পরপারের যাত্রী
মুখতারুল ইসলাম
বযলুর রহমান 2413 বার পঠিত
কিছু
ঘটনা, কিছু স্মৃতি, কিছু স্বপ্নকে লালন করে মানুষ বেঁচে থাকে। হৃদয়ের
মুকুরে জমে থাকা সেই স্মৃতিগুলো কাউকে কখনো আনন্দ দেয়, আবার কাউকে কাঁদিয়ে
ছাড়ে। আবার কাউকে সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা জোগায়। আজ
এমনি একটি স্মৃতিবিজড়িত ঘটনার অবতারণা করছি এখানে, যা এক অজানা ও অব্যক্ত
হৃদয়ের আশাহীন দুর্ঘটনার প্রতিচ্ছবি!
ফেব্রুয়ারী ২০০৫। আমি তখন দাখিল পরীক্ষার্থী। সাতক্ষীরার ঐতিহ্যবাহী মারকায ‘দারুলহাদীছ আহমাদিয়া সালাফিইয়াহ বাঁকাল’-এর ছাত্র। যেখানে দ্বিতীয় শ্রেণী থেকে দাখিল পর্যন্ত দীর্ঘ ৯ বছর অধ্যয়ন করেছি। সেখানে দেখেছি অনেক আনন্দ, অনেক ঘটনা। দেখেছি সাংগঠনিক কর্মতৎপরতা, সৌহার্দপূর্ণ দায়িত্বপালন, সাধারণ জনতার প্রাণোচ্ছল উপস্থিতি, ছহীহ হাদীছের সংগঠক একদল নিবেদিতপ্রাণ মানুষ। সব ঠিকঠাক চলছিল। নিয়মতান্ত্রিকতা ছিল দারুল হাদীছের অনন্য বৈশিষ্ট্য। হঠাৎ খবর আসল, অত্র মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’-এর আমীর প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিবসহ কেন্দ্রীয় চার নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। খবরটা শুনামাত্রই যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। তখন সবার মধ্যে এক ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হল। যাবতীয় কর্মচাঞ্চল্যের গতি থেমে গেল। হৃদয়ের গভীরে কোথায় যেন আপনজন হারানোর ব্যাথায় মোচড় দিল। এক ভূতুড়ে পরিবেশের সৃষ্টি হ’ল।
চতুর্দিকে সুনসান নীরবতা। হঠাৎ ভয়ংকর এক খবর আসল। প্রশাসন কর্তৃক মাদরাসা রেইড হবে। চিরূনি অভিযান চালানো হবে ড. গালিবের প্রতিষ্ঠানে বোমা, অস্ত্র পাওয়া যায় কি-না! একদিকে স্যারের গ্রেফতারে সকলের মন বিষণ্ণতায় ভরপুর, অন্যদিকে ছাত্র জীবনের প্রথম ধাপ উত্তীর্ণের প্রচেষ্টা অর্থাৎ দাখিল পরীক্ষা। মাদরাসার শিক্ষকগণ বললেন, তোমরা যারা পরীক্ষার্থী, তারা বাড়ি চলে যাও। অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাড়ী চলে যেতে হল। কিন্তু বাড়ীতে গিয়ে অতি শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি হারানোর ব্যাথা আরো ঘনীভূত হ’ল। এরই মধ্যে হঠাৎ শুনলাম বাঁকালের দশ-বারো জন ছাত্র স্যারের মুক্তির দাবিতে পোস্টার মারতে গিয়ে গ্রেফতার হয়েছে। তখন হৃদয় বলে যেন কিছু নেই। মানুষ এত নিষ্ঠুর হতে পারে! মুক্তির দাবিতেও কিছু করতে দিবে না! এরই নাম কি মানবাধিকার! এরই নাম কি গণতন্ত্র!
