সুন্নাতের দুর্ভিক্ষ ও দৃপ্ততেজী তারুণ্য
ইলিয়াস বিন আলী আশরাফ
তাওহীদের ডাক ডেস্ক 973 বার পঠিত
(এক)
আমার জন্ম যশোরে। শীতের ছুটিতে মামার বাড়িতে যেতাম। যশোরের কথা মনে হতেই চোখে ভাসে একটা আলো। ভোরবেলা ছন-ঢাকা মটর গ্যারেজে বাল্ব জ্বলছে কুয়াশার চাদর ভেদ করে। আলো আমি বহু দেখেছি। এরপরেও, শিকাগো কিংবা নিউইয়র্কের চোখ ধাঁধানো আলোর মালা সেই টিমটিমে বাতিটিকে হারাতে পারেনি এখনও। মুহাম্মাদপুরে কেটেছে শৈশব। হয়ত গুলশানের রাস্তাগুলো আরো সুন্দর, বনানীর বাড়িগুলো আরো বনেদি। কিন্তু আজো পৌনে দু’কাঠার পোকামাকড়ের ঘরবসতিগুলোই মনকে আর্দ্র করে। মনে গেঁথে আছে সেন্ট যোসেফের বিশাল সব গাছের ছবি। হয়ত সেন্ট প্লাসিডসের গাছগুলো আরো সজীব, আরো সবুজ; কিন্তু সেগুলোর জন্য আমার মনে ব্যাকুল কোন আকুলতা নেই। মানুষ নস্টালজিক প্রাণী। সে যেখানে বেড়ে উঠেছে তার সাথে হৃদ্যতা থেকে যায় মৃত্যু অবধি। বাংলা অভিধান মতে দেশ মানে স্থান। শৈশব-কৈশোর-তারুণ্যের স্মৃতিবিজড়িত স্থানটিকে মানুষ ভালোবাসে। এই ভালোবাসার নাম দেয়া যায় দেশপ্রেম। যে মানুষগুলোকে সে ছোট থেকে দেখে এসেছে, তাদের জন্য টান থেকে যায় মনে। এই টানের জন্মও সেই দেশপ্রেম থেকেই।
মানুষ বাঁচে কেন? একটা স্বপ্ন নিয়ে। গরু স্বপ্ন দেখে না, তার প্রতিবেলা দু’আঁটি ঘাস আর রাতে একটা খুঁটি হলেই চলে। কিন্তু মানুষের চলে না। কেউ যদি মানুষ হয় তাহলে সে শুধু নিজেকে নিয়ে থাকতে পারে না। ব্যক্তিভেদে স্বপ্নের পরিসর বদলায়। সবচেয়ে যে ছোট, তার স্বপ্ন শুধুই তার সন্তানদের নিয়ে। তার চেয়ে যে বড়, সে স্বপ্ন দেখে একটা গরীব বাচ্চার পড়ার খরচ দেবে। আরো যে বড়, সে স্বপ্ন দেখে গাঁয়ে কোন অভাবী লোক থাকবে না, খালের উপারের নড়বড়ে বাঁশের সাকোর উপর একটা ছোট্ট ব্রিজ হবে। কেউ স্বপ্ন দেখে একটা হাসপাতালের। সামর্থ্য নেই, তবু আশা থাকে মনের কোণে। মানুষ যখন আত্মকেন্দ্রিকতার উপরে ওঠে, তখন সে তার চারপাশের এলাকার জন্য, মানুষের জন্য কিছু করতে চায়। এ স্বপ্নগুলোর জন্ম একটা আদর্শ থেকে। এই আদর্শের নাম দেশপ্রেম।
বিশ্বায়নের এ যুগে এই আদর্শটা ক্রমেই রূপ বদলাচ্ছে। মানুষ স্বদেশ পাড়ি দিয়ে পরবাসে গিয়ে থিতু হচ্ছে ভাল থাকা ও খাওয়ার আশায়, তথাকথিত উন্নত জীবনযাপনের মোহে। মাতৃভূমিতে যারা আছে, তারাও মত্ত ভোগবাদী জীবনধারাতে। রাতদিন জীবনকে উপভোগের পালায় যখন হঠাৎ ছেদ পড়ে, বিবেকবোধ আত্মাকে তখন সজোরে ধাক্কা মারে। সে মুহূর্তে বিবেককে স্তব্ধ করতে যে আত্মপ্রবঞ্চনার সাহায্য নেওয়া হয়, তার নামও দেশপ্রেম বটে।
