ছূফীদের ভ্রান্ত আক্বীদা-বিশ্বাস (২য় কিস্তি)
মুখতারুল ইসলাম
মুহাম্মাদ আব্দুর রঊফ 1330 বার পঠিত
(৯) আশ্বত্থামাহত ইতি গজ : কোন কথা পরিষ্কার করে না বলে কিছু কথা গোপন করা অর্থে প্রবাদটির প্রচলন আছে। ‘আশ্বত্থামা হত ইতি গজ’ প্রবাদটির শাব্দিক অর্থ অশ্বত্থামা নামক হাতি মারা গেছে। মহাভারতে বর্ণিত ঘটনার আলোকে একশত কৌরব বংশীয় রাজপুত্র ও পাঁচ পান্ডব বংশীয় রাজপুত্রদের অস্ত্রগুরু এবং হস্তিনাপুর রাজ্যের রাজগুরু ছিলেন ঋষি ভরদ্বাজের পুত্র দ্রোনাচার্য। তিনি প্রবল পরাক্রমশালী যোদ্ধা ছিলেন। মহাভারত যুদ্ধে কৌরব বংশীয় রাজপুত্ররা অন্যায়ভাবে যুদ্ধ বাধিয়েছে জেনেও তিনি রাজগুরু হওয়ার কারণে রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতার দরুণ তাদের পক্ষালম্বন করেন। গুরু দ্রোনাচার্যের একমাত্র স্নেহের পুত্রের নাম ছিল অশ^ত্থামা। যুদ্ধের এক পর্যায়ে পান্ডবগণ তাদের গুরুর অস্ত্রের মুখে টিকতে না পেরে কৃষ্ণের পরামর্শে অশ্বত্থামার মৃত্যু হয়েছে এমন মিথ্যা সংবাদ ছড়ায়। এতে গুরু দ্রোণ পু্ত্র শোকে যুদ্ধ করা ছেড়ে দিলে পান্ডবদের সহযোগী পাঞ্চাল দেশের রাজা দ্রুপদের পুত্র তাকে হত্যা করে। গুরু দ্রোণ নিজ পুত্রের বাহুবলের উপর অত্যাধিক আত্মবিশ্বাসী ছিলেন। বিধায় মৃত্যু সংবাদ বিশ্বাস করেননি। তিনি পান্ডবদের বড় ভাই যুধিষ্ঠিরকে সত্যতা জিজ্ঞাসা করেন যে কিনা কখনো মিথ্যা বলে না। কিন্তু যুধিষ্টির কৌশল অবলম্বন করে অর্ধ সত্য বলে। তাদের মিত্র রাজা ইন্দ্রবর্মারও ‘অশ^ত্থামা’ নামে একটা হাতি ছিল। সেদিন যুদ্ধের মাঠে পান্ডবদের দ্বিতীয় ভাই ভীম যুধিষ্টিরকে যাতে মিথ্যা বলতে না হয় সেজন্য রাজা যুদ্ধরত ইন্দ্রবর্মার হাতিটিকে হত্যা করে। অতঃপর গুরু দ্রোণের প্রশ্নের জবাবে যুধিষ্ঠির উচ্চস্বরে বলে অশ্বত্থামা হত অর্থাৎ মারা গেছে; কিন্তু নিম্নস্বরে বলে ইতি গজ যার অর্থ দাঁড়ায় অশ^ত্থামা নামক হাতির মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু শেষের অংশ নিম্নণস্বরে বলায় গুরু দ্রোণের কানে সে কথা পৌছায়নি। তখন তিনি অস্ত্র ফেলে দিলে তাকে হত্যা করা হয়। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মুখে অস্পষ্টতা রেখে কথা বলা ব্যক্তির উপমা প্রয়োগের সময় উক্ত প্রবাদ ব্যবহার করা হয়।[1]
