শেকড়ের টানে, স্মৃতির নায়ে
ফারহান দাউদ
তাওহীদের ডাক ডেস্ক 3066 বার পঠিত
সময়
ও কালের চিরাচরিত নিয়ম অনুযায়ী পুরাতনকে বিদায় জানিয়ে সূচনা হয় নতুনের।
ঠিক সেই নিয়ম অনুসারেই পরিবর্তন এসেছে আন্তর্জাতিক ক্যালেন্ডারের শিরোনামে।
২০১৩-কে বিদায় জানিয়ে নতুন করে পদযাত্রা শুরু হয়েছে ২০১৪ সালের। ‘১
জানিুয়ারী’-কে বলা হয় ইংরেজী নববর্ষের প্রথমদিন। খ্রিষ্টীয় নববর্ষ হিসাবে
‘১ জানুয়ারী’ উৎযাপন শুরু হয় কয়েকশ’ বছর আগে। সর্বপ্রথম নববর্ষ উৎযাপন শুরু
হয় খ্রিষ্টের জন্মের ২০০১ (দু’হাযার) বছর আগে। আর সে সময় ‘১ মার্চ’-কে বলা
হত নববর্ষের প্রথমদিন। কারণ রোমান দিন পঞ্জিকা অনুসারে মার্চ থেকে
ডিসেম্বর এই দশ (১০) মাসে বছর গণনা হত।
১ জানুয়ারী নববর্ষের প্রথম দিন হিসাবে গণনা শুরু হয় খ্রিষ্টের জন্মের ১৫৩ বছর আগ থেকে। সে সময় জুলিয়াস সিজার প্রাচীন রোমান দিন পঞ্জিকায় ১ জানুয়ারীকে বছরের প্রথম দিন হিসাবে অন্তুর্ভুক্ত করেন। মধ্যযুগীয় সময়ের ৫৬৭ খ্রিষ্টাব্দে ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে এটি চালু হয়। তবে ১৫৮২ সালে গ্রেগরিয়ন দিন পঞ্জিকা অনুযায়ী ১ জানুয়ারী বছরের প্রথম দিন হিসাবে চালু করা হয়। আর বৃটিশরা তাদের পার্লামেন্ট গ্রেগরিয়নদের ক্যালেন্ডারকে নিজেদের ক্যালেন্ডার হিসাবে গ্রহণ করে (দৈনিক সমকাল, ১ জানু, ২০১৩)। যাই হোক সময় ও কালের বিবর্তনে মানুষ ১ জানুয়ারীকেই ইংরেজী নববর্ষের প্রথম দিন হিসাবে গ্রহণ করেছে। কিন্তু এই দিনটিকে ঘিরে মানুষ যে স্বপ্নিল আয়োজন করে চলছে তার লাভ বা স্বার্থকতা অথবা ধর্মীয় স্বীকৃতিটাই বা কতোটুকু? সূর্য মহান আল্লাহ হুকুমেই পূর্বাকাশে উদিত হয়ে পশ্চিমাকাশে অস্ত যায়। ৩১ ডিসেম্বার, ২০১৩-তেই নিয়মের কোন ব্যতিক্রম ছিল কি? যদি নাই থাকে তাহলে কেন কুয়াকাটা, কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকতসহ পৃথিবীর বিভিন্ন সমুদ্র সৈকতে এই দিনটিতে লাখো মানুষের সমাগম ঘটে? কেনইবা লাখো মানুষ তাদের মূল্যবান সময় ও অর্থ নষ্ট করে বছরের শেষ দিনে সূর্যের অস্তলগ্ন মুহূর্তাটি দেখতে গিয়েছিল? তাদের সমাগমে এটাই মনে হচ্ছিল যেন বছরের প্রথম দিন সূর্যের উদয় হয়েছে আর আজ শেষ দিনে অস্ত যাচ্ছে। এর মাঝে একদিনও অস্ত যায়নি। আর এ সকল আয়োজনের মধ্য দিয়ে শুরু হয়ে যায় পুরাতনকে বিদায় জানিয়ে নতুন বছরকে গ্রহণ করার বহুমুখী কর্মসূচী।
