মাওলানা আববাস আলী : জীবন ও কর্ম
মুহাম্মাদ আব্দুল হামীদ
তাওহীদের ডাক ডেস্ক 692 বার পঠিত
ভূমিকা :
ইসলামের ইতিহাসে যে সকল ছাহাবী রাজকীয় পরিবেশে বেড়ে উঠেছিলেন, তন্মধ্যে মুছ‘আব বিন উমায়ের (রাঃ) ছিলেন অন্যতম। তাঁর সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘আমি মক্কাতে তার চেয়ে সুন্দর কোঁকড়ানো কেশওয়ালা ও ঐতিহ্যবান আর কাউকে দেখিনি’ (মুস্তাদরাকে হাকেম হা/৪৯০৪, ৩/২২১)। তাঁর তীক্ষ্ম বুদ্ধিমত্তা ও মর্মস্পর্শী বক্তব্যের কারণে মাত্র এক বছরের ব্যবধানে মদীনার চিত্রপট সম্পূর্ণ পরিবর্তন হয়ে গিয়েছিল। তিনি যুবকদের অগ্রগতি, আশা-আকাঙ্খ ও উৎসাহ-অনুপ্রেরণার মূর্তপ্রতীক। তাঁর জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র যুবকদের সম্মুখপানে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণার উৎস। নিমেণ তাঁর জীবনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হ’ল।
জন্ম ও শৈশবকাল :
মুছ‘আব বিন উমায়ের (রাঃ) মক্কার কুরাইশ বংশের সম্ভ্রামত্ম ও ঐতিহ্যবাহী এক ধনাঢ্য পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর জন্ম তারিখ সম্পর্কে কোন সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। তাঁর মাতা সম্পদশালী হওয়ায় তাকে অত্যমত্ম ভোগবিলাসের মধ্যে পরম আদর-সেণহে লালন পালন করেন। সেইকালে তার মাতা তাকে মক্কার সবচেয়ে দামী দামী পোশাক পরিধান করাতেন। তিনি মক্কার সবচেয়ে বেশি ও উন্নতমানের সুগন্ধি ব্যবহার করতেন (মুস্তাদরাকে হাকেম ৩/২২১, হা/৪৯০৪)।
নাম ও বংশ পরিচয় :
মূল নাম মুছ‘আব। ইসলাম গ্রহণের পূর্বে তাকে আবু আব্দুল্লাহ বা আবু মুহাম্মাদ নামে ডাকা হত। আর ইমলাম গ্রহণের পর মুছ‘আব আল-খায়ের বলে ডাকা হত (আর-রাহীকুল মাখতূম, ২১৪)। অন্যদিকে মদীনাতে দূত হিসাবে প্রেরিত হওয়ার পর তাকে মুক্বরিয়ূ তথা ক্বারী লক্বব প্রদান করা হয় (হাকেম হা/৬৬৩৮; রওযুল আনফ ২/২৫১)।
তাঁর পিতার নাম উমায়ের বিন হাশেম বিন আব্দে মানাফ বিন আব্দুদ্দার বিন কুশাই বিন কিলাব বিন মুররা বিন কা‘ব বিন ফিহর (কুরাইশ)। মাতার নাম খুনাস বিনতু মালেক বিন মুযরাব। তার বংশের ঊর্ধ্বতন পুরুষ হাশিমের স্তরে গিয়ে রাসূল (ছাঃ)-এর বংশের সাথে মিলিত হয়েছে ।
ইসলাম গ্রহণ :
মুছ‘আব বিন উমায়ের (রাঃ) প্রথম পর্যায়ে ইসলাম গ্রহণকারী ছাহাবীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। যখন মুছ‘আব (রাঃ) যৌবনে পর্দাপণ করলেন, তখন তাঁর মন ধীরে ধীরে ইসলামের দিকে ঝুঁকতে থাকে। তিনি একদা ‘দারুল আরকামে’ রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে গেলেন। সেখানে রাসূল (ছাঃ) ছাহাবীদেরকে কুরআন শিÿা দিতেন ও তাদের সাথে ছালাত আদায় করতেন। এভাবে মুছ‘আব (রাঃ) রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট থেকে ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞাত হওয়ার পর ইসলামে দীÿÿত