দক্ষিণ এশিয়ায় আহলেহাদীছ আন্দোলন
প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব 654 বার পঠিত
আধুনিক যুগ : ২য় পর্যায় (ক)
دور الجديد : المرحلة الثانية(الف)
জিহাদ আন্দোলন ১ম পর্যায় শহীদায়েন (রহঃ)
حركة الجهاد للشهيدين
(১১৯৩-১২৪৬/১৭৭৯-১৮৩১) ৫২ বৎসর
শাহ ইসমাঈল (রহঃ) ও জিহাদ আন্দোলন
পাঞ্জাবে মুসলমানদের উপর শিখদের অবিরত লোমহর্ষক নির্যাতনের খবর শুনে ও দীর্ঘ দু’বছর যাবত পাঞ্জাবের গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে অভিজ্ঞতা হাছিলের পর দিল্লী ফিরে এসে শাহ ইসমাঈল গভীর চিন্তায় মগ্ন হলেন।[1] অবশেষে সশস্ত্র প্রতিরোধই এর একমাত্র পথ হিসাবে তিনি সাব্যস্ত করেন ও সেমতে মানসিক প্রস্ত্ততি নিতে থাকেন। ইতিমধ্যে দেশ হ’তে ইংরেজ শাসন উৎখাতের উদ্দেশ্য নিয়ে সুদক্ষ সৈনিক সাইয়িদ আহমাদ ব্রেলভীর (১২০১-১২৪৬ হিঃ/১৭৮৬-১৮৩১ খ্রিঃ) দ্বিতীয়বার (১২৩১/১৮৬১ খৃঃ) দিল্লী আগমনের খবর শুনে তিনি যেন পথ খুঁজে পেলেন এবং বুযর্গ উস্তাদ ও চাচা শাহ আবদুল আযীযের ইশারায় তিনি ও মাওলানা আবদুল হাই (মৃঃ ১২৪৩/১৮২৮ খৃঃ) সৈয়দ আহমাদ ব্রেলভীর হাতে জিহাদের বায়‘আত গ্রহণ করেন। তাঁদের বায়‘আতের সাথে সাথে অলিউল্লাহ-পরিবারের সকলে ‘আমীরে জিহাদ’ হিসাবে তাঁর হাতে বায়‘আত নেন। শুরু হ’ল জিহাদের পরিকল্পনা ও ব্যাপক প্রস্ত্ততি। সৈয়দ আহমাদ যুদ্ধের ময়দানের ‘আমীর’ হলেও আল্লামা ইসমাঈল ছিলেন প্রধান সেনাপতি ও সকল বিষয়ের মূল পরিকল্পক। তিনিই ছিলেন জিহাদের প্রাণপুরুষ। তাঁদের পরিচালিত ‘দাওয়াত ও জিহাদ’-কে আমরা অভিন্ন লক্ষ্যে নিয়োজিত চারটি স্তরে ভাগ করতে পারি।[2] যেমন- ১. সৈয়দ আহমাদের হাতে ‘বায়‘আতে ইমারত’ এবং পাঁচ বছর যাবত ব্যাপক দাওয়াত ও তাবলীগ (১২৩১-৩৬/১৮১৬-২১ খৃঃ ২. হজ্জের সফর : সৌরবর্ষ হিসাবে ২ বছর ১০ মাস আটাশ দিন (১২৩৬-৩৯/১৮২১-২৪ খৃঃ) ৩. জিহাদের সক্রিয় প্রস্ত্ততি ও দেশব্যাপী সফর প্রায় দু’বছর (১২৩৯-৪১/১৮২৪-২৬) ৪. হিজরত, জিহাদ ও শাহাদত : ১২৪১ হিজরীর ৭ই জমাদিউছ ছানী মোতাবেক ১৮২৬ সালের ১৭ই জানুয়ারী সোমবার হ’তে ১২৪৬ হিজরীর ২৪শে যুলকা‘দা মোতাবেক ১৮৩১ সালের ৬ই মে শুত্রুবার পূর্বাহ্ন পর্যন্ত মোট পাঁচ বছর তিন মাস উনিশ দিন। চারটি স্তরে সর্বমোট প্রায় ১৫ বছর।
১ম স্তর : বায়‘আতে ইমারত-দা‘ওয়াত ও তাবলীগ (১২৩১-৩৬/১৮১৬-২১ খৃঃ)