(১০) গজ কচ্ছপের লড়াই : এ প্রবাদ দ্বারা ‘প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতা’ বোঝানো হয়। হিন্দু পুরাণ মতে, বিভাবসু নামে এক রাগি ঋষি ছিল। তার ছোট ভাই সুপ্রতিক বাবার মৃত্যুর পর তাদের সম্পত্তি ভাগ করার জন্য ঋষিকে বারবার তাগিদ দিতে থাকে। কিন্তু ঋষি সম্পত্তি বিভাজনের বিরোধী ছিলেন। ঋষির নিষেধ সত্ত্বে্ও সুপ্রতীক সম্পত্তি ভাগের জন্য পীড়াপিড়ি করলে বিভাবসু তাকে হাতি হওয়ার অভিশাপ দেয়। অতঃপর সুপ্রতীকও ঋষি বিভাবসুকে কচ্ছপ হওয়ার অভিশাপ দেয়। এতে উভয়ে হাতি-কচ্ছপ রূপে পরিবর্তিত হয়ে যায়! কিন্ত তাদের ভ্রাতৃদ্বন্দ্ব সে রূপেও বহাল থাকে। সেজন্য প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী ব্যক্তির উদাহরণ দিতে এ কাহিনী বাংলা সাহিত্যে ‘গজ কচ্ছপের লড়াই’ প্রবাদ নামে স্থান দখল করেছে।[2]
মহাভারতের ন্যায় রামায়ণও হিন্দুদের প্রধান মহাকাব্য এবং ধর্মগ্রন্থ হিসাবে সমধিক প্রসিদ্ধ। গ্রন্থটির রচায়িতা ঋষি বাল্মীকি যিনি প্রাথমিক জীবনে একজন দস্যু ছিলেন। চবিবশ হাজার শ্লোক সমৃদ্ধ ৭ কান্ডে বিষ্ণুর সপ্তম অবতার রামের জীবন কাহিনী এ গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে। রামায়ণের কাহিনীর আলোকে অনেক প্রবাদ বাংলা সাহিত্যের পরতে পরতে উপমা হিসাবে দেখা যায়। এ অংশে রামায়ণ গ্রন্থের কাহিনী নির্ভর প্রবাদগুলো বর্ণনা করা হল।
(১১) সাত কান্ড রামায়ণ পড়ে সীতা রামের মা : কোনো বিষয়ে বিস্তারিত জানার পরেও সে বিষয়ের প্রাথমিক জ্ঞান সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা ব্যক্তির উদাহরণ প্রয়োগ করা সম্বন্ধে উক্ত প্রবাদটি সমাজে প্রচলিত। অর্থাৎ অতি দূর্বল ধিশক্তি সম্পন্ন ব্যক্তি অর্থে ব্যবহৃত। রামায়ণে মূলত রাম ও তার স্ত্রীর কাহিনী সাত কান্ডে অনেক অলৌকিক ঘটনা বর্ণনার মাধ্যমে আলোচনা করা হয়েছে। এ বিশাল গ্রন্থ পড়ার পর কেউ যদি বলে সীতা রামের মা ছিলেন, তাহলে তাকে অবশ্যই প্রাথমিক জ্ঞানহীন বলা হবে। এমন দূর্বল মেধার অধিকারী ব্যক্তির উদাহরণ দিতে উক্ত প্রবাদ ব্যবহার করা হয়।
