ছালাত মুমিনের চিরন্তন বৈশিষ্ট্য (শেষ কিস্তি)
যহীরুল ইসলাম
আব্দুল হালীম বিন ইলিয়াস 973 বার পঠিত
৬. আল্লাহর রাস্তায় নাক-কান কর্তিত যুবক আব্দুল্লাহ বিন জাহশ (রাঃ) :
আল্লাহর রাস্তায় শহীদ হয়ে পরকালে উচ্চ মর্যাদা লাভের আশায় ওহোদ যুদ্ধে নামার আগের দিন হামযার ভাগিনা ও রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ফুফাতো ভাই যুবক আব্দুল্লাহ বিন জাহশ (রাঃ) দো‘আ করেছিলেন যে, হে আল্লাহ! আমাকে কালকে এমন একজন বীর যোদ্ধার মুখোমুখি কর, যে আমাকে প্রচন্ড লড়াই শেষে হত্যা করবে এবং আমার নাক ও কান কেটে দেবে। তারপর আমি তোমার সামনে হাযির হলে তুমি বলবে, হে আব্দুল্লাহ! তোমার নাক ও কান কাটা কেন? আমি বলব, হে আল্লাহ! তোমার জন্য ও তোমার রাসূলের জন্য (فيك وفي رسولك)। তখন তুমি বলবে, صدقت ‘তুমি সত্য বলেছ’। এ দো‘আর সত্যায়ন করে সা‘দ বিন আবী ওয়াক্কাছ (রাঃ) বলেন, আমার চেয়ে তার দো‘আ উত্তম ছিল এবং সেভাবেই তিনি শাহাদত লাভে ধন্য হয়েছেন। এ জন্য তাকে المجدع في الله ‘আল্লাহর রাস্তায় নাক-কান কর্তিত’ নামে অভিহিত করা হয়। আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) নিজে হামযাহ ও আব্দুল্লাহ বিন জাহশ (রাঃ) দু’জনকে একই কবরে দাফন করেন।[1]
শিক্ষণীয় বিষয় :
(ক) শহীদী মর্যাদা লাভের আকাঙক্ষা থাকা প্রত্যেক মুমিন মুসলিম যুবকের একান্ত কর্তব্য। অন্যথায় মুনাফিক্বী হালাতে মৃত্যুবরণ করতে হবে।
(খ) দুনিয়াবী জীবন মুসলিমদের নিকট তুচ্ছ। পরকালের উচ্চ মর্যাদাই তাদের একমাত্র কাম্য।
(গ) পরকালীন উচ্চ মর্যাদা লাভের জন্য আল্লাহর নিকট সর্বদা দো‘আ করতে হবে।
৭. হক্ব ও বাতিলের পার্থক্যকারী ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) :
৬ষ্ঠ নববী বর্ষের শেষ দিকে যিলহজ্জ মাসের কোন একদিনে হামযা (রাঃ)-এর ইসলাম গ্রহণের মাত্র তিনদিন পরেই আরব জাহানের অন্যতম তেজস্বী পুরুষ ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) আকস্মিকভাবে মুসলিম হয়ে যান। তিনি ছিলেন চল্লিশতম মুসলিম। এটা ছিল রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর বিশেষ দো‘আর বরকত। হাদীছে এসেছে, ইবনু আবক্ষাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) দো‘আ করেছিলেন,اللَّهُمَّ أَعِزَّ الإِسْلاَمَ بِأَبِى جَهْلِ بْنِ هِشَامٍ أَوْ بِعُمَرَ. ‘হে আল্লাহ! আবু জাহল ইবনু হিশাম অথবা ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব দ্বারা তুমি ইসলামকে শক্তিশালী কর’। এই দো‘আর পরদিন ওমর ভোরে নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকট এসে ইসলাম গ্রহণ করলেন এবং কা‘বা গৃহে গিয়ে প্রকাশ্যে ছালাত আদায় করলেন।