বিশ্বের সকল দেশের উন্নত হোটেল আর রেস্টুরেন্টগুলো লক্ষ- কোটি টাকা ব্যয়ে আয়োজন করে এই বর্ণিল অনুষ্ঠানের। বিভিন্ন রঙ্গের মসৃণ কাপড় ও বাইরের সবগুলো পয়েন্ট লাল, নীল, সবুজ বঙ্গের রঙ্গীন আলোয় আলোকিত করা হয় হোটেল রেস্টুরেন্টের সর্বত্র। আর টেবিলগুলোতে শোভা পায় রকমারি স্বাধের নামি দামি খাবারসমূহ। হোটেল আর রেস্টুরেন্টগুলো সাজসজ্জা ও আলোকিত করাটা কয়েক যুগের পুরনো ঐতিহ্য হলেও বিগত কয়েক বছর থেকে নতুন সাজে সাজানো হচ্ছে গিফট কর্ণারগুলো। নতুন বছরকে কেন্দ্র করে বাহারি ডিজাইনের নযর কাড়া উপহার সামগ্রী শোভা পাচ্ছে সেই সব দোকানগুলোতে। আতশবাজি আর রঙ্গ মাখামাখিতো পুরা দিনটির মৌলিক কাজে পরিণত হয়। এবছরে আতশবাজি প্রদর্শনীতে বিশব রেকর্ড গড়েছে দুবাই। দেশটির উপকূলে ৯৪ বর্গ কি.মি. ব্যাপি এই প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। ৬ মিনিট ব্যাপী আতশবাজি প্রদর্শনীতে ৫ লক্ষ মানুষ অংশ নেয়। যার প্রস্ত্ততি চলছিল বিগত দশ (১০) মাসব্যাপী। কুয়েতে ১ ঘন্টাব্যাপি প্রদর্শনীতে ৭৭ হাযারের বেশী আতশবাজির সমাগম ঘটে। প্রধান প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয় বিশ্বের সর্বোচ্চ ভবন বুর্জ খলিফা এবং অভিজাত হোটেল আটলান্টায় । তার পরিকল্পনায় ছিল একটি মার্কিন কোম্পানী। ১০০ (একশত) কম্পিউটার, ২০০ (দু’শত) প্রকোশলী এবং ৬ মিলিয়ন অর্থের প্রয়োজন হয় এই আয়োজনে (এন.ডি.টিভি পত্রিকা, ২ জানু, ২০১৪)।
বিবেকবান পাঠকের কাছে প্রশ্ন, ইরাক আফগানিস্তান মিয়ানমার সহ সারা বিশ্বের লক্ষ-কোটি মুসলমান যেখানে খাদ্যাভাবে ক্ষুধার তাড়নায় না খেয়ে মরছে, যাদের আর্তচীৎকার ও মির্মম আহাজারিতে ভারি হচ্ছে আকাশ বাতাস, লুন্ঠিত হচ্ছে হাযারো মুসলিম মা-বোনের ইয্যত, সে সময় মিলিয়ন মিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যায়ে কিসের নেশায় মত্ত হয়েছে? দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এ সকল আয়োজনে উন্নত ও পশ্চিমা দেশগুলো থেকে পিছিয়ে পড়ে নেই বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ হিসাবে পরিচিত আমাদের এই বাংলাদেশ। রাজধানী রূপালি বাংলা পাঁচতারা হোটেলগুলো সহ দেশের সবগুলো যেলার নামিদামি হোটেলগুলোতেও আয়োজন করা হয় বর্ষ বরণের বিভিন্ন স্বপ্নিল অনুষ্ঠানের। বিভিন্ন জায়গায় আয়োজন করা হয় বড় বড় কনসার্টের। আর সে সকল কনসার্টের মঞ্চ কাঁপাতে দেশের বড় বড় শিল্পীও শিল্পগোষ্টীকে অনেক আগে থেকেই সিরিয়াল দিয়ে নিয়ে আসা হয় একটু বেশি দামে। অনেক আগে থেকেই বুকিং চলে ডেকোরেশন ও কমিউনিটি সেন্টারগুলোতে। আর এসকল আয়োজনের মধ্যদিয়ে সন্ধ্যা থেকে নেচে গেয়ে যখনই রাত ১২টা বাজে সবাই মিলে হৈচৈ করে আতশবাজি ও পটকা ফুটিয়ে আর বাহারি স্বাধের খাবার খাওয়ার মধ্য দিয়ে নতুন বছরকে বরণ করে। আর একেই নাকি বলে ‘Thirty first Night’। আর এক শ্রেণীর মানুষ (?) মদ, আফিম, ফেনসিডিল