প্রচলিত দ্বীন

তাওহীদের ডাক ডেস্ক 443 বার পঠিত

আমি সিলেট শহরের একজন মুদ্রণ ব্যবসায়ী। শিক্ষা জীবনে সিলেট সরকারী আলিয়া মাদ্রাসা থেকে কামিল এবং এম সি কলেজ থেকে বি এ পাশ করি। অতঃপর সিলেট ল’ কলেজে দু’বছর অধ্যয়ন করলেও শেষ সনদটি অর্জিত হয়নি। শায়েখ আবু তাহের ও শায়েখ আবুল কালাম মুহাম্মদ আব্দুর রহমান রচিত প্রায় ১৪/১৫টি বই ছাপানোর সুবাদে তাঁদের মাধ্যমেই আহলেহাদীছ আন্দোলন এবং ‘আত-তাহরীক’-এর সাথে পরিচিত হই। অতঃপর জীবন চলার পথে বিভিন্ন শিরক-বিদ‘আত ও কুসংস্কার দেখতে পাই, যা আমাকে ব্যথিত করে। বাতিল না চিনলে হক্ব চেনা সম্ভব নয়। তাই এ বিষয়ে দু’কলম লিখলাম। আলিম সমাজ শিরক-বিদ‘আত ও কুসংস্কার সম্পর্কে আরো জ্ঞাত হবেন এবং তা নির্মূলের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন বলে আমি মনে করি।

প্রচলিত দ্বীন

১৯৬৮ সাল থেকে আজ অবধি জীবন যুদ্ধের প্রতি পরতে পরতে দ্বীন ইসলামকে বিকৃত ও অসহায় অবস্থায় দেখতে পেয়েছি। নিম্নে তার কিছু নমুনা তুলে ধরা হল-

(এক)

জন্মেছিলাম পীর-ফকীর প্রভাবিত সিলেট যেলায়। এলাকার শতকরা ৯৫% মুসলিমই একজন বিশিষ্ট পীরের মুরীদ। অবশ্য সে পীর ছাহেবের কিছু খলীফা বা প্রতিনিধি রয়েছেন বিভিন্ন এলাকা কেন্দ্রিক। শিশুকাল থেকে ফয়েয লাভের জন্য উক্ত পীর ছাহেবকে পালকী করে আমাদের এলাকায় মাঝে-মধ্যে নিয়ে আসতে দেখেছি। গাড়ীতে করে আনলে ফয়েয লাভ করা সম্ভব হবে না, তাই পীর ছাহেবের জন্য বিশেষভাবে তৈরী অনেক লম্বা ডান্ডাওয়ালা পালকী আছে। এ ডান্ডার সুবিধা হল, এখানে ভাড়াটিয়া কোন বেহারার প্রয়োজন হয় না। বরকতের জন্য পীর ছাহেবের মুরীদানরা উভয় সাইটে দশ+দশ=বিশ জনে হুড়োহুড়ি করে পালাক্রমে বহন করেন। একটু পর পর একজনকে অনেকটা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে অন্যজন ফয়েয সংগ্রহ করার জন্য ডান্ডায় হাত বা কাঁধ লাগান। মুরীদদের চাহিদা মোতাবেক পীর ছাহেব বিভিন্ন স্থানে যাত্রাবিরতি করেন। পীর ছাহেবের কাছ থেকে ফয়েয নেয়ার জন্য মুরীদানরা হুড়োহুড়ি করে কদমবুসি করেন। কদমবুছি করতে গিয়ে ধাক্কাধাক্কি করে অনেকেই আহত হন। বিশেষ করে কম বয়সের এবং বেশী বয়সের মানুষদেরই বেশী সমস্যা হয়ে থাকে। ধাক্কাধাক্কিতে পড়ে আহত হলেও কারো তেমন কোন অভিযোগ পরিলক্ষিত হয় না। পীর ছাহেবের কদমে একটু হাত লাগাতে পেরে অনেকেই তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেন। তবে যারা পীর ছাহেবের কদমে হাত দিতে ব্যর্থ হয়েছেন তাদের আফসোসের কোন সীমা থাকে না। পরকালের জন্য কোন অসীলার ব্যবস্থা করতে ব্যর্থ হওয়ায় তারা অনেকটা শঙ্কিত হয়ে পড়েন। কেননা ক্বিয়ামতের ময়দানে পীর ছাহেবরা প্রত্যেকে তাদের মুরীদদের নিয়ে সদলবলে পুলছিরাতের পুল পার হবেন। যারা পীরের স্পর্শ লাভে ধন্য হতে পারেনি, তাদের কপালে রয়েছে নির্ঘাত খারাবি।