[2] অতঃপর ওমরের ইসলাম গ্রহণের মাধ্যমে প্রমাণিত হল যে, তিনিই আল্লাহর নিকটে অধিকতর প্রিয়। ছাফা পাহাড়ের পাদদেশের গৃহে যখন ওমর ইসলাম কবুল করলেন, তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও গৃহবাসীগণ এমন জোরে তাকবীর ধক্ষনি করলেন যে, মসজিদুল হারাম পর্যন্ত তা পৌঁছে গিয়েছিল।[3]
ইসলাম কবুলের পরপরই ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) ইসলামের সবচেয়ে বড় দুশমন আবু জাহলের গৃহে গমন করলেন এবং তার দরজায় করাঘাত করলেন। তখন আবু জাহল বের হয়ে এসে বলল, أهلا و سهلا ما جاء بك؟ ‘স্বাগতম, তোমার আসার কারণ কী? ওমর (রাঃ) কোন ভূমিকা না দিয়ে তার মুখের উপর বলে দিলেন যে, ‘আমি তোমার কাছে এসেছি এ খবর দেওয়ার জন্য যে, আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর উপর ঈমান এনেছি এবং তিনি যে শরী‘আত এনেছেন তা সত্য বলে জেনেছি’। একথা শুনে আবু জাহল সরোষে তাকে গালি দিয়ে বলে উঠল, ‘আল্লাহ তোমার মন্দ করুন এবং তুমি যে খবর নিয়ে এসেছ তার মন্দ করুন’। অতঃপর সে দরজা বন্ধ করে ভিতরে চলে গেল। এ সংবাদ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লে লোক জমা হয়ে সকলেই ওমরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল এবং গণপিটুনী শুরু করল। এই মারপিট চলল প্রায় দুপুর পর্যন্ত। এ সময় কাফিরদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘যদি আমরা সংখ্যায় তিনশ’ পুরুষ হতাম, তবে দেখাতাম এরপর মক্কায় তোমরা থাকতে না আমরা থাকতাম’। এই ঘটনার পর নেতারা হত্যা করার উদ্দেশ্যে ওমরের বাড়ী আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নিল। তিনি ঘরের মধ্যেই ছিলেন। কিন্তু ‘আছ ইবনু ওয়ায়েল সাহমীর প্রচেষ্টায় লোকজন সেখান থেকে ফিরে গেলে ওমর (রাঃ) রাসূলের খিদমতে হাযির হয়ে বললেন,
يا رسول الله ألسنا على الحق إن متنا وإن حيينا قال بلى والذي نفسي بيده إنكم على الحق وإن متم وإن حييتم قال قلت ففيم الاختفاء والذي بعثك بالحق لنخرجن.
‘হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমরা কি হক্বের উপরে নই? তিনি বললেন, হ্যাঁ। যাঁর হাতে আমার জীবন, তাঁর কসম করে বলছি, নিশ্চয় তোমরা সত্যের উপর আছ, যদি তোমরা মৃত্যুবরণ কর কিংবা জীবিত থাক। ওমর (রাঃ) বললেন, তাহলে লুকিয়ে থাকার প্রয়োজন কী! যিনি আপনাকে সত্য সহকারে প্রেরণ করেছেন তাঁর কসম করে বলছি, অবশ্যই আমরা প্রকাশ্যে বের হব’। অতঃপর রাসূলকে মাঝখানে রেখে দুই সারির মাথায় ওমর ও হামযার নেতৃত্বে মুসলিমগণ প্রকাশ্যে মিছিল সহকারে মসজিদুল হারামে উপস্থিত হলেন। এ সময় দূরে দন্ডায়মান কুরায়েশ নেতৃবৃন্দ ও জনতাকে লক্ষ্য করে ওমর (রাঃ) নিমেণাক্ত কবিতা পাঠ করেছিলেন,