(দুই)
ধর্মবোধ সাধারণত মানুষের আদর্শের উৎস হিসাবে কাজ করে। এক সময় চার্চের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ইউরোপের মানুষেরা জেগে উঠেছিল। অত্যাচারী-অনাচারী খ্রিষ্ট ধর্মকে তারা তাড়িয়ে দেয় আদর্শগত অবস্থান থেকে। কিন্তু আদর্শের স্থানটা খালি থাকে না কখনই। আধুনিক মননে আদর্শের শূন্যস্থান পূরণ করে জাতীয়তাবাদ। মাতৃভাষা ও মাতৃভূমির প্রতি মানুষের সহজাত ভালোবাসাকে পুঁজি করে ভাষা ও সংষ্কৃতিকেন্দ্রিক বিভাজন শুরু হয়। ইতিহাসকে ভেঙে গড়া হয়, স্বজাতির দুর্বৃত্তদের জাতীয় বীর হিসাবে উপস্থাপন করা হয়। রক্তখেকো নেপোলিয়নকে হাযির করা হয় আদর্শবান ফরাসী নেতা হিসাবে। গণহত্যার দায়ে দুষ্ট অলিভার ক্রমওয়েলকে ব্রিটিশরা নির্বাচিত করে সেরা দশ ব্রিটিশদের একজনে, ভুলে যায় যে এই লোকই বিদ্রোহ দমনের নামে আইরিশ মেয়েদের মুখ চিরে দিত ক্ষুর দিয়ে। পৃথিবীর সভ্যতার দু’হাযার বছরের ইতিহাসের ঐক্যের কলতানকে ছাপিয়ে ভাঙনের বাঁশি প্রবল হয়। মিলগুলোকে বলা হয় গৌণ, অমিলগুলোকে মুখ্য। দার্শনিকেরা আপন জাতিকে শ্রেষ্ঠ হিসাবে প্রমাণের জন্য বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্বৃত্তপনায় নেমে পড়েন নির্দ্বিধায়। জর্জ অরওয়েলের ভাষায়-
Nationalism is power-hunger tempered by self-deception. Every nationalist is capable of the most flagrant dishonesty, but he is also—since he is conscious of serving something bigger than himself—unshakeably certain of being in the right.1
জাতীয়তাবাদ কী? এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকার মতে, যখন কোন ব্যক্তির আনুগত্য এবং অনুরাগ সব কিছুকে ছাপিয়ে দেশের প্রতি ন্যস্ত হয়, তখন সেই আদর্শকে জাতীয়তাবাদ বলে। তার মানে রাষ্ট্র যা করবে তাকে শুধু মেনেই নিলে চলবে না, তাকে তার আদর্শে লালনও করতে হবে। এই আদর্শের মূল যে কত গভীরে প্রোথিত হতে পারে তার প্রমাণ পাওয়া যায় ভিয়েতনামে আমেরিকান নৃশংসতার সমর্থকদের স্লোগানে- `My country, right or wrong' কিংবা `America, love it or leave it'
এই স্লোগান অতীত হয়ে গেছে এমন ভাবার অবকাশ নেই। আজো এই বাংলাদেশে প্রচলিত ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’র বিপক্ষে কিছু বললে তাকে পাকিস্তান বা আফগানিস্তানে চলে যেতে বলা হয়।