পীর ছাহেবের বেশ কয়েকজন মুরীদ ছাহেবের সুপারির খেদমতে নিয়োজিত। বাঁশ দিয়ে তৈরী বিশেষ শলাকা সিলেটি ভাষায় যাকে ‘কুটনী’ বলা হয়, তার ভিতরে পান সুপারি ঢুকিয়ে মিহি করে পীর ছাহেবকে পরিবেশন করা হয়। সুপারি কিছু সময় মুখে রেখে চিবিয়ে পীর ছাহেব তা মাটিতে ফেলে দেন। অতঃপর পীর ছাহেবের চিবানো কথিত বরকতপূর্ণ (?) এ সব সুপারি খাওয়ার জন্য হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। এখানে আহত হয়েও একটু সুপারি সংগ্রহ করাটাকে বেশ ভাগ্যের মনে করা হয়। আমার শিশু বয়সে আমি এগুলো দূরে দাঁড়িয়ে প্রত্যক্ষ করেছি। নিজের জীবনের জন্য বেশী মায়া থাকায় এমন ধাক্কাধাক্কি করে উক্ত শিরকী বরকত হাছিল করা আমার পক্ষে কখনও সম্ভব হয়নি।

(দুই)

আমাদের স্থানীয় অলংকারী গ্রামের পীর ছাহেব অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ সব বলে দিতে পারেন বলে এলাকায় জনশ্রুতি আছে। চোরে নিয়ে যাওয়া গরুটি বর্তমানে কোথায় আছে, বিদেশ যাত্রা মঙ্গল নাকি অমঙ্গল হবে, আগামী বন্যায় কী পরিমাণ পানি হতে পারে ইত্যাদি প্রশ্নগুলো জানার জন্য লোকজন তাঁর কাছে যাতায়াত করতেন। পীর ছাহেব দুর্ভোধ্য ভাষায় ভবিষ্যৎবাণী করতেন। তার বর্ণনাকৃত দুর্ভোধ্য শব্দগুলো নিয়ে গোলটেবিল বৈঠক করে সিদ্ধান্ত গৃহীত হত। বিয়ের ৬/৭ বছর পরও আমার ছোট চাচীর কোন সন্তান-সন্ততি জন্মগ্রহণ না করায় তিন চাচী আমাকে সাথে করে অলংকারীর পীর ছাহেবের কাছে নিয়ে যান। আমার তখন বয়স ছিল দশের কাছাকাছি। পীর ছাহেব আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিলেন, বড় হয়ে আমি একজন পীর হব। আর চাচীর ব্যাপারে বলেছিলেন যে, চাচীর কপালে সন্তান-সন্ততি নেই। এ কথা শুনে আমার চাচী কান্না শুরু করে দেন। হেঁটে আসার পথে আমার এ চাচী অঝোর নয়নে কাঁদছিলেন। উল্লেখ্য যে, তখন অলংকারী গ্রামে পরিবহনের কোন ব্যবস্থা ছিল না। বড় দু’চাচী আমার ছোট চাচীকে শান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলেন যে, সন্তান না হওয়ার বিষয়টি তারা চাচাকে আপাততঃ জানাবেন না। কেননা চাচা মাসখানেক পর তাঁর কর্মস্থল বৃটেনে ফিরে যাবেন। পরবর্তীতে চাচা দেশে আসার পর ঘটনাটা জানাবেন। তারপর তারা চাচার জন্য আরেকজন চাচী আনবেন।