পরীক্ষা দিলাম। ফলাফল প্রকাশ পেল। আলিমে ভর্তি হলাম। শুরু হ’ল জীবনের আরেক অধ্যায়। আলিম পরীক্ষা শেষে ফলাফল প্রকাশ পেল। হৃদয়ের কোণে আন্দোলিত হ’ল উচ্চশিক্ষা অর্জনের স্পৃহা। সে মোতাবেক কঠোর পরিশ্রম করলাম। আল্লাহর অশেষ রহমতে ভর্তি হলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগে। সময় আসল জীবনের সাথে যুদ্ধ করার। পাশাপাশি আমি বড়ই সৌভাগ্যবান এই কারণে যে, ড. গালিব স্যার যখন বাঁকালে যেতেন তখন তাকে দেখলে মনে হত, তিনি কত বড় মানুষ, কত বড় জ্ঞানী ব্যক্তি! তখন তার সাথে দেখা করা ও সালাম-মুছাফাহা করা বড়ই আনন্দের মনে হত। আনন্দে মনটা ভরে যেত। খুব খুশি হতাম আমরা সবাই। কিন্তু তাঁর সংস্পর্শে থাকতে পারব, তাঁর সাথে এক মসজিদে ছালাত আদায় করব, তাঁর সাথে কোন্ বৈঠকে উপস্থিত হতে পারর, কাছে থেকে তাঁর খেদমত করতে পারব এটা তখন কল্পনাতেই ছিল না। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির মাধ্যমে মহান আল্লাহ সেই সুযোগটা আমার জীবনে এনে দিয়েছেন। এজন্য হাযারো শুকরিয়া। ফালিল্লা-হিল হামদ।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগে ‘আন্দোলন’ ও ‘যুবসংঘ’-এর কেন্দ্রে উঠাবসা করার সুযোগ পেলাম। কিন্তু এমন সময় আমি আসলাম, যখন শ্রদ্ধার পাত্র মুহতারাম আমীরে জামা‘আত দুনিয়ার এই উম্মুক্ত ময়দান থেকে কারাগারের চার দেয়ালের অন্ধ প্রকোষ্ঠে বন্দী। তাই প্রতিনিয়ত আল্লাহর কাছে দো‘আ করতাম, কাঁদতাম, দান করতাম। আল্লাহ যেন আমাদের প্রাণপ্রিয় ব্যক্তিত্ব আমীরে জামা‘আতকে আমাদের মাঝে আবার ফিরিয়ে দেন! এভাবে হাযারো কর্মীর চোখের পানিতে সিক্ত হত প্রিয় ব্যক্তির মুক্তির ফরিয়াদ। অতঃপর সহপাঠী আবু তাহের, ছাদীক্ব মাহমূদ, হারুণদের সাথে মারকাযে উঠাবসা শুরু করলাম। একপর্যায়ে সবার সাথে পরিচয় হল। মারকাযে ঘটে যাওয়া সকল ঘটনা তাদের নিকট থেকে শুনলাম ও সত্যটা উপলব্ধি করলাম। আর আল্লাহর প্রশংসা করলাম মনের গহীনে বাসা বাঁধা সেই স্বপ্ন পূরণের মুহূর্তগুলোর জন্য।
মারকাযের অদূরে এক ছাত্রাবাসে থাকতাম। কিন্তু অধিকাংশ সময় মারকাযেই সময় কাটাতাম। দিন যেতে লাগল, সপ্তাহ অতিবাহিত হ’ল। এমনকি কয়েক মাস পেরিয়ে গেল। হঠাৎ আমীরে জামা‘আতের বাসা পাহারা দেওয়ার প্রস্তাব আসল। প্রস্তাব পেয়ে আনন্দে চন্দ্র হাতে পাওয়ার মত মনে হল। ঘরের শত্রু বিভীষণ। তাই অভ্যন্তরীণ শত্রু কর্তৃক আক্রান্ত হওয়ার আশংকায় এই পাহারা। সেদিন পাহারায় ছিলাম আমি, বন্ধু আবু তাহেরসহ আরো কয়েকজন। রাত ১২-টার দিকে মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হ’ল। শীতের রাত। কম্বল মুড়ি দিয়ে আমরা আমীরে জামা‘আতের বাসার নীচের বারান্দায় বসা। আমি ও আবু তাহের বসে