পবিত্র ক্বাবা যখন যুদ্ধক্ষেত্র
মিনহাজ আল-হেলাল, হেলসিংক, ফিনল্যান্ড
মিনহাজ আল-হেলাল, হেলসিংক, ফিনল্যান্ড 468 বার পঠিত
ঘটনার সূত্রপাত :
তখনও অন্ধকার ছাপিয়ে শুরু হয়নি আলোর ঝলকানি। একটি সাধারণ দিনের ন্যায় সেদিনের পূর্ব গগন লাল বর্ণের রক্তিম আভায় বর্ণিল। অন্যদিনের মতই ফজরের ছালাত আদায় করতে হাযার হাযার মুছল্লীর আগমন ঘটেছিল পবিত্র হারামে শরীফে। অন্য প্রভাতগুলোর মতই একটা স্বাভাবিক প্রভাত প্রত্যাশা ছিল সকলের। হজ্জ্বের মৌসুম। ১৯৭৯ সালের ২০ নভেম্বর। তখনও সবার অজানা ছিল এই দিনেই রচিত হতে যাচ্ছে মুসলমানদের জন্য নতুন ইতিহাস। ফজরের ছালাতের ঠিক পূর্ব মুহূর্তে বাব্রি চুলের অধিকারী টগবগে এক যুবকের নেতৃত্বে অন্য মুছল্লীদের মতই পবিত্র হারাম শরীফে প্রবেশ করল কয়েকটি কফিনসমেত বেশ কিছু লোক। ঘটনার সূত্রপাত হতে বাকী আরও কিছুক্ষণ। হারামের সম্মানিত ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে সুবাইইল-এর ইমামতিতে সবেমাত্র সমাপ্ত হয়েছে ফজরের ছালাত। অব্যবহিত পরেই কফিন থেকে বের হতে লাগল অত্যধুনিক অস্ত্রশস্ত্র। কতিপয় গুলির শব্দে স্তম্ভিত পবিত্র হারামের উপস্থিত মুছল্লীবৃন্দ। একে একে গুলি হত্যা করা হল হারামের নিয়োজিত সকল নিরাপত্তারক্ষীকে। পরক্ষণেই কালো কুচকুচে শশ্রুষামন্ডিত এক যুবক বন্দুকসমেত সামনে অগ্রসর হন। অতঃপর ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে সুবাইইলের কাছ থেকে মাইক্রোফোন কেড়ে নেন এবং একের পর এক বলতে শুরু করেন সঊদী সরকারের দুর্নীতির বিভিন্ন দিক। দীর্ঘকায় যুবক ঈমাম মাহদীর আগমন সম্পর্কিত রাসূল (ছাঃ)-এর হাদীছ উল্লেখ করে বলেন, যখন সারাবিশ্ব অন্যায় এবং পাপ কর্মে পরিপূর্ণ হয়ে যাবে, তখন ইমাম মাহদীর আগমন ঘটবে। যুবকটি আরও ঘোষণা করলেন, এটাই সেই সময় যখন ইমাম মাহদীর আগমনের ব্যাপারে রাসূল (ছাঃ) ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। আর ইমাম মাহদী আমাদের মাঝেই বর্তমান রয়েছে। শশ্রুষামন্ডিত দীর্ঘকায় যুবকের নাম ‘জুহাইমান আল ওতাইবী’।
জুহাইমান আল-ওতাইবীর পরিচয় :
ঊনিশ শতকের চল্লিশ দশকের গোড়ার দিকে সঊদী আরবের আল-কাশিম (Al-Qassim) রাজ্যের আল-সাজিরে (Al-Sajir) সম্ভ্রান্ত পরিবারে মুহাম্মাদ ইবনে সাইফ আল ওতাইবীর ঔরসে জন্মগ্রহণ করে ফুটফুটে একটি পুত্র সন্তান। এই সন্তানই সেদিনকার জুহাইমান আল ওতাইবী। কে জানত এই মিষ্টি শিশুটিই মাত্র তিন যুগের ব্যবধানে পবিত্র হারাম দখল করে হাযার হাযার নারী-পুরুষ এবং শিশুকে জিম্মি করে অধিকার আদায়ের ব্যর্থ অভিযানে নেতৃত্ব দিবে। তীক্ষ্ণ মেধাসম্পন্ন হলেও জুহাইমানের আনুষ্ঠানিক লেখাপড়ার কথা রয়ে গেছে একেবারেই অজানা । হাঁটি হাঁটি পা পা করে মরুভূমির আলো বাতাসে বেড়ে ওঠা ওতাইবী কৈশোরেই যোগদান করেন সঊদী আ্যারাবিয়ান ন্যাশনাল গার্ড (Saudi Arabian National Gaurd) বাহিনীতে। সালটি ছিল ১৯৫৫। সময়ের আবর্তনে জুহাইমান আল ওতাইবীর মধ্যে ধর্মের প্রভাব বৃদ্ধি পেতে থাকে। জুহাইমান স্বীয় প্রচেষ্টায় যথাসম্ভব ইসলামী শিক্ষায় দীক্ষিত হতে শুরু করেন। ঊনিশ শতকের প্রখ্যাত ইসলামী ব্যক্তিত্ত্ব শায়খ আব্দুল আযীয বিন বায (রহঃ)-এর তত্ত্বাবধানে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত