জামা‘আতবদ্ধ জীবন-যাপনের সুফল (৩য় কিস্তি)
লিলবর আল-বারাদী
আযীযুর রহমান 1520 বার পঠিত
৬. সোনামণিদের নিয়মিত উৎসাহিকরণের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা :
সোনামণি তথা শিশু-কিশোরগণ সর্বদা কল্পনার জগতে থাকে। তাদেরকে বড়দের মত সাধারণভাবে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করা যায় না। তাদের হৃদয় স্পন্দন খুব বেশী। তারা নতুন নতুন স্বপ্ন দেখে এবং চিত্তপটে হাযারো কল্পনা অাঁকে। বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে বলছি, আমাদের অনেক বড় বড় দায়িত্বশীলগণও সোনামণি প্রশিক্ষণে উপস্থিত হয়ে তাদেরকে সঠিক দিক নির্দেশনা দিতে ব্যর্থ হন। তাই কল্পনা প্রবণ ও স্বপ্নাশ্রয়ী শিশু-কিশোরদের মনের খোরাক যোগাতে ‘সোনামণি’ সংগঠন উদ্ভাবন করেছে এক অভিনব কৌশল। সোনামণিদের অনুপ্রাণিত ও উৎসাহিতকরণের নিমিত্তে ‘সোনামণি’ সংগঠন পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের পাশাপাশি ইসলামী জ্ঞান, সাধারণ জ্ঞান, মেধা পরীক্ষা (অংক, ইংরেজী ও বাংলা), কবিতা, সংলাপ, উপদেশমূলক গল্প এবং বিজ্ঞানকে সিলেবাসভুক্ত করেছে। যার মাধ্যমে সোনামণিদের মেধা ও মননের দ্বার উন্মুক্ত হয়। এতে তাদের সুপ্ত মেধা বিকশিত হবে এবং সকলের কাছে তারা আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে। এর মাধ্যমে সোনামণিরা লেখাপড়ার সাথে সাথে এসব কাজে অনেক তৃপ্তি ও আনন্দ পাবে। আর গার্ডিয়ানরাও এ সংগঠনের প্রতি উৎসাহিত হবে ও সার্বিক সহযোগিতা প্রদানে আগ্রহী হয়ে উঠবে ইনশাআল্লাহ। ইসলামের দৃষ্টিতে সন্তান আল্লাহর দেওয়া বিশেষ নে‘মত ও অনুগ্রহ। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন,
وَاللَّهُ جَعَلَ لَكُمْ مِنْ أَنْفُسِكُمْ أَزْوَاجًا وَجَعَلَ لَكُمْ مِنْ أَزْوَاجِكُمْ بَنِينَ وَحَفَدَةً وَرَزَقَكُمْ مِنَ الطَّيِّبَاتِ أَفَبِالْبَاطِلِ يُؤْمِنُونَ وَبِنِعْمَتِ اللَّهِ هُمْ يَكْفُرُونَ .