১২৩১ হিজরীতে দিল্লীতে সৈয়দ আহমাদের হাতে ‘বায়‘আতে ইমারত’ শেষে ‘হুজ্জাতুল ইসলাম’ আল্লামা ইসমাঈল ও ‘শায়খুল ইসলাম’ আল্লামা আবদুল হাইসহ[3] কমবেশী বিশজন সেরা আলিম ও বন্ধুবান্ধবসহ আমীর সৈয়দ আহমাদ ব্রেলভী মুহাররম ১২৩৪/নভেম্বর ১৮১৮ সালে দিল্লী হ’তে সারা ভারতবর্ষে ব্যাপক তাবলীগী সফরে বের হন।[4] ইতিপূর্বে তাঁরা দিল্লী ও আশপাশে তাবলীগ করেন। অলৌকিক বক্তৃতা প্রতিভার অদিকারী আল্লামা ইসমাঈলের নছীহত ও বাগ্মিতায় মুগ্ধ হয়ে লোকেরা বিভিন্ন কুসংস্কার হ’তে তওবা করে এবং দলে দলে সৈয়দ আহমাদের নিকটে বায়‘আত করতে থাকে। সর্বত্র তাঁরা শিরক ও বিদ‘আতের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের সাথে সাথে সকলকে জিহাদে উদ্বুদ্ধ করে তোলেন। এইভাবে প্রায় পাঁচ বৎসর যাবত ব্যাপক দাওয়াত ও তাবলীগের ফলে একদিকে যেমন বায়‘আতকারীর সংখ্যা বহুগুণে বৃদ্ধি পায়, অন্যদিকে তেমনি শিখ ও ইংরেজ শক্তির বিরুদ্ধে আগামী দিনের সর্বভারতীয় মুজাহিদ নেতা হিসাবে তাঁদের ভাবমূর্তি সর্বসাধারণের হৃদয় গ্রথিত হয়ে যায়।
২য় স্তর : হজ্জের সফর (১.১০.১২৩৬ হিঃ - ২৯.৮.১২৩৯ হিঃ / ২.৬.১৮২১ খৃঃ - ৩০.৪.১৮২৪ খৃঃ) :
জলপথে পর্তুগীজদের ভয়ে ভারতের একদল আলিম ‘এখন হজ্জের ফরযিয়াত মুলতবী হয়ে গেছে’ এই মর্মে ফৎওয়া জারি করলে[5] তার প্রতিবাদে প্রথমে আল্লামা ইসমাঈল একটি ফৎওয়া লিখে বিলি করেন। অতঃপর হিম্মতহারা মুসলমানদের হিম্মত ফিরিয়ে আনার জন্য ধনী-নির্ধন সকল মুসলমানকে তাঁদের সাথে হজ্জে যাওয়ার জন্য আমীরের নির্দেশক্রমে ব্যাপক ঘোষণা জারি করলেন। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, একেবারে কপর্দকশূন্য অবস্থায় পাঁচটি জাহাযে চারশত নর-নারী নিয়ে ১লা শাওয়াল ১২৩৬ হিজরী মোতাবেক ১৮২১ সালের ২রা জুন তারিখে ঈদুল ফিৎরের ছালাত শেষে তাঁরা হজ্জের উদ্দেশ্যে রায়বেরেলী ত্যাগ করেন। ব্যবস্থাপনার দায়িত্বশীল শাহ ইউসুফ ফল্তীর নিকটে মাত্র সাত টাকা অবশিষ্ট ছিল। সেটাও মিসকীনদের মধ্যে দান করে দিয়ে রওয়ানার সময় রিক্তহস্ত আমীর সৈয়দ আহমাদ আল্লাহর নিকটে সফরের সফলতার জন্য করুণকন্ঠে দো‘আ করেন। সাথীদের নির্দেশ দিলেন যেন কারু কাছে কিছু না চায় এবং কোন অবস্থায় তাক্বওয়া পরিত্যাগ না করে। এ যেন ছিল জালূতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ যাওয়ার সময় তালূত কর্তৃক সৈন্যদের পিপাসা পরীক্ষার