مالي ارا كم كلكم قياما * الكهل و الشبان والغلاما
قد بعث الله الينا رسولنا * محمدا قد شرع الاسلام
‘এই দিন আমাকে ও হামযাকে মুসলমানদের মিছিলের পুরোভাগে দেখে কুরায়েশ নেতারা যতবেশী আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছিল, এমন আঘাত তারা কখনোই পায়নি’।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এদিনই ওমর (রাঃ)-কে ফারূক (الفاروق) বা ‘হক ও বাতিলের পার্থক্যকারী’ উপাধিতে ভূষিত করেন। আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন, ما كنا نقدر ان نصلي عند الكعبة حتي اسلم عمر وقال ما زلنا اعزة منذ اسلم عمر ‘ওমরের ইসলাম গ্রহণের আগ পর্যন্ত আমরা কা‘বা গৃহের নিকট ছালাত আদায় করতে সক্ষম হইনি’। তিনি আরো বলেন, ‘ওমরের ইসলাম গ্রহণের পর থেকে আমরা সর্বদা শক্তিশালী ও সম্মানিত ছিলাম’। ছুহায়েব বিন সিনান আর-রূমী (রাঃ) বলেন, ‘ওমর (রাঃ) ইসলাম গ্রহণের পর ইসলাম তার গোপন প্রকোষ্ঠ থেকে বাইরের জগতে প্রকাশ্য রূপ লাভ করে। মানুষকে ইসলামের দিকে প্রকাশ্যে আহক্ষান জানানো সম্ভব হয়। আমরা গোলাকার হয়ে কা‘বা গৃহের পাশে বসতে পারতাম এবং ত্বাওয়াফ করতে পারতাম। যারা আমাদের উপর কঠোরতা দেখায় তাদের প্রতিশোধ নিতাম এবং তাদের কোন কোন অন্যায়ের প্রতিবাদ করতাম’।[4]
ওমর (রাঃ) ছিলেন সুন্নাতের পূর্ণ অনুসারী, মুমিনদের প্রতি অতীব দয়ালু। পক্ষান্তরে কাফের, বেদ্বীন ও অনৈসলামিক রীতি-নীতির বিরুদ্ধে অত্যন্ত কঠোর। শয়তান তাঁকে দেখলে ভিন্ন পথে চলে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাঁকে উদ্দেশ্য করে বলেন, وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ مَا لَقِيَكَ الشَّيْطَانُ قَطُّ سَالِكًا فَجًّا إِلاَّ سَلَكَ فَجًّا غَيْرَ فَجِّكَ ‘(হে ওমর!) যাঁর হাতে আমার জীবন, তাঁর কসম করে বলছি, শয়তান তোমাকে যে পথে চলতে দেখে, সে তোমার রাস্তা ছেড়ে অন্য রাস্তা ধরে’।[5]