হন। পঞ্চাশ, ষাট এবং সত্তরের দশকে ইসলামের দৃষ্টিকোন থেকে সমাজে প্রচলিত নানা অসংগতি জুহাইমানের মধ্যে ক্রমেই ধর্মের প্রভাব তীব্র থেকে তীব্রতর হতে শুরু করে। তার চোখের সামনেই শুরু হয় সঊদী আরবের তেল সম্পদের জমিদারী কারবার, তার সম্মুখেই সঊদী আরবের বিভিন্ন জায়গায় তৈরি হয় বিলাসবহুল সুউচ্চ অট্টালিকা, যেদিকে চোখ যায় সেদিকেই তার দৃষ্টিগোচর হয় বস্তুকেন্দ্রিক সমাজব্যবস্থা, তার অক্ষিসমক্ষেই সংগঠিত হয় যুক্তরাষ্ট কর্তৃক বিভিন্ন শহর দখলের বাস্তব ঘটনা, তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে সঊদী রাজ পরিবারের নানা দুর্নীতি, এখানে সেখানে তার চোখে পডছে হিজাব ব্যতীত নারী, তার চোখে প্রতিফলিত হয় ইসলাম বিরোধী নানা কাজ কর্ম। ইসলামী শরী‘আহর প্রয়োগরেখা ক্রমেই নিম্নগামী হতে দেখে প্রতিবাদের ভাষা জুহাইমানের মধ্যে অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মত দানা বাঁধতে শুরু করে।।
কর্মজীবন ও উগ্রপন্থী সংগঠন পরিচালনা :
দীর্ঘ আঠার বছর চাকুরী করার পর জুহাইমান ১৯৭৩ সালে ‘সঊদী অ্যারাবিয়ান ন্যাশনাল গার্ড’ থেকে পদত্যাগ করেন এবং মদীনায় প্রত্যাবর্তন করেন। অতঃপর তৃণমূল পর্যায়ে মদীনায় দাওয়াতুল মুহতাসিবা (Movement of accountability)-এর সাথে দাওয়াতী কাজ শুরু করেন। এই দাওয়াতী কাজের উদ্দেশ্য ছিল সঊদী সাধারণ জনগণকে প্রকৃত মুসলমান হিসাবে গড়ে তোলার প্রচেষ্টা। একজন সাধারণ কর্মী হিসাবে কাজ শুরু করলেও আস্তে আস্তে দাওয়াতুল মুহতাসিবায় জুহাইমানের সক্রিয়তা বৃদ্ধি পেতে থাকে। সেই সাথে জুহাইমান তৃণমূল পর্যায়ের দাওয়াতী আন্দোলনকে রাজনৈতিক রূপ দিতে হন বদ্ধ পরিকর। আন্দোলনের স্বাভাবিক লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য (সাধারণ সঊদী জনগণের মধ্যে দাওয়াতী কাজ) থেকে সরে এসে জুহাইমান সঊদী রাজ পরিবার, শাসক এবং সমাজে প্রচলিত নানা অপকর্মের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে দাওয়াতুল মুহতাসিবার প্রতি আহবান জানান। দাওয়াতুল মুহতাসিবা তার দাবী প্রত্যাখান করে তাদের স্বাভাবিক কাজ কর্ম করার প্রত্যয় ব্যক্ত করে। স্বীয় আবেগ এবং কর্মনীতি অনুযায়ী পরিচালিত না হওয়ায় দাওয়াতুল মুহতাসিবা থেকে বের হয়ে জুহাইমান ১৯৭৬ সালে গঠন করেন ‘ইখওয়ান’ নামক নতুন একটি সংগঠন। অতঃপর তিনি মদীনা শহর ছেড়ে পার্শ্ববর্তী একটি গ্রামে বসবাস শুরু করেন। জুহাইমান তার নবগঠিত সংগঠনের মাধ্যমে অনেকটা গোপনে মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত বেশ কিছু ছাত্রকে লক্ষ্য করে কার্যক্রম শুরু করেন। ১৯৭৮ সালে এক ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগের অপরাধে জুহাইমান তার কয়েকজন সহযোগীসহ গ্রেফতার হন এবং আব্দুল আযীয বিন বায (রহঃ)-এর বিশেষ অনুরোধে বিচার প্রক্রিয়া ছাড়াই মুক্তি পান।
১৯৭৯ সালে প্রকাশ্য দাওয়াতের পাশাপাশি জুহাইমান গোপন কার্যক্রম শুরু করেন, যা ছিল তার একান্ত অনুগত বেশকিছু লোকের মধ্যে সীমাবদ্ধ। গোপন অভিসার জুহাইমানের মধ্যে দিন দিন বিশেষ কিছু করার তীব্র আকাঙ্খা সৃষ্টি করে।
ক্বা‘বা আক্রমণের নীলনকশা ও বাস্তবায়ন :