‘আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন তোমাদের থেকে তোমাদের জোড়া এবং সৃষ্টি করেছেন তোমাদের জোড়া থেকে তোমাদের পুত্র ও পৌত্রদের। আর রিযিক দিয়েছেন তোমাদের উত্তম বস্ত্ত থেকে। তবুও কী তারা বাতিলকে বিশ্বাস করবে এবং আল্লাহর নে‘মত অস্বীকার করবে’ (নাহল ১৬/৭২)। সুতরাং সন্তান আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে বিশ্বমানবতার জন্য এক বিশেষ দান ও পৃথিবীর সৌন্দর্যের প্রতীক। সোনামণিরা নিষ্পাপ ফুলের মত পবিত্র। তাই তাদেরকে নিজ মন থেকে আদর ও সেণহ করা এবং ভালবাসা উচিৎ। আসুন! আমরা সকলে মিলে সোনামণিদেরকে উৎসাহিতকরণের এ সুযোগ প্রদান করি। আমরা জানি, সুবচনে ভালবাসা, বিনয়ে মর্যাদা, হাসিমুখে আনুগত্য, ত্যাগে নেতৃত্ব আর অনুগ্রহে ভ্রাতৃত্ব টেনে আনে।
(১) সালাম ও মুছাফাহা করা, কুশলাদি জিজ্ঞাসা করা।[1]
(২) বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ ও আদর সেণহ করা।[2]
(৩) লেখা-পড়া, পরিবার-পরিজন ও ইসলামী কাজের খোজ-খবর নেওয়া।[3]
(৪) হালকা নাস্তাসহ সার্বিক সহযোগিতা করা।[4]
(৫) বৈধ পন্থায় রসিকতা করা ও সুন্দর গল্প বলা।[5]
(৬) পরিশেষে সংগঠনের দাওয়াত দেওয়া (মায়িদা ৫/৬৭)। এ মর্মে হাদীছে এসেছে, আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, যে ছোটদের সেণহ করে না এবং বড়দের সম্মান করে না সে আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়।[6] আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ঐ ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না, যার প্রতিবেশী তার অনিষ্ট হতে নিরাপদ নয়।[7] তাই আসুন! আমরা সকল পর্যায়ের দায়িত্বশীলগণ এভাবে ধীরে ধীরে ‘সোনামণি’ সংগঠনকে বাস্তবায়ন করি এবং তাদের কাছে এ সংগঠনকে আকষর্ণীয় করে তুলি। ‘সোনামণি’ সংগঠনের মূল শ্লোগানটি তাদেরকে বুঝিয়ে দিই।
‘এসো হে সোনামণি।
রাসূল (ছাঃ)-এর আদর্শে নিজেকে গড়ি’।
৭. যথাযথ ইসলামী জ্ঞানার্জনে সর্বদা সচেষ্ট থাকা :
যে কোন সংগঠন পরিচালনার জন্য দায়িত্বশীলদেরকে ইসলামী জ্ঞানের পাশাপাশি বিশেষ কিছু জ্ঞানার্জন করা অপরিহার্য। পবিত্র কুরআনের প্রথম নাযিলকৃত শব্দ ছিল জ্ঞানার্জন করা। মহান আল্লাহ চান তার সুন্দরতম সৃষ্টির মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষ সুন্দরভাবে জীবন-যাপন করুক। এ জন্য তিনি নবী-রাসূলগণের মাধ্যমে পথ নির্দেশনা দিয়েছেন এই মর্মে যে, ‘সকল জ্ঞানের উৎস একমাত্র আল্লাহ’ (আহকাফ ৪৬/২৩)। আর এ জন্যই তো স্কুল, কলেজ, মাদরাসা ও সংগঠন।