বসে সারারাত খোস গল্প করে পাহারা দিলাম। নিজেকে সেদিন খুবই ভাগ্যবান মনে হয়েছিল। এভাবেই চলতে থাকল দিন। অতঃপর আগমন ঘটল সেই মাহেদ্রক্ষণের। ২০০৮ সালের ২৮ আগষ্ট। যেদিন আহলেহাদীছ জামা‘আতের মুকুট, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, খ্যাতনামা ইসলামী ব্যক্তিত্ব, ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’-এর আমীর, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যলয়ের আরবী বিভাগের প্রবীণ প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব স্যারের কারামুক্তির দিন। নেতৃবৃন্দের অধিকাংশই স্যারকে রিসিভ করার জন্য বগুড়ার জেল খানায় গিয়েছিলেন। আর মারকাযের সকল ছাত্র, শিক্ষক ও বিভিন্ন স্তরের সাংগঠনিক দায়িত্বশীলবৃন্দ মারকাযে অধীর আগ্রহে অপেক্ষার প্রহর গুণছিলাম। কখন দেখতে পাব আমীরে জামা‘আতকে! কখন সেই হাস্যোজ্জ্বল চেহারার মানুষটিকে আবার ফিরে পাব! কারাগার থেকে বের হয়ে রাত পৌণে এগারটার দিকে রাজশাহীতে পৌঁছেন। সেদিন তাকে দেখে মনে হয়েছিল, ঠিক ৩ বছর ৬ মাস ৬ দিন পূর্বে যেমন দেখা গিয়েছিল, ঠিক তেমনিই দেখা গেল। চেহারার কোন পরিবর্তন নেই, দেহের কোন ব্যত্যয় ঘটেনি, ঘটেনি স্বাস্থ্যের কোন অবনতিও। তবে সামনের কয়েকটি দাড়ি সাদা হয়ে গিয়েছিল। হাস্যোজ্জ্বল চেহারার সেই চিরচেনা মানুষটিকে পেয়ে ফেলে আসা যাবতীয় কষ্ট, ব্যথা-বেদনা ভুলে গিয়েছিলাম। শত শত মানুষের ভীড়। এরই মধ্যে নিয়ে যাওয়া হ’ল তাঁরই প্রতিষ্ঠিত দারুলহাদীছ বিশ্ববিদ্যালয় (প্রাঃ) জামে মসজিদে। সাতক্ষীরা, বগুড়া, মেহেরপুর সহ রাজশাহী ও তার আশেপাশের যেলার বিপুল সংখ্যক লোকের সমাগম। সেদিন নওদাপাড়া মাদরাসা প্রাঙ্গণ নতুন করে প্রাণ ফিরে পেয়েছিল। পুরাতন আনন্দে সবাই আবার নতুন করে জেগে উঠল। খুশিতে সবাই আত্মহারা। আনন্দ প্রত্যেকের চেহারায় ঝলমল করছে। দীর্ঘদিন পর আমাদের আমীর মুক্ত। আমাদের সামনেই তাকে দেখতে পাচ্ছি। এশার ছালাত আদায়ের পর তিনি এক আবেগঘন বক্তব্য উপহার দিলেন। তিনিও যেন তাঁর হাতে গড়া কর্মীবাহিনীর হাস্যোজ্জ্বল চেহারা দেখে অন্ধ প্রকোষ্ঠের যাবতীয় ব্যথা-বেদনা, দুঃখ-কষ্ট ভুলে গেছেন। নেতৃবৃন্দের স্মৃতিময় ও আবেগঘন বক্তব্যে সবার মাঝে আনন্দের হিল্লোল বয়ে যাচ্ছিল। স্যারের বক্তব্য শুনে উপস্থিত সবাই আবেগাপস্নুত হয়ে পড়েছিল। চোখ থেকে আনন্দের অশ্রু ঝরছিল। একপর্যায়ে অনুষ্ঠান শেষ হয়। অতঃপর শুরু হয় মুছাফাহার পালা। কে আগে মুছাফাহা করবে! যেন প্রতিযোগিতায় নেমেছে জান্নাতপিয়াসী একদল নিবেদিতপ্রাণ কর্মী বাহিনী। এ যেন এক কৃতজ্ঞ মনের অকৃত্রিম ভালবাসার আশাতীত প্রাপ্তি।
