সফল কর্মীর আচরণবিধি (পূর্ব প্রকাশের পর)
অধ্যাপক আকবার হোসাইন
অধ্যাপক আকবার হোসাইন 977 বার পঠিত
মুমিন জীবন সফলতার, ব্যর্থতার নয়। অহি প্রতিষ্ঠার সংগঠনের কর্মীরা পিচ্ছিল পথ ও কাঁটা বিছানো রাস্তা অতিক্রম করে সফলতার চূড়ান্ত ঠিকানা জান্নাতের দিকে এগিয়ে যায়। এভাবেই তার সার্বিক সফলতার যাত্রা শুরু হয়। আল্লাহ বলেন, قَدْ أَفْلَحَ مَنْ تَزَكَّى ‘নিশ্চয়ই সাফল্য লাভ করবে সে, যে শুদ্ধ হয়’ (আ‘লা ৮৭/১৪)। অন্যত্র তিনি বলেন- قَدْ أَفْلَحَ مَنْ زَكَّاهَا- وَقَدْ خَابَ مَنْ دَسَّاهَا ‘যে নিজেকে শুদ্ধ করে সেই সফলকাম হয় এবং যে নিজেকে কলুষিত করে সে ব্যর্থ মনোরথ হয়’ (আশ-শামস ৯১/৯-১০)।
২২. আল্লাহর সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলা :
কর্মীর সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ আচরণ হল আল্লাহর সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে শতভাগ আন্তরিকতা থাকা। পৃথিবীর অন্যান্য কাজ ব্যক্তি, পরিবার, গোত্র, জাতি বা দেশের জন্য করা যেতে পারে; ব্যক্তি স্বার্থ ও ব্যক্তিগত লাভের যাবতীয় দিক সম্ভবনা সহকারে সম্পাদন করা যেতে পারে, পার্থিব সাফল্য অর্জন করা যেতে পারে। কিন্তু ইসলাম অনুযায়ী সার্বিক জীবন পরিচালিত করা একটি সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমধর্মী কাজ। যে পর্যন্ত মানুষের সম্পর্ক আল্লাহর সাথে যথার্থ ও গভীর না হয় এবং সে একমাত্র আল্লাহর জন্য কাজ করতে মনস্থ না করে, সে পর্যন্ত এ কাজে কোন প্রকার সাফল্য সম্ভব নয়। কারণ এখানে মানুষ তার সার্বিক জীবন পবিত্র অহি দ্বারা পরিচালনা করতে চায়। আর এ জন্য সব কিছু আল্লাহর জন্য করা প্রয়োজন দেখা দেয়। এ কাজে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টিই কাম্য। একমাত্র আল্লাহর সাথে গভীর সম্পর্ক স্থাপনই এ কর্মের মূল প্রেরণা হতে হবে। একটি বিষয় এখানে উল্লেখ্য যে, আল্লাহর সাথে গভীর সম্পর্ক স্থাপনের সর্বোত্তম মাধ্যম হল ছালাত। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর শিখানো পদ্ধতি অনুযায়ী ছালাত সম্পন্ন করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَاسْجُدْ وَاقْتَرِبْ ‘তোমরা সিজদা কর এবং আমার নিকটবর্তী হও’ (‘আলাক্ব ৯৬/১৯)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, إِنَّ أَحَدَكُمْ إِذَا صَلَّى يُنَاجِىْ رَبَّهُ ‘অবশ্যই তোমাদের মধ্যে যখন কেউ ছালাত আদায় করে তখন সে তার প্রভুর সাথে মুনাজাত করে’ (ছহীহ বুখারী হা/৫৩১)। অন্যত্র এসেছে,
عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ أَقْرَبُ مَا يَكُونُ الْعَبْدُ مِنْ رَبِّهِ وَهُوَ سَاجِدٌ فَأَكْثِرُوا الدُّعَاءَ.
আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন, বান্দা যখন সিজদায় থাকে তখন সে তার প্রভুর সবচেয়ে নিকটবর্তী হয়। সুতরাং তোমরা বেশী বেশী দো‘আ কর[1] সুতরাং আল্লাহর সাথে সম্পর্ক স্থায়ী করার প্রধানতম মাধ্যম হ’ল ছালাত। যা যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা একজন কর্মীর আচরণে সর্বদা উপস্থিত থাকা যরূরী।
২৩. আখেরাতের চিন্তা করা :
কর্মীর অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ আচরণ হল সর্বদা আখেরাতের কথা চিন্তা করা। যদিও দুনিয়াই মুমিনের কর্মস্থল এবং সবকিছু তাকে এখানেই করতে হয়। কিন্তু এতদসত্ত্বেও সে এ দুনিয়ার জন্য কাজ করে না। আখেরাতের জন্য করে এবং দুনিয়ার ফলাফলের দিকে তার লক্ষ্য থাকে না; বরং তার লক্ষ্য থাকে আখেরাতের প্রতি। যেসব কাজ আখেরাতে লাভজনক সেসব তাকে করতে হবে। অনুরূপ যেসব কাজের ফলে আখেরাতের কোন লাভ হবে না সেগুলো তাকে ত্যাগ করতে হবে। দুনিয়ার যেসব লাভ আখেরাতে ক্ষতিকর, সেগুলো তাকে বর্জন করতে হবে। আর দুনিয়ার যেসব ক্ষতি আখেরাতে লাভ জনক সেগুলো তাকে গ্রহণ করতে হবে। তাকে একমাত্র আখেরাতের শাস্তি ও পুরষ্কারের চিন্তা করতে হবে। দুনিয়ার কোন শাস্তি ও পুরষ্কারের গুরুত্ব তার কাছে থাকা উচিত নয়। এ দুনিয়ায় তার চেষ্টা ফলপ্রসূ হোক বা না হোক, সে সফলতা বা ব্যর্থতা যারই সম্মুখীন হোক তার প্রশংসা বা নিন্দা যাই করা হোক, যে পুরষ্কার লাভ করুক বা পরীক্ষার মধ্যে নিক্ষিপ্ত হোক, সকল অবস্থায় তাকে এ বিশ্বাস নিয়ে কাজ করা উচিত যে, সে আল্লাহর জন্য এ পরিশ্রম করছে তার দৃষ্টি থেকে কিছুই প্রচ্ছন্ন নেই এবং তার নিকট আখেরাতের চিরন্তন পুরষ্কার পাওয়া থেকে সে কোন ক্রমেই বঞ্চিত হবে না এবং সেখানকার সাফল্যই হচ্ছে আসল সাফল্য। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَلَلْآخِرَةُ أَكْبَرُ دَرَجَاتٍ وَأَكْبَرُ تَفْضِيلًا ‘নিশ্চয়ই পরকালই হচ্ছে সম্মান ও মর্যাদায় শ্রেষ্ঠ’ (বনী ইসরাঈল ১৭/২১)। অন্যত্র তিনি বলেন- وَلَدَارُ الْآخِرَةِ خَيْرٌ وَلَنِعْمَ دَارُ الْمُتَّقِينَ ‘আখিরাতের আবাসই উত্তম এবং তা মুত্তাক্বীদের জন্য কতই না সুন্দর আবাস’ (নাহল ১৬/২২)।