সোনামণিদের জ্ঞানার্জন মূলতঃ ৩ ভাবে হয়ে থাকে। যথা : (১) পড়াশুনা করে (২) দেখে ও ঠকে এবং (৩) প্রশিক্ষণের মাধ্যমে। ১ ও ২ নং জ্ঞানার্জন অনেকের পক্ষে সম্ভব কিন্তু প্রশিক্ষণের মাধ্যমে জ্ঞানার্জন সংগঠন ছাড়া সম্ভব নয়। তাই তো সংগঠনের এত গুরুত্ব ও প্রয়োজন। নিয়মিত ইসলামী বই, পত্রিকা, পাঠাগার ইত্যাদির মাধ্যমেও জ্ঞানার্জন করা যায়। ‘সোনামণি’ সংগঠনের জন্য সোনামণিদের উপযোগী কিছু জ্ঞানার্জন করা একান্ত প্রয়োজন। সোনামণিদের সাথে খারাপ আচরণ ও বদমেজাজে ও রাগ করলে তারা সংগঠন থেকে সরে পড়বে। সোনামণিদের সাথে সর্বদা মুচকি হাসি দিয়ে কথা বলতে হবে। কারণ মুচকি হাসি পাথরকেও মোমের মত গলিয়ে দেয়।
সোনামণিদেরকে এক একজন ভাল বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করে তাদেরকে ইসলাম ও সংগঠন শেখাতে হবে। আল্লাহ বলেন, لَا يَتَّخِذِ الْمُؤْمِنُونَ الْكَافِرِينَ أَوْلِيَاءَ مِنْ دُونِ الْمُؤْمِنِينَ ‘মুমিনগণ যেন মুমিন ছাড়া কোন কাফেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করে’ (আলে ইমরান ৩/২৮)। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘সে ব্যক্তি তার সঙ্গে থাকবে, সে যাকে ভালবেসেছে’।[8] রাসূল (ছাঃ) অন্যত্র বলেন, طَلَبُ الْعِلْمِ فَرِيضَةٌ عَلَى كُلِّ مُسْلِمٍ ‘জ্ঞানার্জন করা প্রত্যেক মুসলমানের উপর ফরয’।[9] তিনি আরও বলেন, مَنْ يُرِدِ اللَّهُ بِهِ خَيْرًا يُفَقِّهْهُ فِى الدِّينِ ‘আল্লাহ যার কল্যাণ চান তিনি তাকে দ্বীনের জ্ঞান দান করেন’।[10] আমাদের উচিৎ ইহকালীন কল্যাণ ও পরকালীন মুক্তির স্বার্থে এবং দেশ ও জাতির বৃহত্তর কল্যাণের জন্য ‘সোনামণি’ সংগঠন বাস্তবায়নে দায়িত্বশীলদের বিশেষ জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে ভূমিকা পালন করা। আর জ্ঞানার্জনকে সংগঠন বাস্তবায়নের অন্যতম মাধ্যম হিসাবে গণ্য করা সকলের একান্ত কর্তব্য।
সোনামণি করব, জীবনটাকে গড়ব।
৮.দায়িত্বশীদের সাংগঠনিক গুণাবলী অর্জন করা :
দলবদ্ধভাবে এক সাথে মিলেমিশে কাজ করাকে সংগঠন বলে। সংগঠন সাধারণত দু’প্রকার। যথা : (১) নিয়মতান্ত্রিক এবং (২) অনিয়মতান্ত্রিক। সংগঠনের মৌলিক ৫টি বৈশিষ্ট রয়েছে। যেগুলো যে সংগঠনের মধ্যে আছে, সেটি নিয়মতান্ত্রিক এবং যার মধ্যে নেই, সেটি অনিয়মতান্ত্রিক সংগঠন। ৫টি বৈশিষ্ট হ’ল- (১) লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এবং মূলমন্ত্র (২) নেতা (৩) কর্মী (৪) অর্থ (৫) ক্ষেত্র। আমাদের ‘সোনামণি’ সংগঠন সহ এ ৫টি বৈশিষ্ট সকল সংগঠনের মধ্যে বিদ্যমান। রাসূল (ছাঃ) বলেন, إنَّ اللَّهَ تَعَالَى رَفِيقٌ يُحِبُّ الرِّفْقَ ‘আল্লাহ কোমল, তিনি কোমলতাকে ভালবাসেন’।[11]