হন। তিনি ইসলাম গ্রহণের বিষয়টি তার মা ও কওমের নিকটে গোপন রাখেন। কারণ তিনি তাঁর ক্বওমকে তেমন ভয় না করলেও মাতাকে প্রচন্ড ভয় করতেন। এরপর থেকে তিনি চুপিচুপি রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে গমন করতেন ও দ্বীনি শিক্ষা গ্রহণ করতেন। একদা গোপনে তিনি ‘দারুল আরকামে’ প্রবেশ করছেন, এমতাবস্থায় ওছমান বিন তালহা তাকে দেখে ফেলে। অন্য একদিন তিনি ছাহাবীদের সাথে ছালাত আদায় করছিলেন, সেদিনও ওছমানের চোখে পড়ে যায়। সুতরাং বাতাসের ন্যায় খবরটি মক্কার অলিতে-গলিতে ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর মায়ের কানেও পৌঁছায়। তাঁর মাতা যখন একথা শ্রবণ করল, তখন সে অত্যমত্ম রাগান্বিত হল। এমনটি খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দেয় ও নানাভাবে নির্যাতন করতে থাকে (আর-রাহীকুল মাখতূম, ৬৫)। এভাবে নির্যাতনের স্টীমরোলার চালিয়ে যখন তাকে হক্বের পথ থেকে বিন্দুমাত্র সরানোর সম্ভাবনা দেখতে পেল না, তখন তারা তাকে বন্দী করে। শুধু একটি কালেমা তথা ‘আল্লাহ ছাড়া কোন সত্য ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ (ছাঃ) তাঁর বান্দা ও রাসূল’ এতটুকু মেনে নেওয়ার কারণে মক্কার সবচেয়ে সুখী মানুষটি সবচেয়ে দুঃখী মানুষে পরিণত হলেন। তবুও তিনি হক্বের পথে আমৃত্যু অটল ও অবিচল ছিলেন (সিরাতুন নববী ৪/৬৯)।
আবিসিনিয়ায় হিজরত :
মুছ‘আব (রাঃ) বন্দী অবস্থায় অতি কষ্টে দিনাতিপাত করতে লাগলেন। কারা জীবনের কষ্ট তাঁর আর সহ্য হচ্ছিল না। তিনি একদিন খবর পেলেন যে, কিছু মুসলিম হাবশায় হিজরত করবেন। তাই তিনি বন্দিত্বের অবসান ঘটিয়ে বন্দীকারী সকল মানুষের চোখে ধুলা দিয়ে আবিসিনিয়ায় হিজরত করেন (রিজালুন হাওলার রাসূল ১/২)।
আবিসিনিয়ায় অবসস্থানকালে হিজরতকারী মুসলিমরা এক মিথ্যা সংবাদ পেলেন যে, মক্কার কুরাইশ নেতারা ইসলাম গ্রহণ করেছে। বর্তমানে মক্কার অবস্থা বেশ ভাল। তাই তারা জন্মভূমি মক্কায় প্রত্যাবর্তনের উদ্দেশ্যে হাবশা ত্যাগ করেন। মুছ‘আব বিন উমায়ের (রাঃ)ও তাদের সঙ্গে ছিলেন। মক্কা থেকে একদিনের দূরুত্বে অবস্থানকালে তারা প্রকৃত খবর জানতে পারের। অতঃপর রাসূল (ছাঃ)-এর নির্দেশে তাদের কিছু সংখ্যক ছাহাবী আবারও আবিসিনিয়ায় হিজরত করেন। দ্বিতীয়বার আবিসিনিয়ায় হিজরতকারীদের সঙ্গে মুছ‘আব (রাঃ) পুনরায় হিজরত করেন (আর-রাহীকুল মাখতূম, ১১১-১১২; রিজালুন হাওলার রাসূল ১/২)।
রাসূল (ছাঃ)-এর দূত ও সফল দাঈ :
৬২১ খৃষ্টাব্দে রাসূল (ছাঃ) মদীনা থেকে আগত ১৩ জন আনছারদের নিকট থেকে বায়‘আত গ্রহণের পর মুছ‘আব বিন উমায়ের (রাঃ)-কে মদীনায় ১ম রাষ্ট্রদূত তথা মদীনাবাসীদের জন্য শিক্ষক হিসাবে প্রেরণ করেন। যারা তখনও ইসলাম গ্রহণ করেনি, তাদের নিকট দ্বীনের দাওয়াত প্রদানই ছিল তাকে প্রেরণের মৌলিক উদ্দেশ্য।