মানুষ মৃত্যুবরণ করলেই সমস্ত কিছু শেষ হয়ে যায় না; বরং মৃত্যু ব্যক্তি আমাদের চক্ষুর অন্তরালে চলে যায় এবং তার আরেক নতুন জীবন শুরু হয়। আর সেটাই প্রকৃত জীবন এবং চিরস্থায়ী চির অনন্ত জীবন। আল্লাহ বলেন, وَإِنَّ الدَّارَ الْآخِرَةَ لَهِيَ الْحَيَوَانُ لَوْ كَانُوا يَعْلَمُونَ ‘নিশ্চয়ই পরকালীন জীবনই প্রকৃত জীবন, যদি তারা জানত’ (‘আনকাবূত ২৯/৬৪)। তিনি আরো বলেন, يَا قَوْمِ إِنَّمَا هَذِهِ الْحَيَاةُ الدُّنْيَا مَتَاعٌ وَإِنَّ الْآخِرَةَ هِيَ دَارُ الْقَرَارِ ‘হে আমার সম্প্রদায়! নিশ্চয়ই দুনিয়ার জীবন হচ্ছে সামান্য। আর অবশ্যই আখিরাত হল চিরস্থায়ী ও চিরন্তন আবাসস্থল’ (মুমিন ৪০/৩৯)। وَالْآخِرَةُ خَيْرٌ وَأَبْقَى ‘আখিরাত হল উৎকৃষ্ট ও চিরস্থায়ী’ (আ‘লা ৮৭/১৭)। অন্যন্য বলেন, وَلَلْآخِرَةُ خَيْرٌ لَكَ مِنَ الْأُولَى ‘অবশ্যই আখিরাত হবে আপনার জন্য দুনিয়া থেকে উত্তম’ (যোহা ৯৩/৪)।
২৪. প্রশিক্ষণ নেওয়া ও দেওয়া :
প্রশিক্ষণ নেওয়া ও দেওয়া সফল কর্মীর অন্যতম আচরণ। প্রশিক্ষণের আভিধানিক অর্থ হ’ল, কোন বিশেষ বিষয়ে হাতে কলমে শিক্ষা দিয়ে কার্য সম্পাদনের উপযুক্ত বানানো বা হওয়া। প্রশিক্ষণের ইংরেজী প্রতিশব্দ হল- Training. কলকাতা থেকে প্রকাশিত Samsad English-Bengali Dictionary-তে Training মানে বলা হয়েছে- ‘To prepare or be prepared for performance by instructions, practice, exercise, diet, etc’. ‘To instruct and discipline’. ‘To direct or aim’.
মূলতঃ সাংগঠনিক, প্রশাসনিক ও পেশাগত বিশেষ জ্ঞান, তথ্য, আচরণ, দৃষ্টিভঙ্গি ও দক্ষতা উন্নয়নের উদ্দেশ্যে পরিচালিত যুক্তিসংগত ও বাস্তবধর্মী কার্যক্রমই হল প্রশিক্ষণ।
আই. এল. ও (ILO) কনভেনশনে প্রশিক্ষণের পরিচয় প্রকাশ করা হয়েছে এভাবে, 'The Special Kind of teaching and instiuction in which goals are clearly determind and are usually and readily demonstrated and call for a degree of mastery.''
প্রশিক্ষণ মূলতঃ মানব জীবনের সকল ক্ষেত্র ও সকল কর্মের সাথেই সম্পৃক্ত। সকল কাজেরই প্রশিক্ষণ প্রদান করা ও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করা উচিত। বিশেষ করে যারা আল্লাহ ও তার রাসূল (ছাঃ)-এর আদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে চাই তাদেরকে প্রশিক্ষণ নেওয়া ও দেওয়া অত্যন্ত যরূরী। প্রশিক্ষণ গ্রহণের মাধ্যমে যে সমস্ত বিষয়াবলী অর্জন করা যায় তা নিম্নরূপ :
১. পেশাগত দক্ষতা উন্নয়ন ২. দায়িত্ব পালনে পারদর্শিতা উন্নয়ন ৩. দৃষ্টিভঙ্গি ও মনোভাব সংশোধন ও উন্নয়ন। ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টি ৪. আচরণ সংশোধন ও উন্নয়ন ৫. তথ্য আহরণ, তথ্য সমৃদ্ধি ও জ্ঞানোন্নয়ন ৬. নৈতিক ও চারিত্রিক মনোন্নয়ন ৭. আত্মিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতি ৮. পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন ৯. আত্মবিশ্বাস ও দায়িত্ব সচেতনতা সৃষ্টি ১০. ব্যক্তিত্ব উন্নয়ন ১১. কর্মকৌশল উন্নয়নে প্রায়োগিক দক্ষতা সৃষ্টি ১২. দূরদর্শী, গতিশীল, চৌকস, সুশৃংঙ্খল ও কর্তব্যপরায়ণ হতে সাহায্য করা ১৩. যোগাযোগ ও মটিভেশনের দক্ষতা সৃষ্টি ১৪. শিক্ষাদানে পারদর্শিতা সৃষ্টি ১৫. কাঙ্খিত ও প্রত্যাশিত মনোন্নয়ন ১৬. সমস্যা চিহ্নিতকরণ, জটিলতা নিরসন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের দক্ষতা সৃষ্টি ১৭. সচেতনতা সৃষ্টি ১৮. সেবা করার যোগ্যতা ও মানসিকতা সৃষ্টি ১৯. মেযাজের ভারসাম্য সৃষ্টি ২০. গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পাওয়া।
উল্লেখিত আলোচনার সূত্র ধরে বলা যায় যে, প্রশিক্ষণ গ্রহণ ও প্রদান সকল কর্মক্ষেত্রে বা সকল ক্ষেত্রে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বিষয়। বাস্তবে যদি আমরা দেশের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি সেক্টরে তাকায় তাহলে আমরা আরও এর প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে পারব। দেশের শান্তি শৃঙ্খলা, নিরাপত্তা, দেশ রক্ষায় যে সকল বাহিনী যেমন, পুলিশ, বিজিবি, র্যাব, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমান বাহিনী কাজ করেন তাদেরকে উপযুক্ত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে একজন দক্ষ সদস্য হিসাবে গড়ে উঠতে হয়। ব্যাংক সেক্টর, ডাক্তারী পেশায় নিয়োজিতদের, শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত জনশক্তি প্রশাসনিক সেক্টরগুলো, মিডিয়াসহ সকল স্তরে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ ও যোগ্যতা সম্পন্ন করে তোলা হয়। আল্লাহ রববুল ‘আলামীন তাঁর বান্দাদেরকে যোগ্য ও খাঁটি মুসলিম হিসাবে গড়ে তোলার জন্য বিভিন্ন ইবাদতের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ প্রদান করেন। ছালাত, ছিয়াম, হজ্জ ইত্যাদি তার বাস্তব প্রমাণ। হাদীছে এসেছে, صَلُّوا كَمَا رَأَيْتُمُونِى أُصَلِّى ‘তোমরা ছালাত সেই ভাবে পড় যেভাবে আমাকে পড়তে দেখেছ’।[2] আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ
‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর ছিয়াম ফরয করা হয়েছে। যেরূপ ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের উপর। যেন তোমরা পরহেযগারীতা অর্জন করতে পার’ (বাক্বারাহ ২/১৮৩)।
২৫. দেশপ্রেমিক :