(১২) কাল রাম রাজা হবে আজ বনবাস : প্রবাদটির অর্থ অপ্রত্যাশিত দুর্ঘটনা অথবা আনন্দে অপ্রত্যাশিত নিরানন্দ।[3] রাম অযোধ্যার রাজা দশরথের পুত্র। দশরথের তিন স্ত্রীর চার পুত্রদের মধ্যে রাম সবার বড় ছিল। দশরথ রামকে রাজা ঘোষিত করে বৃদ্ধা অবস্থায় অবসর নিতে চেয়েছিলেন। সে জন্য মন্ত্রীসভায় রামের অভিষেকের ঘোষণা করা হয়। রাম রাজা হবে শুনে সমস্ত রাজ্য আনন্দ উল্লাসে মেতে উঠে। কিন্তু রামের সৎমা কৈকয়ী তার দাসী মন্থরার চক্রান্তে প্রভাবিত হয়ে নিজ পুত্র ভরতকে রাজ্যভার দিতে রাজা দশরথকে বাধ্য করে। দশরথও নিরুপায় ছিলেন। কারণ তিনি কৈকয়ীকে কথা দিয়েছিলেন যে, কোন একদিন কৈকয়ী তার কাছে কিছু চাইলে তিনি তাকে ফিরিয়ে দিবেন না। কৈকয়ী এই শপথের সুযোগ নিয়ে ভরতের জন্য রাজ্য এবং রামকে ১৪ বছর বনবাসে রাখার দাবী করে। এতে বাধ্য হয়ে দশরথ ভরতকে রাজা ঘোষণা করে রামকে বনবাসে পাঠায়। এহেন মুহূর্তে সমস্ত রাজ্যে শোকের ছায়া পড়ে। এ কারণে আনন্দঘন পরিবেশে হঠাৎ বিষাদের অবতারণা বোঝানোর জন্য উক্ত প্রবাদটির উপমা দেওয়া হয়।[4]
(১৩) ভূতের মুখে রাম নাম : বহুল প্রচলিত প্রবাদটির উৎস সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায় না। তবে হিন্দুদের প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী রাম নাম জপলে ভূত তার শরীরে যন্ত্রণা অনুভব করে বিধায় পালিয়ে যায়। রাম কাহিনীতে ভূত, প্রেত, পিশাচ, রাক্ষস, অসুর ইত্যাদি ভয়ংকর কিছু কাল্পনিক চরিত্রের বর্ণনা রয়েছে। যদিও হিন্দুদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী এসব নাম দ্বারা ভয়ংকর কিছু বোঝায় না। কিন্তু এদের অলৌকিক ক্ষমতার বর্ণনা পড়লে ভয়ংকর প্রাণীর প্রতিই ইঙ্গিত করে। বলা হয়ে থাকে, একবার ভূতের উৎপাত হলে রাম ভূত রাজাকে পরাজিত করে। তখন ভূত ভীত হয়ে রামকে প্রতিশ্রুতি দেয় যে, ভূতকে দেখলে যে রাম নাম জপবে ভূত তার কাছ থেকে পালাবে। বর্তমান আধুনিক সমাজে এখনো হিন্দুরা বিশ্বাস করে ভূত রাম নাম শুনলে পালায়। সে কারণে একটি ছড়া প্রচলিত আছে-
ভূত আমার পুত, পেত্নী আমার ঝি
রাম-লক্ষ্মণ বুকে আছে করবি আমার কি!