এর পরিপ্রেক্ষিতেই জুহাইমান ১৯৭৯ সালের ২০ নভেম্বর, ১ মহর্রম ১৪০০ হিজরী তারিখে ফজরের পূর্বে পবিত্র হারামে উপস্থিত থাকার লক্ষ্য নিয়ে দুই শতাধিক (ধারণা করা হয় এ সংখ্যা দুই হাযার পর্যন্ত) সহযোগীসমেত মদীনা থেকে যাত্রা শুরু করেন। জুহাইমানের সহযোগীর অধিকাংশই ছিল মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র ও ইসলামী বিষয়াদী সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞানের অধিকারী, যাদের মধ্যে দু’জন ছিল আফ্রো-আমেরিকান। ফজরের জামা‘আত শুরুর পূর্ব মুহূর্তে সকলের চোখ ফাঁকি দিয়ে সাজানো কফিনে ভারী অস্ত্র শস্ত্র নিয়ে জুহাইমান এবং তার বাহিনীর আগমন ঘটে। উদ্দেশ্য মুসলিম উম্মাহকে একজন নতুন নেতার সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া। তৎকালীন সময়ে সঊদী আরব এবং হারাম শরীফে নিরাপত্তা তল্লাসীর কোন বালাই না থাকায় খুব সহজে কোন বাধা ছাড়াই জুহাইমান বাহিনী পবিত্র ক্বা‘বা শরীফে প্রবেশ করতে সমর্থ হয়।
কথিত ইমাম মাহদী :
ক্বা‘বার অভ্যন্তরে অনবরত বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন জুহাইমান। বক্তব্যের শুরুতে উপস্থিত মুছল্লীদের মাঝখান থেকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে একজনকে উঠে আসার নির্দেশ দিলেন। অতঃপর সকলকে উদ্দেশ্যে করে বললেন, এই ব্যক্তিই হচ্ছে তোমাদের মাহদী। জুহাইমান মুছল্লীদেরকে তার কাছে বায়‘আত গ্রহণের জোরালো আহবান জানান। লোকটি ছিলেন জুহাইমান আল-ওতাইবীর শ্যালক মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল্লাহ আল-কাহতানী, যিনি কুরাইশ বংশের কাহতান গোত্রের অধিবাসী। জুহাইমান আবারও বলতে শুরু করলেন, হে লোকসকল! এই লোকটির নাম মুহাম্মাদ, যে নামটা ইমাম মাহদীর নাম হবে বলে রাসূল (ছাঃ) ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। তার পিতার নাম আব্দুল্লাহ যেমনটা রাসূল (ছাঃ) ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। সে কুরাঈশ বংশের অধিবাসী, যেমনটা রাসূল (ছাঃ) ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। ইমাম মাহদীর আগমন এবং বৈশিষ্ট সম্পর্কে রাসূল (ছাঃ) যে বর্ণনা দিয়েছেন তার সাথে মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল্লাহ আল-কাহতানীর অনেক বৈশিষ্ট্য মিলে যাওয়ায় দ্বিধাদ্বন্দে পতিত হন উপস্থিত মুছল্লীদের মধ্যে অনেকেই। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, তার নাম হবে আমার নাম, তার পিতার নাম হবে আমার পিতার নাম, সে হবে আমার বংশধর (কুরাইশ বংশের), সে দুনিয়ায় ন্যায় প্রতিষ্ঠা করবে যেহেতু সে সময়টা থাকবে অন্যায় অপকর্মে ভরপুর (আবু দাউদ হা/৪২৮২, সনদ ছহীহ)। জুহাইমান যেহেতু মনে করতেন তখনকার সময়টা ছিল অন্যায় অপকর্মে পরিপূর্ণ, তাই হাদীছে উল্লেখিত বৈশিষ্ট্যগুলো উল্লেখ করে তিনি মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল্লাহ আল-কাহতানীকে ইমাম মাহদী হিসাবে মেনে নিতে এবং তার হাতে মুছল্লীদের বাই‘আত গ্রহণের আহবান জানান।
জুহাইমানের ক্বা‘বা আক্রমণের নেপথ্যে কারণ :
