ইহূদী ঘরে জন্মানো এক খ্রিস্টান ভাষাবিদ লেইটনার এবং ব্রিটেনের শাহজাহান মসজিদ
জান্নাতুন নাঈম পায়েল
ইতিহাস লুকোচুরি : সত্যের তুলাদন্ড; কতিপয় ঐতিহাসিক বুদ্ধিজীবী
পলাশীর রক্তস্নাত ইতিহাস কোন রক্তরাঙ্গা পলাশ প্রসূন নয়, এক ভাগ্যবিড়ম্বিত নবাবের পতন কাহিনী। এটা ঘুমপাড়ানি মাসি-পিসির ছেলেভুলানো গান নয়, নয় কোন আরব্য রজনীর অলীক উপন্যাস। পলাশীর আম্রকানন থেকে যেদিন বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হল, সেদিন থেকে ইংরেজদের একচেটিয়া রাজত্ব শুরু হল। আর শুরু হল এ দেশের ভুঁইফোড় জমিদারদের ইংরেজপ্রীতি। এর খেসারত বাঙালি জাতিকে বারবার দিতে হয়েছে। ইংরেজ বাঙালি জাতিকে অনেক দিয়েছে, কিন্তু নিয়েছে এর লক্ষ-কোটি গুণ বেশি। ইংরেজ বাহাদুররাই আমাদেরকে শিখিয়েছে কিভাবে অন্যের পা ধরে থাকতে হয়। তাইতো বাঙালিরা ইংরেজ শাসনামল থেকে শুধু কেরানির চাকুরী পেতে শুরু করেছিল। ইংরেজদের সাথে আপোস করে বাঙালি জমিদার বাবুরা তাদের পাপোশে পরিণত হল। নীতির মুখে বোমা মেরে তারা তাদের বিশাল ধামা পাতলো ইংরেজদের কাছে, ঠিক ভিখারীর মত। সাপের মুখেও তারা চুমু দিল আবার বেজির মুখেও। তাই তারা বাবুদের কাছে জলে ধোয়া তুলসি পাতা বনে গেল। আর যারা ইংরেজদের বিরুদ্ধে লাঠি তুলেছিল, তারা আজ ইতিহাসের পাতা থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। ইংরেজ বাবুদের কাছে বাহবা পাওয়া এদেশের পা চাটা কুকুরগুলো ইতিহাসের মজ্জা চিবিয়ে খেয়েছে। তাইতো ঐতিহাসিকরা লিখেছেন তাদের বিজয়গাঁথা, পরিয়েছেন বিজয়মাল্য।
পাশ্চাত্যের পদলেহী নেতৃত্বের করুণ পরিণতি :
ইতিহাস আমাদেরকে এটাও শিখিয়েছে যে, পাপ মানুষকে ক্ষমা করে না। সে তার ষোলআনা প্রাপ্য চুকিয়ে নেয়। নবাব সিরাজদ্দৌলাকে বাংলার মসনদ থেকে যে কুচক্রী মহল উৎখাত করে নিজেদেরকে বহাল করেছিলেন, তারা একদিকে মানুষের কাছে হয়েছে ঘৃণিত, অন্যদিকে ইতিহাসের যুগকাষ্ঠে হয়েছে বলি। মীরজাফরের শেষ জীবন সুখের হয়নি। এমনিতেই ব্রিটিশরা তাকে টিস্যু পেপারের মত ব্যবহার করেছে। তারপর তার বিশ্বাসঘাতকতার পুরস্কার স্বরূপ তাকে নিজেদের সহজ শিকারে পরিণত করেছে। এই বিশ্বাসঘাতক মীরজাফর এতটাই ঘৃণ্য এক নাম যে, আজকাল কেউ তার সন্তানের নাম পর্যন্ত মীরজাফর রাখতে চায় না। অথচ তার নাম ছিল মীর জাফর আলী খান। আজকাল কোন ব্যক্তি কোন টাউটবাজ মানুষকে দেখলে তাকে ‘মীরজাফর’ কিংবা ‘ব্রিটিশ’ বলে আখ্যা দেয়। এই ধারণা মানুষের মনে হঠাৎ করে উড়ে আসেনি, বরং তা এক বিশ্বাসঘাতকতার হিংস্র ইতিহাসের বহিঃপ্রকাশ। মীরজাফর কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। আর তার পুত্র মীরন বজ্রাঘাতে মারা যায়। উমিচাঁদ উন্মাদ ও ক্ষুধার যন্ত্রণায় কাতর হয়ে বিদায় নেয়। মহারাজ নন্দকুমার মিথ্যা অভিযোগে ফাঁসির কাষ্ঠে নস্যাৎ হয়। জগৎশেঠ ও মহারাজ স্বরূপচাঁদ গঙ্গার জলে ডুবে বিনাস হয়। মুহাম্মাদী বেগ কূপে পড়ে মারা যায়। রায়দুর্লভ জেলখানায় থেকে অনশন-অর্ধাশনে মারা যায়। আর দুর্লভরাম নিঃস্ব অসহায়ের মত নান্তানাবুদ হয়ে সর্বস্বান্ত হয়।