দেশপ্রেমের মত সহজাত একটি প্রবৃত্তির দুর্বৃত্তায়ন হল কিভাবে? জাতীয়তাবাদের হাতে দেশপ্রেম ছিনতাই হয় সেক্যুলার জাতিভিত্তিক রাষ্ট্রের ধারণা পৃথিবীতে প্রবল হবার পর। রাষ্ট্রনায়করা পরিকল্পিতভাবেই দেশপ্রেম আর জাতীয়তাবাদের সীমানা মুছে একে অপরের সমার্থক করে ফেলেছিল। কেন? কারণ দেশপ্রেম মানুষ তাড়িয়ে নেবে এমন একটা হাতিয়ার। অন্যায়কে ন্যায় বানাতে একটা আদর্শিক ভিত্তি লাগে। আর দেশপ্রেম সেই ভিতটা দেয়। ১৯৭১ সালে যারা পাকিস্তান নামক দেশটার প্রেমে অন্ধ ছিল তারা পাক আর্মিদের নৃশংসতায় সাহায্য করেছে। রাষ্ট্রের আনুগত্যের সংজ্ঞায় এরাও দেশপ্রেমিক ছিল। যদি আজ বাংলাদেশ স্বাধীন না হত, রাজাকারের বদলে এরা এখন পরিচিত হত দেশপ্রেমিক, দেশের সূর্যসন্তান হিসাবে। আর মুক্তিযোদ্ধারা বিবেচিত হতো বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী হিসাবে, কুলাঙ্গার হিসাবে। এভাবেই জাতীয়তাবাদী দেশপ্রেম ভাল-মন্দের ব্যবধান ঘুচিয়ে দেয়, নতুন একটা সীমারেখা তৈরী করে। যত অত্যাচারী শাসকই হোক না কেন, যত অন্যায় আহবানই হোক না কেন দেশপ্রেমের দাবী হচ্ছে সে অন্যায়কে ন্যায় মেনে তার পক্ষে কাজ করা। একই কাজ হিটলার করিয়েছিল জার্মান জাতিকে দিয়ে। পিতৃভূমির উচ্চ মর্যাদার রক্ষার্থে লক্ষ মানুষের মৃত্যুও আপত্তিকর মনে হয়নি সাধারণ জার্মানদের কাছে। দেশপ্রেমের থাবা থেকে বাঁচতে পালিয়ে যেতে হয়েছে বিবেকবানদের। এই দেশপ্রেমের দোহাইয়ে পাকিরা তৈরী করে দিল শান্তিবাহিনী। তারা মানুষ মেরে শান্তি আনতে চাইল এ বাংলায়। এই দেশপ্রেমের ডাক আমরা আজও শুনতে পাই: ‘শিক্ষা-শান্তি-প্রগতি’ যাদের মূলমন্ত্র তারা মানুষ ধরে ধরে যবাই করে দেওয়ার আহবান জানায়। যে মঞ্চ থেকে বিচারের দাবি ওঠে সেই একই মঞ্চ থেকে বিচারের রায় দিয়ে দেওয়া হয়। আকাঙ্খিত রায় না পেলে কী পরিণাম হবে তাও জানিয়ে দেওয়া হয়। রাষ্ট্রাধীন আদালত অবমানিত হতে ভুলে যান। আমরা দেশপ্রেমের ঠুলি চোখে বেঁধে পুরো ব্যাপারটার প্রহসন উপেক্ষা করি।
(তিন)
দেশপ্রেমিক ব্যবহার করার সবচেয়ে সফল অস্ত্র তাকে একটি ধর্ম হিসাবে গড়ে তোলা। ফরাসী সমাজতান্ত্রিক তাত্ত্বিক গুস্তাভো হার্ভে বলেছিলেন, For the patriotism of modern nations is a religion (Notes on Nationalism" (Polemic, No 1, October 1945, May 1945( . এ দেশেও মানুষের আবেগকে পুঁজি করে ক্ষমতালোভীরা নতুন একটি ধর্মের প্রবর্তন করেছে বাঙালি জাতীয়তাবাদ। সে ধর্মের দোহাই দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের আগে ও পরে