চাই সহনশীলতার চর্চা
ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব 722 বার পঠিত
মানুষের ব্যক্তিগত অপারগতা ও
অজ্ঞতা; অপরদিকে সামাজিক অবিচার ও অনাচার- মূলতঃ এদু’টি মৌলিক কারণ একদিকে
যেমন তাকে জীবনযুদ্ধে অসহায় ও বিপন্ন করে তোলে, অন্যদিকে সমাজের বিরুদ্ধে
বিক্ষুব্ধ ও বিদ্রোহী করে তোলে। আর এখান থেকেই ধীরে ধীরে পুঞ্জিভূত হয়
হতাশা আর বেদনার এক অবিচ্ছেদ্য মেঘকাব্য। যা কখনও একাকীত্বের বেদনায় মুষড়ে
পড়ে গুমরে গুমরে কাঁদে আবার কখনওবা ক্ষোভের বিজলী বর্ষণে অবিরল ধারায় ঝরে
পড়ে। মানুষের এই জীবনগতি প্রায় সবারই একই রকম হলেও পার্থক্য ঘটে বোধের
জায়গায় এবং নীতির প্রতি অবিচলতায়। যারা ঈমানদার তারা ধৈর্য ও আত্মবিশ্বাসকে
নিত্য সাথী করে সাধ্যমত আদর্শের পথে নিজেকে পরিচালনা করেন, কিন্তু যারা
ঈমানহীন তারা প্রায়শই এই যুদ্ধের ময়দানে নিঃশর্ত আত্মসমার্পণ করে
স্বেচ্ছাচারী সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন। আর এভাবেই চলে আসছে শত-সহস্র বছরের
মানবীয় জীবনাচার।
বাংলাদেশ সহ বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বস্ত্তগত উন্নয়নের জোয়ার ক্রমবর্ধমান হলেও মানুষের ব্যক্তিগত জীবনাচারে হতাশার বিস্তার কিন্তু ধীরে ধীরে বাড়ছে। কারণ মিডিয়া ও মার্কেটিং-এর সীমাহীন হাইপে মানুষের ব্যক্তিগত প্রত্যাশার জায়গা যেই উত্তুঙ্গ হারে বাড়ছে, প্রাপ্তির জায়গা নিঃসন্দেহে সেই হারে বাড়ছে না। ফলে মানুষ দ্রুতই নিজেকে প্রতিযোগিতার ময়দানে পরাজিত এবং পশ্চাদপদ ভেবে হতোদ্যম হয়ে পড়ছে। হতাশার গ্রাস থেকে তারা সহজে নিজেকে বের করে আনতে পারছে না। ফলে অধিকাংশ সময় নেতিবাচক সিদ্ধান্তেই সে মুক্তি খুঁজে নিতে চাচ্ছে। কেউ ক্ষণিকের মিথ্যা সুখের জন্য বেছে নিচ্ছে অনৈতিক সিদ্ধান্ত কিংবা মাদকের মত নীল দংশন, কেউবা চুড়ান্ত পর্যায়ে বেছে নিচ্ছে আত্মহননের পথ।
এখন প্রশ্ন হ’ল, অধিকাংশ মানুষ কেন নেতিবাচক সিদ্ধান্তকেই অগ্রাধিকার দেয়? কেন শত প্রাপ্তির মাঝেও অপ্রাপ্তিগুলোকেই বড় করে দেখে? কেন এত হতাশায় মুহ্যমান হয়ে পড়ে নিজেকে নিঃশেষ করে দেয়ার পরিকল্পনা করে? এর উত্তর খুঁজতে গেলে আমরা কয়েকটি বিষয়কে সামনে আনতে পারি- (১) আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসের দুর্বলতা : যে ব্যক্তি তার সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তার আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস রাখে না, আস্থা রাখে না; সে কখনই জীবনে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে না, সঠিক পথে পরিচালিত হতে পারে না। কেননা সে তার জীবনের মূল ভরকেন্দ্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। (২) জীবনের