লর্ড ক্লাইভের ছন্দপতন :
লর্ড ক্লাইভ ইংরেজদের হাতে গড়া এক লর্ড। এ লাট ছাহেবের মৃত্যুও হয় অত্যন্ত করুণ অবস্থায়। এই রক্তপিপাসু লর্ড ক্লাইভ আত্মহত্যা করে জীবন ধ্বংস করে। তার আত্মহত্যার কারণ সকলের জানা দরকার। ভারতের অর্থনৈতিক পতনের মূলহোতা শোষক ক্লাইভ ভারত ছেড়ে যাওয়ার আগে তৎকালীন সময়ে পেয়েছিলেন দুই লক্ষ আশি হাযার (২,৮০,০০০/-) টাকা। আর হাতের পুতুল মীরজাফর তাকে দিতে বাধ্য হয়েছিল আরও এক লক্ষ ষাট হাযার (১,৬০,০০০/-) টাকা। মেম্বার হিসাবে তার পকেটে আরও দুই লাখ (২,০০,০০০/-) টাকা জমা পড়েছিল। আর সেনাপতির যোগ্যতা ও ষড়যন্ত্রের পুরস্কার স্বরূপ পেয়েছিল আরও এক লাখ ষাট হাযার (১,৬০,০০০/-) টাকা। যখন ইংল্যা--র উদ্দেশ্যে তার ত্রিশটি নৌকা ছেড়ে যাচ্ছিল, তখন তা ছিল ধনরত্ন, মণি-মাণিক্য, সোনা ও রূপায় ভর্তি। দেশে ফেরার পর সে এক বিরাট মামলার আসামী হিসাবে বিবেচিত হয়। বিষয়টি এমন ছিল না যে, সে ভারতের মানুষকে শাসন-শোষণ করে কোটি কোটি টাকা লুটে এনেছে। বরং তার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ ছিল এমন যে, সে ব্রিটিশ সরকারকে যা দেওয়ার কথা ছিল তা দেয়নি। তাই আসামী হওয়ার অপমানে, ক্ষোভে, বিস্বাদে সে আত্মহত্যা করেছিল। এটাই একজন শোষকের যোগ্য পুরস্কার। কই ঐতিহাসিকরা তো এই ইতিহাস ফুটিয়ে তুলতে চান না? কেন? কারণ মানুষ সত্য জেনে যাবে! ইতিহাস যে জাতির কাছে অস্পষ্ট, সে জাতির মত অভাগা আর কেউ নেই। জাতি ততদিন নির্বোধ থেকেই যাবে যতদিন জাতির সত্য ইতিহাস উন্মোচিত না হবে। আজ জাতি ব্যাঙের মত ঘুমিয়ে গেছে, পঠন-পাঠন থেকে জাতি শত শত আলোকবর্ষ দূরে অবস্থান করছে। তাই এ জাতির কল্যাণ আজ ধূলায় ভূলুণ্ঠিত ও দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত। এরপরও কিছু কিছু পা চাটা ঐতিহাসিক ও বুদ্ধিজীবী সম্পর্কে জানা প্রয়োজন। নিমেণ তাদের কয়েকজনের পরিচয় উল্লেখ করা হ’ল :
ইতিহাসের কতিপয় বিদেশী বুদ্ধিজীবী :
আল-বুকার্ক : আল-বুকার্ক প্রথম মিশনারী, যিনি ভারতকে খ্রীস্টান ধর্মের আওতায় আনা যায় কি-না এমন ভেবে ভারতবর্ষে এসেছিলেন। ভারতকে তিনি শোষণের এক বড় ক্ষেত্র হিসাবে তৈরি করতে চেয়েছিলেন। মূলতঃ তিনি পর্তুগাল থেকে উপমহাদেশে এসেছিলেন।
রাণী এলিজাবেথ : ব্রিটেনের অবিবাহিতা রাণী। পরাক্রমশালী এই রাণী ৪৫ বছর শাসন ক্ষমতায় ছিলেন। তিনি যখন ব্রিটেনের রাণী তখন ভারতবর্ষের শাসক আকবর। রাণী আকবরকে কব্জা করে ফেলেছিলেন। রাণী ভারতবর্ষে বাণিজ্য করার অনুমতি প্রার্থনা করলে তা আকবরের কাছে সহজেই মঞ্জুর হয়ে যায়। রাণী ইস্ট ই--য়া কোম্পানিকে নির্ভয়ে ১৫৯৯ সালে এদেশে বাণিজ্য করার অনুমতি দেয়। এর পর থেকে ধীরে ধীরে ভারতবর্ষের পতন শুরু হয় এবং ইংরেজদের শক্তি প্রবল হতে শুরু করে।