মুছ‘আব বিন উমায়ের (রাঃ) মদীনায় পৌঁছে আস‘আদ বিন যুরারা (রাঃ)-এর বাড়িতে অবস্থান করেন। এরপর বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনার সাথে তারা উভয়ে মদীনাবাসীদের নিকট ইসলামের দাওয়াত দিতে শুরু করেন। এ সময় তিনি মুক্বরিয়ূ তথা ক্বারী উপাধি লাভ করেন। দ্বীনের তাবলীগের ÿÿত্রে তার ব্যাপক সফলতা রয়েছে। আস‘আদ বিন যুরারা (রাঃ)-কে সঙ্গে নিয়ে একদিন বনী আব্দুল আশহাল এবং বনী জা‘ফরের মহল্লায় যান। সেখানে বনী জা‘ফরের একটি বাগানে ‘মারক’ নামক একটি জলাশয়ের কিনারে বসেন। তাদের নিকটে কয়েকজন মুসলিমও সমবেত হন। বনী আশহাল গোত্রের নেতা ছিলেন সা‘দ বিন মা‘আয ও উছায়েদ ইবনে খোযায়ের। তারা তখনও ইসলাম গ্রহণ করেননি। তারা নবাগত মুসলিমদের আগমনের খবর পেলেন। সা‘দ অপর সর্দার উছায়েদ ইবনে খোযায়েরকে বললেন, তুমি যাও, দেখে এসো ব্যাপারটা কী?। ওদের বলবে যে, তোমরা কী আমাদের দুর্বল লোকদের বোকা বানাতে চাও। তাদের ধমক দিবে ও আমাদের মহল্লায় আসতে নিষেধ করবে। আস‘আদ বিন যুরারা আমার খালাতো ভাই। এ কারণেই আমি তোমাকে পাঠাচ্ছি। অন্যথা আমি নিজেই সেখানে যেতাম।
উছায়েদ তার বর্শা নিয়ে তাদের কাছে গেলেন। আস‘আদ (রাঃ) তাকে আসতে দেখে মুছ‘আব (রাঃ)-কে বললেন, ক্বওমের একজন সর্দার আপনার কাছে আসছেন। তার ব্যাপারে আল্লাহর রহমত কামনা করুন। উছায়েদ পৌঁছেই ÿÿপে গেলেন এবং বললেন, আপনারা কেন আমাদের এলাকায় এসেছেন? আপনারা কী আমাদের দুর্বল লোকদের বোকা বানাতে চান? প্রাণের মায়া থাকলে কেটে পড়ুন। মুছ‘আব (রাঃ) বললেন, একটু বসুন। আমাদের কিছু কথা শুনুন। পসন্দ হলে গ্রহণ করবেন, না হলে গ্রহণ করবেন না। উছায়েদ বললেন, ঠিক আছে, বলুন। তারপর তিনি তার বর্শা মাটিতে পুঁতে বসে পড়লেন। মুছ‘আব (রাঃ) ইসলামের কথা বলতে শুরু করলেন এবং কুরআন তেলাওয়াত করলেন। সবকথা শুনে উছায়েদ বললেন, এ তো খুব চমৎকার বাণী। আপনারা মানুষকে কিভাবে ইসলামে দীÿÿত করেন? মুছ‘আব (রাঃ) বললেন, আপনাকে গোসল করে পবিত্র কাপড় পরিধান করতে হবে। এরপর কালেমা শাহাদাত পাঠ করতে হবে এবং দু’রাকা‘আত ছালাত আদায় করতে হবে। উছায়েদ সব কাজ সম্পাদন করলেন এবং বললেন, আমাদের গোত্রে আরেকজন প্রভাবশালী নেতা আছেন। তিনি যদি ইসলাম গ্রহণ করেন, তাহলে পিছনে কেউ বাকী থাকবে না। আমি তাকে এখনই আপনাদের নিকটে পাঠাচ্ছি।
এরপর উছায়েদ (রাঃ) বর্শা নিয়ে সা‘দ বিন মা‘আযের কাছে গেলেন। সা‘দ উছায়েদকে দেখে বললেন, এই লোকটি যে চেহারা নিয়ে গিয়েছিল তার পরিবর্তে অন্য চেহারা নিয়ে ফিরে এসেছে। তাই উছায়েদ (রাঃ)-কে সা‘দ বললেন, তুমি কি করেছ? উছায়েদ (রাঃ) বললেন, আমি তাদের সাথে কথা বলে আপত্তিকর কিছু পাইনি। তবে আমি তাদের নিষেধ করেছি। তারা বলেছেন, আপনারা যা চান আমরা তাই করব। আমি শুনেছি, বানু হারেছা গোত্রের লোকেরা আস‘আদকে হত্যা করতে চায়। কারণ সে আপনার খালাতো ভাই। ওরা আপনার সাথে কৃত ওয়াদা ভঙ্গ করতে চায়। এ কথা শুনামাত্র সা‘দ ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে বর্শা নিয়ে ওদের নিকটে পৌঁছলেন। অতঃপর সেখানে গিয়ে দেখলেন, দুজনই নিন্ডিমেত্ম বসে আছেন। তিনি বুঝতে পারলেন যে, উছায়েদ চেয়েছে যে, আমি দুজন আগন্তুকের সাথে কথা বলি। সা‘দ তাদের সামনে গিয়ে রুÿ ভাষায় বললেন, তোমরা আমাদের দুর্বল লোকদের বোকা বানাতে চাও? এরপর আস‘আদকে বললেন, আল্লাহর কসম হে আবু আনাস! তোমার ও আমার মধ্যে যদি আত্মীয়তার সম্পর্ক না থাকত, তাহলে তুমি এ কাজ করতে পারতে না। আমাদের এলাকায় এসে তোমরা এমন কাজ করছ, যা আমরা পসন্দ করি না। আস‘আদ বিন যুরারা (রাঃ) মুছ‘আব (রাঃ)-কে আগেই বলেছিলেন যে, আপনার কাছে এমন একজন লোক আসছেন, যিনি তার গোত্রের প্রভাবশালী নেতা। তিনি যদি ইসলাম গ্রহণ করেন, তবে কেউই তার পিছনে বাকী থাকবে না। এ কারণে মুছ‘আব (রাঃ) সা‘দ (রাঃ)-কে বললেন, আপনি বসুন, আমার কিছু কথা শুনুন। মনে লাগলে শুনবেন আর না হলে শুনবেন না, চলে যাবেন। সা‘দ বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে বলুন। একথা বলে তিনিও বর্শা মাটিতে পুঁতে বসে পড়লেন। মুছ‘আব (রাঃ) তাকে ইসলামের দাওয়াত দিলেন এবং কুরআন তেলাওয়াত করলেন। সা‘দ বললেন, তোমরা ইসলাম গ্রহণের পর কী কর? মুছ‘আব (রাঃ) বললেন, আপনি গোসল করুন। এরপর পবিত্র কপড় পরিধান করুন। তারপর দু’রাকা‘আত ছালাত আদায় করুন। অতঃপর সা‘দ ইবনে মা‘আয গোসল করলেন, কাপড় পরিধান করলেন এবং দু‘রাকা‘আত ছালাত আদায় করলেন। ইসলাম গ্রহণের পর সা‘দ (রাঃ) তাঁর নিজ গোত্রের নিকট ফিরে গেলেন। লোকেরা বলল, আপনি ভিন্ন চেহারায় ফিরে এসেছেন মনে হচ্ছে! সা‘দ (রাঃ) বললেন, তোমরা আমাকে কেমন মনে কর হে বনী আব্দুল আশহাল! সকলে সমস্বরে বলে উঠল, আপনি আমাদের কুশাগ্রবুদ্ধি ও জনপ্রিয় নেতা। বিবেক-বুদ্ধি ও বিবেচনায় সকলের শ্রেষ্ঠ। সা‘দ বললেন, তাহলে শোনো, তোমরা যতক্ষণ আল্লাহ রববুল ‘আলামীন ও তাঁর রাসূল মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর উপরে ঈমান না আনবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তোমাদের সাথে আমার কথা বলা হারাম। বিকাল পর্যন্ত উসায়রিম নামক জনৈক ব্যক্তি ব্যতীত গোত্রের সকলে ইসলাম গ্রহণ করল। তিনিও উহুদ যুদ্ধের দিনে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং উক্ত যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করেন। তাঁর সম্প©র্ক রাসূল (ছাঃ) বলেন, সে সল্প আমল করে অনেক বেশি প্রতিদান পেয়েছে (ইবনে হিশাম ১/৪৩৫ পৃঃ)।
এভাবে মুছ‘আব (রাঃ)-এর দাওয়াতে আনছারদের প্রতিটি পরিবার থেকেই কয়েকজন করে ইসলাম কবুল করেন। পরবর্তী হজ্জ মৌসুম আসার পূর্বেই তিনি এ সুসংবাদ নিয়ে রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে হাজির হন। তিনি রাসূল (ছাঃ)-কে মদীনার সামগ্রিক অবস্থার বিবরণ দেন। পরবর্তীতে তিনি স্বস্ত্রীক মুহাজিরদের সাথে আবার মদীনাতে হিজরত করেন। এবার তিনি ও তাঁর স্ত্রী হুমনা বিনতু জাহাস সা‘দ বিন মা‘আযের বাড়িতে অবস্থান করেন
বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ :
বদর যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণকারী ছাহাবীদের মধ্যে মুছ‘আব বিন উমায়ের (রাঃ) ছিলেন অন্যতম। বদর যুদ্ধের সেনা বিন্যাস ছিল এক দল আনছার অপর দল মুহাজির। মুহাজিরদের পতাকা ছিল আলী ইবনু আবু ত্বালেবের হাতে। পÿামত্মরে আনছারদের পতাকা ছিল সা‘দ বিন মা‘আযের হাতে। আর সম্মিলিত মুসলিম বাহিনীর পতাকা অর্পণ করা হয় মুছ‘আব বিন উমায়ের (রাঃ)-এর হাতে (আর-রাহীকুল মাখতূম, ২১২)।
যুদ্ধ শেষে মুছ‘আব তাঁর ভাই আবু আযীযের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। আবু আযীয মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। সেসময় আনছারী ছাহাবীর হাত কেটে গেল। মুছ‘আব (রাঃ) বললেন, এই লোকটির মাধ্যমে হাত শক্ত করুন। তার মাতা বড় ধনী। তিনি সম্ভবত তোমাকে মোটা অঙ্কে মুক্তিপণ দিবেন। তার ভাই আবু আযীয তাকে বললেন, ভাইরে; আমার ব্যাপারে তোমার এটাই অছিয়ত। মুছ‘আব (রাঃ) বললেন, তুমি নাও এই আনছারী আমার ভাই (রওযুল আনফ ৩/৯৫)। এভাবেই মুছ‘আব বিন উমায়ের (রাঃ) ছিলেন ঈমানের প্রতি অটল ও অবিচল। স্বজনপ্রীতি ও স্বদেশের মায়া তার মনকে কখনও হক্ব হতে বিন্দু মাত্র টলাতে পারেনি।
উহুদ যুদ্ধে অংশগ্রহণ ও শাহাদত বরণ :
রাসূল (ছাঃ) কাফেরদের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য মদীনা থেকে বেরিয়ে পড়লেন। তিনি সমগ্র সেনাবাহিনীকে তিন ভাগে ভাগ করলেন। যেমন- (ক) মুহাজির বাহিনী (খ) আনছারদের খাজরাজ বাহিনী (গ) আওস বাহিনী। মুহাজিরদের পতাকা মুছ‘আবকে প্রদান করা হয়। মুসলিমরা অত্যমত্ম বীরত্ব ও সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করছিলেন। এক সময় তারা বিজয়ের দ্বার প্রামেত্ম পৌঁছে গেল। কিন্তু তীরন্দাজদের মারাত্মক ভুলের কারণে যুদ্ধের মোড় ঘুরে গেল। মুসলমানরা চরম বিপদের সম্মুখীন হলেন। কাফেররা উম্মাদ হয়ে রাসূল (ছাঃ)-কে হত্যার জন্য তার দিকে প্রচন্ড আক্রমণ চালাতে লাগল। এক পর্যায়ে তারা তাকে ঘিরে ফেলল। মুছ‘আব পরিস্থিতির ভয়বহতা উপলব্ধি করলেন এবং তা প্রতিরোধের জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগলেন। এসময় তিনি ইবনু কোম্মার আঘাত প্রতিরোধ করছিলেন। দুর্বৃত্ত ইবনু কুম্মা প্রথমে তার ডান হাতে আঘাত করলে তা কেটে গেল। তখন তিনি তার বাম হাতে মুসলিম বাহিনীর পতাকা উত্তোলন করলেন। কিন্তু শত্রুর হামলায় তার বাম হাতও কেটে গেল। তখন তিনি পতাকাকে বাহুদ্বয়ের মাধ্যমে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরেন। অতঃপর সেই অবস্থাতেই তিনি শাহাদতের পেয়ালা পান করেন। তাঁর হত্যাকারী ছিল আব্দুল্লাহ ইবনে কুম্মা। এই দুর্বৃত্ত মুছ‘আবকে রাসূল (ছাঃ) মনে করেছিল। কেননা মুছ‘আবের চেহারা রাসূল (ছাঃ)-এর চেহারার সাথে কিছুটা মিল ছিল। মুছ‘আবকে হত্যা করার পর ইবনু কুম্মা কাফেরদের মধ্যে