এক্ষণে স্বয়ং ভূত যদি রামের নাম জপে তাহলে সেটা বড়ই আশ্চর্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। সেজন্য কেউ যখন নিজের স্বভাব বিরুদ্ধ কাজ করে তখন তাকে ব্যাঙ্গ করে বলা হয় ‘ভূতের মুখে রাম নাম’।
(১৪) অজগরের দাতা রাম : অজগর প্রাণী হিসাবে খাদ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে খুবই অলস। তার শারিরিক গঠন ও দৈর্ঘ্য বৃহদাকার হওয়ার কারণে অন্যান্য সাপের মত দ্রুত চলাচল করতে পারে না। কিন্তু সে অভুক্ত থাকে না। হিন্দুদের বিশ্বাস অনুযায়ী অজগরকে রাম তথা ঈশ্বর খাদ্য সরবরাহ করেন। সেজন্য দীন দুঃখীর রক্ষাকর্তা ঈশ্বর অর্থে উক্ত প্রবাদটি ব্যবহার করা হয়।[5] প্রবাদটির কারণে রামকে রিজিকদাতা হিসাবে বিশ্বাস করা হচ্ছে। যা সম্পূর্ণ ইসলামী আক্বীদা পরিপন্থী।
(১৫) রাবণের বংশ : ঋষি বিশ্রবা ও অসুর রাজা সুমালীর কন্যা কৈকসীর তিন পুত্র যথাক্রমে রাবণ, কুম্ভকর্ণ ও বিভীষণ। রাবণ অসুর রাজা ময়াসুরের কন্যা মন্দোদরীকে বিবাহ করেছিল। রামায়ণে শুধু মন্দোদরীর উল্লেখ থাকলেও তার ধন্যমালিনী নামে অন্য একজন স্ত্রীও ছিল। রাবণের ঠিক কতজন সন্তান ছিল সে ব্যাপারে যথেষ্ট মতানৈক্য রয়েছে। কারো কারো মতে, তার লক্ষাধিক সন্তান এবং তার ও অধিক নাতী ছিল। রামায়ণে মন্দোদরীর গর্ভজাত সন্তান মেঘনাদ ও অক্ষয়কুমারের নাম পাওয়া যায়। অপরদিকে ধন্যমালিনীর সন্তান নরান্তক, দেবান্তক, অতিকায় ও ত্রিশিয়ার কথাও রামায়ণে বর্ণিত হয়েছে।[6] যেহেতু রাবণের বংশ বড় ছিল সেজন্য বর্তমানে কারো বৃহৎ পরিবার কিংবা বংশ থাকলে সে বংশকে ব্যাঙ্গ করে ‘রাবণের বংশ’ বলা হয়।
(১৬) ঘরের শত্রু বিভীষণ : আপন জনের শত্রুতা কিংবা বিশ্বাসঘাতকতা বোঝানো এ প্রবাদের উদ্দেশ্য। রাবণের দুই ছোট ভাই ছাড়াও শূপর্ণখা নামে এক বোন ছিল। রামায়ণের বর্ণনা মতে, শূপর্ণখা রামের বনবাসকালীন সময়ে সুন্দরী রমনীর রূপ ধারণ করে রাম ও তার ভাই লক্ষ্মণকে প্রলুদ্ধ করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। লক্ষ্মণ শূপর্ণখার নাক কান কেটে দেয়। এতে রাবণ প্রতিশোধ নিতে রামের স্ত্রী সীতাকে অপহরণ করে। রাম সীতার উদ্ধারের জন্য রাবণ রাজ্য লঙ্কায় আক্রমণ করলে রাবণের ছোটভাই বিভীষণ সীতাকে মুক্ত করে রামের কাছে ক্ষমা চাইতে বলে। কিন্তু রাবণ অহংকারে স্ফীত হয়ে সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে এবং বিভীষণকে অপমান করে। বিভীষণ রাবণের সংকটকালীন সময়ে তাকে ত্যাগ করে রামের দলে যোগ দেয় এবং রাবণের সমস্ত গোপন তথ্য ফাঁস করে দেয়। এ ঘটনার জন্য বিভীষণকে ঘরের শক্র বলা হয় এবং উক্ত বাক্যটি বাংলা সাহিত্যে প্রবাদরূপে স্থান পায়।[7]