ভক্ষণ করে মেতে উঠে জঙ্গলের হিংস্র হায়নার মত উন্মাদ হয়ে মহাযজ্ঞের সর্বগ্রাসী ধ্বংসাত্মক কর্ম নারী ভোগের মরণ নেশায়। এই একটি রাতকে কেন্দ্র করেই বিশ্বের লক্ষ-কোটি নারীর সতিত্বের শুভ্র আবরণে কলঙ্কের কালিমা লেপন করে রাতের নিকোশ কালো আধার কাটিয়ে ভোরের সোনালি সূর্যের উদয় ঘটে। এখান থেকেও পিছিয়ে পড়ে নেই সোনার বাংলার সোনার ছেলে মেয়েরা। হে বঙ্গীয় পিতা! সাত সমুদ্র তের নদী পেরিয়ে মসজিদের কোণায় বসে তসবীহ টেনে নিজেকে জান্নাতের অধিবাসী মনে কর না, সারাজীবন ইসলামী আন্দোলন করেই নিজেকে জান্নাতবাসী মনে কর না। হৃদয়ের ভালবাসা উজাড় করে অতি যত্নে জীবনের সব আয় রোজগার ব্যয় করে তোমার যে সোনামণিকে ১৮/২০ বছরের পূর্ণ যুবক/যুবতীতে পরিণত করেছ একটু তালাশ করে দেখ সে আজকের এই রাতে কোথায় রয়েছে। নতুবা তোমাকে সে দাউস বানিয়ে তোমার জান্নাত হারাম করে ছাড়বে।
১ জানুয়ারী ভোরের সূর্যটা পূর্বাকাশে উদয় হয় অন্যসকল দিনের মতই তারপরও কেন সোনার বাংলার লাখো ঘরে আয়োজন করা হয় ভাল খাবারের? যে দেশের লক্ষ-কোটি জনগণ দরিদ্র সীমার নীচে বাস করে, সে দেশে কেন লক্ষ-কোটি টাকা ব্যয়ে আয়োজন করা হয় এই অনুষ্ঠানের? যে দেশের প্রায় শতকরা ৯০ ভাগ মানুষ মুসলমান সে দেশের জনগণ কেন গ্রহণ করল এই বিজাতীয় সংস্কৃতি? ১ জানুয়ারী ২০১৩-তেও একইভাবে আয়োজন করা হয়েছিল ‘Happy New year’ কিন্তু কতটুকু Happy ছিল ২০১৩ সালে দেশের মানুষ? নিজেদের অনিচ্ছা সত্ত্বেও শাসক গোষ্ঠীর চাপের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ রানা প্লাজাতে সহস্রাধিক নিরীহ মানুষকে রড আর ইট-সিমেন্টের শক্ত কনক্রিটে পিষ্ট হতে হয়েছে। গণতান্ত্রিক রাজনীতির মারপ্যাচে হারিয়ে গেছে শত শত অসহায় ভাই-বোনের লাশ। হাযার হাযার ভাই-বোন নির্মমভাবে আহত হয়ে অসহনীয় যন্ত্রনা বুকে চেপে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মৃত্যুর প্রহর গুনছে।
৬ মে শাপলা চত্ত্বরে গভীর রাতের নিকষ কালো আঁধারে যালেম শাসকের হায়নারূপী গোলাম প্রশাসনের গুলির শিকার হয়ে প্রাণ দিতে হয়েছে আল-কুরআনের হাফেযসহ অসংখ্য ইসলাম প্রিয় মানুষকে। এছাড়াও সারা দেশের অসংখ্য নিরীহ মানুষ হত্যা, গুমসহ নানাবিধ নির্যাতন ও লাঞ্ছনার শিকার হয়েছে। প্রায় সারাটা বছর জুড়ে হরতাল, অবরোধ আর জ্বালাও-পোড়াও কর্মসূচীর শিকার হয়ে প্রাণ দিতে হয়েছে অসংখ্য নিরীহ মানুষকে। পেট্রোল বোমার শিকার হয়ে বার্ন ইউনিটে ডুকরে ডুকরে কেঁদে মরছে অসংখ্য মানুষ। মানুষরূপী নরপিচাসদের লালসার শিকার হয়ে সম্ভ্রম হারাচ্ছে অসংখ্য মা-বোন। কিন্তু তাদের চিৎকার এদেশের শাসক গোষ্ঠীর কর্ণ পর্যন্ত পৌঁছেনি। তাদের