অতঃপর জুহাইমান একে একে তার বিভিন্ন দাবী পেশ করতে শুরু করেন। তার উল্লেখ্যযোগ্য দাবী ছিল, টেলিভিশন চ্যানেলে নারীদের নিষিদ্ধকরণ, গান-বাজনা নিষিদ্ধকরণ, সঊদী আরব থেকে আমেরিকাকে বহিষ্কার, আরব উপদ্বীপ থেকে সকল বিদেশী সামরিক এবং বেসামরিক লোকদের বহিষ্কার ইত্যাদি। ইতিপূর্বে জুহাইমান প্রায় পনেরটি পুস্তিকা এবং কলাম লিখতে সমর্থ হন, যার সবগুলোই বর্তমানে নিষিদ্ধ। লেখক হিসাবেও জুহাইমানের ছিল অসাধারণ প্রতিভা। তার প্রতিটি লেখাই ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এবং বাস্তবধর্মী। বর্তমান সময়ের তরুণ ইসলামী ব্যক্তিত্ব ইয়াসির কাধী (Yasir Qadhi) তার সবগুলো লেখা অধ্যয়ন করে তাতে পদ্ধতিগত কোন ত্রুটি খুজে পান নি বলে মন্তব্য করেছেন। জুহাইমানের লেখাগুলো ছিল সতর্কতা এবং পূর্বাভাসমূলক। জুহাইমান তার লেখাগুলোতে মূলতঃ বলার চেষ্টা করেছেন, আমরা ইহলোকের শেষ পর্যায়ে এসে পড়েছি, আমেরিকা আমদের গ্রাস করতে চলেছে, তারা আমাদের তেল সম্পদ আত্মসাৎ করে চলেছে, আরব উপদ্বীপগুলো দুর্নীতিতে ভরে গেছে, সবকিছুকে পশ্চিমাকরণ করা হচ্ছে; আর এসব ফেতনাহ থেকে মুক্তির জন্য এখন আমাদের দ্বায়িত্ব কিছু একটা করা। কিন্তু জুহাইমান তার কোন লেখায়ই স্পষ্ট করে বলেননি সত্যিকারে তিনি কি করতে চান বা কি করতে তিনি অন্যদের উদ্বুদ্ধ করছেন। জুহাইমান তার লেখায় সূরা ত্ব-হা-এ আলোচিত মূসা এবং ফেরাউনের উদাহরণ দিয়ে একথা বুঝাতে চেষ্টা করেছেন, তিনি হচ্ছেন মূসা (আ)-এর মত একজন ধার্মিক লোক আর তৎকালীন সময়ের সকল শাসকই ফেরাউনের মত যালিম।
জুহাইমানের হিংস্র আক্রমণ :
এতক্ষণে হারামের অভ্যন্তরে নানান ঘটনা ঘটলেও সে সম্পর্কে বাইরের কারো পক্ষে কিছু জানার যেমন কোন উপায় ছিল না, তেমনি সম্ভব ছিল না হারামের অভ্যন্তর থেকে কারো পক্ষে বের হয়ে যাওয়া। প্রবেশ করার অব্যবহিত পরেই জুহাইমান বাহিনী হারামের সকল ফটক বন্ধ করে দেয়, টেলিফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা হারামের উপস্থিত হাজী এবং মুছল্লীরা হয়ে পড়েন অবরুদ্ধ। প্রবল ধোঁয়াশার মধ্যে আচ্ছন্ন হয় সঊদী কর্তৃপক্ষ। হারাম শরীফ উদ্ধারে তাৎক্ষণিকভাবে সঊদী সরকারের স্বরাষ্ট মন্ত্রনালয় শতাধিক পুলিশের সমন্বয়ে একটি বাহিনী প্রেরণ করে। কিন্তু ঘটনার আকস্মিকতায় তারা হারাম শরীফের নিকটে ভিড়তে ব্যর্থ হয়। পডন্ত বিকালেই সঊদী বাদশাহ আল-মুখাবারাত আল-আমানাহ (Saudi Intelligence)-এর প্রধান প্রিন্স তুর্কি বিন ফায়ছাল আল-সঊদকে সার্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করার জন্য কামান্ডার নিযুক্ত করেন। প্রকৃতপক্ষে ঘটনার সাথে কারা সম্পৃক্ত তা ছিল খুবই অস্পষ্ট। কেউ কেউ ঘটনাটিকে ইরানের শী‘আ অথবা আমেরিকা এবং ইসরাইলের ইহুদী চক্রের কার্যক্রম মনে করলেও তা প্রমাণিত হয়নি। ২৫ নভেম্বর বৈরূত থেকে আরব সোস্যালিস্ট অ্যাকশন পার্টি (Arab Socialist Action Party) নামক একটি সংগঠন জুহাইমান বাহিনীর দাবী দাওয়ার স্বপক্ষে ব্যাখ্যা প্রকাশ করলেও ঘটনার সাথে তাদের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করে।
কা‘বার ইমামের কৌশল ও অপরাধীদের শনাক্ত :