ফ্রাসোয়াঁ বারনিয়ের : ফ্রাসোয়াঁ বারনিয়ের ছিলেন বিখ্যাত ডাক্তার। যাকে ১৬৫৮ সালে শাহজাহানের রাজত্বকালে ভারতবর্ষে পাঠানো হয়। তিনি অনেকগুলো মুসলিম দেশ ভ্রমণ করে ভারতবর্ষে পাড়ি জমান ভারতের পেটের কথা জানতে। শাহজাহান ছিলেন খুব ধার্মিক মানুষ, তাই তাঁর সময়ে প্রাথমিক পর্যায়ে বারনিয়ের খুব বেশি সুবিধা করতে পারেননি। কিন্তু বারনিয়েরকে খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি। কারণ তিনি পেয়েছিলেন শাহজাহানের বিলাসী ছেলে দারাশিকোকে। দারাশিকোর মনের বরফ গলতে দেরি হয়নি। বারনিয়েরকে তিনি পারিবারিক ডাক্তার হিসাবে স্বীকৃতি দেন। কারণ তার স্ত্রী বারনিয়ের চিকিৎসায় বেশ উপকার পেয়েছিলেন। দিল্লীর রাজ দরবারে তিনি ভিসাবিহীন প্রবেশ পাওয়ার সুবাদে দরবারের ভিতরের বালক-বালিকা ও মহিলাদের সাথে কথা বলার সুযোগ পেয়েছিলেন এবং তাদের ভিতরের কথা বের করে নেওয়ার চেষ্টায় বিভোর ছিলেন। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল যে, তিনি কোন পারিশ্রমিক নিতেন না। এটা ছিল তার সবচেয়ে বড় অস্ত্র। এমনকি দারাকে তিনি প্রথম পরামর্শ দিয়েছিলেন, যাতে সম্রাটের মৃত্যুর পর পরবর্তী সম্রাট হিসাবে দিল্লীর মসনদে দারাই বসতে পারেন। এর পিছনে বারনিয়ের সবচেয়ে বড় স্বার্থ ছিল দারাকে হাত করে ভারতবর্ষে প্রভাব বিস্তার করা। এই কুলাঙ্গার বারনিয়ের দারাকে আকবরের অনুসরণে উদ্বুদ্ধ করেন। তাই আর নিজেকে গুটিয়ে না রেখে দারাশিকোও ‘মাজমূউল বাহরাইন’ বলে একটি বই লিখেছিলেন এবং হিন্দুধর্ম গ্রন্থ ‘উপনিষদ’-এর অনুবাদ করেছিলেন বা করিয়ে নিয়েছিলেন। যা ছিল বিলেতি মস্তিষ্কজাত একটা কৌশল। পরবর্তীতে তাকে এর জন্য যথেষ্ট মূল্য দিতে হয়েছিল।
ওয়ারেন হেস্টিংস : ওয়ারেন হেস্টিংসকে ইস্ট ই--য়া কোম্পানির কেরানি বানিয়ে পাঠানো হয় ভারতবর্ষে। অত্যাচারের ষ্টীমরোলার চালিয়ে ব্রিটিশ সরকারকে দারুণভাবে মুগ্ধ করেন তিনি। শাসন শোষণের পুরষ্কারস্বরূপ তিনি ভারতের গভর্ণর জেনারেলের পদ অলঙ্কৃত করেন। তার সময়ে তৈরি হয়েছিল ‘এশিয়াটিক সোসাইটি’। মুদ্রণ যন্ত্রের প্রচলনও তার সময়ে হয়েছিল। তার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল দেশীয় ভাষায় খ্রীস্টান ধর্ম প্রচার করা ও প্রভাব সৃষ্টি করা।
উইলিয়াম হান্টার : উইলিয়াম হান্টার ছিলেন একাধারে বিখ্যাত সিভিলিয়ান, সাংবাদিক ও শক্তিশালী লেখক। তার এই মেধার যোগ্যতার স্বীকৃতিস্বরূপ ‘Direct General of Statistics’ পদে তাকে আসীন করা হয়েছিল। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর পদে অধিষ্ঠিত হন। আবার বড়লাটের শাসন পরিষদের সদস্য এবং একজন পরামর্শদাতা হিসাবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেন। সত্য-মিথ্যা যত ধরণের শিলালিপি, পুঁথি, মুদ্রা, মোহর ইত্যাদি ছিল উপরের লেখা এই বুদ্ধিজীবী যেগুলোর ইংরেজি অবরের প্রতিলিপি করার পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন। এটা আসলে লক্ষ কোটি মানুষকে ভুল বুঝাবার একটি অভিনব পদক্ষেপ। যে সমস্ত শিলালিপি ও তাম্রলিপি উদ্ধার করা হয়েছে যেমন সেগুলোর ভাষা বুঝে ওঠা অসম্ভব, তেমনি তার অনুবাদ করাও অলীক কল্পনা ও হাস্যকর। এই হান্টার ভেবেছিলেন যে, হিন্দুদেরকে দমন করতে মুসলিমদের পৃষ্ঠপোষকতা করা অতীব যরূরী। কারণ হিন্দুরা পর্যন্ত ব্রিটিশ রাজ্যের আধিপত্য সহ্য করতে পারেনি। মুসলমানদের জন্য তার দরদ উপচে পড়েছিল। তিনি মুসলমানদের অবনতির কারণ ও তাদের ব্রিটিশ বিদ্বেষের কারণ উল্লেখ করে একটি তথ্য ভিত্তিক রিপোর্ট প্রকাশ করেন। যার নাম দেন ‘The Indian Musalmans’. এই বইটিতে তিনি বুঝাতে চেয়েছেন যে, ইংরেজরা মুসলিমদের চাকুরী কেড়ে নিয়ে বড়ই ভুল করেছে। সবকিছুই যে ধাপ্পাবাজি তা স্পষ্ট হয়েছিল, যখন তিনি বইটি তাঁর একান্ত বন্ধু হার্টসনকে উৎসর্গ করেছিলেন। ইনি সেই সাদা চামড়ার ভদ্রলোক হার্টসন, যিনি দ্বিতীয় বাহাদুর শাহের রাজবাড়ির ২৯টি কচি বাচ্চাকে হত্যা করে তাদের মাথা ঝুড়িতে সাজিয়ে বৃদ্ধ বাদশাহকে উপহার দিয়েছিলেন। দুঃখজনক হলেও সত্য ইতিহাস এই যে, মুসলিম জাতিকে চমকে দেওয়া সেই বুদ্ধিজীবী হান্টারও পেয়েছিলেন ব্রিটিশের দেওয়া ‘স্যার’ উপাধি।
উইলিয়াম কেরি : কেরি ছিলেন একজন খ্রীস্টান মিশনারী। ১৭৯৪ সালে তিনি বাংলায় ব্যাপটিস্ট মিশন প্রতিষ্ঠা করেন। তার উদ্দেশ্য ছিল ভারতের কোটি কোটি মানুষকে খ্রীস্টান ধর্মের ছায়াতলে শামিল করান। তাই তিনি দেশীয় ভাষা শিক্ষার উপর বেশ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। বাংলা ভাষাকে অখ্যাত করে দেওয়ার জন্য সংস্কৃত ভাষার দুহিতা হিসাবে বাংলাকে চিহ্নিত করেন তিনি। ১৭৯৯ সালে কেরি ছাহেব হুগলীর শ্রীরামপুরে একটি মিশন প্রতিষ্ঠা করেন। তার নিজের তৈরি করা ছাপাখানায় ১৮২৫ সালে ছাপা হল একটি অভিধান, যেখানে শব্দ সংখ্যা ছিল আশি হাযার। বেশির ভাগ শব্দকে সংস্কৃত থেকে সৃষ্টি বলে চিহ্নিত করা হল। ব্রিটিশদের কারসাজি এখানে। তাদের সূক্ষ্ম মস্তিষ্কের কারচুপি বাঙালিদের চোখ এড়িয়ে যায়। সেখান থেকে তারা এমন এক ইনজেকশন পুশ করে দিয়েছে যে, আজও বাঙালি বিশ্বাস করে বাংলা ভাষার অধিকাংশ শব্দ সংস্কৃত থেকে আমদানি করা। অর্থাৎ সংস্কৃত ভাষা হল মূল, আর বাংলা হল এর নাতনি। তখন থেকেই তাদের প্রচার ও অপপ্রচারে সংস্কৃত থেকেই বাংলার উৎপত্তি, এই মতবাদটি প্রতিষ্ঠা লাভ করল। এই ঘটনা রটনার পিছনে সবচেয়ে বড় কলকাঠি যিনি নেড়েছিলেন, তিনি হলেন উইলিয়াম কেরি। তার চেষ্টায় বাংলা ভাষায় বাইবেলের প্রথম অনুবাদ হয়েছিল।