দেশের একজন সুনাগরিক হিসাবে অন্যতম কর্তব্য হল, দেশকে ভালবাসা, দেশের কল্যাণ, সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য কাজ করা। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হলে উহা রক্ষার্থে নিজের সর্বস্ব উৎসর্গ করে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিধানে সহায়তা করা। বহিঃশত্রু দ্বারা আক্রান্ত হলে সরকারের আহবানে সাড়া দিয়ে জিহাদে শরীক হয়ে দেশকে হেফাযত করা। এ মর্মে পবিত্র কুরআনে ঘোষিত হয়েছে, انْفِرُوا خِفَافًا وَثِقَالًا وَجَاهِدُوا بِأَمْوَالِكُمْ وَأَنْفُسِكُمْ فِي سَبِيلِ اللهِ ‘তোমরা বের হয়ে পড় হালকা ও ভারী (অস্ত্রসহ) অবস্থায় এবং আল্লাহর রাস্তায় জান ও মাল দিয়ে জিহাদ কর’ (তওবা ৯/৪১)।
২৬. মানুষের ভাল গুণগুলোর প্রতি দৃষ্টি রাখা :
সমাজে অনেক শ্রেণী ও পেশার মানুষ বসবাস করে। অনেকের মধ্যে এমন কিছু আকর্ষণীয় আচরণ লক্ষ্য করা যায়, যেগুলো অনুসরণ করা যরূরী। কিন্তু কারো খারাপগুণ খুঁজে বের করা সফর কর্মীর বৈশিষ্ট্য নয়। তবে পরিবেশ পরিস্থিতি বুঝে একান্ত আপনজনের মতো কাউকে সংশোধন করার চেষ্টা করা যেতে পারে। মূলতঃ কাজ হল মানুষের ভাল গুণ দেখা। অতঃপর সেগুলোকে বিকশিত করার চেষ্টা করা। একজন মালি, ফুল বাগানের সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি ও ফুল ফুটানোর ব্যাপারে যে ভূমিকা গ্রহণ করে, সফর কর্মী অন্য সকলের ব্যাপারে সেই একই ভূমিকা গ্রহণ করবে।
২৭. নাম মনে রাখা :
একজন ব্যক্তিকে সনাক্ত করার উত্তম মাধ্যম হল তার নাম। তাই সকল কর্মীর সর্বোত্তম আচরণ হল বেশী বেশী মানুষের নাম স্মরণে রাখা। একই আদর্শের ও আন্দোলনের সহকর্মীদের নামতো অবশ্যই স্মরণ থাকা উচিত। তাছাড়া সাধারণ ও অসাধারণ সব ধরণের মানুষের নাম মনে রাখার চেষ্টা করা। অতঃপর পুনরায় যখন দেখা হবে তখন তার সুন্দর নাম ধরে ডাকা এবং তার সাথে ভাই যোগ করে ডাকা। ফলে উক্ত ব্যক্তির মনে রেখাপাত করবে এবং পূর্বের চেয়ে বহুলাংশে আকৃষ্ট হবে। এজন্য একজন সফল কর্মীকে অন্য সহপাঠীদের নাম স্মরণ রাখার জন্য স্মৃতির প্রখরতা বৃদ্ধি করতে হবে। প্রয়োজনে স্মৃতির পাতায় নামের তালিকা তৈরী করতে হবে। অতঃপর যাদের নাম নিজের স্মৃতির ফাইলে সংরক্ষিত তাদের খোঁজ-খবর নেওয়া। বিশেষ করে সাক্ষাতে বিস্তারিত খোঁজখবর নেওয়া এবং তাদের কল্যাণে আল্লাহর কাছে সর্বদা দো’আ করা।
২৮. সদা সক্রিয় ও সচেতন থাকা :
সফল কর্মী তার মহান উদ্দেশ্য অর্জনে সর্বদা সক্রিয় ও সচেতন থাকবে। লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হাছিলের প্রচেষ্টায় নিজেকে সর্বদা নিয়োজিত রাখবে ও অবিরাম প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবে। তাই একজন কর্মীর জীবনাভিধান থেকে ‘শিথিলতা’, ‘নীরবতা’, ‘নিষ্ক্রিয়তা’, ‘অসচেতনতা’ ইত্যাদি শব্দ মুছে ফেলতে হবে।
২৯. বাধাগ্রস্ত হলে ভগ্ন মনোরথ না হওয়া :
মুমিন জীবনের সফলতা একটি চিরন্তন। দ্বীনী কাজে বাধাগ্রস্ত হওয়া আবহমান কাল থেকে চলে আসছে এবং ক্বিয়ামত পর্যন্ত এ ধারা অব্যহত থাকবে। কিন্তু কর্মী হিসাবে সফল। যদিও নেকীর একটু ঘাটতি হবে। তাই আল্লাহর উপর ভরসা করে কর্মতৎপরতা চালিয়ে যেতে হবে। ভেঙ্গে পড়া যাবে না। চিন্তিত, মনভাঙ্গা ও মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকা চলবে না। এগুলোকে গুরুত্ব না দিয়ে শিক্ষা গ্রহণ করে সঠিক পথে আরো সতেজ ও সক্রিয় হতে হবে। তাছাড়া হতাশা মুমিনের জন্য বৈধ নয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَلَا تَهِنُوا وَلَا تَحْزَنُوا وَأَنْتُمُ الْأَعْلَوْنَ إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ ‘তোমরা হীনবল হয়ো না, দুঃখিত হয়ো না, ঈমানদার হলে তোমরাই শ্রেষ্ঠ’ (আলে ইমরান ৩/১৩৯)।
৩০. কর্মীদের অবদানকে স্বীকার করা :
কর্মীর অবদানকে মূল্যায়ন করে তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের মানসিকতা থাকতে হবে। সহকর্মী তার জ্ঞান, বুদ্ধি, বীরত্ব, ধন ও শ্রম দিয়ে অভিন্ন আদর্শ প্রতিষ্ঠায় যে সহযোগিতা করছে এজন্য তার জন্য অন্তরখোলা দো‘আ করা, তার প্রশংসা করা, হাসিমুখে কথা বলা একান্ত যরূরী, যাতে সে উৎসাহবোধ করে। প্রয়োজনে পবিত্র কুরআন, ছহীহ হাদীছ, ইসলামী সাহিত্য, ডাইরী, কলম ইত্যাদি উপহার দেওয়া। ফলে আরো প্রাণবন্ত ও আন্তরিকতার সাথে কাজ করবে। মনে রাখতে হবে যে, সহকর্মীরা নিঃসন্দেহে ব্যক্তির জন্য নয়, বরং আল্লাহর জন্য ও তাদের লক্ষ্য অর্জনের জন্য কাজ করে। দায়িত্বশীল তাদের প্রতিনিধি কিংবা পরিচালক মাত্র। তাই তাদের কাজকে স্বীকৃতি দেওয়া ও শুকরিয়া আদায় করা কর্তব্য। এক্ষেত্রে কখনো তাদের কোন কাজকে ছোট মনে করে অবহেলা করা যাবে না।
৩১. শৃঙ্খলা প্রিয় হওয়া :