উর্দূভাষীদের কচুকাটা করা হয়েছিল। পাকরা না, বাঙালিরা করেছিল। যারা বেঁচে গিয়েছিল তাদের করা হয়েছিল খোঁয়াড়ে বন্দী। এখনও ঢাকার বুকে সেই ‘ক্যাম্প’গুলো স্বগৌরবে বর্তমান। দেশ স্বাধীনের পরে ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারী অবাঙালিদের উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছিল, ‘বাঙালি হয়ে যাও’। একটি ধর্ম নাযিল হতে সময় লাগে। বাঙালি ধর্ম নাযিল হয়নি এ পৃথিবীতে, বরং বঙ্গদেশে উৎপাদিত হয়েছিল।
প্রতিটি ধর্মের দু’টি দিক আছে বিশ্বাস, creed ও আচার-প্রথা, rituals। বাঙালি ধর্মের বিশ্বস্ত বাঙালি সংষ্কৃতি এবং বাংলাদেশের রাষ্ট্রযন্ত্রের আনুগত্য। নামে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ হলেও মূলতঃ হিন্দু বিশ্বাস ও সংষ্কৃতিকে বেছে নেওয়া হয়েছে বাঙালি ধর্মের জন্য। ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞতা এবং পূর্বপুরুষে দেবীপূজার রীতি থাকায় দেশকে মা হিসাবে মেনে নিতে সমস্যা হয়নি বাঙালি মুসলিমদের। জাতীয় সঙ্গীতে গাওয়া হল, ‘মা, তোর বদনখানি মলিন হলে...।' যে তরুণ প্রজন্ম বিজ্ঞানমনষ্ক হিসাবে গর্ব করছে তারাও ভেবে দেখে না প্রকৃতির মুখাবয়ব আছে কিনা। যা নেই তা মলিন হতে পারে কিনা। দেশাত্মবোধে সেজদা করা হলো বিশ্বমাতাকে সেজদা করার ন্যায়। যেমন,
ও আমার দেশের মাটি, তোমার পরে ঠেকাই মাথা।
তোমাতে বিশ্বময়ীর, তোমাতে বিশ্বমায়ের আঁচল পাতা ।
নিশ্চল প্রকৃতিকে আল্লাহর গুণাবলী দেওয়া হলো নির্দ্বিধায়;
তুমি অন্ন মুখে তুলে দিলে,
তুমি শীতল জলে জুড়াইলে,
তুমি যে সকল-সহা সকল-বহা মাতার মাতা।।
কৃষক রোদে জ্বলে, পানিতে ভিজে ধান উৎপাদন করে তার পেটে লাথি মারতে হবে ধানের দাম কমিয়ে। আর বন্দনা করতে হবে অন্নদাত্রী মায়ের, আল্লাহর এক নাম যে আর-রযযাক, সে কথা ভুলেও মুখে আনা যাবে না। ‘রববুল ‘আলামিন’ নামটা সূরা ফাতিহাতে তালা মেরে আটকে রেখে দিতে হবে, বাস্তব জীবনে গাইতে হবে মাতার জয়গান। আসলে কী রাষ্ট্র আর মা এক? মা কি বদলানো যায়? আমার দাদার ‘মা’ ভারতকে ভেঙে নতুন ‘মা’ বানানো হয়েছিল পাকিস্তান। আমার বাবারা নতুন মাকে আবার ভাঙলেন, এলো বাংলাদেশ। আমার বাবারা ভারত মাকে ঘৃণা করা শিখলেন, আমাদের ঘৃণা করতে শেখানো হল পাকিস্তানকে। নতুন মাকে ভালোবাসার শর্ত এটাই আগের মাকে ঘৃণা করতে হবে। যে মা, মাটিকে রক্ষা করার জন্য প্রাণত্যাগের সংকল্প করা, সেই মায়ের উপরেই হামলে পড়তে হবে ক’দিন পরে। যে মাকে মানুষ কাটে, মানুষ জোড়া লাগায় তাকে ‘ইলাহ্’ হিসাবে মেনে নিতে হবে, প্রকৃত বাঙালি হতে হলে।