মুক্তির পর তিনি অল্প কিছু দিনের মধ্যে সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে যথারীতি তাঁর সাংগঠনিক কার্যক্রম শুরু করলেন। জ্বলে উঠলেন অভ্রান্ত সত্যের চূড়ান্ত উৎসের মহা শক্তিতে। অতঃপর শুরু হল আরেক ষড়যন্ত্র। মারকায দখলের ষড়যন্ত্র। বিজাতীয় সভ্যতার শিরকী মতবাদ হিংস্র ‘গণতন্ত্র’-এর অযাচিত ষড়যন্ত্র।
এরই মাঝে একদিন হঠাৎ করে মাসিক আত-তাহরীকের মাননীয় সম্পাদক ড. মুহাম্মাদ সাখাওয়াত হোসাইন তাঁর চেম্বারে ডেকে শায়খ আব্দুর রাযযাক বিন ইউসুফ উস্তাদযী ও মুফাক্ষার স্যারের সামনে আমাকে দারুলহাদীছ বিশ্ববিদ্যালয় (প্রাঃ) জামে মসজিদে আযান দেয়ার দায়িত্ব প্রদান করেন। অতঃপর মুযাফফর বিন মুহসিন ভাইয়ের একান্ত পরামর্শে ছাত্রাবাস ছেড়ে চলে আসলাম মারকাযে। আরো ঘনিষ্টতার সাথে শুরু হ’ল পথচলা।
স্মৃতিময় ৯ দিন :
২০০৯ সালের রামাযান মাস। মুহতারাম আমীরে জামা‘আত ই‘তিকাফে বসা। এ সময় মারকাযের উপর দিয়ে ঘটে যায় এক মহা বিপদ, অন্ধকারাচ্ছন্ন কালো মেঘের ঘনঘটা। যার চিত্র বর্ণনা করা বড়ই কষ্টসাধ্য। সেদিনের সেই অভিভাবকহীন কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় আল্লাহই আমাদেরকে গায়েবী মদদে রক্ষা করেছিলেন। ই‘তিকাফে থাকাবস্থায় খুব কাছ থেকে ড. গালিব স্যারের খেদমত করার সুযোগ পেয়েছিলাম।
১৭ সেপ্টেম্বর মোতাবেক ২৫ রামাযান যোহর ছালাতের পূর্বমুহূর্তে সালাফী ছাহেবের প্রায় ২৫/৩০ জন ভাড়াটে সন্ত্রাসী এসে ‘আত-তাহরীক’ ও ‘আন্দোলন’ অফিস ছাড়া ‘যুবসংঘ’ ও ‘সোনামণি’-এর কেন্দ্রীয় কার্যালয় সহ মারকাযের পূর্ব ও পন্ডিম পার্শ্বস্থ প্রত্যেকটি রুমে তালা ঝুলিয়ে দেয়। এমনকি তারা মসজিদের ওযূখানা ও বাথরুম পর্যন্ত বন্ধ করে দেয়। তখন মুযাফফর বিন মুহসিন ভাই পন্ডিম পার্শেব ‘যুবসংঘ’-এর সভাপতি কক্ষে পড়ছিলেন। তার সাথে ছিল হাসিবুল ইসলাম (রাজশাহী)। ২০৮ নং রুম থেকে বের হয়ে দেখি তাকে সেখান থেকে বের করে দেওয়া হচ্ছে। অবশেষে তাকে এক কাপড়ে রুম থেকে বের করে দেয়া হল। শুধুমাত্র সাথে ছিল তার অতি প্রয়োজনীয় ডায়েরী ও ল্যাপ্টপ। অতঃপর এক পর্যায়ে শুরু হ’ল ছাত্রদের রুমগুলোতে তালা দেওয়ার ঘৃণ্য কর্মসূচী। আমাদের রুমে গিয়ে বলা হ’ল, ‘তোরা তাড়াতাড়ি প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে বের হয়ে যা’। তখন রুমে ছিলাম আমি ও সাবিবর নামের আলিম শ্রেণীর এক ছাত্র। দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে কাপড় গুছিয়ে নিচ্ছিলাম। আর চোখের পানি ঝরঝর করে পড়ছিল। কাপড় গুছিয়ে নিতে দেরী হওয়ায় নরপশুরা গালি দিয়ে বলল, ‘এই শুয়োরের বাচ্চারা! সহজ কথা বুঝতে পারছিস না। এখনি বের হয়ে যা। কিছুই নিতে হবে না। দেরী হলে ভিতরে রেখেই তালা দিয়ে দিব’। সেদিনের হিংস্র