আল্লাহ তা‘আলা বিশৃঙ্খলা তৈরী করা পসন্দ করেন না। তিনি শৃঙ্খলা রক্ষা করা এবং বিশৃঙ্খলা প্রতিরোধ করাকে মুমিন জীবনের অনিবার্য বৈশিষ্ট্য হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করে দিয়েছেন। বিশৃঙ্খলা প্রতিরোধের জন্য সর্বাত্মক যুদ্ধ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহবান জানিয়েছেন। কেননা এতে কেবল বিশৃঙ্খলাকারীরাই নয় বরং সমাজের সকল শ্রেণীর লোক আক্রান্ত হয়ে থাকে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন- وَاتَّقُوا فِتْنَةً لَا تُصِيبَنَّ الَّذِينَ ظَلَمُوا مِنْكُمْ خَاصَّةً وَاعْلَمُوا أَنَّ اللهَ شَدِيدُ الْعِقَابِ ‘তোমরা এমন ফাসাদকে ভয় কর, যা বিশেষ করে তোমাদের মধ্যে যারা যালিম কেবল তাদেরকেই ক্লিষ্ট করবে না এবং জেনে রাখ যে, নিশ্চয়ই শাস্তিদানে কঠোর’ (আনফাল ৮/২৫)। অন্যত্র তিনি বলেন- وَقَاتِلُوهُمْ حَتَّى لَا تَكُونَ فِتْنَةٌ وَيَكُونَ الدِّينُ لِلَّهِ فَإِنِ انْتَهَوْا فَلَا عُدْوَانَ إِلَّا عَلَى الظَّالِمِينَ ‘তোমরা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে থাকবে, যতক্ষণ না ফেৎনা দূরিভূত হয় এবং আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠিত না হয়। যদি তারা বিরত হয় তবে যালিমদেরকে ব্যতীত আর অন্যদেরকে আক্রমণ করা চলবে না’ (বাক্বারাহ ২/১৯৩)।
ফেৎনা বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকে অত্যন্ত ঘৃণ্য কর্ম হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে। বিশৃঙ্খলার চেয়ে আল্লাহ তা‘আলা আইনসঙ্গত মৃত্যুদন্ডকে শ্রেয় বলে ঘোষণা করেছেন। ইরশাদ হচ্ছে- وَالْفِتْنَةُ أَشَدُّ مِنَ الْقَتْلِ ‘বিশৃঙ্খলা হত্যার চেয়েও জঘন্য’ (বাক্বারাহ ২/১৯১)। অতএব সফল কর্মীর আচরণে এটা যেন সূর্যের ন্যায় পরিষ্কারভাবে প্রকাশ পায় যে, সে নিজে শৃঙ্খলা মেনে চলবেন, শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য কাজ করবেন এবং কোথাও বিশৃঙ্খলা তৈরী না হয় সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখবেন।
৩২. সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা থাকা :
সফলকর্মীর উল্লেখযোগ্য আচরণ হল সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। কেননা যথাসময়ে উপযুক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের উপর সাংগঠনিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সাফল্য নির্ভর করে। কর্মী যদি যথাসময়ে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণে ব্যর্থ হয় বা সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে তবে অধঃস্তন জনশক্তিকে কখনই সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা সম্ভব হয় না। তাই প্রয়োজনীয় মুহূর্তে ত্বরিৎ সিদ্ধান্ত গ্রহণের আচরণটি কর্মীর মধ্যে বিদ্যমান থাকা আবশ্যক।
৩৩. বিশ্লেষণের অনুভূতি লাভ করা :
কর্মী যে মানচিত্রে বসবাস করে, যে সমাজে চলাফেরা করে, যে সংগঠনের সাথে আছে তার প্রত্যেকটি বিষয়ের ও অবস্থার বিশ্লেষণের ক্ষমতা থাকতে হবে। যথাসময়ে তার বিশ্লেষণ যদি ভুল হয় তবে কর্মীর সফলতায় কালো পর্দা নেমে আসবে। অতএব সঠিক বিশ্লেষণ করে সঠিক কর্মপন্থা গ্রহণই তাকে পৌঁছে দিবে সফলতার স্বর্ণশিখরে।
৩৪. পদলোভী না হওয়া :
ইসলামী আন্দোলনে দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। এ জন্য পৃথিবীতে যেমন ঝুঁকি থাকে, তেমনি পরকালে ও সমূহ বিপর্যয়ের সম্ভবনা রয়েছে। দায়িত্ব পালন সঠিকভাবে না করলে দায়িত্বহীনতার জন্য সংশ্লিষ্ট নেতার কাছে জবাবদিহি করতে হয়। আর আখিরাতে এ অপরাধের জন্য আল্লাহ জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন। সে জন্য কোন মুসলিম বা ইসলামী আন্দোলনের কর্মী স্বেচ্ছায় দায়িত্বপূর্ণ কোন পদপ্রার্থী হতে পারে না। এটা অন্যায় এবং ক্ষমতা অপব্যবহারের আগাম ইঙ্গিত। সে জন্য ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের আচরণই হবে সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থ। কেননা পদ বা ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য মানুষ যে কোন অন্যায় করতে পারে। এ বিষয়ে কর্মীকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ঘোষণা সর্বদা সতর্কতার সাথে মনে রাখতে হবে। রাসূলুল্লাহ (ছা.) বলেন- إِنَّا وَاللهِ لاَ نُوَلِّى عَلَى هَذَا الْعَمَلِ أَحَدًا سَأَلَهُ وَلاَ أَحَدًا حَرَصَ عَلَيْهِ ‘আল্লাহর কসম! আমরা এমন ব্যক্তিকে কখনোই আমাদের দায়িত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ করব না, যে নিজে প্রার্থনা করে বা তার জন্য লালায়িত থাকে’।[3]
৩৫. অফিস পরিচালনায় দক্ষতা অর্জনা করা :
একজন সফল কর্মীর আচরণবিধিতে অফিস পরিচালনার দক্ষতা থাকা একান্ত যরূরী। অফিস পরিচিতি, অফিসের কার্যাবলী সম্পর্কে নিম্নে উল্লেখিত হল :
অফিস (Office) একটি ইংরেজি শব্দ। যার বাংলা অর্থ হল কার্যালয় বা দফতর। অবশ্য অফিস (Office) শব্দটি সর্বজনবোধ্য হওয়ায় বাংলাতে বহুল ব্যবহৃত। প্রতিষ্ঠানের মালিক ও পরিচালকগণ বা কর্মচারীগণ যেখানে বসে সংগঠন পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণসহ যাবতীয় কার্যক্রম সম্পন্ন করে থাকে তাকে অফিস বলে। অফিস সম্পর্কে অধ্যাপক হাস্ট-এর মত হল, ‘সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানের যে প্রধান কার্যালয় হতে যাবতীয় নির্দেশনাবলী দেওয়া হয় এবং যেখানে উক্ত নির্দেশসমূহের ফলাফল নিরূপিত হয় ও প্রতিষ্ঠানের কার্যাবলী সংক্রান্ত বিষয়ে যাবতীয় নথিপত্র সংরক্ষণ করা হয় তাকে অফিস বলে’। বি.বি ঘোষ-এর মতে, `Office is the seat of administration where policy decisions are taken and from where all the organization are directed'.