এদিকে হারাম শরীফের ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে সুবাইইল কাছ থেকে সমস্ত ঘটনা প্রত্যক্ষ করায় স্পষ্টতই বুঝতে পেরেছিলেন ঘটনাটি উগ্রপন্থি কতিপয় লোকের বাড়াবাড়ি ছাড়া আর কিছুই নয়। তিনি সুকৌশলে সাধারণ মুছল্লীদের সাথে মিশে যান এবং হিজাবসমেত নারী পোষাক পরিধান করে অন্যদের সাথে পবিত্র ক্বা‘বা শরীফ ত্যাগ করতে সমর্থ হন। ক্বাবা শরীফ থেকে ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে সুবাইইলের প্রস্থানের পরই মূলতঃ কর্তৃপক্ষ মূল ঘটনা সম্পর্কে অবহিত হয়। কর্তৃপক্ষ নিজেদের মধ্যে একের পর এক কথোপকথন, আলোচনার পর আলোচনা চালাতে থাকেন একটা সুষ্ঠু সমাধান বের করার উদ্দেশ্য।
ইমাম মাহদীকে নির্বাচনে বিভক্তি :
অন্যদিকে প্রকৃত ঘটনা না জানার কারণে এবং মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল্লাহ আল-কাহতানীর কতিপয় বৈশিষ্ট্য ইমাম মাহদীর কতিপয় বৈশিষ্ট্যের সাথে মিলে যাওয়ায় দ্বিধাদ্বন্দে পতিত হন নামকরা আলেমগণ। অনেকে মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল্লাহ আল-কাহতানীকে আসল ইমাম মাহদী ভেবে বসেন। কোন কোন আলেম হারাম শরীফ উদ্ধারে সেনাবাহিনী পাঠানো সংক্রান্ত ফৎওয়া জারি করতেও অস্বীকার করেন। অন্যদিকে সমকালীন সময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইসলামী ব্যক্তিত্ত্ব আব্দুল আযীয বিন বায (রহঃ) জুহাইমানের শিক্ষক এবং জুহাইমানের প্রকাশ্য দাওয়াতী ও সংস্কারমূলক কার্যক্রমের সমর্থক হলেও জুহাইমান কর্তৃক পবিত্র হারামকে জিম্মী করাটা স্বাভাবিকভাবেই মেনে নিতে পারেননি। পরবর্তীতে শায়খ আব্দুল আযীয বিন বায (রহঃ)-এর নেতৃত্বে কতিপয় শায়খ পবিত্র হারাম শরীফ ষড়যন্ত্রকারীদের হাত থেকে মুক্ত করতে সেনাবাহিনী পাঠানো সংক্রান্ত ফৎওয়া জারি করেন।
ইমাম মাহদী সম্পর্কে রাসূল (ছাঃ)-এর ভবিষ্যদ্বাণীর সাথে মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল্লাহ আল-কাহতানীর কতিপয় বৈশিষ্ট্যের মিল থাকলেও কয়েকটি ভবিষ্যদ্বাণীর সাথে কোন মিল খুঁজে পাওয়া যায়নি। রাসূল (ছাঃ)-এর ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী ইমাম মাহদী হবেন রাসূল (ছাঃ)-এর বংশধর, তিনি হবেন একজন সাধারণ মানুষ এবং এক রাতে আল্লাহ তাকে বিশেষায়িত করবেন (ইবনে মাজাহ হা/৪০৮৫, সনদ ছহীহ)। রাসূল (ছাঃ)-এর হাদীছ অনুযায়ী ইমাম মাহদীর আগমনের সময়ে তখনকার আরবে গৃহযুদ্ধাবস্থা বিরাজ করবে। ১৯৭৯ সালের ২০ নভেম্বর সঊদী আরবে আদৌ কোন গৃহযুদ্ধ বিরাজমান ছিল না। বরং বর্তমানের তুলনায় সে সময়টা ছিল অধিকতর শান্তিপূর্ণ এবং অধিকতর ইসলামিক। তাছাড়া ইমাম মাহদী হবেন ইনছাফ প্রতিষ্ঠাকারী সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য বিজয়ী ব্যক্তি। তিনি কখনো আটক হবেন না। এ সকল অসামাঞ্জ্যতা এবং ক্ষমতার প্রতি মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল্লাহ আল-কাহতানীর মোহ শেষ পর্যন্ত সকলকে সত্য এবং সঠিক বিষয়টি বুঝতে দারুণভাবে সহযোগিতা করে। শুধুমাত্র ওলামারাই নন দ্বিধাদ্বন্দে পতিত হন সেনাবাহিনীতে কর্মরত সৈনিক কর্মকর্তারাও। শীর্ষ আলেমদের ফৎওয়া সত্ত্বেও হারাম শরীফে রক্তপাত নিষিদ্ধ হওয়ায়, কেউ কেউ মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল্লাহ আল-কাহতানীকে সত্যিকারের ইমাম মাহদী মনে করায় এবং সর্বোপরি রাসূল (ছাঃ)-এর হাদীছের কারণে সেনাবাহিনীতে