রাসূল (ছাঃ) বলেন, الْحَيَاءُ وَالْعِىُّ شُعْبَتَانِ مِنَ الإِيمَانِ وَالْبَذَاءُ وَالْبَيَانُ شُعْبَتَانِ مِنَ النِّفَاقِ ‘লজ্জা ও কম কথা বলা ঈমানের দু’টি শাখা আর অশালীন ও অসার কথা বলা মুনাফিকের দু’টি শাখা’।[12] আল্লাহ বলেন, وَالَّذِينَ هُمْ عَنِ اللَّغْوِ مُعْرِضُونَ ‘(মুমিনদের পরিচয়ে) ‘যারা আসার ক্রিয়াকলাপ হ’তে বিরত থাকে’ (মুমিনূন ২৩/৩)। অতএব দায়িত্বশীল হবে তারাই, যাদের মধ্যে আল্লাহভীতি রয়েছে। একদা রাসূল (ছাঃ) এক ছাহাবীকে বলেন, أُوصِيكَ بِتَقْوَى اللَّهِ فَإِنَّهُ رَأْسُ كُلِّ شَىْءٍ ‘আমি তোমাকে তাক্বওয়া অর্জনের অছিয়ত করছি। কারণ তাক্বওয়া সকল কিছুর মুকুট’।[13] তাক্বওয়ার কারণে আল্লাহ তার ইচ্ছা পূরণ করবেনই (তালাক্ব ৬৫/৩)।
ধৈর্য একটি বিশেষ গুণ। ধৈর্যহীন মানুষ মহৎ হতে পারে না, সফলতার শীর্ষে আরোহন করতে পারে না। সংগঠনের দায়িত্বশীলদের চরম ধৈর্যের পরিচয় দিতে হয়। এই কারণে হয়তোবা মহান আল্লাহ ধৈর্যশীলদের ভালবাসেন (আলে ইমরান ৩/১৪৬)। حُرِّمَ عَلَى النَّارِ كُلُّ هَيِّنٍ لَيِّنٍ سَهْلٍ قَرِيبٍ مِنَ النَّاسِ ‘ঐ ব্যক্তির উপর জাহান্নামের আগুন হারাম হয়ে যায়, যার মেযাজ নরম স্বভাবের ও কোমল, মানুষের সাথে মিশুক প্রকৃতির এবং তার চরিত্র সহজ ও সরল’।[14] জারীর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, مَنْ يُحْرَمِ الرِّفْقَ يُحْرَمِ الْخَيْرَ ‘যাকে কোমলতা থেকে বঞ্চিত করা হয়, তাকে যাবতীয় কল্যাণ থেকে বঞ্চিত করা হয়’।[15] আব্দুল্লাহ ইবনু হারেছ ইবনে জাযই (রাঃ) বলেন, مَا رَأَيْتُ أَحَدًا أَكْثَرَ تَبَسُّمًا مِنْ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ‘আমি রাসূল (ছাঃ)-এর চেয়ে অন্য কাউকে অধিক মুচকি হাসি হাসতে দেখিনি’।[16] ‘সোনামণি’ সংগঠনের বাস্তাবায়নের লক্ষ্যে এসব গুরুত্বপূর্ণ গুণাবলী অর্জন করা প্রত্যেক দায়িত্বশীলের জন্য অপরিহার্য।
৯. নিয়মিত বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ ও প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করা :
প্রশিক্ষণ শব্দের অর্থ হচ্ছে হাতে কলমে শিক্ষা দেওয়া। সারা বছর লেখাপড়া করে কোন সন্তান যা শিখতে পারে না, কয়েক ঘন্টার প্রশিক্ষণে সে তা শিখতে পারে। শাখা পর্যায়ে প্রতি ৩ মাস অন্তর, যেলা/মহানগর পর্যায়ে প্রতি বছর এবং কেন্দ্রীয়ভাবে বার্ষিক প্রশিক্ষণ ও প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করা বাঞ্চনীয়। এর মাধ্যমে সংগঠনের প্রসার ঘটে ও পরিচিত লাভ করে এবং সোনামণিরাও পায় প্রচুর আনন্দ। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, تَعَاوَنُوا عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوَى وَلَا تَعَاوَنُوا عَلَى الْإِثْمِ وَالْعُدْوَانِ ‘তোমরা ভালকাজে ও তাক্বওয়ার কাজে পরস্পরকে সহযোগিতা করবে এবং পাপ ও সীমালংঘনের কাজে একে অন্যের সহযোগিতা করবে না’ (মায়েদা ৫/২)।