নানা ধর্মের মতো বাঙালি জাতীয়তাবাদ ধর্মে নানা প্রথাগত আচরণও আছে যেমন, বিমূর্ত মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে পুষ্প অর্ঘ্য দেওয়া, চেহারায় পতাকার তিলক আঁকা, মোমবাতি জ্বেলে শোক জানানো, মৃতদের উদ্দেশ্যে চিঠি লেখা কিংবা আকাশে ফানুশ ওড়ানো। এ ধর্মে আছে উৎসব শহীদ, স্বাধীনতা কিংবা বিজয় দিবস। আছে তীর্থস্থান শিখা অনির্বাণ, শহীদ মিনার আর স্মৃতিসৌধ। আছে উৎসর্গ বিরুদ্ধবাদীদের জীবন, সাধারণ মানুষের জীবন। এ ধর্মে দীক্ষিতরা নেকী কামানো চকচকে চোখে স্লোগান দিয়ে রাজপথ কাঁপায় ‘ধরে ধরে যবাই করো’; পিছনে থাকে রাষ্ট্রের রক্ষীবাহিনী। বাঙালি ধর্মের জন্য আলাদা উপাসনালয় লাগে না, বিদ্যালয়ই আচ্ছা। শিশুরা জাতীয় পতাকাকে সালাম করে, জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে দিন শুরু করে। ‘চেতনা’ধারী নবী সেজে ধর্মগ্রন্থ লেখেন, শিশুরা তা পড়ে পাঠ্যবইয়ে, বুড়োরা সংবাদপত্রে। লিও তলস্তয় বড় চমৎকারভাবে বর্ণনা করে গেছেন পদ্ধতিটা,
In the schools, they kindle patriotism in the children by means of histories describing their own people as the best of all peoples and always in the right. Among adults they kindle it by spectacles, jubilees, monuments, and by a lying patriotic press.
(চার)
বাঙালি ধর্মে পীর প্রথাও বিদ্যমান। রাজনৈতিক নেতারা মুরীদদের পার্থিব স্বপ্ন দেখায় দশ টাকার চাল, ঘরে ঘরে চাকরি, পদ্মা সেতু ইত্যাদি ইত্যাদি। পীরদের খাদেম হিসাবে থাকে মুক্ত মনারা, বণিকেরা, প্রশাসনিক চাটুকারেরা। পীর এবং খাদেমদের গাড়ির বহর, বাড়ির উচ্চতা দীর্ঘ হতে থাকে। মানুষ সবই বোঝে তাও পাঁচ বছরে একবার গিয়ে ভোটের নযরানা দিয়ে আসে। ভোট কিনে পীরেরা রাষ্ট্রের মালিক বনে যায় সুখ আর সুখ। বিদেশী গ্যাস-তেল কোম্পানির কাছে মায়ের রক্ত বিক্রির সুখ। মায়ের আকাশ মুক্ত রাখতে বিমান কেনার সুখ। সুখের আগুন থেকে বেরিয়ে আসে শেয়ার বাজার, হলমার্ক, ডেস্টিনি, কাল বেড়াল নামের কিছু স্ফুলিঙ্গ। সুখের আগুনের জ্বালানী হয় সীমান্তের মানুষ, পিলখানার সেনাকর্মকর্তা, ক্ষমতাচ্যুত পীরের অবুঝ মুরীদেরা। ১৯০৫ সালে গুস্তাভো হার্ভে যা বুঝেছিলেন তা আমরা আজো বুঝিনি,
A country of the present time is nothing but this monstrous social inequality, this monstrous exploitation of man by man.