পরবর্তীতে মাসে এয়ারটিকেট কনফার্ম করতে চাচা সাথে করে চাচীকেও শহরে নিয়ে যান। চাচীকে ডাক্তার দেখান। ডাক্তার পরীক্ষা করে জানান চাচী এখন গর্ভবতী। আমার এ চাচা আজ পরপারে এবং চাচীর রয়েছে প্রায় এক ডজন নাতী-পুতি। আমার এ চাচী আজ (০৭/০১/২০১৪) সিলেটস্থ রাগীব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। ডাক্তার বাইপাস সার্জারীর পরামর্শ দিয়েছেন। অবশ্য বড় দু’চাচী ইতিপূর্বে মারা গেছেন। সম্মানিত পাঠকবৃন্দের কাছে আমার এ চাচীর সুস্থতা ও অন্য দু’চাচীর মাগফেরাতের জন্য দু‘আ চাই।

(তিন)

আমার বয়স তখন ছিল এগার। স্থানীয় খালপার গ্রামের হরমুজ আলী নামক মধ্যবয়স্ক এক দিনমজুর। হঠাৎ তিনি নিঁখোজ হয়ে যান। চার দিন অপেক্ষার পর অলংকারীর পীর ছাহেবের কাছে গেলে তিনি ‘কাঁক-শকুন’ দেহ খাচ্ছে বলে হা হা করে কাঁদেন। হরমুজ আলীর মৃত্যুর বিষয়ে নিশ্চয়তা পেয়ে পরদিন ‘পাঁচা’র জন্য অর্থাৎ পাঁচ দিনের অনুষ্ঠানের জন্য গ্রামে বৈঠক বসে। আমাদের এলাকায় যথেষ্ট হিন্দু লোকজন রয়েছে। হিন্দু ও মুসলিম উভয় সমাজে কারো মৃত্যু হলে পাঁচা, দশা, চল্লিশার অনুষ্ঠানাদি খুবই গুরুত্বের সাথে পালন করা হয়। বিশেষ করে মুসলিম সমাজে কারো মৃত্যু হলে জানাযার ছালাত শেষ হওয়ার পর কবরস্থ করার পূর্বেই মাইয়্যেতকে সামনে রেখে সবাই হাত উপরের দিকে তুলে বিশেষ পদ্ধতিতে মুনাজাত করা হয়। অতঃপর মীলাদ-ক্বিয়াম ও ডাল-চালের খিচুড়ির আয়োজন করা হয়। তা না করলে কবরে সওয়াল-জাওয়াবে সমস্যা হয়ে থাকে। আর ‘পাঁচা’র অনুষ্ঠানাদি না করলে কবরের যিন্দেগীতে সমস্যা হয়ে থাকে। হরমুজ আলীর দশ বছরের ছেলের পক্ষে বাবার ‘পাঁচা’র অনুষ্ঠান করা সম্ভব নয়। প্রতিবেশীরা চাঁদা তুলে মীলাদ-ক্বিয়াম ও শিরনির ব্যবস্থা করেন। উল্লেখ্য, ‘দশা’র অনুষ্ঠানাদি হিন্দু সমাজ মাথা মুন্ডানো, উপবাস থাকা, ঝাড়ু হাতে নিয়ে চলাফেরাসহ বেশ গুরুত্বের সাথে পালন করে। এক মাস শেষ হওয়ার পূর্বেই ‘চল্লিশা’র অনুষ্ঠানাদির জন্য এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিরা সভায় বসেন। হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে চল্লিশা না হলে পরজীবনে সমস্যা হয়ে থাকে। তাই সবাই চাঁদা তুলে চল্লিশার আয়োজনে যখন ব্যস্ত, তখন অপ্রত্যাশিতভাবে হরমুজ আলী এসে হাযির। কাজের খোঁজে কয়েক মাইল দূরে গিয়ে তিনি এক মাসের চুক্তিতে ভাল বেতনে একটি কাজ পেয়ে যান। তাই তাঁর আসতে বিলম্ব হয়।

(চার)