পশুর গর্জন যেন এখনো কর্ণকুহরে ধ্বনিত হয়। ব্যাগ গুছিয়ে বারান্দায় আসলে তারা ঘরে তালা ঝুলিয়ে দেয়। চোখের পানি মুছতে মুছতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকলাম। আর একনেত্রে তাকিয়ে রইলাম তালাবদ্ধ মারকাযের দিকে। মাদরাসা ছুটি থাকায় আমরা হাতে গোণা কয়েকজন ছাত্র ছিলাম। আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম (বগুড়া), আহসান (জয়পুরহাট), আব্দুল্লাহ আল-মামূন (রাজশাহী), আরিফুল ইসলাম (রাজশাহী), মুহাম্মাদ রবীউল ইসলাম (নওগাঁ) সহ আরো কিছু ছাত্র। যদিও পরবর্তীতে আব্দুল বারী (চাঁপাইনবাবগঞ্জ), ওবাইদুল্লাহ (গাইবান্ধা) এসেছিল। তালা বন্ধ করার দৃশ্যটি আরিফ (রাজশাহী) তার মোবাইলে ভিডিও করে রেখেছিল। অতঃপর মারকাযের পূর্বপার্শ্ব থেকে মুযাফফর ভাই আমাকে মোবাইলে বললেন, ‘তোমরা মসজিদে গিয়ে আপাতত অবস্থান কর’। ব্যাগ নিয়ে আমরা সবাই ব্যথাতুর হৃদয়ে মসজিদে গেলাম।
পরে জানতে পারলাম যে, নিষ্ঠুর হায়েনাদের তালা মারার করুণ দৃশ্য মুহতারাম আমীরে জামা‘আত মসজিদের বারান্দায় দাঁড়িয়ে পুরোটাই দেখেছেন। তখন স্যারের মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছিল না। দুঃখ-ভারাক্রান্ত বদন। আহলেহাদীছ আন্দোলনের কেন্দ্রীয় মাদরাসায় আজ সন্ত্রাসীরা তালা ঝুলিয়ে দিয়েছে। এ দৃশ্য দেখে তিনি কি স্থির থাকতে পারেন? তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে আমাদেরও কান্না এসে গেল। রান্না ঘরেও তালা ঝুলিয়ে দেওয়ার কারণে ইফতারের ব্যবস্থা করা যায়নি। রাস্তাতেও যাওয়া যাচ্ছিল না। গেলেই মারপিট করছে। পার্শ্ববর্তী যুবসংঘের কর্মী আমীনুলের মাধ্যমে দোকান থেকে মুড়ি, চানাচুর ও পাউরুটি এনে সবাই ইফতার করলাম। মাগরিবের পর স্যার আমাকে ডাকলেন। স্যারের চেহারা বিষণ্ণতায় ভরা। চিন্তাক্লিষ্ট ভাবনার ছাপ। কিন্তু আল্লাহর প্রতি প্রগাঢ় বিশ্বাস ও ভরসা কানায় কানায় পূর্ণ। তিনি অস্থির হয়ে বিভিন্নজনকে ফোন করতে বললেন আমাকে। তিনি তো অস্থির হবেনই! তিনিই মারকাযের অভিভাবক। মসজিদের উত্তর-পন্ডিম কোণে কালো হুজরার মধ্যে থেকে তিনি অস্থির সময় অতিবাহিত করছেন আর ভাবছেন মাদরাসাকে সন্ত্রাসীদের হাত থেকে কিভাবে রক্ষা করা যায়। কেমন যাচ্ছে কর্মীদের দিন! কিভাবে কাটছে তাদের সময়! ধিক! শত ধিক! যারা ই‘তিকাফকারী একজন নিরীহ মানুষের উপর অত্যাচার করে। একপর্যায়ে আমার ফোনে ব্যালেন্স শেষ। আমচত্বর যাওয়া যাচ্ছে না। গেলেই সন্ত্রাসী কর্তৃক আক্রান্ত হওয়ার আশংকা। বাধ্য হয়ে বর্তমানে সাতক্ষীরা যেলার ‘যুবসংঘ’-এর প্রচার সম্পাদক আসাদুল্লাহ বিন মুসলিম ভাইকে ৫০ টাকা ফ্লেক্সিলোড করার কথা বললাম। অতঃপর স্যার আরো কয়েক জায়গায় ফোন