কর্মরত অনেকেই হারাম শরীফ উদ্ধার কাজে অশগ্রহণ করতে অপরাগতা প্রকাশ করে। জ্ঞানের স্বল্পতা এবং সংকটময় অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সাধারণ মানুষের মধ্যেও অনেকে মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল্লাহ আল-কাহতানীকে ইমাম মাহদী হিসাবে মেনে নিতে ছিলেন সিদ্ধহস্ত। গভীর সংকটের মধ্যে আপতিত হয় কর্তৃপক্ষ। শুধু নাম, পিতার নাম কিংবা বংশ পরিচয়ে নয়, চেহারার বিবরণেও ছিল হুবহু মিল। রাসূল (ছাঃ) ইমাম মাহদীর চেহারার বিবরণ দিয়ে বলেছেন, ইমাম মাহদী হবে প্রশস্ত কপাল এবং লম্বা নাসিকা বিশিষ্ট (আবুদাউদ হা/৪২৮৫, সনদ হাসান), যা বর্তমান ছিল মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল্লাহ আল-কাহতানীর চেহারার প্রতিফলনে। এমন অবস্থায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যে কোন লোকের জন্যই কষ্টসাধ্য। ইতিমধ্যে পঞ্চাশ হাযার লোকের খাবারের ব্যবস্থা না করতে পেরে ঘটনা শুরুর দুই তিনদিন পর অন্যান্য মুছল্লীদের পবিত্র হারাম থেকে বের করে দেয় জুহাইমান বাহিনী। তবে নিজ বাহিনীর আহারের জন্য তারা ছিল নিশ্চিন্ত। তখনও তাদের সঙ্গে মজুদ ছিল বিপুল পরিমান খেজুর, যা তারা ক্বা‘বা শরীফে প্রবেশের প্রাক্কালে সঙ্গে নিয়েছিল। আর অতিরিক্ত হিসাবে ছিল যমযমের পানি।
বিভীষিকাময় পরিস্থিতির অবতারণা :
ততদিনে এক সপ্তাহ সময় অতিবাহিত হয়ে গেছে। এ সময়ে কোন অমুসলমান, কাফের কিংবা মুশরিকদের দ্বারা নয়; সমাজে ন্যায় এবং ইসলামী রীতি-নীতি প্রতিষ্ঠা করার দাবীতে হারাম শরীফ জিম্মি করা জুহাইমান বাহিনীর হাতে রক্তপাত ঘটে নিষিদ্ধ এই পবিত্র অঙ্গনে। সমাজ এবং রাষ্ট্র থেকে নষ্টামি দূর করতে গিয়ে জুহাইমান লঙ্ঘন করে বসেন আল্লাহর পবিত্র কুরআন। বড় বড় অপরাধ, অপকর্মের বিরুদ্ধে ভূমিকা রাখতে গিয়ে জুহাইমান করে বসেন মস্তবড় অপরাধ। মুসলমানরাতো বটেই জুহাইমানের এমন জঘন্যতায় আশ্চর্য হন সারাবিশ্বের অমুসলিমরাও। হারাম শরীফ দখল করার প্রাক্কালেই হত্যা করা হয় সকল নিরাপত্তরক্ষীদের। পরবর্তী কয়েক দিনে হত্যা করা হয় পুলিশ ও সেনাবাহিনীর বেশ কিছু সদস্যকে যারা তথ্য সরবরাহ কিংবা হারামের চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মৃত লাশগুলো সংগ্রহের জন্য পবিত্র হারামের পানে কদম ফেলেছিলেন। হারামের চারিদিকে নজরদারী স্থাপন করা এবং ক্বা‘বা শরীফে যাতে কেউ জীবিত ঢুকতে না পারে, সেজন্য জুহাইমান বাহিনী কর্তৃক হারামের সুউচ্চ মিনারের উপরিভাগে আগেই নিয়োজিত করা হয় বন্দুক চালনায় অতিদক্ষ কতিপয় সদস্যকে। যখনই কেউ ক্বা‘বা শরীফের দিকে অগ্রসর হয়েছে, মিনারের উপর থেকে সাথে সাথেই তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। জুহাইমান বাহিনীর হাতে নিহত নিরাপত্তারক্ষী কিংবা পুলিশের কোন সদস্যের লাশ নিতেও কেউ ভিড়তে পারেনি। এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে লাশগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছিল। আশ্চর্যজনকও বটে! পবিত্র ক্বা‘বা শরীফ এবং এর আশপাশ রক্তের বন্যায় ভাসিয়েছে যারা, তারাই বলছে মানবতার কথা, তারাই বলছে সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠার কথা?