ইংরেজীতে একটি প্রবাদ আছে `Training is learning designed to change the performance of the people doing job'. ‘প্রশিক্ষণ হচ্ছে এমন এক শিক্ষণ পদ্ধতি, যা মানুষের ধারাবাহিক কাজের গতিধারার পরিবর্তন এনে দেয়’। প্রশিক্ষণের নীতিমালা ৭টি। যথা : (১) সময়মত উপস্থিত হওয়া। (২) খাতা ও কলম সঙ্গে আনা (৩) মনোযোগী হওয়া (৪) প্রয়োজনীয় বিষয় নোট করা (৫) অনুমতি নিয়ে বাইরে যাওয়া (৬) শৃংঙ্খলা বজায় রাখা (৭) দো‘আ পাঠের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ শেষ করা। এভাবে নিয়মিত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কর্মী, দায়িত্বশীল, নেতা ও সোনামণিদের যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, দক্ষতা এবং মনোবল বৃদ্ধি পায়। ফলে সকল বিষয়ে বিশেষ যোগ্যতা অর্জন করে থাকে। ইসলামের সকল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পর্যায়ক্রমে প্রতিযোগিতার মাধ্যমেও ‘সোনামণি’ সংগঠনের বাস্তবায়ন সম্ভব। এ দু’টি বিষয়ে ‘সোনামণি’ সংগঠনের সকল পর্যায়ের দায়িত্বশীলদের বিশেষ নযর দেওয়া ও ভূমিকা রাখা একান্ত প্রয়োজন। প্রশিক্ষণ সংশ্লিষ্ট এলাকার গণ্য-মান্য ব্যক্তিদের স্কুল-মাদরাসা ও কলেজের শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের এবং জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করা যেতে পারে। বিশেষ করে প্রতিযোগিতায় বিজয়ী সোনামণিদের পুরস্কার প্রদানের জন্য এর মাধ্যমে আর্থিক ও অন্যান্য সুবিধা পাওয়া যেতে পারে। ‘সোনামণি’ সংগঠনের ব্যাপক প্রচার, প্রসার ও বাস্তবায়নের স্বার্থে সকল পর্যায়ের দায়িত্বশীলদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করা একান্ত প্রয়োজন। আসুন আমরা সকলে মিলে এ বিষয়ে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করি।
১০. সোনামণি সংগঠনের সাথে অন্যান্য শিশু-কিশোর সংগঠনের পার্থক্য সম্পর্কে জানা :
‘সোনামণি’ সংগঠন ছাড়াও বাংলাদেশে আরও প্রায় ২০/২২টি শিশু-কিশোর সংগঠন আছে। এসব শিশু-কিশোর সংগঠনের অনেকগুলোর কোন সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এবং কর্মসূচী নেই। প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী এবং আন্তর্জাতিক শিশু-অধিকার দিবস পালন ইত্যাদি ছাড়া এদের তেমন কোন কর্মসূচী দেখা যায় না। সোনামণি সংগঠনের সাথে অন্যান্য শিশু-কিশোর সংগঠনের আদর্শিক ও মৌলিক পার্থক্যসমূহ নিমণরূপ :