(১৭) লঙ্কাকান্ড : লঙ্কা রাবণের সৎ ভাই কুবেরের রাজ্য ছিল। রাক্ষস রাবণ কুবেরকে রাজ্যচূত করে লঙ্কা দখল করে। ধারণা করা হয় বর্তমান শ্রীলঙ্কা পূর্বে লঙ্কা রাজ্য ছিল। কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে সেটা প্রমাণিত নয়। অযোধ্যার রাজা রাম বনবাসে থাকাকালীন সময়ে রাবণ তার স্ত্রী সীতাকে হরণ করে লঙ্কায় অশোক বনে নজরবন্দি করে রাখে। রামের একনিষ্ঠ ভক্ত ও অসীম অলৌকিক শক্তিধারী হনুমান লঙ্কায় গুপ্তচর হিসাবে প্রবেশ করে রাবণের হাতে ধরা পড়ে। রাবণ হনুমানের লেজে আগুন লাগিয়ে দেয় কিন্তু তাতে হনুমানের কোন ক্ষতি হয়না বরং সে তার লেজের আগুনে সমস্ত লঙ্কা জ্বালিয়ে দেয়। পরবর্তীতে রাম রাবণের সম্মুখ যুদ্ধে লঙ্কা তছনছ হয়ে যায়। মূলত হনুমানের লঙ্কা পোড়ানো এবং যুদ্ধোত্তর ধ্বংসাত্মক পরিণতিকেই লঙ্কাকান্ড বলা হয়। আজকের সমাজে তুমূল যুদ্ধ বা গোলযোগ কিংবা ভয়নক অগ্নিকান্ডের পরিণতি বোঝাতে লঙ্কাকান্ড উপমার প্রয়োগ করা হয়।[8]
(১৮) অতি দর্পে হত লঙ্কা : লঙ্কার অধিপতি রাক্ষস রাজা রাবণ শক্তি অর্জন করে পৃথিবীর রাজা, অন্তরীক্ষে দেবতা সকলকে পরাজিত করে একচ্ছত্র অধিকার কায়েম করে। তার ধারণা ছিল তার চেয়ে অধিক বলবান আর কেউ নেই এবং কেউ তার রাজ্য আক্রমণ করার ক্ষমতা রাখে না। সে কারণে রাবণ বড়ই অহংকারী ছিল। রাম লঙ্কা আক্রমণ করলে সে তাকে তুচ্ছ মনে করে। অতি অল্প সময়ে রামকে পরাজিত করবে এমন আত্মবিশ্বাসে বিভোর ছিল। কিন্তু রামের হাতেই রাবণ ও লঙ্কার পতন ঘটে। অহংকার যে পতনের মূল, ‘অতির্দপে হত লঙ্কা’ প্রবাদ দ্বারা সে কথাই প্রকাশ করা হয়।
(১৯) একা রামের রক্ষা নাই সুগ্রীব দোসর : হিন্দুদের নিকট রাম স্বয়ং দেবতার অংশ। রামায়ণের বর্ণনা মতে, সে যেমন নৈতিক ও চারিত্রিক দিক থেকে সর্বশ্রেষ্ঠ, তেমন বলবান ও অস্ত্র বিদ্যায় সমান দক্ষ। রাবণের সাথে যুদ্ধ করার জন্য সে একাই যথেষ্ট। কিন্ত তারপরেও রাম বানরদের সহায়তা নিয়ে রাবণের সাথে যুদ্ধ করে। কিষ্কিন্ধার বানর রাজা সুগ্রীব রামকে তার বানর সেনা দিয়ে সাহায্য করে। যেখানে রাম একাই রাবণের জন্য যথেষ্ট সেখানে সুগ্রীবের সহায়তা তো রাবণের জন্য ‘গোদের উপর বিষফোঁড়া’র ন্যায়। অর্থাৎ কষ্টের উপর কষ্ট, একের বিক্রমই যথেষ্ট অন্যকে কি প্রয়োজন কিংবা একের বিক্রমেই প্রাণ ওষ্ঠাগত, দুইয়ের বিক্রমে মরার উপক্রম ইত্যাদি বোঝানো এই প্রবাদটির উদ্দেশ্য।