মূল্য সম্পর্কে অজ্ঞতা : মানুষকে আল্লাহ খুব সংক্ষিপ্ত একটি সময় দিয়েছেন তাকে পরীক্ষা করার জন্য। একজন পরীক্ষার্থী যেমন তার পরীক্ষার মূল্য বুঝে বলে পরীক্ষার হলে ভালো ফলাফলের জন্য প্রাণান্ত পরিশ্রম করে, তেমনি এই জীবন পরীক্ষাগারের মূল্য সম্পর্কে জ্ঞাত ব্যক্তি প্রতিটি মুহূর্তকে গুরুত্বপূর্ণ ভেবে পরকালীন সাফল্যের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালায়। কিন্তু যে অজ্ঞ ব্যক্তি সে শিশু, পাগল কিংবা চতুষ্পদ জন্তুর মতই উদাসীন থেকে যায়। ফলে এই জীবনের প্রকৃত মূল্য সে অনুধাবন করতে পারে না। তাই এর বিনাশ সাধনেও সে দ্বিধাবোধ করে না। (৩) জীবনের লক্ষ্য সম্পর্কে অসচেতনতা : আল্লাহর দাসত্বকে যে জীবনের মূল লক্ষ্য বানাতে পারে নি, সে নিঃসন্দেহে লক্ষ্যহীন কিংবা ভুল লক্ষ্যপানে ছুটে চলা ব্যক্তি। সুতরাং জীবনের কোন অংক না মেলাতে পারলে খুব সহজেই সে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। (৪) ধৈর্যের অভাব : পাথিব জীবনে আমাদের উপর যে কোন পরীক্ষা নেমে আসবে। কখনও সে পরীক্ষা কঠিন থেকে কঠিনতর হবে, কিন্তু হাল ছেড়ে দেয়া মুমিনের বৈশিষ্ট্য নয়। সর্বাবস্থায় সে আল্লাহর উপর ভরসা রাখবে এবং ধৈর্য সহকারে সুসময়ের জন্য অপেক্ষা করবে, এটাই ঈমানের দাবী। যারা এই ধৈর্যের নীতি অবলম্বন করে না, তারা অতি সহজেই হতাশাগ্রস্ত হয়ে ভুল সিদ্ধান্তে উপনীত হয়। (৫) ব্যক্তিস্বাতর্ন্ত্যবাদ: আধুনিক সমাজে প্রত্যেক মানুষ পৃথক এন্টিটি হিসাবে বসবাস করতে চায়। যে যার মত চলাফেরা করবে, কেউ কারো ব্যাপারে নাক গলাবে না- এটাই মূলনীতি। ফলে একে অপরের প্রতি দায়িত্বশীল হওয়া এখানে যরূরী নয়। স্বার্থপরতা, অসামাজিকতা, আত্মকেন্দ্রিকতা এই সমাজব্যবস্থার আবশ্যিক অনুষঙ্গ। একে অপরের অতি কাছে থেকেও তারা একেকজন বসবাস করে অবরুদ্ধ জানালা নিয়ে। ফলে ফিতরাতবিরোধী এই সমাজ ব্যবস্থায় মানুষ সহজেই হতাশা ও বিষণ্ণতাগ্রস্ত হচ্ছে।
এ অবস্থা থেকে উদ্ধার পেতে চাইলে আমাদের জন্য করণীয় হ’ল-প্রথমতঃ ইতিবাচক জীবন যাপন করা : মনে রাখতে হবে, মানুষের জীবন ভালো-মন্দ, সহজ-কঠিন, ইতি আর নেতির বিচিত্র সমাহার। জীবনে কখনো ভালো সময় আসবে, কখনও মন্দ সময় আসবে এটাই জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ। অতএব একজন মুমিন ব্যক্তি সর্বদা মধ্যমপন্থায় তার জীবন পরিচালনা করবে। এমনভাবে যে, আনন্দের সময় সে আত্মহারা হবে না, আবার দুঃখের সময় শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়বে না। জীবনের সকল অবস্থায় শোকর ও ছবরের মাধ্যমে ভারসাম্য বজায় রাখবে। সবকিছুকে সাধ্যমত ইতিবাচকভাবে নেবে। যেমন ওহুদ যুদ্ধের পরাজয়ে যেন মুসলমানরা অধিক শোকাকুল না হয়, সেজন্য ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি