্যবহারিক বিষয়সমূহ তাহাদের শাস্ত্র অনুসারে মীমাংসিত হইবে। যে সকল বিষয় তাহাদের শাস্ত্র অনুসারে বিধিসঙ্গত অথচ ইসলামী শরী‘আতে নিষিদ্ধ সে সকল কার্য অমুসলমান প্রজারা আপনাপন জনপদে স্বাধীনভাবে সম্পন্ন করিতে পারিবে। ইসলামী স্টেটের অন্তর্গত মুসলিম নগরী সমূহের অমুসলমানদের পুরাতন দেবালয় ও মন্দিরগুলি সুরক্ষিত থাকিবে। ভাঙ্গিয়া গেলে সেই স্থানে সেগুলি তাহারা সংস্কার করিয়া লইতে পারিবে। কিন্তু নুতন দেবালয় ও মন্দির প্রভৃতির নির্মাণ কার্য স্টেটের সম্মতি সাপেক্ষ হইবে’।

এই বিষয়টি একটু সবিস্তার আলোচনা করার উদ্দেশ্য এই যে, পাকিস্তানকে ইসলামী স্টেটে পরিণত করা সম্মন্ধে অনভিজ্ঞের দল নানারূপ সন্দেহের অবতারণা করিয়া থাকেন। কোন দায়িত্ব সম্পন্ন লোকের মুখে আমরা এরূপ কথাও শুনিয়াছি যে, ইসলামী বিধান অনুসারে অমুসলমান নাগরিকদের প্রতি ন্যায়সঙ্গত ব্যবহার করা সম্ভবপর হইবে না। কাজেই পাকিস্তানের জন্য সুইজ, ব্রিটিশ, রাশিয়ান, আমেরিকান বা হিন্দুস্তানী Consitution ধার করিতে হইবে। অজ্ঞতা অন্যতম শত্রুর নাম। স্বীয় বিকৃত রুচিকে পরিতৃপ্ত করিতে গিয়া যাহারা ইসলামের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ উপস্থাপিত করে, তাহারা যে কোন ব্যক্তি হউক না কেন, তাহাদের অপেক্ষা ইসলামের বড় শত্রু আর কেহ নাই। আমরা চ্যালেঞ্জ করিতেছি। ইসলামী বিধান অপেক্ষা উৎকৃষ্টতর বর্তমান যুগের কোন আন্তর্জাতিক Consitution-এর সন্ধান কেউ দিতে পারেন কি?    [ক্রমশঃ]

আল্লামা আব্দুল্লাহিল কাফী আল-কুরায়শী (রহঃ) প্রণীত ‘আহলেহাদীস পরিচিতি’ শীর্ষক বই থেকে সংগৃহীত, পৃঃ ৪৫-৭১ পৃঃ।



আরও