১. সোনামণি সংগঠনের লক্ষ্য : শিশু-কিশোরদের মধ্যে ইসলামী চেতনা সৃষ্টি ও তদানুযায়ী জীবন ও সমাজ গড়ে তোলা।[17] অন্যান্য শিশু-কিশোর সংগঠনের লক্ষ্য হচ্ছে, কোন ব্যক্তি বা সংগঠনের নেতার লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য চেতনা সৃষ্টি ও জীবন ও সমাজ গড়ে তোলা। যেমন- জিয়া শিশু-কিশোর সংগঠন এবং শেখ রাসেল জাতীয় শিশু-কিশোর সংগঠন ও কঁচি-কাঁচার মেলা ইত্যাদি।
২. সোনামণি সংগঠনের উদ্দেশ্য : আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা।[18] অন্যান্য শিশু-কিশোর সংগঠনের উদ্দেশ্য হচ্ছে, কোন ব্যক্তি বা সংগঠনের নেতার সন্তুষ্টি অর্জনের উপর সীমাবদ্ধ থাকবে। (তাদের কর্মসূচী উপরের উদাহরণ দ্রষ্টব্য)।
৩. সোনামণি সংগঠনের মূলমন্ত্র : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর আদর্শে নিজেকে গড়া’ (আহযাব ৩৩/২১)। এর স্বপক্ষে পবিত্র কুরআনে আরো অনেকগুলো আয়াত আছে।[19] অন্যান্য শিশু-কিশোর সংগঠনের চরিত্র গঠনের জন্য তেমন কোন ভিত্তি, উপাদান বা মূলমন্ত্র নেই। বাংলাদেশের অন্যতম ইসলামী সংগঠনের জাতীয় শিশু-কিশোর সংগঠন ‘ফুল কুঁড়ি’-এর মূলমন্ত্র হচ্ছে ‘নিজেকে গড়া’। কার, কি বা কোন আদর্শ তারা বাস্তবায়ন করবে ইত্যাদি কোন বালাই এর মধ্যে নেই। সুবিধামত সময়ে তারা সুবিধামত যে কোন আদর্শ বা মূলমন্ত্র নিয়ে কাজ করতে পারবে। তাহলে শিশু-কিশোরদের চরিত্র কেমন হবে তা অতি সহজেই বুঝা যায়।
৪. সোনামণি সংগঠনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এবং মূলমন্ত্র ছাড়াও শিশু-কিশোরদের চরিত্র গঠনের জন্য ১০টি গুণাবলী, ৫টি নীতিবাক্য এবং ৪ দফা কর্মসূচীসহ একটি সুনির্দিষ্ট প্লাটফর্ম ও কর্ম-পরিকল্পনা আছে। অন্যান্য শিশু-কিশোর সংগঠনে চরিত্র গঠনের জন্য এমন সুবিবেচনাপূর্ণ প্লাটফর্ম ও কর্ম-পরিকল্পনা নেই।
৫. সোনামণি সংগঠনের প্রত্যেক দায়িত্বশীলদেরকে কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে সার্বিক জীবন গঠনের শপথ নিতে হয়। অন্যান্য শিশু-কিশোর সংগঠনের দায়িত্বশীলদেরকে এমন সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ব্যতীত শুধুমাত্র কর্মসূচী পালনের শপথ নিতে হয়।
৬. সোনামণি সংগঠনের দায়িত্বশীলদেরকে প্রত্যেকটি কথা, কাজ, সভা-সমাবেশ, বৈঠক এবং আলোচনায় ইসলামী চেতনা ও আদর্শকে যথাযথ অনুসরণ করা ও সমুন্নত রাখা বাঞ্চনীয়। অন্যান্য শিশু-কিশোর সংগঠনের এমন কোন পদ্ধতি ও আদর্শ অনুসরণ করা বাধ্যতামূলক নয়। যেমন- জাতীয় শিশু-কিশোর সংগঠন ‘খেলাঘর’-এর প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে তারা ঢাক-ঢোল, নাচ-গান, নাটক, অভিনয়, ক্রীড়া-কৌতুক ইত্যাদি কর্মসূচী পালন করে থাকে।