আমার ছাত্রজীবনে দুপুরের নাস্তার নির্ধারিত একটি বাজেট ছিল। তবে এক সহপাঠী মাঝে-মধ্যে আমাকে উন্নতমানের নাস্তা করাত। একদিন সে আমাকে নিয়ে গেল আমার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনতিদূরে শাহজালালের মাযারে, সেখানে পুলিশ কর্মকর্তা তার মামা আসছেন। আমরা তাঁর জন্য মাযারের প্রধান গেইটে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলাম। মামা আমাদের ভাল রেস্টুরেন্টে নাস্তা করিয়ে নিয়ে গেলেন শাহজালালের সব চেয়ে বড় ডেক্সির নিকটে। আমাদের দু’জনের হাতে দু’টি পাঁচ শত টাকার নোট দিয়ে ডেক্সিতে ঢালতে বললেন। অতঃপর আমাদের দু’জনের হাতে একশত টাকার দুটো নোট ধরিয়ে দিয়ে বিদায় দেন। বন্ধুটি আমাকে জানালো যে, মামার ভাল কামাই হলে শাহজালালের ডেক্সিতে আয়ের একটি অংশ দান করেন। তিনি মাঝে-মধ্যে মোটা অংকের কামাই করেন, অর্থাৎ মোটা অংকের ঘুষ পান।  ঘুষের কিছু অংশ তিনি শাহজালালকে দিয়ে ঘুষের ভাগীদার বানিয়ে নেন, যাতে পরকালের শেষ বিচারের সময় শাহজালাল তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে যান।

উল্লেখ্য, অতি সম্প্রতি (২০১৩) ঢাকার উচ্চ পদস্ত একজন পুলিশ কর্মকর্তা স্বীয় কন্যা ‘ঐশী’ কর্তৃক খুন হন। মিডিয়ার কল্যাণে জানতে পেরেছি যে, তিনি স্বীয় কন্যার পকেট খরচ বাবদ মাসিক এক লক্ষ টাকা দিতেন; যদিও তাঁর সর্বমোট বেতন ছিল ত্রিশ হাযারেরও নীচে। তবে তিনি তাঁর আয়ের অংশবিশেষ শাহজালাল-এর মাযারে দিতেন কিনা বিষয়টি মিডিয়া থেকে জানতে পারিনি। কেননা মিডিয়া ঐ সব বিষয় নিয়ে মাথা ঘামায় না। জনশ্রুতি রয়েছে যে, শাহজালাল-এর বড় ডেক্সিটি শাহজালালের হাতের স্পর্শ লাভে ধন্য হয়েছে। তাই এ ডেক্সিতে দান করলে সরাসরি শাহজালালকে অংশীদার বানিয়ে দেয়া হয়। তাই অবৈধ আয় যারা করেন, তারা শাহজালালকে আয়ের অংশীদার বানিয়ে নিজেরা পাপমুক্ত হয়েছেন বলে আত্মতৃপ্তি অর্জন করেন। আর মাযারের খাদেমরা শাহজালালকে না দিয়ে গভীর রাতে ডেক্সি থেকে টাকাগুলো উঠিয়ে নিজেদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা করে নিয়ে যায় বলে সিলেট শহরের সচেতন অধিবাসীরা নিশ্চিত।

(পাঁচ)

আমার জন্মের সময় দাঈয়ের কাজ করেছেন আমার এক নিকটাত্মীয়া। তিনি ছালাতের ব্যাপারে অনেকটা শৈথিল্য প্রদর্শন করতেন। আমার ছাত্রজীবনে একদা তার কাছে ছালাতে গাফলতির কারণ জানতে চেয়েছিলাম। তিনি জানালেন, সিলেটের সর্বাধিক পরিচিত পীর ছাহেব একবার তাদের গ্রামে গিয়েছিলেন। গ্রামের লোকেরা পীর ছাহেবের পায়ে হাত দেয়ার জন্য হুড়োহুড়ি করছিল। এমতাবস্থায় পীর ছাহেব তার বাবাকে দেখে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। তার মতে, পীর ছাহেবের বুকে বুক লাগানো ব্যাটার বেটি তিনি। তার বাবার বুকটাতো অবশ্য জান্নাতে যাবে, কেননা পীর ছাহেবের বুক যার বুকে লেগেছে জান্নাত তার জন্য ওয়াজিব হয়ে গেছে। এখন তার প্রশ্ন হল, বাবা জান্নাতে যাওয়ার সময় কী প্রিয় কন্যাকে রেখে যাবেন? চাচীর ধারণা অবশ্য তাঁর বাবা তাকে সাথে নিয়ে জান্নাতে যাবেন। জান্নাতে যাওয়াটা যেহেতু তার নিশ্চিত, সেহেতু তিনি মাঝে মধ্যে ছালাত একটু শৈথিল্য প্রদর্শন করেন।