সুতরাং কর্মী যে স্তরের হোক না কেন তাকে কেন্দ্র, যেলা, উপযেলা, এলাকা, মহানগর, পৌরসভা, শহর, স্কুল, কলেজ, মাদরাসা ও বিশ্ববিদ্যালয় অফিসের কার্যাবলী সম্পর্কে দক্ষতা থাকতে হবে। অফিসের কার্যাবলী প্রধানতঃ দুইটি অংশে ভাগ করা যেতে পারে : (ক) অফিসের নিয়মিত কার্যাবলী (খ) অফিসের প্রশাসনিক কার্যাবলী। যেমন
(ক) অফিসের নিয়মিত কার্যাবলী :
১. তথ্য সংগ্রহ ২. তথ্য সংরক্ষণ ৩, তথ্য বিশ্লেষণ, ৪. আসবাবপত্র সংরক্ষণ ৫. কাজের রুটিন প্রণয়ন ৬. প্রচার ৭. স্টেশনারী ও মনিহারি দ্রব্য সংগ্রহ ৮. হিসাব সংরক্ষণ ৯. যোগাযোগ ১০. নথিকরণ ইত্যাদি।
(খ) অফিসের প্রশাসনিক কার্যাবলী :
১. পরিকল্পনা প্রণয়ন ২. নিয়ন্ত্রণ ৩. সমন্বয় সাধন ৪. আইন-কানূন, নিয়মনীতি ও শৃঙ্খলার অনুসরণ ৫. সদস্য সংগ্রহ ৬. কর্মী প্রশিক্ষণ ৭. আসবাবপত্র নির্বাচন ৮. ফরম প্রস্ত্তত ও নিয়ন্ত্রণ ৯. ঝুঁকি হ্রাস।
উল্লেখিত ‘ক’ ও ‘খ’ অংশের কার্যাবলী পরিচালার জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক রেজিস্ট্রার ও ফাইল পত্রের সাথে কর্মীর ভালভাবে পরিচিত থাকতে হবে। তাহলে অফিস পরিচালনার দক্ষতা কাজে লাগিয়ে সফলতার দিকে এগিয়ে যাবে।
৩৬. মধ্যমপন্থা অবলম্বন করা :
ইসলাম একটি মধ্যমপন্থী জীবন ব্যবস্থা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَكَذَلِكَ جَعَلْنَاكُمْ أُمَّةً وَسَطًا لِتَكُونُوا شُهَدَاءَ عَلَى النَّاسِ وَيَكُونَ الرَّسُولُ عَلَيْكُمْ شَهِيدًا ‘অনুরূপভাবে আমি তোমাদের মধ্যমপন্থী জাতিরূপে প্রতিষ্ঠিত করেছি, যাতে তোমরা মানুষ জাতির জন্য সাক্ষীস্বরূপ এবং রাসূল তোমাদের জন্য সাক্ষীস্বরূপ করা হবে’ (বাক্বারাহ ২/১৪৩)। সুতরাং ইসলাম এমন একটি মধ্যপন্থী ধর্ম, যাতে বাড়াবাড়ি ও সীমালংঘনের কোন স্থান নেই। এটি একটি ন্যায়ানুগ জীবন ব্যবস্থা, যা সর্বব্যাপী। এতে একটি দিক বাদ দিয়ে অন্যদিককে ধারণ করা হয়েছে, বা প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে এমন নয়; বরং সকল দিককে সমান গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কর্মীর জীবনে যত দিক ও বিভাগ আছে তার প্রত্যেকটি দিক ও বিভাগে মধ্যপন্থা থাকা যরূরী। চাই সেটা ঈমানের ক্ষেত্রে হোক কিংবা কর্ম ও ইবাদতের ক্ষেত্রে হোক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে হোক, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে হোক বা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে হোক, আবেগ-অনুভূতির ক্ষেত্রে হোক কিংবা বিচার-ফায়ছালা ও সাক্ষ্যদানের ক্ষেত্রে হোক। মধ্যপন্থা অবলম্বন করা কর্মীর অন্যতম আচরণ। হাদীছে এসেছে,
عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ قَالَ أَحْبِبْ حَبِيبَكَ هَوْنًا مَا عَسَى أَنْ يَكُونَ بَغِيضَكَ يَوْمًا مَا وَأَبْغِضْ بَغِيضَكَ هَوْنًا مَا عَسَى أَنْ يَكُونَ حَبِيبَكَ يَوْمًا مَا.
আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, আমি নবী কারীম (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, বন্ধুর সাথে স্বাভাবিক বন্ধুত্ব বজায় রাখ (বাড়াবাড়ি কর না), হতে পারে সে একদিন তোমার শত্রু হয়ে যাবে। অনুরূপভাবে শত্রুর সাথে স্বাভাবিক শত্রুতা বজায় রাখ (আধিক্য দেখিও না), হতে পারে একদিন তোমরা বন্ধু হয়ে যাবে।[4]
৩৭. সত্যবাদী হওয়াঃ
মুমিন জীবন আর সত্যবাদিতা কখনো আলাদা হতে পারে না। মুমিন মানেই তাকে সত্যবাদী হতে হবে। সে যেমন ছয়টি সত্যের উপর বিশ্বাস রেখে মুমিন হয়েছে, তেমনি ভাবে জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে সত্যের ওপর অবিচল ও অটুট থাকতে হবে। মুমিন শুধু ঈমানের মৌখিক স্বীকৃতিই দেয় না। সে মনেপ্রাণে বিশ্বাস রেখে কাজের মাধ্যমে বাস্তব প্রমাণ দেয়। মূলতঃ মৌখিক স্বীকৃতি, অন্তরের বিশ্বাস এবং তা কাজের সমন্বয়কারীকেই বলা হয় মুমিন। এ সমন্বয়ের ওপরই মুমিনের যাবতীয় কাজ ও চরিত্র নির্ভরশীল। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ آمَنُوا بِاللهِ وَرَسُولِهِ ثُمَّ لَمْ يَرْتَابُوا وَجَاهَدُوا بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنْفُسِهِمْ فِي سَبِيلِ اللهِ أُولَئِكَ هُمُ الصَّادِقُونَ
‘তারাই মুমিন, যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনে, পরে সন্দেহ পোষণ করে না এবং জীবন ও সম্পদ দ্বারা আল্লাহর পথে জিহাদ করে, তারাই সত্যনিষ্ঠ’ (হুজুরাত ৪৯/১৫)।
একজন ব্যক্তি যখন সে নিজেকে সত্যবাদী হিসাবে চিহ্নিত করতে চাইবে তখন তার ওপর প্রথম যে কর্তব্যটি বর্তাবে তাহল, সে নিজেকে সত্যনিষ্ঠ লোকদের সঙ্গী করে নিবে। কেননা আল্লাহ তা‘আলার স্বাভাবিক বিধান হল, যে যেমন চরিত্রের অধিকারী তার সঙ্গী-সাথীও তেমনই জুটিয়ে দেন। মানুষের চিন্তা-চেতনা ও ঝোঁক প্রবণতা এবং আগ্রহ অনুসারেই তার সঙ্গী জুটে।
মুমিন হয় মুমিনের বন্ধু আর কাফির হয় কাফিরের বন্ধু। মুমিনের হৃদয়ের বন্ধন থাকে আরেকজন মুমিনের হৃদয়ের সাথে। সুতরাং কর্মীর আচরণে সত্যবাদিতা অবশ্যই থাকতে হবে এবং সত্যনিষ্ঠ লোকদের সাথে শামিল হতে হবে। আল্লাহর ঘোষণা- يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللهَ وَكُونُوا مَعَ الصَّادِقِينَ ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্যনিষ্ঠ লোকদের সঙ্গী হও’ (তওবা ৯/১১৯)।
৩৮. হাস্যোজ্জ্বল চেহারা, মৃদু হাসি ও শীতল চক্ষু সম্পন্ন হওয়া :
এই আচরণ একজন সফল কর্মীর অমূল্য সম্পদ। এমন গুণে গুণান্বিত ব্যক্তির পাশে মানুষ আশ্রয় গ্রহণ করে। তার পরশে এসে প্রশান্তি লাভ করে। তাছাড়া চক্ষু ব্যক্তির আকর্ষণ। চোখের চাহনি মানুষের হৃদয়কে বিগলিত করে। কিন্তু যে চোখ চৈত্রের খরার মত তা কি মানুষের মনকে শীতল করে? দুঃখজনক হলেও সত্য যে, সমাজের অনেক মানুষের চেহারায় এমন কুৎসিত ছাপ পড়ে থাকে যার কারণে মানুষ তার পাশে যেতে চায় না। কখনো কেউ কাছে আসলেও তার অশালীন ভাষা, রুক্ষ ব্যবহার, কর্কশ বাক্য, অশ্রাব্য বকাবকি তাকে দূরে সরিয়ে দেয়। ফলে আর কখনো তার ধারে কাছে আসে না। নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির মাঝে এই স্বভাবের সমাবেশ বেশি ঘটে। একজন সফল কর্মীর মাঝে এ ধরণের স্বভাব থাকা খুবই নিন্দনীয়। হাদীছে এসেছে,
আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত, একদা এক ব্যক্তি রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট প্রবেশের অনুমতি চাইল। তিনি লোকটিকে দেখে বললেন, সে সমাজের নিকৃষ্ট লোক এবং সমাজের দুষ্ট সন্তান। এরপর সে যখন এসে পড়ল, তখন নবী করীম (ছাঃ) আনন্দ সহকারে তার সাথে মেলামেশা করলেন। লোকটি চলে গেলে আয়েশা (রাঃ) তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! যখন আপনি লোকটিকে দেখলেন তখন তার ব্যাপারে এমন বললেন, পরে তার সাথে আপনি আনন্দচিত্তে সাক্ষাৎ করলেন। তখন রাসূল (ছাঃ) বললেন, হে আয়েশা! তুমি কখন আমাকে অশালীন দেখেছ? ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহর কাছে মর্যাদার দিক দিয়ে মানুষের মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট সেই ব্যক্তি, যার দুষ্টামির কারণে মানুষ তাকে ত্যাগ করে (ছহীহ বুখারী হা/৬০৩২; মিশকাত হা/ ৪৮২৯)। আব্দুল্লাহ ইবনু হারেছ ইবনে জাযই (রাঃ) বলেনمَا رَأَيْتُ أَحَدًا أَكْثَرَ تَبَسُّمًا مِنْ رَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم ‘আমি রাসূল (ছাঃ)-এর চেয়ে অন্য কাউকে অধিক মুচকি হাসতে দেখিনি’।[5]
৩৯. মূর্খতার জবাবে যুক্তিপূর্ণ কথা বলা :