করতে বললেন। এভাবেই ২৫ রামাযানের রাত্রি কঠিন যাতনা ও দুঃখ-কষ্টের মধ্যে কেটে গেল। নিরাপত্তার জন্য আমরা কয়েকজন শিফটিং করে রাত্রি অতিবাহিত করলাম। অন্যদিকে স্যার এই বিপদঘন মুহূর্তে সর্বদা উপদেশ দিতেন, ‘বেশী বেশী কুরআন তেলাওয়াত কর, বেশী বেশী আল্লাহর কাছে দো‘আ কর, শেষ রাতে উঠে নফল ছালাত আদায় কর’। হক্বপন্থী নেতার এমনই নির্ভীকচিত্ত ও মহানুভবতা।
১৮ সেপ্টেম্বর মোতাবেক ২৬ রামাযানে আসিফ রেযা (রাজশাহী)-এর ইমামতিতে এশার ছালাত আদায় করলাম। পরে স্যার আমাকে বললেন, তোমার গলায় জোর আছে তুমি তারাবীহর ছালাত আদায় করাও। ইতস্ততবোধ করলাম। তারপরেও ইমামতি করলাম। কারণ পিছনে রয়েছেন দক্ষিণ এশিয়ার সুপরিচিত ইসলামী ব্যক্তিত্ব মুহতারাম আমীরে জামা‘আত। অন্যদিকে সেই রাতে মাদরাসার সামনে রাস্তার উপরে সন্ত্রাসী বাহিনীর আনাগোনা। স্যার টয়লেটে যাবেন। স্যারকে বললাম, স্যার পরিস্থিতি ভাল নয়। আমি বারান্দার লাইটগুলো বন্ধ করে দিলাম। অতঃপর স্যারকে বাথরুমে রেখে দ্রম্নত আবার লাইট জ্বালিয়ে দিলাম। যাতে করে শত্রু পক্ষরা বুঝতে না পারে। আবার লাইটগুলো বন্ধ করে তাঁকে মসজিদে নিয়ে আসলাম।
সামনে ঈদুল ফিতর। মারকায মাঠে ঈদের ছালাতের ব্যবস্থা করছেন ছালাফী ছাহেব। কতিপয় কর্মচারী মাঠে কাজ করছে। শুরু হ’ল আরেক নির্যাতন। ১৯ সেপ্টেম্বর (২৭ রামাযান) যোহর ছালাতের প্রাক্কালে স্যার ওযূ করার জন্য টয়লেটে যাবেন। ষড়যন্ত্রের আশংকায় সর্বদা টয়লেটে তালা দিয়ে রাখতাম। গিয়ে দেখি তালা আর খুলে না। স্যার পিছনে দাঁড়িয়ে আছেন। দেখি তালা পলিথিন বা অন্য কিছু দিয়ে সিলগালা করে দেওয়া হয়েছে। হতবাক। শত্রুরা কত ইতর, নিষ্ঠুর হলে একজন ই‘তিকাফকারী ব্যক্তির প্রতি এমন অমানবিক অত্যাচার করতে পারে! সেদিন স্যার যে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়েছিলেন, যেন আকাশ পর্যন্ত কেঁপে উঠেছিল। অতঃপর তিনি ২য় তলায় উঠে প্রয়োজন সারেন। পরে আমাকে বললেন, দ্রম্নত সাখাওয়াত, মুযাফফরকে জানাও। পরে তারা দ্রম্নত পুলিশ নিয়ে আসলেন। মাঠে যে দুষ্কৃতিকারীরা কাজ করছিল তাদের মধ্যে কাওছার নামে এক ধূর্ত অমানুষ ছিল। পুলিশ অফিসারটি (দ্রাবিড়) তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, কে এটা করেছে? সে অস্বীকার করে? একপর্যায়ে মুযাফফর ভাই ক্ষেপে গেলেন। পরবর্তীতে পুলিশ তাকে একটা থাপ্পড় মারেন এবং চাবীর গোছা নিয়ে আসার জন্য নির্দেশ দেন। কিন্তু সে নিয়ে আসল না। তখন পুলিশ তাকে শাসিয়ে দেন। তারপর পুলিশের উপস্থিতিতে তালা ভাঙ্গার প্রস্ত্ততি নেওয়া হয়। আব্দুল্লাহ প্রথমে হাতুড়ী দিয়ে ভাঙতে ব্যর্থ হওয়ায় পরে রড ডুকিয়ে ভেঙ্গে ফেলা হয়।