৭. সোনামণি সংগঠন সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এবং আদর্শের উপর ভিত্তি করে আদর্শবান ব্যক্তি, পরিবার, সোনালী সমাজ ও সুশৃংখল দেশ গড়ার নিমিত্তে একনিষ্ঠভাবে কাজ করে যাচ্ছে। আর অন্যান্য শিশু-কিশোর সংগঠন তাদের দায়িত্বশীলদের নিজস্ব জ্ঞান-বুদ্ধি ও বিচার-বিবেচনার উপর ভিত্তি করে এগুলো গড়ার নিমিত্তে কাজ করে যাচ্ছে।
৮. সোনামণি সংগঠনের সকল বিধি-বিধান ও নীতিমালা অপরিবর্তনীয় ও দীর্ঘস্থায়ী। পক্ষান্তরে অন্যান্য শিশু-কিশোর সংগঠনের সকল বিধি-বিধান ও নীতিমালা ঘনঘন পরিবর্তনশীল ও ক্ষণস্থায়ী। সোনামণি সংগঠন ব্যতীত বাংলাদেশের আরো কিছু শিশু-কিশোর সংগঠনের নাম ও পরিচিতি জানার জন্য নিম্নে পেশ করা হল। ১. ফুল কুঁড়ি, ২. আলোর প্রদীপ ফৌজ ৩. শেখ রাসেল জাতীয় শিশু-কিশোর সংগঠন ৪. জিয়া জাতীয় শিশু-কিশোর সংগঠন ৫. কমল কুঁড়ি ৬. রূপালী তারার মেলা ৭. কঁচি-কাঁচার মেলা ৮. নতুন কুঁড়ি ৯. চাঁদের হাট ১০. খেলা আসর ১১. কেন্দ্রীয় ফুল পাখি ১২. শিশু বন্ধু ১৩. খেলা ঘর ১৪. আবোল তাবোল ইত্যাদি।
সোনামণি সংগঠনের যথাযথ বাস্তবায়নের জন্য উল্লেখিত ১০টি গুণাবলী অর্জন সাপেক্ষে মহান আল্লাহর বিশেষ মদদ কামনা করছি। হে আল্লাহ! আপনি আমাদের সাথে থাকুন এবং সহায় হৌন। আমীন!!
মুহাম্মাদ আযীযুর রহমান
প্রথম পরিচালক, সোনামণি
[1] . বুখারী, মিশকাত হা/৪৬৩৬।
[2]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৪৯৫৩।
[3]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৪৯৬৩।
[4]. বুখারী, মুসলিম মিশকাত হা/৪৯৪৭।
[5]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৪৮৮৪।
[6]. তিরমিযী, আলবানী হা/১৯১৯।
[7]. মুসলিম, মিশকাত হা/৪৯৬৩।
[8]. তিরমিযী হা/২৩৮৫, সনদ ছহীহ।
[9]. ইবনু মাজাহ হা/২২৪, মিশকাত হা/২১৮, সনদ ছহীহ।
[10]. বুখারী হা/৭১, মিশকাত হা/২০০।
[11]. মুসলিম. মিশকাত হা/৫০৬৮।
[12]. তিরমিযী, মিশকাত হা/৪৭৯৬, সনদ ছহীহ।
[13]. আহমাদ হা/১১৭৯১; সিলসিলা ছহীহাহ হা/৫৫৫, সনদ ছহীহ।
[14]. আহমাদ হা/৩৯৩৮; ছহীহুল জামে‘ হা/৫৪৪৬, সনদ ছহীহ।
[15]. মুসলিম হা/৬৭৬৩; মিশকাত হা/৫০৬৯।
[16]. তিরমিযী হা/৩৬৪১, মিশকাত হা/৪৭৪৮, সনদ ছহীহ।
[17]. সূরা বাক্বারাহ ২/১১৩; আলে ইমরান ৩/১৫৯।
[18]. বাইয়েনাহ ৯৮/৭ ও ৮; ফজর ৮৯/২৭-৩০; মায়িদা ৫/১১৯; ত্বহা ২০/১৩০; রা‘দ ১৩/২২-২৪।
[19]. কলম ৬৮/৪; আম্বিয়া ২১/১০৭; হাশর ৫৯/৭; নজম ৫৩/৩ ও ৪; আলে ইমরান ৩/৩১ ও ৩২, ১৩২-১৩৪,১৫৯; সাবা ৩৪/২৮; নূর ২৪/৫৪; নিসা ৪/৫৯ ও ৮০; ইব্রাহীম ১৪/১; ‘আরাফ ৭/১৯৯; তাগাবুন ৬৪/১২-১৩; ইয়াসিন ৩৬/৩৪।