(২০) কুম্ভকর্ণের ঘুম : অস্বাভাবিক ঘুমকাতুরে ব্যক্তিকে নির্দেশ করতে ‘কুম্ভকর্ণের ঘুম’ প্রবাদটির উৎপত্তি ঘটেছে। রাবণের ভাই বিরাটাকার দেহ বিশিষ্ট্য কুম্ভকর্ণ জন্ম গ্রহণ করেই সহস্র মানুষ খেয়ে ফেলে। এতে দেবতাদের রাজা ইন্দ্র তাকে বজ্র নামক অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে। তখন ব্রহ্মা (তিন প্রধান দেবতার একজন) তাকে মৃতপ্রায় শুয়ে থাকার অভিশাপ দেয়। এই অভিশাপ শুনে রাবণ আপত্তি করে।
তখন ব্রহ্মা অভিশাপ পরিবর্তন করে ছয় মাস ঘুম এবং একদিন জেগে উঠে মানুষ ভক্ষণ করার অভিশাপ দেয়। রামায়ণে বর্ণিত যুদ্ধে রামের বিপরীতে যুদ্ধ করার জন্য ছয় মাসের পূর্বেই বিভিন্ন উপায় অবম্বন করে অনেক কষ্টে কুম্ভকর্ণের ঘুম ভাঙ্গানো হয়। এ কারণেই অলস ঘুমন্ত ব্যক্তিকে কুম্ভকর্ণের ঘুমের সাথে তুলনা করা হয়।[9]
(২১) কালনেমীর লঙ্কা ভাগ : কালনেমী রাক্ষস রাবণের মামা। রামের সাথে রাবণের যুদ্ধের এক পর্যায়ে রাবণ লক্ষ্মণকে কঠিন আঘাত হানে। এতে লক্ষণ মৃত প্রায় অচেতন হয়ে যায়। লক্ষণের শুশ্রুষার জন্য হনুমানকে গন্ধমাদন পর্বতে ঔষধি আনতে পাঠানো হয়। এ খবর রাবণের কাছে পৌছালে রাবণ কালনেমীকে অর্ধেক লঙ্কার রাজ্যত্ব দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে হনুমানকে হত্যা করতে পাঠায়। কিন্তু কালনেমী অর্ধ রাজত্ব পাওয়ার লোভে কল্পনায় বিভোর হয়ে হনুমানকে হত্যা করতে ব্যার্থ হয় বরং হনুমানের হাতেই তার মৃত্যু হয়। সে কারণে উক্ত ঘটনার আলোকে কাজ শেষ করার পূর্বেই ফলাফল প্রাপ্তির অতিরিক্ত আশা করার পরিণাম বুঝাতে প্রবাদটি বাংলা সাহিত্যে স্থান লাভ করে।[10]
(ক্রমশঃ)
মুহাম্মাদ আব্দুর রঊফ
সভাপতি, বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ, রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়
[1]. মহাভারত, অনুবাদ : রাজশেখর বসু; ১৩তম মুদ্রণ : বাংলা ১৪১৮, পৃ. ৪৫৪-৪৫৬।
[2]. মহাভারত, অনুবাদ : রাজশেখর বসু, আদি পর্ব, পৃ. ১৬-১৭।
[3]. সরল বাংলা অভিধান, শুবলচন্দ্র মিত্র, অষ্টম সংস্করণ, পৃ. ১৫৩৬।
[4]. রামায়ণ, রাজশেখোর বসু, ১৩তম মুদ্রণ : বাংলা ১৪১৮, পৃ. ৬৮-৯৯।
[5]. প্রবাদ সংগ্রহ, শ্রীকানাইলাল ঘোষাল, ১৪ যুগল কিশোর দাস লেন, কলকাতা-১৮৯০ খ্রীঃ , পৃ. ৫
[6]. রামায়ণ, পৃ. ৩৪৯
[7]. রামায়ণ, পৃ. ১৬২, ৩১১।
[8]. প্রাগুক্ত, পৃ, ২৯১-২৯৪।
[9]. প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৪৩-৩৪৮।
[10]. নূতন বাঙ্গালা অভিধান, আশুতোষ দেব, প্রবাদ-সংগ্রহ, পৃ. ১৫-৪৭।