মূর্খ বলতে অশিক্ষিত বা লেখাপড়া জানে না, অক্ষর জ্ঞান নেই এমন লোককে বুঝানো হয়নি। বরং মুর্খ বলতে এমন লোককেই বুঝানো হয়ে থাকে, যাদের মধ্যে দ্বীনদারিতার কোন জ্ঞান নেই, যারা ধর্মীয় মূল্যবোধ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। যারা জাহেলী কর্মকান্ডে লিপ্ত হবার উদ্যোগ নিয়েছে এবং কোন সভ্য-ভদ্র ও দ্বীনদারি লোকের সাথে অশালীন ব্যবহার করে। দ্বীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামী কর্মীর আচরণ হবে, তারা এসব মূর্খ লোকদের গালি বা অশালীন ব্যবহারের জবাবে গালি বা অশালীন ব্যবহার এবং দোষারোপের জবাবে দোষারোপ করবে না। বরং যারাই তাদের সাথে এহেন আচরণ করে তাদের সালাম দিয়ে মুমিন বান্দারা সামনের দিকে অগ্রসর হয়ে যায়। যেমন আল্লাহ বলেন,وَإِذَا سَمِعُوا اللَّغْوَ أَعْرَضُوا عَنْهُ وَقَالُوا لَنَا أَعْمَالُنَا وَلَكُمْ أَعْمَالُكُمْ سَلَامٌ عَلَيْكُمْ لَا نَبْتَغِي الْجَاهِلِينَ ‘তারা যখন কোন বেহুদা কথা শোনে, তখন তারা উপক্ষো করে যায় এবং বলে, আমাদের কাজের ফল আমাদের জন্য এবং তোমাদের কাজের ফল তোমাদের জন্য; তোমাদের প্রতি সালাম। আমরা অজ্ঞদের সঙ্গ চায় না’ (ক্বাছাছ ২৮/৫৫)।
একজন কর্মী সর্বদা ভাল আচরণ দিয়েই মন্দ আচরণের মোকাবেলা করে থাকে। কেননা যার অন্তরে বিন্দু পরিমাণ ভদ্রতা ও মানবতাবোধ থাকে সে যদি মন্দের মোকাবেলায় ভাল আচরণ দেখতে পায় তাহলে সে খারাপ আচরণে আর স্থির থাকতে পারে না। বরং তার অন্তরে ঘৃণা ও হিংসার পরিবর্তে ভালবাসা ও মমতা সৃষ্টি হয়। আল্লাহর ঘোষণা,وَلَا تَسْتَوِي الْحَسَنَةُ وَلَا السَّيِّئَةُ ادْفَعْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ فَإِذَا الَّذِي بَيْنَكَ وَبَيْنَهُ عَدَاوَةٌ كَأَنَّهُ وَلِيٌّ حَمِيمٌ ‘ভাল ও মন্দ সমান হাতে পারে না। ভাল দিয়েই মন্দের মোকাবেলা কর। ফলে তোমার সাথে যার শত্রুতা আছে, সে হয়ে যাবে অন্তরঙ্গ বন্ধুর মত’ (হা-মীম সাজদাহ ৪১/৩৪)। যেমন হাদীছে এসেছে, আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) বলেন, উয়াইনা ইবনে হিসন ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ)-এর নিকট উপস্থিত হয়ে বলল, হে খাত্তাবের পুত্র! আল্লাহর শপথ, আপনি আমাদের বেশী দান করেন না এবং আমাদের ব্যাপারে ইনছাফের সাথে ফায়ছালা করেন না। এ কথায় ওমর (রাঃ) ক্রোধান্বিত হলেন, এমন কি তাকে আক্রমণ করতে উদ্যত হলেন; তখন (হিসন-এর ভ্রাতুষ্পুত্র) হুর ইবনে কায়েস (রাঃ) বললেন, হে আমীরুল মুমিনীন! আল্লাহ তা‘আলা তার নবী (ছাঃ)-কে বলেছেন, ‘ক্ষমা ও উদারতা প্রদর্শন কর, ভাল কাজের নির্দেশ দাও এবং মুর্খদের এড়িয়ে চল’ (‘আরাফ ৭/১৯৯)। রাবী আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) বলেন, আল্লাহর শপথ! এ আয়াত শুনে ওমর (রাঃ) আর অগ্রসর হননি। তিনি আল্লাহর কিতাবের নির্দেশ শুনা মাত্রই সর্বাধিক অনুগত হয়ে যেতেন।[6]
৪০. আল্লাহর দেওয়া সীমা রক্ষা করা :
সূর্য উদিত হওয়ারর মধ্য দিয়ে দিন শুরু হয় এবং সূর্য অস্ত যাওয়ার মধ্য দিয়ে দিন শেষ হয়। অর্থাৎ রাতের আগমন ঘটে আবার সূর্য উদিত হওয়ার মধ্য দিয়ে রাত শেষ হয় অর্থাৎ দিনের যাত্রা শুরু হয়। এ রুটিন হল মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ রাববুল ‘আলামীনেরই কর্মের ও হুকুমের বহিঃপ্রকাশ। এ রাত আর দিনের আলোকেই মানুষকে তার কর্মসূচী নির্ধারণ করতে হয়। এ কর্মসূচী একেকজন একেক পন্থায় সম্পাদন করে থাকে। কেউ সম্পাদন করে বিভিন্ন দার্শনিক, পন্ডিত ও বুদ্ধিজীবীকে কেন্দ্র করে, কেউ সম্পাদন করে বিভিন্ন তন্ত্র-মন্ত্র ও দলকে কেন্দ্র করে, আবার কেউ সম্পাদন করে মহাপরাক্রমশালী আল্লাহর সীমারেখাকে কেন্দ্র করে। আর যারা আল্লাহর দেওয়া সীমারেখায় তাদের দিনাতিপাত করে থাকে তারাই হল মুমিন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَالْحَافِظُونَ لِحُدُودِ اللهِ وَبَشِّرِ الْمُؤْمِنِينَ ‘তারা (মুমিনরা) আল্লাহর দেওয়া সীমারেখা সংরক্ষণকারী। আর মুমিনদের জন্য সুসংবাদ’ (তওবা ৯/১১২)।
কর্মী ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক কর্মকান্ড আল্লাহর দেওয়া সীমা রেখার মধ্যে আবদ্ধ রাখে। কখনো এ সীমা অতিক্রম করে ইচ্ছাকৃত নিজেদের জীবন পরিচালনা করে না। এখানে আল্লাহর দেওয়া সীমারেখা বলতে, আল্লাহর আদেশ নিষেধ ও তার হুকুম-বিধানকেই বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ চিন্তা-চেতনা, আনুগত্য-অনুসরণ, ঈমান-আক্বীদা, নৈতিকতা, সভ্যতা-সংস্কৃতি, সামাজিকতা, বিচার ব্যবস্থা, শিক্ষা ব্যবস্থা, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, স্বরাষ্ট্রনীতি, পরাষ্ট্রনীতি, মুসলিম-অমুসলিম সম্পর্ক, একে অন্যের প্রতি দায়িত্ব ইত্যাদি ক্ষেত্রে এক কথায় মানব জীবনের রান্নাঘর থেকে পল্লী ভবন পর্যন্ত, বিদ্যালয় থেকে আদালত পর্যন্ত, ব্যক্তি জীবন থেকে আন্তর্জাতিক জীবন পর্যন্ত সকল পর্যায়ের জন্য একমাত্র বিধানদাতা আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন যে নীতি-নির্ধারণ করেছেন সেই নীতি নির্ধারণই হল আল্লাহর দেওয়া সীমারেখা।
কর্মী এই সীমার প্রতি পূর্ণ লক্ষ্য রেখে দিনাতিপাত করবে। নিজের ব্যক্তিগত হোক অথবা সমষ্টিগত হোক সকল কর্মকান্ড এই সীমারেখার মধ্যে আবদ্ধ রাখবে। কখনো এ সীমা অতিক্রম করে ইচ্ছামত কাজ করবে না। আবার কখনো আল্লাহর আইনের পরিবর্তে মনগড়া আইনকে বা মানুষের তৈরী করা ভিন্নতর আইনকে জীবন বিধান হিসাবে গ্রহণ করবে না। কেননা আল্লাহ তা‘আলা মুমিনদের কে সতর্কমূলক ভাষা দিয়ে অবগত করে দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন,