আমার এই চাচীর ইন্তেকালের পর জানাযার ছালাতের দায়িত্ব পড়েছিল আমার উপর। আমাকে মানুষ করার পেছনে রয়েছে তার যথেষ্ট অবদান। তার পীর ছাহেব তখনও জীবিত। জীবিত পীর ছাহেব কিভাবে এই চরম সঙ্কটময় মুহূর্তে ভক্তকে সহযোগিতা করবেন বিষয়টা আমার বুঝে আসছিল না। ভক্তের এমন অসহায় অবস্থার খবর পীর ছাহেবের কাছে কেউ পৌঁছায়নি। কেননা এ রকম অতি নগন্য ভক্তের জানাযায় তিনি আসার কথা নয়।

 (ছয়)

(ক) শিক্ষাজীবন সমাপ্ত হতে না হতেই হঠাৎ একটি ভিসা পেয়ে ১৯৯০ সনে মধ্যপ্রাচ্যের দোহা-কাতার চলে যাই। অল্প কিছুদিন সেলসম্যানের কাজ করার পর দোহার একমাত্র ‘পুলিশ ট্রেনিং ইন্সটিটিউট’-এর লোক নিয়োগের লিখিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে উত্তীর্ণ হই। পরীক্ষায় এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশের আট সহস্রাধিক প্রার্থীর মধ্যে ন’শত জন প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত হই। পরবর্তীতে চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত প্রায় আড়াই শত প্রার্থীর মধ্যে তেইশজন বাংলাদেশী নির্বাচিত হই। অতঃপর তিন মাস প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে একজন পুলিশ সদস্য হিসাবে কর্মজীবন শুরু করি। বাহিনীতে ‘ফরীদ’ নামে বাংলাদেশী দু’জন লোক ছিল। আমরা পরিচয়ের জন্য একজনকে ‘শেখ ফরীদ’ ও অন্যজনকে ‘মিসকীন ফরীদ’ নামে ডাকতাম। আর আব্দুল আযীয নামেও ছিল দু’জন। তাদেরকে পরিচয়ের জন্য একজনকে ‘আব্দুল আযীয গরম সুন্নী’ অন্যজনকে ‘আব্দুল আযীয সিলেটী’ বলে ডাকা হত। ‘গরম সুন্নী’ নামের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে অবশ্য আমার কোন ধারণা নেই। চট্টগ্রামের সহকর্মীরা তাকে এ নামে নামকরণ করেছিল।

বছর খানেক পর হঠাৎ শুনলাম যে আমাদের আব্দুল আযীয গরম সুন্নী বর্তমানে জেলে আছেন। পরে জানা গেল আমাদের এ সহকর্মীর ডিউটি পড়েছিল একটি ইন্ডাস্ট্রিয়াল এরিয়ায়। স্থানীয় মসজিদের বাংলাদেশী ইমাম ও আমাদের সহকর্মী পার্শ্ববর্তী কোম্পানীতে কর্মরত বাংলাদেশী লেবারদের নিয়ে মসজিদে আপত্তিকর কী কাজের অভিযোগে সবাইকে গ্রেফতার করা হয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম শবেবরাত উপলক্ষ্যে তারা সবাই মসজিদে দাঁড়িয়ে মীলাদ পড়ছিলেন, আর আয়োজন করেছিলেন গরম গরম জিলাপির। পুলিশ জিলাপিসহ তাদের সবাইকে গ্রেফতার করে আদালতে সোপর্দ করেছে।