ন্যায়। কলিকাতায় নভেম্বর ১৮২১ হ’তে প্রায় তিন মাস অবস্থানের পর মোট দশটি জাহাযে ৭৫৩ জন হাজী নিয়ে কাফেলা জেদ্দার পথে রওয়ানা হয়ে যায়। এখানেই সর্বাপেক্ষা বেশী লোক বায়‘আত করেছিল। ধনী ব্যবসায়ী মুনশী আমীনুদ্দীন, মৌলবী ইমামুদ্দীন বাংগালী প্রমুখ বায়‘আত করার সাথে সাথে উদারহস্তে আর্থিক সাহায্য করেছিলেন। ৭/৮ মাস হারামাইনে কাটিয়ে ২ বছর ১০ মাস ২৮ দিন পর ২৯শে শা‘বান ১২৩৯ মোতাবেক ১৮১৪ সালের ৩০শে এপ্রিল তারিখে রামাযানুল মুবারকের পূর্বদিন এই বিরাট কাফেলা রায়বেরেলী ফিরে আসে ও বিদায়ী ভোজপর্ব শেষে তখনও দশহাযার টাকা উদ্বৃত্ত থাকে, যা বায়তুল মালে জমা করা হয়।[6] আল্লাহর উপরে তাওয়াক্কুলের এই অনন্য দৃষ্টান্ত ভবিষ্যত মুজাহিদগণের জন্য প্রেরণা হয়ে থাকবে।
৩য় স্তর : হিজরত, জিহাদ ও শাহাদাত (৭.৬.১২৪১-২৪.১১.১২৪৬ হিঃ / ১৭.১.১৮২৬-৬.৫.১৮৩১ খৃঃ)
(......... ১২৩৩ বাং সোমবার) হ’তে ১৭ই বৈশাখ ১২৩৮ বাং শুক্রবার পূর্বাহ্ন পর্যন্ত সৌরবর্ষ হিসাবে পাঁচ বছর তিন মাস ঊনিশ দিন।)
হারামাইন শরীফাইন হ’তে প্রত্যাবর্তনের পর সর্বত্র জিহাদের দাওয়াতের কাজ শুরু হয়ে যায়। রায়বেরেলী হ’তে আমীর সৈয়দ আহমাদ নিজে এবং ভারতের অন্যত্র আল্লামা ইসমাঈল ও আল্লামা আবদুল হাইয়ের ব্যাপক তাবলীগী সফর চলতে থাকে। কুরআন ও হাদীছভিত্তিক জীবন গঠন, সমাজ-সংগঠন, মুসলমানদের উপরে অমুসলিম শাসকদের ব্যাপক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নির্যাতনের বিরুদ্ধে জিহাদী জাযবা পুনরুদ্ধার ইত্যাদিই ছিল তাদের বক্তব্যের মূল বিষয়বস্ত্ত। শাহ ইসমাঈল তাঁর সকল বক্তব্যে একথা পরিষ্কার করে তুলে ধরেন যে, মুসলমানদের সামনে এখন তিনটি পথ খোলা রয়েছে। ১. তাকে ‘হক্ব’ ছেড়ে বাতিলকে অাঁকড়ে ধরতে হবে ২. হক্ব-এর উপরে দূঢ় থাকার কারণে বাতিলপন্থীদের হামলায় ধৈর্য ধারণ করতে হবে ৩. অথবা বাতিলকে সাহসের সঙ্গে মুকাবিলা করে হক্ব-এর সার্বিক বিজয়লাভের পথ সুগম করতে হবে। তিনি জাতিকে স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দেন যে, প্রথমটি কোন বাঁচার রাস্তা নয় বরং ওটাই প্রকৃতপ্রস্তাবে মরণের রাস্তা। দ্বিতীয়টির পরিণতি বেশীর বেশী এটাই হবে যে, তিলে তিলে মরতে হবে। কেবলমাত্র তৃতীয় পথটিই এখন আমাদের জন্য খোলা রয়েছে। আর সেটা হ’ল সরাসরি সম্মুখ মোকাবিলা বা জিহাদ। জিহাদ ত্যাগ করার কারণেই আজ মুসলমান সর্বত্র