গিয়ে চিৎকার দিয়ে বলেছিল, আমি মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে হত্যা করেছি (ইবনে হিশাম ২/৭৩-৭৪ পৃঃ)। অথচ সে মুছ‘আব (রাঃ)-কে হত্যা করেছিল। তাঁর মৃত্যুর খবর মক্কার অলিতে-গলিতে প্রচার হতে থাকল। এক সময় তার স্ত্রী ওমনা বিনতু জাহসের নিকট পৌঁছল। এ খবর শুনে তার স্ত্রী হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। তখন রাসূল (ছাঃ) বললেন, প্রত্যেক নারীর স্বামীই তার কাছে বিশেষ মর্যাদার অধিকারী (আর-রাহীকুল মাখতূম, পৃঃ ২৬৫)।
দাফন ও কাফন :
মুছ‘আব বিন উমায়ের (রাঃ)-এর দাফন-কাফনের ঘটনা অত্যমত্ম করুণ ও বেদনাদায়ক। যা হাদীছে অত্যমত্ম আবেগময় অবস্থায় বর্ণিত হয়েছে। খাববাব ইবনুল আরাত (রাঃ) বলেন, আমরা আল্লাহর রাস্তায় আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সাথে হিজরত করেছিলাম। আমাদের এ কাজের প্রতিদান আল্লাহর নিকট রয়েছে। আমাদের মধ্যে যারা একাজের প্রতিদান মোটেও না নিয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে একজন মুছ‘আব বিন উমায়ের (রাঃ)। উহুদ যুদ্ধের দিনে তিনি শাহাদত বরণ করেন। তাকে দাফন দেওয়ার জন্য এক প্রস্থ চাদর ছাড়া কিছুই পাওয়া যাচ্ছিল না। যা তিনি রেখে গিয়েছিলেন। তা দিয়ে তার মাথা ঢাকলে পা ঢাকে না এবং পা ঢাকলে মাথা ঢাকে না। অবশেষে রাসূল (ছাঃ) আমাদেরকে বললেন, চাদর দিয়ে তার মাথা ঢেকে দাও, আর পা ‘ইযখির’ ঘাস দিয়ে ঢেকে দাও (বুখারী হা/৩৮৯৭, ‘নবী করীম (ছাঃ) ও তাঁর ছাহাবীদের মদীনায় হিজরাত’ অনুচ্ছেদ-৪৫; ছহীহ ইবনু হিববান হা/৭০১৯; বায়হাক্বী-শু‘আবুল ঈমান হা/১০৪০২; মুছান্নাফে আব্দুর রাযযাক হা/৬১৯৫)।
জীবনী থেকে শিক্ষা :
(ক) হক্বের পথে দৃঢ় থাকতে গেলে পারিবারিক বাধা আসা স্বাভাবিক। কিন্তু সেই বাধাকে নির্ভয়, সাহস ও কৌশলে মোকাবেলা করাই প্রত্যেক মুমিনের ঈমানী দায়িত্ব।
(খ) মানুষকে দাওয়াত দেওয়ার সময় তার সাথে নরম ভাষায় কথা বলতে হবে এবং তাদেরকে বুঝানোর চেষ্টা করতে হবে।
(গ) ঈমানের তাকীদে প্রয়োজনে হিজরত করতে হবে ।
(ঘ) দাওয়াতের ÿÿত্রে সফলতার জন্য খালেছ নিয়ত থাকা আবশ্যক।
(ঙ) পিতা-মাতার আদেশ মান্য করা ফরয। কিন্তু সে আদেশ যদি কুরআন ও সুন্নাতের পরিপন্থী হয়, তাহলে তা পরিত্যাগ করাও আবশ্যক।
উপসংহার :
ধৈর্য ও অটল বিশ্বাসের প্রাণপুরুষ ছিলেন মুছ‘আব বিন উমায়ের (রাঃ)। তাঁর প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব ও হিকমতপূর্ণ কার্যাবলী সত্যিই প্রশংসার যোগ্য। বর্তমান বিশ্বের মুসলিম ও অনাগত ভবিষ্যতের মুসলিম যুবকদের জন্য বিশেষ করে আহলেহাদীছ নওজোয়ানদের জন্য তাঁর জীবনাদর্শ অনুকরণীয় এবং তাদের সংগ্রামী জীবনে নিত্য প্রেরণা যোগাবে বলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস।
মুহাম্মাদ তামীমুল ইসলাম
আলিম প্রথম বর্ষ, আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, নওদাপাড়া, রাজশাহী