ন্যায়পরায়ণ, সাহসী ও বিজ্ঞ রাজনীতিবিদ ইসলামের ইতিহাসের দ্বিতীয় খলীফা ওমর (রাঃ)-এর খেলাফত আমলে মুসলিম জাহানে দ্বীনের প্রচার ও প্রসারে তিনি যে বিরাট অবদান রেখেছেন তা ইতিহাসে চিরস্মরণীয়। তাঁর শাসনামলে মানুষ সর্বত্র সুখ-শান্তিতে জীবন যাপন করেছেন। ওমর (রাঃ) ছিলেন খুবই দূরদর্শী এবং প্রজাহিতৈষী। জনসাধারণের অবস্থা জানার জন্য তিনি রাত্রিতে ঘুরে বেড়াতেন। তিনি এক রাতে একটি ছোট কুটিরের সামনে এলে বাড়ীর ভিতরের কথাবার্তা শুনতে পেলেন। মা মেয়েকে আদেশ করছেন, দুধের সাথে পানি মিশাও। ভোর হয়ে এল। মেয়েটি উত্তর দিল, ‘না মা, ওমর (রাঃ) দুধে পানি মেশাতে নিষেধ করেছেন। তিনি জানতে পারলে শান্তি দিবেন’। মা বললেন, ‘ওমর দেখতে পেলে তো’? মেয়ে বলল, ‘আমি প্রকাশ্যে তাঁর আনুগত্য করব আর গোপনে তাঁর অবাধ্যতা করব? আল্লাহর কসম! এটা আমার পক্ষে মোটেই সম্ভব নয়। অন্য বর্ণনায় এসেছে, সে বলল, ‘ওমর (রাঃ) হয়ত আমাদেরকে দেখছেন না, কিন্তু তাঁর প্রভুতো আমাদেরকে দেখছেন’! গোপনে সব শুনে ওমর (রাঃ) বাড়ীটি চিহ্নিত করে ফিরে এলেন। পরে তাঁর ছেলে ‘আছেমের সাথে ঐ মেয়ের বিবাহ দিলেন। তার গর্ভে দু’টি কন্যা সন্তান জন্মলাভ করেছিল, যাদের একজনের গর্ভে ওমর বিন আব্দুল আযীয (রহঃ)-এর জন্ম হয়েছিল।[6]
সারাজীবন হক্বের পথে অটল থেকে ওমর (রাঃ) ২৩ হিজরীর ২৭ যিলহজ্জ মাসে মসজিদে নববীতে জামা‘আতে ফজর ছালাতরত অবস্থায় কুখ্যাত খারেজী আবু লুলু কর্তৃক ছুরি দ্বারা আঘাত প্রাপ্ত হন। তার তিনদিন পর তিনি শাহাদত বরণ করেন।
শিক্ষণীয় বিষয় :
(ক) জাহেলী যুগে যুবকদের ইসলাম গ্রহণ ও তাকবীর ধক্ষনির মাধ্যমেই আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ ঘর কা‘বাতে প্রকাশ্যে ছালাত আদায় শুরু হয়েছে। তাই আল্লাহর ঘরসমূহ ও যমীন আবাদ করার জন্য যুবকদেরকেই এগিয়ে আসতে হবে।
(খ) নিজের সুখ শান্তির কথা সর্বদা না ভেবে প্রজাদের প্রকৃত অবস্থা জানতে সর্বদা সচেষ্ট থাকতে হবে ইসলামী নেতাদের।
(গ) মানুষের অন্তরকে ইসলামের দিকে ফিরিয়ে দেয়ার জন্য সর্বদা আল্লাহর নিকট দো‘আ করতে হবে।
(ঘ) গোপনে ও প্রকাশ্যে তাক্বওয়াশীল আমীরের আনুগত্য করা।
(চলবে)
[লেখক : কেন্দ্রীয় পরিচালক, সোনামণি ও শিক্ষক, আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, নওদাপাড়া, রাজশাহী]
[1]. আর-রাহীকুল মাখতূম, পৃঃ ২৮১, আত-তাহরীক ১৪/১০ জুলাই ২০১১, পৃঃ ৫-৬।
[2]. আহমাদ, তিরমিযী, মিশকাত হা/৬০৪৫, ‘মানাক্বিব’ অধ্যায় ৩০ ‘ওমর (রাঃ)-এর মানাক্বিব’ অনুচ্ছেদ ৪।
[3]. আর রাহীকুল মাখতূম, পূর্বোক্ত, পৃঃ ১০৪, আত-তাহরীক ১৪/২ নভেম্বর ২০১০, পৃঃ ৪।
[4]. আর রাহীকুল মাখতূম, পৃঃ ১০৫; বুখারী হা/৩৮৬৩, আত-তাহরীক ১৪/২ নভেম্বর ২০১০ পৃঃ ৫।
[5]. মুত্তাফাক আলাইহ, মিশকাত হা/৬০৩৬।
[6]. তারীখু মাদীনাতি দিমাশক্ব ৭০/২৫৩।