নৃশংস ঘটনাকে কঠোর হস্তে দমন :
সুবিশাল ট্যাঙ্ক এবং সমরাস্ত্রের বহর নিয়ে হারামের চারিদিকে অবস্থান নেয় বিশেষ বাহিনী। হারামের আকাশে চক্কর দিতে থাকে হেলিকপ্টার। পবিত্র হারাম শরীফে বিশেষ বাহিনীর প্রবেশের পূর্বমুহূর্তে কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে জুহাইমান এবং তার বাহিনীকে মাইকে বারবার আত্মসমর্পণ করার আহবান জানানো হয়। ঘোষণা করা হয়, ‘তোমরা যা করছ তা মোটেও আল্লাহকে খুশি করে না এবং আল্লাহ পবিত্র কুরআনে এ ধরণের কাজ করতে নিষেধ করেছেন। সেজন্য কিং খালিদের পক্ষ থেকে আমরা তোমাদের সতর্ক করে দিচ্ছি, আত্মসমর্পণ কর এবং অস্ত্র জমা দাও’। কিন্তু জুহাইমান তার দাবীতে থাকে অটল অবিচল। জুহাইমানও ক্বা‘বা শরীফের অভ্যন্তর থেকে তার দাবী দাওয়া ঘোষণা করতে থাকে। মোটকথা সঊদী রাজ পরিবারের ক্ষমতা হস্তান্তর করার আগ পর্যন্ত জুহাইমান পবিত্র হারাম শরীফকে জিম্মিদশা হতে মুক্তি দিতে অস্বীকৃতি জানান। সুষ্ঠু কোন সমাধানে পৌছতে না পেরে অনেক আলোচনা পর্যালোচনা সাপেক্ষে আটদিন পর জুহাইমান বাহিনীর কবল থেকে ক্বা‘বা শরীফ উদ্ধার করতে বিশাল ট্যাংকের বহর নিয়ে বিশেষ বাহিনী হারাম শরীফের প্রধান ফটকগুলো ভেঙ্গে পবিত্র হারাম শরীফের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। পবিত্র ক্বা‘বা শরীফের অভ্যন্তরে শুরু হয় তুমুল যুদ্ধ। অবিশ্বাস্য! মুসলমান মুসলমানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে, সামনাসমানি গুলি করে হত্যা করছে একে অপরকে। জুহাইমান বাহিনী ক্ষমতার জন্য, বিশেষ বাহিনী ক্বা‘বা শরীফ মুক্ত করার জন্য। যুদ্ধের মাত্রা ক্রমেই তীব্র থেকে তীব্রতর হতে শুরু করল। জুহাইমান বাহিনী অবস্থান নিল হারাম শরীফের ভূ-গর্ভস্ত অংশে, একটিমাত্র ফটক থাকার সুযোগ নিয়ে জুহাইমান বাহিনী ফটকে তাদের সশস্ত্র অবস্থান সুসংহত করে। সেখানে প্রবেশের সাথে সাথেই অনেককে গুলি করে হত্যা করা হয়। কোনভাবেই দমানো যাচ্ছিল না জুহাইমান বাহিনীকে। একের পর এক কৌশল অবলম্বন করতে লাগল বিশেষ বাহিনী।
বিশ্ব নেতৃবৃন্দের আলোচনার পর আলোচনা তখনও শেষ হয়নি। সারা দুনিয়ার মুসলমানদের মধ্যে সংশয় দানা বাঁধতে শুরু করে। অবশেষে ক্বা‘বা শরীফ উদ্ধারে নিয়োজিত বিশেষ বাহিনীর কৌশলের কাছে পরাজিত হতে হয় জুহাইমান এবং তার বিপদগামী সহযোগীদের। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে (মতান্তরে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান) বিশেষ বাহিনী হারামের ভূ-গর্ভস্ত অংশের অভ্যন্তরভাগ পানি দিয়ে অর্ধপূর্ণ করে দেয়। অতঃপর পানিতে বৈদ্যুতিক তার সংযুক্ত করে দেওয়া হয়। যুদ্ধক্ষেত্রে জুহাইমান বাহিনী দুর্বল হয়ে পড়ে। বৈদ্যুতিক শকে জীবিত সকলের দেহ কালো বর্ণ ধারণ করে, যা তাদের ছবিতে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়। ক্ষণস্থায়ী যুদ্ধে পরাজয় হয় জুহাইমান এবং তার বাহিনীর। মৃত্যু হয় কথিত ইমাম মাহদী মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল্লাহ আল-কাহতানীসহ জুহাইমান আল-ওতাইবীর অসংখ্য সহযোগীর। আহতবস্থায় আটক করা হয় জুহাইমান আল-ওতাইবী এবং তার প্রায় সত্তরজন সহযোগীকে। শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থার মধ্যে কেটে যায় দুই সপ্তাহ। কষ্ট হলেও মেনে নিতে হচ্ছে এই সময়ে পবিত্র হারাম শরীফে কোন মুছল্লী প্রবেশ করতে পারেনি, আযানের সুমধুর ধ্বনি ভেসে আসেনি ক্বা‘বা শরীফের সুউচ্চ মিনার থেকে, দুই সপ্তাহ ক্বাবা শরীফে কোন ছালাত হয়নি, হয়নি কোন ত্বাওয়াফ। যদিও সময়টি ছিল হজ্জ্বের মৌসুম।