চিৎকারে হয়ত শুভ্র জাতীয় সংসদ ভবন লজ্জায় কালো বর্ণ ধারণ করেনি, তাদের কষ্টে ম্লান হয়ে হয়ত বাংলার জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত হয়নি, কোন মানবধিকার গোষ্টী শোক প্রকাশে কালো ব্যাচ ধারণ করে রাজপথে মেŠনমিছিল করেনি, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কল্যাণকামী সাংবদিকরাও তাদের পক্ষে কোন কলম ধরেনি, কলম ধরেনি জাতীয় পত্রিকার কোন বিশিষ্ট কলামিষ্ট। কিন্তু তাদের বুকফাটা আর্তনাদ ও করুণ চাহনি ঠিকই সাত আসমানকে ডিঙ্গিয়ে আরশে আযীমের সুমহান অধিপতি দু’জাহানের মালিক সর্বশক্তিমান আল্লাহ তা‘আলার কর্ণকূহরে পৌঁছে গেছে।
মুক্ত গগনে ডানা মেলে উড়মত্ম প্রাণচঞ্চল পাখি গুলোও হয়তবা তাদের ব্যাথায় ব্যথিত হয়ে ফেলেছে দু’ফোটা চোখের জল! কিন্তু বাংলার এক শ্রেণীর তরুণ প্রজন্মের দামাল ছেলে-মেয়েদের হৃদয়ে সামান্য অনুভূতির সঞ্চার পর্যমত্ম ঘটেনি। আর সে জন্যই এত সব কষ্টের ভারে নুয়ে পড়ে মাযলূম জনতা যখন কষ্টের প্রহর গুণছে, বাবা হারানো শিশুটি যখন মাঝ রাতে ঘুমের ঘরে আববু আববু বলে চিৎকার দিচ্ছে, অগ্নিদগ্ধ মানুষগুলো যখন বার্ন ইউনিটের গভীর শান্ত রজনীকে চিৎকার দিয়ে অশামত্ম করে তুলছে, হায়েনাদের বিষাক্ত ছোবলে সম্ভ্রম হারানো বোনটি যখন বাংলার কোন আদালতে বিচার না পেয়ে পাগল প্রায় হয়ে লিষ্ফল অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে, স্বামী হারানো বোনটি যখন কেঁদে চোখের জ্যোতি হারানোর উপক্রম, আর সন্তান হারানো হতভাগা বাবা-মা জীবনের শেষ বেলাভূমিতে দাঁড়িয়ে যখন সমত্মান হত্যার বিচারের সকল আশা ছেড়ে দিয়ে গভীর রজনীতে আল্লাহর যমীনে মাথা ঠুকে চোখের জলে জায়নামাজের পাটি শিতল করছে ঠিক এমনই সময়ে বাধভাঙ্গা আনন্দে উচ্ছস্বিত হয়ে স্বপ্নিল আয়োজনে নেশায় বিভর হয়ে ‘Thirty first Night’-এর গীত গেয়ে উল্লাস প্রকাশ করছে বঙ্গীয় মুসলিম (?) জনতা। কতটা নাদান, নির্লজ্জ, বেহায়া হলে এই জাতি ‘Thirty first Night’-এর মত বিজাতীয় সংস্কৃতির আষ্টেপৃষ্টে নিজেদের আবিষ্ট করে বেহায়াপনার চরম শিখরে পৌঁছতে পারে, তা হয়ত লৈখিক ছাপে ব্যক্ত করাটা অসম্ভব। তাই বলতে চাই, হে আত্মভোলা হতভাগা জাতি,
যেও না ভুলে নিজ পরিচয়
তুমি যে মুসলমান,
হারিয়ে ফেলেছ অতীত তোমার
যা কিছু ছিল সম্মান।
নেচ না তুমি পশ্চিমাদের
বাজনার সুর তালে,
সন্ধ্যা তোমার ঘনিয়ে এসেছে
ফিরে এসো আজ আপন গৃহে।
আঁকড়ে ধর কুরআন-সুন্নাহ
ঝেঁড়ে ফেল সব কুসংস্কার,
সব Night-ই Happy হবে
শুধু নয় ঐ Thirty First।
আতাউর রহমান
এম.বি.এ.
হিসাব বিজ্ঞান ও তথ্য ব্যবস্থা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়