লালনের জন্য আল্লাহ রাববুল আলামীনের স্বান্তনাসূচক বক্তব্য, তোমাদেরকে যদি আঘাত লেগে থাকে, অনুরূপ আঘাত (বদর যুদ্ধে) তো তাদেরও লেগেছে এবং মানুষের মধ্যে এ (বিপদের) দিনগুলিকে পর্যায়ক্রমে অদল-বদল করে থাকি (আলে ঈমরান ১৪০)। দ্বিতীয়তঃ হতাশাকে প্রশ্রয় না দেয়া : জীবনের সুখ-দুঃখের সাথে হতাশার যোগ খুবই ওতপ্রোত। যে কোন অপ্রত্যাশিত কথায় ও কাজে কিংবা অপ্রাপ্তির বেদনায় আমাদের মধ্যে হতাশা আসতেই পারে। কিন্তু একজন বিশ্বাসী মানুষ তা নিজের মধ্যে জিইয়ে রাখতে পারে না। তার চেষ্টা থাকে যে কোন মূল্যে তা দূরীভুত করা কিংবা ভুলে যাওয়া। কেননা আল্লাহর বাণী হ’ল- ‘আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হওয়া পথভ্রষ্ট লোকদের কাজ’ (হিজর ৫৬)। তৃতীয়তঃ মানুষের সাথে সুসম্পর্ক রাখা : মানুষের সাথে মিশতে পারা এবং তাদের সাথে সুসম্পর্ক রাখতে পারা হতাশা ও বিষণ্ণতা থেকে বেরিয়ে আসার অন্যতম কার্যকর মহৌষধ। এজন্য রাসূল (ছাঃ) আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখাকে অত্যন্ত গুরুত্বারোপ করেছেন। আত্মকেন্দ্রিক ও অসামাজিক মানুষ বরাবরই নিজের কষ্টের সময়গুলো মানুষের সাথে ভাগাভাগি করতে না পেরে নিদারুণ মানসিক কষ্টে আপতিত হয়। সুতরাং সমাজের ভালো মানুষদের সংস্পর্শে থাকা, সংঘবদ্ধ ও সাংগঠনিক জীবন যাপন করা সুস্থ মানুষের জন্য খুবই যরূরী এবং ইসলামের অন্যতম নির্দেশনা। চতুর্থতঃ শয়তানী কুমন্ত্রণার ব্যাপারে সতর্ক থাকা : শয়তান মানুষের চুড়ান্ত শত্রু। সে সর্বদা কুমন্ত্রণা যোগায় মানুষকে অন্যায় পথে নেয়ার জন্য। আল্লাহ বলেন, ‘শয়তান তোমাদের দারিদ্রের ভয় দেখায় এবং অশ্লীল কাজের নির্দেশ দেয়। আর আল্লাহ তোমাদেরকে তার পক্ষ থেকে ক্ষমা ও অনুগ্রহের প্রতিশ্রুতি দেন’ (বাক্বারাহ ২৬৮)। এজন্য সর্বদা শয়তানের ফেরেব থেকে সতর্কতা অবলম্বন করা আবশ্যক। পঞ্চমতঃ তাক্বদীর ও তাওয়াক্কুল অবলম্বন করা : আল্লাহর উপর ভরসা ও তাক্বদীরে বিশ্বাস যে কোন মানুষের জন্য অফুরন্ত আত্মবিশ্বাস ও সৃদৃঢ় মনোবলের খোরাক। কেননা সে জানে যে, সবকিছুর নিয়ন্তা আল্লাহ রাববুল আলামীন। বিশ্বাসী বান্দার একান্ত মঙ্গলের জন্যই তাঁর কর্মপরিকল্পনা। এই বিশ্বাস তাকে কখনও পথ হারাতে দেয় না। আশার প্রদীপ নেভাতে দেয় না। বরং বুক ভরে প্রশান্তির নিশ্বাসে সে সর্বাবস্থায় বলতে পারে- আলহামদুলিল্লাহ। সুতরাং আল্লাহর প্রতি এই দৃঢ় ঈমান ও ইস্তিকামাত যে কোন হতাশা থেকে মুক্তির অব্যর্থ মাধ্যম। আল্লাহ রাববুল আলামীন আমাদের সকলকে দুনিয়াবী পরীক্ষার মঞ্চে সদা-সর্বদা সত্য ও ন্যায়ের উপর অবিচল রাখুন এবং যাবতীয় হতাশা থেকে মুক্ত থেকে আল্লাহর উপর পূর্ণ ভরসা রেখে জীবন পরিচালনার তাওফীক দিন। আমীন!