টমাস মনরো : টমাস মনরো ছিলেন একজন ব্রিটিশ সৈনিক, যিনি মাত্র ২১ বছর বয়সে ভারতে এসেছিলেন। তার জীবনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল, ‘মহীশুরের বাঘ’ নামে খ্যাত হায়দার আলী খান ও তার সুযোগ্য পুত্র টিপু সুলতানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা। মিস্টার মনরো প্রতারণা, শঠতা, ঘুষ ও প্রতিশ্রুতি ভঙ্গে ছিলেন খুবই প্রসিদ্ধ। টিপু সুলতানের কর্মচারীদের ও হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের সামরিক নেতাদের মন মাতানো, মিথ্যা প্রতিশ্রুতি ও প্রতারণায় জয়লাভ করেছিলেন তিনি। এই কারণে টিপুকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা তার পক্ষে খুব সহজ হয়ে উঠেছিল।
ডিরোজিও : ‘ইয়ং বেঙ্গল’-এর কথা নিশ্চয়ই আমরা অনেকেই জানি। এর সাথে একজন ব্যক্তির নাম জড়িয়ে আছে, তিনি হলেন ডিরোজিও। কলকাতার ‘হিন্দুস্কুল’-এর শিক্ষক ছিলেন এই উদারচিত্ত কবি। ‘হিন্দুস্কুল’ নামটি শুনলেই বোঝা যায় যে, ব্রিটিশরা কিভাবে হিন্দুদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিল। মুসলমান বুদ্ধিজীবী সমাজ বলতে যেটি ছিল তাহল উপেক্ষিত, অবহেলিত, নিঃষ্পেষিত। আজও এই কথা রটে যে, মুসলিমরা অভিমান করে ইংরেজি শেখেনি। কিন্তু ইংরেজরা এমন পরিবেশ-পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল যে, যেখানে মুসলিমদের শিক্ষা গ্রহণ করার দুয়ার ছিল রুদ্ধ। ইংরেজ ও তাদের পা চাটা তাবেদার শ্রেণী সবসময় নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত থেকেছে। তেমনি অনুন্নত সমাজ, কোল, ভিল, মু-া, সাঁওতাল প্রভৃতিদেরকে মানুষ বলতে তারা কষ্টবোধ করত। এই বঞ্চিতের দল ছিল তাদের কাছে ভোগ্য জীবের মত। ডিরোজিও তার দেশীয় ছাত্রদের স্বাধীন মতামত দেবার ক্ষমতা ও স্বাধীন রুচি সৃষ্টিতে সক্ষম ছিলেন। তিনি তার ছাত্রদের ভিতরে একটি আধুনিক দল সৃষ্টি করেন, যাদের বলা হত ‘ইয়ং বেঙ্গল’। তারা স্বাধীন হতে গিয়ে হিন্দুবংশে জন্ম নিয়েও হিন্দু ধর্ম বিরোধী হয়ে পড়ে। তারা গরুর গোশত ও মদ খেতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে এবং ঠাকুর দেবতাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। ইংরেজ পুত্র ডিরোজিও শিক্ষা দিয়েছিলেন কীভাবে স্বাধীনভাবে চলতে হয়। কিন্তু তিনি তার দলের সদস্যদেরকে এটা কখনও ভাবতে শেখাননি যে, মুসলমানদেরকে কেন দাবিয়ে রাখা হয়েছে, অনগ্রসর জাতি ও আদিবাসীরা কেন বঞ্চিত? মিথ্যা ইতিহাস কেন লেখা হচ্ছে? ‘ইয়ং বেঙ্গল’ দলে ঠাকুর দেবতাকে গালি দেওয়া, গো-মাংস খাওয়া, মদ পান করার অভ্যাস প্রভৃতি খ্রীস্টান ধর্মের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ডিরোজিও মহাশয় আসলে তার দলকে অনেকটাই খ্রীস্টান ধর্মমুখী করতে সক্ষম হয়েছিলেন এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার হল যে, তার দলে কোন মুসলিম বা ছোটলোক (হরিজন বা উপজাতি) ছিল না। এই তথ্য পড়ে অবাক হলেও বাস্তবতা এমনি। [ক্রমশঃ]
মেহেদী আরীফ
এম. এ ইংরেজী বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়