মার খাচ্ছে। দশ হাযার মাইল দূর থেকে নৌকা চালিয়ে বণিকের বেশে মুষ্টিমেয় কয়েকজন লোক এদেশে এসে যুগ যুগ ধরে বসবাসকারী মুসলিম শক্তিকে আসমুদ্র হিমাচলব্যাপী বিশাল ভারতীয় ভূখন্ডের শাসন ক্ষমতা হ’তে উৎখাত করল। অথচ মুসলমানরা শিক্ষা-দীক্ষা, অর্থে-বিত্তে, অভিজ্ঞতায় ও অস্ত্রশক্তিতে সেরা হওয়া সত্ত্বেও নির্বিবাদে মার খেয়ে যাচ্ছে। কেউ আপোষ করছে, কেউ এটাকে কপালের লিখন ধরে নিয়েছে, কেউ আপোষ করতে না পেরে ধুকে ধুকে মরছে। আর মুষ্টিমেয় কিছু লোক আত্মমর্যাদায় উদ্বুদ্ধ হয়ে এর বিরুদ্ধে সশস্ত্র জিহাদের পরিকল্পনা করছে। তিনি সৈয়দ আহমাদের নেতৃত্বে জানমাল দিয়ে জিহাদে অংশ গ্রহণের জন্য সকল ভারতীয় মুসলমানের প্রতি উদাত্ত আহবান জানান।[7] দেশব্যাপী এই প্রচারণার ফলে একদিকে যেমন মুসলমানরা জিহাদে উদ্বুদ্ধ হ’তে থাকেন, অন্যদিকে শাহ ইসমাঈলের আপোষহীন ব্যক্তিত্বের প্রভাবে এবং কুরআন ও হাদীছের প্রতি দাওয়াতের ফলে সর্বত্র আহলেহাদীছ আন্দোলন জোরদার হ’তে থাকে।
এইভাবে দীর্ঘ এক বৎসর দশ মাস যাবৎ সর্বত্র দাওয়াতী সফর শেষে জিহাদে গমনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। জিহাদের স্থান হিসাবে সীমান্ত এলাকাকে নির্বাচন করা হয়।
কারণ (১) সারা হিন্দুস্থানে কোথাও এমন স্বাধীন ও নিরাপদ স্থান ছিল না, যাকে জিহাদের কেন্দ্র বানানো যেতে পারে। (২) সীমান্তের স্বাধীন মুসলিম স্বায়ত্তশাসিত রাজ্যগুলোর প্রতিনিধিরা বলেছিলেন যে, আমাদের ওখানকার লোকেরা শিখদের যুলুমে অতিষ্ঠ হয়ে আছে। অতএব সেখান থেকে জিহাদ শুরু করলে লাখ লাখ লোক স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে জিহাদে যোগ দিবে। তাছাড়া আমাদের জাতি জন্মযোদ্ধা। তাদেরকে বিশেষ ট্টেনিং না দিলেও চলবে (৩) সর্বোপরি পাহাড়-জংগলের এলাকা হওয়ার কারণে যে কোন সুশিক্ষিত নিয়মিত বাহিনীকে মোকাবিলা করা কেবল সেখানেই সম্ভব (৪) সীমান্ত এলাকা ব্যতীত হিন্দুস্থানের অন্যত্র মুসলিম নওয়াবেরা সকলে ইংরেজ আশ্রিত ছিলেন (৫) সীমান্ত প্রদেশ ও তৎসন্নিহিত এলাকাসমূহের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতা যথেষ্ট ছিল। অমুসলিম শিখ ও ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তাদের সমর্থন পাওয়া গেলে জিহাদে জয়লাভ একরূপ নিশ্চিত বলা যায়। সবদিকে বিবেচনা করে হিন্দুস্তানে বিভিন্ন এলাকার পক্ষ হ’তে দাবী থাকা সত্ত্বেও সৈয়দ আহমাদ ও শাহ ইসমাঈল অবশেষে সীমান্ত এলাকাকেই জিহাদ শুরুর কেন্দ্র হিসাবে নির্বাচনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন।[8]