লেবাররা আদালতে দাঁড়িয়ে অজ্ঞতার কথা জানিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করে। আদালত তাদেরকে তওবা পড়িয়ে ছেড়ে দেয়। অতঃপর ইমাম ছাহেব আদালতে দাঁড়িয়ে বলেন, আমি হলাম একজন কুরআনের হাফেয। আমি আলিম নই। আমাদের দেশে মসজিদে শবেবরাত উপলক্ষে ঐ সব কাজ করতে দেখেছি। না জেনে কাজটি করে আমি অনুতপ্ত। তাকেও তওবা পড়িয়ে ছেড়ে দেয়া হয়। অতঃপর আসে আব্দুল আযীয ভাইয়ের পালা। তাঁকে জেলে পাঠানো হয়। আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য তাঁকে সরবরাহ করা হয় বিভিন্ন তাফসীর ও হাদীছের কিতাবাদী। পরদিন আদালতে উঠে তিনি শবেবরাত উপলক্ষে দু’টি হাদীছ আদালতে উপস্থাপন করেন। আদালত হাদীছ দু’টিকে প্রথমতঃ মেনে নিলেও এ দিনে মসজিদে দাঁড়িয়ে মীলাদ পড়ার পক্ষে কুরআন অথবা হাদীছের প্রমাণ দেখাতে বলেন।

অতঃপর সময় নির্ধারণ করে তাকে আবার জেলে পাঠিয়ে দেয়া হয়। আবারও তাঁকে সরবরাহ করা হয় বিভিন্ন তাফসীর ও হাদীছের কিতাবাদী। তিনি নির্ধারিত তারিখে আদালতে দাঁড়িয়ে কিছু যুক্তি উপস্থাপন করেন। আদালত তাকে তওবা করার সুযোগ প্রদান করে। তিনি তওবা করতে অস্বীকৃতি জানালে তাকে আবারো জেলে পাঠানো হয়। কয়েকদিন পর তাকে দেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়।

(খ) সিকিউরিটি ডিপার্টমেন্টে দায়িত্ব পালন করলেও মাঝে মধ্যে অপরাধীর বক্তব্য বিচারককে বুঝিয়ে দিতে আদালতে আমাদের কারো কারো ডাক পড়ত। একদা আমার ডাক আসে। আলোচ্য অপরাধীর বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ কোন প্রমাণ নেই। তারপরও অনুমানের ভিত্তিকে সে অপরাধী। অপরাধীর বক্তব্য অনুবাদ করে শুনানোর পর আমি নিজ পক্ষ থেকে কুরআন কারীমের একটি আয়াত তেলাওয়াত করি। আদালতে উচ্চ স্বরে কথা বলা একটি অপরাধ। কিন্তু আমি উচ্চ স্বরে কুরআনের আয়াত পাঠ করার পর আদালত আমাকে তিরষ্কার না করে বরং অপরাধের বিষয়ে অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেন। তদন্তে সে নির্দোষ প্রমাণিত হলে আদালত তাকে মুক্তি দানের নির্দেশ প্রদান করেন।

আদালত সংশ্লিষ্ট ভারতীয় এক কর্মচারীর কাছ থেকে জানলাম যে, কোন অপরাধী তাঁর বক্তব্যের স্বপক্ষে যদি কোন হাদীছ উপস্থাপন করতে পারে, তবে তার মুক্তির একটি উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখা দেয়। আর যদি কুরআনের আয়াত শুনাতে পারে তবে মুক্তি প্রায় নিশ্চিত বলা যায়। এ আদালতে উকীল নিয়োগের কোন ব্যবস্থা নেই। আজ আপনি উকীলের মত কাজটাই করলেন।

উল্লেখ্য যে, এ দেশে কোন স্থানে কোন হাদীছ উল্লেখ করার পর হাদীছটি ছহীহ হলে তা মেনে নেয়া হয়। অথচ আমাদের দেশের কোথাও হাদীছ শুনানো হলে হাদীছটি স্বীয় ভাবধারার পুস্তকে আছে কি না এ জাতীয় বাহুল্য প্রশ্ন করা হয়ে থাকে।