وَمَنْ يَبْتَغِ غَيْرَ الْإِسْلَامِ دِينًا فَلَنْ يُقْبَلَ مِنْهُ وَهُوَ فِي الْآخِرَةِ مِنَ الْخَاسِرِينَ ‘যে ব্যক্তি ইসলাম ছাড়া অন্য কোন পদ্ধতি অবলম্বন করতে চাই, তার সে পদ্ধতি কখনো গ্রহণ করা হবে না এবং আখেরাতে সে হবে ক্ষতিগ্রস্তদের (ব্যর্থ, আশাহত, বঞ্চিত, লাঞ্ছিত ও অপমানিত) অন্তর্ভুক্ত’ (আলে ইমরান ৩/৮৫)।
দ্বীনকে আল্লাহ তা‘আলা মানুষের জন্য যথেষ্ট করে দিয়েছেন। সুতরাং এখন মুমিনদের গলায় প্রকৃত পক্ষে আল্লাহ ছাড়া আর কারো আনুগত্য ও বন্দেগীর শৃঙ্খল নেই। এখন আক্বীদা-বিশ্বাসের ক্ষেত্রে যেমন মুমিনরা একমাত্র আল্লাহর আনুগত্যকারী, ঠিক তেমনি কর্ম জীবনেও আল্লাহর ছাড়া আর কারোর আনুগত্যকারী নয়। আল্লাহর ঘোষণা-
الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِينًا ‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন (জীবনব্যবস্থা)-কে পরিপূর্ণ করে দিয়েছি। আমার নে‘মত তোমাদের প্রতি সম্পূর্ণ করেছি এবং তোমাদের জন্য ইসলামকে তোমাদের দ্বীন হিসাবে মনোনীত করে দিয়েছি’ (মায়েদা ৫/৩)।
৪১. পর্যালোচনা করা :
দ্বীন প্রতিষ্ঠার কর্মী একজন মুমিন। মুমিন ঈমানের হ্রাস-বৃদ্ধিতে বিশ্বাসী। ঈমানের পরিভাষিক সংজ্ঞায় হ্রাস-বৃদ্ধির ব্যাপারে বলা হয়েছে-
الايمان هو الةصديق بالجنان والاقرار باللسان والعمل بالاركان يزيد بالطاعة وينقص عن المعصية-
‘ঈমান হল হৃদয়ে বিশ্বাস, মুখে স্বীকৃতি ও কর্মে বাস্তবায়নের সমন্বিত নাম। যা আনুগত্যে বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয় ও গোনাহে হ্রাস প্রাপ্ত হয়। আল্লাহর ঘোষণা-
إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ إِذَا ذُكِرَ اللهُ وَجِلَتْ قُلُوبُهُمْ وَإِذَا تُلِيَتْ عَلَيْهِمْ آيَاتُهُ زَادَتْهُمْ إِيمَانًا وَعَلَى رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُونَ
‘যারা ঈমানদার, তারা এমন যে, যখন আল্লাহর নাম স্মরণ করা হয় তখন ভীত হয়ে পড়ে তাদের অন্তর। আর যখন পাঠ করা কালাম/কুরআন, তখন তাদের ঈমান বেড়ে যায় এবং তারা স্বীয় পরওয়ারদেগারের প্রতি ভরসা পোষণ করে’ (আনফাল ৮/২)। অন্যত্র তিনি বলেন-
هُوَ الَّذِي أَنْزَلَ السَّكِينَةَ فِي قُلُوبِ الْمُؤْمِنِينَ لِيَزْدَادُوا إِيمَانًا مَعَ إِيمَانِهِمْ وَلِلَّهِ جُنُودُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَكَانَ اللهُ عَلِيمًا حَكِيمًا ‘তিনি মুমিনদের অন্তরে প্রশান্তি অবতীর্ণ করেন, যাতে তাদের ঈমানের সাথে আরও ঈমান বেড়ে যায়। নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের বাহিনী সমূহ আল্লাহরই এবং আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়’ (ফাতাহ ৪৮/৪)।
আলোচনা দ্বারা একথা পরিষ্কার করে বলা যায়, ঈমানের হ্রাস-বৃদ্ধির ফলে কর্মীর কাজের গতি কখনো গতিশীল হয় আর কখনো মন্থর হয়। কর্মীর আচরণে ‘পর্যালোচনা’ বিষয়টি অবশ্য থাকা যরূরী। কারণ পর্যালোচনার মাধ্যমে কর্মীর কাজের প্রকৃত মান নির্ণীত হয় এবং ভবিষ্যৎ সফলতার পথ সুগম হয়। কর্মীর কাজের যতগুলো দিক ও বিভাগ আছে তার প্রত্যেকটির পর্যালোচনা করে সফলতা ও ব্যর্থতার দিকগুলো চিহ্নিত করা। চিহ্নিত করা কিভাবে সফলতা এসেছে এবং কী কী কারণে কিছুটা হলেও ব্যর্থতা এসেছে? চাই সেটা আর্থিক ক্ষেত্রে, কর্মী যোগাযোগের ক্ষেত্রে, দাওয়াতী ক্ষেত্রে কিংবা সাংগঠনিক মযবুতির ক্ষেত্রে হোক। জানুয়ারী ২০১৩ সালে সংগঠনের সামগ্রিক অবস্থা কেমন ছিল এবং ডিসেম্বর ২০১৩ সাংগঠনিক অবস্থা কেমন তা পর্যালোচনার মাধ্যমে কর্মীকে নিরূপণ করতে হবে। এ আচরণবিধি সংগঠনের সকলস্তরের কর্মী ও দায়িত্বশীলদের থাকা যরূরী।
পরিশেষে বলতে চাই, উল্লেখিত আচরণ সম্পন্ন কর্মীদের ওপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠবে সেই কল্যাণ ও মঙ্গলের সৌরভে সুবাসিত মানব সমাজ, যে সমাজ পৃথিবীর বুকে বিশ্ব মানবতার বন্ধু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মানব জাতিকে উপহার দিয়েছিলেন। আজো পৃথিবীর মানুষ যাবতীয় শোষণ, লুণ্ঠন, নির্যাতন-নিপীড়ন, অন্যায়-অত্যাচার, নির্যাতন, নিষ্পেষণ থেকে মুক্তি লাভ করে একটি সুখী-সমৃদ্ধশালী, শোষণ মুক্ত ভীতিহীন ও নিরাপত্তাপূর্ণ সমাজ লাভ করতে সক্ষম হবে, যদি আলোচ্য আচরণগুলো আমাদের চারিত্রিক ভূষণে পরিণত করতে সক্ষম হই। হে আল্লাহ! আমাদের সবাইকে আলোচ্য আচরণগুলো জীবনের সকল ক্ষেত্রে বাস্তবায়ন করার তাওফীক্ব দান করুন। আমিন!
অধ্যাপক মুহাম্মাদ আকবার হোসাইন
আরবী বিভাগ, হামিদপুর আল-হেরা কলেজ, যশোর ও সাবেক কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ
[1]. ছহীহ মুসলিম হা/১১১১; আবুদাঊদ হা/৮৭৫; মিশকাত হা/৮৯৪।
[2]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৬৮৩।
[3]. ছহীহ মুসলিম হা/৪৮২১; মিশকাত হা/৩৬৮৩।
[4]. তিরমিযী হা/১৯৯৭; আদাবুল মুফরাদ হা/১৩২১; ছহীহুল জামে‘ হা/১৭৮, সনদ ছহীহ।
[5]. তিরমিযী/৩৬৪১; মিশকাত হা/৪৭৪৮; সনদ ছহীহ।
[6]. ছহীহ বুখারী হা/৪৬৪২।