অগ্রগামী বাহিনী, দক্ষিণ বাহু, বামবাহু, রসদবাহী দল ও মূলবাহিনী সহ পাঁচটি বাহিনীতে বিভক্ত হয়ে প্রত্যেকটিকে পৃথক পৃথক আমীরের দায়িত্বে সোপর্দ করে ১২৪১ হিজীরর ৭ই জমাদিউছ ছানী মোতাবেক ১৮২৬ খৃষ্টাব্দের ১৭ই জানুয়ারী সোমবার সৈয়দ আহমাদের জন্মগ্রহণ অযোধ্যার রায়বেরেলীর ‘তাকিয়া’ গ্রাম হ’তে জিহাদী কাফেলা আল্লাহর নামে রওয়ানা হয়ে যান। মুজাহেদীনের প্রাথমিক সংখ্য পাঁচ-ছয়শ’ ছিল।[9] তবে রাস্তায় চলার পথে বহু লোক তাদের সঙ্গী হয়েছিলেন একথা প্রায় সকল জীবনীকার বলেছেন।
জিহাদে গমনের তারিখ ঘোষিত হওয়ার সাথে সাথে চরদিক হ’তে ত্যাগ ও কুরবানীর বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। দলে দলে লোক মুজাহেদীনকে বিদায় জানাতে আসেন। আশ্রুসজল নেত্রে সকলেই কিছু না কিছু ‘হাদিয়া’ দিয়ে জিহাদে শরীক হওয়ার ছওয়াব লাভের চেষ্টা করেন। দশমাসের দীর্ঘ সফরে প্রায় তিন হাযার মাইল পথ পরিক্রমায় শ্রান্ত-ক্লান্ত মুজাহেদীনের ভাগ্যে এক মুহূর্ত বিশ্রামের অবকাশ হ’ল না। পথিমধ্যে সিন্ধু, হায়দরাবাদ, বেলুচিস্তান, কান্দাহার, গযনী, কাবুল সকল এলাকার শাসক ও আমীরদের নিকট জিহাদে অংশগ্রহণের আবেদন জানিয়ে ব্যর্থ হওয়ায় সৈয়দ আহমাদ ও শাহ ইসমাঈলের পূর্বের ধারণা বানচাল হয়ে গিয়েছিল। তবুও তাঁরা ভাবতে পারেননি যে, এরা মুসলমান হয়ে এদেরই শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মুজাহিদদের বিরোধিতায় যোগদান করবে। সরলপ্রাণ বীরহৃদয় শাহ ইসমাঈল অত্যন্ত দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হলেও এত সংকীর্ণ চিন্তায় তিনি বা তাঁর সাথীরা কখনোই অভ্যস্ত ছিলেন না। সীমান্তের শী‘আ ও পাঠান সর্দাররা যে কত ধূর্ত ও মুনাফিক চরিত্রের হ’তে পারে তা অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তাঁদের নিকট প্রতিভাত হয়ে ওঠে। আমীর সৈয়দ আহমাদ নির্দেশ দিলেন ‘কেউ যেন পোষাক পরিবর্তন না করে। যে যে অবস্থায় আছে সেই অবস্থায় যেন জিহাদের জন্য প্রস্ত্তত হয়ে যায়।’ মাত্র সাত মাইল দূরে আকূড়াতে অত্যাচারী শিখ রাজা রনজিৎ-এর সেনাপতি বুধ সিং ৮টি কামানসহ দশ হাযার সৈন্য নিয়ে শিবির গেড়েছে দেড় হাযার দীনহীন মুজাহিদের মুকাবিলা করার জন্য।[10] পেশোয়ারের নওশেরাঁ এলাকাই ছিল শিখ নির্যাতনের মূল উৎসস্থল।[11] শুরু হ’ল সোয়া পাঁচ বছর ব্যাপী জিহাদ ও শাহাদতের রক্ত রঞ্জিত জান্নাতী ইতিহাস।