এইদিন মাগরিব পর মুহতারাম আমীরে জামা‘আতকে মারকায থেকে বের করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সন্ত্রাসীরা। এটা ছিল তাদের সর্বশেষ পরিকল্পনা। মসজিদের পন্ডিম পার্শ্বে মোতায়েন করা হয় ২০/২৫ জন অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী। রামদা, বটি ও বিভিন্ন লাঠিসোটা নিয়ে তারা প্রস্ততি নিয়েছে। তারাবীহর পর স্যারকে ই‘তিকাফ খানায় রেখে আমি বাইরে এসে দেখলাম কালো পোশাকধারী কিছু লোক মুযাফফর ভাই ও সাখাওয়াত ভাইয়ের সাথে কথা বলছে। বুঝলাম তারা র্যাব। তাদের সাথে গিয়ে মসজিদের দক্ষিণ-পন্ডিম কোণের দরজার তালাটি খুলে দিলাম। তখন স্থানীয়দের মধ্যে আমাদের সাথে ছিল সালমান ফারসী সুমন, তার ভাগ্নে তাওফীক্ব, মুস্তাক্বীম ভাইসহ প্রায় ৭-৮ জন মানুষ। সাহায্য আসে আল্লাহর পক্ষ থেকে। সেদিন পুলিশ প্রশাসন কোন সহযোগিতা করেনি। সরাসরি আল্লাহর গায়েবী মদদে ষড়ষন্ত্রকারীদের দম্ভ টুটে গিয়েছিল। অস্তিত্বহীন হয়ে গিয়েছিল তাদের উপস্থিতি। সেই যে তাদের পতন হ’ল, আজও পর্যন্ত আর কোন সমস্যা সৃষ্টি হয়নি। ফালিল্লা-হিল হাম্দ। এরপর খবরটি স্যারকে জানালে তিনি অসংখ্যবার আল্লাহর প্রশংসা করেন ও সকলের জন্য অন্তরখোলা দো‘আ করেন।
অতঃপর রাতেই নেতৃবৃন্দের পরামর্শক্রমে স্যারের নিরাপত্তার জন্য হুজরা খুলে মসজিদের মাঝ বরাবর বেঁধে দিলাম। সেদিন আমরা প্রায় সারারাত জেগে পাহারা দিলাম। ২৭ রামাযানের রাত পার হ’ল। পরের দিন সকাল সাড়ে ৯-টার দিকে স্যার আমাকে ডেকে বললেন, খুব মাথা যন্ত্রণা করছে। ফলে দীর্ঘ সময় তাঁর পাশে থাকলাম। ১২-টা পর্যন্ত প্রায় তিন ঘন্টা বিভিন্ন বিষয়ে কথা বললেন। বিভিন্ন মনীষীর জীবনী উল্লেখ করে নিজে সান্তবনা খুঁজছিলেন। আহলেহাদীছ মনীষী আল্লামা ছিদ্দীক্ব হাসান খান ভূপালী (রহঃ) সহ বিভিন্ন সালাফী বিদ্বানদের জীবনে ঘটে যাওয়া অত্যাচার এবং অসংখ্য শিক্ষণীয় ঘটনা শুনান। একপর্যায়ে তিনি আমাকে অসহায়ত্ব প্রকাশ করে কান্না জড়িত কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘দীর্ঘ ২৮ বছর ধরে আমি রাজশাহীতে অবস্থান করছি। আজও আমার কোন সত্যিকারের বন্ধু জুটল না! কোথায় যাব আমি’? আমি তখন বলেছিলাম, স্যার রাজশাহীর নওদাপাড়ার মানুষ যদি আপনাকে ঠাঁই না দেয়, তাহলে সাতক্ষীরার ‘আন্দোলন’ ও ‘যুবসংঘ’-এর প্রত্যেকটি কর্মী ও দায়িত্বশীল আপনার জন্য প্রস্ত্তত রয়েছে। তখন তিনি দুঃখ করে বলেছিলেন, ‘তুমি কি মনে করছ, আমার সন্তানেরা মানুষের বাড়িতে জীবনযাপন করবে?’ তখন আমি আর কোন কথা বলতে পারিনি। কণ্ঠ আড়ষ্ঠ হয়ে গিয়েছিল। তিনি আরো একটি কথা বলেছিলেন, ‘শোন বযলু! আমাকে যদি কখনো হত্যা করা হয়, তাহলে সবাইকে বলে দিবে কেউ যেন কোন প্রকার মামলা-মুকাদ্দামা না করে’। তখন আমার ভিতরে যেন তীরের মত বিদ্ধ হল। কণ্ঠ স্তব্ধ হয়ে গেল। মনে উদয় হ’ল, আমরা থাকতে আপনাকে হত্যা করবে মানে! আপনার হাযারো কর্মী বাহিনী আপনার জন্য জীবন দিতে প্রস্ত্তত। সম্মুখপানে এগিয়ে চলুন মহাসত্যের সন্ধানে দৃঢ় মনোবল নিয়ে। অতঃপর যোহরের আযানের সময় হওয়ার কারণে স্যার বললেন, যাও। আযান দাও।