ধারণা করা হয় জুহাইমান কর্তৃক কা‘বা শরীফ জিম্মি করার ঘটনায় দুই হাযারেরও বেশি মুসলমানের মৃত্যু হয় যদিও অফিসিয়ালী এ সংখ্যা প্রায় চারশ’। জুহাইমান গ্রেফতার হওয়ার পরেও অনেক ওলামা দ্বিধাদ্বন্দে উপনীত হন; তারা জুহাইমানের মধ্যে বেশ কিছু ভাল গুণাবলী প্রত্যক্ষ করেছিলেন। তৎকালীন সময়ের শ্রেষ্ঠ ওলামা আব্দুল আযীয বিন বায (রহঃ), শেখ মুখবিল, শেখ বদীউদ্দীন শাহ সিন্দীসহ অনেকেই ছিলেন জুহাইমানের ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত এমনকি বিপদগামী হওয়ার আগ পর্যন্ত অনেকেই জুহাইমানের সহযোগী ছিলেন। এ ঘটনায় যেহেতু কথিত ইমাম মাহদীর মৃত্যু হয়েছিল, তাই এখন নির্দ্বিধায় বলা যায় মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল্লাহ আল-কাহতানী ইমাম মাহদী ছিলেন না। তাছাড়া শায়খ বিন বায (রহঃ) এ ব্যাপারে একটি দারুণ ফায়ছালা প্রদান করেন। তিনি বলেন, যদি মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল্লাহ আল-কাহতানী ইমাম মাহদী হন, তাহলে তো তিনি গ্রেফতার হবেন না কিংব মরবেনও না। অথচ সে মরেছে।
রূঢ় বাস্তবতা :
তখনকার প্রেক্ষাপটে ব্যাপারটি মোটেও এত সহজ ছিল না। অবাক হওয়ার মত হলেও বাস্তব সত্য পবিত্র হারাম শরীফে রক্তপাতের মত ঘটনা ঘটালেও জুহাইমান শেষ অবধি মনে করেছিলেন সেই সঠিক পথে রয়েছে এবং আল্লাহ তাকে রক্ষা করবেন। বন্দী অবস্থায় জুহাইমান মুহাম্মাদ আল-আমীন আশ-শানকিতীর নেতৃত্বে মদীনার কয়েকজন প্রখ্যাত ইসলামী ব্যক্তিত্ত্ব ছাড়া অন্য কারও সাথে কথা বলতে অস্বীকার করেন। জেলখানায় দেখতে গিয়ে মুহাম্মাদ আল-আমীন আশ-শানকিতী জুহাইমানের সাথে কোলাকুলি করেন, এ সময় তাদের উভয়ের চোখ ছিল অশ্রুসজল। আশ-শানকিতী জুহাইমান কাছে তার কৃতকর্মের কারণ জানতে চান। অতঃপর জুহাইমান বলেন, সমসাময়িক সমাজে চলমান বিশৃঙ্খলা তাকে একাজে প্রেষনা যুগিয়েছে, যদি তারা আল্লাহকে স্মরণ করে এবং ক্ষমা প্রার্থনা করে হয়ত আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা করে দিবেন। জুহাইমানের নিষ্ফল অভিযানের ফলে সত্যের সুমহান পতাকা আবারও উম্মোচিত হয় সর্বত্র। অবশেষে ১৯৮০ সালের ৯ জানুয়ারী হারাম শরীফের অদূরে জুহাইমান এবং তার সহযোগীদের প্রকাশ্যে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। ১৯৭৯ সালের ২০ নভেম্বর থেকে ১৯৮০ সালের ৯ জানুয়ারী একটি সময়কাল, যে সময়ে মুসলমানদের জন্য রচিত হয় নতুন ইতিহাস, যা কলঙ্কজনক একটি অধ্যায়।
নোট :
(১) রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, আমি অদ্ভুদ কিছু স্বপ্ন দেখেছি আমার উম্মতের কিছু সংখ্যক লোক ক্বা‘বা শরীফ আক্রমণে মনস্থ করবে। কুরাইশ বংশের একজন লোক ক্বা‘বা শরীবে আশ্রয় গ্রহণ করবে। অতঃপর একটি সেনাদল তাকে আক্রমণ করতে ক্বা‘বা শরীফের দিকে আগ্রসর হবে। যখন সেনাদলটি বাইদাহ নাকম স্থানে পৌছবে, তখন আল্লাহ ভূ-পৃষ্ঠ খুলে দিবে (ভুমিকম্প) এবং পুরো সেনাবাহিনী তার মধ্যে ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে। আয়েশা (রা) বললনে, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! সেখানেতো অনেকে থাকবে, যারা ক্বা‘বা শরীফ আক্রমণে অনিচ্ছুক। রাসূল (ছাঃ) বললেন, সবাইকে ধ্বংস করে দেওয়া হবে, অতঃপর নিয়ত অনুযায়ী তাদের প্রত্যেককে উত্থিত করা হবে (বুখারী হা/২১১৮; মুসলিম হা/৭৪২১)।
(২) "....আর মসজিদে হারামের কাছে যতক্ষণ তারা তোমাদের সাথে যুদ্ধ না করে, তোমরাও যুদ্ধ করো না ৷ কিন্তু যদি তারা সেখানে যুদ্ধ করতে সংকোচবোধ না করে, তাহলে তোমরাও নিসংকোচে তাদেরকে হত্যা করো ৷ কারণ এটাই এই ধরনের কাফেরদের যোগ্য শাস্তি’ (বাক্বারাহ ২/১৯১)।
মিনহাজ আল-হেলাল
হেলসিংক, ফিনল্যান্ড।
গ্রন্থপঞ্জী
1) The Mahdi between facts and fictions by Abu Aammar Yasir Qadhi
2) Hindsight is 20/20 by Abu Aammar Yasir Qadhi
3) http://forums.islamicawakening.com
4) http://www.wikipedia.com