দুর্ভাগ্য এই যে, অধিকাংশ স্থানেই স্থানীয় মুসলিম সর্দারদের বিশ্বাসঘাতকতা গাযীদের বেশী ক্ষতি করেছিল। তাদের মধ্যে ‘ইসলামিয়াত’-এর চাইতে ‘আফগানিয়াত’ এবং বংশীয় ও আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদ বেশী ক্রিয়াশীল ছিল। ফলে সৈয়দ আহমাদের জিহাদের তাৎপর্য বুঝতে তারা ব্যর্থ হয়েছিল। যুদ্ধগুলোর মধ্যে কেবল ১ম ও ২য় যুদ্ধটি সরাসরি শিখদের সাথে হয়। বাকী প্রায় সবগুলো যুদ্ধ বিশ্বাসঘাতক স্থানীয় মুসলিম সর্দারদের সাথে সরাসরি অথবা ইংরেজ-শিখ-মুসলিম মিলিত শক্তি কিংবা শিখ-মুসলিশ যৌথ বাহিনীর বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়। [ক্রমশ]
[লেখক : প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব প্রণীত ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন : উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ, দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষিতসহ’ শীর্ষক গ্রন্থ। পৃঃ ২৫৯-২৬৪]
[1]. জীবনীকার মিরযা হায়রাত দেহলভী, ‘হায়াতে তাইয়িবা’ (লাহোর : মাকতাবাতুস সালাম ১৯৫৮) পৃঃ ১৯০; অন্য জীবনীকার গোলাম রসূল মেহের এই সফরের ঘটনাকে ‘নিছক কাহিনী’ বলেছেন। -মেহের, প্রাগুক্ত পৃঃ ১৪৮; শাহ ইসমাঈলকে ‘কাফের’ আখ্যায়িত করা হয় ও তাঁকে হত্যা করার জন্য চারজন গুন্ডা নিযোগ করা হয়। দ্র. মিরযা, হায়াতে তাইয়িবা পৃঃ ১৪১,১৪৪।
[2]. মাসঊদ আলম নাদভী, ‘হিন্দুস্তান কি পহেলী ইসলামী তাহরীক’ (দিল্লীঃ মারকাযী মাকতাবা ইসলামী, ২য় সংস্করণ, নভেস্বর ১৯৮১) পৃঃ ২৬।
[3]. উস্তাদ শাহ আবদুল আযীয তাঁর প্রিয় ছাত্রদ্বয়কে এই লকবে ডাকতেন। -মেহের, ‘সাইয়িদ আহমাদ শহীদ’ পৃঃ ১১৮।
[4]. প্রাগুক্ত পৃঃ ১২৫।
[5]. প্রাগুক্ত পৃঃ ১৭৬।
[6]. ‘পহেলী তাহরীক’ পৃঃ ২৬; মেহের, প্রাগুক্ত পৃঃ ১৮৩, ২০৮, ২৩১।
[7]. প্রাগুক্ত পৃঃ ২৩৪-৩৮।
[8]. প্রাগুক্ত পৃঃ ২৬৪-৬৭।
[9]. প্রাগুক্ত পৃঃ ১২৬৮, ২৭০।
[10]. প্রাগুক্ত পৃঃ ৩৩২।
[11]. আবু ইয়াহ্ইয়া ইমাম খান নওশাহরাবী, ‘তারাজিমে ওলামায়ে হাদীছ হিন্দ’ (লায়ালপুর-পাকিস্তানঃ জামেয়া সালাফিইয়াহ, ২য় সংস্করণ, ১৩৯১/১৯৮১) পৃঃ ১০৫।