অশুভ শক্তির হিংস্র থাবার ঐ দিনগুলো আজও মনের অন্দর মহলে ধাক্কা দেয়। কী দোষ ছিল গালিব স্যারের? কী অন্যায় তিনি করেছিলেন? তিনিতো কেবল পথভোলা মানুষকে সঠিক পথের সন্ধান দাতা। তিনিতো বিচ্ছিন্ন মুসলিম জনতাকে এক ইমারতের অধীনে জমায়েত করার আহবায়ক মাত্র। তিনিতো মানুষকে শুধুমাত্র পরকালীন মুক্তির সোপান হিসাবে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের দিকে আহবানকারী মাত্র। একমাত্র দোষ এটাই। কিন্তু স্বতঃসিদ্ধ কথা হ’ল, হক্বের বুলন্দ আওয়াজ যেখানে প্রস্ফুটিত হয়, বাতিলের আক্রমণ সেখানে তীব্রতর হয়। আর এটাই ঘটেছিল সেই দিনগুলোতে। ই‘তিকাফের সেই ৯টি দিনের দুঃখ ও কষ্টে বিজড়িত স্মৃতিগুলো আমার জীবনের সবচেয়ে স্মৃতিময় দিন, যা সর্বদা হৃদয়াভ্যন্তরে চির জাগরূক হয়ে থাকবে জীবনের প্রান্তকাল পর্যন্ত উৎসাহ ও অনুপ্রেরণার কেন্দ্রবিন্দু হিসাবে।
উল্লেখ্য যে, তৎকালীন চারদলীয় জোট সরকার জঙ্গীবাদের মিথ্যা ধুয়া তুলে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করে তাঁর বিরুদ্ধে ১০টি মিথ্যা মামলা চাপিয়েছিল। অতঃপর একের পর এক যামিন হতে থাকে। অবশেষে ২০০৮ সালের ২৮ আগষ্ট দীর্ঘ ৩ বছর ৬ মাস ৬ দিন কারান্তরীণ থাকার পর মুক্তি পান। অতঃপর দীর্ঘ প্রতিক্ষার অবসান ঘটিয়ে ৮ বছর ৮ মাস ২৮ দিন পর গত ২০ নভেম্বর ২০১৩ রোজ বুধবার বগুড়া জজকোর্ট থেকে সর্বশেষ মামলায় বেকসুর খালাস পান। ফালিল্লা-হিল হামদ। এর মাধ্যমে বিগত চারদলীয় সরকার ও তথাকথিত ইসলামী মূল্যবোধের ধ্বজাধারী জোট কর্তৃক ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’ ও ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ’-এর উপর যে জঙ্গীবাদের মত নিকৃষ্ট অভিযোগ আরোপ করা হয়েছিল তার অবসান ঘটল। মৃত্যু ঘটল মিথ্যা ইতিহাসের জঞ্জাল। আর জাতির নিকট পরিষ্কার হ’ল ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’ই একমাত্র নির্ভেজাল ইসলামী আন্দোলন এবং ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ’ই হল একমাত্র নির্ভেজাল ইসলামী যুবসংগঠন।
তাই দেশে ও বিদেশে অবস্থানরত আহলেহাদীছ ভাই ও বোনসহ সকলের নিকট আমাদের একটাই আহবান, যেখানে থাকুন না কেন আসুন! পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে জীবন গড়ি।
বযলুর রহমান
রাজনগর, লাবসা, সাতক্ষীরা।