আস্তে আস্তে পৈত্রিকসূত্রে ধর্ম পাওয়া মুসলিমরা বিশ্বাস আনে বাঙালি জাতীয়তাবাদে, সংষ্কৃতি হিসাবে তারা যেটা ধারণ করে তাকে দেখতে কখনো কখনো ইসলামের মতো লাগে বৈকি। তারপরেও হঠাৎ একদিন বাঙালি ইসলাম আর বাঙালি জাতীয়তাবাদে ঠোকাঠুকি লেগে যায়। তখন বাঙালি জাতীয়তাবাদের দীক্ষা দেয়া হয় ইসলাম শিক্ষা বই থেকে: দেশপ্রেম ঈমানের অর্ধেক।
(পাঁচ)
ধর্ম হিসাবে দেশপ্রেম বড্ড একচোখা। রবীন্দ্রনাথের উপাধি ‘বিশ্বকবি’ আমরা জানি। উদ্দেশ্য বাংলা পরীক্ষায় বেশি নম্বর। তিনি যে সীমান্তের বেড়াজাল কাটিয়ে বিশ্বমানবতার মধ্যে ঐক্যের সূত্র বাঁধতে চেয়েছিলেন সে উপলব্ধিটা আমাদের কখনোই শেখানো হলো না। দেশ বলতে যদি রাষ্ট্র ধরা হয় তবে তার উপকরণ দু’টি মাটি ও মানুষ। মাটি মানে প্রকৃতিঅবোধ নদী, মূক পাহাড়, শ্যামল সবুজ, সজীব সব না-মানুষ। এদের সবার জীবন আছে, ভাষা আছে যদিও তা আমাদের বোধের বাইরে। দেশপ্রেম বলতে যদি আমরা বুঝি রাষ্ট্রের সীমানাকে ঘিরে ভালোবাসা তাহলে পঞ্চান্ন হাযার বর্গমাইলের বাইরের প্রকৃতিকে কি ভালোবাসতে নেই? সবই তো একই স্রষ্টার সৃষ্টি। আর যদি দেশপ্রেম বলতে আমরা বুঝি দেশের মানুষকে ভালোবাসা তাহলে প্রশ্ন আসে কেন শুধু দেশের মানুষকে ভালোবাসতে হবে, কেন গোটা দুনিয়ার মানুষকে নয়? মানবিকতাকে কাঁটাতারে আবদ্ধ করার যুক্তি কী?
১৯৪৭ সালের ৮ই জুলাই জীবনে প্রথমবারের মত ভারতে আসার পর সাইরিল রেডক্লিফকে দায়িত্ব দেয়া হল ভারত ভাগ করে দাও। তিনি টেবিলে বসে কলম চালালেন, সীমান্ত তৈরী হ’ল। আমার দাদাকে বলা হ’ল, পশ্চিম দিনাজপুরের যে গ্রামটিতে তুমি বড় হয়েছ সেটা এখন ভারত। তুমি পাকিস্তানী। তল্পি-তল্পা গোটাও। এক অপরিচিত জায়গায় বসিয়ে তাকে জানানো হল এটা তোমার দেশ, একেই তোমার ভালোবাসা দিতে হবে। শৈশবের গ্রাম, গ্রামের মানুষগুলো আর তোমার আপন কেউ না। তোমাকে এখন প্রেম করতে হবে চট্টগ্রামের মানুষের সাথে, যাদের একটা কথাও তুমি বোঝ না। রাষ্ট্রীয় আদেশে প্রেম। ধর্ম হিসাবে বাঙালি দেশপ্রেম যে আসলে প্রাক্তন ব্রিটিশ প্রভুদের সংজ্ঞার উপরে টিকে আছে এই তথ্যটুকুই ধর্মটা মিথ্যা হবার জন্য যথেষ্ট।