(গ) পুলিশের সিকিউরিটি বিভাগে তিন শিফ্টে পালাক্রমে আমাদের চবিবশ ঘন্টা ডিউটি করতে হত। একদা আমার ফিলিপিনি এক সহকর্মীর ও আমার সাপ্তাহিক ছুটি হয়েছিল একই দিনে। এক সাথে বেড়াতে বের হওয়ার পর সে আমাকে নিয়ে গেল একটি ক্যাসেটের দোকানে।  সেখানে সে একাধিক ক্বারীর  তেলাওয়াত ও আধুনিক কিছু আরবী গানের ক্যাসেট কিনল। জানতে পারলাম দোহা শহরে তার স্ত্রীর পরিচালিত ‘হাল্লাকা লিস সাইয়েদাত’ বা মহিলাদের বিউটি পার্লারে দিনের বেলা বাঁজানো হয় বিভিন্ন প্রকার সাধারণ গানের ক্যাসেট। কেননা দিনে কাস্টমার আসে সাধারণতঃ আধুনিক মনের; তারা কোন অনুষ্ঠানে যাওয়ার উদ্দেশ্যে অথবা যুব সমাজকে নিজ রূপ যৌবন দেখাতেই পার্লারে আসে। আর রাতের বেলা ব্যবসা জমে ওঠে। তখন সামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া সাধারণতঃ আসে ধার্মিক মহিলারা; তারা স্বীয় স্বামীর কাছে নিজেকে তুলে ধরতেই পার্লারে আসে। তাই রাতের বেলা বাজানো হয় কুরআনের তেলাওয়াত এবং রূপচর্চার উপকরণে তখন হালালের প্রসঙ্গ প্রাধান্য পায়। অথচ আমাদের দেশের শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে সব স্তরের সকল ধার্মিক মহিলাই রূপচর্চাকে হারাম বলে জানেন।

(সাত)

১৯৯৪ সনে দেশে ফিরে মুদ্রণ ব্যবসার সাথে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ি। সাথে সাথে শিক্ষাজীবনের অসমাপ্ত পরীক্ষাগুলোতে একে একে অংশগ্রহণ করি। ব্যবসার প্রথম দিক থেকে শ্রীমঙ্গলের জনৈক মাওলানা মাস খানেক পর পর বই ছাপার কাজে আমার কাছে আসতেন। আমাকে প্রায় একাই তখন কম্পিউটার কম্পোজ, কারেকশন, ফরমেটসহ সবকিছুই করতে হত। সে সুবাদে মাওলানা ছাহেবের লেখনি ভাল করে পড়া হয়ে যেত। হিসাব অনুযায়ী দেখা গেল তিনি আমার ক্লাস মেট। সম্ভবতঃ ১৯৯৯ সনে তাঁর একটি বইয়ের কাজ করার সময় বললাম, আমি একজন সুন্নী মুসলিম হতে চাই। তিনি ফ্যাল ফ্যাল করে আমার মুখের দিকে তাঁকাচ্ছিলেন। আমি বললাম, রসে ভর্তি ফলকে বলা হয় আনারস, দানায় ভর্তি ফলকে বলা হয় বেদানা ঠিক সেভাবে সুন্নী হতে হলে হাদীছের খেলাফ কাজ করতে হবে বলে আপনাদের লেখনি থেকে জেনেছি। এখন আমি জানতে চাচ্ছি আমাকে একজন সুন্নী হতে হলে আর কী কী কাজ করতে হবে? তিনি আমার কথায় মনক্ষুণ্ণ হয়ে বললেন যে, সুন্নী বেশ কয়েকজন মিলে শ্রীমঙ্গলেই আমরা একটি প্রিন্টিং প্রেস করার উদ্যোগ নিয়েছি। সম্ভবতঃ আগামি বইটি ছাপার জন্য আমাকে আপনার কাছে আর আসতে হবে না। সত্যিই তিনি আর কোন দিন আমার কাছে আসেননি। (আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)



বিষয়সমূহ: বিবিধ
আরও