আমরা বিশ্বাস করি এই মহাবিশ্বের সৃষ্টিকর্তা একজনই এবং এই পৃথিবীর মালিক তিনিই। আমাদের আগে বহু মানুষ এসেছিল, যারা ‘দেশ আমার, মাটি আমার’ বলে মিথ্যা গর্ব করেছিল। এই দেশ, মাটি একই আছে কিন্তু সেই মানুষগুলো মাটির তলায় চলে গেছে। যখন আমরা এই পৃথিবীতে আসিনি তখন আমাদের দেশ কী ছিল? আমরা যখন মরে যাবো তখন আমাদের দেশ হবে কোনটা? মাটির তলায় কোন রাজার রাজত্ব চলে? কোন পুলিশ ডান্ডা মারে? কোন আদালত বিচার করে? যিনি বলেছেন, ‘তিনি আগে বাঙালি পরে মুসলিম’ তিনি কি দেশের নেতাদের আল্লাহর উপরে স্থান দিচ্ছেন না? এই নেতাদের চরিত্র কী আমরা ভালো করে জানি না? এরা যে আমাদের আখেরাতে কেন দুনিয়াতেই জাহান্নাম দেখানোর জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করে সেটা কি আমরা বুঝি না? এদের আমরা আল্লাহর চেয়েও বেশি ভালোবাসছি? এদের ক্ষমতা দখলের লোভে আমরা আমাদের জীবন বিকিয়ে দিচ্ছি? আমরা এত জেনে-বুঝেও এদের হাতের পুতুল হচ্ছি?
আমরা মুসলিমরা বিশ্বাস করি যে, এই বাংলাদেশ না, পৃথিবীটাও না আমাদের সত্যিকারের দেশ জান্নাত। আমরা সেই জান্নাতের জন্য কাজ করি যেখানে আমরা একদিন ছিলাম, যেখানেই আমরা যেতে চাই। তাই আমরা প্রকৃতির বদলে প্রকৃতির স্রষ্টা আল্লাহকে একমাত্র ইলাহ হিসাবে মেনে নিয়েছি। আমরা এই পৃথিবীর ভন্ডদের না, মুহাম্মাদ ছাল্লালাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আমাদের নেতা হিসাবে মেনে নিয়েছি। দু’টিই আমাদের সচেতন প্রয়াস। আমরা জানি, কেন এই বেছে নেওয়া? যদি এই অবস্থানকে অক্ষুণ্ণ রাখতে গিয়ে পৃথিবী থেকে চলে যেতেও হয় আমরা রাজি। পৃথিবী কখনোই আমাদের ছিল না, সেটাকে ঘিরে স্বপ্নও তাই আমরা সাজাই না। আমরা সাধারণ মানুষের পার্থিব ও পারলৌকিক মঙ্গলের জন্য সাধ্যে যা কুলায়, তাই করতে চাই। এই মঙ্গল কামনাটাও সীমানা দিয়ে আবদ্ধ নয়। আমরা এই দেশের মানুষের জন্য যা চায়, সারা দুনিয়ার মানুষের জন্যও তাই চায়। আমাদের কাছে এটাই দেশপ্রেম। আর এই দেশপ্রেমের উদ্দেশ্য মানুষের মনোতুষ্টি নয়, একুশে পদক পাওয়া নয়, ববং আল্লাহকে সন্তুষ্ট করা। আল্লাহ যেন আমাদের আবেগটাকে সৎ কাজে ব্যবহার করার তৌফিক দেন, মন্দ মানুষদের চক্রান্ত বোঝার তৌফিক দেন, ইসলাম বুঝে জীবনটাকে অর্থবহ করার তৌফিক দেন! আমীন!
শরীফ আবু হায়াত অপু
মুহাম্মাদপুর, ঢাকা।